স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। #নিবেদন। (অন্তিম পর্ব)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
#নিবেদন। (অন্তিম পর্ব)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

৪০.
চৌকাঠে পা রাখবার পরপরেই জাওয়াদ বলল,
‘কার যেন অনুভূতির ঢেউ উঠেছিল? এখন সে চাইলে প্রকাশ করতেই পারে। আই এম এভেইলেবল।’

মুশরাফা দাঁড়িয়ে আছে সিড়ির কাছটায়। জাওয়াদের কথা শুনে নিকাবের অন্তরালে দুষ্টু হাসল। হাসি থামিয়ে গম্ভীরমুখে বলল, ‘ প্রকাশ করবার সাহস আমি দেখাতেই পারি। কিন্তু সমস্যা হলো আপনার সরা সরির অভ্যাস নিয়ে।’

মুশরাফার ইঙ্গিত ধরতে পারল জাওয়াদ। দরজায় ঝুলানো তালা খুলতে খুলতে মৃদু হেসে বলল, ‘অভ্যাস তো বদলাবার জন্যই ।’

মুশরাফা ভ্রু নাড়াল, ‘সত্যিই তো?’

মুশরাফা আশপাশ চোখ বুলিয়ে নিকাব নামিয়ে ফেলল। ওর চোখে মুখে দুষ্টুমি। চোখের চাহনি পাশের বাসায়। জিশানের বাসার দরজার কাছটায় থাকা কলিংবেলে। জাওয়াদ তৎক্ষনাৎ টের পেল এই মেয়ে তাকে আবার নাস্তানাবুদ করবার পায়তারা করছে। তার ভাবনাকে সত্যতা প্রমাণ করে কলিংবেল চাপল । খানিক বাদেই ভেতর থেকে জয়নাল আবেদীনের স্বর ভেসে এলো, ‘কে?’

মুশরাফা জাওয়াদের দিকে এগিয়ে বলল, ‘ অনুভূতিদের লাই দেয়াই যাক তবে? ‘

জাওয়াদ অসহায় চোখে তাকাল। এক্ষুনি বাবা দরজা খুলে ফেলবেন। ইতস্ততভাবে বলল, ‘বাসায় গিয়ে বাদ দিই?’

মুশরাফা বিজয়ী হাসল, ‘ভীতু!’

সেই ক্ষণে দরজা খুলে বেরুলেন জয়নাল আবেদীন। মুশরাফা সালাম দিল। জাওয়াদ জব্দ হলো। জয়নাল আবেদীন সহাস্যে জবাব দিলেন। কোমল স্বরে বললেন, ‘তোমার পরিবারের সবাই ভালো আছেন?’
মুশরাফা প্রসন্ন হেসে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন সবাই। ‘
জয়নাল আবেদীন দরজা ছেড়ে বললেন, ‘ভিতরে এসো।’

ডাইনিং রুমে জিহান আর মায়মুনার কথা শুনা যাচ্ছে। দাদী নাতি মিলে বিড়াল সেবা করছে। জিহান উৎফুল্ল হয়ে হৈচৈ করছে। মুশরাফা ভেতরে ঢুকল। মায়মুনা ওকে দেখে উঠে এলেন। হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ বেড়ানো শেষ এত তাড়াতাড়ি? আমি ভেবেছি, এতদিন বাদে পরিবার পেয়ে আজ আসবেই না। তা এই অসুস্থ শরীরে যাওয়া উসুল হলো?’

মায়মুনার কথায় মুশরাফা টের পেল মায়মুনা আগে থেকেই জানতেন সব। মুশরাফা প্রাণবন্ত হাসল, ‘খুব উসুল হয়েছে। আমি সব পেয়ে গেছি, মা। কাল বাবা মা আসবেন এখানে। ‘
মায়মুনা পুত্রবধূর মাথায় হাত রাখলেন, ‘ আলহামদুলিল্লাহ। সদা সুখী হও।’

জিহান চাচীকে দেখেই দুই হাতে দুটো বিড়াল কোলে নিয়ে উঠে এলো। উৎফুল্ল হয়ে চেঁচাল, ‘চাচ্চি! আমি তিলো মিলোর খেয়াল রেখেছি। আমার কাছে খুব হ্যাপি ছিল, একটু ও স্যাড হয়নি।’

মুশরাফা বিড়াল দুটোকে আদর করল। তারপর জিহানের মাথায় হাত দিয়ে স্নেহের সুরে বলল,
‘এর বিনিময়ে আল্লাহ অনেক পুরষ্কার দিক।’
থেমে বলল, ‘ এমন করে আমি না থাকলে তিলো মিলোকে দেখে রেখো। কেমন?’

জিহান মাথা নাড়াল। বিড়াল চাচ্চীর দুটোকে কোলে দিয়ে চাচ্চুর কাছে গেল। একা হতেই মায়মুনা ধীরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘খবর কী?’
মুশরাফা লাজুক স্বরে বলল, ‘এখন গিয়ে জানব।’
‘জার্নি করে এসেছো। এখন গিয়ে রেস্ট করো। কাল সকাল সকাল সুখবর দিও।’ কোমল স্বরে বললেন মায়মুনা।

মুশরাফা যেতে গিয়েও থেমে গেল। আকস্মিক শ্বাশুড়িকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘ আমার উপর কোন রাগ রাগবেন না। সব ভুলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন, মা।’

মায়মুনা ভ্রু কুঁচকালেন, ‘হঠাৎ ক্ষমা চাইছো কেন?’

মুশরাফা দায়সারা ভাবে বলল, ‘জানি না, মা। হুট করেই ইচ্ছে হলো। আমাকে সবসময় দোয়ায় রাখবেন, মা।’

মায়মুনা বললেন, ‘তুমি ক্লান্ত। যাও, গিয়ে রেস্ট নাও।’

মুশরাফা যাবার কালে দেখল জাওয়াদ জয়নাল আবেদীনের সাথে বসে গল্প করছে। মুশরাফা শ্বশুরকে বলল,
‘বাবা, আপনাকে চা দিই?’
জয়নাল আবেদীন মানা করলেন, ‘এতদূর থেকে এসেছো। গিয়ে রেস্ট করো। কাল খাবো চা।’

‘ কালকে চা নসিবে থাকে কি না তা তো বলা যায় না। আজই দিই!’ বলে মুশরাফা চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে চা এনে খাওয়ালো সবাইকে। চায়ের কাপে পারিবারিক আড্ডা বসল। ফারুকী বেয়াই মশাইয়ের কাছে প্রথমবারের মতো ফোন করেছেন কিয়ৎক্ষণ আগে। আন্তরিকভাবে কুশল বিনিময় করেছে কাল বাসায় থাকবার অনুরোধ করেছেন। বেয়াইয়ের সাথে আলাপ সারবেন। সে নিয়ে কথা হলো। এর মাঝে যায়েদ জিশান এসে যোগ দিল। মুশরাফা আড্ডা ছেড়ে বাসায় ফিরল।

________________________

মুশরাফা জায়নামাজে বসে আছে। এর হাত পা কাঁপছে থরথর করে, চোখ বেয়ে গড়াচ্ছে জল। অন্তরে আনন্দরা ঝঙ্কার দিচ্ছে, ঠোঁটের কোণের হাসি সরছেই না। আজ তার পাওয়ার দিন। একে একে সব পেয়ে যাচ্ছে। খুশির ঠিকানা নেই যেন ওর। নিজের বাবা মাকে পেল, নিজেকেও মা হিসেবে পেল। সে ‘মা’ হবে? কথাটা মস্তিষ্কে আন্দোলিত করছে বারংবার। প্রথমবার মা হবার, মাতৃত্ব অনুভবের অনুভূতি সে কী সুন্দর! মুশরাফা শিউরে ওঠছে বারবার। বিড়বিড় করে বারবার পড়ছে, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।
খানিক আগেই জেনেছে খবরটা। জানবার পর সর্বপ্রথম অযু করে নামাজে দাঁড়িয়েছে। যে স্রষ্টা ওকে এত কিছু দিয়েছে, সুখের সাথী করবার অধিকার সর্বপ্রথম তার। খুশিতে শুকরানার নামাজ যে কত রাকাত পড়েছে হিসেবটি রাখেনি। সেজদায় আনন্দে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। সালাম ফিরিয়ে ভেজা চোখ নিয়ে হেসে ফেলল। চোখে কান্না, ঠোঁটে হাসি। আকস্মিক জাওয়াদের চেহারাটা ভেসে উঠল। মানু্ষটা জানলে কেমন রিয়েক্ট করবে? একটু পরেই তো ফিরে আসবে। তখন জানাতে হবে। কিভাবে জানাবে? ওর যে ভীষণ লজ্জা লাগছে। সুখের মতো পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লজ্জা। উত্তেজনায় কাঁপছে বুক, কেঁপে উঠছে হাত পা।

এই সুন্দর মুহুর্তকে বিশেষ করবার জন্য একটা পরিকল্পনা ও কষে নিল। মনে এক গাদা প্রেম আনন্দ নিয়ে শাড়ি পরল। জাওয়াদের দেয়া বউ বউ ধরনের লাল জামদানি। তারপর অপেক্ষায় বসল জাওয়াদের আগমনের।

জাওয়াদ বাবার সাথে কথা বলে বাসায় ফিরল তখন ঘড়ির কাটায় এগারোটা। মুশরাফাকে জায়নামাজে বসা পেল। জায়নামাজের কিছুটা অংশ ভাজ করা। যার অর্থ, নামাজ শেষ। জাওয়াদ রুমে ঢুকতে ঢুকতে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুমুস, মিসেস? আপনার মনের অবস্থা কেমন?’

