স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ,পর্ব-১২,১৩

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ,পর্ব-১২,১৩
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
১২

ধূসর প্রভাত। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। কালচে মেঘের মৃদু গর্জন। এই বুঝি বৃষ্টি এলো। আঁধার মাড়িয়ে গেছে চারপাশে। ঘড়ির কাটায় সাড়ে সাতটা বাজলে ও পরিবেশ দেখে সন্ধ্যা ঠেকছে। কারেন্ট চলে গেছে খানিক আগে। মুশরাফা জানালা বেয়ে আসা আবছা আলোয় নামাজ পড়ছে। সালাতুল হাজাতের নামাজ। বিপদ আপদ কিংবা কঠিন সময়ে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে এ নামাজ পড়া হয়। মুশরাফা পরীক্ষার হলে যাবার আগের এ নামাজ পড়তে ভুলে না। বেশ সময় নিয়ে দুইরাকাত নামাজ শেষ করল। মোনাজাতে ও সময় নিল। জায়নামাজ ভাজ করার সময় শোয়া থেকে উঠে বসল জাওয়াদ। সবেই ঘুম ভেঙেছে তার। মুশরাফার দিকে চোখ ফেলে বলল,
‘ ন’টায় পরীক্ষা তুমি এখনো রেড়ি হওনি! ‘

‘এই তো যাচ্ছি।’ কাভার্ড থেকে বোরকা নিল মুশরাফা। জাওয়াদকে কাভার্ড থেকে শার্ট-প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে দেখে বলল,
‘আপনি আমার সাথে যাবেন!’ ভারি অবাকের সাথে বলল ও। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘ এতে অবাক হওয়ার কী আছে?’
‘আমি আশা করিনি।’

জাওয়াদ ফুঁসে উঠল, ‘ ভালো কিছু আশা করবে কেন? তুমি তো আশা করবে আমাকে বেরোজাদার হওয়া, এই ঝড়ের মধ্যে তোমাকে একা ছেড়ে দিয়ে আরাম করে ঘুমানো। ‘

মুশরাফা নিকাব ঠিক করতে করতে জাওয়াদের চেহারা দেখল এক ঝলক। ঠোঁট চেপে হাসল। রাগ বাড়াতে বলল,
‘আমি আরও ভেবেছিলাম মামার সাথে যাব।’

‘আমি থাকতে মামার কথা আসছে কেন?’ জাওয়াদের স্বর উত্তপ্ত।
‘আপনি আমার সাথে গেলে অফিসের জন্য দেরি হবে, আর আপনার জন্য ও কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই।’

জাওয়াদ দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আল্লাহর দোহাই লাগে, তোমার দুইলাইন বেশি বোঝার অভ্যাসটা এবার ছাড়ো। আমার কষ্ট হবে বলেছি তোমায়! ‘

জাওয়াদের রাগের বিপরীতে মুশরাফা হেসে গেল,প্রশান্তিতে নিঃশব্দে। জাওয়াদ টেরও পেল না। সে ফোন দিয়ে নাজমুল সাহেবকে আসতে মানা করল। ওয়াশরুম থেকে ফিরে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তৈরি হলো, বার কয়েক চোখ রাঙাল মুশরাফাকে। মুশরাফা বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে হাসল।


রুম থেকে বেরিয়ে শ্বশুরের রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলা। জয়নাল আবেদীন পত্রিকা পড়ছেন, মায়মুনা সবে উঠে বসেছেন। মুশরাফা দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে অনুমতি নিল। জয়নাল আবেদীন পুত্রবধূকে দেখে পত্রিকা বন্ধ করে হেসে বলল,
‘আসো, মা। বেরিয়ে যাচ্ছো?’
মুশরাফা ভেতরে যেতে যেতে বিনম্র স্বরে বলল, ‘জ্বি, বাবা। দোয়া করবেন।’

জয়নাল আবেদীন কোমল স্বরে বলল, ‘আল্লাহ তোমার ভালো করুক। ভালো করে পরিক্ষা দিও। ‘

মুশরাফা খাটে এগিয়ে গেল। মায়মুনার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মা যাচ্ছি।’
মায়মুনা ঘুম জড়ানো স্বরে উত্তর দিলেন, ‘ সাবধানে যেও।’

মুশরাফা গেল না। বরং শ্বাশুড়ির পাশে বসে পড়ল। ধীর স্বরে বলল, ‘ আগে পরীক্ষা দিতে যাবার সময় মামী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিতেন। আপনি কি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন, মা?’

