শব্দহীন_অনুভূতি,পর্ব_৫,৬

শব্দহীন_অনুভূতি,পর্ব_৫,৬
পলি_আনান
পর্ব_৫

অনেকটা সময় ধরে হৃদিতা কপি শপের সচ্ছ গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।আরাফ তার সামনে বসেই অংকের উওর মেলাতে ব্যস্ত।সম্পূর্ণ অংকটা শেষ পর্যায়ে কিন্তু উওর তার মিলছে না। বাম পক্ষ সমান ডান পক্ষ কিছু তো গড়বড় আছেই।বোকা আরাফ কিছুতেই বুঝতে পারছেনা তার অংকের শুরুতেই গন্ডগোল শেষের মিলটা আশা করা একদম বোকামি।আরাফ বিরক্ত হয়ে হৃদিতার দিকে তাকায়। কিন্তু হৃদিতা অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। তৎক্ষণাৎ হৃদিতার দৃষ্টি অনুসরণ করে আরাফ।বাইরে একটি বেঞ্চিতে বিড়াল হাতে নিয়ে সাদা শাট পরা একটি ছেলে বসে আছে।ছেলেটা একদম কপিশপের মুখোমুখি বসে আছে যার কারনে হৃদিতা ছেলেটাকে খুব সহজেই দেখতে পাচ্ছে।ছেলেটা আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বিড়ালটার গায়ে, আর কি যেন বিড়বিড় করে বলছে।আরাফ মাথা ঘুরিয়ে হৃদিতার দিকে তাকায়। হৃদিতা এখনো তাকিয়ে আছে সেই ছেলের দিকে; বিষয়টা মোটেও ভালো লাগলোনা আরাফের কাছে।মূহুর্তেই রাগ যেন সাত আসমানে উঠে গেছে।সামনে থাকা খাতাটা হৃদিতার দিকে ছুড়ে মেরে ধমকের সুরে বলে,

– পিচ্চি!আমি অংকটা পারছিনা বুঝিয়ে দে।
আরাফের হঠাৎ ধমকে কেঁপে উঠে হৃদিতা।বুকে হাত রেখে জোরে শ্বাস ছেড়ে তড়াক করে আরাফের দিকে তাকায়।
– কি সমস্যা ?
– ওই ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিলি কেন?
খাতা থেকে তড়িৎ গতিতে হৃদিতা চোখ সরিয়ে আরাফের দিকে তাকায়।আরাফের এমন গম্ভীর কন্ঠের কথা শুনে বেশ অবাক লাগে তার।
– মানে?
নিজের হঠাৎ রিয়েকশেনে আরাফ নিজেই থতমত খেয়ে যায়।কথা ঘুরাতে আমতা আমতা স্বরে বলে,
– না মানে বুঝতে পারছি না পুরো অংকটায় কোথায় সমস্যা তুই আরেকবার বুঝিয়ে দিবি প্লিজ!
– ওকে।
হৃদিতা পুরো অংকটা আরাফকে আরেকবার বুঝিয়ে দেয়।আরাফ পড়ায় মগ্ন হয়ে গেলেই হৃদিতা আবার ডুব দেয় সামনে থাকা সেই ছেলের দিকে। বিষয়টি ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে আরাফ।
– সমস্যা কি তোর ওই ছেলের দিকে তাকিয়ে কি দেখছিস?
কথাটি বলেই আরাফ টেবিলের উপর থাবা মেরে দাড়িয়ে যায়।বিকট শব্দে ভড়কে যায় হৃদিতা সহ কপি শপে থাকা ম্যানেজার আর চারজন কর্মচারী।তারা দ্রুত আরাফের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।এদিকে হৃদিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আরাফের দিকে।হঠাৎ এই ছেলেটা রেগে যাওয়ার কারন বুঝতে পারছেনা সে।আশেপাশে থাকা কর্মচারী গুলোর দিকে একবার তাকিয়ে তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। লজ্জায়, ক্ষোভে ইচ্ছে করছে আরাফের গালে কষিয়ে একটা চড় দিতে কিন্তু সেই দুঃসাহস করবেনা হৃদিতা।
– সমস্যা কি আরাফ? হঠাৎ এমন করার মানে কি?
আরাফ যেন বাস্তবে ফিরে এসেছে আশেপাশে থাকা কর্মচারী গুলোর দিকে তাকিতে দূরে সরে যেতে বলে,ম্যানেজারকে হাত ইশারায় করে ডেকে বলে,
– আমি বলেছিলাম আমি যখন এখানে থাকবো তখন যেন এখানে কেউ না আসে। তাহলে এরা কি করছে?কাল থেকে যেন ভুল না হয়।
– ওকে স্যার।
ম্যানেজার মাথা নুইয়ে চলে যায়।আরাফ ধুপ করে চেয়ারে বসে পরে। কিন্তু হৃদিতা এখনো দাঁড়িয়ে আছে একদম অবাক হয়ে।
– কি হলো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?বস।
আরাফের শান্ত কন্ঠের কথা শুনে হৃদিতা বসে যায়। ভ্রু কুচকে সন্দিহান গলায় বলে,

