শব্দহীন_অনুভূতি,পর্ব_7,8

শব্দহীন_অনুভূতি,পর্ব_7,8
পলি_আনান
পর্ব_7

দুপুরের রোদে পুকুরপাড়ে বসে আছে হৃদিতা।উঠানে উড়ে বেড়ানো কবুতর গুলো গম ছুড়ে দিচ্ছে।এক ঝাক কবুতর টিনের চাল থেকে উড়ে এসে উঠানে হৃদিতার দেওয়া খাবার খুটে খুটে খাচ্ছে; বিষয়টা এক মনে তাকিয়ে উপভোগ করছে হৃদিতা।কিন্তু তার দিকে দুটো চোখ নিষ্পলক ভাবে,তাকিয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ।পুকুর পাড়ের শেষ প্রান্তে লম্বা দুটো কড়াই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আরাফ।তার চোখ দুটো তৃষ্ণার্ত! হৃদিতাকে দেখার তৃষ্ণা তাকে আকুল করে দিয়েছে। টানা চারদিন হৃদিতা বাড়ি থেকে বের হয় নি। গত কাল বিকাল থেকে রাতের আটটা পর্যন্ত গাছ তলায় আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল আরাফ শুধু মাত্র হৃদিতাকে দেখার জন্য।পুকুরের বিপরীত পাশের দিকটায় ঝোপঝাড়ে আবৃত তাই প্রয়োজন ছাড়া কেউ সেদিকটায় তেমন যায় না কিন্তু ব্যাকুল আরাফ দিনের অর্ধভাগ অপেক্ষা করছিল হৃদিতার আশায়।অবশেষে অপেক্ষার প্রহর যেন আজকে শেষ হলো। বেলা এগারোটার সময় এদিকটায় এসে হাজির হয় আরাফ।আর হৃদিতা একটার কিছুক্ষন পরেই পুকুর পাড়ে এসে বসে।
সেদিন নেহাকে ফোন করে ইনিয়েবিনিয়ে হৃদিতার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে আরাফ।পরবর্তীতে জানতে পারে সেদিন মধ্যে রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর হয় হৃদিতার।তাই ভার্সিটিতে নিয়মিত ক্লাসে যেতে পারছে না সে।তারপর থেকেই চিন্তার পোকারা ভর করতে থাকে আরাফের মাথায়।নিদ্রাহীন, খাওয়া বিহীন আরাফ একমনে হৃদিতার চিন্তায় মগ্ন থাকে।হৃদিতাকে দেখার আকুলতা তাকে বার বার গ্রাস করে। তাই উপায় না পেয়ে কাল থেকেই হৃদিতাকে এক পলক দেখার জন্য এইভাবে অপেক্ষায় থাকে।বেশ কয়েকবার হৃদিতাকে ফোন করা হয় কিন্তু অভিমানী হৃদিতা আরাফের ফোন তুলে নি।
হৃদিতার পরা গাঢ় নীল ওরনাটা দিয়ে মাথার চুল সহ কপাল পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে সে।তবুও পুকুরের ওই পাড় থেকে একপাশটা স্পষ্ট দেখতে পারছে আরাফ।

– এহন তো সুস্থ হইসো তাহলে এইবার কামে হাত লাগাও।
সুফিয়ার কথা শুনে চোখ পিটপিট করে তাকায় হৃদিতা।মাথার ওরনাটা আরেকটু টেনে কাচুমাচু হয়ে বসে সে।সুফিয়া তার বিপরীত পাশের ঘাটে বসে।
– কি হইলো কথা কওনা কেন?আর কত কাম করবো আমার নাতনিটা?এবার একটু হাত লাগাও।
– নেহা আপুতো সব কাজ করে নিয়েছে আমাকে আর কি কাজ করতে হবে?আর তো কোন কাজ নেই।
হৃদিতার কথায় ফিচেল হাসেন সুফিয়া।
– একটু আগে যে খাওন গিল্লা আইছো হেই গুলা কে ধুইবো?যাও পাকের ঘর থেকে থালাবাসন আর পাতিল গুলা ধুইয়া ঘরে তুলো।
গত চারদিন টানা ঘরে থেকে শরীরটা যেন অনায়ত্ত হয়ে গেছে তার। তাই একটু বাইরে আড়মোড়া কাটাতে প্রকৃতির হাতছানি নিতে এসেছে। কিন্তু সুফিয়ার কথা শুনে জ্বর যেন মাথা চওড়া দিয়ে এসেছে।

হৃদিতা উঠে গিয়ে পাকের ঘরে যায়। তিনটে পাতিল সাথে কিছু থালাবাসন নিয়ে পুকুর ঘাটে নেমে ছাই দিয়ে ধৌত শুরু করে।দূর থেকে আরাফ হৃদিতার কান্ডকারখানা দেখছে। এখনো সুস্থ হয়নি এই মেয়ে অথচ কাজ করতে লেগে গেছে।নিশ্চই এই বুড়ি দাদী খুঁচিয়ে খুঁচিতে এতক্ষন কিসব বলেছে তাই এই মেয়ে জ্বরের মাঝেও কাজ করছে।আরাফের ভীষণ রাগ লাগছে তবুও তার কিচ্ছু করার নেই।

তখনি আরাফের ফোনে আইদার কল আসে,
– হ্যালো দাদাভাই কোথায় তুমি?
– দূরে আছি কেন?
– আমার কোচিং আছে আমাকে একটু কোচিং এ পৌঁছে দিয়ে আসো না দাভাই।
– কেন ছোট চাচ্চু আর চাচিমা কোথায়?
– বাবা আর মা আজ বাইরে গেছে এখনো আসেনি।ফোনটাও সুইস্টপ।
– তুই একা চলে যা। দাভাই এখন দূরে আছি।
আরাফের কথা শুনে রেগে গেলো আইদা।
– তোমার বিড়াল কাল আমার পায়ে কামড়ে ক্ষত করে দিয়েছে। সেই বজ্জাত বিড়ালের কারনে আমি ঠিক মতো হাটতে পর্যন্ত পারছিনা আর তুমি বলছো একা যাবো?
– তোকে বলেছিনা হৃদিকে বিড়াল বলবিনা আর ভুলেও হৃদিকে বকবিনা বলে দিচ্ছি।দোষ তোর ও আছে কে বলেছে তোকে হৃদির লেজ ধরে টানতে।আর না হাটতে পারলে যাওয়ার কি প্রয়োজন আজব বুঝিনা আমি।
– তোমার মতো আমি পড়া চোর নই দাভাই।আমি আমার পড়া উসুল করার আগ পর্যন্ত কোচিং থেকে বাড়ি ফিরিনা।আজ কোচিংএ পরিক্ষা আছে আমায় নিয়ো চলো প্লিজ।
– বেশি পক পক করিস।দেখবো এই পড়া লেখা করে কোন মহা ভারত তুই শুদ্ধ করিস। বাই দা ওয়ে আমি আসছি অপেক্ষা কর।

