স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ,(পর্ব-১৭)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ,(পর্ব-১৭)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

‘অবহেলা’ চার বর্ণের এই শব্দে লুকিয়ে আছে হাজার উপেক্ষা, অবজ্ঞা,অযত্ন, অনাদর, অমনোযোগ, অপমান, কষ্ট। এই শব্দের মর্মার্থের ভার যেন সইতে পারছে না মুশরাফা। সেই ছোটোবেলা থেকে পরিবারের কাছ থেকে ‘অবহেলা’ পেয়ে এসেছে কিন্তু কখনো কষ্টের তীব্রতা এতখানি অনুভব করেনি। যতখানি আজ অনুভব করেছে। মুশরাফার মনের কোন এক কোণে আশা ছিল, তার প্রিয় ভাই অন্তত আজ একটু হলেও আপন ভাববে তাকে, আপন না ভাবলেও কোমল চোখে একটাবার তাকাবে। সেই আশাবশতই জাওয়াদের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে গিয়েছে ভাইয়ের সামনে। মামা, মামী তার নিজের পরিবার, সবাই এই পরিস্থিতির সাথে আগে থেকে পরিচিত। কিন্তু জাওয়াদ পরিচিত না, মুশরাফার ভাবনা ছিল ভাইয়ের থেকে আসা একটুখানি ভালোবাসা জাওয়াদের সামনে তার মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু দাবার গুটির মতোন তার ভাবনার চাল বদলে গেল এই ক্ষণে। ভাই ভালোবাসা তো দিলোই না, উলটো জাওয়াদের কাছে তাকে ছোটো করে গেল।

মুশরাফার তীব্র অপমানবোধ হচ্ছে। ভাই আমাকে ভালোবাসল না কেন? এই প্রশ্নটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ওকে। অন্য সময় হলে সেজদায় লুটে কাঁদতো। আজ নামাজের বিধিনিষেধের কারণে তাও পারল না। কান্নারা সব আটকে আছে। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে, ছুঁয়ে দিলেই যেন রক্ত ঝরবে, কিংবা আগুন।

জাওয়াদ দরজায় দাঁড়িয়ে ওর দুঃখবিলাস দেখল। চুপটি করে এসে বসল পাশে। দুঃখ কষ্টে মরবার উপক্রম হলেও এই মেয়ে কখনো তার বুকে মাথা রেখে কাঁদে না। অথচ সে বুক পেতে থাকে সবসময়। আজ ও রইল। আদুরে স্বরে ডাকল,
‘রাফা?’

মুশরাফা মুখ থেকে হাত ছাড়ালো। কিন্তু তাকাল না, মাথা নিচু করে বসে রইল। খানিক সময় নিয়ে বলল,
‘কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দিতে পারবেন আমায়?’

যাবার নামটি মনে কিংবা মুখে কোথাও তুলল না জাওয়াদ। কেবল ওর পানে চেয়ে রইল স্থির চোখে। আকস্মিক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ আমার জন্য কিসের অপমান বোধ তোমার, পাগলী মেয়ে? আমি কিছুই মনে করিনি, তুমি ছোটো ও হওনি। আমি কখনোই এ নিয়ে তোমাকে কথা শুনাব না, দ্বিতীয়বার এই ব্যাপার আমাদের সামনে ও আসবে না। তোমার স্থান, সম্মান সব আগের মতোই আছে। একটু ও নড়ে নি, নড়বে ও না। সো বি রিল্যাক্স। ‘

মুশরাফা রিল্যাক্স হলো না, দুঃখ ফুটিয়ে কাঁদল না। কেবল একটা হাত দিয়ে খামচে ধরল জাওয়াদকে। জাওয়াদ ওকে বুকে টেনে নিল। আশ্বাসের সুরে বলল,
‘ ট্রাস্ট মি. তারিফের মাঝে যদি তোমার জন্য বিন্দুমাত্র ভালোবাসা দেখতাম, তবে আমি এখনই তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যেতাম, এতকিছুর পর ও।
কিন্তু আমি দেখিনি ওর মাঝে ভাইয়ের দায়িত্ববোধ কিংবা ভালোবাসা। তাই এখন তুমি চাইলেও ওর কাছে তোমাকে যেতে দেবার অনুমতি দিতে পারব না আমি। বলছি কি রাফা, ওদের অধ্যায়টা এবার বন্ধ করে দাও।’

