স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি সিজন 2 #নিবেদন। (পর্ব-২)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি সিজন 2
#নিবেদন। (পর্ব-২)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

দূরের মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। সুমধুর স্বরে রবের সান্নিধ্যে যাবার আহ্বান করছে মুয়াজ্জিন। জাওয়াদ দরজা অবধি গিয়ে ফিরে এলো। ডাক গুলো গলাতেই আটকে গেছে। আজানের সময় অতি প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলা, মনোযোগ দিয়ে আজান শোনা সুন্নত, আজানের জবাব দেয়া মুস্তাহাব কাজ। দু’দিন আগে মুশরাফাই শিখিয়েছে ওকে। ইসলামের সাথে নতুনভাবে পরিচিত হওয়া জাওয়াদ আজকাল খুব করে চেষ্টা করে ইসলামের বিধিনিষেধ মেনে চলার। জাওয়াদ খাটে নিশ্চুপ বসে মনোযোগ দিয়ে আজান শুনল, জবাব দিল। আজানের দোয়া পড়ল আল্লা-হুম্মা রাববা হা-জিহিদ দাওয়াতিত তা-ম্মাতি….
আজানের পরবর্তী সময়টা প্রার্থনা কবুলের সময়। চিন্তিত মনে যার ছবি ভাসল তাকেই দোয়ায় রাখল জাওয়াদ। পরপরেই রুম ছাড়ল। বসার ঘরের সামনে কাকনকে পেয়ে বলল,
‘ভাবি, আপনার জা কে ডেকে দিন তো! ‘
‘কেনো?’
‘ওকে আমার লাগবে।’
‘জা তো কাজ করছে। আসতে পারবে না। ‘
‘আপনার বোধহয় কিচেনে গিয়ে ও সময় কাটানো উচিত। আপনার পরিবারের টেস্ট রাফা বুঝবেনা। আপনি গিয়ে ওকে পাঠিয়ে দিন। আমার নামাজে দেরি হচ্ছে। ‘

সেই ক্ষণে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো মুশরাফা।
‘কিছু লাগবে?’
‘আমার নীল পাঞ্জাবিটা আয়রন করা নেই। আয়রন করে দাও। আমার নামাজে দেরি হচ্ছে।

‘ রান্না…

ওকে থামিয়ে দিল জাওয়াদ। মুশরাফার চেহারায় ক্লান্তভাব থাকলেও কান্নাভাবের রেখা মুছে গেছে। অনেকটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে তাকে। মুশরাফার নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার দিক দেখে । জাওয়াদ মনে মনে অবাকই হলো। চোখ সরিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
‘আমি গোসলে যাচ্ছি। এসে যেন পাঞ্জাবি আয়রন দেখি। ‘
জাওয়াদকে কেমন কঠোর লাগল। কাকন বলল,
‘তুমি যাও, ও কী বলে দেখো। আমি রান্না দেখছি।’

জাওয়াদ রুমে চলে গেছে। অনুসরণ করল মুশরাফাও। দুমড়ানো মোচড়ানো পাঞ্জাবির স্তুপে নীল পাঞ্জাবিটা বিছানায় উপর অবহেলায় পড়তে থাকতে দেখা গেল। সযত্নে তুলে আয়রন মেশিন নিয়ে বসল মুশরাফা। সকালে অতগুলো রুটি বেলতে গিয়ে হাতের তালুতে ফোসকা পড়ে গেছে। চাপ দিয়ে আয়রন মেশিন ধরার সময় জ্বালা করে উঠল, তীব্র যন্ত্রণার সাথে একটা বোধহয় গলে ও গেল। কপাল কুঁচকে এলো, মনে এলো রবের স্মরণ। সেই স্মরণের সাথেই কাজ এগিয়ে নিল মুশরাফা।

কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা ধরে আড়চোখে স্ত্রীর কাজ দেখল জাওয়াদ। দরজা অবধি গিয়ে ফিরে এলো। মুশরাফা থেকে আয়রন মেশিন নিয়ে আফসোসের সুরে বলল,
‘ এত বড় মেয়ে হয়েও আয়রনটা করতে পারো না। ব্যাপারটা দুঃখজনক। আমার পছন্দের পাঞ্জাবিটা নষ্ট করে ফেলবে। তোমাকে বলার শখ মিটে গেছে। আমিই করছি।’