আরাফ পকেটে ফোন পুরে হৃদিতার দিকে তাকায়।এখনো নুইয়ে নুইয়ে থালাবাসন ধৌত করছে সে।আরাফ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।দুহাত দিয়ে মাথার চুল টেনে আবারো তাকায় তার প্রেয়সীর দিকে।
– আরাফের ভালোলাগা আর ভালোবাসা দুইটাতে কখনো দাগ লাগতে দেয় না।অবহেলা পেতে দেয় না।কষ্ট পেতে দেয় না।তাই তোমার নিশ্চই সুদিন আসবে অপেক্ষায় থাকো।

কেন্টিনে বসে লিবান, শাকীল আর নাফিসার সাথে আড্ডায় মশগুল আরাফ।দীর্ঘ চারদিন পর সে আজ ভার্সিটিতে এসেছে।আসার কথা না থাকলেও তিন বন্ধুত জোরাজোরিতে তাকে আসতে হয়েছে।

– এই লাইব্রেরিতে চলনা প্লিজ আমার কিছু বই লাগবে।
নাফিসার কথা শুনে কপাল কুচকে নেয় আরাফ।
– কিরে পড়ালেখা শুরু করলি নাকি?হঠাৎ বইয়ের জন্য এত তাড়া?
– ইয়েস বস, পড়ালেখা শুরু করে দিয়েছি ফাইনাল এক্সামের এক মাসও বাকি নেই।এতদিন অনেক আড্ডা মাস্তি হয়েছে এবার অন্তত পড়ায় মন দে।
-আমার ম্যাম আসছে না। সো আমার পড়ালেখাও আপদত বন্ধ।
আরাফের কথা শেষ হতে চট করে লিবান প্রশ্ন করে,
– হ্যা তাই তো ভাবছি হৃদিতা আসছে না কেন?মেয়েটার তুই খোঁজ নিস নি আরাফ?
– না তার খোঁজ নেওয়া আমার কাজ না।আচ্ছা এবার আমাদের লাইব্রেরিতে যাওয়া উচিত।

লিবানের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সবাইকে নিয়ে লাইব্রেরির দিকে যায় আরাফ।কিন্তু লাইব্রেরিতে গিয়ে এমন একটি সিন দেখবে তা মোটেও ভাবে নি সে।হৃদিতা আর কবির একসাথে বসে আছে।কবির হৃদিতাকে বইয়ের দিকে তাকিয়ে পড়া বোঝানোর চেষ্টায় মগ্ন।বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও আরাফের কছে বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না।লাগবে কি করে হৃদিতার পাশে কোন ছেলে কে দেখা আর আরাফের মাথায় আগুন লাগা সমান কথা।
– ওই হৃদিতা এসেছে।
নাফিসার কথায় ঘাড় কাত করে আরাফ।ভেতটায় জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেলেও এই মূহুর্তে বন্ধুদের সামনে কোন প্রতিক্রিয়া করা যাবে না। তাই নিজেকে পরিবেশের সাথে মানিয়ে ধাতস্ত করে।
গল্পটি লেখনীতে পলি আনান

একটি টেবিলের হৃদিতা আর কবির মুখোমুখি বসে আছে হুট করে আরাফ ধড়াম করে কবিরের পাশের চেয়ারে বসে পরে।আকস্মিক এমন কান্ডে হৃদিতা চকিতে তাকায়।কিন্তু আরাফকে দেখেই উদ্দীপ্ত চোখ দুটো শান্ত হয়ে যায়।চোখ দুটো শান্ত থাকলেও ভাবধারায় যেন রাগ ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে।কবির আরাফকে দেখেই একটু নড়েচড়ে বসে।আরাফ হৃদিতার চোখে চোখ রাখতেই দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় হৃদিতা।হালকা গোলাপি রঙের শার্টের এলোমেলো কলার দু হাত দিয়ে টেনে ঠিক করে নেয় আরাফ।তার সাথে সাথে পেশিবহুল হাতটার স্লিভটা কোনুই পর্যন্ত উঠিয়ে কবিরের দিকে ঘাড়ঘুরিয়ে তাকায়।কাজ গুলো আরাফ শান্ত ভাবে করলেও, বিষটি যেন কবিরক মারার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।দূর থেকে শাকীল লিবান আর নাফিসা আরাফের কান্ডকারখানা দেখছে।

– উরিম্মা,আরাফ এমন করে কেন?কিছু কি বুঝলি নাফু?
শাকীলের প্রশ্নে নাফিসা আবারো আরাফকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। কিন্তু নিদিষ্ট কোন উওরে সে সীমাবদ্ধ হতে পারছে না। আরাফ কি করতে চাইছে?
– না রে এখনো কিছু বুঝতে পারছিনা। গত চারদিন হৃদিতাকে পড়াতে আসেনি। আজকে যাও এলো কিন্তু কবিরের সাথে ব্যস্ত বিষয়টি আরাফের খারাপ লাগার কথা কিন্তু তাতে আরাফের কি সে তো পড়াচোর; না পড়লে তো বেঁচে যায়।
– আমিও তা জানি কিন্তু আরাফের ইশারা ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে কবিরকে মারবে। দেখ কেমন করে তাকাচ্ছে কবিরের দিকে।
– দূর কিসব ফাউল কথা বলছিস?আমাদের আরাফ এইসব মারপিটে নেই।
– ভুলে কি যাচ্ছিস নোমান ভাইয়ের রক্ত আরাফের শরীরে বইছে। আর নোমান ভাই যা আগুন সেই আগুনের কিছুটা তাপ আরাফের গায়ে লাগারি কথা।
– সেই সব আমাদের ভেবে কাজ নেই চল আমরা ক্লাসে যাই। ক্লাস সময় হয়ে গেছে।
তারা তিনজনেই দ্রুত ক্লাসের দিকে পা বাড়ায়।

