অনুভূতি_জুড়ে_তুমি পর্ব_০৩

#অনুভূতি_জুড়ে_তুমি
পর্ব_০৩
লেখনীতে: স্পর্ষীয়া ভূমি

নিরব আদ্রিতাকে এক প্রকার জোর করেই কোলে তুলে নিলো।আদ্রিতার শরীরটা লেপ্টে গেলো তার চওড়া বুকে।নিরবের চারপাশে বরাবরই শতশত মেয়ের ব্যস্ততা থাকে।অনেক মেয়েই রোজ তার শরীরে ঢলে পড়ে।অনেক মেয়েকেই সে খুব কাছ থেকে নিরীক্ষণ করেছে। কিন্তু এই মেয়েটার মুখে ভিন্ন কিছু আছে।নিরব না চাইতেও তার দৃষ্টি বারবার মেয়েটার গোলগাল ধবধবে ফর্সা মুখটায় গিয়ে পড়ছে।যদিও মেয়েটির নজরে তা পড়ছে না।চোখে কালো রংয়ের সানগ্লাস থাকায় আপাদত তার সম্মান রক্ষা হলো।নয়তো মেয়েটি কী ভাবতো কে জানে?মেয়েটিকে নিজের দামি গাড়িটার বা পাশের সিটটায় বসিয়ে দিয়ে জলের বোতলটা তুলে নিলো।ঘন সিল্কি চুল গুলোকে ঠিক করার চেষ্টা করে জলের বোতলটা এগিয়ে দিলো মেয়েটির দিকে।আদ্রিতাও ছটফট বোতলটা ছিনিয়ে নিলো।বোতলের অর্ধেক জল শেষ করে অসহায় দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালো।সময় যেন যাচ্ছেই না।কবে তার ভাইয়া আসবে?

অপর পাশের মানুষটা তার অসহায় মুখটা দেখে মৃদু হাসলো।তারপর কী বুঝেই বলে উঠলো,

‘ পায়ে বেশি ব্যাথা হচ্ছে?চাইলে উপরে উঠিয়ে বসতে পারেন।আমি সাহায্য করে দিচ্ছি না হয়।’

অাদ্রিতা বিস্ফোরক চাহনিতে তাকালো। এভাবে একজন অপরিচিত লোকের গাড়িতে উঠে পড়া একেবারেই ঠিক হয় নি তার।লোকটা কিডন্যাপ করে নিয়ে গেলে তখন?অাদ্রিতা বুঝে উঠলো না। তবে সত্যিই এখন কিডন্যাপের চিন্তা বাদ দিয়ে পা তুলে বসতে পারলেই আরাম লাগতো তার।পায়ের ব্যাথায় যেন কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে তার।নিরব আদ্রিতার নিশ্চুপ মুখ দেখে কী বুঝেই হুট করে আদ্রিতার পা জোড়া আলতো হাতে গাড়ির সিটে উঠিয়ে দিলো।তারপর কোথায় যেন সরে গেলো।মিনিট পাঁচের মধ্যে একটা বরফের বোতল এনে আদ্রিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

‘ আপাদত এটা পায়ে দিয়ে ম্যাসাজ করুন।ব্যাথা কিছুটা কমবে।আপনার ভাই আসা না পর্যন্ত তো হসপিটালেও নিয়ে যেতে পারবো না।’

এতোক্ষণ লোকটার কন্ঠ তেমন মনোযোগ দিয়ে না শুনলেও এবার আদ্রিতা শুনলো।সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো লোকটির কন্ঠ আসলেই খুব সুন্দর।আদ্রিতার পরিচিত কোন কন্ঠস্বর।কিন্তু এই লোকের কন্ঠ কীভাবে তার পরিচিত হহবে?পরমুহুর্তেই সে চিন্তাকে মাথা থেকে বের করে বরফের বোতলটা পায়ের গোঁড়ালিতে দিতেই মনে হলো লোকটি চমকপ্রদ একটা কাজ করেছে। লোকটিকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়।তবুও চুপ করে রইলো।নিরব মোবাইলটা পকেট থেকে বের করেই কাউকে কল দিতে ব্যস্ত হলো।ওপাশ থেকে কেউ কলটা রিসিভ করতেই গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ বাসস্ট্যান্ডের সামনের গলিটায় আরেকটা গাড়ি পাঠাও তো।ড্রাইভারকে চলে যেতে বলে এখন নিজেই আটকে গেলাম।আর হ্যাঁ অনিক ভাইকে বলে দিও আজকে রেকর্ডিং টা হচ্ছে না।আই হোপ উনি বুঝবেন।আমিই কল করে নিতাম কিন্তু যে পরিস্থিতিতে আছি আপাদত কল করতে ইচ্ছে করছে না।’

নিরব কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবারও বলে উঠলো,

‘ নিরব চৌধুরী কবেই কারো বাধ্য ছিলো?নিরব চৌধুরীর জীবনে কোন রুলস নেই।আম্মুকে চিন্তা করতে না করে দিও ওকে?

