স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ (পর্ব-১৪)

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ (পর্ব-১৪)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

অপরাহ্নের প্রথমভাগ। তপ্ত সূর্য তখনো মাথার উপরে। প্রাণ ওষ্ঠাগত। তীব্র দাবদাহে গলা শুকিয়ে কাঠ, । কুরআন শরীফটা রেখে ক্লান্তির শ্বাস ফেললেন ফরিদা। শরীর নুয়ে আসছে তার, বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই পরম শান্তিতে ঘুম নামল চোখে। ঘুম ভাঙল ফাইজার চিৎকারে, ‘মা, মা? শিগগির এসো।’

ঘুম জড়ানো চোখ মেলে তাকালেন দেয়ালে। গোলাপি রঙা দেয়ালে টাঙানো ঘড়িতে সবে ৩টা বেজে ৮ মিনিট। কপালে ভাজ পড়ল তার। মেয়ের প্রতি বেজায় বিরক্ত হলেন ফরিদা। ঘুমোবার সময় ফাইজাকে বারকয়েক বলেছিলেন, তিনি ঘুমাচ্ছেন, যেন ডিস্টার্ব না করে, আসরের আজান দিলে জাগিয়ে দিতে। নামাজ পড়ে রান্নাঘরে ঢুকবেন। তবে মেয়ে জাগাল কেন? আক্কেল জ্ঞান নেই এই মেয়ের! কটা কথা শোনাবার ইচ্ছে নিয়ে উঠে পড়লেন তিনি। ফাইজার ডাক তখনো ভেসে আসছে বসার ঘর থেকে। ফরিদা খোঁপা করতে করতে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। চোখে রাগ নিয়ে যেই কিছু বলতে যাবেন ওমনি চোখ পড়ল চৌকাঠে। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলে। তড়িৎ রাগ সরে গেল চোখ থেকে, সেথায় স্থান দখল করল বিস্ময় অবিশ্বাস। তিনি সত্যি দেখছেন! বলা নেই কওয়া নেই, অবেলায় অতিথি এলো কিভাবে? অতিথি তো নয়, সে তো ঘরের মেয়ে। ফরিদার মনে হলো তিনি ভুল দেখছেন। চোখ ফিটফিট করে চাইলেন। কল্পনা বাস্তবতার ঘোর কাটল যখন মুশরাফা এসে জড়িয়ে ধরল,
‘আসসালামু আলাইকুম মামী। ভালো আছো?’

ফরিদা অবাক হয়ে সুধালেন, ‘তুই সত্যি এসেছিস?’
‘হ্যাঁ।’
মুশরাফা হেসে বলল, ‘অবাক হয়েছো, না? এইজন্যই বলিনি। ‘

ফরিদাকে আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো খুশি দেখাল । মুশরাফাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলে কতক্ষণ। উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘কতদিন পর দেখছি তোকে!’
মুশরাফা হেসে বলল,
‘মাত্র চৌদ্দ দিন মামী!’
‘আমার মনে হচ্ছে চৌদ্দ বছর হয়ে গেছে।’

মুশরাফার পর জাওয়াদের সাথে ও কুশল বিনিময় করলেন ফরিদা। তারপর ছুটলেন রান্নাঘরে। মেয়ে, মেয়ে জামাই এসেছে কত কী রাঁধতে হবে! ফ্রিজ থেকে এটা, ওটা নামাচ্ছেন,ফাইজাকে ফরমায়েশ দিচ্ছেন, ওটা কর ওটা কর। নাজমুল সাহেবকে ফোন দিয়ে খবর জানালেন, সাথে বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিলেন, তাড়াতাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরো। এই কাজগুলো প্রতিটা মা আনন্দের সাথে করেন।

