অনুভূতি_জুড়ে_তুমি পর্ব_১০+১১

অনুভূতি_জুড়ে_তুমি
পর্ব_১০+১১
লেখনীতে: স্পর্ষীয়া ভূমি( ভূমি)

১০.

রাস্তার পাশে একটা ডাস্টবিনে কয়েকটা কাক নিজেদের আড্ডায় মেতেছে।মাঝেমাঝেই ডাস্টিবেনের ময়লাগুলো নিজেদের লম্বা ঠোঁটজোড়া দিয়ে নড়েচড়ে দিচ্ছে। কাকেদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা চলছে।ডাস্টবিনের ময়লাগুলো থেকে খাবার কুড়োচ্ছে তারা।একজনের খাবার অন্য জন কেড়ে নেওয়ার কিঞ্চিৎ প্রতিযোগিতা চলছে তাদের মাঝে।ক্ষণে ক্ষণেই নিজেদের কর্কশ কন্ঠে মানুষের কানে পৌঁছে দিচ্ছে ” কা কা” শব্দ।ডাস্টবিনের নোংরা দরজা বরাবর দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটা ছেলে।পরনে নোংরা ছেঁড়া জামা। চুলগুলো ময়লায় বিশ্রী দেখাচ্ছে।তবে চেহারাটা ময়লা হলেও মায়াবী।গোল গোল চোখজোড়ার দৃষ্টি গভীর মনোযোগে ডাস্টবিনের ময়লায় নিক্ষেপ করেছে।হাতে ছোট একটা লাঠি।লাঠিটা দিয়ে ময়লাগুলো নাড়িয়ে মাঝে মাঝেই কিছু সংগ্রহ করছে।কাঁধে ঝুলে থাকা বড় প্লাস্টিকের ব্যাগটায় প্লাস্টিকের বোতল সহ আরো অন্যান্য উপাদান ভরতে ব্যস্ত সে।পায়ে জুতো নেই।দুপুরের খা খা রোদে রাস্তার কালো অমসৃন জমিন উত্তপ্ত হয়ে আছে।কালো জমিনের উত্তাপে ছেলেটার পা কী পুড়ে যাচ্ছে না?সহ্য করছে কীভাবে?বয়সই আর কত হব? সাত কী আট বছর!অথচ এই বয়সে আদ্রিতা তার মা বাবার আদুরি ছিলো।ভাইয়া আর বড় আপু কতোই আদর করতো।অথচ রাস্তার ঐ ছেলেটি?সেও শিশু।শুধু ভাগ্য আলাদা।সৃষ্টিকর্তা হয়তো এভাবেই সকলের ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন।আদ্রিতা ছোট ছোট চোখে ছেলেটার দিকে আবারো তাকালো।ছেলেটি প্লাস্টিকের ব্যাগটা ঝুতসই করে মজবুত করে ধরে উল্টোদিকে এগিয়ে যাচ্ছে।হোস্টেলের রুমের ভেতর আদ্রিতার গরমে যায় যায় অবস্থা?তবে ঐ ছোট্ট ছেলেটির কী অবস্থা এ উত্তপ্ত রোদের তেজে।আদ্রিতা ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্যটা মুহুর্তেই মন খারাপ করে দিলো তার।হুট করেই ইচ্ছে করলো ছেলেটিকে গিয়ে আদর করতে কিন্তু ছেলেটি তখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে রাস্তার এলেমেলো মোড়ে। জানালাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিয়ে ভেজা চুলে মোচড়ানো টোয়ালে টা খুলে নিলো।তারপর চুলগুলো ছাড়িয়ে বেলকনির দিকে পা বাড়ালো।বেলকনির লোহার গ্রিলে দুপাশ থেকে বাঁধা হয়েছে কয়েকটা প্লাস্টিকের দড়ি।সেই দড়ির একটাতে টোয়ালেটা মেলে দিয়ে টিশার্ট ঠিক করে গ্রিল আকড়ে দাঁড়ালো।রুমের থেকেও এখানে রোদ বেশি পরছে।রুমের ভেতর থেকে মোবাইলের শব্দের কম্পাঙ্কটা কানে পৌঁছুতেই দ্রুত দৌড়ে রুমে গেলো।মোবাইলটা তুলে নিতেই জ্বলজ্বল করলো দুটো শব্দ।” মাই লাভ”।আদ্রিতার মুখে এসে জড়ো হলো একরাশ বিরক্তি।কালকে রাতে নামটা ডিলিট করতেই ভুলে নিয়েছে সে।মোবাইলটা জোড়ালো হাতে বিছানার একপাশে ছুড়ে মারলো।আবারো কল এলো।আদ্রিতা রিসিভ করলো না।
রৌদ্রের দেওয়া মোবাইলটা নিয়ে কানে ইয়ার ফোন গুঁজে গান শুনতে ব্যস্ত হলো।কিন্তু গান শোনাটা বেশিক্ষনের জন্য টিকলো না।কিছুটা সময় যেতেই ভিড়িয়ে দেওয়া দরজা ঠেলে হোস্টেলের দাড়োয়ান এসে দাঁড়ালো।আদ্রিতা কানে ইয়ারফোন থাকায় প্রথমে বুঝে উঠতে না পারলে ও পরে বুঝতে পারলো।তৎক্ষনাৎ সটান উঠে দাঁড়ালো।মোবাইল আর ইয়ার ফোন রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে বিনয়ী গলায় বললো,

‘ কিছু বলবেন চাচা?’

দাড়োয়ান সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকালো।যে তাকানোর অর্থ আদ্রিতাকে তার পছন্দ হচ্ছে না।আদ্রিতা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই সে গমগমে কন্ঠে বললো,

‘ জি আপা।আমনের লগে একজন দেহা করতো আইছে।’

আদ্রিতা ভ্রু জোড়া কুচকে তাকাতেই লোকটি সরে গেলো।পেছনে লম্বাচওড়া একটা মানুষকে দেখা গেলো।মুখে মাস্ক আর চোখে সানগ্লাস।ঠিক সেদিনের মতো।যেদিন তার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো সেদিনকার লোকটির বেশভূষাও এমন ছিলো। ভুল না করলে লম্বাচওড়াও এমনটাই হবে।চুলগুলোও তেমন।আদ্রিতা সরু চোখে তাকিয়ে দাড়োয়ানের বিরক্তির কারণটা ধরে ফেললো।হোস্টেলে একটা মেয়ে অন্য জায়গা থেকে এসে এখানে থাকছে। নিশ্চয় এই শহরে তেমন পরিচিত রিলেটিভস নেই তাই।কিন্তু বারবার এভাবে একটা যুবতী মেয়ের সাথে ছেলেপুলে দেখা করার বিষয়টা কেমন যেন দেখায়। বিশেষ করে মানুষটা যদি নিম্নবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত হয়।আর গুরুজনদের চোখে তো এটা নীতিমতো অপরাধ।আদ্রিতা আরো দু পা এগিয়ে চোখজোড়ার পাপড়িগুলো মেলে ধরে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আপনি?আপনি সেদিনের গাড়িটার.. ”

আদ্রিতার কথাটার মাঝপথে থামিয়ে দিলো লোকটি।সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ডুকিয়ে বললো,

‘ আপনার মোবাইলটা কোথায়?’