এদিকে আরাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হৃদিতার দিকে।এতদিন না দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে একদিনে।
– এখানে কি চলছে? আর পিচ্চি আমাকে পড়াতে আসিস নি কেন?
আরাফের মুখে পিচ্চি ডাকটা শুনেই অবাক দৃষ্টি ভঙ্গিতে তাকায় কবির।কবিরকে এই মূহুর্তে কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না তার তাই কবিরের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– এখন কি তোমার কোন কাজ আছে?আমি পিচ্চির সাথে কিছু কথা বলবো তুমি যাও।
সহসা কবির ব্যাগ নিয়ে চলে যায়।আরাফের সাথে এই মূহুর্তে তর্কে গেলেই বিপদ।

ক্লাস শুরু হওয়ায় লাইব্রেরিতে থাকা সবাই বেরিয়ে যায়।বাকি থাকে হৃদিতা আরাফ আর একটি মেয়ে।কিছুক্ষণ পরে সে মেয়েটিও চলে যায় তখনি হৃদিতা ব্যাগপত্র নিয়ে উঠে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হয়।যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আরাফ ব্যাগ টেনে আবার বসিয়ে দেয়।হৃদিতা বিরক্ত অঙ্গভঙ্গি নিয়ে আরাফের দিকে তাকায়।

– কি হচ্ছে এইসব।
– খবরদার আর এক পা বাড়ালে এখনে তুফান হতে যাবে বলে দিলাম।
– হলে হোক আমি বাড়ি যাবো।

আরাফ আর কথা বাড়ালোনা।সে যানে হৃদিতা কেমন মেয়ে অন্তত এই দুইদিনে সে বুঝে নিয়েছে হৃদিতা তাকে মোটেও ভয় পায়না বরং আগুনের মাঝে তুষ দিলে যেমন দাউ দাউ করে জ্বলে।ঠিক তেমন আরাফ রেগে গেলে হৃদিতা তার রাগ আরো দুইগুন বাড়িয়ে দেয়।আরাফ উঠে গিয়ে লাইব্রেরির দরজাটা বন্ধ করে দেয়।ছিটকিনি লাগাতে গিয়ে আবারো থেমে যায়। কি মনে করে ছিটকিনি না লাগিয়ে আবার ফিরে আসে হৃদিতার কাছে।
– এবার বল আমার সাথে এতদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছিস কেন?আমি জানি তোর জ্বর কিন্তু তবুও ফোন ধরিস নি একটা মেসেজের এন্সার দিস নি কারনটা কি?
– আমার ইচ্ছে হয় নি তাই ফো ধরিনি।
– আমাকে পড়াবে কে?
– আমি জানিনা তবে আমি আর তোকে পড়াতে পারবো না। আর হ্যা তোর নোমান ভাইকে যা করার করে নিতে বলিস তবুও তোকে পড়াবো না।
– আমাকে না পড়ানোর কারনটা কি?
– আশা করি সেদিন বিকালের পর আর কোন কারন তোর জানতে চাইবার কথা না।আমি গেলাম গুড বাই!
হৃদিতা আবার উঠতে নিলেই আরাফ হৃদিতার হাত টেনে বসিয়ে দে।এবং নিজেও টেবিলের উপর উঠে বসে।আরাফ আর হৃদিতা এখন মুখোমুখি। না চাইলেও হৃদিতা দৃষ্টি সরাতে পারছে না।
– সেদিন কি হয়েছিল আমাদের মাঝে?খারাপ কিছু তো হয়নি তুই শুধু শুধু নিযে থেকে বিষয়টা খারাপ করছিস।
– তুই একা একটা মেয়েকে পেয়ে কি সব উলটা পালটা কথা বলেছিস।তোর কাছে আমি এক চুল পরিমানেও নিরাপদ নয়।আমি আর তোর সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে চাইনা।

হৃদিতার কথা শুনে আরাফের মাঝে অনুশোচনার সৃষ্টি হয় কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ না করে উলটো হৃদিতাকে রাগ দেখায়।
– তুই সত্যি আমাকে পড়াবি না তাইনা?
– না পড়াবো না।
– ওকে তোকে একটা ভিডিও দেখাই বাকিটা সিধান্ত তোর।

আরাফ একটি ভিডিও হৃদিতার সামনে ধরে।বিষটি কয়েকদিন আগের।পশ্চিম বাজারে হৃদিতার খালু ওয়ালীদের সাথে দোকান করে এমন একটি যুবক চাঁদা না দেওয়ায় এবং এর সাথে নোমানের লোকদের সাথে তর্ক করার বেশামাল ভাবে মারা হচ্ছে তাকে।কয়েক মিনিট ভিডিওটা দেখেই শরীরের রক্ত হিম হয় যায় হৃদিতার। মাথা নুইয়ে বলে,
– প্লিজ বন্ধ কর।
আরাফ বন্ধ করে হৃদিতার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো।
– তোর খালুর সাথেও নোমান ভাই এমনটা করবে। যদি আমাকে না পড়াস এবার বল আমাকে পড়াবি?
– হ..হ্যা।
হৃদিতার সম্মোতিতে আরাফের মুখে ফুটে উঠে এক চিলতে হাসি।

এদিকে তিনদিন থেকে রুমে বন্ধীনি হয়ে আছে মাইশা।বিডিতে যাওয়ার জন্য সব গোছগাছ করতেই বিষটি তার বাবা আঁচ করতে পারেন।একপর্যায়ে এইসব বিষয় নিয়ে বাবা মেয়ের প্রচুর তর্কবির্তক হয় উপায় না পেয়ে তার বাবা বাইরে থেকে তাকে বন্ধী করে কাজে চলে যান। খাওয়ার সময় একজন মেড এসে খাওয়ার দিয়ে যায় এই ছাড়া বাড়ি থেকে বের হওয়া তার বারন। বন্ধী রুমে নোমানের কথা ভাবা ছাড়া আর কোন কাজ নেই তার। সকাল থেকে নোমানকে বেশ কয়েকবার ফোনে ট্রাই করলেও সে ফোন রিসিভ করেনি।অবশেষে এই মূহুর্তে ফোন রিসিভ করলো নোমান।