কেমন করে বলল মেয়েটা! মায়মুনার বুক কেঁপে উঠল। কোমল চোখে চাইলে পুত্রবধূর পানে। মেয়েটার চোখে যেন মা’হীনতা করুণ ব্যাথা স্পষ্ট ভাসছে। এ নিবেদন অগ্রাহ্য করা যায়না। মায়মুনা কাঁপা হাত রাখলেন পুত্রবধূর মাথায়। প্রথমবারের মতো মন থেকে দোয়া আসল তার, ‘তোমার পরীক্ষা ভালো হোক। ‘

আপনতত্ত্বের গাঢ় রেখে ছিল সে কথায়। মুশরাফা কৃতজ্ঞ হাসল। প্রসন্নতায় বলল, ‘এবার আসি,মা?’
‘বাইরে বৃষ্টি, ছাতা নিয়ে বের হও।’

জয়নাল আবেদীন ড্রাইভার ডেকে রেখেছে আগেই। বেরুনোর দোয়া পড়ে ওরা নিচে নেমে গাড়িতে বসল। জাওয়াদ চুপচাপ রইল। মুশরাফা গাড়িতে উঠে আয়তুল কুরসি, তিন কুল পড়ে গা ফুঁ দিল। এতে ভ্রমণ নিরাপদ হয়। তারপর বইয়ে চোখ বুলাল। ওরা যখন কেন্দ্রের সামনে পৌঁছল তখন আকাশ কাঁপিয়ে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। এতক্ষণে মুখ খুলল জাওয়াদ,
‘ গাড়ি এখানে থাকবে। তোমার পরীক্ষা শেষের আগে আমি অফিস থেকে ফেরার চেষ্টা করব। কোনভাবে যদি আমার আসতে দেরি হয়, তবে গাড়ি করে চলে যাবে। বৃষ্টির মাঝে আমার অপেক্ষা করার দরকার নেই। মনে থাকবে?’

মুশরাফা সায় জানাল। জাওয়াদ মানিব্যাগ থেকে হাজার টাকার কয়েকটা নোট নিয়ে মুশরাফার পার্সে ভরে দিল। মুশরাফা কখনো মুখ ফুটে ওর কাছে টাকা চায় না, হাত খরচ নেয় না, যতক্ষণ না জাওয়াদ নিজ থেকে না দেয়। মাসের শুরুর দিকে নাজমুল সাহেব মুশরাফাকে হাত খরচের জন্য হাজার পাঁচেক টাকা দেন। মুশরাফা নিতে চায় না বলে বিকাশে পাঠিয়ে দেন। বলেন, ছেলেমেয়ের খরচ বহন বাবার দায়িত্ব। ফিরিয়ে দিলে আমি কষ্ট পাব। বিয়ের পর ও সেই অভ্যাসটা বদলান নি, এখনো মাসের বেতন পেয়ে এই মেয়ের জন্য টাকা পাঠাতে ভুলেন না। মুশরাফার খরচ চলে সেই টাকাতেই। জাওয়াদ বাহানার আশ্রয় নিয়ে কিছু টাকা গুজে দেয় ওর পার্সে। আজ সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করল না। মুশরাফা তেঁতে উঠল, ‘আমার কাছে টাকা আছে।আর লাগবে না।’

জাওয়াদ চোখ রাঙাল, ‘বেশি বুঝতে মানা করছি না? বেরোনোর সময় সাথে টাকা রাখা ভালো। অসময়ে কাজে লাগবে। রাখো।’

জাওয়াদ দরজা খুলে আগে বেরুলো। ছাতা খুলে ওকে আহ্বান করল, ‘আসো।’

মুশরাফাকে দিয়ে এলো গেট অবধি। অভিভাবকদের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। আসার সময় কোমল স্বরে বলল,
‘ রিল্যাক্সলি পরীক্ষা দিবে। ভালো রেজাল্ট করতেই হবে এমন কোন চাপ নিবে না। সেদিন আমি মজা করেছিলাম। তুমি যাই রেজাল্ট করো, আমার পক্ষ থেকে কোন দ্বিরুক্তি আসবে না।’

