স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ,(পর্ব-১৫)

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ,(পর্ব-১৫)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

তীব্র দাবদাহের পর হিমেল হাওয়া নিয়ে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে ভোর বেলায়। ধুয়েমুছে নিয়ে গেছে ভ্যাপসা গরম। রেখে গেছে শীতলতা। আকাশ ঘোলাটে, বাতাস বইছে মৃদু বেগে। সুন্দর পরিবেশ। চিলেকোঠার ছাদে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করার ফাঁকে অতীত স্মরণে ডুবেছে জাওয়াদ। পরনে অফিশিয়াল ফর্মাল ড্রেসাপ। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো টাই। অফিসের জন্য তৈরি হয়ে ছাদে এসেছে। দুই বন্ধু একসাথে বেরুবে বলে। অনিকের ঘুম ভেঙেছে দেরিতে, জাওয়াদ এসে ঠেলে পাঠিয়েছে গোসলে। ওর রুমমেটরা সবাই ঘুমাচ্ছে। ওই ঘুমন্ত পরিবেশে বন্ধুর সাথে আড্ডায় বসা যায়না বলে জাওয়াদ অনিককে তৈরি হবার তাড়া দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। স্মৃতি বিজড়িত চিলেকোঠা চোখে পড়তেই হাসল সে। তড়িৎ মুশরাফার ঝড়ো হাওয়া সামলে বিরক্তমাখা তাকানোটা চোখে ভাসল, সেই প্রথম দেখা। সেই এক ঝলকের প্রখর ক্ষমতা ছিল, নয়তো কিসের টানে মেয়েটা আর বর্তমান ভবিষ্যৎ জুড়ে থাকছে!

লোহার সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে জাওয়াদ অতীত স্মরণে ডুবল। চিলেকোঠার ঠিক সেখানটায় দাঁড়াল যেখানে দাঁড়ানোর পর মুশরাফা ওর নজরে এসেছিল। আচঁড়ে পড়েছিল ওর জীবনে। মনে হলো, এই তো কদিনের আগের কথা, মেয়েটা শুকনো কাপড় নিতে এলো ছাদে। মুখ ঢাকা, ঝড়ের কবলে পড়ে ওড়না সরল মাথা থেকে। চাঁদমাখা মুখটা বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ঝিলিক দিয়ে উঠল ওই মেঘলা পরিবেশে। জাওয়াদ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ, অনেক্ষণ।
ভেবেই আবার হাসল জাওয়াদ। সেই অতীতটা ক্ষনিক আগের মনে হলেও সময়ের গভীরতা কম না। ছ’মাস পেরিয়ে গেছে, সেই অচেনা মেয়ে তার হয়ে গেছে, কাগজে কলমে মনে সবখানে।

অনুভূতিঘণ মুহূর্তে চোখ ঘুরাতে গিয়ে চোখ পড়ল বিল্ডিংয়ে সামনের পার্কিং এরিয়ায়। একটা গাড়ি এসে ডুকেছে সবে। গাড়ি পার্কিং করে চালকের আসন ছেড়ে বেরিয়েছে আভিজাত্যপূর্ণ পোশাকের এক সুদর্শন যুবক। কি রিং ঘুরাতে ঘুরতে এগিয়ে আসছে বিল্ডিংয়ের দিকে। ছেলেটার চেহারা দৃষ্টিগোচর হতেই বিস্ফোরিত চোখে তাকাল জাওয়াদ। মনের ভুল ভেবে চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। ঘটনার সত্যতা বোধগম্য হতেই সর্বপ্রথম মাথায় এলো, রাফা বাসায়। এই ছেলের সাথে রাফার সাক্ষাৎ ঠেকাতে হবে। তার অনুপস্থিতিতে এই বর্বর ছেলে কী না করে বসবে তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর সাথে! জাওয়াদের মস্তিষ্ক কাজ করল না কিছুক্ষণ। স্তব্ধ হয়ে রইল। নিজেকে ধাতস্থ করে উঠতেই ছুটল সিড়ির দিকে।