বিয়ের মাস ছয়েকে হাজার কষ্টের চাপা গলি পেরিয়ে এসে এই প্রথম মুশরাফা জাওয়াদের বুকে মাথা পেতে কেঁদে উঠল, ডুকরে। আর্তনাদের সুরে বলল,
‘এত গুলো বছরেও ওরা আমাকে আপন ভাবতে পারল না কেন?’
এই বাক্যেই সব কষ্ট উগড়ে বেরিয়ে এল যেন । স্বর কাঁপছে, চোখের জল গড়িয়ে ভিজে একাকার জাওয়াদের টি-শার্ট।

জাওয়াদ খুব করে চাইতো মুশরাফা ওর সামনে এসে দুঃখগুলো ভাগ করুক। ওর বুকে মাথা ঠেকিয়ে কাদুক। এত সময় বাদ আজ যখন সেই সময়টা এলো, তখন জাওয়াদের খুশি হবার কথা। অথচ সে খুশি হতে পারছেনা। তখন মনে হয়েছিল, মুশরাফা তারিফের সামনে কাঁদলে সে মানতে পারবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সমস্যা তারিফে নয়, সমস্যা মুশরাফার কান্না। মুশরাফার কান্নাই ওর সহ্য হবে না, নিজের সামনে ও না। তার রাফা স্ট্রং, কারো সামনেই কাঁদতে পারেনা, এটা সহ্য করার মতো না। জাওয়াদ ওকে সরিয়ে দিল। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
‘ কান্না থামাও। তোমার না কাঁদতে মানা? ওটা মানাই থাকুক। আর কখনো যেন কাঁদতে না দেখি। যে তোমায় নিয়ে ভাবে না, তাকে নিয়ে ভাবনা ছেড়ে দাও। তোমাকে নিয়ে ভাববার মতো কতগুলো মানুষ আছে, তাদের নিয়ে ভাবো। তুমি একা নও রাফা, দুই পরিবারের সবাই আছে তোমার সাথে, আমি আছি। আমি থাকতে তুমি কখনো একা হবে না ইন শা আল্লাহ। ‘

মুশরাফা কান্না থামাতে চাইল। ভাইয়ের অবহেলা মনে পড়তেই গলা কেঁপে উঠল, ‘ভাইয়া..’
জাওয়াদ ধমকে উঠল,
‘আবার কাঁদে। মানা করছি না? চোখের পানি খুব মূল্যবান। মানুষ এর মূল্য বুঝেনা। তুমি একটা মানুষের জন্য কেঁদে ভাসালেও তোমার চোখের পানির মূল্য দিবে না সে। অথচ এর এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে তুমি আল্লাহর কাছ থেকে পুরো দুনিয়া চেয়ে নিতে পারবে। তুমি না বলতে, কাঁদতে হলে আল্লাহর কাছে কাঁদব, আর কারো কাছে কাঁদব না? আজ কী হলো তবে?’

মুশরাফা হেঁচকি তুলে বলল, ‘আজ ভীষণ খারাপ লাগছে।’
জাওয়াদ বাইরের দিকে তাকালো। বৃষ্টি থেমে গেছে। সে বলল, ‘ বাইরে থেকে ঘুরে এলে ভালো লাগবে। উঠো, বেরুবো।’

‘ রোজা রেখে ঘুরাঘুরি! ‘ ভেজা চোখে প্রশ্ন করল মুশরাফা। জাওয়াদ হেসে বলল,
‘ উপোস রইলাম আমি, আর রোজার চিন্তা তোমার?’