‘ কেন?আমার মোবাইল দিয়ে কী করবেন?’

‘ আমি আপনাকে অনেকবার কল করেছি।ফোন তুললেন না তাই জিজ্ঞেস করছি।মোবাইলটা কী মাটির নিচে ফুঁতে রেখেছেন?’

আদ্রিতার চোখজোড়া মুহুর্তেই বড়বড় হয়ে গেলো।সামনের লোকটি যে নিরব তা বুঝতে এক সেকেন্ডও দেরি হলো না।গোলগোল চোখজোড়া লোকটার মাস্ক পরিহিত মুখের দিকে মিনিট দুই তাকিয়েই ঘুরিয়ে নিলো। সোজা পায়ে রুমের ভোতরে ডুকে যেতেই নিরব ও ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো।বিছানায় ছুড়ে রাখা দু দুটো মোবাইলের দিকে তাকিয়ে মাস্ক খুললো।চোখের সানগ্লাসটা খুলে নিয়ে আদ্রিতার দিকে মনভরে চাইলো।লাল রংয়ের একটা টিশার্ট আর কালো রংয়ের প্লাজু।গলায় হালকা পাতলা একটা ওড়না জড়ানো। ভেজা চুলগুলো থেকে টপটপ করে পানি গুলো ফ্লোরের সাদা জমিনে গোল গোল হয়ে পড়ছে।আদ্রিতার টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়েই আদ্রিতার একটা খাতা নিয়ে হাওয়া করতে লাগলো।আদ্রিতা বিরক্তিতেই রি রি করে চোখজোড়া নিক্ষেপ করলো নিরবের দিকে।গায়ের রং ধবধবে সাদা।পরনে কালো রংয়ের শার্ট।হাতা গুলো গুটানো।বুকের কাছে দুটো বোতাম খোলা।চেয়ারের কাঠে ফর্সা হাতটা খব স্বযত্নে তুলে রেখেছে।কপালে কিছু চুল বেশ সুন্দর ভাবে সেঁজে আছে।আদ্রিতা নিরবের রূপে সে ক্লাস টেন থেকেই মুগ্ধ। কিন্তু সে মুগ্ধতা এই মুহুর্তেই তার বিরক্তিকে হার মানাতে পারলো না।বিরক্তিতে কপালের চামড়ায় দুই ভাজ ফুটিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

‘ কী হচ্ছে কী মিঃ নিরব চৌধুরী?আমি আপনার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছি?কি হলো বলুন?তাও এভাবে পিছু নিয়েছেন কেন?আমার হোস্টেলের ঠিকানা কোথায় থেকে পেলেন?’

নিরব কিছু বললো না।কেবল হাসলো।যে হাসি দেখে আদ্রিতা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।আবারো জোরালো গলায় বলে উঠলো,

‘ একদিন আপনার লোক তো একদিন আপনি। মানুষজন আমায় কী ভাবছে?এভাবে অপরিচিতরা হুটহাট হোস্টেলে এসে আমার সাথে দেখা করতে চাইলে তো হোস্টেলেই থাকা হবে না আমার।তাছাড়া কোন ভাবে আপনার মুখ দেখলে? কী হবে ভেবেছেন?আপনি সেলিব্রিটি আমি সাধারণ।সো পিছু ছাড়েন।সেলিব্রেটিদের এটুকু খবরও কোনদিক থেকে কোনদিকে যায় বলা যায় না।আমি সেলিব্রিটির সাথে জড়িয়ে সমালোচনার স্বীকার হতে চাই না।’

নিরব এবার আরো জোরে হেসে উঠলো।তারপর ঘড়ির দিকে তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে সময় দেখলো।আদ্রিতার ছেড়ে দেওয়া ভেজা চুল গুলোতে একনজর তাকিয়ে কঠিন কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ বাহ!ভিতু মেয়ের মুখে বুলি ফুটেছে দেখছি।এনিওয়ে আমি তোমাকে দশমিনিট সময় দিচ্ছি। তৈরি হয়ে নাও।তোমাকে বের হতে হচ্ছে আমার সাথে এই মুহুর্তে।’

আদ্রিতা রুদ্ধ কন্ঠে বললো,

‘ হুয়াই? আমি কেন বের হবো আপনার সাথে?’

‘ আমি বলছি তাই।’

আদ্রিতা বিছানায় বসে পড়লো।শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ আপনি যেতে পারেন।আমি কোথাও যাচ্ছি না।’

‘ বললাম না দশ মিনিট।আমি বের হচ্ছি।ঠিক দশ মিনিট পর রুমে ডুকে যদি তোমায় এই অবস্থায় দেখি তো এই অবস্থাতেই সবার সামনে দিয়ে কোলে তুলে গাড়িতে উঠিয়ে দিবো।সেটা নিশ্চয় ভালো হবে?’

আদ্রিতা চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলো নিরবের দিকে।এই লোক তার পেছনে এভাবে পড়ে আছে কেন বুঝে উঠছে না সে।তাকে কী জনসম্মুখে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে নিরব?ভয়ে শুকনো ডোক গিললো।কিন্তু সবার সামনে কোলে তুলে নিয়ে যাওয়াটা তো আরো বেশি ভয়ানক হবে।সে কী করবে তবে?আদ্রিতার ভয়ার্ত মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে মৃদু হাসলো নিরব।মাস্কটা মুখে লাগিয়ে চোখে আগের মতো সানগ্লাসটা বসিয়ে দিয়ে গুঁটি গুঁটি পায়ে বের হয়ে গেলো।আদ্রিতা নিরব যেতেই কোনরকম একটা সালোয়ার কামিজ হাতরে নিয়ে তৈরি হলো।