আদ্রিতার কানে সবগুলো কথাই ডুকলো।সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু জোড়া কুচকে নিলো।নিরব চৌধুরী?লোকটার নাম কী নিরব চৌধুরী?রেকর্ডিং? কীসের রেকর্ডিংয়ের কথা বলছে এই লোক?আদ্রিতা বুঝে উঠলো না।নিরব চৌধূরী নামটা শুনতেই বর্তমানের জনপ্রিয় গায়ক নিরব চৌধুরীর মুখটাই ভেসে উঠলো আদ্রিতার কল্পনায়।আদ্রিতার বরাবরই তার গানের ভক্ত।আদ্রিতার ভাবনা ঝাপসা হতেই দেখলো গাড়ির সামনের সিটে বসে পড়লো লোকটি।হুট করে প্রশ্ন করে বসলো সে,

‘ আপনি এমন মাস্ক আর সানগ্লাস পরে আছেন কেন?আশ্চর্য!সামান্য এক্সিডেন্টের জন্য এতোটা ভয় পাচ্ছেন?পুরুষরা এতোটা ভীতু হয় জানতাম না।’

নিরব অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকালো।মেয়েটা এতোক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এখন স্পষ্ট কথা বলছে।এতোক্ষণ এতগুলো কথা বলেও সে মেয়েটির মুখ থেকে এমন লম্বা চওড়া বাক্য বের করতে পারে নি।নিরব কপালে চলে আসা চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে বলে উঠলো,

‘ আপনার সমস্যা হচ্ছে কোন?এনিওয়ে আপনার নামটা?’

আদ্রিতা কপাল কুচকে তাকালো।চুপচাপ থাকার মাঝেই আবার অপর পাশের ব্যাক্তিটা বলে উঠলো,

‘ এইমাত্রই তো কাঁটা কাঁটা গলায় স্পষ্ট কথা বললেন। এখন আবার চুপ?’

আদ্রিতা চোখ বড় বড় করে তাকালো।কিছুটা সময় চুপ থেকে মৃদু গলায় বললো,

‘ আদ্রিতা মাহমুদ।’

কথাটা বলেই গাড়ির জানালার বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলো রৌদ্রকে।কপালে চিন্তার ভাজ।মুখে হতাশা স্পষ্ট।এদিকটায় একপ্রকার দৌড়েই আসছে সে।এদিক ওদিক বিভ্রন্তভরা চোখে তাকিয়ে বোনকে খুঁজছে।লোকগুলোতো বললো এখানেই এক্সিডেন্ট হয়েছে কিছু সময় আগে।তাহলে?কোথায় তার বোন?মুখে চিন্তার চাপটা আরো ঘন হলো।মাথার চুলগুলো এলেমেলো।চোখজোড়া লালচে হয়ে আছে।নিজের ভাইকে এমন পাগলাটেভাবে আর কখনোই দেখে নি আদ্রিতা।ভাইয়ের এহেন মুখ দেখে কলিজায় মোচড় দিলো।অস্ফুট সুরে জোরে বলে উঠলো,

‘ ভাইয়া।’

রৌদ্র শব্দটাকে অনুসরন করে সেদিক ফিরে চাইলো।তার আদি বুড়িকে জানালায় মুখ বাড়িয়ে তাকাতেই দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।এলেমেলো পায়ে বোনের কাছে এগিয়ে এসেই বোনের মুখে হাত জোড়া আলতো ভাবে রেখে বলে উঠলো,

‘ তুই ঠিক আছিস তো আদি বুড়ি?’

‘ আমার পা শেষ ভাইয়া।আমি তো হাঁটতে পারছি না।কী হবে?আমি কী সারাজীবন এভাবে বসে থাকবে?’

