অনুভূতি_জুড়ে_তুমি
পর্ব_০৫
লেখনীতে: স্পর্ষীয়া ভূমি
রাতের খাবার খেয়েই রুমে ডুকেছে রৌদ্র।দরজা বন্ধ করে বিছানায় উপরে পড়লো।বুকে বালিশ চেপে চোখজোড়া বন্ধ করলো।মুখে উৎফুল্ল হাসি।কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ রেখে খুলে নিলো চোখজোড়া।খাটের থেকে কয়েক হাত দূরে আলমারি।ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো।আলমারি খুলে ড্রয়ার থেকে বের করে নিলো একটা নুপুর সাথে একটা মালা।মালাটা শুঁকিয়ে গিয়েছে।মড়মড়ে হয়ে কয়েকটা ফুলের অংশ ড্রয়ারে পড়েও রয়েছে।কবেকার কে জানে?রৌদ্র কিছুক্ষণ চোখের পলক না পেলে তাকিয়ে থাকলো ঐ দুটো জিনিসে। তারপর মালাটা নাকে চেপে ধরলো।শুকনো মালায় কী ঘ্রাণ পাওয়া যায়?রৌদ্র সে পরিচিত গন্ধটা খুঁজতে লাগলো।পেয়েও গেলো।কেমন এক মাদকতা শরীরটাকে নেশায় মত্ত করলো।বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলো রৌদ্র।কল্পনায় আঁকতে লাগলো এক রমণীকে।শাড়ি পরিহিত, হাতে চুড়ি, কপালে টিপ, মাথার খোলা চুলগুলো বেলিফুলের মালা দিয়ে জড়ানো।পায়ের নুপুরের ক্ষীণ আওয়াজ।মুহুর্তেই চোখ জোড়া খুলে নিলো রৌদ্র।কল্পনার সেই রমনীকে চোখের সামনে আবিষ্কার করলো।মেয়েটিকে দেখে নজর সরালো না।কেন সরাবে নজর?এই সময়টি একান্ত তার। যতোবার ইচ্ছে ততবার দেখবে সে।রৌদ্র মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ভারী চমৎকার হাসলো। বাঁকা হেসে মৃদু কন্ঠে বললো,
‘ আমাকে সেকেন্ডেই সেকেন্ডেই বুকের চিনচিনে ব্যাথা অনুভব না করালেই তো হয়।প্রতিমুহুর্তে তোমার কথায় মনে পরে।কেন?তোমাকে দেখলেই অদ্ভুত মাদকতায় নেশাগ্রস্থ হয়ে যাই যে।সত্যিই বলো তো তুমি মানুষ নাকি ম্যাজিসিয়ান?ম্যাজিক করে দাও নি তো আমার উপর?’
কথাটা বলেই আরেক পা এগুতেই নিলেই দরজায় টোকা পড়লো।রৌদ্র চমকে উঠলো।সামনে তাকাতেই আর দেখা পাওয়া গেলো না সে রমণীর।সে মেয়েটি কী এসেছিলো?রৌদ্র হাসলো।সত্যিই দিন দিন সে পাগল হয়ে যাচ্ছে।পাগলাটে ভাবে ভরে উঠেছে তার মন।নাহলে কী কেউ সজাগ থেকেই কল্পনাকে বাস্তব মনে করে?নুপুর আর মালাটা তাড়াতাড়ি ড্রয়ারে রেখে দরজার দিকে পা বাড়ালো।দরজা খুলতেই টিশার্ট আর প্লাজু পরা আদ্রিতাকে দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো।কপালের চামড়ায় ভাজ পড়লো।দেওয়াল ঘড়িটার দিকে সোজা দৃষ্টি ফেললো।বারোটা বাঁজার আর পনেরো মিনিট বাকি।আদ্রিতা এখনো ঘুমায়নি।বাড়িতে আসার পর এগোরোটা বাঁজতে না বাঁজতেই সে ঘুমিয়ে পড়তো।তবে আজ ঘুমায়নি?রৌদ্র আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘ রাত জেগে প্রেম করছিস নাকি? এখনো ঘুমোস নি যে?’
আদ্রিতা কিছু বললো না। পা বাড়িয়ে ঢুকে পড়লো রুমের ভেতরে।খাটের উপর ধুপ করে বসে পড়েই মুখ বাঁকালো।
‘ আমি তেমন না যে রাত জেগে প্রেম করবো ওকে?কথা হলো তোর মোবাইল কোথায়?’