হাসপাতাল এমন একটা শব্দ যে শব্দ সাধারণ মানুষের জন্য কখনো দুঃখের বার্তা তো কখনো সুখের বার্তা নিয়ে আসে।কখনো বা পৃথিবীতে কারো আগমণের সাক্ষী হয় কখনো কারো বিদায় নেওয়ার সাক্ষী হয়। কখনো কারো প্রিয় মানুষগুলোর দুঃখের। প্রিয় মানুষের মৃত্যুতে, কষ্টে হাজার হাজার দীর্ঘশ্বাস জমা হয় হসপিটালের দেওয়াল গুলোর ইটের টুকরো গুলোতে।কখনো বা কারো নোনতা পানির আহাজারির আওয়াজে।ভারী অদ্ভুত এই ” হাসপাতাল ” শব্দটা।আজ সেই হাসপাতালের লম্বাটে বারান্দায় চিন্তার চাপ মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেহু।পরনে ধূসর রংয়ের ঢিলেঢালা সুতি সালোয়ার কামিজ।ওড়নাটা গলায় জড়ানো।ঘামে ভিজে আছে পরনের কামিজটা।বেনুনি করা চুলগুলো হালকা এলেমেলো।শ্যামলা মুখটা আরো কালো রংয়ের গভীরতায় ফুটে উঠেছে।চিন্তিত চেহারায় পাশে থাকা দরজার দিকে উঁকি দিয়েই মাকে বাবার কেবিনের পাশে বসে থাকতে দেখে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো।কপালের ঘামটা মুঁছে নিয়ে চুলগুলোকে কানের কাছে গুঁজে দিলো।পরনের জামাটা কাল থেকে পাল্টানো হয় নি।হসপিটাল থেকে যাওয়ার সুযোগই হয়ে উঠে নি।রাতে মাকে মাসির বাসায় পাঠিয়ে সেই হসপিটালে থেকেছে।সকালে ও বাবার ঔষধগুলো কিনে আর সুযোগ হয়ে উঠে নি যাওয়ার।এখন দুপুর তিনটে।মা ঘন্টাখানেক আগেই এসেছে।মায়ের সাথে আরেক ধপা কথা বলে সে মাসির বাসায় গিয়ে শাওয়ার নিয়ে তৈরি হয়ে আবার আসবে।বাবার একাউন্ট থেকে প্রায় সব টাকায় তোলা শেষ।এই অবস্থায় বাবাকে চাকরি করতে দেওয়াটাও ঠিক না।তার ওপর হোস্টেলের খরচ।সংসারের খরচ।মেহুকে খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরি পেতে হবে।যে করেই হোক।মেহুর গভীর চিন্তার মাঝেই মোবাইলটা বেঁজে উঠলো পুরো দমে।মেহু দ্রুত কলটা রিসিভ করে কানে নিলো। ওপাশ থেকে ছোট ভাই বলে উঠলো,

‘ দিদি তুই আসছিস না কেন?মা তো গিয়েছে অনেক্ষন হলো।’

‘আসছি রিদু, তুই খেয়েছিস?’

‘ হ্যাঁ, খেয়েছি।’

‘ ওহ।মাসি তোর পাশে?মানে তুই তো মাসির নাম্বার থেকে কল করলি।’

‘ হ্যাঁ।আছে।’

‘ ওহ, আচ্ছা।রাখছি।’

মেহু মোবাইলটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে দরজা ঠেলে মায়ের দিকে এগুলো।বেডে শান্ত ভাবে ঘুমোচ্ছে তার বাবা।মায়ের চিন্তিত মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে ঠোঁট চেপে থমকানো কন্ঠে বললো,

‘ মা, আমি আসছি তবে?তুমি ঘন্টা দুই থাকো।আমি চলে আসবো।দরকার হলে আমাকে কল করো ওকে?আর হ্যাঁ বাবার কোন কিছুর প্রয়োজন হলে নার্সদের বলো। ওকে?

তার মা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কিছুটা সময় তাকিয়েই হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো।মেয়ের এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে গোছালো করে দিয়ে বললো,

‘ খাস নিতো দুপুরে।খেয়ে, বিশ্রাম করে আসিস।আমি আছি এখানে।কিছু চিনি না ঠিক তবে মানিয়ে নিবো।চিন্তা করিস না।’

মেহু ঠোঁট চেপে মৃদু হাসলো।উল্টো দিকে হাঁটা ধরলো।মাথায় হাজার চিন্তা।এতো এতো চিন্তায় মাথাটা ঘুলিয়ে উঠছে তার। চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে উঠছে।কাঁদতে ইচ্ছে করছে কাউকে জড়িয়ে। কিন্তু কে আছে তার যে তার দুঃখের সঙ্গী হবে?কেউ নেই। দিনশেষে তার কান্নাগুলো শুধুমাত্র তার হৃদয়ের ভেতরের ভেঙ্গে ঘুড়িয়ে যায়।

হসপিটাল থেকে বেরিয়েই কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে অদূরে রিক্সা গুলোর দিকে তাকিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিলো।মাসির বাসা এখান থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। সে হেঁটে ঠিক চলে যেতে পারবে। গলার কাছে ঘাম ওড়না দিয়ে মুঁছে নিয়ে পা এগুলো।হসপিটালের মোড় ফেরিয়ে সোজাসুজি হাঁটা ধরতেই তার চোখজোড়া চমকপ্রদ কিছু দেখতে পেলো।তবে তার চোখজোড়া আজ ক্লান্ত।অক্লান্ত দৃষ্টিতে চমকপ্রদ বস্তুটির দিকে তাকিয়ে থাকার ইচ্ছে হচ্ছে না তার।ইচ্ছে করছে ঘুমোতে।আজ তিন রাত তার ঘুম হয় নি।তার চোখজোড়া বড্ড ক্লান্ত।মেহু আবারো জোড়ালো দীর্ঘশ্বাস ফেললো।সামনে কিছুটা দূরে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।ডান পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটতেই গাড়িটার দিকে নিজের এগিয়ে যাওয়া বুঝে ধুকফুক করে উঠছে বুক।কাছের মানুষটি তার খুব প্রিয়।প্রিয় মানুষের দুঃখ ভাগ করাটাও অনেক শান্তির।কিন্তু মেহু?মেহুর ক্ষেত্রে এসব মানায় না।মেহু ধুকফুক করা বুক নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যেতেই সেই প্রিয় মানুষটির মুখোমুখি হলো।তার চোখমুখ থমথমে।সে একবারো মেহুর দিকে ফিরে চাইলো না।মোবাইলে ব্যস্ত তার চোখ।মেহু থমকে দাঁড়ালো। গাড়ির ভেতরে তাকাতেই গাড়ির গ্লাসের ভেতর স্পষ্ট দেখা গেলো রিয়াকে।মেহুর গলা শুকিয়ে এলো।গাড়িটা আর মানুষগুলোকে দেখেনি ভেবেই পা বাড়াতেই নিলেই রিয়া গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।মেহুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রাণোজ্জ্বল হাসি হেসে বলে উঠলো,

‘ আরেহ মেহু আপি?কেমন আছো?’

মেহু চমকে তাকালো।শুকনো ঢোক গিলে বললো,

‘ ভালোই।তুমি?’

‘ ভালো।তুমি অভ্রকে দেখো নি?না মানে কথা না বলেই চলে যাচ্ছিলে?’

মেহু চমকিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালো।অভ্রকে দেখে নি হিসেবে ছোট্ট একটা অভিনয় করলো।কারো প্রতি গোপণ ভালোবাসা যে তাকে অভিনয় করার সাহস যুগিয়ে দিবে সে কখনো ভাবে নি।অথচ আজ?কত সহজেই অভিনয় করছে সে।মেহু অভ্রের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,

‘ আসলে টেন্সড ছিলাম তো তাই দেখে নি?তা অভ্র আর তুমি এখানে?’

‘ ঘুরতে এসেছিলাম।তুমি?’