অনিক তৈরি হয়ে বেরিয়েছে। জাওয়াদকে দেখে বলল,
‘এবার চল।’
জাওয়ার চিন্তিত মনে বলল, ‘তুই যা, আমি যাব না অফিসে।’
অনিক ভ্রু কুঁচকাল, ‘অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বলছিস অফিস যাবি না! মানে কী? এভাবে অফিস কামাই করলে তোর চাকরি থাকবে? চল তো।’

জাওয়াদ বলল, ‘গোল্লায় যাক চাকরি। আমি পরে এসে বলব তোকে। এখন যাই। ‘
জাওয়াদ প্রাণপণে ছুটে গেলে সিড়ির দিকে। অনিক হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল কেবল। কী এমন হলো যে চাকরি হারানোটা ও ওকে ভাবাচ্ছে না? কোন বিপদ হলো না তো? অনিককে চিন্তিত দেখাল এ পর্যায়ে।

সিড়ির দিকে চোখে ফেলে কলিংবেল চাপল জাওয়াদ। ওর হাত কাঁপছে। মুখটা অজানা আতঙ্কে ছেয়ে গেছে। প্রথমবারে দরজা খুলল না। জাওয়াদ কপালে রাগের আভা টেনে আবার সুইচ চাপল। পরপর তিনবার।
‘একবার বাজালেই তো হয়, এতবার বাজানো লাগে?’ কথাটা ভেতর থেকে এলো এর পরেই। বিরক্তির গাঢ় আভা টেনে দরজা খুললেন নাজমুল সাহেব। জাওয়াদের রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে মুখ দেখে তড়িৎ বিরক্তির আভা ঠেলে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
‘ ফিরে এলে যে!’

নাজমুল সাহেবের বলার অপেক্ষা না করে ভেতরে ঢুকল জাওয়াদ। বাইরে একবার উঁকি দিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেলল। আতঙ্কিত গলাতে বলল, ‘ তারিফ আসতেছে…

কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছলেও তৎক্ষনাৎ বুঝে উঠতে পারলেন না নাজমুল সাহেব। খানিক সময় নিয়ে ভাবলেন। পরপরেই অবিশ্বাস্য চোখে বললেন, ‘তারিফ আসতেছে? এখন!’

জাওয়াদের চোখের তারায় ভয়ের আভা। কপালে চিন্তার ভাজ, আতঙ্ক। কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে সারা মুখ। গলা কাঁপছে, কাঁপছে বুক। হৃদস্পন্দন বেড়ে শ’পেরিয়েছে। সাহসী ছেলের সাহস উবে গেছে আগন্তুকের এক ঝলকে। জাওয়াদ অপ্রতিভ স্বরে বলল, ‘মামা, আপনি প্লিজ তারিফকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যান বাসা থেকে। ‘

ওর অস্থিরতা দেখে এই চিন্তাঘন মুহুর্তে ও প্রশান্তির স্পর্শ পেলেন নাজমুল সাহেব। তিনি সুপ্রসন্ন হেসে বললেন, ‘ভয় পেও না। আমার বাসায় এসে আমার মেয়ের ক্ষতি করার মতো সাহস কারো নেই। আজ খারাপ কিছু হবে না ইনশা আল্লাহ। ‘ মুখে সাহস দিলেও চিন্তার রেখা দেখা গেল তার চোখে।

জাওয়াদ চিন্তাগ্রস্ত স্বরে বলল, ‘ যাকে তাকে ভয় পাওয়ার লোক নই আমি। যাকে আমার অপছন্দ তাকে নিয়ে ভাবি না আমি, ওকে নিয়েও ভাবছিনা। আমার সব ভাবনা আপনার ভাগ্নিকে নিয়ে। তারিফের মুখোমুখি হলে রাফা এলোমেলো হয়ে যাবে, ওকে আমি সামলাতে পারব না। আমি চাইছিনা তৃতীয় ব্যক্তি আমাদের জীবন এসে আমার স্ত্রীকে কষ্ট দিয়ে যাক। প্লিজ মামা, আপনি একটু ম্যানেজ করুন!’

