স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। পর্ব-১০,১১

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। পর্ব-১০,১১
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
১০

আত্মশুদ্ধি, পরিশুদ্ধি, পূণ্য, প্রশান্তি, পরকালীন মুক্তি, ইহকালীন কল্যান লাভের মাধ্যম নিয়ে হাজির হয়েছে পবিত্র মাহে রমজান। এই মাসটা ইবাদতের মাস, সিয়াম সাধনার মাস। এই মাসে মুসলমানগন রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উপোস দিন পার করে। রবের নামেই রোজা ভঙ্গ করে। নামাজ, রোজা, সদকা এবং উত্তম কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভই এই মাসে মুসলমানের মুল উদ্দেশ্য থাকে।

কাল রাতে বাঁকা চাঁদ উঁকি দিয়েছে কালচে মেঘের ফাঁকে। আজ প্রথম রমজান। মুশরাফার আজ সকাল সকাল রান্নার ব্যস্ততা নেই। আজ নাস্তার তোড়জোড় নেই, নেই দুপুরের টেবিল সাজানোর দৌড়। আজ থেকে প্রতিটা সকাল তার ছুটি। রাতের খাবার বসাবে মাগরিবের পর।
দিনের বেলায় কাজ বলতে ওই ইফতার রেডি করাই। তা রয়েসয়ে করা যাবে বলে নিশ্চিন্ত অনেকটা।

মুশরাফা বেলা গড়াতেই গোসল সেরে কুরআন নিয়ে বসল। রমজান মাসে সব আমলের দিগুণ সাওয়াব। মুশরাফা রমজানে তিনটি আমলকে বিশেষ প্রাধান্য দেয়। এক, তাহাজ্জুদ। দুই, কুরআন তেলাওয়াত। তিন, সদকা। কুরআন অর্থ বুঝে পড়ে। খতম দেয়াটা তার মূখ্য উদ্দেশ্য থাকে না, বুঝে পড়াটা উদ্দেশ্য থাকে। রমজানে যেহেতু অধিক সময় পাওয়া যায় তাই সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পড়ে। এগারোটায় বসল, আজান পড়ার পর উঠেছে। নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ তাসবিহ পড়েছে।

তৃতীয় রমজানে ওর পরীক্ষা আছে। কিছু সময়ে বইয়ে ব্যয় করল। ঘড়ির কাটায় তিনটা বাজতেই শ্বাশুড়ির ঘরে এগুলো । জাওয়াদ, যায়েদ, জায়নাল আবেদীন অফিস থেকে ফেরেনি তখনো। জিশান দিনের বেলা বাইরে থাকে। সেই সুবাধে ঘরে কেবল তারা বউ শ্বাশুড়ি।
মায়মুনা চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে আছে। মুশরাফা ধরে নিল, শ্বাশুড়ি ঘুমাচ্ছে। তার ঘুমে ব্যাঘাত হবে বলে ফিরতি পা বাড়াল। মায়মুনা ডাকলেন পিছু, ‘কিছু বলবে?’

মুশরাফা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল শ্বাশুড়ির পানে। মায়মুনা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি শান্ত। মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ বাসায় কী কী ইফতার বানানো হয়?’
‘ রুহ আফজা, ফ্রুট সালাদ, দই চিড়ার ডেজার্ট, চিকেন ফ্রাই, ফালুদা, আর ডিম, দুধ, শরবত। ‘

থামলেন মায়মুনা। তারপর কী যেন ভেবে বললেন,
‘ দই চিড়ার ডেজার্ট আমি বানাব। কাকন ফালুদা আর ফ্রুট সালাদ করবে। তুমি চিকেন ফ্রাই, আর শরবত করো।’

‘ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজু, ডিম চপ কোন কিছু করা হবে না?’
‘ সারাদিন রোজা রেখে ভাজাপোড়া খায়না কেউ। চিকেন ফ্রাইটা খাওয়া হয় শুধু। ইফতার হালকাই হয়। তুমি খেলে করতে পারো।’

খাবারের ইচ্ছে মনে চেপে রাখতে নিষেধ করেছেন রাসূল। মুশরাফা বলল, ‘আমি ডিম চপ আর বেগুনি খাই। ওগুলো করব তাহলে।’

মায়মুনা শান্ত স্বরে বললেন, ‘ বেগুন নেই ঘরে। জাওয়াদকে ফোন দিয়ে বলো আনতে।’

মুশরাফা সায় জানাল। মায়মুনা আবার বললেন, ‘ শরবত চারজনের জন্য করো।’

‘বাকিরা খাবে না?’ মুশরাফা ভ্রু কুঁচকাল। মায়মুনা বললেন,
‘আজ যায়েদ অফিসে ইফতার করবে। জিশান, জাওয়াদ তো ইফতার করে না। জিহাদ শুধু একটু ফালুদা মুখে নিবে। বাদবাকি আমরা চারজনের ইফতার বানালেই হবে। ‘

মুশরাফা চোখে প্রশ্ন খেলে গেল, ‘রোজা রেখে ইফতার করে না!’
মায়মুনা বললেন, ‘রোজা রাখলে তো ইফতার করবে। ওরা রোজা রাখে না। ‘

মুশরাফার স্তব্ধ হয়ে গেল এ কথা শুনে। এত বড়ো ছেলে রোজা রাখে না! জিশান নয়, জাওয়াদের কথাই তাকে ভাবালো বেশি। জাওয়াদ ও রোজা রাখে না! ও কাঁপা স্বরে বলল,
‘জাওয়াদ একটা রোজা ও রাখে না!’
‘জিশান যা দুই একটা রাখে কালে ভাদ্রে। জাওয়াদ তাও রাখে না। এত বলে কয়েও এই ছেলেকে রোজা রাখাতে পারিনি। শেষ কবে ও রোজা রেখেছে ও নিজেই জানে না।’ মায়মুনার স্বর বলে দেয় ব্যাপারটা স্বাভাবিক।

মুশরাফার বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিল, আগে এক কথা ছিল। এবার বোধহয় রোজা রেখেছেন। মনের সান্ত্বনার সত্যতা জানতে আমতাআমতা করে বলল,
‘ এবার ত ভাঙার কথা না।’
‘আমি ও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু সকালে অফিস যাবার আগে ওকে কিচেন থেকে বেরোতে দেখে আমার ভুল ভাঙল। ‘