মুশরাফা মাথা নিচু করে সালামের উত্তর নিল। সেই সাথে ধীরে বলল, ‘ অযু করে আসুন।’

জাওয়াদ ওয়ালেট, ফোন পকেট থেকে বের করতে করতে মৃদু হেসে বলল, ‘ জড়িয়ে ধরবার জন্য আজকাল অযু করা লাগে? ‘

মুশরাফা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ হাত ঘড়ি খুলবার সময় ভ্রু নাড়িয়ে আবেদন করল, ‘ আপনি চাইলে অযু ছাড়াই ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেন। দেখি, কাছে আসেন?’

মুশরাফা এলো না, কিছু বলল না, তাকাল ও না। ওর দু’গাল লাল থেকে লাল হলো কেবল। জাওয়াদ খেয়াল করল, মুশরাফার সাজসজ্জা। সে রসিকতার সুরে বলল,
‘ তুমি কি আগে থেকেই বউ বউ ধরনের, না কি এখন আমার কাছে নতুন করে লাগছে?’

এ কেমন কথা! মুশরাফা হেসে ফেলল, ‘বউদের বউ তো বউ ধরনের লাগবে। ‘

জাওয়াদ ঘড়ি রেখে ড্রেসিংটেবিলের টুল টেনে জায়নামাজের কাছে বসল, ‘দেখি তাকাও তো!’

মুশরাফা তাকাল না। আরও মিইয়ে গেল। জাওয়াদ ওকে পরখ করে বলল, ‘ ও বাবা! সাজগোজ করা হয়েছে দেখি! তা এত আয়োজন কেন? সুখবর টুখবর শুনাবে না কি!’

মুশরাফা এত তাড়াতাড়ি ধরা দিতে চাইল না। বলল, ‘ সাজগোজের সাথে সুখবরের কী সম্পর্ক?’
‘ সুখবর ছাড়া আপাতত আর পাওয়ার কিছু দেখছি না।’

মুশরাফা নিশ্চুপ বসে রইল। মুশরাফার দিকে তাকাতেই ঘোর লেগে যাচ্ছে জাওয়াদের। এত চোখধাঁধানো সুন্দর লাগছে ওকে! সে টুল ঠেলে ফ্লোরে বসল, পাশে কাছে। কোমল স্বরে বলল,
‘ তাহলে বলো, কী হয়েছে?’

মুশরাফা বলল না। নিশ্চুপ রইল। লজ্জায় লাল ওর মুখ খানা। জাওয়াদ কৌতুহল নিয়ে বলল,
‘ হুটহাট এত লজ্জা আসছে কোথা থেকে? হয়েছেটা কী?’

মুশরাফা লজ্জা নিয়ে বলল, ‘আমার লজ্জা লাগলে আমি কী করব?’
‘তাকাও আমার দিকে?’

মুশরাফা কিছুতেই তাকাতে পারল না ওই চোখ পানে। কাঁপা স্বরে বলল, ‘ আমার লজ্জা করছে।’

সুখবর ছাড়া লজ্জার কোন কারণ ধরতে পারছে না। জাওয়াদ। সে দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘তা লজ্জার কারণ আমাকে ও বলো, আমি একটু লজ্জা পাই।’

‘অযু করে আসুন, তারপর বলব।’

মুশরাফা নিশ্চুপ রইল। জাওয়াদ অত না ভেবে বলল, ‘আজ তোমাকে আমি বুঝতে পারছি না। সকাল থেকে অদ্ভুত বিহেভ করছো। পরিবার টরিবার ফিরে পেয়েছো, কোথায় খুশি হবে, তা না ও লজ্জা পাচ্ছে। হলো কী মেয়ে, তোমার?’

বলতে বলতে ওয়াশরুমের দিকে গেল জাওয়াদ। আকস্মিক পিছু ডাকল মুশরাফা।
‘দেখুন?’

জাওয়াদ পিছু ফিরল আগ্রহ নিয়ে, ‘কী?’

মুশরাফা লজ্জা নিয়ে চাইল ওর পানে। কিছু বলল না। কেবল হাত উঁচু করে তিনটা আঙুল দেখাল। প্রথমে তর্জনী, তারপর মধ্যমা, তারপর অনামিকা। তিনটা আঙুল খোলা রেখে দু’বার হাত নাড়াল। জাওয়াদ যেন আজ বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। এত ভারি কথা হুটহাট মাথায় এলো না ওর। ও চোখ সরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
‘খুশিতে এই মেয়ের মাথা গেছে।’

মুশরাফা শুনল কি না কে জানে। পিছন থেকে বলল, ‘কিছুক্ষণ পর আপনার ও যাবে।’

জাওয়াদ ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লক করবার সেকেন্ড বিশেক বাদেই ধড়াম করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে অনেকটা চেঁচিয়ে বলল, ‘সিরিয়াসলি?’

মুশরাফা মাথা নাড়াল। জাওয়াদের চোখে বিস্মিত, মুখে হতভম্ব ভাব। মুশরাফা এবার জায়নামাজ ছেড়ে উঠে এলো। প্রিয়তমের কাছে এসে দাঁড়াল, লজ্জা, হাসি নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আমার হয়ে কেউ একজন আসতে চলেছে। আমাদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি নিয়ে, ভীষণ ভীষণ বিশেষ হয়ে, আমাদের সব ভালোবাসা কুড়িয়ে নিতে।’

জাওয়াদের কথাই রিপিট করল। জাওয়াদ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল যেন। বুক কাঁপছে, হৃদস্পন্দন বেড়ে শ ছাড়িয়েছে বোধহয়। চোখে ঘোর, মুখে বাবা হবার আনন্দ। মস্তিষ্কে আন্দোলিত হচ্ছে একটাই কথা, আমি বাবা হবো? ছেলেদের বাবা হবার কথা এলে একটা পুতুলকন্যার ছবিই ভাসে চোখে। জাওয়াদের চোখে ও ভাসল একটা পুতুলকন্যা। গোলগাল চেহারা, ডাগর ডাগর চোখ, ছোটো ছোটো হাত, পা তুলতুলে শরীরের একটা বাচ্চা হবে তার। তাকে বাবা ডাকবে। ‘বাবা!’ শরীরে ঝঙ্কার দিয়ে উঠল। অস্ফুট সুরে বলল, ‘ আমি বাবা হতে যাচ্ছি!’

