স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ,(পর্ব-১৬)

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ,(পর্ব-১৬)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

ঝড়ের পূর্ব গুমোটতার মতো ভয়ংকর দেখাচ্ছে জাওয়াদকে। চোখে মুখে রাগের চটা নেই, অদ্ভুত একটা নির্লিপ্ততা প্রকাশ পাচ্ছে। তীব্র শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মুশরাফার দিকে। মুশরাফা ও চেয়ে আছে, ওর স্বর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এত শীতলতায় জমে যাওয়ার চেয়ে গরমে পোড়া ঢের ভালো। চুপ না থেকে কিছু বলে দিক। ওর দৃষ্টিতে অনুরোধ, ‘যাওয়ার অনুমতি দিন না প্লিজ!’

জাওয়াদ নাকের ডগা ফুলিয়ে বলল, ‘ আমি মন থেকে কখনোই তোমাকে ওই পরিবারের কাছে যাবার অনুমতি দিব না। তাও যদি যেতে চাও, তবে যাও।’

‘হাদিসগুলো শুনে ও এমন বলছেন?’

‘হাদিস শুনেই শান্ত আছি। নয়তো এতক্ষণে তুমি এখানে থাকতে না।’

‘ তো আমি কি এখন যাব?’

জাওয়াদ নিরবতার চাদরে গা ঢেকে রইল। অনুমতি দিতে ইচ্ছুক নয় সে। জাওয়াদের মতের বিপক্ষে গিয়ে ভাইয়ের কাছে যেতে ও অনিচ্ছুক মুশরাফা। লুকোচুরি নেই তার মাঝে, যা করবে সম্মুখে। তা ছাড়া এতে জাওয়াদের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হবে। প্রাণপ্রিয় স্বামীর বিরহ সইবার ক্ষমতা নেই মুশরাফার। তবে ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে ও অনড়। সাক্ষাৎ সে করবেই, আর তা জাওয়াদের অনুমতি নিয়েই। মুশরাফা ওর হাত ধরে বলল,
‘ আজ ভাইয়ার সাথে কথা বলতে দিন, আমি আর কখনো আপনার কাছে কিছু চাইব না ইন শা আল্লাহ। আমার এই একটা চাওয়া রাখুন, প্লিজ!’

জাওয়াদ শান্ত চোখে চেয়ে রইল ওর দিকে। তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না। সময় নিল, ভাবল। ভেবেচিন্তে বলল,
‘ আমার কয়েকটা শর্ত আছে। শর্ত মানলে যেতে পারবে তুমি।’

মুশরাফার চোখে আশার আলো দেখা গেল। সে আগ্রহী হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী শর্ত?’
জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল,
‘শর্ত-১. তুমি তারিফের সামনে গিয়ে কাঁদতে পারবেনা। কোনভাবে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে পারবে না। তোমাকে গম্ভীর থাকতে হবে।’

মুশরাফা তড়িৎ বলল, ‘কথা দিতে পারছি না। তবে আমি চেষ্টা করব।’
‘কথা দিতে হবে। আমার স্ত্রী কোন অপরাধীর কাছে নত হবে, চোখের জল ফেলে দুর্বলতা প্রকাশ করবে এটা আমি মানতে পারব না। ইসলাম ভালো ব্যবহার করতে বলছে, অপরাধ না করলে নত হতে তো বলেনি। চোখের পানি ছেড়ে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতেও বলেনি। তাই আমি চাইছি, আমার স্ত্রীর পার্সোনালিটি স্ট্রং থাকুক। আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে না কাঁদুক। ভালো ব্যবহার করুক, কিন্তু নত না হোক।’

কী সুন্দর কথা! মুশরাফা চমৎকার হাসল। মাথা নেড়ে সায় জানাল। ‘আচ্ছা, পরের শর্ত কী?’