জাওয়াদের প্রখর দৃষ্টি দরজার দিকে। আনমনেই কথা বলছে ও। বাবাজনক প্রশান্তিতে নাজমুল সাহেব ভেসে বেড়ালেন। এমন একজন সঙ্গী মেয়ের জীবনে থাকলে বাবাদের ‘মেয়ে’ নিয়ে চিন্তার খাতা খুলে বসতে হয়না। বরং পসরা সাজিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে হয়। নাজমুল সাহেব হঠাৎ অনুভব করলেন, তার চিন্তা হচ্ছেনা। সব চিন্তা যে জাওয়াদের ভাগে চলে গেছে। তিনি জাওয়াদের কাধ চাপড়ে হেসে বললেন, ‘ আল্লাহ ভরসা। উপরে আল্লাহ আছেন। নিচে উসিলা হিসেবে রাফার মামা আছে, নিচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাফার স্বামী আছে। সবাইকে মাড়িয়ে রাফার ক্ষতি করার এত সহজ! তারা হতে দিবে? ও এসে পড়বে। তুমি গিয়ে দেখো রাফা কী করছে। ‘

জাওয়াদের চোয়াল থেকে চিন্তা সরল না। বরং গাঢ় হয়ে গেল। সেই সাথে যোগ হলো রাগ, ক্ষোভ। সতর্কতার সাথে বলল, ‘মামা, আমি আপনাকে আগেই বলে দিচ্ছি, আজ যদি তারিফ রাফার সাথে বিন্দুমাত্র খারাপ আচরণ করে, আমি ওকে খুন করে ফেলব। আপনি আমাকে তখন আটকাতে আসবেন না। ‘

কথাগুলো বাচ্চামো ঠেকল নাজমুল সাহেবের কাছে। হেসে ফেললেন তিনি, ‘আসব না। যাও তুমি।’

কলিংবেলের শব্দটা কানে এলো সেইক্ষণে। জাওয়াদের রূপ বদলাল আবার। রাগ উবে ঠায় নিলো উদ্ধিগ্নতা। দ্রুত পা ফেলল ভেতরের দিকে। মুশরাফার ঘরে গিয়ে দরজা দিল। নব ঘুরাল, উপর-নিচের দুটো ছিটকানি দিল। তারপর দ্রুত এসে বসল বিছানায়। যেখানটায় চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে জাওয়াদের রাফা, ঠিক তার পাশে। এক পলকে এক ঝলক চাইল স্ত্রীকে। ঘুমন্ত মেয়েটা কি জানে তার চিন্তায় দুটো মানুষের দম আঁটকে আসছে? জানে না, জানবে ও না। নাটক ছবির মতো বাস্তবে যে কল্পনা কিংবা ফ্ল্যাশব্যাক দেখার সিস্টেম নেই। সবটা বাস্তবতার আড়ালেই থেকে যাবে। জাওয়াদ ওকে ঘুমন্ত মুখখানায় চেয়ে হাসল, আলতো হাতে বিলি কাটলো এলোচুলে। বিড়বিড় করে বলল,
‘ আল্লাহ, আজ দিনটা সুন্দর হোক। মন্দ কিংবা অসুন্দর কিছু না হোক, যার প্রভাবে এই যোগে জল গড়াবে। রাফার ভাগ্যঝুলির কষ্ট সব শেষ হোক, আর যেন না আসে। প্লিজ আল্লাহ!’

থামল জাওয়াদ। ওর মনে পড়ল, ভালো কাজের উছলায় দিয়ে দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়। এমন কাজ, যা শুধু মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়েছে, গোপনে। যার কথা কেউ জানে না। আল্লাহ জানেন শুধু। জাওয়াদ ওর ভালো কাজের হিসেব কষল, তারপর বলল,
‘ আল্লাহ শুধু মাত্র তোমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হতদরিদ্র ১০টি পরিবারে পুরো মাসের ইফতার বিতরণ করেছি। এই কথা তুমি, তারা আর আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আমার এই ভালো কাজের উছিলায় আমার স্ত্রীকে কষ্টমুক্ত রাখো, সুন্দর একটা জীবন দাও।’
স্ত্রীর কপালে চুমু খেয়ে বিড়বিড় করল,
‘ওকে ভালো রেখে আমায় ভালো থাকার সুযোগ দাও।’