মুশরাফার চোখে অশ্রু চিকচিক করছে। সে হাসি কান্না নিয়ে চাইল স্বামীর পানে। মাথা নাড়ল। অস্ফুট সুরে বলল, ‘আওয়ার চাইল্ড…

শেষ কবে এত খুশি হয়েছিল জাওয়াদের মনে নেই। এই পুরো জীবনের সবচেয়ে সুখী মুহুর্ত বোধহয় এটাই। জাওয়াদ খুশিতে আটখানা হয়ে গেছে। উচ্ছ্বাস, উৎফুল্ল, চঞ্চল হলো ওর অনুভূতি। চওড়া হাসল সে। হাসতে হাসতে দু’হাতে মুখ ঢাকল। আনন্দে দিশেহারা লাগছে ওর। কত কী বলতে চাইছে, স্বর বেরুচ্ছে না।

মুখ থেকে হাত সরিয়ে আকস্মিক বুকে টেনে নিল মুশরাফাকে। শেকড়েত মতো আঁকড়ে নিল। প্রশান্তির সুরে বেশ জোরেই বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ!’ স্ত্রীর কপালে চুমু খেল। রাফার মাথায় চিবুক ঠেকিয়ে রইল অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

প্রিয়তমের বুকে মুখ লুকিয়ে আনন্দাশ্রু ফেলা মুশরাফা টের পেল প্রিয়তমের হৃদপিণ্ডের উৎফুল্লতা, পুরো বুক নড়ে উঠছে যেন। মানুষটা কী খুশি! এই খুশি দেখে ওর খুশির মাত্রা দিগুন হয়ে গেল। দৈবাৎ মাথার তালুতে এক ফোঁটা জলের অস্তিত্ব অনুভব করল। জাওয়াদ কাঁদছে! একরাশ বিস্ময় নিয়ে মাথা তুলে চাইল মুশরাফা। গালের জল মুছে ফেলেছে জাওয়াদ। তবে চোখে ঠাসা আনন্দের অঠায় জল। ঠোঁটে বিজয়ের চওড়া হাসি। এত উৎফুল্ল, চঞ্চল আনন্দিত জাওয়াদকে অনেকদিন দেখা হয়নি মুশরাফার। সেই খুশি মন ছুঁতেই কান্না পেল। মুশরাফা ডুকরে উঠল । জাওয়াদ ভ্রু বাঁকাল,
‘তুমি কাঁদছো কেন?’
‘আপনি যে কারণে কাঁদছেন সে কারণে।’ ভেজা স্বরে বলল মুশরাফা। জাওয়াদ অবাক স্বরে চাইল,
‘আমি কাঁদছি না কি!’

ওর ঠোঁটে হাসি, চোখের কোণ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়াচ্ছে। মুশরাফা হাত বাড়িয়ে সে অশ্রু লোচন করল। চোখে চোখ রেখে বলল,
‘আর ইউ হ্যাপি?’

জাওয়াদ উদ্ভাসিত মুখে বলল, ‘তুমি নিজেও জানো না, কী সংবাদ দিয়েছো আমায়। আমি যে কতটা হ্যাপি আমি বলে বুঝাতে পারব না। বেবি আসছে, আ…মাদের বেবি! ক্যান ইউ ইমাজিন, এটা কত চমৎকার কথা!
কেউ একজন আমাকে বাবা বলে ডাকবে ভাবতেই বুক কেঁপে উঠছে আমার, ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যাচ্ছি আমি।
থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ, সো মাচ ফর দ্যা গিফট। জাযাকি-আল্লাহু খায়রান। আল্লাহ, আল্লাহ তোমাকে সবচেয়ে উত্তম প্রতিদান দিক।’

জাওয়াদ ক্ষণে ক্ষণে চঞ্চল হয়ে উঠছে। বাচ্চা হবার কথা শুনে নিজেই বাচ্চা হয়ে গেছে যেন। একবার হাসছে, আরেকবার মুখ চেপে বসে আছে, পায়চারি করছে। খানিক পর পর উৎসুক দৃষ্টিতে বলতেছে, ‘রাফা, সত্যি একটা ফিন্সেস আসবে? আমার ফ্রিন্সেস! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘ফ্রিন্স ও হতে পারে। যা আমাদের জন্য মঙ্গল তাই দিক আল্লাহ। ছেলে মেয়ের বিভেদ করা উচিত না।’

মুশরাফা মুগ্ধ চোখে ওর খুশি দেখছে। জাওয়াদের আনন্দের মাঝে বিলীন হয়েছে ওর লজ্জা। এক পর্যায়ে ও বলল, ‘ এই সুন্দর মুহুর্ত যে দান করেছে, আসুন তাকে স্মরণ করি, তার কৃতজ্ঞতা আদায় করি। অযু করে আসুন। ‘

দুজনে একসাথে দু’রাকার নফল নামাজ পড়ল। মোনাজাত করে দোয়া চাইল। জায়নামাজ ছেড়ে উঠল না। বসে রইল। জাওয়াদের কাধে মাথা দিয়ে কাছ ঘেঁষে বসে রইল মুশরাফা। নিশ্চুপ বসে প্রথমবার মা বাবা হবার আনন্দ উপভোগ করছে। হঠাৎ মুশরাফা বলল,
‘ ওয়া লাছাওফা ইউ’তীকা রাব্বুকা ফাতারদা। [অচিরেই তোমার রব তোমাকে এত বেশি নিয়ামত দিবেন যে, তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে। (সুরা দুহা-৫)] ‘

থেমে বলল, ‘আজ সেই দিন।’

জাওয়াদ আনমনেই হাসল। বিড়বিড় করে পড়ল এই আয়াতটা। তারপর বলল, ‘আসোলেই।’

মুশরাফা উৎফুল্ল হলো, ‘ এই আয়াতের সাথে আজ আমার জীবনের মিল খুঁজে পাচ্ছি। আমার এত এত অপেক্ষা, ধৈর্য সবের মূলমন্ত্র ছিল এই আয়াত। একদিন আমার রব আমাকে দিবে। এই অপেক্ষায় আমি দোয়া করে গেছি। দেখুন আজ আমি সব পেয়ে গেছি। আমি আপনাকে পেয়ে গেছি, মা বাবা, আপু, ভাইয়া, জায়ফা, শ্বাশুড়ি, শ্বশুর সবাইকে পেয়ে গেছি। আমাকে বহুকাঙ্ক্ষিত মাকে পেয়েছি আজকের দিনে, আবার আজকেই নিজেকে মা হিসেবে পেয়েছি। আমি সব পেয়ে গেছি। আমার রব আমাকে সব দিয়েছেন। আমাকে ধৈর্যের প্রতিদান দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ! আমার মনে হচ্ছে আমার জীবনটা পূর্ণতা পেয়ে গেছে। জীবনের উপর, স্রষ্টার উপর আমার কোন অভিযোগ নেই, ভীষণ সন্তুষ্টি আছে। আলহামদুলিল্লাহ। আমি সব পেয়ে গেছি! ‘

মুশরাফা চঞ্চল হলো। ওর চেহারায় রাজ্যের সুখ। সুখ নিয়েই বলল,
‘ জানেন? আমি সবসময় মোনাজাতে দোয়া করতাম, আমি যেন পূর্ণতা নিয়ে মরতে পারি। আমার জীবনের সব অপূর্ণতা পূর্ণতায় যেদিন রূপ নিবে, যেদিন আমার মনে হবে আমার এতকাল বেঁচে থাকা সার্থক, আমার জীবন পরিপূর্ণ, যেদিন আমার রব আমার উপর সন্তুষ্ট থাকবেন, আমার গুনাহের খাতা শূন্য হবে সেদিন। এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে আমার জীবন, সার্থক, পূর্ণতা। আমি সব পেয়ে গেছে। আমার আপনজন গুলোকে আমি আপন হিসেবে পেয়ে গেছি। আজ আমি শ্বাশুড়ির হাতে সেজে গেছি, মায়ের হাতে সেজে ফিরেছি। আমার মা আমাকে পর্দার জন্য উৎসাহ দিয়েছে, আমাকে বোরকা গিফট করেছে। আমি মা হতে যাচ্ছি। এর চেয়ে পূর্ণতা আর কী হতে পারে। এই মুহুর্তে আমার সব আছে। আমি সুখী, সন্তুষ্ট। ‘

জাওয়াদ ওর এই কথাকে আনন্দ প্রকাশ হিসেবে ধরে নিয়ে বিশেষ প্রাধান্য দিল না। আলতো করে কাধ চেপে বলল,

‘ আমাদের আরও অনেক কিছু পাওয়া বাকি। যেই প্রাণের অস্তিত্ব সবে এসেছে তাকে লালন করা বাকি। আমার সামনে এক সমুদ্র সুখ আছে। অনেক কষ্ট করেছো। আল্লাহ, সুদিন দিয়েছেন, এবার শুধু সুখ আর সন্তুষ্টির পালা। এখন অন্য কিছু নিয়ে ভাবার দরকার নেই। এখন শুধু তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবো। আমাদের বেবি নিয়ে ভাবো। আমাদের জীবনে, সংসারে এখন নতুনত্ব আসবে। সব চেঞ্জ হবে। ‘

থামল জাওয়াদ। রুমে চোখ বুলাল। ওর চোখে হাজার স্বপ্ন, ঘোর, জ্বলজ্বল করা আনন্দ। উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘ বেবি আসবে মনে হচ্ছে না। বাসায় একটা ভাইব আনতে হবে। এই রুমের কালার চেঞ্জ করে ফেলব। কাল গিয়ে আমি শপিং করে আসব
। বেবিদের কী কী লাগে? আমি তো কিছুই জানি না। একটা লিস্ট করে দিও। ও আসার আগেই বাসা সাজিয়ে ফেলব। আচ্ছা, ও ছেলে হবে না কি মেয়ে হবে? নাম কী রাখব?’

