স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ,(পর্ব-১৮)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ,(পর্ব-১৮)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

ঝলমলে অপরাহ্ন। মুয়াজ্জিনের কন্ঠে সুমধুর আযান ভেসে আসছে। হাইয়্যা আলাস সালাহ, হাইয়্যা আলাল ফালাহ। নামাজের জন্য এসো, এসো কল্যানের জন্য। অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিল জাওয়াদ। কখন যে চোখের পাতায় ঘুম নেমেছে টের পায় নি সে। আযান কানে যেতেই ঘুম ছুটে গেল। চোখ বন্ধ করে আযান শুনল, জবাব দিল। আযান শেষ হতেই বিছানা ছাড়ল। ফ্রেশ হয়ে বের হলো নামাজের উদ্দেশ্যে। যাবার কালে বসার ঘরে দাঁড়িয়ে ধীর স্বরে ডাকল,
‘মামা, নামাজে যাবেন?’

নাজমুল তৈরি হয়েই বের হলেন, ‘হ্যাঁ, চলো। ‘ কল্যানের পথে পা বাড়াল দুজন। রমজান মাসে রাস্তাঘাটে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। সারাবছর মসজিদ মুখো না হওয়া মানুষটাকে মসজিদ মুখো হতে দেখা যায়। রাস্তার ধারের যে দোকান থেকে আগে গান ভেসে আসতো, সেখানে থেকে এখন কুরআন ভেসে আসে। পাঞ্জাবি, টুপি উঠে কিশোর, যুবক বৃদ্ধের শরীরে। এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসা গালির পরিমাণ কমে যায়। গলির মোডে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ানো ছেলেদের বেঞ্চটাও খালি পড়ে থাকে। প্রকৃতিতে অন্যরকম এক স্নিগ্ধতা থাকে। পানির পিপাসায় তৃষ্ণার্ত গলা, শুষ্ক ঠোঁট, শুকনো মুখে তীব্র ক্লান্তিভাব থাকার পর দেহ মনে অন্যরকম এক শীতলতা, এক প্রশান্তির আলো ঝলকানি দেয়। একে বলা হয় নুরানি চেহারা। রোজাদার ব্যক্তির এই চেহারা আল্লাহর অধিক পছন্দ। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কয়েকটা কিশোরের শুকনো মুখ দেখে মনে পড়ল জাওয়াদের। ব্যাপারটা সুন্দর লাগে ওর।

মসজিদে আরেকটা চমৎকার দিক চোখে পড়ল। টয়োটা কার থেকে ফরমাল ড্রেসাপের এক ভদ্রলোক বেরিয়ে মসজিদে ঢুকেছেন। তার খানিক বাদে এক রিক্সাচালক রিক্সা থামিয়ে অযু করে মসজিদে প্রবেশ করল। জায়গা খালি পেয়ে কার মালিকের পাশে কাধে কাধ মিলিয়ে নামাজে দাঁড়াল। লোকটা দেখেও কিচ্ছুটি বললেন না, সরলেন না। যেন তারা সমভাই। অথচ মসজিদ থেকে বের হলে স্পষ্ট চোখে পড়ে বৈষম্য। রিক্সা চালক ওভাবে দাঁড়ানোর সাহস পাবেন না, আর তিনি ও মেনে নিবেন না। এ ঘরে কোন বৈষম্য নেই, ধনী গরির, সাদা কালো কোন ভেদাভেদ নেই। কোন জোর, কোন অহংকার চলে না এখানে। সবাই আল্লাহর বান্দা, সবাই মানুষ, সবাই সমান। এটাই শিক্ষা দেয় ইসলাম, নামাজ। মসজিদে এলে এই ব্যাপারটা মুগ্ধ করে জাওয়াদকে। আজও মুগ্ধ করল ওকে।