– তুই রেগে গেলি কেন আরাফ?
– না কিছুনা। আসলে পড়াটা মাথায় ডুকছেনা।তাই সব কিছু অসহ্য লাগছে।
হৃদিতা কিছুক্ষন চুপচাপ তাকিয়ে ছিল আরাফের দিকে।গলা ঝেরে কেশে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলে,
– এভাবে না রেগে কোথায় সমস্যা বললেই পারতি শুধু শুধু সিনক্রিয়েট করার কোন মানে হয় না।
– তুই ওই ছেলের দিকে কেন তাকিয়ে ছিলি?বুঝলাম না নিজেকে আড়াল করে লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলে দেখিস।
হৃদিতার কথা শেষ হতেই আরাফের এমন বাজঁখাই সুরে বলা কথাটি মনে সন্দেহ সঞ্চার করে হৃদিতার।
– আমি কখন ওই ছেলের দিকে তাকালাম? আমি তো বিড়ালটাকে দেখছিলাম।কত সুন্দর একটা আদুরে বিড়াল।লেজটা আর কানটা দেখ এটা আমাদের দেশীয় বিড়াল না। নিশ্চই বাইরের কান্ট্রির।কত্তো আদুরেভাব ইচ্ছে করছে কোলে নিয়ে আদর করি।
আরাফ দ্রুত আবারো পেছনে তাকালো।সত্যি লোকটার কোলে বিড়ালটি সাদা অন্য জাতের।হৃদিতার বলা উওর শুনে সঙ্গে সঙ্গে মন ভালো হয়ে যায় আরাফের। হৃদিতার চোখে চোখ রেখে বলে,
– তোর কি বিড়াল পছন্দের?
– অবশ্যই।দেখ কতো আদুরে!
– ওকে তুই জাস্ট আধা ঘন্টা বসে থাক আমি আসার আগে পর্যন্ত কোথাও যাবিনা ভুলেও না।
– কিন্তু কেন?
– আহ! বসতে বলেছি বসে থাক।আমার কথার বাইরে গেলে কিন্তু উলটা পালটা কিছু হয়ে যাবে।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হৃদিতাকে রেখে আরাফ দ্রুত কফিশপ থেকে বেরিয়ে গেলালো।ফিরলো ঠিক কাটায় কাটায় বেয়াল্লিশ মিনিট পর।হাতে তার সেই বিড়ালের মতো দেখতে একই রকম দেখতে আরেকটা বিড়াল।
– নে এবার পড়া খবরদার বাইরের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকবিনা।বিড়াল দেখার একান্ত ইচ্ছে থাকলে আমার দিকে তাকিয়ে থাক।
আরাফের কান্ডে আহাম্মক বনে যায় হৃদিতা।