আদ্রিতার বাচ্চামো কথায় হেসে উঠলো রৌদ্র। সামনের সিটে বসে থাকা নিরবও মুচকি হাসলো।মেয়েটা সত্যিই বাচ্চা। রৌদ্র কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কীভাবে হলো এসব?এইজন্যই বেশি পাকামো করতে নিষেধ করি।তোর ইচ্ছেমতো চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিস ঠিকাছে।হোস্টেলে থাক আমার প্রবলেম নাই।কিন্তু এভাবে দিন রাত হার্টের রোগীর মতো বুকে ব্যাথা উঠিয়ে দিলে তো আমার বউটা বিধবা হয়ে যাবে আদি বুড়ি।’

‘ তোর বউ বিধবা হবে না।তুই বিধবা হবি। বেচারি বিয়ের পর তোর জ্বালাতেই মরে যাবে। ‘

‘ হোস্টেলে এসে এসব শিখেছিস?ভাইকে বিধবা বলছিস?’

‘ ভালো করেছি।’

আদ্রিতা একটা জিনিস খেয়াল করলো ভাইয়ের সাথে কথা বলতেই ব্যাথাটা কয়েক মুহুর্তের জন্য অনুভবই হলো না তার।রৌদ্র এতোক্ষণ বোনের সাথেই কথা বলতে মগ্ন ছিলো।হঠাৎ গাড়ির সামনের সিটে বসে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে নিলো।তার বোন যে অন্য কারো গাড়িতে বসে আছে সেটাও বুঝতে পারলো।বাস থেকে নেমে যা শুনেছে তাতে এটাই বুঝেছে কালো রংয়ের একটা গাড়ি তার বোনের রিক্সাকে ধাক্কা দিয়েছে।গাড়িটার মালিকের মুখে মাস্ক চোখে চশমা।গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রৌদ্রের আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছু্। আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ একটু বস।আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে তে তোকে।’

রৌদ্র কথাটা বলে দু পা বাড়াতেই সামনে দাঁড়ালো অচেনা লোকটি।রৌদ্রের ইচ্ছে হলো কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিক লোকটা মাস্কে ডাকা গালে।কিন্তু সে তেমন কিছু করলো না।চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর চাহনীতে তাকাতেই নিরব বলে উঠলো,

‘ আপনারা আমার গাড়িতেই যেতে পারেন।আমি এতোক্ষন আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম।আপনার বোনকে হসপিটাল নিয়ে যাওয়া জরুরি কার গাড়িতে যাচ্ছেন সেটা নয়।’

রৌদ্রের রক্তিম চোখজোড়া লোকটার দিকে আবারো কঠোর দৃষ্টি ফেললো।লোকটার অদ্ভুত সাঁজ তাকে ভাবালো। থমথমে মুখে লোকটির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

‘ ইউ!আশি লাখ টাকার একটা গাড়ি আছে বলে কী পুরো পৃথিবী কিনে নিয়েছেন নাকি? গাড়ি চালানোর সময় হুশ থাকে কোথায়?ওহ নো!আপনি যে ভয়ে তটস্থ হয়ে আছেন তা তো বোঝাই যাচ্ছে।’

নিরব মৃদু হাসলো।সে খুব ভালোভাবেই ব্যাপারটাকে সমাধান করতে পারবে বলে তার বিশ্বাস।চোখের কালো সানগ্লাসটা খুলে হাতে নিয়ে গভীর নিঃশ্বাস পেললো। তারপর খুব সুন্দরভাবেই উপস্থাপন করলো বিষয়টাকে।যে উপস্থাপনে রৌদ্রের এক ফোঁটা অভিযোগকে ও খুবই বুদ্ধিমত্তার সাথে সরিয়ে দিলো সে।পুরো বিষয়টা বলে নিয়ে চোখে সানগ্লাসটা আবার পরে নিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। ততক্ষনে তার সামনে এসে দাঁড়ালো হোয়াইট কালারের একটা।গাড়িতে থাকা ড্রাইভারকে নামতে ইশারা দিয়েই গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো সে।রৌদ্রকে একবার দেখে নিয়ে মৃদু হাসলো।তারপর নিজের সিল্কি চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে নিয়ে বলে উঠলো,

‘ আপনাদের কে আমার ড্রাইভার হসপিটাল পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।হসপিটালে আমি যোগাযোগ করে নেবো।আপনারা শুধু গিয়ে ট্রিটমেন্ট করাবেন।গুড বাই মিঃ মাহুমুদ?রাইট?’