‘ আমি?আ আমার আন্টির বাসা এখানে তাই।’

মেহু চট করেই মিথ্যে বলে বসলো।কেন জানি না সত্যটা তার বলতে ইচ্ছে করলো না।ভেতর থেকে উত্তরটা আসলো না তার।হু হু করে কেঁদে উঠলো ভেতরটা।অভ্রের দিকে এক নজর তাকালো।অভ্র এখনো মোবাইলে ব্যস্ত।মেহু ভিজে ওঠা চোখজোড়া লুকোতে অন্য দিকে ফিরিয়ে নিতেই অভ্র এগিয়ে আসলো।রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘ তুমি নামলে কেন?বাইরে যা রোদ পড়েছে।’

‘ মেহু আপু যে দেখতে পাচ্ছো না।’

মেহুর ভেতরটা আরো নরম হয়ে উঠলো।রিয়ার প্রতি অভ্রের কতোটা যত্ন!অভ্র আর রিয়া সত্যিই সেরা জুটি।মেহু কেন পড়ে আছে অভ্রের পেছনে?সেই এক মুহুর্তের স্মৃতিটা ভুলে গেলেও তো হতো।কেন এতো যত্নে মনে রেখেছে মেহু সেই স্মৃতি?কেন?অভ্রের দিকে একনজর তাকিয়ে মৃদু হেসে সৌজন্যতার খাতিরে বললো,

‘ অভ্র?কেমন আছিস?’

অভ্র কড়া ভাবে বলে উঠলো,

‘ দেখছোই তো ভালো আছি।জিজ্ঞেস করার কী আছে?’

মেহু ঠোঁট চেপে হাসলো।কান্নাটাকে নিজের ভেতরে গুঁটিয়ে নিয়ে বললো,

‘ এমনিই, জিজ্ঞেস করলাম আর কী।’

অভ্র মেহুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।দুদিনে মেহুর চেহারার কী দুর্দশা হয়েছে।শ্যামলা মুখশ্রীতে সে উজ্জ্বলতা নেই।হাজার চিন্তার চাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।চোখজোড়ার নিচে কালো প্রলেপ বসেছে।চেহারা শুকনো লাগছে।ঘামগুলো লেপ্টে আছে মুখে।অভ্র কিছুটা সময় তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো।তাচ্ছিল্য মাখা হাসি দিয়ে বললো,

‘ আমি যেখানেই যাই সেখানেই দেখি তুমি মেহু।’

‘ হয়তো তোদের ড্রিস্টার্ব করছি।স্যরি রে।’

‘ মেহু এসব স্যরি তে তোমার মতো মেয়েরা গলে যেতে পারে।আমি না।সো এসব আমার সামনে না বললেই বেটার।’

মেহু কী বলবে বুঝে উঠলো না।কিছুটা সময় নিশ্চুপ থেকে বলে উঠলো,

‘ আমি আসি।দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

কথাটা বলেই এগিয়ে গেলো মেহু।অভ্র তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো।কামিজটা ঘামে ভিজে আছে।কোমড় বরাবর ঝুলছে কালো চুলের বেনুনিটা।চেহারার কী অদ্ভুত দশা আজ মেহুর?কতো সহজে সব মেনে নিচ্ছে।সামলে নিচ্ছে এই দুর্দশা।অভ্রের সামনে কতোটা শান্ত থাকলো। এতোটা শান্ত থাকা কী উচিত এই অবস্খায়?সত্যিই উচিত?না।মেহুর এখন ভেঙ্গে পড়া উচিত।কান্নায় চোখজোড়া ভাসিয়ে দেওয়া উচিত।কিন্তু মেহু?সে অদ্ভুত! সত্যিই অদ্ভুত।এই অদ্ভুততাই কী মেহুর প্রতি কোন একটা সময় অভ্রকে দুর্বল করে তুলেছিলো?অভ্র জোড়ালো নিঃশ্বাস নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো।

১১.

ড্রয়িং রুমের মাঝ বরাবর রাখা আছে কাঠের অতি সুন্দর সোফা সেট।সেই সোফার এক সিট দখল করে বসে আছে রৌদ্র। হাঁটুতে ল্যাপটপ রেখে চোখজোড়া গুঁজে রেখেছে ল্যাপটপের চতুর্ভুজাকার স্ক্রিণে। তার কিছুটা সামনেই এককোণে ডাইনিং টেবিল।ডেবিলে খাবারের পদ গুলো বেশ ভালো ভাবে সাঁজিয়ে রেখেছেন অামেনা বেগম।ছেলের ভাতের প্লেটের এক কোণে লেবু আর কাচা মরিচটা রেখে হাত সরালেন।কড়াই থেকে চামচটা তরকারির বাটি তে রেখে কড়াইটা নিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।ফিরে এসেও ছেলেকে একই ভাবে দেখে মৃদু হাসলেন।শাড়ির আঁচলটা সামনে নিয়ে সোফায় বসে টিভির রিমোটটা খুঁজতে লাগলেন।তারপর রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠলে,

‘ খেতে যাবি তুই?কাজটা তো পরেও করা যাবে।নাকি?’

রৌদ্র মায়ের কথাতেই মুখ তুলে চাইলো।ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে খাবারের প্লেটে এক নজর তাকিয়ে ল্যাপটপটা রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো।চেয়ার টেনে বসে খাবারে হাত দিতেই আমেনা বেগম মুখে এক রাজ্য খুশির চাপ নিয়ে ফিরে এলেন।রৌদ্র একনজর মায়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো মায়ের হঠাৎ এমন খুশির কারণ কী হতে পারে।কিন্তু কোন উত্তর পাওয়া গেলো না।দু তিন গ্রাস খেতে না খেতেই আমেনা বেগম উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ রোদু ঐ মেয়েটা কী সে?’

রৌদ্র বুঝতে পারলো না।ভ্রু জোড়া পয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে বাঁকিয়ে মায়ের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

‘ কোন মেয়ে আম্মু?’

‘ আরেহ ঐ যে অয়ন্তী আহমেদ?তুই যাকে ভালোবাসিস সেই এই মেয়েটা?’

রৌদ্রের চোখজোড়া বড় বড় হতে দু সেকেন্ড ও সময় নেয় নি।মুখের খাবার টা আর গলায় পৌঁছানো সম্ভব হলো না।গ্লাসে থাকা জলটা দ্রুত খেয়ে নিয়ে কোনভাবে ঢোক গিললো।মায়ের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েই প্রশ্ন ছুড়লো,

‘ আমি কাকে ভালোবাসি?তুমি এসব কোথায় শুনেছো?’

রৌদ্রের মা মুখ বাঁকালো।একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লো।ডান হাতের কনুইটা টেবিলের চারকোনার মসৃন তলের উপর রেখে মৃদু হেসে বললো,

‘ আজব!এমন ভাবে তাকাস কেন?আমি জানতে পারি না?তুই আমার ছেলে।আমার সাথে এক বাসায় থাকিস অথচ আমি জানবো না? আমাকে না জানিয়েই তুই প্রেম করবি?’

‘ আমি কখন প্রেম করলাম? কিসব বলছো আম্মু?’

‘ তাহলে প্রিয়তা কে?বল।’

রৌদ্রের মুখটা এবার আরো বিস্ময়ে খেলে গেলো।শুকনো ঢোক গিলে বলে উঠলো,

‘ আম্মু তুমি প্রিয়তার কথা কীভাবে জেনেছো?’

‘ না জানলে ভালো হতো?’