‘শর্ত-২. আমি তোমার ভাইয়ের সামনে যাব না। তবে তোমার কথা শুনব। সবার অগোচরে আড়িপেতে কারো কথা শোনার মতো খারাপ অভ্যাস আমার নেই। আমি এটা পারব না। তাই তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি। তুমি বসার ঘরে যাবে। যতক্ষণ কথা বলবে, ততক্ষণ আমি ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে শুনব। যদি ওই তারিফ তোমার সাথে বিন্দুমাত্র মিসবিহেভ করে তবে আমার হাত উঠে যাবে। তার অবস্থা বিয়ের আগে তোমার মতো হবে। এতে আমাকে বাধা দিয়ে পারবে না তুমি।’

মুশরাফা শুনল, বুঝল। আড়িপাতার কথায় হাসি ও পেল। কী ইনসিকিউর লোকটা! পাড়ার মহিলাদের মতো আড়ি পাতবে, আবার অনুমতি ও চাচ্ছে। অবশ্য এটাকে অনুমতি বলে না, জানানো বলে। এই দুঃখঘন মুহুর্তে মুশরাফা হেসে ফেলল। আরও গা ঘেঁষে বসে গভীর স্বরে বলল,
‘ আমার সাথে আপনি মারতে পারবেন? আপনার হাত উঠবে?’

জাওয়াদ সরে বসল। রেগে বলল, ‘ একদম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবে না। ভার্সিটি লাইফে ঝামেলায় পড়ে ছেলে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর রেকর্ড ও আছে আমার। দু’দিন হলো ভালো হয়েছি। তাও পুরোপুরি না, এখনো আগের অনেক অভ্যাস রয়ে গেছে, সেই সাথে রাগটাও। আমি বা আমার প্রিয়জনের সাথে মিসবিহেভ করা মানুষদের ক্ষমা করতে এখনো শিখিনি আমি। সুতারাং, আমাকে মনভোলানো কথা বলতে আসবে না।’

মুশরাফা আবার হাসল। ফিরতি ঘেঁষে বসে বলল,
‘বুদ্ধিমানরা কখনোই প্রতিশোধ নেয় না, ঝগড়া করে না। একজন মানুষ এক তরফা তাদের যতই খারাপ ব্যবহার করে যাক, সে উলটো খারাপ ব্যবহার করে না। বরং ভালো ব্যবহার করে। তারা শুধু ভালোবাসে, ঘৃণা করতে জানে না। ভালোবাসা আর ভালো ব্যবহারের চেয়ে কঠিন প্রতিশোধ আর কিছুতে নেই। যেমন ধরুন, একজন মানুষ আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করে গেল। আপনি চুপ রইলেন। হুট করে একদিন দেখা হবার পর, আপনি হেসে সালাম দিলেন। তাকে সাহায্য করলেন এবং চলে গেলেন। তখন তার মাথায় একটা প্রশ্নই আসবে, ‘আমি কি নির্দোষ একজনের সাথে দোষ করে এসেছি?’
তার অনুশোচনা হবে। জানেন অনুতাপের চেয়ে বড়ো শাস্তি পৃথিবীতে নেই। এটি সোজা মস্তিষ্ক ঘা বসায়, শান্তি কেড়ে নেয়। নিজেকে নিজের কাছে হারিয়ে দেয়। আমি কী করলাম? এই প্রশ্ন তাকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। তার খারাপ ব্যবহারে আপনি যতটা না কষ্ট পেয়েছেন, আপনার সাথে খারাপ ব্যবহারের কথা মনে করে সে হাজার গুন বেশি কষ্ট পাবে, দিনের পর দিন। চাইলেই সে ক্ষমা চাইতে পারেনা। ক্ষমা চাইতে না পারাটা দহন বাড়ায় অধিক।
শরীরের ঘা শুকায়, মনের ঘা শুকায় না। মানুষকে শরীর দিয়ে নয়, ভালো ব্যবহার দিয়ে মানুষিক শান্তি, শাস্তি দুটোই দেয়া যায়। শরীরিক ঘা দিয়ে আপনি কখনোই কারো মনে জায়গা করতে পারবেন না, তার চোখে নিজের জন্য সম্মান বসাতে ও পারবেন না। ভালো ব্যাবহারের মাধ্যমেই পারবেন। এটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এ ক্ষেত্রে আমি নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করি।’