মুশরাফা প্রসন্ন হাসল। ধীর স্বরে বলল, ‘ আজ আপনাকে দেখে আমার ভীষণ ভালোবাসা পাচ্ছে।’

জাওয়াদ ও ধীর স্বরে বলল, ‘ এখন দেখিয়ো না প্লিজ! আমার লজ্জা লাগবে।’

মুশরাফা চোখ রাঙাল। জাওয়াদ হেসে বলল, ‘ দেরি হয়ে যাচ্ছে যাও। ফিরে এসো দেখিয়ো না হয়।’

মুশরাফা কদম বাড়ালে থামিয়ে দিল। হাতের ছাতা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ হল অবধি যেতে ভিজে যাবে। এটা নিয়ে যাও।’
‘আপনি কিভাবে যাবেন?’
‘আমার ছাতা লাগবে না। ফি আমানিল্লাহ। ‘ ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দৌড় দিল জাওয়াদ। গাড়ি অবধি যেতে যেতে অনেকটা ভিজে গেল। গেটের ভেতর পা রেখে সেই দৃশ্য চোখে পড়ল মুশরাফার। ছাতার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘তবুও বলবে আমায় না কি ভালোবাসে না।’

পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে জাওয়াদকে গাড়িতে পেল। বাসায় ফিরতে ফিরতে দুটো বেজে গেল। জাওয়াদ মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে নামাজ পড়ে নিয়েছিল। মুশরাফার নামাজ পড়া হয়নি। এসেই ফ্রেশ হয়ে নামাজে দাঁড়াল। তিনটা বাজতেই রান্নার জন্য বের হলো। মায়মুনা ওকে দেখে বললেন,
‘ আজ তোমার রান্নাঘরে যেতে হবে না।’
‘কেন মা?’
‘কাকন ইফতার বানাবে, তুমি রুমে গিয়ে রেস্ট করো। ‘

মায়মুনা স্বর সময়ের পালাবদলে কোমল হচ্ছে। কেমন মা মা জনক আচরণ করছেন তিনি। মুশরাফা টের পেল। শরীরটা ক্লান্তির বহরে নুয়ে আসছে। একটু বিশ্রাম না করলেই নয়। তাই কথা বাড়াল না মুশরাফা। বলল,
‘ ভাবি একা পারবেনা। আমি কিছুক্ষণ পর আসছি।’

মুশরাফা রুমের দিকে পা বাড়াল। সেই ক্ষণে কোথা থেকে দৌড়ে এলো জাহিন। মুশরাফার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চাচ্চি শুনো না?’
মুশরাফা থেমে গেল, ‘বলো।’
‘তুমি বলেছিলে সিক্স সেভেনে উঠলে আমি রোজা ফরজ হয়। তবে এখন আমার বন্ধুরা সবাই রোজা রাখলো কেন?’

ওর গাল টেনে মুশরাফা বলল, ‘ কারণ রোজা রাখলে পুরষ্কার আছে। ‘

পুরষ্কারের কথা শুনে জাহিন উৎফুল্ল হয়ে গেল, ‘কী পুরষ্কার?’

মুশরাফা চেয়ার টেনে বসল। তারপর বলল,
‘তার আগে বলো, তুমি কখনো আল্লাহকে দেখেছো?’

জাহিন মাথা নাড়াল। মুশরাফা আবার বলল, ‘ যিনি পৃথিবী বানালো, তোমাকে বানাল সেই আল্লাহকে দেখতে ইচ্ছে করে না তোমার?’
‘করে।’
‘তুমি যদি রোজা রাখো। তবে আল্লাহকে দেখতে পারবে। আল্লাহ নিজেই তোমাকে রোজার পুরষ্কার দিবে। তোমাকে জান্নাত উপহার দিবেন। সেখানে তুমি যা চাইবে সাথে সাথে পেয়ে যাবে। কোন অভাব থাকবে না।’

জাহিন কী বুঝল কে জানে। প্রফুল্ল মুখে বলল,
‘আমি ও তবে কাল থেকে রোজা রাখব। জান্নাতে যাব। আমি জান্নাতে যাব, আমার পছন্দের সব খেলনা নিব। ইয়েএএএএ। ‘ লাফিয়ে উঠল জাহিন। মাকে বলতে চলে গেল। মুশরাফা হাসল ওর কান্ড দেখে। মায়মুনা আগ্রহী গলায় বললেন,
‘ এতক্ষণ যা বললে সবটা সত্যি? সত্যিই আল্লাহকে দেখতে পারবে রোজা রাখলে?’