হতভম্ব হয়ে গেল মুশরাফা। সাহরি খেয়ে ঘুমানোর পর উঠতে দেরি হয়ে গেছে তার। তাকে ঘুমে রেখে অফিস গেছে জাওয়াদ। তাই টের পায়নি।
বাকরুদ্ধতায় কথা বলতে পারল না। ভেতরে কষ্টের বন্যা বয়ে গেল। এমন তো হবার কথা ছিল না! তবে কি সে ব্যর্থ! জাওয়াদ কেবল ওর সামনে ভালো সাজার চেষ্টা করছে! মনে একটা সন্দেহের দানা বিঁধল। চাপা কষ্টে চোখে পানি চলে এলো। মায়মুনা আকস্মিক বললেন,
‘ ও হ্যাঁ, ফ্রিজে কালকের বিরিয়ানি আছে। জাওয়াদ আসলে খেতে দিও। জাওয়াদ আসলে ওকে গরম করে দিও।’

মায়মুনার কথা শুনে মুশরাফার মনে হলো বে-রোজাদারের জন্য খাবার তৈরি করা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এবং তা বাধ্যতামূলক। না দিলেই নয়। মুশরাফা অবাক চোখে চাইল, ‘ রোজা না রাখলে উনাদের জন্য রান্না করা হয়?’

মায়মুনা স্বভাবিক ভাবেই বললেন, ‘হ্যাঁ। রোজা যেহেতু রাখেনি, উপোস থাকবে কেন, কিছু খাক। তাই সকালে টুকটাক রান্না করে রাখি।’

মুশরাফা শূন্য চোখে চেয়ে রইল শ্বাশুড়ির দিকে। কিছু বলল না। মুলত, সে স্থবির হয়ে গেছে। বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। ওর পরিবার উশৃংখল হলেও রোজার মাসে দিনের বেলায় রান্না হতো না। কেউ রোজা না রাখলে বাইরে থেকে খেয়ে আসতো, তাই বুঝা যেত না। কে রোজা রাখেনি। মুশরাফা ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকল। শ্বাশুড়ির পাশে বসে বলল,
‘ আপনি কি জানেন মা, আপনার এই স্নেহ একদিন আপনার কাল হয়ে দাঁড়াবে?’

মায়মুনা সোজা হয়ে বসে ভ্রু কুঁচকালেন, ‘কাল হবে কেন?’
‘পাপ যে করে এবং যে পাপকে প্রশ্রয় দেয়, উভয়ই সমান অপরাধী। রোজা হলো ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। একটা ফরজ ইবাদত। নামাজ যেমন ফরজ, রোজা ও তেমন ফরজ। রাখতেই হবে, কোন ছাড় নেই। যদি সমস্যা হয় তবে ভিন্ন ব্যাপার। আমার জানামতে উনারা দুজন সুস্থ সবল মানুষ। কোন সমস্যা নেই। সুতরাং তারা যদি রোজা না রাখে অর্থ্যাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দেয় তবে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে। তারা ফরজ কাজ পালন করছে না, তা জেনেও আপনি কঠোর হয়ে শাসন না করে তাদের রান্না করে খাওয়ানোর মাধ্যমে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এতে উনারা রাখার হলে ও রাখবে না। কেয়ামতের দিন ফরজ লঙ্ঘনের দায়ে উনাদের শাস্তি দেয়ার সময় প্রশ্রয়ের দায়ে আপনাকেও শাস্তির আওতায় আনা হবে। এটা কাল না?’ বিনম্র স্বরে বলল মুশরাফা।

মায়মুনা অসন্তোষ গলায় বললেন, ‘ চেষ্টা করেছিলাম। পারলাম না। কী করব আর?’

মুশরাফা কোমল গলায় বলল, ‘ আপনি কঠোর হন। রোজা না রাখলে বাসায় কোন রান্না হবেনা। আমি রান্না করব না, আপনাকে বললে আপনি সাফ না করে দিবেন। যেভাবে হোক উনাদের রোজা রাখা উচিত। ইচ্ছেকৃত রোজা ছাড়ার পরিনাম খুব ভয়ানক মা। উনারা সহ্য করতে পারবেন না।’

মুশরাফার চোখে একরাশ ভয়, রক্তশূন্য চোয়াল। মায়মুনা ভ্রু কুঁচকালেন, ‘ তুমি ভয় পাচ্ছো কেন?’

মুশরাফা ভীত স্বরে বলল, ‘আপনাকে একটা হাদিস শুনাই, মা?’ অনুমতি চাইল সে। মায়মুনা আগ্রহীভাবে ভ্রু নাড়ালেন।

মুশরাফা বলল,
‘হজরত আবু উমামাহ বাহেলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, একদিন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম; এমন সময় আমার কাছে দুই ব্যক্তি উপস্থিত হল।
তারা আমার উভয় বাহুর উধ্বাংশে ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ে উপস্থিত করালো এবং বললো, ‘আপনি এ পাহাড়ে আরোহন করুন।’
আমি বললাম, ‘এ পাহাড়ে আরোহন করতে আমি অক্ষম।’ তারা বলল, আপনার চলাচল আমরা সহজ করে দেব।’ সুতরাং আমি এ পাহাড়ে চড়লাম।
অবশেষে যখন পাহাড়ের চুড়ায় আরোহন করলাম, তখন বেশ কিছু চিৎকার-ধ্বনি শুনতে পেলাম।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এ চিৎকার-ধ্বনি কাদের? তারা বললেন, ‘এ হলো জাহান্নামীদের চিৎকার-ধ্বনি।
পুনরায় তারা আমাকে নিয়ে চলতে লাগলেন। হঠাৎ দেখলাম একদল লোক তাদের পায়ের গোড়ালির ওপর মোটা রশি দিয়ে (বাধা অবস্থায়) ঝুলানো আছে, তাদের কশগুলো কেঁটে ও ছিড়ে আছে। তা থেকে রক্ত ঝরছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ওরা কারা। লোকদুটো বলল, ওরা হল তারা, যারা সময় হওয়ার আগেই ইফতার করে নিত। অর্থাৎ রোজা ছেড়ে দিতো।’ (বাইহাকি, ইবনে খুযাইমা, ইবনে হিব্বান, মুসতাদরেকে হাকেম)