‘ তা বলিনি।কিন্তু কীভাবে জানলে?’

তার মায়ের মুখটি হাস্যোজ্জল থেকে কঠোর হয়ে উঠলো।মুখে চোখে কাট কাট একটা ভাব।কন্ঠস্বরটা গম্ভীর করে নিয়ে আমেনা বেগম বলে উঠলেন,

‘ আলমারির ড্রয়ার লক করে না গেলে তো আম্মু কেন আব্বু ও দেখে নিবে এসব। ‘

রৌদ্রের আর বুঝতে বাকি রইলো না।আলমারির বা পাশের ড্রয়ারে শুকনো মড়মড়ে বেলিফুলের মালা আর নুপুরের সাথে একটা সবুজ মলাটের ডাইরি।সেই ডাইরি শুধু এবং শুধু তার প্রিয়তার।ডাইরির সবুজ মলাটের উপর কালো কলমে খুব সুন্দরভাবে লিখা রয়েছে “প্রিয়তাতে যত অনুভূতি”। সেই ডায়েরিতে যখনই তার মন প্রিয়তাকে নিয়ে খেলে উঠে তখনই লেখা হয়।বিস্তর লেখা।যে লেখার প্রতিটা লাইনে এক সাগর অনুভূতিতে জড়ানো থাকে। লেখাগুলোও যেন প্রিয়তাকে পাওয়ার ব্যাকূল অপেক্ষায় আছে।রৌদ্র গ্লাসে মগ থেকে জল ডেলে আরো একগ্লাস জল খেলো।মায়ের দিকে তাকিয়ে থমথমে কন্ঠে বললো,

‘ তুমি কী প্রেমের বিরোধিতা করতে চাইছো আম্মু?’

আমেনা বেগমের কঠোর মুখের চাহনিটা এবার হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠলো।সশব্দে হেসে দিয়ে বলে উঠলেন,

‘ তার মানে প্রেম করছিস? ‘

রৌদ্র ছোট বাচ্চাদের মতো মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলো,

‘ আম্মু!প্রেম করার মতো কোনকিছু তোমার ছেলে করেছে?’

‘ নাহ!করে নি।কিন্তু আলমারির ড্রয়ারটা কী তবে মিথ্যে বলছে?’

‘ তেমন কিছু না আম্মু। এমনিই।’

‘ এমনিই?ইশ আলমারির ডানপাশের ড্রয়ারটা খোলা থাকলে ভালো হতো।ওই ড্রয়ারে মেয়েটার ছবি আছে নিশ্চয়?আমি জানি আছে।’

রৌদ্র এবার সশব্দে হেসে উঠলো।খাবার হাত দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো।স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,

‘ ভাগ্যিস!নয়তো ছবিগুলো দেখলে তো আমারে আর বাঁচতে দিতে না।আম্মু তুমি কী ডায়েরির সব লিখা পড়ে নিয়েছো?’

‘ ছেলের প্রেমের কথা। মায়ের এতো আগ্রহ নিয়ে পড়তে নেই।প্রথম পেইজ পড়েই বুঝে নিয়েছি মেয়েটাকে প্রচুর ভালোবাসিস এখন বিয়েটা করে নে তাকে।আমি একটু গল্প করতে পারবো তার সাথে।’

‘ পাগল নাকি?চাকরি করি মাত্র একবছর।বেতন মাত্র পয়তাল্লিশ হাজার।তারা রাজি হবে না নিশ্চিত।’

‘ বড়লোক মেয়ে নাকি?শেষ পর্যন্ত তুই বড়লোক মেয়েকেই ভালোবাসলি রোদু?’

‘ উফফস মা আমি কখন বললাম সে বড়লোক।’

‘ তবে রাজি হবে না কেন?ঢাকা শহরে চারতালা বিল্ডিংয়ের বাসা আছে আমাদের।বাসাভাড়া দিয়েই দিব্যি ভালো যায় আমাদের।তোর চাকরি না করলেও হয়। তবে রাজি হবে না কেন?তাও যদি রাজি না হয় তো আমি আছি কী করতে?দরকার পড়লে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসবো।তাও বউ করবোই।কুল রোদু।’

মায়ের কথা শুনে রৌদ্র কয়েক সেকেন্ড বিস্ময় নিয়ে তাকালো মায়ের দিকে। এটা যে তার মা বিশ্বাসই হচ্ছে না তার।মায়ের দুষ্টুমিমাখা হাসিতে একনজর তাকিয়েই সে বলে উঠলো,

‘ এখন এসব কথা অফ রাখো।ছয় সাত মাস পর আমি নিজেই তোমার হাতে ছবি দিবো।বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেও কেমন?’

রৌদ্রের কথাতে আমেনা বেগমের মুখটা কালো হয়ে গেলো মুহুর্তেই।রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে কপোট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,

‘ ছয়মাসে কী করবিটা কী? এখন বিয়ে করলে কী তোর চরিত্রে দ্বোষ লেগে যাবে রোদু?’

রৌদ্র কিছু বললো না।নিরবে হেসে চলে গেলো।মা যে তার মনে আক্ষেপ নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছে সে।তবুও সে এখন বিয়েতে রাজি না।আর কয়েকদিন পর তার প্রিয়তার অনার্স তৃতীয় বর্ষের এক্সাম শুরু হবে।এমন সময় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোটা সত্যিই বিরক্তিকর ঠেকবে তার প্রিয়তার কাছে।

গেটের সামনে দুজন সিকিউরিটি গার্ড।পরনের ড্রেস এ তেমনই মনে হচ্ছে।নিরব আর আদ্রিতার গাড়িটা গেট বরাবর থামতেই দুজনই হন্তদন্ত হয়ে বসা থেকে উঠে পড়লো।তারপর দ্রুত গেট খুলে দিলো।গেটের চওড়া পরিধি দিয়ে নিরবের গাড়িটা ডুকে গেলো।আদ্রিতা বিস্ময় নিয়ে চারদিকে তাকালো।বেশ সুন্দর একটা বাড়ি।ছিমছাম দোতালা একটা বাড়ি।বাড়ির ছাদে হরেক রকমের গাছ নিচ থেকেই চোখে পড়ছে।বাড়ির চারপাশে ইট সিমেন্টের চিকন দেওয়াল তৈরি করে হরেক রকমের ফুলগাছও লাগানো আছে।তার থেকে কিছুটা দূরে কর্নার গুলোতে বেলিফুলের লতানো গাছ।তবে লতাতে অল্প কয়েক ফুল। বোধ হয় বেলি ফুল ফোটার সিজন নয় তাই।নিরব গাড়ি থেকে নেমে পড়লেও আদ্রিতা তখনো অপলক দৃষ্টিতে চারপাশ দেখে যাচ্ছে।বাড়ির প্রতিটি কোণার সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করছে।এতোটা সুন্দর বাড়ি হতে পারে? ইশশ!এবার বাসায় গেলে সেও ছাদটাকে এভাবে সাঁজাবে।হরেক রকমের ফুলে ভরিয়ে তুলবে।নিরব শার্টের কলার ঠিক করে আদ্রিতার মুখ বরাবর মাথা ডুকিয়ে বললো,

‘ মিস আদ্রিতা?এভাবে কী দেখছো?বাড়িটা সুন্দর লেগেছে?থেকে যাবে এখানে?’