‘হ্যাঁ। এ সম্পর্কে হাদিস আছে। বলব?’

মায়মুনা কৌতুহলী চোখে বললেন, ‘বলো, শুনি।’

মুশরাফা বলে গেল,
‘ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘বনি আদমের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্যই। শুধু রোজা ব্যতীত; তা আমার জন্য। আমি নিজেই তার পুরস্কার দেব।’ (সহিহ বুখারি)

দ্বিতীয় হাদিসটি হলো।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘সিয়াম পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি হলো, যখন সে ইফতার করে, তখন আনন্দিত হয়; অপরটি হলো, যখন সে মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তখন সে আনন্দিত হবে।’ (সহিহ মুসলিম )’

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জান্নাতের একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়ান। হাশরের দিন ওই দরজা দিয়ে সিয়াম পালনকারীরা প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া আর কেউই ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। সিয়াম পালনকারীরা প্রবিষ্ট হয়ে গেলে দরজা বন্ধ করা হবে। ফলে সেই দরজা দিয়ে আর কেউই প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ বুখারি) ‘

লম্বা কথা বলে মুশরাফা থামল। মায়মুনা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কী সুন্দর হাদিস! আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ পাবে, কথাটা ভেবেই মনে ঝঙ্কার দিয়ে উঠল। শীতল শিহরণ বয়ে গেল শিরায় শিরায়। মন প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। এই হাদিসগুলো তাকে ইসলামের দিকে টানছে যেন। জানার আগ্রহ বাড়ছে। দুনিয়ার পিছনে ছুটতে ইসলাম সম্পর্কে জানা হলো না। এই বয়সে এসে জানতে ইচ্ছে করল। তিনি আনমনে বলে ফেললেন,
‘ কী সুন্দর হাদিস! এত সুন্দর হাদিস তুমি কোথায় পাও?’
‘এমন হাজারো সুন্দর হাদিসের সংকলন আছে বই। আমি সেই বই পড়ে জেনেছি।’

মায়মুনার কৌতুহল বাড়ল, ‘কী বই? আমাকে দিও তো।’

মুশরাফা ভারি অবাক হলো, ‘আপনি হাদিসের বই পড়বেন মা!’

মায়মুনা স্বাভাবিক স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ। এখন তো অবসরই থাকি। বই এনে দিও, আমি পড়ব।’

মুশরাফা হেসে বলল, ‘আমি এখনি এনে দিচ্ছি।’

দ্রুত পায়ে রুমে চলে গেল সে। বইয়ের তাক থেকে মিশকাতুল মাসাবিহ(১-৩), সহিহ বুখারী শরীফ(১-১০), সহিহ মুসলিম শরীফ(১-৬) এ তিনটি বই নিল হাতে। তারপর কী ভেবে যে পর্দার বিধান সম্পর্কিত একটা বই ও নিয়ে নিল। শ্বাশুড়িকে দিয়ে বলল,
‘ আজ আমি আপনাকে হাদিস শুনিয়েছি, একদিন এমন আসুক আপনি আমাকে হাদিস শুনাবেন। সেই দিন আসবে ইনশা আল্লাহ। ‘

চলবে…

জাযাকুমুল্লাহু খায়রান।

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-১৩)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

রোদ্দুরে দুপুর। পরীক্ষা দিয়ে সবেই বেরিয়েছে মুশরাফা। সূর্য্যের তাপ ঠিকরে পড়ছে মাথায়। ভারি আবরণে আবৃত শরীরটা যেন ঘাম সাগরে ডুবছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। ফাইল হাতে গেট পেরুতেই অপেক্ষামান ক্লান্ত জাওয়াদকে চোখে পড়ল। কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে তার অপেক্ষা প্রহর গুনছে। মুখটা লাল হয়ে আছে, ঘেমে একাকার। মুশরাফার ভীষণ মায়া হলো। এগিয়ে গেল সেদিকে। হাজার লোকের ভীড়ে মুশরাফাকে তখনো চোখে পড়েনি জাওয়াদের। মুশরাফা পাশে গিয়ে পিঠে টোকা দিল। জাওয়াদ তাকাতেই চঞ্চল গলায় বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম। কখন এসেছেন? ‘