মুশরাফা মুখ কুঁচকে জিহ্বা কামড় দিল। জাওয়াদ শব্দ করে হেসে বলল, ‘ উঠে রেড়ি হও। ঘুরেফিরে তোমার লাঞ্চ আমার ইফতার করে বাসায় ফিরব। ইদ আসতেছে, শপিং ও সেরে ফেলা যাবে। ‘

‘অন্যদিন গেলে হয়না?’ মুখে বিতৃষ্ণা ফুটিয়ে বলল মুশরাফা। জাওয়াদ গরম চোখে দেখল ওকে, ‘ না, হয় না। ইদের আগে আমি আর ছুটি পাব না। আজই যেতে হবে। কোন কথা নয়। উঠো। ‘

টেনে তুলল ওকে। ওয়াশরুমের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘যাও মুখ ধুয়ে আসো।’
মুশরাফা হাঁটা ধরলে পিছু ডাকল, ‘শুনো?’
মুশরাফা পিছু ফিরে প্রশ্নবোধক চাহনি দিল, ‘হু!’
‘আজই শেষ। আর কখনো আমার কাছে কাঁদতে আসবে না। কাঁদবেই না, ধরে কিংবা ছেড়ে। জায়নামাজে ছাড়া কোথাও কাঁদতে যেন না দেখি। ইট’স ওয়ার্নিং, নট আ সাজেশন। ‘

দুঃখরা আবছা হতে বসল যেন। মুশরাফা স্মিত হাসল, ‘ আমার কান্না সহ্য হয়না আপনার?’
জাওয়ার আবার গম্ভীর হলো, ‘ এত কথা বলো কেনো? কাঁদবে না ব্যাস। আমি তোমার কান্না দেখার লোক নই, কারণ ও নই। তাই আমার সামনে কাঁদবে না।’

মুশরাফা প্রসন্ন হাসল। তৈরি হয়ে বের হলো ওরা। বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ পরিবেশ এদিক ওদিক ঘুরে শপিংয়ে গেল। জাওয়াদ প্রথমে গেল শাড়ি দোকানে। মুশরাফাকে বলল,
‘দেখো কোনটা পছন্দ হয়।’

মুশরাফা বলল, ‘ গিফট আপনার পক্ষ থেকে, দেখবেন ও আপনি। তাহলে আপনিই পছন্দ করে দিন!’
জাওয়াদ বোধহয় এরই অপেক্ষায় ছিল। চোখ বুলিয়ে দুটো কালো শাড়ি বেছে নিল। বলল,
‘ এই শাড়িগুলো কেমন লাগছে?’
মুশরাফা দেখে বলল, ‘ভালোই। কিন্তু দুটোই কালো কেন?’
‘কালো শাড়িতে তোমাকে খারাপ লাগে না।’

খারাপ লাগে না মানে হলো, ওকে সুন্দর লাগে। চমৎকার লাগে। জাওয়াদের দেখতে ভালো লাগে। মুশরাফার মনে পড়ল না, সে কবে কালো শাড়ি পরেছে। সে ভ্র কুঁচকাল, ‘আমি কবে কালো শাড়ি পরেছি?’
‘বিয়ের পর কক্সবাজার গেছিলাম যে, তখন পরেছিলে। ‘

মুশরাফা অবাক চোখে তাকাল। এতকিছু মনে স্মরণে রেখেছে জাওয়াদ! এই ছোটো ব্যাপারটা ওর মনের কষ্টটা চাপিয়ে দিল। মনটা প্রসন্নতায় চেয়ে গেল। চাপা হেসে বলল,
‘তখন আপনি আমার উপর নাখোশ ছিলেন, এতকিছু খেয়াল করলেন কিভাবে?’
‘আমার মন নাখোশ ছিল, চোখ তো খোলা ছিল। আমার স্মৃতিশক্তি প্রখর। ‘
কাপড় দেখতে দেখতে বলল জাওয়াদ।

ওর শাড়ি কেনা শেষে দোকান থেকে বেরিয়ে মনের করিডোরে হাঁটার সময় মুশরাফা বলল,
‘ আচ্ছা, আমার বাবার বাড়ি থেকে ইফতার, কাপড়চোপড় না গেলে কি কোন সমস্যা হবে?’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘কী সমস্যা হবে?’
‘আমাদের সামাজিক রীতি অনুযায়ী বিয়ের পর কনের বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ির লোকদের জন্য মৌসুমী ফল, রমজানে ইফতার, ইদে জামাকাপড়, কোরবানিতে পশু এসব দেয়া হয়। না দিলে কথা শুনতে হয় মেয়েকে। কেউ কৌতুকের বেশে বলেন, কেউ আবার গম্ভীর মুখে। সংসারে অশান্তি হয় এ নিয়ে। এখন আমার বাবার বাড়ি থেকে তো কিছু যাবে না। মা কিছু বলবেন?’ মুশরাফা ধীর স্বরে বলল।