জাওয়াদ বিশ্রাম নিতে গেলেও মুশরাফা ফ্রেশ হয়ে মামীর সঙ্গ নিলো। মামীকে সাহায্য করার বাহানায় কত কী গল্প বলে গেল! ওকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে, আনন্দিত দেখাচ্ছে ফরিদাকেও। চোখ মুখে খুশির ঝিলিক দিচ্ছে। নাজমুল সাহেব ও ফিরলেন তাড়াতাড়ি। একসাথে ইফতারের আসর বসল। ইফতার সাজানোর দায়িত্ব নিলো মুশরাফা। ফরিদা বেড়ে দিচ্ছেন, নাজমুল সাহেব এনে রাখছেন টেবিলে। ফাইজা শরবত করছে। সবাই কাজে ব্যস্ত, একমাত্র জাওয়াদ ছাড়া। সে তখনো রুমে। নাজমুল সাহেবের ডাকে বেরিয়ে এলো। মুশরাফা টেবিল সাজানোর ফাঁকে তাকাল এক পলক। ঘুমিয়েছে বোধহয়, চোখমুখ ফোলা লাগছে। জাওয়াদ টেবিলে এসে বসার সময় চারদিক তাকাল। তারপর অনেকটা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কিছু খেয়েছো?’

ওর বলার ধরণ দেখে মুখ চেপে হাসল মুশরাফা। বলল, ‘ দুইবার খাওয়া হয়ে গেছে। এখন পেটের উপর উকুন মারা যাবে।’

জাওয়াদ ওর কৌতুকে হেসে ফেলল, ‘মারোতো দেখি।’
‘যাহ্!’

কাজ সেরে সবাই এসে বসল। হাসি আনন্দের সাথে ইফতারের পর্ব চুকাল সবাই। ইফতার শেষে ঘরে নামাজ পড়ে বিশ্রাম করছিল জাওয়াদ। মুশরাফা পরীক্ষার উত্তর ঠিক হয়েছে কি না দেখছিল। খানিক পরপর তাকাচ্ছে জাওয়াদের দিকে। একবার জাওয়াদের সাথে চোখাচোখি হলো। জাওয়াদ ভ্রু নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী? মুশরাফা মাথা নাড়িয়ে বইয়ে চোখ দিল। বই বন্ধ করে খাটের পাশে দাঁড়াল। নিশ্চুপ চেয়ে রইল। জাওয়াদ ফোন দেখছিল তখন। চোখ তুলে বলল, ‘কিছু বলবে?’

মুশরাফা উত্তর দিল না, চোখ ও সরাল না। তাকিয়ে রইল। কোন রাগ নেই, কোন প্রেম ও নেই, প্রগাঢ় শান্ত সে দৃষ্টি। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে আবার ফোনে মন দিল। খানিক বাদে আবার তাকিয়ে দেখল মুশরাফা তখনো তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ কেন যেন বিব্রতবোধ করল, ‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কিছু বলার হলে বলো?’

মুশরাফা বলল না, চলে গেল বারান্দায়। তারে মেলে দেয়া বোরকা হাতে ফিরে এলো। বোরকা ভাজ করতে করতে আবার তাকাল, তাকিয়েই রইল। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই জাওয়াদ ও তাকাল। বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হলো যেন।
‘ হলো কী তোমার? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আগে কখনো দেখোনি? আশ্চর্য! ‘

মুশরাফা চোখ ফেরাল না। জাওয়াদ বিরক্তমাখা স্বরে বলল, ‘এভাবে কী দেখো? চোখ নামাও।’

মুশরাফা মনে মনে খুব হাসল। আচ্ছা জব্দ হচ্ছে লোকটা। হাসিটা প্রকাশ করল না। শান্ত চোখ চেয়ে চোখ ফেরাল। তবে জাওয়াদকে জব্দ করতে ভুলল না। ওয়ারড্রবের বোরকা রাখার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা দিয়ে মুখ বের করে উঁকি দিল। ফিরে এসে খাটে শুয়ে পড়ল, আকস্মিক উঠে বসে গালে হাত দিয়ে ওকে পরখ করতে লাগল। সে কী দেখা! দেখার অন্ত নেই। যেন সব দেখা আজ দেখে শেষ করে ফেলবে! জাওয়াদ নিষ্পাপ মনে ভাবছে, এই মেয়ের হলোটা কী!