রৌদ্র ভ্রু জোড়া কুচকে নিলো।সামনের লোকটি কী করে জানে তার টাইটেল মাহমুদ?লোকটা কী তাকে চেনে নাকি?রৌদ্র উত্তর পেলো না।মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘ আপনি কীভাবে জানলেন মাহমু…’

রৌদ্রের কথাটা থামিয়ে নিয়ে নিরব বলে উঠলো,

‘ আমি আপনার নাম জানি না।বাট আপনার বোন বললো ওর নাম আদ্রিতা মাহুমুদ।সেই সূত্রেই আন্দাজ করা।’

রৌদ্র হাসলো।কপালে আসা ঘাম গুলো ডান হাতের উল্টো তালুতে মুঁছে নিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আপনার নাম?’

‘ সেটা না হয় পরে জানা যাবে মিঃ মাহমুদ!চলি।’

নিরব হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালো।তারপর পাশে থাকা গাড়িটায় উঠে বসলো।সিট বেল্ট ঠিক করে নিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

‘ উনাদের হসপিটালে পৌঁছে দিও।’

ভার্সিটির ক্যান্টিনে একটা টেবিলেই বসে আছে প্রিয়া, জেনি, মেহু, বিনয়,রিয়াদ আর অভ্র।নিজেদের মধ্যে হাসি, মজা,খুনসুটির আড্ডা জমে উঠেছে।সকালে ঠান্ডা ভাবটা দুপুরে এসেই তীব্র গরমে রূপ নিয়েছে।গরমে নাজেহাল অবস্থায়ও গল্পের আমেজ তাদের কমছে না।ঘামে চুপসে থাকলে ও কারো মুখে নেই বিরক্তির চাপ।কেউ মোবাইল ঘাটতে ব্যস্ত তো কেউ খেতে ব্যস্ত।তবুও তাদের আড্ডা চলছে।ক্যান্টিনের ভ্যাপসা গরমে ও অভ্রের হাতে গরম কফির মগ।বিনয় আর জেনির হাতে বার্গার। মেহু একপাশে চুপচাপ বসে আছে।সবার রসালো কথাগুলো শুনে মাঝেমধ্যেই উত্তর দিচ্ছে।শ্যামলা মুখে ঘাম জমেছে।সে ঘামে লেপ্টে পড়েছে কিছু অবাধ্য চুল।প্রিয়া মোবাইলে প্রেমিকের সাথে চ্যাট করতে ব্যস্ত।তার মতে প্রেমিককে সবসময় সময় দেওয়া উচিত।প্রেমিকের সাথে আজ বাদে কাল যে ব্রেকাপ হয়ে যাবে না তার কী গ্যারান্টি?তার চেয়ে জুটিয়ে প্রেম করে নিক।রিয়াদের এক হাতে কিছু নোটস।এইমাত্রই মেহুর থেকে নিয়েছে।অন্য হাত দিয়ে খেতে ব্যস্ত।হাসি খুশি জমালো আড্ডার মাঝেই তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো একজন। সে এই ভার্সিটিরই সিনিয়র ভাই।আড্ডার মূলকেন্দ্র থেকে সবার নজর ছিটকে তার কাছে গেলো।ছেলেটি গমগমে কন্ঠে মেহুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘ মোহনা ভৌমিক তুমিই তো?’

মেহু এদিক ওদিক তাকালো। বোকা বোকা চাহনিতে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

‘ হ্যাঁ,কিছু বলবেন ভাইয়া?’

‘ হ্যাঁ।কিছু প্রয়োজনীয় কথা ছিলো।মাঠে গিয়ে বলি?একটু সময় হবে?’

মেহু ভ্রু জোড়া কুচকে এক পলক তাকালো। নিজের ব্যাগটা টেবিল থেকে নিয়ে ওড়নাটা ঠিক করে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। অভ্র ব্যাতীত বাকি সবাই তাদের যাওয়ার পথে এক নজর তাকিয়ে ভ্রু কুচকে নিলো।মেহুর কিছুটা সামনে ছেলেটাকে পুরো স্ক্যান করে নিলো কয়েক সেকেন্ডেই।ছেলেটার হাঁটার ধরণ, মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল পরণের শার্ট হতে পায়ের জুতোটাও। নিজের পাশে সবকটাকে এভাবে অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হলো অভ্র। চেয়ারে হেলান দেওয়া গিটারটাকে সোজা করে ঠিক করে রেখে নিজের মুখের খোচা দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলো,

‘ ওদিকে কী কোন দেশের প্রধাণমন্ত্রীর আগমণ ঘটেছে নাকি রে?’