জাওয়াদ মনে করে দেখল, তার বোনের পরিবারের এসব কিছুই যায়, ভাবির পরিবার থেকেও আসে। দেয়া নেয়ার কাজটা মা’ই করেন। এখন যদি মুশরাফার পরিবার থেকে না আসে তবে ব্যাপারটা মা ঠিক কী ভাবে নিবেন নিশ্চিত বলতে পারল না জাওয়াদ। চিন্তিত মুখে বলল,
‘ইসলাম কী বলে এটা নিয়ে?’

‘যৌতুক হারাম। আমাদের সমাজে এগুলো তো বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে, দিতেই হবে। চেয়েই নেন অনেকে। বাধ্যতামূলক বিষয়টা জায়েজ নেই। ‘

‘ তারমানে শ্বশুরবাসা থেকে কিছু নেয়া যাবে না, তাই তো।’

‘ যৌতুক হারাম, উপহার সুন্নত। এখানে আপনাকে যৌতুক আর উপহারের মাঝের পার্থক্য বুঝতে হবে। বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে যৌতুককে ‘সম্মান/উপহার’ হিসেবে বলা হয়। মূলত দুটো আলাদা বিষয়। যৌতুক হলো বিয়েতে দাবি করা, গহনা, বাড়ি, গাড়ি দিতে হবে। অনেকে আবার সরাসরি দাবি করেন না। বলেন, আমাদের কিছু চাই না। যা দেবার আপনাদের মেয়েকে দিবেন। মেয়েকে, মেয়ের ঘর সাজিয়ে দিয়েন। তারপর বিয়ের পর ফল, পশু, কাপড়চোপড় এসব দাবি করে বসেন, না দিলে অশান্তি করেন। এটা যৌতুক। এটা করা যাবে না। স্ত্রীর অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের দায়িত্ব স্বামীর উপর বর্তায়। এটা মেয়ের বাবা মায়ের দায়িত্ব নয়। মেয়ের শ্বশুর পক্ষের অন্নের দায়ভার ও মেয়ের বাবার নয়। সুতরাং শ্বশুর পক্ষ মেয়ের বাবা থেকে এটা দাবি বা আশা করতে পারবেন না। দাবি করে নিলে জায়েজ হবে না। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে এসব জিনিসাধি পাঠাতে গিয়ে যদি বাবার উপর বিন্দুমাত্র আর্থিক চাপ পড়ে, তিনি যদি ঋণগ্রস্ত হন তবে এর জন্য শ্বশুরপক্ষের সবাইকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে, এবং কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এই খাবার হালাল হবে না। ‘

‘জায়েজ কখন হবে?’

‘জায়েজ তখন হবে, যখন বাবা উপহার হিসেবে মেয়েকে কিছু দেন। উপহার বা সম্মানটা মন থেকে দেয়া হয়, লোকের ভয় থাকে না এতে। নিজের সামর্থ অনুযায়ী দেয়া হয়। এক বাবার সামর্থ আছে, তিনি ভাবলেন মেয়ের জন্য একটু উপহার দিই। তিনি নিজের সামর্থ অনুযায়ী উপহার হিসেবে জামা কাপড় বা ফল পাঠালেন, সম্পূর্ণ খুশি মনে। যা না দিলেও কেউ আপত্তি করবে না। এটা জায়েজ হবে। যার সামর্থ নেই, তার থেকে দাবি করতে পারবেন না। স্ত্রীর দায়িত্ব অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য স্বামীকেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে। ‘

জাওয়াদ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে শুনল। তারপর বলল,
‘ ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু চাওয়াটা কেমন যেন ভিক্ষার মতো লাগছে। আমার মা কেন চাইবেন?
আমার স্ত্রীকে খাওয়া, পরানোর মতো যথেষ্ট সামর্থ আছে আমার। আমি কেন অন্যের কাছে চেয়ে যাব? সারাবছর তোমাকে খাওয়াতে পারলে, ইফতার করাতে পারব না? তোমার পরিবারের সাহায্য নিতে হবে কেন? বিয়ের সময় তোমার সব দায়িত্ব আমার কাধে এসে গেছে। এখন শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু চাওয়া মানে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করা। এটা ব্যাক্তিত্বহীনতার কাজ। তোমার বাসা থেকে কিছু লাগবে না। মাকে আমি ম্যানেজ করব।’