আত্মপ্রশান্তি এবং রবের প্রতি সন্তুষ্ট নিয়ে নামাজ শেষ করে বের হলো জাওয়াদ। দলে দলে মুসল্লিরা বেরিয়ে যে যার পথে রওনা দিচ্ছে। কেউ টয়োটা নিয়ে, কেউ রিক্সা, কেউ ইফতারের থালা।
নাজমুল সাহেবের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে সেসব দেখল জাওয়াদ। নাজমুল সাহেব এলেন খানিক বাদে। জাওয়াদ বাসার দিকে হাঁটা ধরলে বললেন, ‘চলো একটু হাঁটি।’

জাওয়াদ কদম বাড়িয়ে বললেন, ‘কিছু বলবেন মনে হচ্ছে?’
নাজমুল সাহেব তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন না। খানিক বাদে বললেন,
‘ মানুষের ভাবনা যেখানে শেষ হয়, আল্লাহর ভাবনা সেখান থেকেই শুরু হয়। আসোলে আমরা জানি না, কিসে আমাদের মঙ্গল লুকিয়ে আছে। না জেনেই আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিই, ধৈর্যহারা হই, অভিযোগ করি, হতাশ হই, রাগ দেখাই। আল্লাহকে দোষারোপ করি। এন্ড অফ দ্যা ডে, আমরা জিতি না। জিতে সে, যে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, ধৈর্য ধরে আল্লাহর বলা পথে চলে যায়। আল্লাহ তাকে এত বেশি নেয়ামত দেন যে, সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনা। ‘

জাওয়াদ নিশ্চুপ শুনল। মনে তার ঘোরতর সন্দেহ। সে ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু হয়েছে মামা?’
‘ আজ তারিফ এসেছিল অফিসে।’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘ হঠাৎ?’
নাজমুল সাহেব মুখে প্রসন্ন ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘বিয়ের আলোচনা করতে এসেছে। তবে আমার মনে হচ্ছে ওর আসার মূল কারণ রাফা।’

জাওয়াদের চোখেমুখে আতঙ্ক দেখা গেল, ‘ রাফা!’

‘ হ্যাঁ, বোনের চিন্তায় অস্থির ও। সেদিনের পর বোধহয় শান্তি পায়নি, ঘুম টুম ও হয়নি। উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছিল ওকে। না পেরে আজ ছুটে এসেছে বোনের খোঁজ নিতে।’ কথাটা বলতে গিয়ে খুশি দেখাল নাজমুল সাহেবকে।

জাওয়াদ চমকাল বেশ। অবিশ্বাস্য চোখে বলল, ‘ তারিফ এসেছে রাফার খোঁজ নিতে! ইজ ইট পসিবল?’
‘ আল্লাহর উপর রাফার ভরসা করাটা ফল দিচ্ছে।’

‘ সেদিন এসে রাফ বিহেভ করল, আজ আবার এসে খোঁজ নিতে চাইছে। মতলব কী ওর?’ সন্দিহান গলায় বলল জাওয়াদ।

নাজমুল সাহেব বললেন,
‘ তারিফের সবচেয়ে আদরের বোন ছিল রাফা। রাফার শৈশব রাঙানো মানুষটা হলো তারিফ। ভাইবোন একে অন্যতে অজ্ঞান ছিল। মাঝে রাফার দ্বিনের পথে আসা, তারিফের মাদকাসক্ত হওয়া ওদের মাঝে তিক্ততা আর দুরত্ব সৃষ্টি করেছে। তাই বোধহয় তারিফ সে টান অনুভব করেনি। এতকাল বাদে যখন দুজন আলাপে বসল তখন রাফার ব্যবহার তাকে সেই টান অনুভব করতে বাধ্য করেছে বোধহয়। রাফার ব্যবহারে একটা জাদু আছে, যা পাথর হৃদয় ছাড়া সবাইকে ওর ব্যাপারে ভাবতে বাধ্য করায়।’