মুশরাফার চোয়াল তখন ভয়ে ডুবে গেছে। চোখে পানি ভর করেছে। স্বর কাঁপছে। জাওয়াদকে ওই অবস্থায় কল্পনা করতেই বুক কাঁপছে ওর। মুশরাফা কাঁপা স্বরে বলল,
‘ আমার ভেবেই বুক কাঁপছে। উনারা সহ্য করবে কিভাবে, মা? আমি জাওয়াদকে বুঝাব, আপনি জিশান ভাইয়াকে বুঝান। প্লিজ মা! সরাসরি জিজ্ঞেস করুন, রোজা রাখে না কেন? হাদিস দিয়ে বুঝিয়ে বলুন, নয়তো আদেশ করুন। পরকালের ওই শাস্তি থেকে দুনিয়ার ওই ক’ঘন্টার উপোস কোটিগুন সহজ। পরকালীন ওই শাস্তি সহ্য করতে পারবেন না উনারা। উনাকে ওখানে কল্পনা করতেই আমার ভয় লাগছে। ‘

ঠোঁট চেপে ধরল মুশরাফা। কান্না আটকানোর স্পষ্ট চাপ। ওর গা কাঁপছে,মায়মুনার হাতে রাখা হাতটা কাঁপছে থরথর করে। বারবার ঢোক গিলে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।
শাস্তির বিবরণ শুনে আঁতকে উঠেছেন মায়মুনা। বুক কাঁপছে, চোখে ভয় ভর ধরেছে তারও। সেই ভয়ের সাথে যোগ হয়েছে বিস্ময়। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে তার বিপদ কল্পনা করে এতটা ভয় পেতে পারে! কতটা ধর্মভীরু হলে কান্না স্বামীকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য এমন ছটফট করতে পারে জানা নেই মায়মুনার। তিনি অবাক চোখে দেখে গেলেন পুত্রবধূকে। মুশরাফা হাতের বাধন শক্ত করে অনুরোধের সুরে বলল,
‘ তিন ব্যাক্তির দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়। ১. মুসাফির। ২. রোজাদার। ৩. সন্তানের জন্য মা বাবার দোয়া।’
আপনি তো এখন রোজা অবস্থায় আছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, আল্লাহ উনাদের হেদায়েত দান করুন। মা, এবং রোজাদার দুই হিসেবে আপনার দোয়া কবুল হবে ইন শা আল্লাহ। প্লিজ মা, উনার জন্য, উনাদের জন্য দোয়া করুন!’

মুশরাফার ভাব দেখে মায়মুনার মনে হলো, জাওয়াদের সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষ মুশরাফা। তারচেয়ে বেশি ভালো চায় সে। তিনি তো কখনো এভাবে ভেবে দেখেন নি। ছেলেরা যা চায় তাই দিয়েছে, কিসে তাদের ভালো তা নয়। বাবা শাসন করতে গেলে তিনি আগলে নিয়েছে। তিনি যদি মুশরাফার মতো এভাবে ভাবতেন তবে বোধহয় আজ তার ছেলেমেয়েরা অন্যরকম হতো। মায়মুনা ধীর স্বরে বলল,
‘ আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করব। মায়ের দোয়া যেহেতু কবুল হয়, সেহেতু ওরা ঠিক পথে আসবে। ওরা এলে আমি কথা বলব। এখন যাও, রান্না বসাও।’

মুশরাফা উঠে দাঁড়াল। কাঁপা বুকেই এগুলো রান্নাঘরের দিকে। মাংস মেরিনেট করার সময় কলিংবেল বাজল। অন্যদিন দরজা খুলতে গেলেও আজ গেল না। জিহান গিয়ে খুলে দিল। জাওয়াদ এসেছে। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। বাজারের ব্যাগে চোখ রেখে জিহান বলল,
‘আমার জন্য কী এনেছো চাচ্চু?’

প্রতিদিন বাইরে থেকে ফেরার সময় ওর জন্য একটা চিপস হলেও আনতে হবে। নয়তো বাইরে নিয়ে খাইয়ে আনতে হবে। নাহলে বাড়ি মাথায় করবে। জাওয়াদ চিপসের প্যাকেট দিল হাতে। তারপর একটা স্প্রাইটের বোতল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘পুরোটা খাবিনা, আমার জন্য রাখবি।’
‘ থ্যাঙ্কিউ চাচ্চু।’ আনন্দিত সুরে বলে প্যাকেট হাতে নিয়ে ছুটল জিহান।

জাওয়াদ হাসিমুখে বাজার ব্যাগ নিয়ে এলো কিচেনে। ব্যাগটা ফ্লোরে রেখে ক্লান্তময় শ্বাস ফেলে বলল,
‘ এই বাজার বয়ে আনতে গিয়ে এনার্জি শেষ। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও তো!’

এক খন্ড লাভা যেন মুশরাফার চোখে ঢেলে দিল কেউ, এমন অগ্নিচোখে তাকাল জাওয়াদের পানে। একে তো রোজা রাখেনি, তারউপর ওকে ফরমাইশ দিচ্ছে তার সেবা করতে! কত বড় নির্লজ্জ! জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘ তুমি যেভাবে তাকাচ্ছো যেন তোমার দুটো কিডনি চেয়েছি। সামান্য এক গ্লাস পানি চাইলাম, এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আশ্চর্য! ‘

মুশরাফা আবার তাকাল সেই ভয়ানক চোখে। জাওয়াদ আফসোসের সুরে বলল,
‘ স্বামী অফিস থেকে এসেছে, কোথায় একটু সেবাযত্ন করবে তা না রিনা খান সেজে বসে আছে। হয়েছে টা কী বলবে?’

মুশরাফা এমন ভান করল যেন তার কথা শুনেই নি। জাওয়াদ ফ্রিজের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ লাগবে না তোমার পানি দেয়া। আমি নিজেই নিয়ে খেতে পারি।’

ফ্রিজ খুলে একটা পানি বোতল বের করল। ক্যাপ খুলতে খুলতে পা বাড়াল সামনের দিকে। মুশরাফা ক্রুর চোখে তাকিয়ে দেখল কেবল। কিছুই বলল না। জাওয়াদ সোফায় বসে জিহানের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আজ বাসায় কিছু হয়েছে?’

