স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি সিজন 2 #নিবেদন। (পর্ব-১)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি সিজন 2
#নিবেদন। (পর্ব-১)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

একা হাতে বিশজনের নাস্তা বানানোর পর যখন মুশরাফার হাত অবশ হবার জোগাড়, ঠিক সেই ক্ষণে শ্বাশুড়ি এসে বললেন, ‘ এখনো শেষ হয়নি? এতক্ষণ লাগে এ কয়টা রুটি বানাতে!’

রুটির সংখ্যাটা পঞ্চাশ পেরিয়েছে। তাও এই কয়টা!
সচেতনভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুশরাফা। বিয়ের মাস ছয়েক হলেও শ্বাশুড়ির মন পাওয়ার সৌভাগ্য এখনো হয়ে উঠেনি তার। সারাদিন কাজ করলেও নাম নেই। ধীর স্বরেই বলল,
‘এই তো হয়ে যাচ্ছে।’

মায়মুনা পা বাড়িয়ে বললেন,
‘নাস্তা হয়ে গেলে দুপুরের রান্না বসিয়ে দিবে।’

শ্বাশুড়ি যাবার পরেই কাকন এসে ডুকল রান্নাঘরে। সম্পর্কে মুশরাফার জা। এসে দুপুরের রান্নার ১০টা মেন্যু বলে চলে গেল। পোলাও, ভাত, ভর্তা, সরষে ইলিশ চিংড়ির মালাইকারী, চিকেন রেজালা, আরও কত কী?একটাবার জানতে চাইল না, এই রান্না মুশরাফা পারে কি না বা পারবে কি না। ভাবখানা এমন যেন হুকুম দেয়াই ওর কাজ। অথচ তার পরিবারের আপ্যায়নের আয়োজন চলছে। কাল মাঝরাতে দেশের বাড়ি থেকে ফিরতি পথে পুরো পরিবার এসে উঠেছে এখানে।
শ্বাশুড়ির দলভুক্ত কাকন জায়ের কাধে রান্নার দায়িত্ব চাপিয়ে পায়ে পা তুলে ভাইবোনদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। নিজেকে কাজের মেয়ের ভূমিকায় দেখে ও নিরবতার চাদর সরল না মুশরাফার গা থেকে। আর যাই হোক অভিযোগ করা হয়ে উঠে না ওর জন্য।

ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। নাস্তা বানিয়ে বিছানায় গা এলানোর তীব্র ইচ্ছে থাকলেও ইচ্ছেটা জলাঞ্জলি দিতে হলো। নাস্তার বানিয়ে টেবিলে সাজানোর পর আবার ছুটল রান্নাঘরে। উপোস পেটেই কড়াইয়ে খুন্তি নাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ছুটির দিনে ঘুমের রেশ বেলা করেই কাটে জাওয়াদের। আজ ও ব্যতিক্রম হলো না। চোখ থেকে যখন ঘুম ছুটল তখন ঘড়ির কাটায় বেলা এগারোটা। ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই মায়মুনা এক গাল হেসে বললেন,
‘উঠে গেছিস? আয় নাস্তা করবি।’

চেয়ার টেনে বসতে বসতে আশপাশ চোখ বুলাল জাওয়াদ। তারপর বলল, ‘তুমি নাস্তা করেছো, মা? ‘
‘হ্যাঁ।’
জাওয়াদ রান্নাঘরের দিকে চোখ ফেলল একবার। তারপর বলল, ‘সবাই নাস্তা করেছে? ‘
‘শুধু তুই বাকি আছিস।’
রুটি রাখা হটপট এগিয়ে দিলেন ছেলের দিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নাস্তা করতে বসল জাওয়াদ। খেতে খেতে বলল,
‘বুয়া আসেনি আজ?’
‘এই বুয়াটা ফাঁকিবাজ। একদিন এলে দুইদিন আসে না। আজও আসল না।’ রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো মায়মুনার স্বরে।

বসার ঘর থেকে কাকন আর তার ভাইবোনরের হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। সেই শব্দে কানে ভাজতেই বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে এলো জাওয়াদের। খাওয়া শেষ করে উঠে বলল,
‘কী গরম পড়ছে! ফ্রিজে ঠান্ডা পানি আছে না?’