রান্নাঘরে যাবার উদ্দেশ্যে উঠতে ধরল মুশরাফা। জাওয়াদ বলল, ‘পাঞ্জাবিগুলো ভাজ করে রাখো।’

রান্নাঘরের অত কাজ ফেলে এখন কাপড় ভাজ করার সময়! কপালে বিরক্তির ভাজ পেলে মুশরাফা পাঞ্জাবির স্তুপের পাশে বসল। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। ক্লান্ত শরীরে বাতাস ছুঁতেই আবেশে চোখ বুজে এলো। ভেঙেচুরে আসা শরীরটা বিছানায় এলিয়ে ঘুমোনোর ইচ্ছেটা প্রবল হলো। ক্লান্তির বহরে বাতাসের বেগ বেড়ে যাওয়াটা চোখে পড়ল না ওর।

খানিক বাদে চোখ খুলে পাঞ্জাবি ভাজ করতে শুরু করল। হাতের জ্বালা বাড়ছে। সময় করে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে নিতে হবে। মুশরাফা বিড়বিড় করে সুরা ফাতিহা পড়ল। সুরা ফাতিহাতে বলা হয়, ‘সূরায়ে শিফা।’ অর্থ্যাৎ রোগমুক্তির সূরা। রাসূল (সাঃ) একে ‘রুকাইয়্যা’ বলেছেন। একনিষ্ঠ মনে, শুদ্ধ নিয়তে এটি পড়ে ফুঁ দিলে, বা পানি খেলে উপকার পাওয়া যায়। মুশরাফা সুরা ফাতিহা পড়ে তিনবার ফুঁ দিল।

জাওয়াদের পাঞ্জাবি আয়রন করা ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা ধরল। আকস্মিক কী ভেবে মুশরাফা বলল,
‘ আমার পরিবার নিয়ে আপনার মনে প্রশ্ন জাগে না?’

জাওয়াদ থামল, থমকাল। চকিতে চাইল। পরপরেই চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘না।’
‘কেন!’ বিস্ময়মিশ্রিত স্বরের প্রশ্ন মুশরাফার। সেই ‘কেন’ উত্তর দিল না জাওয়াদ। বলল,
‘ এখানে থাকো, কথা আছে। আমি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে যেন তোমাকে এখানে পাই। ‘

ওয়াশরুমের দরজা দিল জাওয়াদ। মুশরাফা ভ্রু কুঁচকাল। লোকটা এড়িয়ে গেল কেন? সে কি জানে সব! আর কী কথা বলবে?
কপালে চিন্তার ভাজ পেলে ভাবতে বসল মুশরাফা।

জাওয়াদ বেরোতেই বলল, ‘ কী কথা বলুন এবার।’

‘গোসল করে আসো, তারপর বলছি।’
‘রান্নাঘরে অনেক কাজ তো, সব সেরে তারপর গোসলে ডুকব। আপনি বলুন কী কথা?’

‘ বাকিটা ভাবি ম্যানেজ করবে। তুমি গোসল সেরে আসো, তারপর বলব।’
‘এখন বললে কী সমস্যা!’
‘এত কথা বলো কেন! যেতে বলছি যাবে।’ আবার কঠোর হলো জাওয়াদ। ওর রাগের সামনে মুশরাফা দ্বিরুক্তি করার সাহস পেল না। উঠে গোসলে ঢুকল। দরজা বন্ধের শব্দটা কর্ণকুহরে পৌঁছতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ঝরল জাওয়াদের। খোশমেজাজে বের হলো নামাজের উদ্দেশ্যে।

‘মুশরাফা, তুমি ও এসে বসে যাও। সবাই একসাথে খাই।’ টেবিলে খাবার সার্ভ করার সময় সৌজন্যবোধে বললেন স্বপ্না। মুশরাফা চিংড়ির বাটিটা রেখে বিনীত স্বরে বলল,
‘আপনারা বসে যান, আমি পরে খেয়ে নিব।’

স্বপ্না জোর করলেন, ‘আরে আসো।’
মুশরাফা উত্তর দেবার আগেই কাকনের ভাই কিরণের কথা শোনা গেল। এদিকে আসছে সে। মুশরাফা উত্তর না দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। মায়মুনা বললেন, ‘বেয়ান, আপনি বসে যান। ও পরে খাবে।’