শেষ কথা শুনে জাওয়াদ বিড়বিড় করল, ‘তা আমার চেয়ে ভালো কে জানে!’
মামার উদ্দেশ্যে বলল, ‘মামা আপনি ওর চোখে অনুতাপ দেখেছেন?’
‘ না, তবে চিন্তা আর ভালোবাসা দেখেছি।’

‘চিন্তা কী নিয়ে?’
‘আমার মনে হয়, তুমি ওকে সবার সামনে বকছিলে যে এ জন্য। এসে তোমার ব্যাপার জানতে চাইল। তখন স্পষ্ট ওর চোখে আমি চিন্তা দেখেছি। রাফা তোমার কাছে সুখে আছে কি না এ নিয়ে যত চিন্তা ওর।’

জাওয়াদ ভ্রু নাড়াল। ‘মানুষ তার আপনজনের জীবন দূর্বিষহ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনা। কিন্তু বাইরে কেউ এসে একটু আঁচড় দিলে ও তা সইতে পারেনা। অথচ তারা এটা বুঝে না, তারা আগলে রাখতে জানলে বাইরের কারো সাহস হবে না চোখ রাঙানোর।’

নাজমুল সাহেব পরামর্শ চাইল, ‘আমার মনে হয় ও আবার আসবে। যোগাযোগের চেষ্টা করবে। কী করা যায়? রাফাকে জানাবো?’

জাওয়াদ স্পষ্ট জানাল, ‘ আমরা আজ বাসায় ফিরব। আপনার বাসায় এলেও পাবে না রাফাকে। আপনার কাছে নাম্বার চাইলে দিবেন না। আমি চাইছিনা এ ব্যাপারে এখন রাফা কিছু জানুক। ‘

‘ রাফা তো খুব খুশি হবে। তবে জানাবে না কেন?’

‘ এত ঘা দিয়ে, চিন্তা বশত এসে দুটো ভালো কথা বলল ওমনি রাফাকে পেয়ে যাবে? এত সস্তা? ওরা কী অপরাধ করেছে তা ওদের বুঝতে হবে, অনুশোচনা করতে হবে। ওদের চোখে চিন্তা ভালোবাসা নয় সম্মান থাকতে হবে। বোন হিসেবে, একজন পর্দাশীল নারী হিসেবে। ওর পোশাকের প্রতি সম্মান করতে হবে, মানতে হবে এটা একটা সাধারণ পোশাক। সম্মান না থাকলে ওরা যখন তখন রাফা নিয়ে কটু কথা বলতে পারবে। এখন হয়তো রাগত মুখে জঙ্গলি বলছে, তখন হেসে হেসে বলবে। হেসে বলুক আর যাই বলুন, আমি চাইছিনা ওই পরিবার থেকে আর কোন তিরষ্কার, কথার আঘাত আসুক।

তাই এত সহজে রাফার নাগাল পাবে না । আমি দিব না। রাফা ও যুগ ধরে চেষ্টা করে এসেছে, ওর অনুভূতির তো কেউ মূল্য দিল না। ও তবে এত তাড়াতাড়ি কেন দিবে? আমি দেখতে চাই, তারা ঠিক কত দূর এগিয়ে যেতে পারে। কতটুকু নিবেদন করতে পারে।’

‘তুমি ওদের এক হতে দিবে না?’

‘অবশ্যই দিব। এখনই রাফার ক্ষমা পেয়ে গেলে ওরা এই ভুল আবার করবে। বাইরের কেউ খারাপ বললে, ওরা সায় জানাবে। ওদের মনে বিশ্বাস জাগবে না। অনুতাপ যত গাঢ় হবে, পরবর্তীতে ভুল করার সাহস তত ক্ষীণ হবে। তাই এত সহজে রাফার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। পুরো দিন অনুতপ্ত হয়ে থাকতে হবে। সম্মান দেবার মনস্থির করতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, সবাইকে নত মুখে নিবেদন করতে হবে। তারপর এন্ড অফ দ্যা ডে নাগাল পাবে রাফার। এর আগে যা আসবে সব আমি মোকাবিলা করব ইন শা আল্লাহ। বেশি জোর করলে আপনি আমার নাম্বার দিয়েন, যা বলার আমি বলব। ‘ জাওয়াদের স্বর দৃঢ়।