জাওয়াদের শিশুসুলভ ভাব দেখে মুশরাফা হেসে ফেলল। খুশি এই ছেলের মাথাও গেছে। কী পাগলামো করছে ছেলেটা! হাসতে হাসতে বলল, ‘ বাচ্চা হবার কথা শুনে আপনি নিজেই বাচ্চা হয়ে গেছেন। আগে হায়াত নিয়ে আসুক।’

জাওয়াদের প্রফুল্লতা বাড়ল বৈ কমল না। মুশরাফার পেটের চোখ ফেলে বলল, ‘ আচ্ছা, ওকে কি এখন আমি অনুভব করতে পারব? ও কি এখন আমার কথা শুনতে পারবে?’

জাওয়াদের চোখে ঘোর। মুশরাফা সম্মোহন নিয়ে চাইল। কোমল স্বরে বলল, ‘ প্রেগ্ন্যাসির পাঁচ মাসে শিশুরা মুভ করতে পারে, সব শুনতে পারে। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে তখন পারবেন। এখন হার্টবিট শুনতে পারবেন শুধু। ‘

‘তাহলে আমরা কাল সকাল সকাল ডাক্তার কাছে যাব। আই কান্ট ওয়েট।’ বলে ঘড়ির দিকে তাকাল। যেন সময়ের কাটা নিজ থেকে ঘুরিয়ে সকালে নিয়ে যাবে।

মুশরাফা হেসে গেল, দেখে গেল জাওয়াদের পাগলামো। এক সময় দুজনেই চুপ হয়ে গেল। নিশ্চুপ বসে স্বপ্ন বুনতে লাগল। ঘড়ির কাটা একটার ঘরে গেল। একটার ঘন্টা বাজল, ঢং ঢং! সময় দেখে জাওয়াদের হুঁশ হলো যেন। আলতো সুরে বলল,
‘অনেক রাত হয়েছে, এবার চলো ঘুমাবে।’

মুশরাফা কাতর চোখে চেয়ে বলল, ‘আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।’

‘এখন রাত জাগা ঠিক হবে না। সকাল সকাল উঠতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে, হাসপাতালে যেতে হবে। আবার লাঞ্চে ও বাসার সবাই আসব। কত কাজ! কাল বিশ্রামের সময় পাবে না। এখন ঘুমাও।’

মুশরাফা আনমনে বলল, ‘ঘুমালে উঠতে পারব তো?’

জাওয়াদ সুন্দর করে হাসল, ‘আমি আছি না, আমি জাগিয়ে দিব। ‘ জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘এসো!’

মুশরাফা হাতে হাত রাখল ঠিকই। তবে উঠল না। জাওয়াদকে বসিয়ে দিল। অনেকটা জোর করে কাধে মাথা রেখে বলল, ‘এই সুন্দর সময়টা, ভীষণ ভালো লাগছে। এমন সুন্দর মুহুর্ত আবার কবে আসে, বলা যায় না। বসুন, তো!’

মুশরাফা উঠল না, বসে রইল। ঘড়ির কাটা একটা পেরিয়ে দুটোয় গেল। জাওয়াদ এবার জোর দিয়েই বলল, ‘ আর দেরি হলে ফজর মিস হয়ে যাবে। ‘ হাত ধরে ওঠালো ওকে। বিছানায় বসিয়ে ওয়াশরুমে গেল।

ফিরে এসে দেখল মুশরাফা তিলো মিলোর ঘরের কাছে বসে আছে। বাচ্চা দুটো ঘুমাচ্ছে। মুশরাফা স্থির চোখে দেখছে, আলতো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। জাওয়াদ ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আজ অতটা পথ ড্রাইভিং করে গিয়েছে, এসেছে। বিকেল থেকে রেস্ট নেবার সুযোগ পায়নি। শরীরটা ভেঙে আসছে। ঘুম পাচ্ছে। এই মেয়ের তো ঘুমানোর নাম নেই। জাওয়াদ এবার গম্ভীরমুখে বলল,
‘রাফা হলো কী তোমার আজ? তিলো মিলোকে সকালে দেখো। এখন ঘুমাও, শরীর খারাপ করবে।’

মুশরাফা উঠল না। জাওয়াদ ধরে উঠিয়ে দাঁড় করাল। ওমনি গলা জড়িয়ে ধরল। গভীর চোখে চাইল। প্রেম নিয়ে বলল, ‘আমি আল্লাহর জন্য আপনাকে ভালোবাসি।’

বরাবরের মতো বুক কেঁপে উঠল জাওয়াদের। গম্ভীরতা সরে গেল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। দু’হাতে আঁকড়ে নিল। আলতো করে আহ্লাদ ভেসে যাওয়া গালে অধর ছুঁয়ে দিল। বোধহয় এই প্রথম সে কনফেস করল, চোখে চোখ রেখে, ‘আমি ও আপনাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।’

মুশরাফা চমৎকার হাসল। খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল গাল। আবেশে চোখ বুঝল। আবার খুলল। আহ্লাদী সুরে বলল, ‘আপনি চাইলে আমাকে কোলে নিয়ে ঘুমের ঘরে নিয়ে যেতেই পারেন। আমি কিন্তু আপত্তি করব না।’

মুশরাফার চোখে এত আহ্লাদ কখনো দেখেনি জাওয়াদ। আজ যেন রাজ্যের আহ্লাদ ভর করেছে। জাওয়াদ লাই দিয়ে তড়িৎ কোলে তুলে নিল। বলল, ‘আজ এত প্রেম! ‘
‘প্রেম তো প্রতিদিনই ছিল। আপনি কি আজই টের পাচ্ছেন!’
জাওয়াদ হেসে বলল, ‘আজ একটু বেশি টের পাচ্ছি।’

____________

হাইয়্যা আলাস সালাহ্, হাইয়্যা আলাল ফালাহ্। আসসালাতু খাইরুম মিনান- নাউম….

দূর থেকে আযান কানে আসতেই ঘুম ছুটল জাওয়াদের। অলসতা নিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল কিয়ৎক্ষণ। আযানের জবাব দিল। মনে পড়ল, ঘুমানোর আগে দেখা হাজার স্বপ্নের কথা, সন্তানের আগমনী বার্তা। আনমনেই হাসল। বুকটা খালি লাগছে। রাফা তো রাতে বুকেই ঘুমিয়েছিল। গেল কই? চোখে মেলে চাইল জাওয়াদ। ওর দিকে পিঠ করে, ডান কাত হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে শুয়েছে বোধহয়। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় চেয়ে আবার হাসল। ঘুমন্ত মুখখানায় পরশ দিল। সারারাত আহ্লাদের পসরা বিছিয়ে শেষরাতে ঘুমিয়েছে। ঘন্টা দুই হবে না। জাওয়াদ ওকে জাগাল না। ঘুমাক কিছুক্ষণ। মসজিদে যাবার আগে ডেকে যাবে। নিঃশব্দে ওঠে গেল। ফ্রেশ হয়ে, তৈরি হয়ে বেরুবার সময় এসে ডাকল, মৃদু স্বরে,
‘রাফা? রাফা? উঠো নামাজের সময় হয়ে গেছে।’

মুশরাফার ঘুম ভাঙবার নাম নেই। বার কয়েক ডেকে থামল জাওয়াদ। রাতে ঘুম হয়নি, আরেকটু ঘুমাক। সময় আছে ঘন্টাখানেক। জাওয়াদ আধঘন্টা বাদের এলার্ম সেট করে দিয়ে গেল। এলার্মে উঠে যাবে।

এসব ভেবে নামাজের জন্য বেরুলো। যাবার কালে বাবাকে ডেকে নিল।

_______

বাবাকে দেখেই আজ কেন যেন লজ্জা লাগল জাওয়াদের। সুখবরটা সর্বপ্রথম বাবাকে জানাবে বলে সিদ্ধান্ত তার। কিন্তু জানাতে অস্বস্তি হচ্ছে, লজ্জা লাগছে। যাবার সময় সিড়ি বেয়েছে দ্বিধা নিয়ে। মসজিদে ঢুকবার সময় ও বলতে চেয়েছে পারে নি।

নামাজ পড়ে বাবা ছেলে হাঁটে কিছুক্ষণ। আজও হাঁটছে। জাওয়াদ ডাকল, ‘বাবা!’
‘হ্যাঁ?’