অভ্রের কথাটা শুনেই সবার নজর সেদিক থেকে ফিরলো।কথাটা মাটি ছোঁয়ার আগেই প্রিয়া সন্দিহান গলায় বলে উঠলো,

‘ আমি নিশ্চিত এই ছেলের সাথে মেহুর প্রেম চলছে।’

জেনি বিরক্তিতে মুখ চোখ কুচকে নিলো।রিয়াদ আর বিনয় হেসে উঠলো।অভ্রের মুখে কোন ভাবাবেগ দেখা গেলো না। সে কথাটা যেন শুনলোই না।মেহু সম্পর্কিত কোন কথা তার কানে প্রবেশ না করায় যেন উত্তম।অভ্র আগের মতোই কফির মগে চুমুক দিয়ে কফি খাওয়াতে মনোযোগী।মোবাইলটা হাতে নিয়ে মনে মনে ভাবলো মেয়েটা চলে গেছে ভালো হয়েছে।অসহ্যকর বস্তু গুলো চোখের সামনে না থাকায় শ্রেয়।অভ্রকে নির্বিকার দেখে জেনি বলে উঠলো,

‘ অভ্র তুই এমন কেন?’

অভ্র মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে মাথা তুলে জেনির দিকে তাকালো।দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘ যেমন?’

‘ শক্তপোক্ত!আর মেহুর ক্ষেত্রে তো বোধ হয় পুরো একটা রোবট।ও এভাবে একটা ছেলের সাথে চলে গেলো আমাদের সবাইকে তা ভাবাচ্ছে।অথচ তুই?ভাবশূণ্যহীন ভাবে বসে আছিস!’

অভ্র ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে মৃদু হাসলো।ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে গিটারটা কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।মোবাইলটা প্যান্টের ডান পাশের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে নিঃশ্বাস নিলো।টেবিলের ওপর থাকা পানির বোতলটা হাতে নিয়ে অর্ধেক শেষ করে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,

‘ জেনি?তোর চিন্তাভাবনা চমৎকার।তবে কী বলতো? অভ্র রায় কখনো এসব থার্ডক্লাস বিষয় নিয়ে ভাবে না।তাতে তোদের কাছে হলাম না হয় শক্তপোক্ত!’

অভ্র উঠে চলে গেলো।জেনি কেন, তাদের বন্ধুমহলের কেউই কখনো অভ্রকে বুঝে উঠতে পারে না শুধুমাত্র অয়ন্তী বাদে।অয়ন্তীর সাথে অভ্রের বন্ধুত্বটা সে হাই স্কুল জীবন থেকে।সেই সুবাদেই হয়তো অয়ন্তী অভ্রকে বাকি সবার থেকে একটু বেশিই বুঝে।অভ্র কখনো কখনো খুবই খোলামেলা।কখনো আবার গম্ভীর।আর মেহুকে তো কখনোই সহ্য করতে পারে না।কেন?মেহুকে ও ফ্রেন্ড হিসেবে মেনে নেয় না কেন?মেহুকে ওর সমান মনে করে না কেন?এসবের উত্তর ওদের বন্ধুমহলের কারো কাছেই নেই।জেনি দীর্ঘশ্বাস পেলে চশমাটা ঠিক করে আবারো আড্ডায় মশগুল হলো।

ভার্সিটির লম্বাটে বারান্দার একপাশ দিয়ে গিটারটা কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অবাধ্য চোখজোড়া হঠাৎ এই দৃষ্টি ফেললো মাঠের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামবর্ণের মেয়েটির দিকে।দুপুরের কাঠফাঁটা রোদ মেয়েটির শ্যামলা মুখশ্রীকে আরো কালো বানিয়ে তুললো।হলুদ রংয়ের ঢিলেঢোলা সালোয়ার কামিজটায় তাকে অতোটাও সুন্দর লাগছে না অভ্রের চোখে।তাকে অভ্রের চোখে কখনো সুন্দর লেগেছিলো?অভ্রের মস্তিষ্ক অভ্রকে প্রশ্নটা ছুড়ে মারতেই তার শক্তপোক্ত মন কী ভেবেই উত্তর দিলো,

‘ হ্যাঁ।কোন এক সময় এই শ্যামলা মেয়েটিকে তার কাছে অপরূপ মনে হয়েছিলো।কিন্তু এখন আর মনে হয় না।’

অভ্রের মস্তিষ্ক পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো,

‘ কখন?’