জাওয়াদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে গেল। কী চমৎকার লজিক মেয়েটার! এই মেয়ে সত্যি মানুষিক ভাবে শাস্তি দেয়। তাকে ও তো দিল। তার মাকে ও দিয়েছে। দুজনের এখন বড্ড আপন সে। জাওয়াদের ভাবনার মাঝে মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ আমি চাইলে আপনার উদাহরণ ও দিতে পারি। আপনার সাথে ও তো আমার সম্পর্কটা খারাপ ছিল। আমি আপনার চোখের বালি ছিলাম, এখন চোখের তারা হয়ে গেছি। ভালো হবার পর আমার সাথে মিসবিহেভের জন্য আপনি যে এখনো মানুষিক শাস্তি পাচ্ছেন, তাও কিন্তু আমার জানা। প্রতি রাতে তাহাজ্জুদে কান্নায় মাঝে আমি আপনার অনুশোচনা দেখতে পাই। আমি কিন্তু কখনোই আপনার সাথে ঝগড়া করিনি, আপনাকে আঘাত করিনি, তবুও চাল বদলে গেছে। এমন করে সব সম্পর্ক বদলায়। দরকার শুধু সময় আর সুযোগের। আমি আপনাকে সুযোগ দিয়েছি, আপনি ভাইয়াকে সুযোগ দিন।’

জাওয়াদ বিব্রতবোধ করল। অন্যদিকে ফিরে চাপা শ্বাস ফেলল। মেয়েটা টের পেল কী করে! এই যে অনুতাপটা তাকে ভেতরে ভেতরে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মুশরাফাকে দেখলেই ভালোবাসার সাথে সাথে অনুতাপ ও আসে। এতো ভালো মানুষের সাথে সে এত খারাপ ব্যবহার করেছে! ব্যাপারটা ওকে শান্তি দেয় না। ক্ষমা ও চাইতে পারেনা, ইগোতে লাগে। আল্লাহকেই বলে, কাঁদে। এটা তো সে আর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। বিচক্ষণ মেয়েটা জানল কী করে! জাওয়াদের রাগ হলো, মেয়েটার দুরদর্শিতা এত প্রখর হতে হবে কেন? না হলে কী হতো? সে প্রসঙ্গ বদলাল।,

‘তৃতীয় শর্ত, আজ তারিফ তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করলে ও তুমি তার কথায় ওই বাসায় যাবার নাম নিবে না। তুমি ততক্ষণ অবধি যাবে না, যতক্ষণ অবধি ওই বাসার প্রতিটা মানুষ তোমার সাথে করা অন্যায়ের জন্য অনুতপ্ত হয়। তোমাকে নিবেদন করে, ক্ষমা চেয়ে তোমাকে বাসায় ফেরার অনুরোধ করে।
। তোমার জন্য ওদের চোখে রাগ বিতৃষ্ণার পরিবর্তে মেয়ে হিসেবে সম্মান এবং ভালোবাসার রেখা দেখা যাওয়ার পরেই তোমাকে আমি ওই বাসায় যেতে দিব। যাতে কোন মন্দ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফিরতে না হয়, কোন কটু কথা শুনতে না হয়। তার আগে তুমি ওই বাসায় যাবার জন্য আমার কাছে অনুরোধ পত্র নিয়ে হাজির হবে না। তারা কল দিলে ধরতে পারবে, কিন্তু সম্পর্ক ঠিক না হওয়া অবধি নিজ থেকে কল দিতে পারবে না। দেখা হলে কথা বলতে পারবে, কিন্তু নিজ থেকে দেখা করতে পারবে না। এটা আমাকে ওয়াদা করতে হবে। ‘ জাওয়াদকে রাশভারি দেখাল।