এশার আজান পড়ল। জাওয়াদ তারাবির নামাজের উদ্দেশ্য বেরুবে, তাই বিছানা ছাড়ল। মুশরাফা বালিশ কোলে নিয়ে বসে আছে, গালে হাত, দৃষ্টি ওর দিকেই নিবদ্ধ। জাওয়াদ ওর এহেন চাহনির বিপরীতে বলল,
‘সেই কখন থেকে দেখে যাচ্ছো, আজ কি বেশি সুন্দর লাগছে আমাকে?’

মুশরাফা উত্তর দিল না, কেবল তাকিয়ে রইল। জাওয়াদ আয়নার সামনে গিয়ে বারকয়েক নিজেকে দেখল। ঝরঝরে চুলে হাত ডুবিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বলল,
‘ সেদিন এক কলিগ বলল, কালো শার্টে আমাকে মারাত্মক লাগে। তোমার কাছে ও লাগছে না কি!’

কালো টি-শার্টে আবৃত মেদহীন দেহটা ঘুরিয়ে নিজেকেই নিজে দেখল। আত্মবিশ্বাস এসে হানা দিয়েছে তার মাঝে। নিজেকে সুন্দর জানার অহং এসে ভর করেছে। যার প্রভাবে ভাবভঙ্গি বদলে গেছে। মুশরাফা শান্ত চোখে ওর ভাব দেখে গেল। বউয়ের সামনে এক বান্ধবীর সাথে গল্প সল্প করে এসে, এখন আবার কলিগের গল্প ও শুনাচ্ছে! রাগের প্রতিফলন ঘটল ভেতরে। প্রকাশ করল না। জাওয়াদ প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলে বলল,
‘মানছি আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে? আমি তো তোমার সাথেই আছি। কোথাও যাচ্ছিনা, প্রতিদিন একটু একটু করে দেখো। একদিনেই সব দেখা শেষ করে ফেললে হবে?’

আজ যেন মুশরাফার বলতে মানা। সে বলবে না কিছু। শুধু চেয়ে রবে। উত্তর না পেয়ে চাপা শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল জাওয়াদ। ফিরে এসে ও মুশরাফার চোখাচোখি হলো। এবার গম্ভীরমুখে বলল,
‘এবার কিন্তু আমি বিরক্ত হচ্ছি রাফা। চোখ নামাও।’

ওর অযুর পানিতে ভাসা চেহারায় সে কী অস্বস্তি! অপ্রতিভ, বিব্রতভাব! মুশরাফার হাসি আটকে রাখা দায় হলো। রুমে ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। মামীর কাছে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুলে হাসির দলকে মুক্ত করল।

নাজমুল সাহেবের সাথে নামাজে গেল জাওয়াদ। নামাজ শেষ ফিরতে ফিরতে রাত হলো বেশ। মুশরাফা তখন জায়নামাজে বসা। ঋতুবতী অবস্থায় নামাজ, রোজা না রাখার বিধান আছে। নামাজ কাযা না করলেও রোজা কাযা করতে হবে। ঋতুবতী অবস্থায় জিকিরের অনুমতি ও আছে। কারণ জিকির সর্বাবস্থায় করা যায়। এ সময় বেশি বেশি সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার জিকির করা, বেশি বেশি ইস্তিগফার করতে বলা হয়েছে। এ সময় কোন দোয়া করলে ও তার দোয়া কবুল করবেন আল্লাহ। জিকিরের অধিক সাওয়াব পাওয়া যায়। মুশরাফা জিকির করছে বসে বসে। জাওয়াদ টুপি নামাতে নামাতে ঢুকল ঘরে। মুশরাফা বিড়বিড় করে পড়তে পড়তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল ওর দিকে। জাওয়াদ অনুরোধের সুরে বলল,
‘এবার অন্তত বলো, তুমি অদ্ভুত বিহেভ করছো কেন?’