রৌদ্র আদ্রিতার দিকে এগিয়ে এলো।আদ্রিতার মাথায় সজোরে একটা চাটি দিয়ে বললো,
‘ আমি ঘুমাবো। ফুট এখান থেকে।তুই এই সময়ে আমার কাছে মোবাইল খুঁজতে এসেছিস?’
‘ দে না ভাইয়া।’
‘ দিবো না।’
‘ তাহলে আমিও যাবো না।তোকে ঘুমোতেও দিবো না।’
রৌদ্র বিরক্ত হলো।আদ্রিতার জেদ সম্পর্কে সে জানে।বলেছে মানে বলেছে।হয়তো সারারাত এখানেই বসে থাকবে।রৌদ্র হাত বাড়িয়ে বালিশের কাছ থেকে মোবাইলটা নিলো।আদ্রিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘ এবার যাবি।নইলে লাথি মেরে বের করবো।’
আদ্রিতা উঠে দাঁড়ালো।এক পা এগোবে ভেবে আবারো খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে পড়লো। মোবাইলটা রৌদ্রের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘ লক খুলে দে।’
রৌদ্র এক টানে মোবাইলটা নিয়ে লক খুললো।তারপর আবারো আদ্রিতার হাতে ধরিয়ে দিলো।
‘ এবার অন্তত যা।’
আদ্রিতা গেলো না।মোবাইলে ডায়াল লিস্টে কিছু একটা দেখে নিয়ে মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে মারলো।বিরবির করে বলে উঠলো,
‘ না এইমাত্র তো কারো সাথে কথা বলিস নি।’
তারপর ঘরের আনাচে কানাচে কিছু খুঁজতে ব্যস্ত হলো।কিন্তু কিছু ফেলো না।তার আশায় যেন এক বালতি নয় সহস্র বালতি জল ঢেলে দিলো কেউ।মুখ চোখ কুচকে নিয়ে বলে উঠলো,
‘ কার সাথে কথা বলছিলি?কল করে ডিলিট করে দিয়েছিস?ম্যাজিসিয়ান সে?আমি শুনেছি তুই বললি সে মানুষ নাকি ম্যাজিসিয়ান।তোর উপর ম্যাজিক করে দিয়েছে ভাইয়া?’
রৌদ্র হাসলো।এতোক্ষনে আদ্রিতার তল্লাশি চালানোর কারণটা বুঝতে পারলো।টেবিলে থাকা গ্লাসটার পানিটা শেষ করে বললো,
‘ তুই দরজায় দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনিস?’
‘ মোটেই না।আমি তো জল খেতে যাচ্ছিলাম। মাঝখানে তোর কথা শুনলাম আর তোর রুমে লাইট ও জ্বলছে তাই ঢুকলাম। এনিওয়ে কে সে ভাইয়া?’
‘ আছে কেউ।’
‘ আমাকে তো বলতেই পারিস।দুইটা বোনের একটা মাত্র ছোট বোন।’
‘ তো?’
‘ বল না।’
রৌদ্র বললো না।হাসলো।আদ্রিতার কান্ডকারখানায় তার প্রচুর হাসি পাচ্ছে।আসলেই কল্পনার সেই রমণী তাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছে।তার জন্যই এখন বোন তার মাথা খাবে।কে জানে বিষয়টা কী থেকে কী নিয়ে যায়।রৌদ্রের হাসি মুখটা দেখে আদ্রিতা মুখ কালো করলো।তারপর কী বুঝেই হেসে উঠলো।উৎফুল্ল মুখে বলে উঠলো,
‘ ভাইয়া!হসপিটালে যে মেয়েটা।ঐ যে পরশুদিন তোর শরীরে জল ঢেলে দিলো?আম্মুকে বলেছি তার বিষয়ে।আম্মু তার রূপের প্রশংসা শুনে রাজি হয়ে গিয়েছে।’
‘ রাজি হয়ে গিয়েছে মানে?’