একটা মানুষকে অপছন্দের জায়গা থেকে হুটহাট পছন্দের জায়গায় আনা যায় না। খারাপ ব্যবহার করায় অভ্যস্ত হওয়া থেকে হুটহাট ভালো ব্যবহার আসে না। ভালোর সাথে ভালো হতে ও সময় লাগে। বাস্তবতার ধর্মই এমন। মায়মুনার মুশরাফাকে অপছন্দের মুল কারণ হলো পর্দা। সেদিন জাওয়াদের অত বুঝানোর পর আজকাল তাকে মুশরাফার পর্দা নিয়ে কটুক্তি করতে দেখা যায় না। কারো সামনে যেতে বাধ্য করেন না। এই ব্যাপারটা মেনে নিলেও পছন্দের তালিকায় এখনো বসাতে পারেন নি। কাকনের মতো ভালো ও বাসতে পারেন নি। এটা সময়কার ব্যাপার, সময়ের পালাবদলে হবে। একসাথে সব আশা করাটাও বোকামি।

জাওয়াদ যখন নামাজ শেষে ফিরল তখন সবাই খেতে বসে গেছে। টেবিলে সবার উপস্থিতি চোখে পড়ল, কেবল মুশরাফা ছাড়া । জাওয়াদ তীর্যক চোখ খুঁজল চারপাশ। সেই ক্ষণে মায়মুনার চোখ পড়ল ওর উপর।
‘আয় বস?’

জাওয়াদ আশপাশ চোখ বুলাল। তারপর বলল,
‘ বাবা এলে একসাথে খাব।’

জাওয়াদের বাবা জয়নাল আবেদীন আর বড়ো ভাই যায়েদ জমিজমা সংক্রান্ত জটিলতা সমাধানে গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন দিন দুয়েক আগে। আজ বাসায় ফিরতেছেন। তারা এলেন চারটা নাগাদ। মুশরাফা তখন সবার খাওয়া এঁটোবাসন ধুতে ব্যস্ত। জয়নাল আবেদীন বড়ো ছেলের শ্বশুরালয়ের সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। মায়মুনা আর জাওয়াদের সাথে ও কথা হলো। তারপর জাওয়াদকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘মুশরাফা কোথায়? ওকে দেখছি না যে।’

‘রান্নাঘরে কাজ করছে।’ ধীর স্বরে বলল জাওয়াদ। জয়নাল আবেদীন কিছু না বলে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। শ্বশুরের স্বর শুনে মাথায় কাপড় টেনে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল মুশরাফা। ক্লান্ত বদনে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম বাবা। কখন এসেছেন!’

‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। মাত্রই এসেছি। কেমন আছো মা?’ স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন তিনি। এই ‘মা’ ডাকটা শুনলে প্রাণ জুড়ে আসে মুশরাফার। বাবার আদর পায়নি বলেই হয়তো শ্বশুরের মাঝে পিতৃত্ব ঢেলে দিয়েছে সৃষ্টিকর্তা। সে প্রাণবন্ত হেসে বলল,

‘ভালো আছি বাবা। ফ্রেশ হয়ে আসুন। টেবিলে খাবার দিচ্ছি।’
‘ তা তোমার খাওয়া হয়েছে তো?’

সবার খাওয়া হয়েছে। ওর যে খাওয়া হয়নি সেই খবরটা কারো নেই। কেউ খোঁজ নেয় নি, এমনকি জাওয়াদ ও না। নামাজ থেকে এসে দেখাও দেয়নি। উপোষ পেটে দিন পার করার পর শ্বশুরের প্রশ্নে কী যে ভালো লাগল মুশরাফার! এই মানুষটা ওকে ভালোবাসে, বাবা বাবা ধরনের যত্ন করে। শ্বাশুড়ির অবহেলা শ্বশুর যেন মেটানোর চেষ্টা করেন প্রতিনিয়ত। মুশরাফার ভালো লাগে। শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে, আপনতত্ত্ব আসে। ও সত্য বলল না, মিথ্যা ও বলল না। কেবল প্রসঙ্গ এড়াল, ‘ আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি বাবা।’

জয়নাল আবেদীন চলে গেলেন। মুশরাফা আবার টেবিল সাজালো। যায়েদ খেতে আসল না, রুমে বিশ্রাম নিল। বসার ঘরের পর্দাগুলো টান টান মেলে দিয়ে ডাইনিংরুমে এলো জাওয়াদ। চেয়ার টেনে বসতেই মুশরাফা চকিত চেয়ে বলল,
‘আপনি খান নি?’
‘তুমি সেধেছো?’ ভাবখানা এমন যেন মুশরাফা না সাধলে তার খেতে মানা। মুশরাফা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘আমার সাধার অপেক্ষায় ছিলেন আপনি!’

