অনুভূতি_জুড়ে_তুমি পর্ব_০৯

অনুভূতি_জুড়ে_তুমি
পর্ব_০৯
লেখনীতে : স্পর্ষীয়া ভূমি

আদ্রিতা হোস্টেলে ফিরেছে আজ দুদিন।আসার আগের দিনই রৌদ্র নতুন দামি একটা মোবাইল কিনে দিয়েছে।কিন্তু তাও মনে একটা খোঁচা রয়েই গেছে।তার মোবাইল হারালো কীভাবে?তার মোবাইলটাতে তো নিরবের ছবিগুলো এখনও রয়েছে। ডিলিট করার সময়টাই তো সে পায় নি।কেউ যদি তার মোবাইলটা পেয়ে যায় তবে?মোবাইলটা কোনভাবে আনলক করে যদি কোনভাবে ছবি গুলো দেখে যায়?আজকাল মোবাইলের পাসওয়ার্ড না জানলে ও লক খোলা কোন ব্যাপার না।আদ্রিতা ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো।না এমনটা না হোক।নিরব লোকটা প্রচুর ভয়ানক!মানুষের মস্তিষ্ক যেটা বিশ্বাস করে সেটাই।তার বাইরে দুনিয়া উল্টে গেলেও সে অন্য কিছু ভাবতে পারে না যতোক্ষণ না তার মস্তিষ্ক বিষয়টা মেনে নিচ্ছে।আদ্রিতাও পারলো না।নিরব লোকটাকে কোনভাবেই সহজ সরল ভালো মানুষ ধরে নিতে পারলো না।বাইরে তুমুল বেগে ঝড়ো হাওয়া বইছে।তার সাথে হচ্ছে বৃষ্টিও।বৈশাখের সময় এই একটা বিরক্ত!সবসময় বৃষ্টি ঝড় লেগেই থাকে।আকাশ অন্ধকার, বজ্রপাত, বৃষ্টি,তুফান সব যেন এই বৈশাখকেই ঘিরে।আদ্রিতা কপাল কুচকে টেবিলের পাশের জানালাটা আটকে দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।আদ্রিতার বেডের সাথে আড়াআড়ি ভাবে রয়েছে আরো একটি বেড।বেড টা যার সে মেয়েটি আজ নেই।রুমে আজ আদ্রিতাকে একাই থাকতে হবে।তার ওপর এই ঝড়।আর ঝড় বৃষ্টির জন্যই বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে।ভয়ে আদ্রিতার মরো মরো অবস্থা।হোস্টেলে এসেছে পর্যন্ত এমন পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয় নি তাকে তাই আজ ভয়ে হৃৎপিন্ডটা চিপকে আছে তার।বজ্রপাতের তুমুল আওয়াজে ডিপডিপ করছে যেন হৃৎপিন্ড।টেবিল হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজে নিয়েই ফ্লাশলাইট জ্বালালো।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলো।সাড়ে সাতটা।এখনো তেমন রাত হয় নি।ভয়ে চুপসে গিয়ে হাত পা কাঁপছে তার তবুও।কিছুটা সময় যেতেই বিদ্যুৎ চলেও আসলো।হোস্টেলের জেনারেটরের জন্য এই যাত্রায় রক্ষা হলো তার।স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করতেই অপরপাশ থেকে দরজায় কড়া পড়লো।ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই হোস্টেলের দাড়োয়ান হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে বললেন,

‘ আদ্রিতা আপা,এই লোকডারে চেনেন? ‘

আদ্রিতা কপাল কুচকে দাড়োয়ানের দেখানোর লোকটির দিকে তাকালো।না সে চেনা না এই লোককে।আদ্রিতা বিনয়ীভাবে বললো,

‘ নাহ তো চাচা।কেন?’