ক্লান্ত মুখে প্রসন্নতা দেখা দিল জাওয়াদের। এক রাশ হেসে বলল,
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। পাঁচ মিনিট হচ্ছে এসেছি। তা, পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’
‘আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো হয়েছে।’

গাড়ি ক্যাম্পাসের বাইরে পার্ক করা হয়েছে, কিছুটা দূরে। ওরা হেঁটে এগুচ্ছে। ভীড়ে হারিয়ে না যায় এই ভয়ে জাওয়াদ মুশরাফার হাত ধরে আছে। গাড়ির কাছে আসতেই একটা মেয়ের মুখোমুখি হলো। মেয়েটা ওকে দেখেই চমকে তাকাল,
‘জাওয়াদ!’
জাওয়াদের চোখে ও বিস্ময়, ‘ তিশা! কতদিন পর দেখা! ভালো আছো?’

তিশা উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘আছি ভালো। তোমার ফোন বন্ধ ছিল কেন? আমি কতবার ফোন দিয়েছিলাম!’
‘সিম বদলে ফেলেছিলাম। তো, কী করছো আজকাল? বিয়ে শাদী করেছো?’

মুশরাফা স্থির চোখে দেখছে দুজনকে। তিশার থেকে তার নজর কাড়ছে জাওয়াদ। কী খুশি দেখাচ্ছে ওকে! তিশা জবাব দিল,
‘ ব্যাংকে আছি।’
থেমে বলল, ‘ ভেবেছিলাম তোমাকে বিয়ে করব। তোমার বিরহে চিরকুমারী উপাধী কাধে চাপিয়ে রেখেছি। বর যদি তুমি না হও, তবে কেউ হবে না?’

জাওয়াদ আড়চোখে তাকাল মুশরাফার দিকে। মুশরাফা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ তিশার কথায় খুশি হয়েছে এমন ভান করে চমৎকার হাসল। ভ্রু উঁচিয়ে আফসোসের সুরে বলল,
‘ আমার জন্য বসে ছিলে তুমি! আগে জানলে আমি তোমাকেই বিয়ে করতাম। ইশ! সুযোগটা মিস করে ফেললাম।’

বলেই মুশরাফার দিকে তাকাল। মুশরাফার চোখে রাগ নেই, তবে গুমোট ভাব স্পষ্ট। চোখ দিয়ে রাগ প্রকাশ করল না ঠিকই, তবে জাওয়াদের হাতের বন্ধনে থেকে হাত ছাড়িয়ে নেবার প্রচেষ্টা চালাতে ভুলল না। ইশ! ঈর্ষায় ডুবে যাচ্ছে মেয়েটা! জাওয়াদের মজা লাগছে। হাতের বাঁধন গাঢ় করেই হাসছে সে। তিশা অবাক হয়ে বলল,
‘তুমি বিয়ে করে ফেলেছো?’

জাওয়াদ আবার হাসল, ‘করেছিতো। ‘
তারপর মুশরাফার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওকে ইশারা করল, ‘এই যে তার প্রমাণ। মাই ওয়াইফ মুশরাফা।’

জাওয়াদের মুখে হাসি, স্বর দৃঢ়, হাতে মুশরাফার হাত তখনো ধরা। মুশরাফ অবাক হয়ে চাইল। মেলালো বিয়ের পরের কথা। পরিচয় দিতে হবে বলে ওকে আইসক্রিম খেতে নিয়ে যায় নি, একাই চলে গেছে। ওর বেশভূষায় ওকে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগতো। অথচ আজ সেই বেশভূষায় গর্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এই দিনটাকেই তো চেয়েছিল সে! তার হাসিটা নিকাবের আড়ালেই রইল।

তিশা মুশরাফাকে পরখ করে বিস্মিত চোখে চাইল জাওয়াদের পানে। তার চোখে অবিশ্বাস। তিশা কী যেন বলতে চাইল। জাওয়াদ চোখ দিয়ে কী যেন ইশারা করল ওকে। ওকে বলবার সুযোগ না দিয়ে মুশরাফাকে বলল,
‘রাফা, ও হলো তিশা। আমরা একই ভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছি। ও আমার এক ব্যাচ জুনিয়র ছিল। ‘

জুনিয়ররের সাথে এত সখ্যতা! এই লোকের জীবনটা ফ্লার্ট করতে করতেই কেটেছে বোধহয়। মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলে কোমল স্বরে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম আপু। ভালো আছেন?’