ঘরের রোয়াকে বসে সুপারি কাটছেন আর এক মনে বকে যাচ্ছে নেহার দাদী হৃদিতাকে।
– কইছিলম পড়ানোর দরকার নাই,শুনবো কে কার কতা।হজ্ঞলে মিললা ওই মাইয়ারে এতদূর পড়তে পাঠাও।এত পইড়া কি করবো?চাকরি করবো?চাকরি।যতসব সময় থাকতে থাকতে মাইয়াডারে বিয়া দিয়া দাও,মাথা থাইকা বোঝাটারে নামাও।

সুফিয়ার কথায় এতক্ষন চুপচাপ দাতে খিল দিয়ে বসে থাকলেও শেষ পর্যায়ে আর বসে থাকতে পারলোনা নেহা।দ্রুত বিছানা থেকে নেমে সুফিয়ার সামনে দাঁড়ায়
-এইসব কি কথা দাদী?কোন দিক থেকে হৃদিতাকে তোমার বোঝা মনে হয়?সে তো তোমার ছেলের টাকায় পরে নেই।সে নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে তবে তোমার সমস্যা কি?
– এমন মুখে মুখে তর্ক করবিনা কইলাম। ওই মাইয়াডারে বিয়া দিতে পারলে তোরে একটা ভালো ঘরে বিয়া দেওন যাইবো।ওই মাইডারে আগে বিদায় কর।
– কেন হৃদিতা থাকলে সমস্যা কি?হৃদিতা তো আমার বোন হিসেবে কোন অংশে কম নয়।
– চুপ কর!একখান ভালো পোলার সন্ধান মিলছে আমার। পোলা চাকরি করে । তার কোন যৌতুকের দাবিও নাই।আমি মাইডার কথা বইলা রাখছি।যেকোন এক সময় দেখতে আসবো, খবরদার তোরা বাধা দিবি না। নাইলে আমি এই সংসার ছাইড়া চইলা যামু কইলাম।
সুফিয়ার কথায় রাগের মাত্রা প্রবল হয়ে যায় নেহার।সামবে থাকা স্টিলের গ্লাসটাকে মাটিতে ছুড়ে মারে।তৎক্ষনাৎ ঝনঝন করে করে উঠে বিকট শব্দে।
– আম্মা তুমি এই বুড়িরে কিছু বলো, সমস্যা কি তার হৃদিতা পড়বে; আমি চাই হৃদিতা পড়বে।
কথাটা শেষ করেই আর এক মুহূর্তে না দাঁড়িয়ে দ্রুত কল পাড়ে যায় নেহা।এতক্ষন সবটাই নিরব দর্শক হিসেবে দেখছিলেন নেহার মা হামিদা।কি বলবেন তিনি? কি বলার আছে?যদি মুখ খুলে তবে তার মৃত বোন আর দুলাভাইয়ের নামে কুৎসিত কথা রটিয়ে ছাড়বেন তিনি।তার থেকে ভালো চুপচাপ দাতে দাত চেপে সবটা সহ্য করাই মঙ্গল।