এই ক্ষণে এসে আটকাল মুশরাফা। করুণ চোখে চেয়ে রইল সে। পরিবারের সাথে তো দেখা নেই, কথা নেই। কিন্তু তারা তো মনে আছে। চুপটি করে কত কাঁদে। এই একটা বিষয়ে ভীষণ দুর্বল সে, অল্পতেই ভেঙে চুরে দেয়। পরিবারের কথা এলেই শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বে ফাটল ধরে তার। কান্না আসে ভীষণ। মাঝে মাঝে মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে, কথা বলতে ইচ্ছে হয়। মামীর বাসায় এলেই মামীর ফোন থেকে কল দিয়ে মায়ের গলা শুনে। এবার সেটাও হবে না? কত কঠিন শর্ত দিল লোকটা! একবার যদি প্রতিশ্রুতি করে ফেলে আর ফেরাতে পারবে না, কারন ওয়াদা ভঙ্গ করলে মুনাফিকের দলভুক্ত হয়ে যাবে সে। আর যদি না করে তবে জাওয়াদ তারিফের সাথে দেখা করতে দিবে না, উপরিলাভ হিসেবে তাদের সম্পর্কে বিবাদের সৃষ্টি হবে। কথা বলা বন্ধ করে দিবে জাওয়াদ। এটা আরও কষ্টকর। কোনদিকে যাবে সে? মুশরাফা যেন চোখে সর্ষে ফুল দেখলো।
‘এত কঠিন শর্ত দিবেন না প্লিজ! উনারা আমার পরিবার। উনাদের ব্যাপারে আমি আবেগ কাবু করতে পারি না।’

জাওয়াদের চোখে রাগ ভাসল। রাগ রাগ নিয়ে বলল, ‘ইউ আর জাওয়াদ’স ওয়াইফ। কোন ফেলনা না যে চাইলেই কেউ এসে অপমান করে যেতে পারবে কিংবা জেসে গিয়ে অপমান হতে হবে। এতটা খারাপ সময় আসেনি। নেহাৎ তুমি এ ব্যাপারে ইমোশনাল বলে, নয়তো আমি সারাজীবনে ও তোমাকে ও বাড়িমুখো হবার অনুমতি দিতাম না। ওকে দেখেই যে আমার হাত উঠেনি সেটা নিয়ে তোমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। আমি ইসলামের কথা ভেবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আছি, ধৈর্য ধরছি, সুযোগ দিচ্ছি। এর বাইরে কিছু আশা করবে না, আমি এখনো এতটা ভালো হইনি যে ধৈর্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারব। এই তিনটা শর্ত পূরণ করতে পারার অঙ্গীকার দিতে পারলেই আমি তোমাকে যাবার অনুমতি দিব। নয়তো না। ‘

কথা গুলো সুন্দর। একজন স্ত্রীর জন্য সুখকর। তার স্বামী তার জন্য কতটা ভাবে! কিন্তু একজন মেয়ের জন্য দুঃখের তার স্বামী তাকে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করবার পায়তারা করছে। একজন স্ত্রী নয়, একজন মেয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবেই মুশরাফা খুশি হতে পারল না। হেসে সায় জানাতে পারল না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ল, আল্লাহর সাহায্য চাইল। ওর অসহায় মুখখানার দিকে চেয়ে জাওয়াদের মায়া হলো। কিন্তু সেই মায়ায় গা মাড়াতে পারল না, তার স্ত্রীর সম্মান এখন তার সম্মান। রাফার সম্মানে আঘাত হানা মানে তার সম্মানে আঘাত হানা। আর নিজের সম্মান রক্ষার ব্যাপারে জাওয়াদ বেশ কঠোর। মুশরাফার নিরবতা তাকে কাটার মতো বিধল। এত দয়া মায়া কেন ওই মেয়ের মাঝে?
চোয়াল শক্ত হলো তার। রাগী স্বরে বলল,

‘ আমার কথার যখন কোন মূল্য নেই, আমার সম্মানের যখন কোন পরোয়া করো না তুমি তবে আমি আর কখনো তোমাকে কোন ব্যাপারে কিছু বলব না। তোমার যা ইচ্ছে হয়, তাই করো, করবে। আমাকে বলতে আসবে না। ‘

জাওয়াদ মুখ ফিরিয়ে উঠে দাঁড়াল। মুশরাফা এরই ভয় পাচ্ছিল। ইসলাম স্বামীকে অনেক অধিকার দিয়েছে। স্বামী যদি কোথাও যেতে নিষেধ করে তবে সে যেতে পারবেনা, এমন কি পরিবারের কাছে ও না।স্বামীর আদেশ পালন স্ত্রীর জন্য বাধ্যতামূলক। স্বামী স্ত্রী একে অপরের সন্তুষ্ট ছাড়া জান্নাতে ও যেতে পারবে না। মুশরাফা জাওয়াদের রাগী মুখ পানে চাইল এক পলক। এই বিরহ সহ্য করার মতো না, মায়ের কষ্ট থেকে ও বেশি যেন। সে বিসমিল্লাহ পড়ে বলল,
‘আমি আপনাকে ওয়াদা দিচ্ছি, আমি নিজ থেকে যোগাযোগ করব না, দেখা দিব না, যাওয়ার কথা বলব না।’