মুশরাফা নড়ে উঠল। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। দমকা হাওয়ায় শীত নিয়ে এলো ঘরে। মুশরাফা কাঁথা মুড়ে গুটিসুটি হয়ে আছে। জাওয়াদ উঠে ফ্যানের স্পিড কমিয়ে দিল। ঝটপট অফিসের কাপড় ছেড়ে টি-শার্ট, ট্রাউজার জড়ালো গায়ে। কাঁথায় ভাগ বসিয়ে আঁকড়ে নিল। দোয়া করার পর নিশ্চিন্ত লাগছে। আল্লাহ ভরসা। আল্লাহ যা করেন ভালো জন্য করেন। সব আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে ঘুম দিবে। এক ঘুমেই তারিফের প্রস্থান। চোখটা সবে লেগে এসেছিল। সেই ক্ষণে দরজায় টোকা পড়ল। তারিফ না কি! বুক কেঁপে উঠল আবার। জাওয়াদ ধীর স্বরে বলল, ‘কে?’
‘ একটু বের হও তো জাওয়াদ।’ নাজমুল সাহেবের গলা শোনা গেল।

জাওয়াদ দরজা খুলে বের হলো। নিচু স্বরে বলল, ‘কী মামা?’
‘অনিক এসে তোমাকে খুঁজছে। কী করি বলোতো?’

জাওয়াদ কপালে বিরক্তির রেখা টানল। এই ছেলে আসার আর সময় পেল না? এই অবেলায় আসতে হলো? জাওয়াদ ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করল অনিকের নাম্বারে। কল ধরেই ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘এক মিনিটের মধ্যে বাইরে আয়। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে আছি।’

কল কাটল পরক্ষণেই। ওর হুলস্থুল কান্ডে বিরক্তির পরিমাণ বাড়ল জাওয়াদের। চাপা শ্বাস ফেলে বলল,
‘মামী কি আমি আসা অবধি রাফার কাছে বসতে পারবে? ‘

নাজমুল সাহেব স্ত্রীকে পাঠালেন মুশরাফার কাছে। জাওয়াদ এগুলো বসার ঘরের দিকে। তারিফ পায়ের উপর পা তুলে ফোন দেখছে। এক হাত সোফার হাতলে। জাওয়াদকে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। ছেলেটা কে? মামার বাসার ভেতরে কী করছে? জাওয়াদ ও তাকিয়েছে ওর দিকে, ক্রোধভরা চোখে। অচেনা ছেলের ছুঁড়ে দেয়া অগ্নিপ্রভায় চোখে ধাক্কা লাগতেই কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল তারিফ,
‘ আপনাকে তো চিনলাম না।’

জাওয়াদের চোখে রাগ থাকলে ও ভয় নেই। অস্বস্তির কোন রেখে নেই দেহে। আছে কেবল ক্ষোভ। শ্যালকের উদ্দেশ্যে প্রথম কথা বলল, প্রগাঢ় স্বরে,
‘ আমাকে না চেনাতেই বোধহয় আপনার মঙ্গল। আমি আপনার সাথে পরিচিত হতে ইচ্ছুক নই।’

তারিফকে বিভ্রান্ত দেখাল। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা একটা ছেলে তাকে কথা শুনাচ্ছে! তারিফের অহংএ আঘাত লাগল। গম্ভীরমুখে বলল,
‘ এক্সকিউজ মি, হু আ….

বাকি কথা বলতে না দিয়ে একপ্রকার অগ্রাহ্য করে চলে গেল দরজায়। অনিক ওকে দেখেই বলল,
‘এবার বল কাহিনি কী? ওভাবে দৌড়ে চলে এলি কেন? ফোন দিলাম ফোন ও ধরলি না। কী না আবার বিপদ হলো এই ভয়ে আমি অফিস যেতে গিয়ে ও ফিরে এসেছি। সব ঠিক আছে?’