ধপধপে সাদা বিড়ালটা কোলে নিয়ে তাকে আদর করতে মগ্ন হৃদিতা।আরাফ আড় চোখে তাকিয়ে হৃদিতার কান্ড দেখছে। কি সুন্দর আদুরে কন্ঠে কথা বলছে একটা বিড়ালের সাথে।আর আরাফ সে একটা জলজ্যান্ত মানুষ হয়েও কোন দিন মিষ্টি স্বরে দুইচারটা কথা বলে নি এই মেয়ে।
– এই যে বিড়াল মশাই আপনার গাল দুটো এত কিউট কেন? লেজটাতো সবচেয়ে বেশি সুন্দর।
হৃদিতার কথায় আরাফ দ্রুত জবাব দেয়,
– ওকে বিড়াল ডাকবিনা ওর নাম “হৃদি”।
-” হৃদি ” এটা আবার কেমন নাম। মানে কি আমার নাম হৃদিতা আর ওর নাম….
হৃদিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই আরাফ হাত ইশারায় তাকে থামিয়ে দেত।ভ্রু নাচিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলে,
– তুই কি ভেবেছিস আমি তোর নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছি। নো নেভার “হৃদি” মানে হৃদয়! যেহেতু এই বিড়ালটাকে হৃদয়ের শুদ্ধ কোন থেকে ভালো লেগেছে তাই তার নাম রাখলাম “হৃদি”।
আরাফের এমন বচন ভঙ্গি কিছুই মাথায় ডুকলোনা বোকা হৃদিতার। উলটো মাথা নাড়িয়ে আরাফের কথার সম্মতি জানায়।
কিছুক্ষণ পর একজন কর্মচারী কফি নিয়ে এলে আরাফ হৃদিতাকে ইশারা করে কফি নেওয়ার জন্য।কিন্তু হৃদিতা কফি হাতে নেওয়ার সাথে সাথে বিড়াল মশাই থাবা মেরে সম্পূর্ন কফি হৃদিতার হাতের উপর ফেলে।গরম গরম কফির উত্তাপে ছিটকে দাঁড়িয়ে যায় সে।
– হৃদিতা বেশি জ্বালা করছে?
– ন..না অল্প ঠিক হয়ে যাবে তুই বস
হঠাৎ আক্রমণে হৃদিতার কন্ঠ কাপঁছে। হাতের দিকটায় অসহ্য জ্বালাপোড়া করছে।
– আমি ওয়াশরুমে গেলাম।
হৃদিতা দ্রুত চলে যায়।আরাফ বিড়ালটাকে টেনে নিয়ে লেজের মধ্যে গরম কফির ছ্যাকা দিয়ে বলে,
– এবার কেমন লাগছে তোর?অসভ্য বিড়াল। আসতে না আসতেই আমার পিচ্চিটাকে আঘাত দিয়ে দিলি।অথচ আমি কি না তার নামের সাথে মিলিয়ে তোর রেখেছি।
আরাফ ম্যানেজারকে ডেকে দ্রুত একটি মলমের ব্যবস্থা করে।তারপর সবার আড়ালে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।
গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।
হৃদিতা একা দাঁড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কাদঁছে।অসহ্য যন্ত্রনায় বার বার বাম হাতে পানি ঢালছে।টলমলে চোখদুটো আর স্থির রাখতে পারলো না। বাধঁ ভেঙ্গে নিঃশব্দে কান্না শুরু করে।নেকাবটা উপরে উঠিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়।তখনি দরজায় কেউ আসার শব্দ হয়।