আদ্রিতা কথাটা বলতেই দাড়োয়ান যেন আরেক ধাপ সুযোগ পেয়ে বসলো।গদগদ গলায় বলে উঠলো,

‘ঠিকই টের পাইছি দেহি।হোস্টেলে এখন ম্যাডাম গুলানও নাই এতোবার করে না করলাম লোকডা হুনতেই রাজি না।আপনার সাথে নাহি কী দরকার আছে।কিন্তু আপনি যেহানে তারে চিনেনই না সেহানে কী দরকার থাকবো?’

আদ্রিতা সাই দিলো কথাটায়।লোকটা অসহায় চাহনিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে কিছু বের করলো।আদ্রিতার দিকে এগিয়ে দিয়েই বললো,

‘ ম্যাডাম সত্যিই দরকার আছে।এটা নিন।’

আদ্রিতা চোখ বড় বড় করে তাকালো।তার হারিয়ে যাওয়া মোবাইলটা লোকটার হাতে।কিন্তু কীভাবে?তবে কী লোকটা তার মোবাইল কুড়িয়ে পেয়ে ফেরত দিতে এসেছে?কিন্তু কীভাবে জানলো এটা তার মোবাইল?আর তার ঠিকানা? ঠিকানা কী করে ফেলো?আদ্রিতা কিছু বুঝে উঠলো না।শুকনো ঢোক গিলে মোবাইলটা এগিয়ে নিলো।লোকটির দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকাতেই লোকটি বলে উঠলো,

‘ স্যার বলেছেন মোবাইলের লক স্ক্রিন খুলে গ্যালারি আর মেসেজ বক্সটা চেক করতে।আসি তবে?’

আদ্রিতা কী বলবে বুঝে উঠলো না।এই লোকের স্যার আবার কে?লোকটি পা বাড়াতেই নিলে আদ্রিতা হকচকিয়ে বলে উঠে,

‘ এই দাঁড়ান।আপনার স্যার কে?’

লোকটি পিঁছু ফিরলো।তারপর বলে উঠলো,

‘ স্যার বলেছে উনার নামটা না বলতে।তবে আপনি নিজেই চিনে যাবেন এটাও বলেছে।’

লোকটি কথাটা বলেই দ্রুতপায়ে চলে গেলো।আদ্রিতা মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাষ ফেললো।গুঁটিগুঁটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে রুমের দরজা আটকালো।মোবাইলের লকস্ক্রীনটায় আনলক করে খুলতেই নিরবের উজ্জ্বল একটা ছবি ভেসে উঠলো হোমস্ক্রীনে।ছবিটা আঠারো উনিশ বয়সী থাকা যুবকের।কালো রংয়ের একটা টিশার্ট ধবধবে ফর্সা শরীর।মুখে ঝুলে আছে এক টুকরো হাসি।ছেলেটির রূপে মুগ্ধ হয়ে সেদিনকার ঘটনাটা মনে করেই ঘৃণায় ভরে উঠলো মনটা।দ্রুত গ্যালারিতে প্রবেশ করতেই নিরবের সেদিনকার তোলা ছবিগুলো পাওয়া গেলো না।
আদ্রিতা কপালে ভাজ ফেলে গ্যালারির সব গুলো ছবি দেখলো।কিন্তু নাহ।কোথাও নিরবের সেদিনের কোন ছবি নেই।কিন্তু নিরবের প্রায় দুশোটা ছবি তার গ্যালারিতে উপস্থিত।কিন্তু সেদিনের ছবি গুলো নেই।আদ্রিতার সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেলো মুহুর্তেই।সেদিন মোবাইলটা নিরবই নিয়েছিলো।আর তারপর মোবাইলের লক খুলে নিজের ছবিগুলো ডিলিট করে দিয়েছে।হোমস্ক্রিণে তার কিশোরকালের ছবি ঝুলিয়ে দিয়েছে।আদ্রিতা ঢোক গিললো।নিরব লোকটা প্রচুর ভয়ঙ্কর। তার মোবাইল দিয়ে কিছু করে নি তো?কাঁপা হাতে ম্যাসেজ বক্স চেক করতেই দেখলো একটা নাম্বার থেকে দু দুটো মেসেজ এসেছে আধঘন্টা আগে।নাম্বারটা ” মাই লাভ “দিয়ে সেইভ করা । আদ্রিতা ভ্রু কুচকে মেসেজগুলো ওপেন করেই অবাক হলো ।চোখজোড়া বড় বড় করে পড়লো,