জাওয়াদ কথাটা বলবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু বলতে পারছে না। ইতস্তত করছে। জয়নাল আবেদীন খেয়াল করে বললেন, ‘কিছু বলবি, জাওয়াদ?’

জাওয়াদ আমতা-আমতা করে বলল, ‘বাবা একটা কথা বলার ছিল। ‘
– কী কথা? বল!’
আগ্রহী হলেন জয়নাল আবেদীন। জাওয়াদ ইতস্ততবোধ করল। বাবাকে কীভাবে জানাবে তার বাবা হওয়ার খবর! জাওয়াদের চোয়ালে লজ্জার আভা। বাবার চোখে চোখ রাখছে না।

জয়নাল আবেদীন বিচক্ষণ মানুষ। ছেলের মুখ দেখে জয়নাল আবেদীন সাহেব ঘটনা আঁচ করে ফেললেন। তবুও ছেলের লাজুক মুখপানে চেয়ে বললেন, ‘কী?’

জাওয়াদ সময় নিয়ে বলল, ‘আপনি দাদা হবেন?

ওমা ছেলের সে কি লজ্জা! জয়নাল আবেদীন সাহেব প্রসন্ন হাসলেন। ছেলের এমন লজ্জা কখনো দেখেন নি জয়নাল আবেদীন। কী ভীষণ ভালো লাগছে তার! তিনি চমৎকার হেসে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ!’

পরপরেই ছেলের কাঁধ চাপড়ে বললেন, ‘ মাশা আল্লাহ! আমার ছেলেটা বাবা হয়ে যাচ্ছে! কদিন বাদে তারও একটা সন্তান হবে, বাবা বাবা ডাকবে। ভীষণ জ্বালাবে। ভাবা যায়!’

জাওয়াদ লাজুক স্বরে বলল, ‘বাবা দোয়া করবেন, যাতে আমার মতো না হয়ে তার মায়ের মতো হয়। ‘

_____

বাবা ছেলে কথা বলতে বলতে বাসায় ফিরল। জাওয়াদের ভ্রু কুঁচকানো। মুশরাফা ফোন দিচ্ছে, উঠাচ্ছে, কল কাটছে না। একক্ষণে এলার্ম বেজে গিয়েছে। মেয়েটা তাও ঘুমাচ্ছে! অথচ অন্য সময় যত রাতেই ঘুমোক ফজরের সময় একটা এলার্মে উঠে যায়, কল দিলে কেটে দিয়ে বুঝায় উঠে গেছে। আজ উঠছে না! স্ট্রেঞ্জ! দরজা কাছে এসে দাঁড়াতেই জয়নাল আবেদীন বললেন,
‘বাসায় আয়!’
জাওয়াদ বলল, ‘রাফাকে নামাজের জন্য ডেকে দিয়ে আসছি! ‘

জাওয়াদ ডুকল নিজ বাসায়। জয়নাল আবেদীন ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে বললেন, ‘আমার ছেলেটার তো বেশ উন্নতি হয়েছে!’

মায়মুনা প্রশ্নবোধক চাহনি দিলেন। জয়নাল আবেদীন প্রসন্ন হেসে বললেন, ‘আমাদের সেই ছোট্টো, বাউণ্ডুলে অবাধ্য ছেলেটা বাবা হতে যাচ্ছে। ভাবতে পারো!’
মায়মুনা নিজের সন্দেহ ঠিক প্রমাণ পেয়ে হাসলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! আমার তো ছেলেটা দেখেই অবাক লাগে। আমার অগোছালো ছেলেটা বিয়ের পর কেমন বদলে গেল। এখন ওকে দেখেই শান্তি লাগে, কী শান্ত, সুন্দর সুখী মানুষ। এবার ছেলেটা জীবন পূর্ণ হয়ে গেছে। ‘
‘সারাজীবন এভাবেই সুখে থাকুক, আমার ছেলেটা। ‘

___

জাওয়াদ দরজা খুলে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল, ‘রাফা? রাফা? উঠেছো?’

রাফার সাড়াশব্দ নেই। প্রশ্নবিদ্ধ মনে রুমে এলো। ভ্রু কুঁচকে তাকাল বিছানায়। আগের মতোই ঘুমোচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো জাওয়াদ, ‘এই মেয়ে আজ ওঠবে না? নামাজ পড়ার খেয়াল নেই!’

রাফা উঠল না, নড়ল না। জাওয়াদ এসে ওর মাথার কাছে বসল। এলোচুলে হাত বুলিয়ে আলতো করে ডাকল, ‘রাফা? উঠো! ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে তো! নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ো না হয়!’

কোন হেলদোল নেই মুশরাফার। আরও কয়েকবার ডাকল জাওয়াদ। মুশরাফা উঠল না। কেমন অসাড় হয়ে আছে। কোন মুভমেন্ট নেই, রাফার ঘুম তো এত ভারি না। তবে আজ কী হলো! জাওয়াদ বাহু ধরে ঝাকালো, ‘রাফা?’

মৃদু ধাক্কায় মুশরাফার শরীর ওপাশে হেলে পড়ল। জাওয়াদ টেনে উঠে বসাল। কিন্তু মুশরাফা তবুও উঠল না, সব ভার জাওয়াদের উপর ছেড়ে দিল হেলে রইল। কেমন যেন অচেতন লাগল মুশরাফাকে। জাওয়াদ ভয় পেল। কী হয়েছে ওর! আকস্মিক জাওয়াদের চোখ গেল বুকটায়! উঠানামা করছে না। জাওয়াদ গালে হাত দিয়ে কাঁপা স্বরে ডাকল, ‘রা…ফা! কথা বলো! ‘

জাগল না রাফা। জাওয়াদের চোখ ভয় দেখা দিল! কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল, বুক তীব্র ব্যাথা অনুভব করল। সেই ব্যাথা বাড়াতেই বোধহয় খেয়াল হলো নিজের হাতে, মুশরাফার নাকে। মুশরাফার নাকের কাছে জাওয়াদের হাত, অথচ ওর হাতে মুশরাফার নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে না। এর মানে কী! জ্ঞান হারিয়েছে রাফা! অজ্ঞানের কথাই মাথায় এলো জাওয়াদের। কী হয়েছে ওর? বড়ো কোন রোগ নয় তো!
ওর পৃথিবীর নড়ে উঠতেছে যেন। হাত পা থর থর করে কাঁপছে, বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। ভাবতে পারছে না কিছু! হাসপাতালে নিতে হবে, ও একা পারবে না। মাকে ডাকতে হবে!

জাওয়াদ কিভাবে যেন পা টেনে গেল জিশানের বাসার কাছে। কলিংবেল চাপল না। ব্যতিব্যস্ত হয়ে জোরে জোরে বাড়ি দিল দরজায়! কয়েকবারের মাঝে দরজা খুলে গেল। সদ্য নামাজ শেষ করা মায়মুনাকে দরজায় দেখেই জাওয়াদ আতঙ্কিত সুরে উচ্চারণ করল,
‘মা..রাফ….

জাওয়াদের স্বর বেরুচ্ছে না। মায়মুনা ভেবেছেন ছেলেকে তাকে সুখবর দিতে এসেছে। তিনি স্মিত হেসে বললেন, ‘ রাফার কী হলো? মা হবে না কি?’

জাওয়াদ কিছু বলতে পারছে না। থরথর করে কাঁপছে, ওর চেহারা বিধ্বস্ত লাগছে। মায়মুনা খেয়াল করে উদ্ধিগ্ন হলেন, ‘কী হয়েছে?’

বাকরুদ্ধতা ঠেলে অনেক কষ্টে জাওয়াদ উচ্চারণ করল, ‘রা…ফা সেন্স..

মায়মুনা ভয় পেলেন, ‘ রাফার কী! দেখি চল তো!’ বলে তড়িঘড়ি এলেন ছেলের ঘরে। মুশরাফাকে দেখে প্রথমে ভাবলেন, ঘুমাচ্ছে। কিন্তু কাছে গিয়ে অন্যকিছু ধরা পড়ল চোখে। তিনি ভয় পেলেন, বিশ্বাস করতে চাইলেন না। এটা কিভাবে হয়! আতঙ্কিত হয়ে বললেন,
‘ কলি আছে বাসায়। ওকে ডেকে আনি। চিন্তা করিস না, ঠিক হয়ে যাবে। ‘

কাকনের বোন কলি পেশায় ডাক্তার। কাল এসেছে বোনের বাসায়। মায়মুনা কলিকে নিয়ে ফেরত এলেন, সাথে কাকন। কলি এসে পালস রেট চেক করে হতাশ শ্বাস ফেলল। জাওয়াদ ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ক্কী হয়েছে ওর?’