‘আসসালামু আলাইকুম।’ নামাজ থেকে ফিরে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে সালাম দিল জাওয়াদ। মুশরাফা ও হাসল,
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনাকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে। কারণটা জানা যাবে?’
জাওয়াদ হেসেই বলল, ‘ সৌভাগ্যক্রমে তোমাকে জানাতে পারছি না। ‘
‘সিক্রেট না কি!’

জাওয়াদ সে কথার উত্তর দিল না। ওর হাতে একটা গোলাপের বুকে । বুকেটা মুশরাফার দিকে বাড়িয়ে দিলো। মুশরাফা ভ্রু কুঁচকাল,
‘আমার জন্য? ‘
‘ তুমি ছাড়া লাল গোলাপ দেবার মতো কোন মানুষ নেই আমার জীবনে।’

জাওয়াদ জুতা খুলে সু-কেসে রাখল। তাজা লাল গোলাপে নাক ডুবাল মুশরাফা। চমৎকার একটা ঘ্রাণ নাক বেয়ে প্রবেশ করল মনে। প্রাণ জুড়িয়ে এলো। ও চমৎকার হাসল,
‘হঠাৎ ফুল আনলেন?’
‘ তুমিই তো চাইলে।’
‘আমি চেয়েছি! কবে? ‘ চমকে প্রশ্ন করল মুশরাফা। জাওয়াদ ধীর স্বরে বলল,
‘ মনে করে দেখো।’

জাওয়াদ রুমের দিকে পা বাড়াল। মুশরাফা দরজা বন্ধ করতে করতে ভাবনায় পড়ল। ভাবনার গভীরে বিচরণের পর আকস্মিক মনে পড়ল। বিয়ের পরপরই ও জাওয়াদকে পাঞ্জাবি আর পারফিউম উপহার দিয়েছিল। জাওয়াদ রেগে বলল, ‘কেনো কিনেছো এসব? আমি বলেছি? ‘
উত্তরে মুশরাফা বলেছিল, ‘ রাসূল (সাঃ) তার স্ত্রীকে ফুল উপহার দিতেন। আপনি চাইলে তাকে অনুসরণ করে আমাকে একটা ফুল উপহার দিতেই পারেন। আমি কিছু মনে করব না। আপনার মতো এত প্রশ্ন ও করব না। চুপচাপ নিয়ে নিব।’

সেই কথাটা মনে রেখেছে জাওয়াদ? আশ্চর্য! সেই কবেকার কথা লোকটার কিভাবে মনে থাকে? ও তো নিজেই ভুলে বসেছে। ও কেবল একটা ফুল চেয়েছিল। জাওয়াদ তো পুরো বুকে এনে দিল। স্বল্পমূল্যের একটি বুকে রাজ্যের খুশি এনে দিল মুশরাফার মনে। চোখে মুখে উৎফুল্লভাব দেখা গেল। ঠোঁটের কোণের হাসি সরলই না। রুমে গিয়ে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে চমৎকার হাসল,
‘জাযাক-আল্লাহু খায়রান।’

জাওয়াদ ও হাসল, ‘মনে পড়ল তবে?’
‘আমি কিন্তু একটা ফুল চেয়েছিলাম।’
‘তুমি অল্প পেয়ে তুষ্ট হলেও আমি অল্প দিয়ে তুষ্ট নই।’ জাওয়াদ এবার ওর দিকে একটা বক্স এগিয়ে দিল। যেখানে আছে একটা ব্রান্ডেড ঘড়ি আর চকলেট বক্স। মুশরাফা ভ্রু নাড়াল,
‘ আজ এত উপহার?’
জাওয়াদ বলল,
‘অচিরেই তোমার রব তোমাকে এত বেশি দিবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে। (সুরা দোহা-৫)
আল্লাহ তোমাকে সেইসব কিছুর প্রতিদান দিবেন, যার ব্যাপারে তুমি ধৈর্যশীল এবং আল্লাহর উপর ভরসা করেছি। ‘