– এই মেয়ে কি সমস্যা তোমার?এইভাবে একাধারে
ফোন দিয়ে যাচ্ছো কেন তুমি?
– তুমি ফোন রিসিভ করছো না কেন নোমান?
– আমার কি তোমার ফোন রিসিভ করা ছাড়া আর কাজ নেই নাকি। এখন রাখছি
– নো নো নো ভুলেও কল কাটবে না। না হলে আমি কিন্তু বাড়ির ল্যান্ড লাইনে ফোন করবো। সেটা আশা করি তোমার জন্য আরো বড় বিপদ বয়ে আনবে।
– কেন ফোন করেছো তা বলো?
– আমাকে বাবা বাড়িতে বন্ধী করে রেখেছে আমি তোমার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য রাস্তা পাচ্ছিনা
প্লিজ নোমান হেল্প মি!
– আংকেল ঠিক করেছে একদম সঠিক কাজটাই করেছে। তোমাকে উচিত শেকল দিয়ে বেধে রাখা কারন তুমি তো মেন্টালি সিক পার্সন।
– নোমান!এইসব কি ধরনের কথা আমি তোমায় ভালাবাসি আর তুমি আমায় পাগল বলছো?
– তো কি? আমার কাছে ভালোবাসা টালোবাসা কিচ্ছু নেই। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই ব্যস্ত আছি।এইসব পাগলামি ছেড়ে পড়াশোনায় মন দাও। তোমার টাকাওয়ালা বাবা তোমাকে একটা ভালো পজিশনে নিয়ে যেতে পারবে।দেখবে অনেক টাকার মালকিন হয়ে যাবে।
– আমার কিচ্ছু চাইনা। টাকা চাইনা আমার।আমার তোমাকে চাই নোমান।প্লিজ আই নিড ইউ।
– আমাকে প্রয়োজন ওকে নিশিরাতে চলে এসো। নিশিরাত ছাড়া মেয়েদের কোন মূল্য নেই নোমানের কাছে।

নোমানের উওরে বেশ রাগ লাগলো মাইশার।সারা শরীরে কেউ যেন আগুনা জ্বালিয়ে দিয়েছে।দ্রুত ফোন কেটে ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দেয় এতটা অবহেলা কেন করে নোমান তাকে?তাকে কি ভালোবাসা যায় না।একদিন আসবে এই মাইশা নামের মেন্টাল সিক পার্সনটার জন্য তুমি পাগল থাকবে দেখে নিয় নোমান।শুধু মাত্র আমি সেদিনের অপেক্ষায় আছি।

লাইব্রেরিতে থাকা বড় বড় বইয়ের তাক গুলোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হৃদিতা।আরাফকে পড়া দিয়ে লাইব্রেরির চারদিকটা ঘুরে দেখছে।এদিকে আরাফ পড়া রেখে তার চাল-চলনের কার্যকলাপ দেখছে। দেয়ালের কোনার দিকটায় সবচেয়ে উচু তাকে একটি বই দেখেই দৃষ্টি আটকে যায় হৃদিতার।দ্রুত সেই বইটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়েলে খেয়াল করে বইটি তার নাগালে নেই।লাফিয়ে ঝাপিয়ে বইটা নেওয়ার নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল শূন্য।আরাফ দূর থেকে হৃদিতার কান্ড দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে।

হৃদিতা আরো বেশ কয়েকবার বইটি নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল শূন্য হওয়ায়।আশে পাশে চেয়ার খোঁজার জন্য চোখ বুলায়।হঠাৎ সে অনুভব করে তার পেছনে কেউ আছে কিন্তু কে? দ্রুত পেছনে ঘুরতেই কারো বুকের সাথে ধড়াম করে বারি খায় সে।বিরক্তে মুখ কুঁচকে সামনে তাকিয়ে দেখে এই ছেলেটা তো আরাফ।আরাফ তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
– এমনি এমনি তোকে আমি পিচ্চি বলিনা। দেখ সামান্য একটা বই নিতে পারিস না।
হৃদিতা সহসা তার চোখ নামিয়ে নেয়।আরাফের প্রশস্ত বুকটার দিকে তাকিয়ে হৃদিতা নিজেই ভড়কে যায়।আরাফের বুকের শেষ প্রান্তে হৃদিতার মাথা গিয়ে ঠেকেছে।মানে কি এই ছেলের সামনে দাঁড়ানো আর নিজের হাইট নিয়ে লজ্জায় পড়া একই ব্যাপার।
হৃদিতাকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরাফ নিঃশব্দে হাসে।হঠাৎ আরাফ উপলব্ধি করে হৃদিতা স্বাভাবিক নেই সে কাঁপছে।আরাফ দ্রুত বইটা হাতে নিয়ে অন্য হাতে হৃদিতাকে টেনে এনে চেয়ারে বসায়।হৃদিতা তার হাত ঝাকড়া মেরে সরিয়ে দিতে গেলে আরাফ আরো শক্ত করে আঙুলের ভেতর আঙুল ভাজ করে হৃদিতার হাত জড়িয়ে ধরে।
– ত..তুই সুস্থ নেই হৃদিতা।আজ ভার্সিটিতে কেন এসেছিস?
– আমি সুস্থ। তুই আমার হাত এইভাবে ধরেছিস কেন?ছাড় আমাকে।
হৃদিতার কন্ঠ কাপঁছে।হুট করেই তার জ্বর আবার বেড়ে গেছে।
– উহ’হু একদম চুপ। হঠাৎ করেই তোর জ্বর বেড়েছে।আমি তোর শরীরের তাপ উপলব্ধি করতে পারছি।
– আ..আমি ঠিক আছি। তুই আমার হাত ছাড় প্লিজ।
হৃদিতার কন্ঠস্বর কাঁপছে।মুখ দিয়ে কথা বলাটাও তার জন্য এখন বড্ড কষ্টের।
– আরাফ তোর হাত ধরেছে অন্য কেউ নয়।প্লিজ সত্যি কথা বল ডাক্তার দেখিয়েছিস?
– না।আর আমার ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। ওষুধ খেয়েছি।এবার ছাড় আমায় আমি বাড়ি যাবো
হৃদিতা আরাফকে তার হাত ছাড়তে বললেও আরাফ উল্টো আরো শক্ত করে ধরে।
– ওষুধ খেয়েছিস মানে?চারদিনের জ্বরে শুধু ওষুধ খেলেই চলবে না কি?দ্রুত আমার সাথে এখন ডাক্তারের কাছে যাবি।
– ছাড় আমাকে আমি বাড়ি গেলেই ঠিক হয়ে যাবো।
হৃদিতার তর্কে এবার বেশ রেগে যায় আরাফ। ধমকের সুরে চিৎকার দিয়ে বলে,
– বাড়ি গেলে ঠিক হবি মানে?বাড়িতে গেলে ঠিক হবি মানে কি?পুকুর ঘাটে রোদের মাঝে থালাবাসন ধুলে তুই ঠিক হয়ে যাবি নাকি?
আরাফের কথায় চমকে তাকায় হৃদিতা। মনে পড়ে যায় গত কালকের দুপুরের কথা মানে কি আরাফ যানলো কি করে?
– ক.. কি বলছিস তুই?
– ভুল কিছুতো বলিনি! মনে রাখবি তুই চাইলেও না চাইলেও দুটো চোখ তোকে সারাক্ষণ পাহাড়া দেয়।তাই নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করলেও এই দুটি চোখ থেকে আড়াল করা তোর সম্ভব নয়।
#চলবে….