পরবর্তী কথা বলার আগে সময় নিল কলি। একরাশ সহানুভূতি নিয়ে জাওয়াদের পানে চেয়ে বলল, ‘সি ইজ নো মোর….. খুব সম্ভবত ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক করে মারা গেছে। ‘

____________

নতুন অতিথির আগমনের আনন্দে মুখরিত হবার জায়গায় শোকের মাতম ছেয়ে গেল। বসার ঘরে কাকন, যায়েদ, জিশান, কলি গুমোট হয়ে বসে আছে। সবাইকে খবর দিচ্ছে অনিক। এক কোণে জয়নাল আবেদীন অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছেন। কিছুক্ষণ আগেও বাবা হবার আনন্দে ভেসে যাচ্ছিল, কাল রাতে মেয়েটার সাথে কত আলাপ হলো! সব তো ঠিক ছিল। হুট করে কী হলো! এক নিমিষেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। ভেতর ঘর থেকে মায়মুনার বিলাপ শোনা যাচ্ছে। পুত্রবধূর শোকে ভাসছেন তিনি। শেষ দিকে ভীষণ আপন হয়ে গিয়েছিলেন। মরে যাবে জেনে গিয়েছিল মেয়েটা! তাই বলেই কী কাল রাতে অমন মাফ চাইল!
শোকেরা পসরা মেলছে তার মনে।
বিড়াল দুটো দেখে মায়মুনা কেঁদে উঠলেন, ‘তার কানে বাজল, ‘মা আমার বিড়াল দুটো দেখে রাখবেন।’
মেয়েটা কি অসিয়ত করে গেল! শোকের মাঝেই যেন কথা দিলেন মায়মুনা, ‘রাখব।’
আর জাওয়াদ? সে তো এখনো ওভাবেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে বিছানায় শোয়া তার প্রিয়তমার দিকে। তার কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে, সি ইজ নো মোর! আমার রাফা নেই!

ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বুকে তোলপাড় চলছে। বিগত কয়েক ঘন্টার জীবনের সবচেয়ে বড়ো দুটো ধাক্কা খেয়েছে। এখন সামলে উঠতে পারছে। সব স্বপ্ন লাগছে। মুশরাফা মারা গেছে এটা বিশ্বাস করতে পারছে না জাওয়াদ। সারারাতে কত পাগলামো করল, এসব কি ছেড়ে যাবার জন্যই? তারপর তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাল। ঘুমের ঘোরে অপাশ হয়েছিল জাওয়াদ। একটু ধস্তাধস্তি ও অনুভব করেনি। তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটি মারা গেল অথচ সে টের পেল না। এত নিশ্চুপ মৃত্যু হয়! ওর বুকটা তো এখনো গরম হয়ে আছে, মনে হচ্ছে মুশরাফার মাথা ওর বুকে। কানে বাজছে শেষ কথাটা, ‘আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।’
এমনটা হয় না কি! হয় না, হতে পারে না। এটা স্বপ্নই। একটু পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। রাফা উঠবে, ওর সাথে কথা বলবে। এমন আশা নিয়ে চেয়ে রইল।

আয়োজন করে আমেজ আর পূর্ণতা নিয়ে মেয়ের বাড়িতে আজ সকালেই আসার কথা ছিল লায়লাদের। তারা এলেন ঠিকই তবে সুখ নিয়ে নয় শোক নিয়ে, অপূর্ণতা নিয়ে। মুশরাফাকে নিয়ে গল্প করতে করতে রাত কেটেছে সবার। শেষ রাতের দিকে ঘুমোতে যাবার পরেই ফরিদা এসে এমন খবর দিলেন। প্রথমে তো বিশ্বাসই করতে পারলেন না তারা। কাল রাতেও সব ঠিক ছিল, মেয়েটা হাসিমুখে বিদায় নিয়ে গেল। হুট করে ভালো মানুষ মারা গেল কিভাবে! মেনে নিতে পারল না। ঘোরে চলে গেল। বেরুতেই মুর্ছা গেলেন লায়লা। সবাই হতভম্ব। কোনমতে এসেছে এখানে। তারা আসতেই কান্নার রোল পড়ল। মায়মুনা ফরিদাকে ধরে ঢুকরে উঠল। ফারুকী, নাজমুল সাহেব, তারিফ নির্বাক চোখে চেয়ে রইলেন। কেউ এখনো মেনে নিতে পারছে না। লায়লা মেয়ের পাশে বসলেন, ছুঁয়ে দেখলেন, ডুকরে উঠলেন।

তারিফ জাওয়াদের কাছে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘কীভাবে হলো?’
জাওয়াদ অসাড়, নিশ্চল। যান্ত্রিক মানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর দিল না। কাকন জবাব দিল, ‘ঘুমের মাঝে স্ট্রোক করেছে।’

তারিফ এসে পাশে বসল। হাত ধরে বলল, ‘এই মুশি! উঠ না!’

মুশি উঠল না। তারিফের গাল বেয়ে জল গড়াল। মায়মুনা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
‘কাল রাতে সুখবর পেয়েছে। আজ সবাইকে জানাবে কত খুশি! বাবা মা হবে শুনে দুজনে খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। সব শেষ হয়ে গেল!

মা হবার সংবাদে কান্নার বেগ বাড়ল। ফরিদা, নাজমুল সাহেব, লায়লা, জায়ফার কান্না বাঁধ ছাড়ল। ডুকরে উঠলেন ফারুকী ও। নিজ হাতে লালন করা মেয়ের শোকে কাতর হলেন ফরিদা, নাজমুল সাহেব। কাল আসবার সময় কী মায়া নিয়ে বিদায় দিয়ে এসেছে সবাইকে। সেটাই ছবি শেষ দেখা ছিল!

কেটে গেল অনেকক্ষণ। আত্মীয় স্বজনে ঘর ভরতি হতে শুরু করেছে। জাওয়াদ তখনো অসাড় হয়ে বসে আছে। না কাঁদল, না কিছু বলছে। সে মুখ খুলল, যখন কাকনের মা বললেন,
‘ আপা, লাশ মেঝেতে নামিয়ে ফেলুন।’

‘ লাশ!’ শব্দটা ধাক্কা গেল জাওয়াদের কানে। কেমন রেগে তাকাল, ‘লাশ বলবেন না। রাফা ডাকবেন ওকে। রাফা থাকুক খাটে। কোন বেগানা পুরুষ যেন না আসে, ওর পর্দার খেলাপ হবে। ‘

সবাই ব্যথিত চোখে তাকাল জাওয়াদের দিকে। ভদ্রমহিলা চুপ হয়ে গেলেন। জাওয়াদ মুখ চেপে বসে রইল এবার। নাজমুল সাহেব এগিয়ে গেলেন জাওয়াদের দিকে। এই পক্ষের একমাত্র তিনিই ভালো জানেন রাফার প্রতি জাওয়াদের অনুভূতি কেমন। ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছে। তিনি জাওয়াদের কাধে হাত রাখলেন, ‘জাওয়াদ!’

জাওয়াদ মুখ তুলে চাইল। কী অসহায় সেই চাহনি! কাতরতা নিয়ে বলল, ‘ আমি কি স্বপ্ন দেখছি, মামা! রাফা সত্যি মারা গেছে! ‘

নাজমুল সাহেব বুকে টানলেন জামাতাকে। ডুকরে উঠলেন, ‘সত্যিই চলে গেছে। আর আসবে না।’

জাওয়াদ কেমন করে বলল, ‘আমার রাফা.. না মামা! ‘ পাগলামো করছে জাওয়াদ। ওর পাগলামো দেখে সবার দুঃখ বাড়ল। অনিক আফসোস নিয়ে বলল, ‘জাওয়াদ শেষ হয়ে যাবে।’

জাওয়াদের অবস্থা দেখে তারিফ বলল, ‘মানুষ চলে আসবে। পরে সুযোগ পাবেনা। জাওয়াদকে একটু রাফার সাথে থাকতে দিন। ছেলেটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।’

_______

জাওয়াদ ধীর পায়ে এসে বসল পাশে। ডাকল আলতো করে,
‘রাফা? এ্যাই রাফা? প্লিজ সব মিথ্যা প্রমাণ করে একটাবার তাকাও, কথা বলো!’