এক নাগাড়ে বলে থামল অনিক। ওকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। প্রকৃত বন্ধুর সংজ্ঞা ভাসছে চোখে মুখে। জাওয়াদ ধীর স্বরে বলল, ‘ ইমার্জেন্সি পড়ে গেছিল।’

মুশরাফার পারিবারিক ব্যাপারটা চারকান হতে দিতে ইচ্ছুক নয় জাওয়াদ। পারিবারিক ব্যাপার পরিবারেই থাকুক। বন্ধু যতই আপন হোক তাকে এসব জানিয়ে পারিবারিক গোপনীয়তা নষ্ট করা উচিত নয়। অনিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর হেসে বলল,
‘ আমি ভাবলাম কী না কী বিপদ হলো। এখন তো দেখি তোর লুজ মোশন শুরু হইছে। তা ক’বার গেছোস?’

জাওয়াদ ওর ভুল ভাঙাল না। অসহায় চোখে তাকাল। অনিক মজা করে বলল,’ লুজ মোশন রোগীদের এদিক সেদিক যেতে নেই। কাপড় খারাপের আশঙ্কা আছে, সেই সাথে পরমাণু বোমার গন্ধে মানুষ হতাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। যা ভাই ওয়াশরুমে গিয়ে বসে থাক, পারলে বালিশ নিয়ে ঘুমা। তাও যা, তোকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপড় খারাপ করতে দেখলে আমার ভীষণ হাসি পাবে। ‘

জাওয়াদ হেসে ফেলল, ‘মজা লস?’

অনিক মজাই নিল, ‘আমি কি এখন সেলাইন আনব না কি ডায়পার?’


নাজমুল সাহেব এসেছেন বসার ঘরে। উনাকে দেখে তারিফ ক্ষোভ ছাড়লো, ‘এই রাস্কেলটা কে মামা? তোমার বাসায় কী করছে?’

নাজমুল সাহেব তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন না। সময় নিলেন, ভাবলেন পরিচয় দেয়া ঠিক হবে কি না। ঘূর্ণিপাকে ভাবনা থামিয়ে আকস্মিক বলে উঠলেন,
‘ ও এ বাসার জামাই। তোর ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলা উচিত।’

এ বাসার জামাই! তারিফ ভ্রু কুঁচকাল। অবিশ্বাস্য চোখে বলল,’ এটা তো ফাবিহার জামাই না। তবে কি ফাইজার? এ টুকুনি মেয়ের দিলে দিয়ে দিয়েছো মামা? তাও আমাদের না জানিয়ে!’

নাজমুল সাহেব ধীর স্বরে বললেন, ‘ এটা ফাইজার জামাই না।’
‘তাহলে কার জামাই?’

নাজমুল সাহেব নিরবতায় গা মাড়ালেন। উত্তর দিলেন না। উত্তরটা নিজেই এসে হাজির হলো।

অনিককে বিদায় দেয়ার সময় কী বলে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল জাওয়াদ। সেই শব্দই বোধহয় এনে দাঁড় করাল মুশরাফাকে। হাতে ফোন ওর। জাওয়াদের দ্বিতীয় ফোন। ভাইব্রেট হচ্ছে ফোনটা। সেই শব্দেই ঘুম ভেঙেছে মুশরাফার।
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর বারান্দায় পা রেখেছেন ফরিদা। ভাবনা ছিল, রুম থেকে শব্দ ভেসে এলেই চলে আসবেন রুমে। কিন্তু মুশরাফা চোখ খুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। জাওয়াদের হাসির আওয়াজ শুনে ভেবেছে জামাই-শ্বশুর আলাপ করছে।
অফিস থেকে কল এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ ভেবে দেবার মনস্থির করে এগুলো সেদিকে। বসার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
‘ অফিস থেকে ফোন আসছে সেই কখন থেকে। ফোনটা সাথে রাখা উচিত আপনার। ধ…’

সবে চৌকাঠে পা ফেলেছিল জাওয়াদ। মুশরাফার কথা শুনে তড়িৎ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল ওকে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয় প্রবাদের বাস্তবিক রূপ দেখছে যেন আজ। ওর চোখে বিস্ময়, ভয়। নাজমুল সাহেব অসাড় হয়ে বসে আছেন। ভয়,বিস্ময় নিয়ে হাজির হলেন ফরিদাও।