জিহান চিপস খাওয়া থামিয়ে ভাবুক হলো। মনে করার চেষ্টা করল। জাওয়াদ কোমল স্বরে বলল,
‘মনে করে দ্যাখ তো, তোর দাদুমণি তোর চাচ্চীকে বকেছে কি না! বললে আইসক্রিম খাওয়াব তোকে।’

জিহান অনেকক্ষণ সময় নিয়ে মনে করার চেষ্টা করল। তারপর বলল, ‘না, দাদুমণি বকে নি চাচ্চিকে। চাচ্চি তো রুমেই ছিল। একটু আগে বের হলো।’

জিহান মিথ্যা বলে না। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। মা কিছু না বললে রাফার হলো টা কি আজ! তবে কি আবার শ্বশুরবাসা থেকে ফোন এসেছে! কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল জাওয়াদের। আনমনে বোতলটা মুখের সামনে ধরে এক ঢোক পানি নিল মুখে। ওমনি জিহান প্রশ্ন করল,
‘মা, বাবা দাদাভাই, দাদুমণি সবার রোজা রেখেছে। তুমি রোজা রাখোনি চাচ্চু?’

বিষম খেল জাওয়াদ। পানি নাকে উঠে একাকার। কাশতে শুরু করল সে। কাশছে তো কাশছে থামার নাম নেই। মুশরাফা দৌড়ে এলো। ওক রুগ্ন মুখ দেখে এগিয়ে যেতে গিয়ে হাতে ধরা বোতল দেখে থেমে গেল। কেন যেন এগুলো না। রোজা না রেখে পানি খাচ্ছে, খাক আরও ভালো করে। শাস্তি হোক। বে-রোজদারের জন্য তার মনে অনুভূতি উগড়ে পড়ছে না।
মুশরাফা রান্নাঘরে ফিরে গেল। জাওয়াদ বেসিনের দিকে এগুলো। কাশি থামার পর রান্নাঘরে গিয়ে মুশরাফার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে ও ব্যার্থ হলো। রুমে ফিরে অপেক্ষা করল ওর। আসর নামাজ পড়তে রুমে গেল। যেতেই জাওয়াদ হাত ধরে বলল,
‘কী হয়েছে তোমার? বলো।’

মুশরাফা হাত সরিয়ে নিল। কিভাবে পারল লোকটা ওর সামনে ভালো সাজতে! একটু ও বাধল না! জাওয়াদ বিরক্তির সাথে বলল, ‘আরে! না বললে বুঝব কিভাবে?’

মুশরাফা এবার মুখ খুলল। ভরাট স্বরে বলল,
‘ নিজেরটা বুঝুন, তাতেই হবে।’

বলেই ওয়াশরুমে চলে গেল। জাওয়াদ ‘আমি কী করেছি’ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বসে গেল। মুশরাফা এসেই জায়নামাজে দাঁড়াল। সেজদায় লুটে কাঁদতে দেখা গেল তাকে! জাওয়াদের চিন্তার মাত্রা বাড়ল। হয়েছি এই মেয়ের! বারান্দায় গিয়ে ফোন দিলো মামী শ্বাশুড়িকে। ওখানকার খবর নেয়ার বাহানায় জেনে নিল কিছু হয়েছে কি না। নাহ্, সন্দেহজনক কিছুই তো কানে এলো না। তবে সমস্যাটা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!

ফিরে এসে ওকে পাওয়া গেল না। ইফতার সাজিয়ে সবাইকে ডাকলে ও জাওয়াদকে ডাকল না মুশরাফা। জাওয়াদ নিজে গিয়ে টেবিলে বসল। মুশরাফা রুহ আফজা গুলতে গুলতে শ্বাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলল,
‘মা, আপনাকে আমি একটা কথা স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, কোন বে-রোজাদারের জন্য আমি আজও রান্না করি নি, আর কখনও করবও না। ‘

রাশভারী দেখাচ্ছে ওকে। মায়মুনার হাসি পেল কেন যেন। অন্যদিক মুখ ঘুরিয়ে হাসলেন। হাসি থামিয়ে গম্ভীরমুখে বললেন,
‘আমি ও না।’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল আবার।

চলবে…

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-১১)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

ভাদ্রের শেষ বিকেল। নীলাভ আকাশে মেঘের দল উড়াউড়ি করছে। কী সুন্দর লাগছে! রুহ আফজায় চামচ নাড়ানোর ফাঁকে আকাশ পানে চোখ গেল মুশরাফার। প্রথমে তার চোখে মুগ্ধতা দেখা গেলেও পরক্ষণেই কেমন যেন অভিযোগ ভেসে উঠল। সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসে আছে, মাঝে-মধ্যে বিপদে আকাশের দিকে মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের কষ্টগুলো আল্লাহকে বলা সুন্নত। মুশরাফা যেন তার দুঃখগুলো আল্লাহকে বলতে চাইল। উদাস হলো সে। মনোযোগ ঘুরে গেছে, হাত থেমে গেছে। জিহানের কথায় ধ্যান ভাঙল,
‘আমি ও তো রোজা রাখি না, তাহলে তুমি আমাকে নুডলস করে দিবে না, চাচ্চি?’ করুণ সুরে বলল জিহান।

মুশরাফার ধ্যান ভাঙলো। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল পাশে এসে দাঁড়ানো জিহানের দিকে। কেমন অসহায় চোখে চেয়ে আছে ছেলেটা। ওর মুখখানা দেখেই হাসি পেল মুশরাফার কিন্তু হাসল না। কোমল সুরে বলল,
‘ অবশ্যই করে দিব। কারণ তোমার জন্য তো এখনো রোজা ফরজ হয়নি। যাদের উপর রোজা ফরজ হয়েছে, তারা রোজা ছাড়লে আমি তাদের জন্য কিছু রান্না করতে পারব না। ‘ বলে ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল।

জিহান খুশি হলো। হেসে বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ চাচ্চি! আমার জন্য রোজা কখন ফরজ হবে? ‘

মুশরাফা এবার হাসল। ওর গাল টেনে বলল, ‘ তুমি যখন সিক্স সেভেনে পড়বে তখন তোমার উপর রোজা ফরজ হবে। তখন তুমি যদি ছাড়ো, আল্লাহ তোমাকে শাস্তি দিবেন। তাই আমি ও তোমার জন্য কিছু রান্না করতে পারব না।’

প্রাপ্ত বয়সে পা রাখলে রোজা ফরজ হয়। শরীয়তের দৃষ্টিকোণে প্রাপ্ত বয়স্কের সময়সীমা ধরা হয় বয়ঃসন্ধিকাল শুরুর দিক থেকে। মেয়েদের ১১-১৩ বা পিরিয়ড শুরুর পর, এবং ১৩-১৫ বা ছেলেদের দাঁড়ি গোঁফ উঠতে শুরুর পর। জিহান এখনো ছোটো মানুষ। এই ভারি শব্দ বুঝবে না, তাই মুশরাফা সাবলীলভাবেই বলল। জিহান পালটা প্রশ্ন করল,
‘চাচ্চুরা তো সিক্স সেভেন পার করে এসেছে, তাহলে তারা থাকে না কেন?’