রাফা মিথ্যা প্রমাণ করল না! মুশরাফার গায়ে এখনো তার দেয়া লাল শাড়ি। কী সুন্দর লাগছে ওকে! কাঁপা হাতে জাওয়াদ রাফার মাথাটা রাখল নিজের কোলে। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিও গাল, কপালে আসা চুল সরিয়ে দিল। মুশরাফার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, উজ্জ্বল মুখ। আনন্দমাখা ঘুম যেন পেয়েছে তার। জাওয়াদ ওই হাসিটা ছুঁয়ে দেখল। পেটে আলতো হাত রাখল। কত স্বপ্ন, কতো ভালোবাসা সব শেষ। জাওয়াদের মনে পড়ল কাল রাতের কথা।

শুয়ে পড়েও আহ্লাদে ভাটা পড়েনি মুশরাফার। ঘুম নামছিল না তার চোখে, তাই চোখ ভরতি ঘুম থাকা জাওয়াদকে ঘুমোতে দেয়নি । পাগলামো করছে। গভীর চোখে দেখেছে জাওয়াদকে। পলক অবধি ফেলছিল না। জাওয়াদ তাড়া দিল তখন,
‘রাত অনেক হয়েছে, এবার ঘুমাও প্লিজ!’

মুশরাফা চোখ বন্ধ করল না। জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে রইল অনিমেষ। গভীর স্বরে বলল,
‘আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ‘

জাওয়াদ তখন রসিকতা করে বলল, ‘সব দেখা আজই শেষ করবে না কি! কালকের জন্য কিছু রাখো?’
মুশরাফা হেয়ালি সুরে বলল, ‘হ্যাঁ, সব আজকে দেখে শেষ করব। কাল যদি না পাই?’

জাওয়াদ ও বলল, ‘ হাজার মানুষ থাকলে ও আমি তোমার জন্য সবসময় এভেইলেবল। কাল সকালে আমি বসে থাকব, যতক্ষণ ইচ্ছে দেখো। আমি বাধা দিব না। এবার ঘুমাও।’

লাইট নিভিয়েকে বুকে টেনে চোখ বুজল জাওয়াদ। মুশরাফা চোখ বুঝল না। বুকে মাথা রেখে নিশ্চুপ চেয়ে রইল আঁধারে।

জাওয়াদের চোখ লেগে আসবে আসবে তখন হুট করে কানে এলো,
‘ আপনি আমার জীবনটা রাঙিয়ে দিয়েছেন। অপছন্দ সত্ত্বেও আমার পরিবারকে মেনে নিয়েছেন।সব দিয়েছেন। আল্লাহ এর বিনিময়ে আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন। আমি আপনার উপর সন্তুষ্ট, ভীষণভাবে সন্তুষ্ট। আপনার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। যা আছে তা হলো শুধু ভালোবাসা আর তুষ্টতা। আপনি কি আমার উপর সন্তুষ্টি? ‘

কথাটা জাওয়াদের কানে গেল, কিন্তু মন অবধি গেল না। ঘুমে তখন অসাড় অবস্থা ওর। খানিকের মাঝেই চোখ লেগে এলো। মিনিট দুয়েক বাদেই আবার ভেঙে ও গেল। কেউ একজন খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে, অক্টোপাসের মতো। বুকে মাথা রেখে ফোঁপাচ্ছে। জাওয়াদ ঘুম ছুটে গেল। উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
‘কী হয়েছে রাফা, কাঁদছো কেন? খারাপ লাগছে?’

ভেজা স্বরে মুশরাফা বলল, ‘খারাপ লাগছে না, তবে কান্না পাচ্ছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে।’

মাঝরাতে এই অদ্ভুত আচরণ করছে মেয়েটা। হলো কী এই মেয়ের! জাওয়াদ তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিয়ে গুগল করল। গবেষণার পর এলো, প্রেগ্ন্যাসির প্রথম ক’মাসে মুড সুইং হয়। এই কান্না, এই হাসি। ফোন রেখে জাওয়াদ আলতো স্বরে বলল, ‘ তোমার মুড সুইং হচ্ছে, রাফা। প্রেগন্যান্সির ইফেক্ট। একটু ঘুমাবোর চেষ্টা করো। ঠিক হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ। ‘

মুশরাফার কানে কথা গেল না। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি।’

চিন্তার মাঝেও হেসে ফেলল জাওয়াদ। মাথায় চুমু খেয়ে বলল, ‘ আমি ও আপনাকে ভালোবাসি। এবার আসো, এবার ঘুমাও।’

মুশরাফা শান্ত হলো। কেমন করে বলল, ‘আপনি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবেন?’

কী আকুল নিবেদনে! বুকে লাগল জাওয়াদের। প্রসন্ন স্বরে বলল, ‘ আচ্ছা, আমি মাথায় বিলি কাটছি। চোখ বন্ধ করো।’

অতঃপর নিজেই ঘুম পাড়িয়ে দিল জাওয়াদ প্রিয়তমা। শেষ ঘুমই পাড়িয়ে দিল। এমন জানলে কখনোই ঘুম পাড়াতো না।

জাওয়াদ নিজের বুকে হাত দিল। বুকটা যেন এখনো গরম, মুশরাফার মাথার চাপ আছে। কানে বাজছে, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি!’ জাওয়াদের খুব আফসোস ছিল, মুশরাফা ওর কাছে আহ্লাদ করে না। কাল রাতে এক জীবনের আহ্লাদ করেছে। চলে যাবে এই জন্যই কী! সে বলে ছিল, আমি সব দেখা আজ দেখে ফেলব। কাল যদি সুযোগ না পাই! আসোলেই কাল সুযোগ পায়নি। মেয়েটা কি জানতো? না হলে ওমন আচরণ করেছে কেন! চলে যাবে যেনেই কি ওমন কেঁদেছিল! ঘুমাবেনা জেদ ধরেছে। সে জোর করে ঘুম পাড়িয়েছে। নিজ হাতে ঘুম পাড়িয়েছে। জাওয়াদ কাতর স্বরে বলল,
‘বিশ্বাস করো, আমি যদি জানতাম তুমি ঘুমালে আর জাগবে না, তবে তোমাকে ঘুমোতেই দিতাম না। আমি যদি জানতাম, শেষ দেখা বলেই তুমি এত দেখছিলে, তবে আমি ও দেখে নিতাম। ‘

জাওয়াদের কাতরতা বাড়ল,
‘তুমি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে গেছো রাফা!’
‘আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকব বলো! আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে রাফা!’

‘তোমার আমার পথচলা এখানেই শেষ, রাফা! এত তাড়াতাড়ি! তুমি আর কখনোই আসবে না আমার কাছে! আমাকে গুছিয়ে দিয়ে চলে গেছো, এখন তোমাকে ছাড়া এই গুছানো জীবন দিয়ে কী করব আমি! কিভাবে থাকব আমি?’

আকস্মিক ওকে ওঠিয়ে বুকে নিল। কাঁধে মুখ গুজে ডুকরে কেঁদে উঠল। এতক্ষণের চাপা কান্না উগড়ে দিল। জাওয়াদের কানে বাজল, মুশরাফার পূর্নতা নিয়ে মৃত্যুর দোয়া। সে বলল, ‘ তুমি ভীষণ স্বার্থপর, নিজের পূর্ণতায় হারাতে চাইলে। একটাবার আমার কথা ভাবলে না। দোয়া চাইবার সময় আমার মৃত্যু ও চাইতে। আমি এখন থাকব কিভাবে?’

জাওয়াদ কান্নায় ভেঙে পড়ল। মুশরাফার বলেছিল, ‘তাহলে যাই? তখন কিন্তু কাঁদতে পারবেন না। আমি আগেই বলে দিচ্ছি, আপনার চোখের পানি মুছব না।

রাফা এই যাওয়ার ইঙ্গিত করেছিল! জাওয়াদের চোখের জলে মুশরাফার কাধ ভিজে যাচ্ছে। মুশরাফা তার কথামতো চোখের পানি মুছে দিচ্ছে না। জাওয়াদ শক্ত করে মুশরাফার মাথা বুকে চেপে ধরল, ‘ আমাকে হাজার স্বপ্ন দেখিয়ে, আমার স্বপ্ন নিয়েই চলে গেলে! তুমি গেলে, আমার সন্তান গেল। সব নিয়ে গেলে তুমি। সব..’

জাওয়াদ মুশরাফাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। চোখ বেয়ে ঝরছে জল। খানিক বাদে মুশিরাফার মুখে চুমু খাচ্ছে, চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। বলছে, আমি তোমাকে ভালোবাসি রাফা।

আমি তোমার উপর সন্তুষ্ট।

রাফা তুমি সারাজীবনের জন্য চলে গেলে! আমি তো মরে যাব রাফা!