হৃদিতা নেকাব দেওয়ার আগেই ধড়ফড় করে রুমে ডুকে যায় আরাফ।তাকে দেখে বিষ্ফরিত চোখে তাকিয়ে থাকে সে।
– ত..তুই এখানে কি করছিস?
আরাফ কয়েক সেকেন্ড হৃদিতার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। হৃদিতার হাতে হাত রাখলেই ঝারা মেরে হাত সরিয়ে দেয় হৃদিতা।
– এইসব কি আরাফ? তুই এখানে কেন এসেছিস।
হৃদিতার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আরাফ উলটো আরো এক ধাপ এগিয়ে আসে তার দিকে। কয়েকপা পেছাতে গেলেই দেয়ালের সাথে ধাক্কা লেগে স্থির হয়ে যায়।আরাফ হৃদিতার হাতে হাত রাখলে দুজনে যেন বরফে জমে যায়। এই প্রথম কোন পরপুরুষের ছোঁয়া হৃদিতার গায়ে গেলেছে।অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে গিয়ে নিজের হাত ঝারা দিয়ে সরিয়ে নেয় কিন্তু ঘাড়ত্যাড়া আরাফ উল্টো আরো শক্ত করে হাত মুছড়ে ধরে। যার দরুনে চোখ মুখ কুচকে কেঁদে দেয় সে।
– প্লিজ লাগছে ছেড়ে দে।
আরাফ তৎক্ষণাৎ হৃদিতার হাত ছেড়ে দেয়। এবার আলতো করে ধরে মলম লাগিয়ে দেয়।এখনো ঠোঁট চেপে কাদঁছে হৃদিতা কিন্তু কেন?গরম উত্তাপে জ্বালাপোড়ায় নাকি আরাফের ছোঁয়ায় তা বোঝা গেলনা।
আরাফ ধীরে সুস্থে তাকায় হৃদিতার দিকে।তার ভেজা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে স্থির থাকতে পারলোনা আরাফ। ত্বরান্বিত তার হাত দুটো পৌছে যায় হৃদিতার দুই গালে। বৃব্ধ দুই আঙুল দিয়ে আলতো করে চোখের পানি মুছে দেয় তার।আরাফের বদ্ধতা থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছটফট শুরু করে হৃদিতা।
– একদম ভয় পাবি না। অন্য কেউ তোকে ছোঁয়ার দুঃসাহস করেনি।একমাত্র আরাফ ছুঁয়েছে তোকে।
– মানে কি আরাফ কে? যে আরাফ আমায় ছুঁয়ে দিতে পারবে।তুই কোন সাহসে এখানে এসেছিস। মলম লাগানোর হলে আমি লাগিয়ে নিতাম তুই এখানে কেন এলি?
হৃদিতার তেজপূর্ণ রাগী গলার কথা আরাফের মাঝে কোন প্রভাব ফেললো না বরং এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মনে।
– তোর কোমল মায়া মাখানো মুখটার দেখার যে
সুযোগ্য সময় ছিল না।এখন যখন হয়েছে আমি ছাড় দেই কি করে বল?
– তোর মাথা ঠিক আছে? কি বলছিস এইসব তুই? সর সামনে থেকে আমায় যেতে দে।
হৃদিতা যেতে নিলেই পথ আটকে দাঁড়ায় আরাফ।হৃদিতার ভেজা দু চোখে ফু দিয়ে বলে,
– একদম ভয় পাবিনা আমায়।তোর জন্য যদি ঘরের বাইরে সবচেয়ে নিরাপদ অপশন থাকে সেটা হলো আমি।
– তা তো দেখতেই পাচ্ছি। সুযোগ পেয়ে একা,ছিহহ!
– একদম উলটা পালটা ভাববিনা।তোকে আমি শ্রদ্ধা করি সম্মান করি স্নেহ করি।তাই তুই তোর সম্মান বজায় রেখে চলবি সবসময়।ভার্সিটির কমনরুমে মেয়ে থাকলেও নেকাব খুলবিনা খবরদার এটা আমার আদেশ।
– তুই সরবি সামনে থেকে আমার কাছে তোকে এখন অসহ্য লাগছে প্লিজ আমায় যেতে দে।
– আমি তোর অসহ্য নয় সহ্যর কারন হতে চাই। তোর কাছে থেকে দূরে নয় আরো কাছে আসতে চাই কিন্তু কি করে একটু বলবি আমায়?

আরাফের এইসব আবেগের কন্ঠের কথা সব হৃদিতার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত আরাফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে যায়। টেবিলের উপর থেকে লেডিস ব্যাগটা নিয়ে কফিশপ থেকে সোজা মেইন রাস্তা ধরে হাটতে থাকে।মনে মনে সিধান্ত নেয় আরাফকে আর পড়াবেনা। ভুলেও আরাফের সামনে আসবেনা সে।
এদিকে আরাফ তার আঙুল গুলোতে আলতো করে ঠোঁট বুলিয়ে দেয়।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে ভর দিয়ে মাথা ঝুকে বিড়বিড় করতে থাকে,
– তোর কান্নার ফলে লেপ্টে যাওয়া চোখের কাজল আমার সব উলট পালট করে দিচ্ছে।একদিন তোকে আমার করে পাই,সেদিন, নিজের দুই হাত দিয়ে তোকে সাজাবো।লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, ঝকঝকে লাল কাচের চুড়ি, পায়ে আলতা, খোলা এলো মেলো চুল,ঠোঁট ভর্তি লেপটানো লাল লিপস্টিক,এলোমেলো হয়ে থাকা শাড়ির আঁচল বিছিয়ে; ঘুটিয়ে বসে কাদবি তুই আর তোর সামনে আমি বসে তোকে শুধু নিষ্পলক ভাবে দেখবো।তোর লেপটানো চোখের কাজলে আরেকবার উম্মাদ হতে চাই।আজকের মতো আবেগের সুরে শত এলোমেলো জড়ানো কন্ঠে তোর সাথে কথা বলতে চাই! কিন্তু সুযোগ পাবো কি আমি?