মুশরাফা দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘তা তোমার বে-রোজদার চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করো। ‘ বলে জাওয়াদের দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। জাওয়াদ ওর যাওয়ার পানে চেয়ে বলল,
‘মা, ও কি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকে বে-রোজদার বলে গেল!’

ছেলে-ছেলেবউয়ের পরোক্ষ ঝগড়ার একমাত্র সাক্ষী হলেন মায়মুনা। তিনি টেবিলের এক কোণে বসে দুজনের কান্ড দেখছেন। ঠিক দেখছেন না। বরং উপভোগ করছেন। ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি তার। ছেলের কথায় বিজ্ঞ গলায় বলল,
‘ তুই ভুল ভাবতেছিস। ‘
‘মানে? ও আমাকে বলেনি?’
‘অবশ্যই তোকে বলেছে । তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নয়, সোজাসাপটা বলেছে।’ ঠোঁট চেপে হাসলেন মায়মুনা। জাওয়াদ অবাক হয়ে বলল,
‘আশ্চর্য, আমাকে কেন বলবে?’

মায়মুনা হঠাৎ গম্ভীর হলেন। ধমকে উঠলেন, ‘রোজা রাখিস নি কেন?’

মুশরাফা গ্লাস নিয়ে ফিরল খানিক বাদে। আসার সময় শুনল জাওয়াদের বিরক্তঘন স্বর, ‘ কাঁচা বাজার আছে কি না চেক করতে গেছিলাম।’

মুশরাফা গ্রাহ্য করল না সে কথা। মনোযোগ দিয়ে গ্লাসে শরবত ঢালায় মন দিল। জয়নাল আবেদীন সাহেব অফিস থেকে ফিরে বিশ্রাম নিয়ে টেবিলে আসলেন। ছেলেকে টেবিলে দেখে ভারি অবাক হলেন। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,
‘ রোজা রেখেছিস না কি রোজা ছাড়াই টেবিলে বসে পড়েছিস? এবার অন্তত রোজা রাখার ইচ্ছেটা কর!’

স্ত্রীর সামনে এহেন কথা বলায় জাওয়াদ লজ্জা পেল। কাচুমাচু করে উঠল। মুশরাফা আবার ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল। তাকিয়েই চলে গেল রান্নাঘরে।

জাওয়াদ বিড়বিড় করে বলল,
সবার বউ ঝগড়া করে। চিৎকার, কান্নাকাটিতে বাড়ি মাথায় তুলে। কিন্তু আমার বউ তা করে না। না চিল্লাবে, আর না কান্না করবে। সবার মতো মুখ দিয়ে নয় সে তখন ঝগড়া করবে চোখ দিয়ে। শুধু তাকাবে, সেই তাকানোর মাঝে থাকবে ভয়ংকর লাভা থাকবে। এখন দেখো কিভাবে তাকাচ্ছে মেয়েটা, পারলে চোখ দিয়ে বাষ্প করে ফেলবে। স্বামীর দিকে কেউ এভাবে তাকায়! বেয়াদব মেয়ে।

চাপা শ্বাস ফেলে ধীর স্বরে বলল, ‘ সময় তো সব এক থাকে না, বাবা। ‘
জয়নাল আবেদীন বিস্মিত চোখে তাকালেন। বাপ ছেলের চোখে চোখেই কথা হলো।

কাকন ফালুদা বাটিতে ঢেলেছে। মুশরাফা এনে টেবিলে রাখল। সবার সামনে দিল। জাওয়াদের সামনে বাটি ও রাখল না, তার দিকে তাকাল ও না, তার পাশের চেয়ার খালি থাকা সত্ত্বেও তার অপজিটে শ্বশুরের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসল। জাওয়াদ শূন্য চোখে দেখে গেল কেবল। মায়মুনা চাপা হেসে বাটিটা নিজেই এগিয়ে দিলেন।

মুশরাফা চুপচাপ বসে কী যে বিড়বিড় করছে। জয়লান আবেদীন বললেন,
‘কিছু বলছো তুমি?’
মুশরাফা থেমে গিয়ে বলল, ‘দোয়া পড়ছি, বাবা।’

জয়নাল আবেদীন আগ্রহী চোখে বললেন, ‘কী দোয়া? আমাকে বলো, আমি ও পড়ি।’

মুশরাফা খুশি হলো। প্রসন্ন হেসে বলল, ‘ইফতার সামনে রেখে বেশি বেশি ইস্তিগফার পড়তে বলা হয়েছে। এতে আল্লাহ তা’আলা সব গুনাহ মাফ করে দেন। আর ইফতার সামনে রেখে মোনাজাত ধরে কিছু চাইলে আল্লাহ তাকে ফেরান না। আপনি পড়ুন,
ইয়া ওয়াসিয়াল মাগফিরাতি, ইগফিরলী।

অর্থ: হে মহান ক্ষমা দানকারী! আমাকে ক্ষমা করুন।’

জয়নাল আবেদীন পারতেন না দোয়াটা। অথচ তার মাঝে কোন লজ্জাবোধ দেখা গেল না। বরং তিনি আগ্রহ নিয়ে পুত্রবধূ থেকে শুনে শিখলেন। পড়লেন কিছুক্ষণ। ততক্ষণে মুশরাফা মোনাজাতে হাত তুলেছে। সাইরেন কানে যেতেই মোনাজাত শেষ করল। খেজুর দিয়ে রোজা ভঙ্গ করা সুন্নত। মুশরাফা একটা খেজুর তুলে পড়ল,
‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়ালা রিযকিকা আফতারতু । ‘ তারপর মুখে নিল ।

খেজুর শরবত আর একটা চিকেন ফ্রাই খেয়ে উঠে গেল জাওয়াদ। উঠতে উঠতে বলল,
‘বাবা, আমি নামাজে যাচ্ছি। তোমার জন্য দাঁড়াব?’