শব্দ সংখ্যা ২৩৬৯
🍂পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন!

#শব্দহীন_অনুভূতি
#পলি_আনান
#পর্ব_৮

মধ্যে রাতের পার্টিতে ব্যস্ত আরাফ, শাকীল,নাফিসা
তাদের মাঝে আজকে লিবানের আসার সুযোগ হয়নি। কেননা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় লিবানের বাবা ধমকে আবার তার রুমে পাঠিয়ে দেয়।
ওয়াইনের বোতলে একটু পর পর চুমুক দিচ্ছে আরাফ।কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শাকীল আর নাফিসা ডান্স করছে।তাদের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় আরাফ।ম্যাসেজের টোন বাজতেই মোবাইলের স্কিনের দিকে চোখ যায়।
“প্রভা” মেসেজ করেছে।ইদানীং প্রভার কথা ভাবলেও তার সারা শরীরে কেউ যেন কেউ আগুন লাগিয়ে দেয়।দ্রুত মোবাইলটা বন্ধ করে ঘাড় ঘুরে শাকীলের দিকে তাকায়। কিন্তু একি শাকীল নাফিসা নেই।হঠাৎ আরাফ তার ঘাড়ে টান অনুভব করে।কেউ তার শাটের স্লিভ ধরে টানছে।বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে শাকীল আর নাফিসাকে দেখেই বিরক্তে মুখ কুচকে নেয়।ঝাকরা দিয়ে শাট ঠিক করে বলে,

– ওই ডাফারের দল কি শুরু করছিস? শাট ছিড়ে যাবে তো।
– ছিড়ে যাক। তুই তলে তলে কি করছিস আরাফ?আর আমাদের জানাচ্ছিস না।এই আমরা বন্ধু?
নাফিসার কথা ভ্রু-যুগল কুচকে নেয় আরাফ।শাটের স্লিভটা ঠিক করতে করতে বলে,
– আমি আবার কি করলাম আজব!কিসব বলছিস তোরা?
– ওই বেটা, আবার মিথ্যা কথা কস কিল্লাইগা।তুই দামড়ার লম্বা বেটারে আগে হাবু ভাবতাম।ভাবতাম আমাদের দলের তুই আমাদের মতোই হাবু কিন্তু না না তুমি তো মিয়া বাবু, সোনা, ময়না পাখীও জুটাই ফেলছোস কপালে।অথচ আমরাই জানলাম না।
শাকীলের কথায় ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বসে রইলো আরাফ।ওয়াইনের বোতলে একটা চুমুক দিয়ে ভাবতে থাকে কি বুঝাতে চাইছে এই লেজ বিহীন বাদর গুলো।তারা কি হৃদিতাকে নিয়ে কিছু সন্দেহ করছে ওহ আল্লাহ।কেস তবে জন্ডিস হয়ে যাবে।

– কি বলছিস তোরা আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। বুঝিয়ে বল প্লিজ।
– ওই নাফু অবুজ খোকাটারে বুঝা।কি কইতাসি আমরা।
নাফিসা আরাফের সামনের চেয়ারে বসে, ভ্রু বাকিয়ে বলে,
– তুই হৃদিতাকে লাইক করিস?
– না নাফিসা এইসব কি কথা বলছিস তোরা। শুধু শুধু বাড়াবাড়ি করছিস।
আরাফের এমন অযৌক্তিক উওর শুনে ক্ষেপে যায় শাকীল তেড়ে এসে আরাফকে কিছু বলতে নিলেই নাফিসা হাত ইশারায় বারন করে।কিন্তু মুখের কথাটা আর লাগামহীন ভাবে রাখতে পারলোনা। নাফিসার পাশে বসে গমগম সুরে বলে,
– আবার মিথ্যা কথা কেন বলস?ওরে জিগা নাফু আজ তাহলে লাইব্রেরিতে বসে হৃদিতার হাতে হাত রাখা,ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া ওইসব কি ছিল।
আরাফ তড়াক করে তাকায় দুজনের দিকে।ওয়াইনের বোতলটা হাত থেকে রেখে আঙুল ইশারা করে বলে,
– তোরা তখন ক্লাসে ছিলি না?
– না ছিলাম না। লিবানকে ক্লাসে বসিয়ে রেখে আমি আর শাকীল প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করবো বলে তোকে দেখতে বেরিয়ে আসি।তারপর যা দেখার দেখে নিয়েছি।যা বোঝার বুঝেও নিয়েছি।