‘ মানে তোর তো তাকে পছন্দ হয়েছে।আম্মুরও পছন্দ হয়েছে।আমার তো হয়েছেই।বাকিদের ও হয়ে যাবে।আম্মু বলেছে পরের বার দেখা হলে যাতে নাম্বার, ঠিকানা নিয়ে নি।শত হোক তার ছেলে একটা মেয়েকে পছন্দ করলো বলে কথা।আমি হোস্টেলে থাকি।আম্মুর কী বাসায় একা থাকতে ভালো লাগে বল?তুই ও তো চাকরি পেয়েছিস এক বছর।সে হিসেবে তোকে বিয়ে করানোই যায়।’
রৌদ্র চোখ বড় বড় করে তাকালো।আদ্রিতা এভাবে তার মাকে সব বলবে স্বপ্নেও ভাবে নি সে।তার মাও এসব বলবে তা কল্পনাও করতে পারে নি।চাকরি পাওয়ার ছয়মাসের সময় একবার বিয়ের কথা বলেছিলো তার মনে আছে।কিন্তু সে না করে দিয়েছিলো।এখন আবার আদ্রিতা তার নাম দিয়ে এমন একটা বিচ্ছিরি কাহিনি আম্মুকে শোনাবে ভাবেই নি সে।চাকরি পেয়েছে এক বছর।এতো তাড়াতাড়ি আবার বিয়ে করে নাকি?
ভার্সিটির গেট থেকে কিছুটা দূরেই আছে দু দুইটি চায়ের টং।চায়ের দোকানের সামনেই বিছানো আছে লম্বাটে কয়েকটা টুল।যেগুলোতে কেউ বসে সিগেরেটে ফুঁকছে তো কেউ চা পান করছে।কেউ বা পান চিবোচ্ছে আর লাল রংয়ের থুতু দিয়ে ভরিয়ে ফেলছে কালো জমিনের রাস্তার কিছুটা অংশ।দুপুরের তরতাজা তেজস্বী রোদে শরীর জ্বলছে।ঘামে চুপসে যাচ্ছে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।গাড়ির যান্ত্রিক আওয়াজে মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে।রিয়াদ কিছুটা সময় চয়ের দোকানের টুলে বসে বিরক্ত হলো।আজ তাদের দুপুর দুটোই ক্লাস শেষ হওয়ার কথা। প্রেয়সীর সাথে দেখা করতে গিয়ে আর ক্লাস করা হয়ে উঠে নি রিয়াদের আজকের জন্য।দুপুর দুটোয় খেয়ে এসে যে দোকানের সামনে বসেছে এখনো তার কোন বন্ধুকে গেট দিয়ে বের হতে দেখলো না।সে কী ক্লাসের শিডিউল ভুলে বসেছে?না তার স্পষ্ট মনে আছে দুপুর একটায় আবিদ স্যারের ক্লাসটা করে দুটোয় শেষ হওয়ার কথা।রিয়াদ উঠে দাঁড়ালো।এতোক্ষন যাবৎ ফুঁকতে থাকা সিগারেটটা নিচে ফেলে দিয়ে জুতো দিয়ে পিষে নিলো।মোবাইলটা পকেট থেকে বের করতে নেবে এমন সময় অয়ন্তী, প্রিয়া, জেনী, মেহুকে বেরিয়ে আসতে দেখে কপাল কুচকালো।বাম হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলো।বরাবর দুইটা বিশ মিনিট।ক্লাসরুম থেকে গেট পর্যন্ত আসতে এদের এতোক্ষন লাগছে?আর বিনয় আর অভ্রই বা কোথায়?ওরা ও কী মেয়েদের মতো টিপির টিপির পায়ে হাঁটছে নাকি?রিয়াদ বুঝলো না।তবে সরু চোখে পেছনে তাকাতেই কিছুটা দূরে ব্যাগ কাঁধে এগিয়ে আসতে দেখলো অভ্রকে আর বিনয়কে।রিয়াদ কপালের ঘামটা মুঁছে নিয়ে এগিয়ে গেলো।সামনাসামনি যেতেই প্রিয়া বিগলিত হেসে বলে উঠলো,
‘ কি রে রিয়াদ কুত্তা!গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা হলো?সারাক্ষণ সবাই হৈ হৈ করে বলে বেড়াস আমি বয়ফ্রেন্ডের সাথে চিপকে থাকি।তোর বেলায়?’