মুশরাফা চমৎকার হাসল। ও জাওয়াদের কাছ থেকে এমন কিছুই আশা করেছিল। উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘বর্তমান সময়ে এটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে। আত্মীয়ের মাঝে কার ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে কত বেশি জিনিস এলো এটা নিয়ে ছেলের মায়ের মাঝে একটা প্রতিযোগিতা চলে। অনেক শ্বাশুড়ি আগ বাড়িয়ে বলে দেন, বৌমা তোমার বাবার বাড়ি থেকে যেন এত জিনিস দেয়। না হলে আমার নাক কাটা যাবে। মধ্যবিত্ত মেয়ের বাবাকে সংসার সামলিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে জিনিস পাঠাতে গিয়ে ধার নিতে হয়, চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ে। বাবার কষ্টটা কেউ দেখেনা, সবাই কেবল বস্তা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে, ছোলা ক কেজি এলো? গরুর সাইজ ছোটো হলো না তো? পুরো গুষ্ঠির কাপড় এলো তো?
ছেলেও কিছু বলে না। বরং রসিয়ে গল্প করে, আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে এটা ওটা আসছে। একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখলে তারা বুঝতে পারতো এটা সরাসরি তাদের আত্মসম্মানে গিয়ে আঘাত হেনেছে। এই গতানুগতিক ধারার বাইরে আপনার চিন্তা দেখে ভালো লাগল। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিক।’

জাওয়াদ প্রশংসা কানে নিল না। বলল, ‘ সমাজের অনেক নিয়ম আছে যা আমরা সচারাচর মেনে থাকি। এর অনেকরীতি ইসলাম বহির্ভূত। তা হয়তো আমরা জানি ও না । এমন কিছু দেখলে আমায় জানাবে, পরিবার ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার।’

চমৎকার হাসল মুশরাফা। জাওয়াদকে নিজের মতোই পাচ্ছে ও। কী সুন্দর কথা বলে ও! আজকাল ইসলাম বিরোধী বিষয় নিয়ে সবার সাথে যুদ্ধ করতেও রাজি সে। মুশরাফা হেসে বলল,
‘আপনাকে দেখলেই আজকাল আমার ভালোবাসা আসে।’
জাওয়াদ সতর্ক করল, ‘তুমি রোজা না রাখলে ও আমি রেখেছি। সিডিউস করো না।’

মুশরাফা হেসে প্রসঙ্গ বদলাল, ‘ ইদে মা বাবার জন্য উপহার দেন না?’
‘আগে তো দিই নি কখনো। এবার দিব। বাসার সবার জন্য কিনব। ‘
থেমে বলল, ‘মামা মামীর জন্য নিই?’
‘এটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার। আপনি যদি খুশিমনে উপহার হিসেবে দেন তবে পারবেন। আমার কোন আপত্তি নেই। উপহার দেয়া সুন্নত। ‘

সবার জন্য শপিং করেই ফিরল ওরা।

দু’দিন পরের কথা। ঘড়ির কাটায় বেলা এগারোটা। নাজমুল সাহেব তখন নিজের কেবিনে বসে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে চোখ বুলাচ্ছিলেন। আকস্মিক দরজায় টোকা পড়ল,
‘আসবো মামা?’
চোখ তুলে দেখলেন তারিফ দাঁড়িয়ে আছে। চমকালেন বেশ। তারিফ ইতঃপূর্বে তার অফিসে আসেনি। আজ এল হঠাৎ? তিনি বিস্ময় ঠেলে বললেন,
‘আয়, বস।’

তারিফ এসে বসল। নাজমুল সাহেব এবার প্রশ্ন করেই ফেললেন, ‘তুই হঠাৎ আমার অফিসে?’