নিরবের কথাটায় অপলক চেয়ে থাকা চোখজোড়া এবার অগ্নিদৃষ্টিতে ভরে উঠলো।ক্ষিপ্র গলায় বলে উঠলো,

‘ আজব!বাড়ি সুন্দর লাগতেই পারে।এভাবে ফুলগাছ লাগালে কার না সুন্দর লাগবে?’

নিরব বাঁকা হাসলো।ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলে উঠে,

‘ সেটাই তো বলছি।সুন্দর লাগলে পার্মানেন্টলি থেকে যাও। না করবো না।’

আদ্রিতা গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।পরনের ওড়নাটা ঠিক করে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।তেজ নিয়ে বলে উঠলো,

‘ কেন আমার বাড়িঘর নেই?ভিখারি আমি?যে এই বাড়িতে আশ্রয় নিবো?’

‘ ওমাহ!পিচ্চি দেখি রাগ ও দেখাতে পারে।’

অাদ্রিতা এবার তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকালো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘ এই বাড়িটা আপনার?আমাকে এখানে কেন এনেছেন?আমি তো আর আপনার কোন ক্ষতি করিনি।কোন ছবি শেয়ার করিনি।কাউকে কিছু বলিওনি এই সম্বন্ধে তাহলে?কেন আমার পিছনে পড়ে আছেন?কেন?’

নিরব আদ্রিতার মুখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে পকেটে হাত ডুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।নিজের অতিসুন্দর পুরুষালি কন্ঠটা গম্ভীর করে বলে উঠলো,

‘ মে বি কোন ক্ষতি অবশ্যই করেছো মিস আদ্রিতা।নয়তো আমি তোমার পিছু পড়তাম না।’

‘ কী ক্ষতি করেছি?বলুন।আমি ক্ষমা চাইছি দরকার হলে তাও আমায় মুক্তি দিন এসবের থেকে।’

নিরব হেসে উঠলো।আদ্রিতার কথাটা তার কাছে খুব হাস্যকরই মনে হলো।হাসিটা থামিয়ে নিয়ে চোখজোড়া রক্তলাল করে বলে উঠলো,

‘ ফলো মি।নয়তো শ্যুট করে দিবো।আমাকে তো চেনোই।’

আদ্রিতা শুকনো ঢোক গিললো।নিরব যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেলো।বাসার সামনে বিশাল দরজা।দরজার দুপাশে বড় বড় দুইটা ফুলদানি।বাড়ির দরজার সাথে অপরূপ মানিয়েছে বটে।নিরব দুবার কলিংবেল বাঁজাতেই একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সী মহিলা দরজা খুলে দিলো।মহিলাটি সবিনয়ে বলে উঠলো,

‘ স্যার মামিমনি অপেক্ষা করে আমনের লাইগা।’

নিরব মৃদু হাসে।তারপর এগিয়ে গেলো।নিরবের পিছু পিছু আদ্রিতাকে এগিয়ে যেতে দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকালো মহিলাটি।আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে তার চোখে যেন প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসলো।কিছুটা সময় তাকিয়েই দৃষ্টি ফেরালো।আদ্রিতা মহিলাটির দৃষ্টিতে অস্বস্তিতে গুঁটিয়ে গেলো।বারবার শুকনো ঢোক গিলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।বাড়ির পরিবেশ খুব শান্ত।বাইরের কোন আওয়াজ ভেতরে আসে না।শুনশান নিরবতা।বাড়ির বাইরেটায় যতোটা সুন্দর ভেতরটা ততোটা বিলাশবহুল।নিরব মাঝখানের সিঁড়িটা দিয়ে দোতালায় উঠতে আদ্রিতাও উঠে পড়লো।সিঁড়ি বাম দিক বরাবর একটা রুম। রুমে দরজা লাগানো।তার বা পাশেই আরেকটা রুম।নিরব সেই রুমের দরজায় এসে থামলো।আদ্রিতাও থামলো।উঁকি দিয়ে রুমের ভেতরটায় নজর দিতে একজন মহিলাকে চেয়ারে বসে বই পড়তে দেখা গেলো।পরনে গিয়া রংয়ের একটি শাড়ি।চোখে চশমা।হাতের কনুইগুলো চেয়ারের হাতলে রেখে বইটি মেলে রেখেছেন চোখের সামনে।কালো কেশে কিছু সাদা চুলেরও দেখা মিলছে।আদ্রিতা নিরবের দিকে এক নজর চেয়ে চট করে বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কার করলেন।নিরব আর এই মহিলাটির মুখের মিল আছো।চোখ জোড়া হুুবুহু একরকম।কেবল গায়ের রংটা আলাদা।নিরবের গায়ের রং ধবধবে সাদা আর মহিলাটির শ্যামলা।আদ্রিতা নিরবের দিকে ভীতু চাহনিতে তাকাতেই নিরবের চোখাচোখি হয়ে গেলো।নিরব বোধ হয় তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো।আদ্রিতা তৎক্ষনাত দৃষ্টি সরালো।নিরব মৃদু হেসে রুমে গেলো।শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ আম্মু, অপেক্ষা করছো? কী কাজে পাঠালে বলোতো?প্রচুর বোরিং।নিরব চৌধুরি কখনো কারো জন্য ওয়েট করেছে?’

নিরবের মা নিলি হক হাসলেন।বইটা বিছানায় রেখে চশমাটা খুলে রাখলেন।নিরবের দিকে একনজর তাকিয়ে আবারো হেসে ফেললেন।নিরবের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে বলে উঠলেন,

‘ তাই নাকি?আমার নীর বাবাই দেখি অনেক বোর হয়ে গেছে।’

নিরব বিরক্তিভরা চাহনিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘ প্রচুর আম্মু। ‘

কথাটা বলে পেছনে ফিরে আদ্রিতাকে দেখলো।কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

‘ এই পিচ্চি শোনো, তোমাকে এখানে রেখে যাচ্ছি।সময় মতো নিয়ে যাবো ‘

কথাটা বলে হেসে চলে গেলো নিরব।আদ্রিতা ভয়ে গুঁটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সামনের মহিলাটি তার সাথে কেমন আচরণ করবে জানা নেই।নিরব এখানে তাকে কেন এনেছে তাও জানা নেই তার। নিরবের কী ক্ষতি করেছে তাও মনে পড়ছে না।কী মুশকিল!ভয়ে একপ্রকার ঘেমে আছে আদ্রিতা।কিছুটা সময় ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই সামনের মহিলাটি তাকে গভীর নজরে পরখ করে দেখলো।চেয়ার ছেড়ে উঠে মগ থেকে গ্লাসে জল ডেলে দিয়ে আদ্রিতার দিকে এগিয়ে দিলো।মৃদু কন্ঠে বললো,

‘ পানিটা খেয়ে নাও।’

আদ্রিতা পানির গ্লাসটা এগিয়ে নিলো। হাতের মুঠোয় শক্তভাবে ধরে ঠোঁটে ছোঁয়ালো।দু চুমুক পানি খেয়েই রেখে দিলো গ্লাসটা।মহিলাটির দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই মহিলাটি বলে উঠলো,

‘ তোমার নাম আদ্রিতা?’