নাফিসার কথা শুনে আরাফ মাথায় হাত দিয়ে আর্তনাদ সুরে বলে,
– ওহ শীট!
নাফিসা আর শাকীলের চোখাচোখি ইশারায় কথা বলে।আরাফ তাদের ইশারা বুঝতে পেরে ধমকের সুরে বলে,
– তোরা দুইজনে প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করতে ক্লাস থেকে বেরিয়েছিস। তাহলে আমার প্রাইভেট টাইমে আড়িপাতা হলো কেন?কমনসেন্স নেই নাকি তোদের?আর নাফিসা শাকীল না হয় বলদ আমি জানি,কিন্তু তুই কেন এমন করলি?
আরাফের কথায় চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে যায় শাকীল, গম্ভীর কন্ঠে আরাফের চোখেচোখ রেখে বলে,
– যা করেছি বেশ করেছি।যদি স্বীকার করতি হৃদিতাকে লাইক করিস তবে রাস্তা ক্লিয়ার করে দিতাম এখন যেহেতু স্বীকার করলি না সেহেতু আমাদের বুঝে নিতে হবে আসলে তোদের দুজনের মাঝে কি চলছে। আর কথা বাড়াতে চাই না এবার সত্যিটা স্বীকার কর বেটা।
আরাফ যা বোঝার বুঝে নিয়েছে এরা আজ তাকে সহযে ছাড়বে না সবটা ইচ্ছা করেই প্লানিং সাজানো তাদের।
– ওকে ঠিক আছে সবটা বলবো তোদের।কিন্তু শর্ত,নোমান ভাই,আর লিবান যেন কিচ্ছু না যানে।
– ওকে আমাদের দুইজন ছাড়া এই বিষয়টি কেউ যানবেনা।
আরাফ একে একে শুরু থেকে শেষ সব কথা নাফিসা আর শাকীলকে জানায়।নাফিসার খুশির যেন কমতি নেই। আরাফের মনে হৃদিতার জন্য ফিলিংস এসেছে এর থেকেও গুড নিউজ আর কি হতে পারে।
– আরে বাহ!আজকের তাজা খবর।’আমাদের আরাফ মশাই অবশেষে ফ্লার্টিং ছেড়ে রিয়েল প্রেমে পড়েছে। কিন্তু তুই হৃদিতাকে বলছিস না কেন?
শাকীলের প্রশ্নে ফিচেল হাসে আরফ।বাম হাতটা ঘাড়ের উপর বুলিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
– হৃদিতা আমায় মোটেও পছন্দ করেনা রে।মেয়েটি তার ক্যারিয়ারের পেছনেই ছুটছে।বাকিটা কি হবে দেখা যাক।
আরাফের আফসোস সুরের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় দুজনের। কিন্তু নাফিসার হুট করেই অন্য কথা মনে পড়তেই মন খারাপ সুরে বলে,
– বাট দোস্ত তোর লাইফে তো প্রভা আছে, তাহলে,?
সঙ্গে সঙ্গে দমে যায় আরাফ।এই এক ভয় তার জীবনে হৃদিতাকে দূরে সরিয়ে রাখার।
– আমি জানি না কি হবে।তবে নোমান ভাই ইদানীং একটু বেশি প্রভার কথা বলছে আমার সামনে।
আরাফের কথা শেষ না হতেই শাকীল ধমকের সুরে বলে,
– কর মাইয়াগো লগে আরো ফ্লার্টিং কর।ওই মাইয়া এবার উল্টা তোরে মুরগী বানাই ছাড়লো।কবে ছাড়া পাবি তুই এইসব থেকে? আমার তো মনে হয় জিন্দেগীতেও ছাড়া পাইবিনা।বাইদা ওয়ে হৃদিতাকে প্রপোজ করবিনা?
– না,ভুলেও না।
আরাফে প্রত্যুত্তরে চমকে তাকায় নাফিসা। অবাক হয়ে বলে,
-মানে কি তুই প্রেম করবি অথচ হৃদিতাকেই বলবি না!বিষয় টা এমন হয়ে গেলো না”ধরি মাছ, না ছুই পানি!
– যা হবার হবে। আমি হৃদিতাকে বলতে পারবো না আমি তাকে ভালোবাসি। যানিস, ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে আমাদের বড্ড ভয়,অন্য কোন ভয় না হারানোর ভয়।যদি চলে যায়।আমার অনুভূতি গুলোকে একা করে।
-তাই বলে তুই বলবি না তাকে?
– না! আমার অনুভূতি গুলো না হয় শব্দহীন ভাবেই থাক।
আরাফ ওয়াইনের বোতলটা হাতে নিয়ে হাটতে হাটতে দুই বন্ধুর কাছ থেকে আড়াল হয়ে যায় এদিকে শাকীল আর নাফিসা তাকিয়ে আছে একে অপরের মুখের দিকে।

কেটে যায় আরো কয়েকদিন। হৃদিতা আর আরাফের সম্পর্কে এখন বেশ উন্নতি হয়েছে।হৃদিতার বর্তমানে সবচেয়ে কাছের বন্ধু আরাফ।পরিক্ষার বাকি মাত্র বারো দিন।এই কয়েকদিন আরাফ আর হৃদিতা দুজন দুজনকে বেশি সময় দিচ্ছে।একদিকে আরাফ যদি এই সেমিস্টার পাশ করে না আসতে পারে তবে তার বাবার দেওয়া সেই ফ্লাট আর ফিরে পাবেনা।বন্ধুদের নিয়ে হইহুল্লোড় আড্ডাও হবেনা।আরাফ মাথা নিচু করে নিজের পড়া পড়ছে। হৃদিতা কিছুক্ষন কাচুমাচু করে আরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আরাফ একটা কথা বলি?
– হুম বল,
– তুই নোমান ভাইয়ার মতো এইসব কাজে নিজেকে জড়াইস না প্লিজ।তুই ছেলেটা ভালো কিন্তু তোর পাগলামোর কারনে পড়াশোনায় পিছিয়ে গেছিস।তুই চাকরি না পেলেও তোর বাবার যে অফিস তার দায়িত্ব নিয়েই চলতে পারবি তারপরেও নোমান ভাইয়ার মতো নিজেকে উগ্র বানাইস না প্লিজ।
হৃদিতার আকুল কন্ঠে এমন কথায় ভড়কে যায় আরাফ। তবুও নিজেকে ধাতস্ত করে আরাফ বলে,
– হঠাৎ এমন কথা বললি কেন৷ তুই?
– আমি জানিনা, তবে তোর খারাপ লাগলে সরি তবে যা মনে এসেছে বলে দিলাম।
আরাফ সুক্ষ্ণভাবে কিছুক্ষন হৃদিতার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিন্তু হৃদিতার কথার কারনটা খুঁজে পেলো না।তবে এটা নিশ্চিত হৃদিত নোমান ভাইকে মোটেও পছন্দ করে না।