মা সায় জানাতেই নিজের এঁটো বাসন হাতে নিয়ে এগুলো রান্নাঘরের দিকে। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ বুলাল ভেতরটায়। চুলোর কাছে দাঁড়ানো কড়াইয়ে খুন্তি নাড়ছে মুশরাফা। মসলা কসানোর ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে চারপাশ। ঘামে ভেজা সারামুখ, চোখের কোণে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুজল। নাক টানছে খানিক পরপর। মেয়েটা কাঁদছে! জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। সিঙ্কের উপর এঁটো প্লেট রাখতে রাখতে বলল,
‘ মা কিছু বলেছে?’

কাজে মগ্ন মুশরাফা এতক্ষণে স্বামীর উপস্থিতি টের পেল। তড়িঘড়ি আঁচলে চোখ মুছে বলল, ‘ নাহ, পেঁয়াজ কা/টছিলাম।’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল এক পলক। তারপর ফ্রিজের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আশপাশ কী যেন খুঁজল। চর্পিং বোর্ডে পেয়াজ কা’টা দেখে নিয়ে ভ্রু নাড়াল। ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে বলল,
‘নাস্তা করেছো?’

মুশরাফা একপলক তাকাল। পরপরেই চোখ ঘুরাল, ঘুরাল প্রসঙ্গ ও,
‘এসেছেন ভালো হয়েছে। যা গরম পড়ছে। ঠান্ডা কিছু না হলেই নয়। আমি আইসক্রিম সার্ভ করে দিচ্ছি। আপনি ট্রে গুলো বসার ঘরে রেখে আসবেন?’

জাওয়াদ উত্তরটা মুখে দিল না, চোখে দিল। কেমন অগ্নিচোখে তাকাল। পরপরেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। সেই দৃষ্টি বুঝে ও সুকৌশলে উপেক্ষা করে রান্নায় মনোযোগ দিল মুশরাফা। খানিক বাদে একটা প্লেট হাতে ফিরল জাওয়াদ। শব্দ করে মুশরাফার সামনে রাখল। রাগরাগ নিয়ে তাকিয়ে বলল,
‘গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথায় চটপট করলে আমার রুমে তোমার জায়গা হবে না, মনে রেখো।’

তারপর ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম নিয়ে চলে গেল। প্লেটের মাঝে পরোটায় চোখ বুলানোর সময় মুশরাফার ঠোঁটের কোণে হাসিটা কখন যে এসে হাজির হয়েছে সে নিজেই টের পেল না।

আইসক্রিমের ট্রে টা বসার ঘরে নিয়ে যেতেই কাকন ঠাট্টার স্বরে বলল,
‘বাহ্! আজ দেখি আমার দেবরজি ও কাজ করছে!’

ট্রে টা টেবিলে রেখে ঠাট্টার চেইন টেনে জাওয়াদ বলল,
‘ভাবিদের দায়িত্বজ্ঞানের পাল্লা নিচে নামলে দেবরদের দায়িত্বের পাল্লা উপরে উঠাতে হয় বোধহয়। না হয় পাল্লাটা একদিকেই হেলে পড়ে। ‘

কাকন বুঝল না বা বুঝতে চাইল না। হেসেই উড়িয়ে দিল, ‘একদিনের জন্য ওমন এক আধটু হেলে পড়লে কিছু হয়না।’

জাওয়াদ আর কিছু বলল না। কাকনের ভাই কিরণ বলল,
‘ভাই ভাবির সাথে তো পরিচয় করিয়ে দিলেন না।’

জাওয়াদ নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে বলল, ‘ও পর্দা করে তো। তাই সামনে আসবে না। ‘

ডাইনিং টেবিলে কাকনের মা স্বপ্না আর মায়মুনা আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করছেন। বেয়ানের আগমনের খবর শুনে পাশের বাসার সারমিন ভাবি এসেছেন। তিন নারীর আড্ডা জমেছে বেশ।
জাওয়াদ বসার ঘর পেরিয়ে যাবার সময় স্বপ্না ডাকলেন,
‘জাওয়াদ, তোমার শ্বশুর বাড়ি কোথায় যেন?’