‘ গ্যালারি তে আমার সেদিনের ছবি গুলো খুঁজলে তো?পেলে না?আমাকে এতো খোঁজাখোঁজির কী আছে বলো?বললেই তোমার সামনে চলে আসবো।এনিওয়ে আমাকে যতোবার ইচ্ছে ততোবারই দেখতে পারো।’

‘ গ্যালারিতে দুশো+ ছবি রেখেছি আর হোম স্ক্রিনে আমার সুন্দর একটা ছবি সেট করা আছে।যতোবার ইচ্ছে ততোবার দেখো না করবো না।কাল দুপুর দুটোয় তোমার হোস্টেলের সামনে থাকছি। আশা করি আসবে নয়তো সেদিনকার কথা মনে আছে তো?’

প্রিয়াদের বাসার ছাদে বসেছে জমালো আড্ডা। মেঝেতে মাঁদুর বিছিয়ে পাশাপাশি বসে আছে অভ্র, রিয়াদ, বিনয়,প্রিয়া, জেনী ও অয়ন্তী।রাতের আঁধার গভীর থেকে গভীর কালো হয়ে উঠেছে।ছাদের লাইটের মৃদু আলো ছড়িয়েছে।আকাশে অর্ধচাঁদ খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে।তার সাথে তারারা বিন্দু বিন্দু মুক্তোর মতো উজ্জ্বলতা ছড়ালো।অভ্র গিটারে হালকাপাতলা সুর তুলছে।বাকিরা সবাই সে সুরের সাথে তাল মিলিয়ে গান গাইছে।কিছুটা সময় পর হঠাৎ ঐ অভ্রের মন খারাপ হয়ে গেলো।গিটারটা কাঁধ থেকে খুলে নিয়ে ছাদের রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে রেখে দিলো।মুখে চোখে তিক্ততা।বন্ধুদের সবার মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।মেহুকে সেদিন হোস্টেলে পৌঁছে দেওয়ার পর থেকে আর এক নজরও দেখেনি সে।ভার্সিটিতেও আসে নি।অভ্রর জানামতে মেহু ক্লাস মিস দেয় না।কিন্তু দুটোদিন সেটাই হচ্ছে।মেহু ক্লাস এটেন্ড করছে না, ভার্সিটি আসছে না, নোট কালেক্ট করছে না। কী হয়েছে মেহুর?সেদিন কী তার ব্যবহারটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আজ দুদিন অশান্ত চোখজোড়া মেহুকে খুঁজে চললেও মেহুর দেখা পাওয়া গেলো না।মেহুর কথা জিজ্ঞেস করবে ভেবেও ফ্রেন্ডদের জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠে নি।তার আত্নসম্মানে লাগবে না?একটা ঘরোয়া টাইপের মেয়ের এতো খোঁজখবর কেন নিবে সে?অভ্রকে অন্যমনস্ক দেখেই অয়ন্তী বলে উঠলো,

‘ কীরেহ অভ্র!গিটার বাঁজানো থামালি কেন?ভালোই তো হচ্ছিল?’