আরাফ বিড়াল হাতে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় কপিশপ থেকে। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে যেন বাস্তবতায় ফিরে আসে।পক্ষান্তরেই মনে পড়ে যায় সে তো মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং করেই সুখ পায়।তাহলে হৃদিতা তার জীবনে কী যে তার আবেগ বাড়িয়ে দেয় শত গুনে, অনুভূতি গুলো নাড়িয়ে দেয় ক্ষনে ক্ষনে!
#চলবে….
:
শব্দ সংখ্যা১৮৪৮
🍂পর্বটা কেমব হয়েছে জানাবেন..!

#শব্দহীন_অনুভূতি
#পলি_আনান
#পর্ব_৬

মাগরিবের আযানের ধ্বন্নি চারিদিকের পরিবেশ মুখরিত হয়ে আছে।সন্ধ্যার শেষ সময়টুকু পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের নীড়ে।পাখির কলরবে গুঞ্জিত পরিবেশটা।আরাফ হাতে থাকা সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে সামনের দিকে হাটতে থাকে।আশে পাশের মানুষ গুলোর ব্যস্ততা যেন সন্ধ্যার সাথে সাথে বেড়েই চলেছে।একদল বাচ্চা হইহই করতে করতে টুপি পরে মসজিদের দিকে যায়। নিশ্চই মাগরিবের নামায আদায় করবে তারা।ঘাড় ঘুরিয়ে সমুজ্জ্বল মসজিদটার দিকে তাকিয়ে মন-প্রাণ প্রশান্তিতে ভরে যায় আরাফের। সাধারণত তার তেমন একটা নামায আদায় করা হয় না। বিশেষ করে জুম্মা নামায ছাড়া নামায পড়তে দেখা যায় না আরাফকে। শুধু আরাফ না এনায়েত বাড়ির পুরুষদের জুম্মা ছাড়া বাদবাকি দিন গুলোতে নামায পড়তে দেখা যায় না এটাই সত্য।তারা এতটাই কাজে নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছে ইহকালে সুখটাই তাদের জন্য বড়।আর সেই ধারাবাহিকতা আরাফের মাঝেও বিদ্যামান।এই নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ আরাফের জেঠিমা হুমায়রা।তিনি সবসময় একটা কথাই বলবেন”যে ঘরের বান্দা গুলো নিয়মিত নামায আদায় করে না সেই ঘরে আল্লাহর নেয়ামত থাকেনা।সুখ শান্তি থাকেনা।ব্যাক্তিগত জীবনে যে বান্দা নামায আদায় করেনা তার মনে,দিলে কোন প্রশান্তি বা সুখ শান্তি থাকেনা।নামায সকল সুখের ভরসার মূল!”
কথাটা অত্যন্ত সত্যি।এনায়েত বাড়িতে কোন সুখের ছোঁয়া নেই।পুরো বাড়িতেই চলে একজনের সাথে অন্য জনের মত বিরধীতা,আড়ালে কূটকচাল। শুধু মাত্র নোমানের মা হুমায়রা, আদীব আর আইদা বাদে সবাই যেন একএকটা পিচাশ।