‘আছি।’ বিস্ময়ে কথা বেরুচ্ছেনা তিশার। জাওয়াদ তড়িঘড়ি করে বলল, ‘এই গরমে দাঁড়িয়ে না থেকে এসি ছেড়ে গাড়িতে বসো। আমি দুইমিনিটের মাঝে আসছি। ‘
বলে দরজা খুলে দিল।

মুশরাফা বিনা বাক্যে গাড়িতে বসে পড়ল। সনাতন ধর্মাবলম্বী চালক লাঞ্চ করতে গেছে। জাওয়াদ এসি ছেড়ে গ্লাস লক করল। তারপর বলল,
‘ ড্রাইভার আসবেনা এখন। তুমি মুখ খুলে কিছুক্ষণ আরাম করো। আমি এক্ষুনি আসছি।’

রমজানে দিনের বেলায় রেস্টুরেন্ট, টং দোকান বন্ধ। স্কুলের পাশে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান খোলা আছে। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের ভীড় দেখা যাচ্ছে। দোকানটা বোধহয় এদের জন্যই খোলা রাখা হয়েছে। সেই দোকানটায় চোখ যেতেই জাওয়াদ দরজা খুলে আকস্মিক বলে উঠল,
‘কিছু খাবে?’

দৈবাৎ অস্বস্তিতে চেয়ে গেল মুশরাফার চোয়াল। ইতিউতি করল সে। আগে বাসায় থাকলে মামার অনুপস্থিতি খাওয়া হতো। মহিলাদের সামনে ব্যাপারটা যতটা স্বাভাবিক, পুরুষদের সামনে ততটা নয়। মুশরাফা বিব্রতবোধ করল। জাওয়াদ স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘ একজন পুরুষের জন্য ত্রিশটা রোজা রাখা যতটা স্বাভাবিক ব্যাপার, একটা মহিলার জন্য সাতটা রোজা না রাখা ততটাই স্বাভাবিক। যেখানে আল্লাহ তোমাকে রোজা ভাঙার অনুমতি দিয়েছে, খাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন, সেখানে তুমি বান্দাকে লজ্জা পাওয়া তোমার সাঝে না। এটা আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ম। ইট’স ন্যাচরাল। ডোন্ট বি ফিল সায় অর আনকোম্পোর্টেবল এট অল। বি নরমাল।’

মুশরাফা তড়িৎ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল জাওয়াদের পানে। আজ জাওয়াদ একবারে তার মতো করে কথা বলছে। তার মানুষিকতায় চমৎকার পরিবর্তন এসেছে! কী সুন্দর কথা!

আজ দশম রমজান যাচ্ছে। এর মাঝে জাওয়াদ যতদিন বাসায় ছিল দুপুরের দিকে রুম থেকে বের হয়নি। নামাজ পড়তে গিয়ে ফিরেছে বেশ বেলা করে। মুশরাফা একদিন জিজ্ঞেস করলে জানাল, বাসার মহিলাদের প্রাইভেসি দেয়। সেদিন কথাটা না বুঝলে ও এই ক্ষণে এসে বেশ বুঝতে পারল। বাসার মহিলারা রোজা না রাখলে দুপুরের দিকে খাবে, এই সময় ও সামনে পড়ে গেলে লজ্জায় পড়ে যাবে। তাই বের হতো না, আর বের হলেও ফিরতো দেরিতে যাতে ওদের খাওয়া শেষ হয় ততক্ষণে।