মুশরাফা জায়নামাজ গুছিয়ে উঠে এলো। কাছে এসে ধীর স্বরে বলল, ‘বিকজ আই লাভ ইউ।’

ভালোবাসে, তাই তাকিয়ে আছে। এ কেমন কথা! দৈবাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল জাওয়াদ। স্তম্ভিত চোখে চাইল, ভ্রু কুঁচকে। কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আবার জব্দ হয়ে গেল। ওকে বিস্ময়ে ফেলে মুশরাফা চলে গেল খাবার ঘরে। রমজানে রাতে ভারি খাবার খায়না জাওয়াদ। হালকা কিছু খায়। মামী আজ মালাই জর্দা করেছে। মুশরাফা এক বাটি মালাই জর্দা নিয়ে রুমে গেল। জাওয়াদের সামনে বাড়িয়ে দিল। জাওয়াদ তখনো বুঝে উঠতে পারছে না ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু কোথায়? এই মেয়ের মাথায় চলছেটা কী?
ভাবুক মনে জর্দা মুখে তুলল।

ওর খাওয়ার মাঝে মুশরাফা বলল,
‘শুনুন!’

জাওয়াদ খাওয়া থামিয়ে বলল, ‘শুনাও প্লিজ! আমি অধীর আগ্রহে বসে আছি শোনার জন্য। ‘

মুশরাফা কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
‘আপনার কি মনে হচ্ছে না, এবার আপনার পর্দা করা উচিত? ‘

জাওয়াদ অবাক হয়ে চাইল কিছুক্ষণ। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘পর্দা তো নারীর জন্য। আমার জন্য কিসের পর্দা!’

ওর হেয়ালিপনা কথায় মুশরাফা গম্ভীর হলো, ‘ কোন বিষয়েই ইসলাম এক পক্ষীয় বিধান চালু করেনি। চালু করেছে আমাদের সমাজ। পর্দা বলতেই একটা বোরকায় আবৃত নারীকে বুঝানো হয় এখানে। পুরুষের পর্দার কথা কেউ বলেই না। অথচ আল্লাহ মহিলাদের শরীরি পর্দার মতো পুরুষদের চোখের পর্দা বিধান ফরজ করেছে। নারী যেমন পর্দা লঙ্ঘন করলে শাস্তির মুখোমুখি হবে, তেমনি পুরুষ ও হবে!’

জাওয়াদ প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে বলল,
‘পুরুষের পর্দা! সেটা আবার কি!’

মুশরাফা উঠে এসে জাওয়াদের পাশে বসল। তারপর ধীর স্বরে বলল,
‘ সূরা নুরের ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নিচু করে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, এটা তাদের জন্য অধিকতর পবিত্র। তারা যা কিছু করে আল্লাহ সে বিষয়ে জানেন।’
‘বুরায়দা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার হজরত আলী (রা.)-কে বললেন, ‘হে আলী! পরনারীর দিকে চোখ পড়ে গেলে দ্বিতীয়বার আর তাকিয়ো না। প্রথমবার অনিচ্ছায় চোখ পড়ে যাওয়ার কারণে তুমি ক্ষমা পাবে, কিন্তু দ্বিতীয়বার তাকানো তোমার জন্য জায়েজ নয়। (মুসনাদে আহমাদ ও তিরমিজি)। ‘

থামল সে। তারপর বলল, ‘মহিলাদের যেমন শরীরি পর্দা ফরজ, তেমন পুরুষের ও চোখের পর্দা ফরজ। মহিলাদের মতো পুরুষের ও মাহরাম আছে। যেমন,
মা,
ফুফু (বাবার বোন),
খালা (মায়ের বোন),
শাশুড়ি ( স্ত্রী এর মা ),
দুধ-মা (যে মা ছোট বেলায় দুধ খাইয়ে ছিলেন), নিজের বোন,
নানি (মায়ের মা),
দাদি (বাবার মা),
নাতনি (আপন ছেলে ও মেয়ের কন্যা)
দুধ-বোন
মেয়ে
ভাতিজি(আপন ভাই-এর মেয়ে)
ভাগ্নি(আপন বোনের মেয়ে)
ছেলের বউ
এই ১৪জন বাদে সবাইকে বিয়ে করা জায়েজ আছে। আর যাদের বিয়ে করা জায়েজ তাদের সাথে বিনা প্রয়োজনে কথা বলা ও জায়েজ নেই। একবারের বেশি তাদের দিকে তাকানো হারাম।
নাভি থেকে হাঁটু অবধি ঢেকে রাখা ফরজ। নারীর মতো একজন পুরুষ ও এমন পোশাক পরতে পারবে না যা একজন নারীকে আকর্ষণ করবে। এই নিয়ম অমান্য করলে পরকালে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে পুরুষকেও। ‘