আরাফ সিগারেটটা রাস্তার মাঝে ছুড়ে সিধান্ত নেয় মসজিদে আজ মাগরিবের নামায আদায় করবে।কেননা তার মনের মাঝে বর্তমানে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।হৃদিতা তখন রেগে বেরিয়ে গেলে তার কিছুক্ষণ পর আরাফ যখন বের হয় তখন হৃদিতার দেখা মেলে না।অনেক্ষন রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশ খুজঁতে থাকে, বার বার ফোন দিয়ে থাকে কিন্তু হৃদিতা ফোন রিসিভ করেনা। তাই অস্থিরতায় একের পর এক সিগারেট ফুঁকছিল সে।
দ্রুত ওযু করে মসজিদে প্রবেশ করে আরাফ। বড় হওয়ার পর কখনো এইভাবে মসজিদে এসে তার মাগরিবের নামায আদায় করা হয় নি।আজ কত বছর পর সে নামাযে দাঁড়াবে।কারনটা কি হৃদিতা? হৃদিতার কারনেই তো তার মনের মাঝে অস্থিরতা আর অস্থিরতা নিরাময় করতে নামায পড়বে বলে সিধান্ত নেয় সে।সত্যি আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।

রাগে সারা শরীর থরথর করে কাপঁছে হৃদিতার।কি করে পারলো আরাফ এমন একটা কান্ড ঘটাতে?আসলে তার নিজের ভুল। এমন একটা গাজাখোরি ছেলেকে তার বিশ্বাস করা কিছুতেই উচিত হয়নি। সন্ধ্যার আযান শেষে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে। রাগের মাথায় আজ অন্য টিউশনি গুলোতে আর যাওয়া হয়নি তার।মেইন রাস্তা পেরিয়ে বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে ছিল সিএনজির জন্য তাই এতটা দেরি হয়েছে।শটকাটে বাড়ি ফেরার জন্য ভেতরের একটি নিরিবিলি রাস্তা বেছে নেয় সে কিন্তু বোকা হৃদিতার মাথায় আসেনি মাগরিবের পরে নিরিবিলি রাস্তাটা কতটা খারাপ হতে পারে।

কিছুক্ষন যাওয়ার পর হৃদিতার চোখে পরে কয়েকটি ছেলে কাটা গাছের গুড়ির উপর বসে আছে।শুনসান নিরিবিলি রাস্তায় ওই ছেলেগুলোর কথা ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছেনা।তড়াক করে হৃদিতার মাথায় ছেলে গুলোকে নিয়ে উলটা পাল্টা চিন্তা আসতে থাকে।চুপচাপ রাস্তার এক পাশ ধরে হাটতে হঠাৎ করেই সব গুলো ছেলে হৃদিতাকে ঘিরে ধরে।