বাড়ি ফিরে হৃদিতা ঘরে ডুকতেই তার মাথায় যেন বাজ পড়ে।তিনজন পুরুষ দুইজন মহিলা তাদের ঘর ঘুরেফিরে দেখছে।হৃদিতা অনেকক্ষন থেকে ভাবছিল এরা কারা হতে পারে, তাকে দেখতে পাত্র আসেনি তো?অবশেষে তার ভাবনাটাই সত্যি হলো সুফিয়া হৃদিতার জন্য পাত্র পক্ষ ঠিক করেছে।সারা বাড়ি খুঁজেও নেহাকে পেলনা হৃদিতা।কিছুক্ষণ পর যানতে পারে সুফিয়া নেহাকে তার ফুফির বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।এরো একটি বিশেষ কারন আছে কেননা হৃদিতার বিয়ের কথা শুনলেই প্রতিবাদ করবে নেহা।হামিদা আর ওয়ালীদ চুপচাপ সুফিয়ার কান্ড দেখছে।
রাগী সুফিয়ার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্য তাদের নেই।

পর্দার আড়ালে পাত্রকে দেখেই হৃদিতার সারা শরীরে ঝংকার দিয়ে উঠে।মধ্যে বয়স্ক পাত্র! তার আগের ঘরেও নাকি একটি দুটি মেয়ে আছে।হৃদিতা দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে খুঁজতে থাকে, কিন্তু পুরো রুম তন্ন তন্ন করলেও তার ফোন সে পায় না।আবারো রুম থেকে বেরিয়ে পাত্র পক্ষের রুমের দিলে উঁকি ঝুঁকি মারে তৎক্ষণাৎ নিজের ফোনটা সুফিয়ার হাতে দেখেই বুঝতে বাকি নেই তাকে আজকের পর থেকে এককথায় বন্ধী করে রাখা হবে।পেছনে ঘুরে তার খালামনির দিকে ঠোঁট ফুলিয়ে কাদঁতে নিলে তিনি চুল হাত বুলিয়ে বলেন,
– অনেক চেষ্টা করেছি আটকানোর কিন্তু তোর দাদি মানলেন না।শেষে কি না এই বাড়ি থেকে আমাকেও বের করে দেওয়ার হুমকি দিলেন।তোর খালুকে ত্যাজ্যপুত্র করার কথা বললেন তুই তো বড় হয়েছিস মা আশা করি সব বুঝতে পারছিস।

হামিদার কথা শুনো থমকে যায় সে। তার জন্য হামিদার সাজানো সংসারটা ভেঙ্গে যাবে কিছুতেই মানতে পারবেনা সে। থাক না কিছু মানু্ষের পূর্ণতার জন্য আমার জীবনটা অপূর্ণ রয়ে যাক।
গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।

কেটে যায় চারদিন। বিয়ের বাকি আর মাত্র দুইদিন।তাই এতদিন রাগের মাথায় শপিং এ না গেলেও হৃদিতাকে তো উপহার হিসেবে কিছু দিতেই হবে তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে শপিং করতে বের হয়।গোল্ড প্যালেসে ডুকেই আরাফকে দেখরে পাবে সপ্নেও ভাবেনি নেহা।আরাফ আর তার জেঠিমা গোল্ডের হার দেখছে তখনি আরাফের শাট টেনে ধরে নেহা।বিরক্তে মুখ ভঙ্গিতে পেছনে তাকালে নেহাকে দেখেই মুখে উচ্ছ্বাসিত ভাব ফুটে উঠে।
– আরে দোস্ত তুই এখানে?
– একটু কাজ ছিল তাই এলাম
তুই বিয়ে শাদী করছিস নাকি?কার জন্য গয়না চুজ করতে এসেছিস?
– আরে না। জেঠিমার বোনের মেয়ের জন্মদিন তাকেই উপহার দেবে।তা তোর কি কাজ?
– আমার আর কাজ!হৃদিতার বিয়ে তাকে একটু কিছু উপহার দেওয়াতো প্রয়োজন তাই চলে এলাম।
হৃদিতার বিয়ে!কথাটি নেহা ঠিক যতটাই সহজ ভঙ্গিতে বললো আরাফের কাছে কথাটি ঠিক ততটাই বিদঘুটে, অসহ্য, শ্রবণ মনে হলো।পর পর কয়েকটি ঠোক গিলে নিজেকে ধাতস্ত করে বলে,
-ম..মানে?
– আরে হৃদিতাকে তুই তো চিনিস দুইদিন পরেই তার বিয়ে।
– মানে কি চারদিন পর আমাদের পরিক্ষা আর এত ব্রিলিয়ান্ট মেয়েটা বিয়ে করে নেবে?
আরাফের কথার উলটো পিঠে নেহা শুরু থেকে শেষ সুফিয়ার কান্ডের কথা আরাফকে জানায়।আরাফ ভাবতে থাকে এজন্যই কি গত দুইদিন হৃদিতা গম্ভীর ছিল?কিন্তু এতটা কাছে থেকেও আরাফ বুঝলো না।নেহাকে আর তার জেঠিমানে বিদায় দিয়ে সে দ্রুত সে দোকান থেকে বেরিয়ে যায়।

শাকীল আর নাফিসা একসাথে বসে নিজেদের পড়া পড়ছে তখনি ফোন দেয় আরাফ। দ্রুত ফোন রিসিভ করে হাসিহাসি মুখ করে বলে,
– কিরে প্রেমিক পুরুষ, আমার কাছে আবার প্রয়োজন ?
– সব শেষ রে শাকীল, সব শেষ!
– শেষ মানে?কি বলছিস তুই?
আরাফ একে একে নেহার বলা কথা গুলো শাকিল কে বলতে থাকে। ফোনের স্পিকার অন করায় পাশ থেকে নাফিসা চুপচাপ সব শুনছে।
আরাফের গলা প্রচন্ড পরিমানে কাপঁছে মুখ দিয়ে কথা বের হতে না চাইলেও জোর করে কথা বের করছে।
– আরে আরাফ চিন্তা করিস না। প্রয়োজনে আমরা তোর জন্য হৃদিতাকে তুলে আনবো। এত চাপ নিস না তুই শক্ত হ।
– নারে এইসব করে কোন লাভ নেই। যাকে পাওয়া হবে না সে না পাওয়াই থাক।শুধু শুধু মেয়েটার কলংক বাড়বে।
– কিন্তু তুই নিজেকে সামলাতে পারবি?
শাকীলের প্রশ্ন শুনে দ্রুত ফোন কেটে দেয় আরাফ।কিচ্ছু বলার নেই তার এই মূহুর্তে। সব যেন ধৌয়াশা লাগছে,পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দে জড়িয়ে যাচ্ছে বার বার।