জাওয়াদ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার চোখে অবিশ্বাস, বিস্ময়। অজানা তথ্য জেনে হজম হচ্ছে না তার। সে ভাবুক হয়ে বলল,
‘ আমি আজ প্রথম শুনতেছি। ‘

‘না শোনার কথা। কারণ আমাদের সমাজে মহিলাদের পর্দার আলোচনা হয় কেবল। পুরুষদের না। নারীকে ঢেকে থাকার আদেশ দেয়া পুরুষ ও আরাম করে বসে নারীর পানে চেয়ে রয়। স্ত্রীকে পর্দার বিধান শুনিয়ে পরপুরুষের সামনে যেতে দেয় না, কিন্তু নিজে ঘন্টার পর ঘন্টা পরনারীর সাথে হাসিঠাট্টায় মত্ত থাকে। কিছু বললেই বলে, পুরুষমানুষ ওমন একটু আধটু করেই, ওসব দোষের কিছুনা। কিন্তু ইসলাম ওমন একটু আধটুর অনুমতি দেয়নি। নারী যেমন অশালীন পোশাক পরে পরপুরুষের সামনে যেতে পারবে না, তেমনি পুরুষ ও বিনা প্রয়োজনে পরনারীর সম্মুখ হতে পারবেনা। সে যেই অবস্থাতেই হোক আকস্মিক ছাড়া তার দিকে তাকাতে পারবেনা। আকর্ষণ কিংবা আকর্ষিত বোধ কেউ কারো প্রতি হতে পারবে না। দুজনই সম্মান, দুরত্ব বজায় রাখবে। তাহলেই যেনা ব্যভিচার হবে না। দেট’স ইসলাম।’

মুশরাফার স্বর গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হচ্ছে। সমাজের এই নিয়মের ঘোর বিরোধী সে। অনেকটা ক্ষুব্ধ ও বলা যায়। আজ কথা প্রসঙ্গেই নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করল। জাওয়াদ তখনো চিন্তায় মশগুল। হতভম্ব হয়ে বসে আছে সে। চোখে অনুতাপ তার। কত গুনাহ হয়ে গেছে তার! বলতে গেলে পরনারীতেই ডুবে ছিল সে। জাওয়াদ অনুতপ্ত হয়ে বলল,
‘তাহলে তো অনেক গুনাহ হয়ে গেল আমার। আল্লাহ কি মাফ করবে?’
‘ অবশ্যই করবে। যদি আপনি ক্ষমা চেয়ে নিজে শুধরে নিতে পারেন। কিন্তু ক্ষমা চেয়ে আবার ভুল করলে আল্লাহ মাফ করবে না। অনেকটা দ্বিতীয়বার তাকানোর মতো।’

জাওয়াদের চোয়ালে আশার আলো দেখা গেল, ‘এবার থেকে মানার চেষ্টা করব। একদিনে তো পারব না, সময় লাগবে।’

মাথা নাড়াল মুশরাফা, ‘সময় নিন। দিনশেষে নিজেকে আল্লাহর দিকে ফেরালেই হবে।’

জাওয়াদ বলল, ‘বাইরের পর্দা করা যাবে। ঘরের পর্দাতেই সমস্যা।’
মুশরাফা হাসল, ‘এটাই পরীক্ষা। এতকাল আমি ভাইয়াদের থেকে পর্দা করেছি। এবার আপনি ভাবির থেকে পর্দা করবেন। মনে রাখবেন, পথ যত কঠিন হবে প্রতিদান তত মধুর হবে। ‘

‘পারিবারিক পর্দা সবচেয়ে কঠিন। তা এ বাসায় কারো সাথে আলাপে বসতে পারব না?’