এমন করে কজন বুঝে! আজকালকার সময় ছেলেরা তো রমজান এলেই মেয়েদের রোজা ভাঙা নিয়ে গবেষণা শুরু করে। বান্ধবী, ক্লাসমেট, পরিচিত মেয়েদের দেখলেই জেসে জিজ্ঞেস করে, ‘আজ রোজা আছিস তো!’ কথাটা বলার সময় দুষ্টুমি খেলে যায় চোখে। পিরিয়ড নিয়ে কৌতুক ভাবনা থাকে। মেয়েটাকে বিব্রত করতে পারলেই যেন শান্তি। একটা ব্যাক্তিত্ববান ছেলে কখনোই একটা মেয়েকে এই প্রশ্নটা করতে পারেনা। একজন নারীর প্রতি, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সম্মান থাকলে এটা কখনোই জিজ্ঞেস করতে পারেনা। তার এই কৌতুকে একটা মেয়ে যদি অপমান বোধ করে তবে ছেলেটার ভাগ্যে কতটুকু গুনাহ জমা হবে সে তা জানেই না। জানলে হয়তো কখনো জিজ্ঞেস করতো না। সেদিক থেকে জাওয়াদের ভাবনা চমৎকার। মুশরাফা কী যে ভালো লাগল। বিব্রতভাব সরে গেল মুখ থেকে। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করল,
‘এবার বলো, কী খাবে?’

মুশরাফা এবার নির্দ্বিধায় বলল, ‘ গলা শুকিয়ে গেছে একটু পানি হলেই হবে।’

জাওয়াদ তিশাকে বলল, ‘তুমি কি একমিনিট দাঁড়াতে পারবে?’
‘ইয়াহ, সিওর।’

জাওয়াদ অনুমতি পেয়ে দোকানে গেল। পানির সাথে আইসক্রিম, আর বার্গার নিয়ে এলো। মুশরাফার হাতে দিয়ে বলল,
‘ এবার খাওয়া শুরু করো।’
‘আপনি যান, তারপর। ‘
‘আমার সামনে খেতে কী সমস্যা!’ জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ রোজা ভাঙার অনুমতি যেমন আমার আছে, তেমনি রোজার সম্মান করার কথাও আছে। রোজার সম্মানার্থে একজন রোজাদারের সামনে বসে আমি খাব না, এতে যদি তার খেতে ইচ্ছে করে তবে আমার দ্বারা রোজার অসম্মান হবে। ‘

‘আমি আসা অবধি সব ফিনিশ দেখতে চাই।’ বলে বেরিয়ে গেল জাওয়াদ। মুশরাফা সিটে হেলান দিয়ে মাথা নাড়ালো কেবল।
জাওয়াদ তিশার কাছে গেল। তিশা ভ্রু কুঁচকাল,
‘এই রমজানে খাবার?’

‘রাফার জন্য। ও রোজা রাখেনি। ‘ স্বাভাবিক শুনাল জাওয়াদের স্বর। তারপর বলল,
‘রমজানে তোমাকে কোথায় বসার অফার ও করতে পারছি না, স্যরি।’

তিশা হাসল, ‘ব্যাপার না।’
‘ এবার বলো, কী যেন বলছিলে?’
কথার কেন্দ্রবিন্দুতে আসায় তিশা প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসল, ‘ প্লে বয় আর পর্দাশীল মেয়ের অংকটা বুঝে আসছে না! কিভাবে কী!’

জাওয়াদ লাজুক হাসল, ‘ কত এলো কত গেলে, আটকালাম শেষ এইজনাতেই। কিভাবে হলো জানি না। ইট’স আ ম্যাজিক। ‘
‘ ওকে ও ডেট….

মাঝপথেই থামিয়ে দিল জাওয়াদ, ‘ ও স্ত্রী হয়েই এসেছিল আমার জীবনে। ফিলিংস টিলিংস সব আমার পক্ষ থেকে ছিল। তারপর কত কসরত করতে হলো বিয়ে অবধি নেয়ার জন্য। ‘

ভার্সিটি লাইফে জাওয়াদ সিনিয়র জুনিয়র কমবেশি সবার সাথে ফ্লার্ট করতো। তিশা ও ছিল ফ্র‍্যাঙ্কলি। সেও হেয়ালি করতো। ফ্লার্টের চেইন সেও টানতো।
তিশার ইর্ষা হলো কেন যেন। বলল, ‘ ম্যারিড লাইফ কেমন কাটছে?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ জাওয়াদ স্বর তখনো দৃঢ়, প্রশান্তিতে মাখা, সুখের আভা মেশানো। তিশা ভ্রু কুঁচকে দেখছে জাওয়াদকে। বেশ পরিবর্তন এসে গেছে ওর। ভার্সিটির সেই প্লে বয় বিহেভিয়ার নেই আর, এখন পাক্কা জেন্টেলম্যান।