জয়নাল আবেদীন ও উঠে পড়লেন। বেশি খেলে নামাজ পড়তে পারবেন না। বাকিটা এসে খাওয়া যাবে। বললেন, ‘ দাঁড়া’

জাওয়াদ রুমে চলে গেল। টুপি নিয়ে ফিরে এলো। কোন দিকে না তাকিয়ে নামাজের জন্য বেরিয়ে গেল। বাবার জন্য বাইরেই অপেক্ষা করল।

নামাজ পড়ে এসে দেখল মুশরাফা পড়তে বসেছে। জাওয়াদ খাটে বসে গম্ভীরমুখে বলল,
‘এদিকে এসো, কথা আছে।’

মুশরাফা পড়া থামিয়ে শুনল কেবল। নাক ফুলিয়ে আবার পড়া শুরু করল। জাওয়াদ কিছুটা রেগে বলল, ‘আসতে বলছি, কথা কানে যাচ্ছে না!’
মুশরাফা এবার ধীর স্বরে বলল, ‘ আমার পড়ার সময় যে কেউ কথা বললে আমি বিরক্ত হই।’
‘আমি যে কেউ!’ জাওয়াদ টেনে বলল।
মুশরাফা মৃদুস্বরে বলল, ‘কেউ না।’

‘দুই মিনিটের ব্রেক নাও, পরে পড়ে নিও।’

মুশরাফা পাতা উল্টাচ্ছে শুধু, আসার নামটি নেই। জাওয়াদের চোয়ালখানা রাগে লাল হলো। বিড়বিড় করে ‘আউজুবিল্লাহ ‘ পড়ল ক’বার। রাগ নিয়ন্ত্রণ হারালে আজ এই মেয়ের কপালে শনি ভর করবে। মুখে হাত বুলিয়ে বারান্দায় চলে গেল। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার জোর চেষ্টা চালাল কিছুক্ষণ। তারপর দ্রুত পায়ে ফিরে এলো। খাটের পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে মুশরাফার পাশে রাখল। ও বসতেই মুশরাফা উঠে যেতে উদ্যত হলো। জাওয়াদ ওর কাধ চেপে বসিয়ে বলল,
‘ আমি চাইছিনা, আগের জাওয়াদে ফিরে যেতে। তার রাগটা ভয়ানক ছিল। চুপচাপ বসো, এক পা নড়বে খুব খারাপ হয়ে যাবে। ‘

রাশভারী স্বরে বলা কথাটায় ভয়ানক রাগের আভা ছিল। যা মুশরাফাকে বসতে বাধ্য করল, কদম বাড়ানোর সাহস হলো না। বসে গেলে ও কাধে জাওয়াদের হাতটা রাখল না, স্পর্শহীনভাবেই কাধ নাড়িয়ে সরিয়ে ফেলল। তাকিয়ে রইল বইয়ের দিকে। জাওয়াদ হাত সরিয়ে ধীর স্বরে বলল,
‘লুক এট মি।’

মুশরাফা তাকাল না, বরং বইয়ের মনোযোগ বাড়াল। জাওয়াদ বই বন্ধ করে ফেলল। মুশরাফা আবার বই খুলে বইয়ের দিকে ঝুকে গেল। জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল,
‘তাকাতে বলছি না!’
মুশরাফা তাকাল না। বইয়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘আমি বে-রোজদারের দিকে তাকাই না।’ কী অভিমান জড়ানো ছিল কথাটায়!

কথাটা শুনেই হাসি পেল জাওয়াদের। হাসল না। ফিসফিস করে বলল,
‘তাকাও। কথা না শুনলে মাইর দিব কিন্তু!’

ধমকমিশ্রিত বাক্যটা কী আদুরে শুনাল! কোন রাগ নেই স্বরে, কোমলতায় ভাসছে। মুশরাফা তাকাল রেগে, ভ্রু কুঁচকে। জাওয়াদ শান্তভাবে বলল,
‘তোমার ভাবলে কী করে, আমি এখন রোজা ছাড়ব?’
মুশরাফা প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করল, ‘আপনি রোজা ছাড়েন নি বলতে চাইছেন?’
‘ তা নয়তো কী! মানছি, আগে আমি রোজা রাখিনি। তখন আমার লাইফস্টাইল ভিন্ন ছিল। আমি ইসলামে থেকেও ছিলাম না। এখন আমার অবস্থা ভিন্ন, আমি মনেপ্রাণে ইসলামে প্রবেশের চেষ্টা করছি। নামাজ পড়ছি নিয়মিত, ফরজ বলে এক ওয়াক্ত নামাজ ও আমি ছাড়ি না তা তুমি জানো। নামাজের মতো ফরজ রোজা আমি ছাড়ব এটা তুমি ভাবলে কিভাবে?’

মুশরাফার মুখে অভিমান বিলীন হয়ে বিস্ময় ফুটে উঠছে। সে অবিশ্বাস্য সুরে বলল, ‘সত্যি আপনি রোজা ছাড়েন নি?’

জাওয়াদ আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘আমি তোমাকে ভয় পাই না যে মিথ্যা বলব। আর সত্য বলার সৎসাহস আছে আমার। না রাখলে স্পষ্টভাবে বলতে পারতাম রাখিনি। আল্লাহকে ভয় না করে বান্দাকে ভয় করব কেন!’