রাত সাতটার পর খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে হৃদিতা। অন্য রুমে নেহা আর তার মা কি নিয়ে আলোচনা করছে।সুফিয়া ঘুমিয়ে আছে মাগরিবের পর থেকে।
হঠাৎ হৃদিতার ফোন ভাইব্রেট হতে থাকে।ফোন হাতে তুলে আরাফের নাম্বার দেখেই একচিলতে হাসে।দরজা খুলে বাইরে গিয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করে।দুইচার বার হ্যালো হ্যালো বলে কিন্তু তবুও ফোনের বিপরীত পাশ থেকে কোন কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিকষ কালো রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা তারার দিকে তাকিয়ে দুচোখে অশ্রু কণা ছেড়ে দেয় সে।ভাবতে থাকে জীবনের কথা গুলো। রাতের আকাশের এমন কালোর মাঝে তার জীবনটাও কালো। কিন্তু তার জীবনে কোন তারা নেই যে অন্ধকার আকাশের মতো একটুকরো আলো নিয়ে তার জীবনে আসবে।
ঠোঁট চেপে নিজের কান্না জমিয়ে রাখতেই হৃদিতা উপলব্ধি করে মোবাইলের বিপরীত পাশের লোকটাও কাদঁছে।ফ্যাচ ফ্যাচ নিশ্বাস নেওয়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কেন কাদঁছে ?নির্জন রাতের পরিবেশে কয়েকটি ঝিঝিপোকার ডাক তার সাথে একম গুমুট কান্নার আওয়াজ পরিবেশটা বড্ড বিষাদিত লাগছে হৃদিতার কছে।

রাতেএ একা নিস্তব্দ জায়গায় মধ্যে রাতে গুমড়ে কাচ্ছে আরাফ পার্টি করতে এসেই হুট করেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে যে।দূর থেকে তাকে তীর্যক দৃষ্টিতে দেখছে নাফিসা আর শাকীল।
– আমরা কি আরাফের জন্য কিছুই করতে পারবো না নাফু?
– মনে হয় না পারবো।আগে চল কান্না থামাই।
নাফিসা আর শাকীল এগিয়ে যায় আরাফের দিকে।মাথা নুইয়ে গুমড়ে কাঁদছে ছেলেটি।
-আরে দোস্ত কাদঁছিস কেন? প্লিজ নিজেকে সামলা।
– কাল হৃদিতার বিয়ে নাফু, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।কি করবো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।কালকের চিরতরে হারিয়ে ফেলবো আমি হৃদিতার অধিকার।
আরাফ আবার মাথা নিচু করে নেয় তখনি শাকীল গমগম সুরে বলে,
– অধিকার হারাবি মানে? তুই না ওকে বেস্ট ফ্রেন্ড ভাবিস। বেস্ট ফ্রেন্ড মানেই তো অর্ধেক বউ।তাহলে ওই ব্যাটার আগে তোর হৃদিতার প্রতি অধিকার আছে।
এমন সিরিয়াস মুহূর্তে শাকীলে এহেন যুক্তিহীন কথায় চোখ পাকিয়ে তাকায় নাফিসা।আরাফ চোখের পানি মুছে ঠোঁট বাকিয়ে বলে,
– নাফিসাও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তাহলে নাফিসা কি আমার অর্ধেক বউ।কইরে নাফিসা আমার অর্ধেক অর্ধাঙ্গিনী আয় আমার কোলে আয়।
আরাফের এমন কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসে নাফিসা কিন্তু হুট করেই শাকীল নাফিসাকে টেনে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
– খবরদার এটা আমার হক।তুই হাত বাড়াইস না।একদিকে খালতো বোন অন্য দিকে বেস্ট ফ্রেন্ড।খালতো বোন মানেই খালতো ভাইগো হক, আর বেস্ট ফ্রেন্ড মানেও হক তাহলে বুঝতেই পারছিস দুইদিক থেকে অর্ধেক অর্ধেক হয়ে,নাফিসা সম্পূর্ন আমার বউ লাগে। তুই বরং ভাবী ডাকিস সমস্যা নাই।
শাকীলের এমন যুক্তি শুনে এবার শব্দ করেই আরাফ হেসে দেয়।
– তোরা সুখে থাক দোস্ত। অন্তত পূর্নতা যেন পায় তোদের সম্পর্কে।
আরাফ উঠে যায়।পকেট থেকে ফোন নিয়ে হৃদিতার ছবি দেখতে থাকে।এই মেয়েটিকে হয়তো তার আর পাওয়া হবেনা।অন্য হাতের সিগারেটেটা আরেকটা টান দিয়ে মুক্ত করে দেয় ধৌয়া গুলো।যেদিন থেকে শুনেছে হৃদিতার বিয়ে সেদিন থেকে কত’শ প্যাকেট সিগারেট খাওয়া আরাফের শেষ হয়েছে যানা নেই তার।সিগারেটে টান দিয়ে হৃদিতার ছবির দিকে তাকায় আরাফ।চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে সেদিনে লাইব্রেরির কথা।পাচঁ আঙ্গুলে হাতে হাত গুজে আরাফ হৃদিতাকে অনুভহ করেছিল। সেই ছোঁয়া যেন এখনো তার হাতে লেগে আছে।সেদিন কফিশপের কান্নার লেপ্টে যাওয়া কাজল মাখা চোখ দুটো দেখার আবার তৃষ্ণা জাগে আরাফের মনে।হয়তো আর কখনোই দেখতে পাবে না সে।প্রেমের অনুভূতি আদান প্রদান কফিশপে বসেও আর হয়তো আড্ডা দেওয়া হবে না।
হাতে থাকা সিগারেটটা শেষ হলেই আরেকটা সিগারেট হাতে তুলে নেয় আরাফ।আগুন জ্বালিয়ে মোবাইলের স্কিনে হৃদিতার ছবি দেখতে দেখতে বলে,
– তোরা মেয়েরা একপ্রকার নেশা!তোরা আশে পাশে থাকলেও যেন নেশা নিয়ে ঘুরিস।সহজেই কাবু করতে সক্ষম তোরা।আবার চলে গেলেও হাতে অন্যরকম নেশা ধরিয়ে দিয়ে চলে যাস।কে বলেছে তোরা মায়াবতী? তোদের নাম নেশাবতী রাখাটাই উচিত ছিল।

চলবে….।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here