___________

লায়লা যেন মেয়েকে পেয়েও পেলেন না। ক্ষমা পেলেন কিন্তু মেয়েকে পেলেন না। মেয়ের সাথে নামাজ পড়া হলো না তার। মেয়ের জন্য কেনা কাপড় দেয়া হলো না তার, মেয়েকে নিজের বাড়িতে নেয়া হলো না, মেয়ের জন্য সাজানো রুমটায় মেয়েকে দেয়া হলো না। ঘটা করে আবার মেয়েকে বিয়ে দেয়া হলো না। কত হাজার স্বপ্ন বুনে ছিলেন, সব অপূর্ণ রয়ে গেল। মেয়ের সাথে সময় কাটাতে পারলেন, দুটো দিন রাখতে পারলেন না, নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে পারলেন না। মা হওয়ার সুযোগ পেয়েও সময় পেলেন, তিনি মা হতে উঠতেই পারলেন না। কিছুই পারলেন না। এক জীবনের আফসোস থেকে যাবে তার। তিনি যা অন্যায় করেছেন তার ক্ষমা পেয়েও সুযোগ পেলেন না। তার দুঃখ দিগুণ হলো।

অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলেও সত্যি সাফা এসেছে বোনের মৃত্যুর খবর পেয়ে। ফারুকী আর সাফা যখন কফিনের কাছে গেলেন তখন একটা অঘটন ঘটালেন লায়লা। লায়লা ঝড়ের বেগে উঠে এসে ওদের নিয়ে গেলেন দূরে, বাসার বাইরে। তীক্ষ্ম স্বরে বললেন,
‘ তোমার চাওয়া পূর্ণ হয়েছে। তোমাদের খুশি হওয়া উচিত, পথের কাটা সরে গেছে। যাও পার্টি করো। আমার মেয়েকে দেখবে না তোমরা। দূর হও। আমার মেয়েটাকে মন থেকে টেনে নিলেনা। এতসব অভিনয় করলে। তোমরা আমার মেয়ের মৃত্যু কামনা করেছো তাই না? তোমাদের জন্য হয়েছে এসব। আমাকে বা আমার মেয়েকে তোমাদের মুখ দেখাবে না। বেরিয়ে যাও!’

লায়লা পাগলের মতো আচরণ করছেন। সাফাকে চড় থাপ্পড় ও দিলেন। ফরিদা এসে টেনে নিয়ে গেছেন শেষে। ওরা যেতেই সাফা বলল,
‘ট্রাস্ট মি, ড্যাড আমি কখনোই মন থেকে রাফার মৃত্যু চাইনি। ওকে অপছন্দ করতাম ঠিক, কিন্তু মৃত্যু চাইনি কখনো। ‘

মৃত্যুর পর শত্রু ও না কি বন্ধু হয়ে যায়। সাফার ক্ষেত্রে ও হলো তাই। কাল অবধি বোনের জন্য টান অনুভব করল না, যেই মরে গেল অমনি টান অনুভব করল। বোনের মৃত্যু মানতে পারল না। ছোটোবেলার স্মৃতি মনে পড়ল। বোনের স্মরণে চোখে পানি এলো। ওর চোখে অনুশোচনা দেখা গেল। কী ভীষণ কাতর, অসহায় দেখাল ওকে। ওর মন নিবেদন করল, রাফার সাথে একটাবার কথা বলার।

ফারুকী অসাড় দাঁড়িয়ে রইলেন। খানিক বাদেই ডুকরে উঠলেন। তার চোখে ও নিবেদন। জীবন দ্বিতীয় সুযোগ দিলেও সময় দেয় না। তারা কেউ সময় পেল না। এতকাল মুশরাফা নিবেদন করেছে এবার তাদের পালা। তারা ক্ষমা পেয়েও পান নি। সবাইকে আক্ষেপ, আফসোসে ভাসিয়ে পূর্ণতা নিয়ে চলে গেল মুশরাফা। সবাই ভালো হয় না, সবাই ভালো হওয়াটা ও মানায় ও না। কিছু মানুষ খারাপই থেকে যায় কিন্তু শাস্তি ঠিকই পায়।

আপাতদৃষ্টিতে মুশরাফা ভীষণ সুখী সময়ে মারা গেছে। ওর জীবনে পূর্ণতা ছিল। সবাই আপন মানুষ। পরবর্তী সময়ে হয়তো সবাই আপন নাও থাকতে পারত। সাফা কিংবা বাবার চেহারা সামনে এলে পূর্ণতায় ভাটা পড়ত।

কফিন পরা রাফার পাশে কুরআন নিয়ে বসা জাওয়াদ। মুখ নাড়িয়ে সুরা ইয়াসিন পড়ছে। চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। চোখ মুখতেছে, আবার পড়তেছে। এক পর্যায়ে আর পারল না। কুরআন বন্ধ করে মুখ চেপে শব্দ করে কেঁদে উঠল। এ কান্না থামবার নয়! জয়নাল আবেদীন এসে ছেলের মাথায় হাত দিলেন,
‘ওকে শেষ দেখা দেখে নে, জানাজার জন্য নিয়ে যাব।’

জাওয়াদ অশ্রুজলে চোখ ভাসিয়ে বলল, ‘শেষ দেখা! আর দেখব না । ও তো আর আসবে না, তাই না বাবা?’ বাচ্চাদের মতো করে বলল জাওয়াদ।

জয়নাল আবেদীন আহত স্বরে বললেন, ‘এটাই নিয়তি বাবা!’

জাওয়াদ আকুল আবেদন করল, ‘রাফা আমার কাছে আরেকটু থাকুক, বাবা!’

শেষ বিদায়ের সময় সবাই কাঁদল। সবার কান্নায় শোক, হাহাকার মেশানো। শুধু তিনজন মানুষের কান্নায় সুরে নিবেদন মেশানো। এই নিবেদন শেষ হবার নয়। অজীবনের, শাস্তির। অনুতাপ, আফসোস, না পাওয়ার বেদনার ভার বয়ে বেড়ানোর যে শাস্তিতে পড়ে, সেই শাস্তির চেয়ে বড়ো কোন শাস্তি নেই। এই তিনজন মানুষ আজীবন কেঁদে যাবেন, পুড়ে মরবেন, ভিন্ন অর্থে। বলতে পারবেন না, সইতে পারবেন না। কেমন সমস্যা পাবেন, সমাধান পাবেন না। নিবেদন উপর দিয়ে সমাধান নিয়ে যে চলে গেছে মুশরাফা।

সমাপ্ত….

• বিঃদ্রঃ -১ ‘নিবেদন’ নামের সার্থকতা আজকের এই পর্বে। গল্পটা এভাবে ভাবা হয়েছে, লেখা হয়েছে। সব মানুষ ভালো হয় না, ভালো হলে মানায় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে হ্যাপি এন্ডিং দিলে অসম্পন্ন থেকে যেত।
আর বাস্তবতা হলো, অনেক সময় জীবন দ্বিতীয় সুযোগ দিলে ও সময় দেয় না। সময় থাকতে মূল্য বুঝতে হয়। না হলে অকালে হারিয়ে শিক্ষা হয়।
বাস্তবতা কল্পনার মতো হয় না। বাস্তবতা হয় কঠিন, ধাক্কা লাগে আকস্মিক।

মুশরাফার দিকে থেকে ভেবে দেখলে এই মৃত্যু সুন্দর। এমন সুখী আর সন্তুষ্ট নিয়ে কজন মরতে পারে? ওর জীবন পূর্। হ্যাপি এন্ডিং দিতে গেলে এই পূর্ণতা আসতো না।
আর মৃত্যু অনিবার্য, অবধারিত, কল্পনাতীত।

• বিঃদ্রঃ -২ এই পর্ব লিখতে গিয়ে ইমোশনাল হয়ে গেছি। রি-চেইক করা সম্ভব হয়নি। ভুল হলে ইনবক্সে বলবেন।

• সমাপ্তি কথা- দীর্ঘ ছ’মাসের জার্নিতে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ পাঠকবৃন্দ। অনেক অপেক্ষা করিয়েছি, তাও যে পাশে থেকেছে তার জন্য সত্যি আমি কৃতজ্ঞ। পাঠক প্রতিক্রিয়া জানাবেন আমার গল্প গ্রুপে। আমি অপেক্ষায় থাকব।

ধন্যবাদ, ভালোবাসা নিবেন। দোয়া করবেন। দেখা হবে নতুন কোন গল্পে, ইনশা আল্লাহ।

জাযাকুম-আল্লাহু খায়রান।

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here