‘ রোজা না রাখলে সকালে কিচেন কেন গেছেন? এসে পানি কেন চাইলেন? আর পানি খেলেন কেন?’ সন্দিহান চোখে জেরা করল মুশরাফা।

‘রোজা রাখার অভ্যাস নেই আমার। এতবছর বাদে রোজা রেখেছি। প্রথম রোজা। তাই মনে ছিল না। অভ্যাসগতভাবে এসে পানি চেয়েছি, নিজে নিয়ে মুখে ও তুলেছি। এতদিন খেয়ে অভ্যাস হওয়ায় স্মরণে ছিল না। জিহান বলায় মনে পড়েছে, ব্যতিব্যস্ত হতে গিয়েই নাকে উঠে এসেছে। তারপর আমি বেসিনে গিয়ে ফেলে দিয়ে এসেছি। ব্যাস এতটুকুই। ‘
থামল জাওয়াদ। তারপর বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ সামান্য একটা কথাকে কোথা থেকে কোথা নিয়ে গেছো তুমি! এইজন্যই বলি, এক পাতা বেশি বুঝো তুমি।’

জাওয়াদের স্বরে আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়। চোখে চলনার রেখা নেই, নেই লুকোচুরি মণি নাড়ানো। ঘামছে না সে, গলা কাঁপছেনা। এটা প্রমাণ করছে, লোকটা মিথ্যা বলছে না। তা ছাড়া জাওয়াদ ভীতু নয়, নিজের অপরাধ ও গলা উঁচু করে স্বীকার করে সে। শিকার করার না হলে এড়িয়ে যায় কিন্তু মিথ্যা বলেনা। মুশরাফার কাছে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো। খুশিতে ভরে গেল মন। সে চোখ নামিয়ে বলল,
‘ রোজার সময় কেউ পানি চাইলে তাকে বে-রোজদার ভাবটাই স্বাভাবিক। ‘

‘একটাবার জিজ্ঞেস করতে আমায়? তা না করে, মনগড়া গল্প বানিয়ে রেগে বসে আছো। ‘ জাওয়াদের স্বরে রাগ অভিমান। মুশরাফার রাগ পড়ে গেছে ততক্ষণে। সে অনুতপ্ত সুরে বলল,
‘স্যরি। আমি আসোলে কোনভাবে মানতে পারছিলাম না। এত কিছু জেনেও এখন রোজা ছাড়বেন এটা ভাবতেই রাগ লাগছিল। ‘

জাওয়াদ রেগে বলল, ‘ আমার ভীষণ রাগ লাগছিল। ‘
মুশরাফা তার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আল্লাহ না করুক, আপনি যদি ধন সম্পদ হারিয়ে ফেলেন, কিংবা বিকলাঙ্গ ও হয়ে যান তবু ও আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না ইন শা আল্লাহ। কিন্তু আপনি যদি দ্বীনে ফিরে দ্বীন ছেড়ে দেন তবে আমি আপনাকে ছাড়তে দু’বার ভাবব না।’

জাওয়াদ ও বলল, ‘ হেদায়েত আল্লাহর রহমত। আল্লাহর এই রহমত কেউ একবার প্রাপ্ত হলে আর কাছছাড়া করেনা। আমি বোধহয় সেই রহমত পেতে শুরু করেছি। কাছছাড়া করব না ইন শা আল্লাহ। নিশ্চিন্ত থাকো।’

মুশরাফা প্রাণবন্ত হাসল। জাওয়াদের হাত ধরল শক্ত করে। সেই বন্ধন যেন বলে উঠল, তবে আমিও আপনাকে ছেড়ে যাব না। জাওয়াদ স্ত্রীর রাগের জলাঞ্জলি হতে দেখে হাসল। আকস্মিক গম্ভীর ভঙিমায় বলল,
‘ এত তাড়াতাড়ি আমি কিছু ভুলছি না। তুমি অনেকগুলো অপরাধ করেছো। এক, না জেনে ধারণা করেছো। দুই, যাচাই বাছাই ছাড়া আমার উপর অপবাদ দিয়েছে। তিন, আমার সাথে চোখ দিয়ে মিসবিহেব করেছো। এই তিনটা অপরাধের দায়ে তোমার শাস্তি প্রাপ্য। কী শাস্তি দেয়া যায় বলো তো?’

মুশরাফার চোয়ালে মেঘ নামল। চোখ জ্বলে উঠল অনুতাপে। মুখে অপরাধবোধ, কন্ঠ কাঁপল। বলল,
‘আপনি আমায় ক্ষমা করে দিন। আমার মস্তিষ্ক কাজ করেনি তখন। প্লিজ!’

মুশরাফা আবার কোমল হলো। পারলে কেঁদে দেয়। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। হেসে বলল,
‘রিল্যাক্স! আমি মজা করছিলাম।’
মুশরাফা হাসল না। অনুতপ্ত সুরে বলল,
‘ আল্লাহর হক আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। কিন্তু বান্দার হক আল্লাহ ক্ষমা করেন না।
আপনি জানেন বান্দার হক নষ্ট করার পরিণতি কত ভয়ানক? ‘

জাওয়াদ আগ্রহী গলায় জানতে চাইল’ আল্লাহর হক আর বান্দার হক মানে কী?’

মুশরাফা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
‘ হক বা অধিকার দুই প্রকার। এক আল্লাহর হক, দুই বান্দার হক। । আল্লাহর হক বলতে ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত ইত্যাদি ইবাদতকে বুঝায়। বান্দার হক বলতে, বান্দার সঙ্গে সম্পৃক্ত হকগুলোকে বুঝায়। যেমন ; পারস্পরিক টাকা-পয়সার লেনদেন, টাকা-পয়সার আমানত, কথার আমানত , পারস্পরিক ইজ্জত-সম্মান রক্ষাসহ আরও অনেক কিছু। বান্দার হক নষ্টের অন্তর্ভুক্ত হলো, লেনদেনে ধোঁকা, চলনা, কথা দিয়ে কথা না রাখা, কথায় কথায় অভিশাপ দেওয়া, কথার খোটা বা গালি-গালাজ করা, হিংসা বা নিন্দা করা, হেয় মনে করে, মিথ্যা কথা বলা, কারো প্রতি মিথ্যারোপ করা, অন্যের ছবি বিকৃত করা, অন্যের ক্ষতি করা, কাউকে ধোঁকা দেয়া, কারো সঙ্গে প্রতারনা করা, অন্যের অর্থের লোভ করা, গীবত বা পরচর্চা করা, শত্রুতামী করা ইত্যাদি ।
বান্দার হক নষ্ট করার সম্পর্কে ইসলাম বলে, যে পর্যন্ত এক বান্দা অন্য বান্দার হক (যার হক সে নষ্ট করেছে) যথাযথভাবে আদায় না করবে বা বান্দার থেকে ক্ষমা চেয়ে না নেবে সে পর্যন্ত আল্লাহও তাকে ক্ষমা করবেন না। সে আল্লাহর কাছে হাজার রাকাত নামাজ পড়ে কাঁদলে ও না। এ ক্ষেত্রে ক্ষমা করার ভারটা আল্লাহ বান্দার হাতে তুলে দিয়েছেন।কেয়ামতের দিন বান্দার হক নষ্টের করার অপরাধে সব ভালো আমল যার সাথে অন্যায় করেছে তার কাছে চলে যাবে। কী কঠিন কথা তাই না!’