দুটো প্লেটে পোলাও বেড়েছে মুশরাফা। জাওয়াদ আরেকটা প্লেটে পোলাও বেড়ে মুশরাফার পাশের চেয়ারে দিয়ে বলল,
‘বাবার জন্য বসে ছিলাম। খেতে বসুন। আপনাকে আবার ধরে বেধে না খাওয়ালে আপনার খেতে মানা। ‘
শুধু বাবা নয় ওর খাবারের হিসাব আরও একজন রেখেছেন তবে! মুশরাফা কেন যেন হাসল, খুব করে। হাসি থামিয়ে বলল,
‘ভাইয়া আসবে। আমি পরে সময় করে খেয়ে নিব।’

জাওয়াদ আবার কঠোর হলো। রোস্টের বড়ো পিসটা ওর পাতে তুলে দিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
‘ভাইয়া টায়ার্ড, এখন খাবে না। কোন কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেতে বসো। বাবার সামনে যেন দ্বিতীয়বার বলা না লাগে।’

জয়নাল আবেদীন এসে গেছেন ততক্ষণে। মুশরাফা শ্বশুরের পাতে খাবার তুলে দিয়ে খেতে বসল। খাবার মুখে তোলার আগে ‘বিসমিল্লাহি ওয়া আ’লা বারকাতিল্লাহ। ( আল্লাহর নামে তাঁর বরকতের প্রত্যাশায় শুরু করলাম।) দোয়া পড়তে ভুলল না।
ওকে খেতে দেখে জয়নাল আবেদীন চোখ কপালে তুললেন,
‘বিকেল হতে চলেছে, তুমি সবে খেতে বসেছো! ‘

মিথ্যা কিবা সত্য দুটোর কোনটা বলতে নারাজ মুশরাফা উত্তরে হাসল কেবল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল প্রসঙ্গ ঘুরাতে, ‘ বাবা রেজালা দিই আপনাকে?’

খাবার মাঝেই বসার ঘর থেকে কাকনের ডাক এলো, ‘রাফা একটু চা করে দিতে পারবে?’

মুশরাফা খাবার ছেড়ে উঠতে গেল। জাওয়াদ নাক ফুলাল,
‘এই এঁটো ভাতের হিসেব দিতে হবে আল্লাহর কাছে। খাবার শেষ করো।’

মানুষের ভাগ্যভাণ্ডার নির্দিষ্ট। আজ অপচয় করলে কাল পাবেনা। অভাবে পড়তে হবে। সেই সাথে অপচয়ের জন্য আল্লাহর দেয়া শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এই ভয়টা মনে জাগতেই বসে পড়ল মুশরাফা। খাবার শেষ করে ঝটপট ছুটল রান্নাঘরে। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে চায়ের পানি বসালো। কোন কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ ‘ বলা সুন্নত। এর অনেক ফজিলত আছে। বিসমিল্লাহ বলে কাজ শুরু করলে আল্লাহ কাজে বরকত দেন। ওই কাজ সম্পন্ন করতে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়। উপরিলাভ হিসেবে কাজটাকে আল্লাহ সাওয়াবের খাতায় তুলে দেন। আল্লাহর নামে কাজ শুরু করলে, ওই কাজ যদি তার জন্য মন্দ হয় বা অবৈধ, পাপ হয় তবে মনে সন্দেহ তৈরি হয়। দ্বিধা, শঙ্কা কাজ করে। মন আগায় না। এতে ভালো খারাপের পার্থক্য বুঝা যায়। মুশরাফা আল্লাহর নাম নিয়ে কাপ নামানো, পিরিচে বিস্কুট সাজানো মগ্ন হয়ে গেল। জাওয়াদরা বাবা ছেলে কথা বলতে বলতে খেতে দেরি হলো। এর মাঝে ট্রে নিয়ে এলো মুশরাফা। জাওয়াদকে পাঠাল ট্রে নিয়ে। তারপর তাদের খাওয়া এঁটোবাসন ধুতে লেগে গেল।