রিয়াদ প্রিয়ার কথায় এক গাল হাসলো।পেছন ফিরে জোরে বলে উঠলো,
‘ অভ্র, বিনয়!কিরে পিঁপড়ার মতো হাঁটছিস কেন?পায়ের গতি বাড়া।তোরা হলি গিয়ে পুরুষ মানুষ।’
অভ্র আর বিনয় হাসলো।দ্রুত পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলো।রিয়াদ তাদের হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়াকে খোচা দিয়ে বললো,
‘ আমি কিন্তু তোর মতো পাঁচ ছয়টারে নিয়ে চিন্তা করি না।একজনকে ভালোবেসেছি একজনকেই ভালোবাসবো।’
প্রিয়া পেছন ফিরে তাকালো।রিয়াদের কথার ঝাঁঝালো উত্তর দিয়ে বসলো,
‘ দেখি তো।ভার্সিটির জুনিয়র মেয়েদের দিকে কেমনে অগণিত ক্রাশ খাস।চোখে পড়ে আমার।’
রিয়াদ হু হা করে হেসে উঠলো।কপালের চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে বলে উঠলো,
‘ ক্রাশ ইজ ক্রাশ।ক্রাশ ইজ নট দশ বারোটা প্রেম!ওকে মিস প্রিয়া? ‘
প্রিয়া ভেংচি কাঁটলো। রিয়াদের সাথে কথা না বলে চুপচাপ হাঁটতে লাগলো।সবাই সমান গতিতে পা এগোচ্ছে।ভার্সিটির কিছুটা দূরে একটা পার্ক আছে।গন্তব্য সেখানেই।প্রায়সয় ক্লাস না থাকলে বা ছুটি থাকলে সেখানে আড্ডা বসে তাদের।আজও ব্যাতিক্রম হলো না।পার্কের এক কোণায় বড় গাছটার ছায়ায় বসে পড়লো সাত জন।মাথার উপর গাছের ডালপালা সুনিপুনভাবে সেঁজে আছে।প্রতিটি ডালে রয়েছে সবুজ পাতার বহর।ঝা ঝা রোদে এদিকটায় গাছের ছায়ায় শীতলই অনুভব হচ্ছে।সবুজ ঘাসে পা পেতে বসে পড়ে নিঃশ্বাস নিতেও যেন অদ্ভুত এক শান্তি।এদিকটায় শুনশান নিরবতা।তেমন কোলহল নেই।গাড়িঘোড়ার আওয়াজ ও খুব ক্ষীণ শোনায় এই জায়গাটা থেকে।আড্ডা দেওয়ার জন্য এই জায়গার থেকে দ্বিতীয় কোন সুন্দর জায়গা আছে কিনা জানা নেই তাদের।অয়ন্তী কাশি দিয়ে ব্যাগের থেকে জলের বোতলটা বের করলো।দু ঢোক পানি গিলে শান্তি চাহনিতে তাকালো।কিছু বলার আগেই রিয়াদ তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
‘ কিরে বইন!তোর অবস্থা তো সুবিধার না।সেদিন কী থেকে কী হইলো।বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসলাম। তারপর থেকে তো পাত্তাই নাই। তলে তলে কী চলে আমাদেরও বল?’
বিনয় হেসে বললো,
‘ নির্ঘাত অন্তির বিয়ে ঠিক করে ফেলছে।আরেহ ঔদিন যে বাসায় গেলাম।আন্টি তো বললো ভালো পাত্র পেলেই ডিরেক্ট শ্বশুরবাড়ি।বিয়ে করলে ননদ দেখি করিস বইন।আমাদের কথা মাথায় রাখিস।’
অয়ন্তী আর অপেক্ষা করলো না।দু কিল বসিয়ে দিলো বিনয়ের পিঠে। বিনয় কিছুটা সরে বসতেই দাঁত মুখ কুচকে বললো অয়ন্তী,
‘ তোর মাথা হাদারাম!’
অভ্র দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
‘ তুই যদি এমন উধাও হয়ে যাস তো আমরা হাদারাম না হয়ে আর কী করি বল?’
অয়ন্তী সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকালো।সরু চোখে অভ্রের দিকে কিছুটা সময় তাকালো।তারপর উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।সন্দেহী গলায় বললো,
‘ এই?এটা তুই?নিজেরে হাদারাম দাবি করলি?’