‘রাফা? ঘুমোচ্ছো?’ গাড়ি ফিরে ধীর স্বরে ডাকল জাওয়াদ। মুশরাফা সিটে হেলান দিয়ে শোয়া, চোখ বন্ধ। মুশরাফা চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল, ‘না। এসি বন্ধ করে দিন, গ্লাস খুলে। ‘ মুশরাফা স্বাভাবিক।

জাওয়াদ বোধহয় মুশরাফা থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল। না পেয়ে অবাক হলো। মেয়েটার আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রখর। ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করেছে। জাওয়াদ ধীর স্বরে বলল,
‘ ইফতারের দাওয়াতে যেতে হলে কী কী নিয়ে যাওয়া লাগে তোমার কোন ধারণা আছে?’

‘ফল ফলাদি, কোল্ড ড্রিংক, আইসক্রিম, দই, রসমালাই বা ডেজার্ট আইটেম নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। যেহেতু ইফতারে এসবই খাওয়া হয় বেশি। কোথায় দাওয়াত পড়েছে?’

‘মামার বাসায়?’ জাওয়াদের কথায় মুশরাফা চমকে তাকাল। মামীর বাসায় যাবার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল তার। এই যে আজ মামা বাসার সামনে দিয়ে যাবে, তখন মনটা কেমন করে উঠবে। ইচ্ছে করবে নেমে দৌড় লাগাতে। মুশরাফা উৎফুল্ল সুরে বলল,
‘ কবে যাচ্ছি আমরা?’
‘আজ গেলে কেমন হয়? মামা কদিন ধরেই ফোন দিচ্ছেন।’

মামা বাসায় যাবার কথা শুনে মুশরাফার ক্লান্তিবোধ পালালো। চঞ্চল হয়ে উঠল সে, ‘ চমৎকার হয়। কাউকে বলবেন না। আমি সারপ্রাইজ দিব?’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। মামা বাসায় যাবার কথাতেই এত খুশি! ওর কাছে থাকতে ভালো লাগে না! বাসা থেকে মামা বাসায় যাবার হিসেব থাকে, কই মামা বাসা থেকে ওর কাছে যাবার হিসেব তো করে না। বলে না, আর থাকব না, চলে যাব। জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল,
‘ তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমাদের বাসায় তুমি খুব কষ্টে থাকো।’

মুশরাফা চপল গলায় বলল, ‘ বিয়ের পর বাবার বাড়ি যাবার আনন্দটা একমাত্র মেয়েরাই অনুভব করতে পারে। ‘
‘আমরা পারব না?’
‘ যখন পরিবার থেকে দূরে যাবেন তখন পারবেন। এমনি পারবেন না। কারণ বিয়ের পর পরিবারকে আমরা ছাড়ি, আপনারা না।’

কঠিন সত্য কথাটার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারল না জাওয়াদ। বিয়ের পর ছেড়ে আসার তালিকা মেয়েদেরই বড়ো হয়, ছেলেদের তো পাওয়ার তালিকা বড়ো হয়। একমত হলে ও হার মানতে চাইল না জাওয়াদ। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘তো, এক কষ্ট অনুভব করতে কি এখন আমি দূরে চলে যাব?’

মুশরাফা চমৎকার হাসল। দূরের যাবার কথায় কাছে এলো। ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ আমাকে ফেলে দূরে যেতে পারবেন? পারবেন আমিহীনা থাকতে? পারলে যান।’

এবার হার মানতেই হলো জাওয়াদকে। এই মেয়েটার উপর জেতার দক্ষতা এখন অবধি হয়ে উঠল না তার। তার দশ কথার পর একটা কথা বলে বাজি সেই দিতে নিবে। জাওয়াদ রেগে তাকাল। মুশরাফার হাসি বাড়ল। চোখ দিয়ে চঞ্চল হেসে সরে গেল,
‘আমার কষ্টটা আপনার অভিজ্ঞতার বাইরেই থাক তবে।’

ভরদুপুরের বিস্ফোরণটা হলো সন্ধ্যায়। মুশরাফা গম্ভীরমুখে বসল বিচারে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here