কলিংবেল বাজার পরে দরজা খুলে বেশ চমকাল জাওয়াদ। দরজায় নাজমুল সাহেব আর ফরিদা দাঁড়িয়ে আছেন। বিনম্র সালাম দিল ভেতরে আনল তাদের। বসার ঘরে নিয়ে স্বপ্নার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল,
‘আন্টি উনারা আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি। ‘

ধরণটা আর বলল না। স্বপ্না ফরিদার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। মায়মুনা সৌজন্যতাবোধে দুটো কথা বললেন কেবল। ‘ভালো আছেন আপা? আপনারা হঠাৎ! ‘
ফরিদা হেসে বললেন, ‘এদিকে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। যাবার সময় মেয়ের জন্য মনটা কেমন করে উঠল। তাই চলে এলাম। তা আমার মেয়েটা কোথায়?’

নিজেই খুঁজে নিলেন মেয়েকে। সারাদিন মাকে স্মরণে রাখা মুশরাফা আকস্মিক মায়ের স্থলাভিষিক্ত দ্বিতীয় মাকে পেয়ে চমকানোর সাথে সাথে আবেগপ্রবণ হয়ে গেল। নিবিড়ভাবে বুকে ঠেসে রইল অনেকক্ষণ। জাওয়াদ বলল,
‘মামী নিয়ে রুমে যাও।’

রুমে গিয়ে মামী ভাগ্নি সুখদুখালাপ জুড়ে দিল। নাজমুল সাহেব বসার আলাপে বসলেন। জয়নাল আবেদীন সাহেব ও আছেন সেখানে। কাকন, কাকনের বাবা ও আছেন। জাওয়াদ বসা মামা শ্বশুরের পাশে। কথাবার্তার মাঝে নাজমুল সাহেব জয়নাল আবেদীনের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ অনেকদিন হলো মেয়েটা বাসায় যায়নি। আমি চাইছি যাবার সময় নিয়ে যেতে। কী বলেন ভাইসাব?’

জয়নাল আবেদীন কালবিলম্ব না করেই বললেন, ‘সপ্তাহে খানেক পরেই রমজান শুরু হবে, তখন তো আর যেতে পারবে না। তাই এখন গিয়ে কটাদিন থেকে আসুক। আপনি বরং নিয়ে যান।’

জাওয়াদ কিছু না বলে প্রশয়ের হাসি দিল মামার পানে। মায়মুনা গাইগুই করে উঠলেন, ‘ বাসায় মেহমান রেখে কিভাবে….
নাজমুল সাহেবের মুখে কালো মেঘ নামল। যৌথ পরিবারের বউদের নাইওর যাওয়ার অনুমতি শ্বশুর শ্বাশুড়ির থেকে নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে স্বামী একার মতামত খুব একটা গ্রহনযোগ্য হয়না। তার মনে হলো, মেয়ের প্রতি তার কোন অধিকার নেই। অধিকার থাকলে এখন তিনি জোর গলায় বলতে পারতেন, ‘না, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাব।’ কিন্তু তিনি পারছেন না।’ মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে বাবার বাড়ির লোকের জোর চলে না। মেয়েকে যে এই বাড়িতেই থাকতে হবে চিরকাল।
নাজমুল সাহেব হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আচ্ছা…
পুরো কথা বলতে না দিয়ে জয়নাল আবেদীন সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ টুকটাক মেহমানদারির জন্য মুশরাফাকে লাগবে না। কাকন একাই সামলে নিতে পারবে। মুশরাফা বরং আজ চলে যাক। সব সামলাতে পারবে না কাকন?’