‘ দাবি করিনি।তোর দৃষ্টিভঙ্গিতে হাদারাম।এটাই বুঝালাম।’
‘ বাহ!অভ্র, রিয়াদ, বিনয় অবশেষে তোরা সকলে হাদারাম।’
এমন কতশত কথায় জমে উঠলো তাদের আড্ডাটা।প্রকৃতির ঠান্ডা পরিবেশে নিরবতাকে ঠেলে দিয়ে পরিবেশটাকে করে তুললো জমজমাট। ফুরফুরে বাতাসটা বন্ধুত্বের মুগ্ধতায় ক্ষণে ক্ষণে ভরে উঠলো।অদূরে কিছু বাচ্চার খেলার আওয়াজ ভেসে আসলো।কিন্তু সেই আওয়াজও তাদের বন্ধুত্বের আড্ডার থেকে বেশি না।আড্ডা জমতে জমতে তাদের কারোরই খাবার কথা মনে পড়লো না।ক্ষিদের জ্বালাও পেটে চিনচিন করলো না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁইছুঁই।তখনো আড্ডায় ব্যস্ত তারা।রিয়াদ সবুজ ঘাসে মাথার নিচে হাত দিয়ে শুঁয়ে আছে।বিনয় কৃষ্ণকালো গায়ের রং কে ভিজিয়ে নিয়েছে বোতলের পানি দিয়ে। মুখটা রুমাল দিয়ে মুঁছে নিয়ে চশমাটা এঁটে নিলো চোখে।অভ্রও গাছে হেলান দিয়ে এক পা উঁচিয়ে রেখে গল্পে মত্ত।রিয়াদ কী বুঝেই হুট করে উঠে বসলো।মেহুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
‘ তোকে যেটা বলেছি এনেছিস?এই দুইদিন ভার্সিটি না আসাতে তো নিতেও পারিনি।’
মেহু বুঝতে পারলো।দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে বের করলো লাল রাঙ্গা একটা কাগজ।রিয়াদ মৃদু হাসলো।তারপর বললো,
‘ অভ্রকে দিয়ে দে।’
মেহু অবাক হলো।অভ্র কী জানতো চিঠিটা লেখার ভার মেহুর উপর পড়েছে?মেহুকেই তার রিয়ার জন্য চিঠি লিখতে হয়েছে কাঁপা হাতে।কান্না জমিয়ে মুখ চেপে।অভ্র জানতো?মেহু ভ্রু জোড়া কুচকে চিঠিটা এগিয়ে দিলো অভ্রের দিকে।অভ্র হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে ভ্রু জোড়া কুচকে তাকালো।তারপর কী বুঝেই বললো,
‘ তুমি লিখেছো?’
মেহু শুকনো ঢোক গিললো।রিয়াদের দিকে তাকালো।কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না।কিছুটা সময় নিশ্চুপ থাকতেই অভ্র আবারো শক্ত দৃড় কন্ঠে বললো,
‘ তুমিই তো লিখেছো।রাইট?’
মেহু ভীতু চাহনিতে তাকালো।ঠোঁটজোড়া চেপে রেখে জোরে নিঃশ্বাস নিলো।আশ্চর্য!সে কী ভয় পাচ্ছে?ভয় পাওয়ার মতো কোন কাজ কী সে করেছে নাকি?না করে নি তো।রিয়াদ বলেছিলো তাই লিখেছে।এটুকুই তো।মেহু আবারো জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো।মৃদু কন্ঠে সাহস নিয়ে বললো,
‘ হ্যাঁ।পড়ে দেখ তো ভালো হয়েছে কিনা?আমি মেয়ে।তাই ছেলেদের অনুভূতি তো আর আমার জানার কথা না।কী লিখেছি কে জানে।’
অভ্রের চোয়াল এবার শক্ত হয়ে এলো।চিঠিটা প্রথমে দেখেই বুঝে নিয়েছিলো এটা মেহুর লেখা।আত্নসম্মান বোধের কারণে সে কখনোই মেহুর থেকে কোন নোটস সংগ্রহ করে নি ঠিক তবে লাইব্রেরিতে একসাথে সাতজন মিলে পড়ার সময়টায় সে প্রায়সয় মেহুর লেখা দেখেছে।রিয়াদ বিনয় যখন নোটস কালেক্ট করে তখনও সে মেহুর হাতের লেখা দেখেছে তাই তার আন্দাজ সঠিকই হলো।অভ্রের উজ্জ্বল ফর্সা মুখটা তীক্ষ্ণ চাহনির তেজে ভরে উঠলো।রাগে চোয়াল শক্ত হলো।হাতের মুঠোও শক্ত হয়ে এলো।রিয়াদের দিকে রাগ নিয়ে তাকাতেই রিয়াদ অসহায় দৃষ্টিতে বলে উঠলো,
‘ আবে শালা!এমনে তাকাস কেন?’
অভ্রের শক্ত জবাব,
‘ আমি তোকেই লিখতে বলেছিলাম।আর তুই না লিখে অন্যকাউকে লিখতে দিয়ে দিলি।তোরে তো আসলেই ইচ্ছে করতেছে..’