অভ্র ভাবনার ঘোর কাঁটিয়ে অযন্তীর দিকে তাকালো।হেসে বললো,

‘ ভালো লাগছে না তাই।’

অয়ন্তী মুখ কালো করে বললো,

‘ আমারও ভালো লাগছে না।মেহুটা ওদিকে এমন অবস্থায় আর এখানে আমরা কত মজা করছি।’

অভ্রের তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করতে মন চাইল ” কী হয়েছে ওর?অসুস্থ?কোন সিরিয়াস ইস্যু?”কিন্তু তেমন কিছু জিজ্ঞেস করলো না।তাচ্ছ্যিল্য মাখা হাসি দিয়ে বললো,

‘ ঘরোয়া টাইপের মেয়ে।মা বাবা কী ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে নাকি অন্তি?’

অন্তি কপোট রাগ নিয়ে তাকালো।জেনী চশমাটা ঠিক করে তেজ নিয়ে বলে উঠলো,

‘ সবসময় ওকে নিয়ে মজা না করলে হয় না অভ্র?’

‘ আজব!কী এমন বললাম?ওকে চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে দিলেও ও চুপচাপ বিয়ে করে নিবে।এটা মাথায় না আসার কিছু আছে?’

রিয়াদ গম্ভীর গলায় বললো,

‘ অভ্র তুই জানিস না তাই এমন বকছিস।আমরা তো সবাই জানি।’

অভ্রের চিন্তাটা গাঢ় হয়ে উঠলো।কী হয়েছে মেহুর?হৃৎপিন্ডটা ধুকবুক করলে ও তার একরাশ ছায়াও পড়লো না মুখে।কঠিন কন্ঠে বললো,

‘ ওর সম্পর্কে জানার ইচ্ছেও নেই।’

অয়ন্তী রক্তলাল চোখে তাকালো।দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

‘ তোর জানার ইচ্ছে নেই যখন তখন মজা করিস না প্লিজ।ওর বাবা স্ট্রোক করেছে।আঙ্কেলের কালকেই হার্টের অপারেশন হয়েছে।মেহু দিশেহারা প্রায়।গ্রামের বাড়ি থেকে হসপিটালে। হসপিটাল থেকে বাড়িতে।তুই বুঝিস?মাকে সামলানো, ভাইকে সামলানো বাবার চিকিৎসার জন্য ছুটোছুটি করা চারটে কথা না অভ্র।তুই নিজে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলি?হয়তো নাহ।তাই এমন মজা করছিস।ও ওর জায়গায় ঠিকই আছে।তাতে কারো কাছে ঘরোয়া হোক কিংবা সেকেলে।’

কথাটা বলে অয়ন্তী আর এক মুহুর্তও বসলো না।উঠে দাঁড়িয়েই হাঁটা ধরলো।অভ্রের বুকের বা পাশে চিনচিন করে উঠলো।মেয়েটা নিশ্চয় মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।অভ্র এর আগেও খেয়াল করেছে মেহু বাবার প্রতি খুবই দুর্বল।আর এখন সে বাবারই অসুস্থতা সামলে যাচ্ছে সে।মেয়েটার প্রচুর ধৈর্যশক্তি।কী করে পারে এতো কষ্ট সহ্য করতে?অভ্র নিজেও তো কম কষ্ট দেয়নি মেহুকে।অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো।শুধু শুধু ভাবছে সে মেহুকে নিয়ে।মেহুর জম্মই হয়েছে কষ্ট পাওয়ার জন্য।সুতারাং সে কষ্ট পাবে এবং অভ্র কষ্ট দিবে।আরো বেশি কষ্ট দেবে।মেহু কষ্ট গুলো চুপচাপ সহ্য করতেই অভ্যস্ত।

#চলবে….

(( কেমন হয়েছে জানাবেন। যারা গল্প পড়ে এই খারাপ লেখনির পাশে আছো তাদেরকে অসংখ্য ভালোবাসা।আর কমেন্টবক্সে এতো সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করে আমার লেখার প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর জন্য আরোও ভালোবাসা তোমাদের।তোমাদের কমেন্টের রিপ্লাই দিতে পারিনি.. রাতে সময় করে দিবো..তার জন্য দুঃখিত!))

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here