মুশরাফা থামল। তারপর আবার বলল,
‘ হজরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা কি জানো অভাবী কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে তো সেই অভাবী যার টাকা-পয়সা ও অর্থ-সম্পদ নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি অভাবী হবে, যে দুনিয়াতে সালাত, সিয়াম, জাকাত আদায় করে আসবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই লোকেরাও আসবে, যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল-সম্পদ আত্মসাত করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে আবার মেরেছে। সুতরাং এই হকদারকে তার নেকী দেয়া হবে। আবার ঐ হকদারকেও (পূর্বোক্ত হক্বদার যার ওপর জুলুম করেছিল) তার নেকী দেয়া হবে। এভাবে পরিশোধ করতে গিয়ে যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায় তবে তাদের (পরের হক্বদারের) গুণাহসমূহ ঐ ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম) ‘

মুশরাফা থেমে গেল। ভয়ে ওর মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেল। জাওয়াদ জানতো না ব্যাপারগুলো। বিস্মিত হলো সে। কী কঠিন শাস্তি! অথচ এই বান্দার হক আমরা কত অনায়েসে হেলা করি। মনের অজান্তে কত ভুল হয়ে যায়, মাশুল দিতে হবে পরকালে। নিজ কর্মের প্রতি অনুশোচনা হলো তার। কত হক নষ্ট করেছে সে! এখন ওই মানুষ গুলোকে পাবে কোথায়! ইশ যদি আগে সাবধান হতে পারতো!
আরও একটা কথা অবাক করল তাকে। ইসলাম এত ছোটো বিষয় ও নজর রেখেছে! বান্দার হক প্রতিষ্ঠিত হলে পৃথিবীতে মানুষের মাঝে অন্যায় হবে না। কেউ অন্যায় করতেই পারবেনা। সব অন্যায় আটকে যাবে বান্দার হকের কাছে। কী সুন্দর ব্যাপারটা! মুগ্ধ হলো সে। বিড়বিড় করে বলল,
‘ইসলাম সুন্দর! সুন্দর তার বিধান।’

পরক্ষণেই স্ত্রীর অনুতপ্ত মুখ দেখে হেসে বলল,
‘আমি মন থেকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আল্লাহ তোমাকে এর জন্য ধরবে না। এবার শান্ত হও।’

কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছতেই মুশরাফার চোয়াল থেকে চট করে কালো মেঘ সরে গেল। শরতের আকাশের মতো শুভ্র মেঘের ভেলা এসে ঝলমলে হেসে উঠল। ওকে সে কী খুশি দেখাল! বই বন্ধ করে ফেলল। আকস্মিক প্রাণোচ্ছল হেসে জাওয়াদকে জড়িয়ে ধরল,
‘আল্লাহ আপনাকে অনেক অনেক পুরষ্কার দিক।’

আতর্কিত হামলায় কিছুটা পিছিয়ে গেল জাওয়াদ। হেসে বলল, ‘ তখন ত একবারে পড়ার জন্য আমাকে ও চোখে পড়ছিল না। এখন বই বন্ধ করলে কেন? পড়ো? আমি বরং যাই।’

মুশরাফা দুটো চেয়ার একসাথে করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। যেতেই দিল না। বলল, ‘পড়ার মুহুর্ত বারবার আসে কিন্তু প্রেমের মুহুর্ত বারবার আসে না। পড়া বাদ, এখন আপনাকে ইনজয় করব। ‘

যাবার লক্ষণ দেখা গেল না জাওয়াদের। মুশরাফাকে আগলে নিয়ে কোমল সুরে বলল, ‘তাকাও, আমার দিকে।’
মুশরাফা তাকাল। জাওয়াদ রিনরিনে গলায় বলল, ‘ এবার বলো দেখি, আমি কেউ না।’

মুশরাফা লাজুক হাসল। ওর চোখে চোখ রেখেই বলল,
‘আপনিই আমার একমাত্র কেউ, যে বড্ডো বিশেষ ।’

এমন একজন স্ত্রী থাকলে সুখের হবার কারণ লাগে না, সোনায় রাঙা সুখানুভুতিতে ছেয়ে থাকে চারপাশ। জাওয়াদ এই ক্ষণে অনুধাবন করল। বড্ডো কোমল স্বরে বলল,
‘সত্যি!’
‘সন্দেহ আছে!’ মুশরাফা ভ্রু বাঁকা। জাওয়াদ নিষ্পাপ ভঙিমায় বলল,
‘ ফালুদার বাটি যে অন্যকথা বলল তখন?’

মুশরাফা ওর বুকে থিতুনী ঠেকিয়ে আলতো সুরে বলল,
‘ এখন পুষিয়ে দিলে চলবে?’
‘দেখা যাক।’

মুশরাফা দ্রুত গিয়ে ফালুদা, চিকেন ফ্রাই, শরবত সব নিয়ে এলো। তখন রাগের কারণে জাওয়াদ ইফতার করতে পারেনি। একে একে সব বাটি জাওয়াদের সামনে রাখল। জাওয়াদের দৃষ্টি কেবল ফালুদার বাটিতেই। বলল,
‘ আজকের ফালুদা তোমার হাতে না খেলে জমবে না।’

মুশরাফা নিঃসঙ্কোচে এক চামচ ফালুদা তুলে দিল। জাওয়াদ নির্দ্বিধায় মুখে নিল। পরের চামচ স্ত্রীর মুখে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘ দেখলে, যে তুমি আমাকে ফালুদা দিলে না, সেই তুমি আমাকে সেই ফালুদা তুলে খাওয়ালে! হোয়াট আ চেইন!’

মুশরাফা ভ্রু কুঁচকাল, ‘আপনি রিভেঞ্জ নিচ্ছেন!’
জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, ‘এটাকে রিভেঞ্জ বলে না পাগলী। এটাকে শাস্তি বলে।’
‘কিসের শাস্তি?’ ভারি অবাক হলো মুশরাফা।

‘আমার চোখ রাঙানোর। স্বামীদের চোখ রাঙাতে নেই জানো না?’

মুশরাফা হেসে ফেলল,’ শাস্তি এত সুন্দর হলে, আমার অপরাধ করতে আপত্তি নেই।’

চলবে…

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here