জাওয়াদকে বিভ্রান্ত দেখাল। বিয়ের ছ’মাসে ও শ্বশুরবাড়িতে পা রাখা হয়নি। ও তো জানেই না ওর শ্বশুরবাড়ি ঠিক কোন জায়গায়। অবশ্য জানার ইচ্ছেটাও নেই। এ প্রসঙ্গ আসতেই চেহারায় রাগ ছেঁয়ে গেল। ওর নিরবতায় সন্দেহের চোখে তাকালেন সারমিন। বাঁকা স্বরে বললেন,
‘ এই বেয়ানের সাথে আলাপ হলে ও তোমার শ্বাশুড়ির সাথে আলাপ হয়নি আমার। বিয়ের এতদিনে ও আসতে দেখলাম না। কোন সমস্যা না কি জাওয়াদ?’

জাওয়াদ হেসে বলল, ‘কোন সমস্যা নেই। ‘

স্বপ্না বললেন, ‘কোন সমস্যা না বলে আজ লাঞ্চে ডাকো। আলাপ করি।’

‘শ্বাশুড়ি’ নামক মানুষটার প্রতি এত ঘৃণা জন্মেছে যে তার জন্য বাহানা দিতেও রুচিতে বাধছে জাওয়াদের। সে নিজেই চাইছেনা ওই মহিলা তার সামনে আসুক, মুশরাফার মুখোমুখি হোক। আবার মুশরাফা কষ্টের ভাগিদার হোক। জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল,
‘অন্য একদিন।’

বলেই পাশ কাটল। রুমে যেতে গিয়ে ও থেমে গেল। ডাইনিং রুম আর কিচেন পাশাপাশি। কথাগুলো দেয়াল বেয়ে ওপাশে গেছে নিশ্চয়ই। এই কথা গুলো মুশরাফার কান এফোঁড়ওফোঁড় যে করেছে তাও নিশ্চিত। আজ সারাদিন কাঁদবে মেয়েটা। জাওয়াদ রান্নাঘরে উঁকি দিল। তার ধারণাই ঠিক, এবার পেঁয়াজের ঝাঁজে নয়, বিষাদের ঝাঁজে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে তার। মা না কি ভালোবাসা দেয়, অথচ মুশরাফার মা দিয়েছে আঘাত। সেই আঘাত জর্জরিত ওর সারা ঘা, ভাজে ভাজে কালসিটে দাগ। যে দাগে চোখ রাখলে মায়ের সংজ্ঞা মিথ্যা মনে হয়।
জীবনটা নরক বানিয়ে দেয়া মায়ের স্মরণে এই মেয়ের কান্না কিভাবে আসে ভেবে পায়না জাওয়াদ। সে খুব করে চাইল গিয়ে চোখ মুছে দিতে। বুকে টেনে বলতে, কেঁদো না, তোমার কান্না আমার বুকে বিধে। কেউ না থাকলেও আমি আছি তোমার পাশে। তুমি একবার ওই মহিলাকে ভোলার চেষ্টা করো। তোমার জীবন থেকে ওকে সরিয়ে দাও, তারপর আমি উনাকে আর তোমার জীবনে আসতে দিব না। তোমাকে আড়াল করে তোমার হয়ে লড়াই করব তোমার সাথে। আঁচ লাগতে দিব না তোমাকে।

কিন্তু পারল না। কিসের যেন জড়তা এসে বাধা দিল ওকে। আসোলে বাস্তবে ওমন সংলাপ ছাড়া যায়না। বাস্তবতায় অনুভূতিগুলো গোপনই সুন্দর, আর আড়ালে আবডালে প্রকাশ করাই যথার্থ। জাওয়াদ ফিরে গেল।

খানিক বাদেই হাঁক ছাড়ল, ‘রাফা, রাফা? আমার আয়রন করা পাঞ্জাবিগুলো কোথায় রেখেছো? খুঁজে পাচ্ছি না। এসে খুঁজে দিয়ে যাও।’

চলবে…

বিঃদ্রঃ এটা ‘স্বর্ণাভ সুখানুভূতি’ গল্পের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। কাহিনি এবং চরিত্র আগের মতো এগুবে। এই পরিচ্ছেদের প্রধান চরিত্রের স্থান এবং দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে বলেই নামটা পরিবর্তন করা হয়েছে। গঠনমূলক মন্তব্যের মাধ্যমে পাশে থাকবেন।
জাযাকুমুল্লাহু খায়রান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here