জাওয়াদ তড়িৎ ঘুরে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ভেবে চিন্তে বলছো তো? পরিস্থিতি যত কঠিন হোক, ওয়াদা ভঙ করতে পারবে না।’

মুশরাফা বিড়বিড় করে বলল, ‘আল্লাহ, তোমার নাম নিয়ে ওয়াদা করেছি। কোন কষ্টদায়ক পরিস্থিতিতে ফেল না, যাতে মনে হয় আমার স্বামী আমার শত্রু। ‘
তারপর সায় জানাল। জাওয়াদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ওর মন বলে উঠল, ‘তুমি বা তোমার পরিবার জানো না, আমি কিসে আটকে দিয়েছি তোমাদের।’
মনের কথা মনে চেপে এগিয়ে এলো মুশরাফার দিকে। মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘দেট’স মাই লেডি। এবার যেতে পারো।’

মুশরাফা তড়িৎ উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ওর হাত কাঁপছে, লক খুলতে পারছে না। জাওয়াদ এসে লক খুলে দিতে দিতে বলল,
‘আমি কিন্তু সব শুনব। তারিফের সামনে তোমার চোখ থেকে এক ফোঁটা চোখের পানি ফেললেও খুব খারাপ হয়ে যাবে। ‘

মুশরাফা রাগী চোখে চেয়ে বলল, ‘আপনি দিন দিন কঠোর হয়ে যাচ্ছে।’
জাওয়াদ হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ‘ আর আপনি দিন দিন কোমল হয়ে যাচ্ছেন। ‘

দরজা খুলতেই মুশরাফা বেরিয়ে গেল। বসার ঘরে তারিফের সাথে নাজমুল সাহেব কথা বলছেন। ফরিদা ডাইনিং টেবিলে মুখে হাত দিয়ে বসে আছেন। ওদের বেরুতে দেখে মুশরাফার দিকে তাকাল। এক মায়ের বুক কাঁপছিল, জামাই মেয়ের গায়ে হাত তুলেনি তো? যে রাগ নিয়ে গেল। মুশরাফার চোখে পানি বা মুখে দুঃখ না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মুশরাফাকে বসার ঘরের দিকে যেতে দেখে বললেন, ‘তারিফ আছে এখনো, তুই যাস না ওখানে।’

ফরিদা জাওয়াদের দিকে তাকালেন। মুশরাফা ও তাকাল। জাওয়াদ ধীর স্বরে বলল, ‘তুমি গিয়ে মামাকে এদিকে পাঠাও।’

মুশরাফা দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে মামা ভাগ্নের কথায় ব্যাঘাত ঘটল। নাজমুল সাহেব প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। তারিফের কপালে বিরক্তি। বিয়ের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করছে মামার সাথে।
মুশরাফা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারল না। সব ভুলে কান্না এলো ভীষণ। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখল। মামাকে কিছু বলতে পারল না। জাওয়াদই ডাকল। নাজমুল সাহেব ভেতরে এসে বললেন,
‘ডেকেছিলে?’
জাওয়াদ ডাইনিং টেবিলে বসতে বসতে বলল,
‘ওরা আলাদা কথা বলুক। এতদিন পর ভাইবোনের দেখা হলো। দেখা যাক কী করে ওরা। বসুন।’

নাজমুল সাহেব অবাক হলেন। তখন একবারে খুন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এতটুকু সময়ে কী এমন হলো যে নিজেই পাঠাচ্ছে! তিনি প্রশ্নবোধক চাহনিতে চাইলেন। জাওয়াদ বলল,
‘আমি আপনার বোনের পরিবারকে সুযোগ দিচ্ছি আমার স্ত্রীকে ইম্প্রেস করার।’

‘আসসালামু আলাইকুম। ‘ নিজেকে স্বাভাবিক করার অপ্রাণ চেষ্টা করে বলল মুশরাফা। তারিফ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে চোখ ফেরাল। ওর চোখে রাজ্যের বিরক্তি। যেন তাকাতে মানা। মুশরাফা এগিয়ে গিয়ে বসল, ভাইয়ের পাশে। কোমল স্বরে ডাকল, ‘ ভাইয়া?’