আদ্রিতা চোখ বড় বড় করে চাইলো।তার নাম কীভাবে জানে উনি?নিরব বলেছে?নিরব কেন বলেছে তার নাম?সে কী এমন ক্ষতি করেছে নিরবের?আদ্রিতার মাথায় এতোসব প্রশ্ন খেলা করলেও এসবের কোন কিছুই সে জিজ্ঞেস করলো না।হালকা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলো।শুকনো ঢোক গিলে তাকাতেই মহিলাটি চেয়ার টেনে বসতে বললো।আদ্রিতা নিঃশব্দে কোন কথা না বলে বসে পড়লো।মহিলার দিকে তাকাতেই তিনি মৃদু হাসলেন।ততক্ষনে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আরেকটি মধ্যবয়স্ক মহিলা।হাতে নাস্তার ট্রে।সে নাস্তার ট্রে টা ছোট টি টেবিলের কাঁচের মসৃন তলে রেখে চলে গেলো।নিরবের মা মৃদু হেসে বললেন,

‘ নাও।হালকা নাস্তা।সমস্যা হবে না।’

আদ্রিতা জোরপূর্বক হেসে উত্তর দিলেন,

‘ না আন্টি, দুপুরের খাবার মাত্রই খেয়েছি।এখন খাওয়া সম্ভব না।’

মহিলাটি হাসলো।মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বললো,

‘ অল্প নাও সমস্যা হবে না।’

আদ্রিতা জোর পূর্বক চামচ দিয়ে অল্প খাবার মুখে তুললো।মহিলাটির দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আপনার আর মিঃ নিরবের মুখের কিন্তু অনেক মিল আন্টি।’

মহিলাটি জবাবে এবার ও হাসলো।কী বুঝেই প্রশ্ন করে উঠলো,

‘ বাগান ভালোবাসো?’

‘ বাসি তবে তেমন বাগানচর্চা কখনো করা হয় নি।বাগানচর্চা বলতে ছাদে দুটো গোলাপ গাছ এটুকুই।তবে আপনাদের বাড়ির পুরোটাই বাগান মনে হয়।’

‘ চিটাগাং ভার্সিটিতে পড়ো?’

আদ্রিতা থতমত খেয়ে গেলো।সে চিটাগাং ভার্সিটিতে পড়ে এটা কীভাবে জানলো ভদ্রমহিলা?আশ্চর্য!তারপর কী বুঝেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো।ভদ্রমহিলা আবারো বলে উঠলো,

‘ তুমি কিন্তু ভারী মিষ্টি মেয়ে।পুরো পুতুল বউ টাইপ।’

আদ্রিতা ভ্রু কুচকে তাকালো।পুতুল বউ টাইপ?এটা আবার কেমন সংজ্ঞা হলো?আদ্রিতার এমন চাহনি দেখে মহিলাটি হাসলো।তারপর আবারো বললো,

‘ তোমার হোস্টেল তো পাশেই।মাঝেমধ্যে আমার সাথে দেখা করে যেতে সমস্যা হবে?নিরবটাও থাকে না।শো,রেকর্ডিংয়ের কাজে বেশিরভাগই ঢাকার ফ্ল্যাটে থাকে।একা একা আর একলা মানুষের কতোটুকুই সময় কাঁটে?’

আদ্রিতা মহিলার শান্ত সুন্দর শ্যামলা মুখশ্রীর দিকে তাকালো।বয়সে তার মায়ের বয়সীই হবে।বেশ গম্ভীর টাইপ মহিলা।তবে মনে হাজার টন সরলতা আছে বুঝতে আর বাকি রইলো না আদ্রিতার।আদ্রিতা মৃদু হেসেই জবাব দিলো,

‘ আচ্ছা আসবো আন্টি।’

কথাটা বলতেই রুমে ডুকলো নিরব।সবে শাওয়ার নিয়েছে।পরনে লাল রংয়ের একটা টিশার্ট আর কালো রংয়ের থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট।বাম হাতে কালো ব্ল্যাসলেইট। হাঁটুর নিচের লোম গুলো ধবধবে ফর্সা পায়ের ত্বকে লেপ্টে আছে।ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি কপালে পড়ছে।আদ্রিতা একনজর তাকিয়ে চোখ সরালো।এভাবে হাজার হাজার মেয়ের ক্রাশ চোখের সামনে থাকলে তাকিয়ে ছাড়া থাকা কোন উপায়ও থাকে না।এতো সুদর্শন ছেলের দিকে না তাকিয়ে আর কী করার আছে?তাদের রূপই চোখকে বশ করে বসে। নিরব আদ্রিতার দিকে একনজর তাকিয়ে মাকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলো,

‘ আম্মু তোমার হয়েছে?বুঝোই তো অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কতোটা পিচ্চি।আমার থেকে তো পাঁচ বছরের ছোট।পিচ্চি মানুষ ভয়ে আমার বাসায় আবার মরে টরে গেলে জেলে যেতে হবে।আমার পেছনে এতো এতো মেয়ে তখন থাকবে না তো তাহলে!’

নিরবের মা হেসে উঠলো।ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ পৌঁছে দিস ওকে।’

‘ আমি পৌঁছে দিতে পারবো না।ডাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিবো ওকে।এই পিচ্চি? আমার পিছু পিছু আসো।’

আদ্রিতা যেন প্রাণ ফিরে পেলো। অবশেষে এখান থেকে যাওয়ার অনুমতি মিললো।ধীর পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিরবের মায়ের হাস্যোজ্জ্বল চাহনির দিকে তাকিয়ে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালো।নিরবের পেছন পেছন আবারো আরেকটা রুমে যেতে হলো তাকে।আদ্রিতার মুখ কালো হয়ে গেলো। ভেবেছিলো এক্ষুনি চলে যাবে সে।কিন্তু আবারো অন্য একটা রুম।আদ্রিতা কৌতুহল নিয়ে এদিক ওদিক তাকালো।বিছানায় লাল রংয়ের একটা গিটার।দেওয়ালে নিরব আর নিরবের মায়ের দু তিনটে ছবি ঝুলানো আছে।আরেকটা ছবিতে এক ভদ্রলোকের কোলে ছোট একটা বাচ্চা পাশে একটা মহিলা।মহিলাটির সাথে নিরবের মায়ের চেয়ারার মিল আছে।আদ্রিতা বুঝলো রুমটা বেশ বিলাসবহুল।এসির হাওয়ায় ঠান্ডা হয়ে উঠেছে ঘর।আদ্রিতা কৌতুহলের মাঝেই দরজা আটকানোর আওয়াজে চোখ তুলে চাইলো।ঢোক গিলে বললো,

‘ আপনি দরজা অফ করলেন কেন?’