কোমল চোখে পুত্রবধুর চোখে চাইলেন জয়নাল আবেদীন। সবগুলো চোখ ওর পানে। এত মানুষের সামনে নিজের বাড়ির লোকের অতিথিয়তা করতে অস্বীকৃতি জানানোটা বোধহয় শোভা পায়না। কাকন নেতিবাচক উত্তর দিতে পারল না। সৌজন্যতাবোধে তাকে বলতে হলো, ‘আমি পারব বাবা।’

জয়নাল আবেদীন এই কথার পরেই ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মুশরাফাকে ব্যাগ গুছাতে বল। আর শুন, আমার গাড়িটা নিয়ে উনাদের পৌঁছে দিয়ে আসিস।’ জাওয়াদ মুখে কিছু বলল না। বাবার দিকে তাকিয়ে চমৎকার একটা হাসি উপহার দিল। সেই হাসিতে কত কী লেখা ছিল! যা পড়ে প্রানবন্ত হাসলেন জয়নাল আবেদীন। তার ছোট্টো ছেলেটা কত বড়ো হয়েছে, কত বুদ্ধি হয়েছে তার!

জয়নাল আবেদীনের একটা কথার পরেই ব্যাগ গুছিয়েই রওনা হলো মুশরাফা। বিয়ের পর বাবার বাড়ি যাবার সময়টায় মেয়েদের জন্য ইদ আসে। খুশিমাখা ইদ, সেই ইদে একঝাক সুখ থাকে, ঠোঁটভর্তি হাসি থাকে, আনন্দ থাকে। মুশরাফার ইদটা বোধহয় আজই এলো। কী খুশি দেখাচ্ছে তাকে! নিকাবের ফাঁকে চোখ দুটো হাসছে, আনন্দে ভাসছে। সেই হাসি পরখ করে হৃদয়ে বয়ে যাওয়া স্বস্তির দল ছুটল জাওয়াদের। ব্যাগ গাড়িতে উঠানোর সময় জাওয়াদ বলল,
‘আগামী এক সপ্তাহ আপনার ছুটি। কাজ টাস সব বাদ। চারবেলা খাবেন, তিন বেলা ঘুমাবেন আর দুই বেলা নিয়ম করে কাঁদবেন। আপনার চোখের পানি বেশি হয়ে গেছে আজকাল।’

মুশরাফা প্রতিবাদী সুরে বলল, ‘কাঁদব কেন!’
‘আপনার কান্নার ত কারণ লাগে না আজকাল। জায়নামাজে বসা ছাড়াও যখন তখন অপ্রয়োজনীয় মানুষদের ভেবে কান্না আসে। নাইওরে গিয়ে নিয়ম করে কান্না করে চোখের পানি শুকিয়ে আসবেন, অপ্রয়োজনীয় অনুভূতি ভুলে আসবেন, মানুষদের ঝেড়ে আসবেন। আমার জীবনে বা আমার রুমে অপ্রয়োজনীয় মানুষের ভাবার সুযোগ নাই। ‘

জাওয়াদ ডিকিতে ট্রলি তুলে ড্রাইভিং সিটে বসল। ওর ভারি কথার মর্মার্থ বোধগম্য হলো না মুশরাফার। কেবল একটা শব্দটাই ঘুরল মস্তিষ্কে ‘ অপ্রয়োজনীয় মানুষ’। উনি কাকে মিন করলেন!

গাড়ি চলছে আপনগতিতে। আকস্মিক জাওয়াদের কল আসায় গাড়ি থামাল সে। কল রিসিভ করে ফোন কানে দিল। তার পাশে বসেছে নাজমুল সাহেব, পিছনে মুশরাফা আর ফরিদা। কথা বলতে বলতে মিররে চোখ বুলাল সে। মুশরাফাকে দেখা যাচ্ছে। স্থির দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। তার চোখ বিস্ময়, একঝাক আবেগ। কী দেখছে ওভাবে! কথা বলতে বলতেই ওকে অনুসরণ করে বাইরে তাকাল। রাস্তার অন্যপাশে একটা ছেলে দাঁড়ানো। যুবক বয়সী সুদর্শন মুখ। ইতঃপূর্বে কখনো দেখেনি জাওয়াদ! মুশরাফা ওকে কেন দেখছে! ছেলেটা কে? ওই তো ছেলেটা এদিকেই আসছে! কেন আসছে! কে হতে পারে ছেলেটা!
জাওয়াদের কথার তার ছিঁড়ে গেল। সে তীক্ষ্ম চোখ তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে। তার বউয়ের সাথে ছেলেটার কী সম্পর্ক জানার জন্য উদগ্রীব তার মন মস্তিষ্ক।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here