‘ কিছু হয়েছে?’
‘চমৎকার একটা কান্ড ঘটে গেছে। শুনলে তুমি ভীষণ খুশি হয়ে যাবে। কিন্তু আমি তোমাকে জানাতে পারছিনা। তবে ইন শা আল্লাহ, শীঘ্রই জানাব। সেদিন খুশিটা দিগুন হবে।’

‘ একটি সুন্দর দিনের অপেক্ষায় রইলাম।’ মুশরাফা এ ব্যাপার নিয়ে বেশি ভাবল না। ঘড়িটা হাতে পরে দেখল। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করল, ‘পছন্দ হয়েছে? না হলে ফেরত দিতে পারো। অপছন্দের জিনিস পরার দরকার নেই।’

‘পছন্দ হয়েছে। ফেরত দেবার প্রশ্নই উঠে না।’

থেমে বলল, ‘দুটো হাদিস মনে পড়েছে, বলব?’
‘বলো।’

মুশরাফা বলতে শুরু করল, ‘আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, হে মুসলিম নারীগণ! কোন মহিলা প্রতিবেশিনী যেন অপর মহিলা প্রতিবেশিনীর হাদিয়া তুচ্ছ মনে না করে, এমনকি তা ছাগলের সামান্য গোশতযুক্ত হাড় হলেও। (বুখারী পর্ব ৫১ : /১ হাঃ ২৫৬৬, মুসলিম ১২/২৯ হাঃ ১০৩০)

আরেকটি হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খিদমতে কোন খাবার আনা হলে তিনি জানতে চাইতেন, এটা হাদিয়া, না সদকা? যদি বলা হত সদকা, তাহলে সাহাবীদের তিনি বলতেন, তোমরা খাও। কিন্তু তিনি খেতেন না। আর যদি বলা হত হাদিয়া, তাহলে তিনিও হাত বাড়াতেন এবং তাদের সঙ্গে খাওয়ায় শরীক হতেন। (সহিহ বুখারী)

এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হাদিয়া বা উপহারের মূল্য কতটুকু। রাসূল (সাঃ) উপহারকে কত মর্যাদার সাথে দেখেছেন জানার পর আমি কখনোই কারো উপহার ফেরত দিইনা। তা যেমনই হোক, আমি খুশিমনে নিই। আর কখনো ফেরত দেবার নাম নিবেন না। ‘ মুশরাফার চোয়ালে অভিমানের ছাপ।

বরাবরের মতোই মুগ্ধমনে শুনল জাওয়াদ। এই হাদিসটাও তার অজানা খাতায় তোলা ছিল। আজ জানা হলো। মানুষ সাধারণত উপহারের মান কম হলে তা তুচ্ছ করে, কিংবা অপছন্দের কারো দেয়া উপহার ফেরত দেয়। এটা উচিত নয়। এতে দাতার অপমান হয়। উপহার পছন্দ না হলে ওয়াড্রবে রেখে দেয়া যায়। না পরলেও দাতা জানবে না। গ্রহন করার আনন্দে আনন্দিত হবেন তিনি।
তবে হারাম বস্তুর ব্যাপারে ফেরত দেয়া সমীচীন।

জাওয়াদ বলল, ‘ সুন্দর হাদিস। এ হাদিস গুলো শুনলে মন ভালো হয় যায়। এত সুন্দর ইসলাম!’