‘ মন চাইলো।’

‘ দরজা খুলুন। আমি বাইরে যাবো।দরজা খুলুন বলছি মিঃ নিরব।’

নিরব দরজা খুলে দিলো।বিছানায় বসে আরাম করে বললো,

‘ শান্তি?’

‘ হ্যাঁ।’

‘ ভীতু একটা। তোমাকে এই রুমে কেন এনেছি? ‘

আদ্রিতা ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

‘ কেন?’

‘ আমি প্রশ্ন করলাম আবার সেই প্রশ্ন আমাকেই ফেরত দিচ্ছো দেখি।’

‘ তো আমি কীভাবে জানবো আমাকে এখানে কেন এনেছেন?’

নিরব চোখ তুলে চাইলো আদ্রিতার দিকে।আদ্রিতা চোখাচোখি দৃষ্টি রেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,

‘ আমার যে এক্সিডেন্ট হয়েছিলো? সেদিনকার গাড়ির লোকটা আপনি ছিলেন তাই না?’

নিরব বাঁকা হাসলো।ভেজা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বলে উঠলো,

‘ কী মনে হয়?’

‘ আপনিই ছিলেন।’

‘ পিচ্চি মাথায় এটুকু ডুকেছে।’

‘ কথায় কথায় এমন পিচ্চি সম্বোধন করছেন কেন?’

‘ পিচ্চি যে তাই।’

‘ আপনি জানেন আপনার জন্য আমার জম্মদিনটা নষ্ট হয়ে গেছিলো।সেদিন আমার বার্থডে ছিলো মিঃ নিরব।আপনার গাড়ি তো আমার পায়ের বারোটা বাঁজিয়ে দিলো।’

নিরব হাসলো।আদ্রিতাকে কিছু বলার থাকলেও আর বললো না।সটান উঠে দাঁড়িয়ে আদ্রিতার উদ্দেশ্যে বললো,

‘ সোজা নেমে গেট পর্যন্ত গেলে হোয়াইট কালারের একটা গাড়ি আছে ওটাতে উঠে বসে চলে যাবে।ড্রাইভার পৌঁছে দিবে।হেরফের হলে কিন্তু মুখে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসাবো।’

আদ্রিতা মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলো,

‘ আমি নিজেই যেতে পারবো।আপনার গাড়ির দরকার নেই।’

নিরব ঘড়ির দিকে তাকালো।তারপর কঠোর কন্ঠে বললো,

‘ পাঁচ মিনিটের মধ্যে যদি না যাও তো আমি কী রূপ ধারণ করবো বলতে পারছি না।তবে তোমার অবস্থা খারাপ হবে।আমার গাড়িতে করেই যাবে।নিজে নিজে যেতে গিয়ে যদি আবার হাত পা ভেঙ্গে বসে তো দায় কে নিবে?’

আদ্রিতা নিরবের কঠোর কন্ঠে ঢোক গিললো।কিছু না বলে দ্রুত হাঁটা ধরলো।এখানে আর এক মুহুর্ত ও থাকা চলবে না

_____________________

সপ্তাহ খানেক হলো মেহু বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে।এখনো পর্যন্ত হোস্টেলে যাওয়া হয়ে উঠে নি তার।আকাশে বিকেল ফেরিয়ে সন্ধ্যার চাপ পড়েছে।তেজ দেখানো সূর্যটা এখন নিশ্চুপ হওয়ার ভান ধরেছে।কাল সকালেই সে ই আবার চঞ্চল কিশোরীর মতো তেজ দেখিয়ে বেড়াবে।দুপুরের রোদের তেজটা এখন মিইয়ে এসেছে।সামনের নদীর পানিগুলো শান্তভাবে বয়ে চলেছে।পানির কনা গুলোর মধ্যে নেই কোন বিবাদ।তারা তাদের গতিতেই নিজেদের সামলাতে ব্যস্ত।নদীর কিনারা থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে অতি পুরাতন কিছু আমগাছ।আমগাছে পাতার মাঝে ছোট ছোট আমের দেখা মিলছে। বৈশাখে আম খাওয়ার মজাটাই আলাদা।মেহু আমগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আজ তার আম খেতে ইচ্ছে করছে।কাঁচা আমেন সেই স্বাদটাও মনে পরছে না।গত তিনবছর হোস্টেলে বন্ধুদের সাথে পড়ালেখার ফাঁকে যা একটু আধটু খাওয়া হয়েছে।ভার্সিটিতে এডমিট হওয়ার আগে বাড়িতে থাকাকালীন সেই জমিয়েই কাঁচা আম খেয়েছে।মায়ের বানানো টক আচার ও খেয়েছে।সেসব স্মৃতি তার মনে পড়ছে কিন্তু স্বাদটা জিহ্বায় আসছে না।কেন?মেহু ছলছল নয়নে নদীর ঘাসের উপরে পা জোড়া মেলে গাছে হেলান দিয়ে বসলো।মেহু চোখজোড়া বন্ধ করতেই মোবাইল বেঁজে উঠলো।মোবাইলে অয়ন্তীর নাম্বারটা দেখে নিয়ে রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে অয়ন্তী বলে উঠলো,

‘ এই মেহু তুই কোথায়?আমরা তো তোর বাড়িতে।তুই কুত্তি কোথায় লুকোলি?’

মেহু বিস্মিত হলো।অয়ন্তীরা তার বাড়িতে মানে?শুকনো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আমি মজার মুডে নেই অন্তি।মজা করিস না।’

‘ সত্যিই এসেছি।আজকে ভার্সিটি ছুটির পরই হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।তারপর রিয়াদ আর প্রিয়া বাদে বাকি সকলে এসে পড়েছি।বিশ্বাস না হলে আন্টির সাথে কথা বল।’

মেহুর এবার কথাগুলো বিশ্বাস হলো।কালকে অয়ন্তী তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছিলো তা যে আসার জন্য সে বুঝতেই পারে নি।যাক তার কষ্টগুলোকে একটু কমানোর জন্য তার বন্ধুরা তো এসেছে!মুহুর্তেই মেহুর মনে প্রশ্ন জাগলো অভ্রও এসেছে?অভ্র তার বাড়িতে এসেছে? না এই কথাটা কেন জানি তার মন মানতে চাইলো না।শত চেষ্টা করেও মানানো গেলো না।মেহু শুকনো ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো,

‘ তোরা কে কে এসেছিস?’

‘ আমি,বিনয়,অভ্র আর জেনী।তুই তাড়াতাড়ি আয়।’

অভ্র শব্দটা মেহুর পুরো মস্তিষ্কে ঘুরতে লাগলো।অভ্র এসেছে?কিন্তু সে তো এসব মিডেলক্লাস কাজকারবার সহ্য করতে পারে না।মেহু কাঁপা কন্ঠে বললো,

‘ আমি আসছি।তোরা আরাম কর।দূর থেকে আসলি।’

#চলবে….

( আজকের পর্ব ছোট হয়েছে বললে আমি কিছু বলবো না..কেমন হয়েছে জানাবেন…পর্ব নিয়ে আপনাদের অনুভূতি গ্রুপে প্রকাশ করবেন..ভালোবাসা সকলের জন্য)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here