‘ফাইজা, ফাবিহা আপুর সাথে পারবেন না।’
‘ওদেরকে আমার বিশেষ দরকার ও নেই। মামীর সাথে পারব?’
মুশরাফা ভাবুক হলো। ভেবেচিন্তে বলল, ‘ মামী আমার দুধ মা। সে হিসেবে পারবেন।’

জাওয়াদ হাফ ছাড়ল। পরপরেই ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার সাথে ও পর্দা মানতে হবে?’

জাওয়াদের মুখে কৌতুকের আভাস। মুশরাফাও চেইন টানল, ‘ নো, আমরা খুললাম খুললা রিলেশনে আছি। কোন পর্দা টর্দা নেই। আপনি যে কোন ভাবে আমার সামনে নিজেকে প্রেজেন্ট করতে পারেন।’

জাওয়াদ কেশে উঠল। আবারও জব্দ সে। কী সাংঘাতিক মেয়ে! মুশরাফা হেসেই খুন। জাওয়াদ প্রসঙ্গ বদলে বলল,
‘ পর্দার ব্যাপারটা হুট করে মাথায় এলো কেন তোমার? কারণটা কি তিশা?’

মুশরাফা সরাসরি উত্তর দিল না। গম্ভীরমুখে বলল, ‘আপনি বিশমিনিটে তেতাল্লিশবার তাকিয়েছেন মেয়েটার দিকে।’

মুশরাফার নাকের ডগা ফুলে লাল। জাওয়ার হাসল ভীষণ। গাড়িতে বসে এসব নোটিশ করছিল মেয়েটা! ওকে দেখে কী ঘুমের ভানটাই না করল! ড্রামাকুইন!
সে ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘ এই জন্যই তখন থেকে ওভাবে তাকিয়ে ছিলে! আর ইউ জেলাস?’
মুশরাফা কিয়ৎপরিমাণ সময় নিল না বলতে। তড়িৎ বলে বসল, নিঃসঙ্কোচে,
‘ অফকোর্স আই আম। আমি ছাড়া এ অধিকার কার? আমার অধিকার অন্যতে প্রয়োগ করা হবে কেন! ‘ হুট করেই জ্বলে উঠল মেয়েটা। জাওয়াদ শব্দ করে হেসে ফেলল। জর্দার বাটি বেডসাইড চেয়ারে রেখে হাসতে হাসতে এক হাতে কাছে টেনে বলল,
‘এদিকে আসো। দেখি তোমার অধিকার তোমাকে দেয়া যায় কি না!’

এত চমৎকার মুহুর্তে কাটানোর সময় ওরা ভাবতেও পারল না কাল তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। রাত পোহালেই যে মুশরাফাকে ‘মুশি’ ডাকা মানুষটা এসে হাজির হবে এ বাসায়, সে কথা ওদের কানে তখনো যায়নি। রাস্তাঘাটে পালিয়ে বাঁচতে পারলেও কাল কি পালানো সম্ভব হবে? সুযোগ থাকবে! বোধহয় না। মুখোমুখি তো হতেই হবে, আজ না হয় কাল। সেই কালটা কালই হবে।

চলবে…

বিঃদ্রঃ ১ প্রথম পরিচ্ছেদে ফরিদার দুধ মা হওয়ার ব্যাপারটা আসেনি। আমি এডিট করে ঠিক করে দিব। দুধ মায়ের ছেলের মেয়ের সাথে বিয়ে জায়েজ নেই।

বিঃদ্রঃ ২ নারী পুরুষ উভয়ের পর্দার আলোচনা করা হয়েছে। নারীর পর্দার কথা প্রথম পরিচ্ছেদে, পুরুষের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে।

বিঃদ্রঃ ৩ বিশাল একটা পর্ব দিয়েছি গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here