‘ এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট নিয়ে কিছু আলোচনা ও করার আছে।’

‘বিয়ে কবে ফিক্সড হয়েছে?’
‘ইদের দু’দিন পর। ফাবিহার বিয়ে হলো যে কনভেনশন হলটাবুক করব। তোমার না পরিচিত কে আছে। কথা বলে নিও ।’

‘আচ্ছা।’ নাজমুল সাহেব ভাগ্নের দিকে তাকাচ্ছেন না। গম্ভীরমুখে নিজের কাজ করছেন। তারিফকে কিছুটা উদাস দেখাল। আকস্মিক বলে উঠল,
‘ ওই ছেলেটা কী করে মামা?’

‘কোন ছেলেটার কথা বলছিস? ‘ নাজমুল সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। তারিফ ধীরে বলল,
‘তোমাদের বাসায় দেখা হয়েছিল যে, সেই ছেলেটা।’

তারিফ যে জাওয়াদের কথা বলছে, এতক্ষণে ধরতে পারলেন নাজমুল সাহেব।
‘মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে আছে। তুই হঠাৎ জাওয়াদের কথা কেন জিজ্ঞেস করছিস? সেদিন রাগ দেখাল বলে ওর উপর ও প্রতিশোধ নিবি?’

‘নাহ্, এমনি।’ বলে উদাস হলো তারিফ। তারপর নড়ে-চড়ে বসে বলল,’ ওদের বিয়ে কি তুমি দিয়েছো মামা? ‘
‘হ্যাঁ। ‘
‘ ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছিলে আগে?কেমন ছেলে?’ নাজমুল সাহেব বিস্মিত হলেন। তারিফের হঠাৎ বোনের স্বামীকে নিয়ে জিজ্ঞাসা তাকে ভাবাল বেশ। তিনি গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ পরিচিত ছেলে। সব খোঁজ নিয়েই রাফাকে তুলে দিয়েছি ওর হাতে। ছেলেটা বেশ ভালো। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, ও মানুষ। রাফা ওর কাছে নিরাপদ আছে।’

‘অনিরাপদ, অমানুষ ‘ শব্দ দুটোর পরোক্ষ ইঙ্গিত নিজেদের দিকে চোখে পড়ল তারিফের। সে গম্ভীরমুখে বলল,
‘সবার সামনেই কিভাবে ধমকাচ্ছিল ওকে!’

নাজমুল সাহেব আশ্চর্য নিয়ে চাইলেন। তারিফের কি বোনের জন্য চিন্তা হচ্ছে! কখনো তো মুশরাফার প্রসঙ্গে কথা বলে না, আজ হঠাৎ কী হলো! নাজমুল সাহেব ভাগ্নেকে পরখ করলেন। আজ ওকে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। চোখ লাল হয়ে আছে। নিদ্রাহীনতার ছাপ স্পষ্ট। চুল এলোমেলো। ফ্যাশন সচেতন ছেলের আজ ফ্যাশন নড়বড়ে, কপালে চিন্তার ভাজ। নাজমুল সাহেব ওকে পরখ করে বললেন,
‘ তোর হঠাৎ মুশরাফাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে কেন? সেদিন তো খুব অপমান করে গেলি। কত আশা নিয়ে গেল ভাইয়ের সাথে দুটো কথা বলবে। কথাতো বলিসই নিয়ে, তাকাসনি পর্যন্ত। জানিস মেয়েটা কত কষ্ট পেয়েছে? তুই কি আসোলে মানুষ! আমার সন্দেহ হয়। একটা ভাই এতটা পাষাণ কিভাবে হয়?’

রাগ উগড়ে দিলেন নাজমুল সাহেব। আকস্মিক চুপ হয়ে গেল তারিফ। ওকে ভীষণ অপ্রস্তুত দেখাল। বারদুয়েক ঢোক গিলল। উদ্ভ্রান্তের মতো চাইল এক পলক। ওর চোখ যেন বলে উঠল, ‘ওর চিন্তায় আমি দুটোরাত ঘুমাতে পারিনি, মামা।’
নাজমুল সাহেব স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন। তারিফের ভাবনায় মুশরাফা এসেছে? ওর এই উদ্ভ্রান্ততা মুশরাফার জন্য! সত্যিই, না কি তিনি স্বপ্ন দেখছেন!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here