‘ প্রেম করবি তুই আর চিঠি লিখবো আমি!ওয়াও!আমি চেষ্টা করেছি পারি নাই।নিজের প্রেমিকা হলে বোধ হয় পারতাম কিন্তু তোর প্রেমিকার জন্য কোন অনুভূতিই আসে নাই।তো কী করতাম? কোনকালে নিজের প্রেমিকার জন্যই চিঠি লিখলাম না
।তাও তো মেহুকে দিয়ে ব্যবস্থা করে দিলাম।’
অভ্র এবার হাসলো।সাথে সাথে হেসে উঠলো সবাই মেহু ব্যাতীত।অভ্র হাসিটা থামিয়ে নিয়ে মেহুর দিকে তাকালো।কী বুঝেই হুট করে বলে বসলো,
‘ থেংক ইউ মেহু।’
অভ্রের শীতল কন্ঠে ধন্যবাদ শব্দটা সে ইতোপূর্বে কখনো শুনে নি।আজই প্রথম।অভ্র তাকে এতোটা বিনয়ী ভাবে ধন্যবাদ বললো?কেন?অভ্র কী পাল্টে যাচ্ছে?চিঠি দেওয়ার পরও বুকের ভেতর কেমন তীব্র যন্ত্রনা কাজ করছিলো।প্রিয়জনের প্রিয়তমার জন্য চিঠি বলে কথা।অভ্রের ধন্যবাদ শব্দটা যন্ত্রনাটা দ্বিগুণ করে দিলো।ভেতরটা হু হু করে উঠলো।ইচ্ছে করলো কান্না করুক।কিন্তু চাইলে কী কান্না করা যায়।হ্যাঁ যায়।কিন্তু ঐ যে নিয়ম।সকলের সামনে যে সে কাঁদতে পারবে না।কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
‘বন্ধুত্বে থেংকিউর কী আছে অভ্র?আজ আমি আসি রে ক্ষিধে পেয়েছে। ক্যান্টিনেও যাওয়া হয় নি আজ।সকালে কিছু না খেয়েই চলে এসেছিলাম।’
মেহুর কথায় সবাই ওর দিকে ফিরে চাইলো।মেহুর মুখ শুকনো দেখাচ্ছে।চোখ মুখ কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।শ্যামলা মুখের চাহনিটা আরো ক্লান্তিকর লাগছে।কপালে ঘাম।অথচ এখানে তেমন গরম নেই।গাছের নিচে অল্প বাতাসেই খুবই শীতল হয়েছে পরিবেশ।এমন পরিবেশে তো ঘামানোর কোন কথা নেই।তবে?অয়ন্তী বলে বসলো,
‘ তুই ঠিক আছিস?’
‘ হ্যাঁ রে।ঠিকই আছি।আজ আসি তবে?’
মেহুর কথার পাল্টা উত্তরেই জেনী বললো,
‘ আমি কিন্তু কালকের টিকিট কেঁটে নিয়েছি।সন্ধ্যা ছয়টায় শাড়ি পরে চলে আসবি।এখনই বলে রাখলাম।কাল ভার্সিটিতে যাচ্ছি না।ফোনে তো বলবোই।আর একদিন হোস্টেল থেকে রাতে বেরুলে কিছু হবে না।হোস্টেলে ঢুকতে না দিলে দরকার হলে আমাদের বাসায় থেকে যাবি সেদিন।সমস্যা নাই।আসবি কিন্তু।নাহলে আমি রাগ করবো।’
মেহু মৃদু হাসলো।তারপর অন্যদিকে ফিরেই ধীর পায়ে হাঁটা ধরলো।এই পৃথিবীতে সে বড্ড একা।কষ্টগুলো ভাগ করার মতো কেউ নেই।শক্ত করে হাত ধরার মতো কেউ নেই।নিজের ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে কাউকে জড়িয়ে ধরে নেওয়ার মতো কেউ নেই।সে একা এবং একা।তার ভেতরের মেহুটা বড্ড একা।বাইরের মেহু কী সুন্দর মুখে হাসি ফুটিয়ে সবার সাথে তাল মেলাচ্ছে অথচ ভেতরের মেহু?
#চলবে….
(( নিরব-আদ্রিতাকে নিয়ে লিখতে পারছি না।কাহিনী অনুয়ায়ী লিখতে হচ্ছে তাই চাইলে সবাইকে পর্বগুলোতে রাখতে পারছি না।গল্পটায় প্রেমকাহিনীর পাশাপাশি ভাই -বোন, বন্ধুদের সম্পর্কটাও ততোটা মূল্যবান।কেমন হয়েছে জানাবেন।))
হ্যাপি রিডিং…