ডাবল সিট সোফায় বসা মানুষটার দিকে চোখ যেতেই কথা থেমে গেল মুশরাফার। স্তব্ধ হয়ে চাইল, চেয়ে রইল। ওর চোখে অবিশ্বাস। ভাইয়া! সত্যি তার সামনে? সে কি ভুল দেখছে? তারিফ ও অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে আছে। উপস্থিত কারো মুখে কোন কথা নেই। পিনপতন নীরবতা, সবাই তাকিয়ে আছে মুশরাফার দিকে। মুশরাফা তো বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর গলা কাঁপছে, হৃদস্পন্দন বাড়ছে। কতদিন পর মানুষটার সাথে মুখোমুখি হওয়া। দিন না বছর হলো বোধহয়। আনমনে বলল, ‘ভাইয়া!’

জাওয়াদের রক্তশূণ্য মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বার কয়েক দোয়া ইউনুস পড়তেই সাহস এলো মনে। ভয় ঠেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলল ক্ষণিকেই। সমস্যা যখন হয়েছে, সমাধানে নামতে হবে। ধীর পায়ে এগিয়ে ফোনটা হাতে নিল। অন্য ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ফোনের ব্যাটারি লো হয়ে গেছে। ফোনটা চার্জে দিয়ে এসো, যাও।’

মুশরাফার শ্রবণশক্তি যেন বিকল হয়ে গেল। শুনতেই পেল না। ভাবাবেগ দেখা গেল না ওর মাঝে। জাওয়াদ আবার টেনে বলল, ‘যায়ায়াও।’

মুশরাফার বিস্ময়, কাতর, করুণ, কোমল দৃষ্টি তখনো ভাইয়ের পানে। পানিতে চোখ টলমল। যেকোনো সময় গড়াবে অক্ষীপক্ষ্ম বেয়ে। সেই পানি দেখেই জাওয়াদের রাগ নিয়ন্ত্রণহারা হলো। সময়ক্ষণ ভুলে ধমকে উঠল, ‘যেতে বলছি না? যাও। ‘

মুশরাফার শ্রবণশক্তি ফিরে এলো সেই ধমকে। করুণ চোখে চাইল ওর দিকে। যেন অনুমতি চাইল। জাওয়াদের দৃষ্টি কঠিন হলো। চোখেই প্রত্যাখ্যান করল যেন। মুশরাফার পলক পড়ল। গাল বেয়ে পড়া পানি তারিফের দৃষ্টিগোচর হবার আগেই জাওয়াদ খপ করে ওর হাত ধরল। ক্রুর চোখে তাকিয়ে আবার টেনে নিয়ে গেল। ধমকে ওঠল, ‘একটা কথা বলবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।’

মুশরাফা কাতর স্বরে বলল, ‘ আমাকে সবসময় এমন করেন কেন?’

জাওয়াদ চোখ রাঙাল, ‘তোমার কি মনে হয়, আমি তোমার অতীত জানি না?’

মুশরাফার অবাক হয়ে চাইল, ‘আপনি জানেন সব?’

ওরা রুমে এসে গেছে। জাওয়াদ ওর হাত ছেড়ে দরজা লক করে বলল, ‘ স্কেল থেকে হাসপাতালের বেডে যাওয়া অবধি সব জানা আমার। সব মানে সব। এত কিছু জানার পর তোমার মনে হয়, আমি তোমাকে ওদের সামনে যেতে দিব?’

মুশরাফা কাঁপা স্বরে বলল, ‘ওরা আমার পরিবারের লোক। আমি ওদের খুব ভালোবাসি। প্লিজ যেতে দিন!’

জাওয়াদের গম্ভীরমুখে বলল, ‘ আমার সামনে ভাইয়ের কাছে অপমানিত হতে ভালো লাগবে তোমার?’