অভ্রের মন উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত হলো।তারপর সেই সময়টির কথা মনে পড়তেই চোখজোড়া রক্তিম হয়ে উঠলো।মুখের চোয়াল হয়ে উঠলো শক্ত।হাতের মুঠোজোড়া কঠিন হলো।এদিক ওদিক তাকিয়েই পা বাড়ালো।সাথে সাথে তার মস্তিষ্ক বলতে লাগলো,

‘ না। মেহুকে তার কখনোই সুন্দর মনে হয় নি।কখনোই না।এমন মেয়ে সুন্দর হয় নাকি কারো কাছে?থার্ড ক্লাস টাইপের মেয়ে।সে আর যার কাছেই সুন্দর হোক কখনোই অভ্রের কাছে সুন্দর ছিলো না, হবে ও না।’

আজ প্রায় এক সপ্তাহ অয়ন্তী ভার্সিটিতে যায় নি।ইচ্ছে করেই যায় নি।ভার্সিটির কথা মনে উঠতেই সেই অজানা ভয় মনের মধ্যে চেপে বসে।সেই অস্বস্তিকর মুহূর্তটা।সেই গরম নিঃশ্বাসের উপছে পড়া অনুভূতি।সেই কপালের বিচরণকারী ঠোঁটজোড়ার স্পর্শও। হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে সেদিনের ঘটনাটা মনে করতেই লোমগুলো কেঁপে উঠলো অয়ন্তীর।হসপিটালের গমগমে পরিবেশে আরোও বেশি চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।মনের মধ্যে বোনের জন্য অজানা ভয় ভর করেছে। বারান্দার চেয়ারে বসে আছে তার বাবা, মা, তোর বোনের শ্বশুড় বাড়ির দুইজন।অবন্তীর সাথে ছোটবেলা থেকে তেমন মেলামেশা হয়ে উঠেনি অয়ন্তীর।অবন্তীর যখন তেরো বছর বয়স তখনই অয়ন্তীর জন্ম।অবন্তী তখন ক্লাস এইটে।তারপর দু এক বছর কেঁটেছিলো বোনের সাথে।এর পরই কলেজ জীবন থেকে সে হোস্টেলে।অবন্তী বরাবরই ভালো স্টুডেন্ট।তাই বাবা মাও মেয়ের পড়ালেখার জন্য হোস্টেলে থাকতে না করে নি।তারপর অনার্স কমপ্লিট করতেই বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি।অয়ন্তীর সাথে মেলামেশা বলতে কলেজের ছুটিতে বাড়ি আসা এটুকুই।তবুও তাদের মধ্যে একটা বন্ধু বন্ধু ভাব আছে।বোনের সম্পর্কটা গড়ে উঠার আগে তাদের বন্ধুর সম্পর্কটাই প্রথমে গড়ে উঠেছে।অয়ন্তী পেছন ফিরতেই অবন্তীর আট বছরের মেয়েটা এগিয়ে এলো।অয়ন্তীর কাছাকাছি এসেই বলে উঠলো,

‘ আন্টি আমি পানি খাবো।’

অয়ন্তী সরু চোখে তাকালো।অয়ন্তী ওর হাতটা ধরে এগুতে নিলেই ও হেসে উঠলো।উৎফুল্ল চাহনিতে বলে উঠলো,

‘ আমি খুব খুশি আন্টি।আমার ভাই হবে।ও আমার সাথে খেলবে।খুব মজা হবে তাই না আন্টি?’

অয়ন্তী মৃদু হেসে বললো,

‘ হ্যাঁ। খুব মজা হবে।ভাইকে দেখে নিয়ে তুমি আর আমি নানুর বাসায় যাবো কেমন?তারপর তোমাদের বাসায় গিয়ে তোমার জামাকাপড় নিয়ে আবার চলে আসবো। তখন কিন্তু হসপিটালে থাকবে বলে জেদ করবে না।’

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here