তারিফ চমকে উঠল কেন যেন। তড়িৎ চোখ তুলে তাকাল বোনের পানে। মুশরাফার কোমল চেহারায় এক পলক তাকিয়ে চোখ ফেরাল। উত্তর দিল না। মুশরাফা নিজেই বলে গেল,
‘আচ্ছা আমি কী সম্বোধন করতাম? ‘তুমি’ না আপনি? আসোলে কত বছর পর কথা বলছি, আমি যেন ভুলেই গেছি। সেই ছোটোবেলার পর তো সেভাবে কথাই হয়নি। বোধহয় মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা ভাইয়া, আপনার মনে আছে আমার সম্বোধন বা আমাকে?’

তারিফ খানিকক্ষণ চুপ রইল। তারপর ছোটো করে উত্তর দিল, ‘মনে নেই। আমি যাকে তাকে মনে রাখি না।’

মুশরাফা তাকিয়ে রইল ভাইয়ের দিকে। এখনো এই চোখে বিতৃষ্ণা ওর জন্য। সেই ছোটোবেলার পর তো তাদের সেভাবে বসা হয়নি,আলাপ হয়নি। আজ এতগুলো বছর বাদে যখন সুযোগ হলো তখনো ভাইয়ের বিতৃষ্ণা চোখে পড়ল। অথচ এই ভাইকে দেখে সে ভেঙে গুড়ো হচ্ছে। মুশরাফা বলল,
‘ আমি তোমাদের মতো ভুলতে পারি না কেন ভাইয়া? তোমরা আমাকে ঘৃণা করো জেনেও আমার কেন তোমাদের জন্য ভালোবাসা আসে বলতে পারো? আমি তো আমার ছোটোবেলা ভুলতে পারিনা, ছোটোবেলার তোমাকে ভুলতে পারিনা। তোমরা কিভাবে ভুলতে পেরেছো ভাইয়া? একটাবার ও কি আমার কথা মনে পড়ে না?’

তারিফ এবার ও উত্তর দিল না, ‘ না।’

মুশরাফার কান্না পাচ্ছে। চিৎকার করে বুকের সমস্ত কষ্ট ঢেলে দেবার মতো কান্না। তাও সে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখছে। কাঁপা স্বরে বলল,
‘ বাবা, আপু, জায়ফা থেকে আসা সব কষ্ট আমি খুব সহজে হজম করতে পেরেছি। কারণ তাদের সাথে আমার বন্ডিং ভালো ছিল না। বাবাকে তো ছোটোবেলাতেও পাইনি আমি। কিন্তু দুটো মানুষ থেকে আসা আঘাত আমি সহজে হজম করতে পারি নি। মা আর তুমি। তোমাদের দু’জনকে আমি ছোটোবেলায় পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি পেয়েছি তোমাকে। আমার পুরো শৈশব রঙিন করেছিলে তুমি। তোমার হয়তো মনে নেই, তুমি আমাকে ‘মুশি’ ডাকতে। আমার মনে আছে, আমি সেসব ভুলতেই পারিনা। সবাই আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করল, আমার তাতে কষ্ট হয়নি, যতটা তোমাদের দুজনের জন্য হয়। সবার কথা বাদ, ভাইয়া তুমি অন্তত আমাকে মনে রাখতে পারতে? এই যে আমার বিয়ে হলো, আমি কত দূরে চলে এলাম। একটা বার খোঁজ নিতে পারতে ভাইয়া? কেমন আছি জানতে না হোক, অন্তত বেঁচে আছি কি না তা জানার জন্য হলে ও। ‘

মুশরাফা গলা আটকে এলো, আর বলতে পারল না। চোখে এসে ভর করেছে অথৈজল। এই গড়াল বলে। তারিফের হাতে ফোন। দৃষ্টি ফোনের মাঝেই নিবদ্ধ। গভীর মনোযোগ দিয়ে গেম খেলছে। চোয়াল শক্ত তার, ভ্রু কুঁচকানো। মুশরাফার কথা সে শুনেছে কি না বুঝা গেল না। কোন ভাবাবেগ দেখা গেল না তার মাঝে, নির্বিকার সে। মুশরাফা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার কোমল ভাইটা এত পাষাণ হলো কী করে? মুশরাফা আবার ডাকল,
‘ভাইয়া?’