মুশরাফা চুপ রইল। জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল, ‘আমি চাইছিনা তুমি ওই পরিবারের কারো সামনে যাও। ব্যাপারটা তোমার আত্মসম্মানে না লাগলেও আমার আত্মসম্মানে লাগবে। সো, তুমি যাবে না।’

মুশরাফা কোমল হলো। জাওয়াদের হাত ধরে বলল, ‘বুঝার চেষ্টা করুন, উনারা আমার রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়।’
‘তো? আত্মীয় বলেই অত্যাচার করবে? আর তুমি সব ভুলে যাবে? শুনো তুমি ভুললেও আমি ভুলব না। যারা আমার সাথে ভালো, আমি ও তাদের সাথে ভালো। আমার সাথে খারাপ হলে আমি তাদের দিকে তাকাই ও না। সেটা যেই হোক। ‘

মুশরাফা ধীর স্বরে বলল, ‘আত্মসম্মানবোধ আমার নেই?’
জাওয়াদ বিরক্তিভরা স্বরে বলল, ‘অন্য বেলায় ভরপুর। এ বেলায় তো দেখছি না। এত অপমান, অপদস্ত, অত্যাচারের পর ও তাদের নাম জপো। আত্মসম্মান থাকলে তাদের দিকে তাকানোর ও কথা না।’

‘আমার আত্মসম্মান আমার ইসলামের কথা শোনে। ‘

‘ইসলাম বলেছে আত্মীয়রা যা খুশি করুক, তাদের নাম জপতে হবে?’ জাওয়াদের স্বরে বিরক্তি বাড়ছে।

মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলল, ‘ মানুষ ভাবে, আত্মীয়-স্বজনরা তার সাথে দুর্ব্যবহার করলে তাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা জায়েজ। মূলতঃ আত্মীয়রা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করার পরও যদি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে তখনই তাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হবে।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ সকল কিছুকে সৃষ্টি করলেন। অতঃপর যখন তিনি সৃষ্টি কাজ শেষ করলেন, তখন আত্মীয়তার সম্পর্ক উঠে বলল, ‘(আমার এই দন্ডায়মান হওয়াটা) আপনার নিকট বিচ্ছিন্নতা থেকে আশ্রয়প্রার্থীর দন্ডায়মান হওয়া।’ তিনি (আল্লাহ) বললেন, ‘হ্যাঁ তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তোমার সাথে যে সুসম্পর্ক রাখবে, আমিও তার সাথে সুসম্পর্ক রাখব। আর যে তোমার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব।’ সে (রক্ত সম্পর্ক) বলল, ‘অবশ্যই।’ আল্লাহ বললেন, ‘তাহলে এ মর্যাদা তোমাকে দেওয়া হল।’’

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তোমরা চাইলে (এ আয়াতটি) পড়ে নাও; ‘ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবতঃ তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। ওরা তো তারা, যাদেরকে আল্লাহ অভিশপ্ত করে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন।’’ (সূরা মুহাম্মাদ ২২-২৩ আয়াত)
(বুখারী ও মুসলিম)’

থামল মুশরাফা। তারপর বলল, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করলে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
যুবায়র ইবনু মুত’ইম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে বলতে শুনেছেনঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। [মুসলিম, বুখারী]
আবূ বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ মহান আল্লাহ বিদ্রোহী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর মত অন্য কাউকে দুনিয়াতে অতিদ্রুত আযাব দেয়ার পরও আখিরাতের আযাবও তার জন্য জমা করে রাখেননি। (সুনানে আবু দাউদ)

এত কঠিন শাস্তির কথা শুনে আসোলে আমার আত্মসম্মান কাজ করে না। তাছাড়া আমার আবেগ আমাকে শক্ত হতে দেয় না এ ব্যাপারে। আসোলে কী জানেন? হাজার লোক এলেও আমাদের পরিবারের জায়গায় কেউ বসতে পারেনা। আমি তাদের ভীষণ ভালোবাসি, ভুলতে পারিনা। কতদিন পর ভাইয়ার সাথে দেখা। যেতে দিন না প্লিজ!’

জাওয়াদ মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনল। কিছুই বলল না। মুশরাফার অনুরোধের ঝুলি খুলে বসল। বিপরীতে কোমল চোখে চাইল। রাজি হলো লোকটা? মুশরাফা সাতপাঁচ না ভেবেই ছুটল দরজার দিকে। অনেক কথা জমা পড়েছে, আজ বলতে হবে। ভাইয়ের মুখোমুখি হতে হবে।

চলবে….

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here