নাইওর শেষে মুশরাফা যখন শ্বশুর বাসায় পৌঁছল তখন ঘড়ির কাটায় রাত আটটা। চারদিক থেকে এশার আযান ভেসে আসছে। কলিংবেল চাপার পর কাকন এসে দরজা খুলল। মুশরাফা চট করে তাকাল জাওয়াদের দিকে। ও পরখ করতে চাইল, ওর কথায় কাজ হচ্ছে কি না। জাওয়াদ নিচের দিকে তাকিয়ে ফোন দেখছে। ভাবির চোখে চোখ রাখছে না, অন্যদিন দেখা হলে হেসে কথা বলতো, আজ বলছে না। নম্র পায়ে পাশ কাটিয়ে গেল। মুশরাফা ভ্রু নাড়াল। তারপর হেসে ভাবির সাথে কুশল বিনিময় করল। তারাবির পর জাওয়াদ,জয়নাল আবেদীন নামাজ থেকে ফিরতেই টেবিল সাজিয়ে সবাইকে খাবারের জন্য ডাকল কাকন। যায়েদ, জিশান, জয়নাল আবেদীন, মায়মুনা সবাই এসে বসেছে। মুশরাফা খাবে না বলেছে। তাই তাকে ডাকলেন না। জাওয়াদকে না দেখে মায়মুনা ডাকলেন,
‘জাওয়াদ খেতে আয়।’

অভ্যাসগত ভাবে জাওয়াদ এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। কাকন সার্ভ করছে সবাইকে। জাওয়াদের পাতে ও এটা ওটা তুলে দিচ্ছে। সার্ভ করে কাকন গিয়ে স্বামীর পাশে বসে পড়ল। ঠিক জাওয়াদের সামনে। জাওয়াদ খাওয়া শুরু করল। চোখ তুলে তাকাতেই কাকনের সাথে চোখাচোখি হলো। আকস্মিক ওর মনে পড়ল, ভাবি গায়রে মাহরাম। দেবর ভাবির সম্পর্ককে মৃত্যু সমতূল্য বলেছে ইসলাম। আগের মতো চললে হবে না। ও চোখ নামিয়ে ফেলল, মাথা নিচু করে খাওয়ায় মন দিল। খাওয়া শেষ হওয়া অবধি মাথা তুলল না। খাওয়া শেষ করে রুমে চলে গেল।

সময়ের সাথে সাথে বিপত্তি বাড়ল। ওর কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল। মেয়েদের পর্দা সহজ। অন্দরমহলে থাকতে পারে, বের হলেও বড়ো ওড়নায় গা ঢেকে চলতে পারে। সে সহজে মানুষকে এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু একটা ছেলে তো ওমন করে নিজেকে ঢেকে চলতে পারে না, ঘরে বসে থাকতে পারে না। তাকে চলতে হয়, হুটহাট বের হতে হয়। তখন দেখা হয়ে যায়। মুশরাফা অনায়েসে জিশান, যায়েদ থেকে পর্দা করে চলতে পারলেও জাওয়াদ কাকন থেকে পর্দা করতে পারল না। রুম থেকে বের হলেই দেখা হয়ে যায়। খেতে ও একসাথে বসে, দরজা খুলে দেয়। কাকন ফ্রি মাইন্ডে এটা ওটা জিজ্ঞেস করেন। উত্তর দিতে গিয়ে থতমত খেতে হয়, পাশ কাটতে পারে না। বলতে পারে না, ভাবি আমার সামনে আসবেন না। আপনি গায়রে মাহরাম। নারীদের পর্দার কথা বলতে হয়, সে সঠিক নিয়ে পোশাক পরলেই তার পর্দার চিহ্ন এঁটে যায় শরীরে। কিন্তু পুরুষের শরীরে তো কোন পর্দার চিহ্ন থাকে না। তাদের শরীর নয় চোখ ঢাকতে হয়। এটা অনেক কষ্টকর। এত বছরের অভ্যাস বদলানো কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠল জাওয়াদের। শেষে না পেরে গেল মায়ের কাছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here