তারিফ তাকাল। আবার চোখ ফিরিয়ে ফোনে তাকাতেই দেখল গেম ওভার। বিরক্তিতে গা রি রি করে উঠল। এই মেয়েটা আস্ত একটা ঝামেলা। ও এখানে আছে জানলে আসতোই না। ধ্যাৎ! তারিফ রাগী চোখে তাকাল। মুশরাফা বলল,
‘মা বাবা কেমন আছে, ভাইয়া?’

তারিফ উত্তর দিল না। উঠে দাঁড়াল। কিছুটা জোরেই বলল, ‘মামা, আমি চলে যাচ্ছি। ‘

মুশরাফা বলল, ‘আজকের পর আমি আর কখনো নিজ থেকে তোমার সাথে দেখা বা কথা বলতে পারব না। আজকেই শেষ। তুমি কি কখনো যোগাযোগ করবে ভাইয়া?’

‘ করব না।’ স্পষ্ট জানাল তারিফ। নাজমুল সাহেব এসে পড়লেন। সাথে জাওয়াদ ও। কেমন রাগ নিয়ে তাকাল মুশরাফার পানে। সোফার কাছে এসে বলল,
‘শেষ নিজেকে অপমান করানো?’

মুশরাফা উত্তর দিল না। ও তখনো তাকিয়ে আছে দরজায় দাঁড়ানো ভাইয়ের দিকে। তারিফ মামার সাথে কথা বলছে। এদিকে তাকাচ্ছে ও না। ভাইয়ের অবহেলা যেন বিষের মতো ফুড়ল মুশরাফার। দুই ফোঁটা জল গড়াল চোখ থেকে। কান্না আটকাতে চলে গেল রুমে। জাওয়াদ ওর যাওয়া দেখল, তারপর রাগী চোখে তাকাল তারিফের দিকে। জাওয়াদের চোখে আগুন ঝরছে। নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। ক্রুর চোখে চেয়ে বলল,
‘ আই উইশ, আই কুড কিল ইউ। ‘

তারিফ বিস্মিত চোখে চাইল। এই ছেলেকে ও কী করেছে? আগে তো দেখাই হয়নি, তবে এত বড়ো ধারালো কথা কেন বলছে? জাওয়াদকে ওর সন্ত্রাস গোছের মানুষ মনে হচ্ছে। প্রচন্ড বেয়াদব আর এগ্রেসিভ। কী ভয়ংকর! রাগ নিয়ে পালটা উত্তর দেবার আগে চলে গেল ছেলেটা।

তারিফ নাজমুল সাহেব থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল, তখনই মুশরাফা আবার এলো বসার ঘরে। হাতে ছাতা। কান্নাভাবটা নেই মুখে, কিছুটা স্বাভাবিক। দরজার কাছে এসে বলল,
‘বাইরে বৃষ্টি। ছাতা নিয়ে যাও ভাইয়া।’

ছাতাটা বাড়িয়ে দিল মুশরাফা। নাজমুল সাহেব, ফরিদাও চোখে বিস্ময়। চটা দেখা গেল তারিফের চোখে ও। আশা করেনি বোধহয়। ছাতার দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকাল। নিল না। মুশরাফা অনুরোধের সুরে বলল,
‘ ওই অবেলার বৃষ্টি শরীরের জন্য ভালো না। ভিজলে জ্বর হবে, প্লিজ নিয়ে যাও ভাইয়া!’

ছোটোবেলায় স্কুলে যাবার সময় ছাতা নিতে চাইতো না মুশরাফা। তখন তারিফ কত কী অনুরোধ করে ছাতা সাথে দিত। আজ যেন তার উল্টোরূপ ফুটে উঠল।

চলবে…

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here