– কিরে হৃদিতা আজ হঠাৎ এই রাস্তায় তুই?
অন্ধকারে ছেলেটির চেহারা বোঝা না গেলেও গলার কন্ঠ স্বর স্পষ্ট বুঝতে পারে সে। এই ছেলেটা “নবীন”।এলাকার মেয়েদের উত্যক্ত করাই তার একমাত্র কাজ।হৃদিতাকে বেশ কয়েকবার বাজে প্রস্তাব দিয়েছে, অবশেষে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব ও পাঠিয়েছে।এমন কুৎসিত চরিত্রের ছেলেকে নিজের স্বামী হিসেবে ভাবতেই সারা শরীর গুলিয়ে উঠে তার। তাই সেদিন অপমান করেই বাড়ি থেকে বের করে দেয় নবীন কে।আজ যখন নবীন তাকে একা পেয়েছে নিশ্চই খারাপ কোন মতলব আটঁবে।
– কিরে এলাকার সবচেয়ে ভদ্র মেয়ে কথা বলছিস না কেন?
-আমার পথ ছাড়ুন নবীন ভাই।
– তোর পথ ধরে রাখার কি সাহস আমার আছে?বরং তুই আমার পথ আটকে রেখেছিস। তোর নিরবতা তোর সরলতায় আমি ফিদা।বিশ্বাস কর ফিদা।
– এইসব বলে আমার সময় নষ্ট না করলেও পারেন দয়া করে রাস্তা ছাড়ুন।
– উহ!রাস্তা ছাড়া যাবেনা।সারাজীবনের জন্য আমার না হলেও অন্তত এক রাতের জন্য হয়ে যা। কথা দিলাম কেউ কিচ্ছু যানবেনা।
নবীনের এমন কুৎসিত কথা শুনে দু কানে হাত দিয়ে চেপে ধরে হৃদিতা।সারা শরীরে ঝংকার দিয়ে উঠেছে আজ কি হবে তার সাথে আজ?নবীন তো তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না।
– আল্লাহর দোহায় নবীন ভাই আমাকে ছেড়েদিন এইসব করার হলে পতিতা পল্লীতে যান। আমায় নিয়ে এইসব বাজে চিন্তা ধারা করা বন্ধ করুন।
– প্রশ্নই আসেনা।তাদের কাছে গেলে কি তোকে পাওয়ার সুখ পাবো?
নবীনের এমন কথায় দু পা পিছিয়ে যায় হৃদিতা তখনি কারো চওড়া বুকের সাথে ধাক্কা লাগে তার পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে নবীনের দলের লোক।ভয়ে হু হু করে কেঁদে দেয় অসহায় হৃদিতা। তার কান্না দেখেই বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসতে থাকে লোক গুলো।
নিজেকে বাচাঁতে সে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে।কিন্তু বেশি দূর যাওয়ার আগেই পেছন থেকে নেকাব টেনে ধরে নবীন। নেকাব ছুড়ে মেরে খোলার আগেই ‘আল্লাহ’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠে সে।সুনশান নিরিবিলি রাস্তায় কেউ শুনতে পায় না হৃদিতার চিৎকার।তাদের মাঝে কিছুক্ষন ধস্তাধস্তি হয়। পাচঁটা ছেলের সাথে একা একটা মেয়ের পেরে উঠা কিছুতেই সম্ভব নয় তবুও আত্নরক্ষায় কাউকে কামড় বা কাউকে লাত্তি দিতে থাকে হৃদিতা।এক পর্যায়ে সেই নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে ছুটি আসে তিনটা মাইক্সো গাড়ি।গাড়ির হেডলাইটে কয়েকটি ছেলের সাথে একা একটা মেয়ের ধস্তাধস্তি দেখে গাড়ি থামাতে বলে নোমান।তার আর বুঝতে বাকি নেই একা একটা মেয়েকে পেয়ে ছেলে গুলো কি করতে চাইছে।দ্রুত গাড়ি থেকে নোমানের সব দলবলকে নেমে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের দেখেই ছুটে পালাতে নেয় নবীনের দলের লোকেরা কিন্তু তার আগেই নোমানের লোক তাদের ধরে নেয়।

হৃদিতা রাস্তায় হাটুমুড়ে বসে পরে।এখনো তার মুখ থেকে নেকাব সরেনি।চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।তখনি তার মুখে কেউ মোবাইলের ফ্লাশ লাইটের আলো ছুড়ে দেয়।পিট পিট করে চোখ খুলতেই নোমানকে সামনে দেখে ভয়ে শরীর আরো অসাড় হয়ে আসে।নোমান, যে কিনা নিশি রাতের আঁধারে মেয়েদের নেশায় মত্ত থাকে।একপাল কুকুরের হাত থেকে সে বেঁচে গেলেও নোমানের হাত থেকে তাকে বাচাঁনোর সাধ্য কারো নেই।যদি নোমানের পৈচাশিক সুখ পাওয়ার লোভ মনে জেগে উঠে তখন?তখন কি করবে হৃদিতা।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্নার সুরটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সে কিন্তু পারছেনা।
– এই তুমি আরাফের ক্লাস মিট হৃদিতা না?
সঙ্গে সঙ্গে আবারো চোখ খুলে তাকায় সে। নোমানের দিকে তাকিয়ে মাথা নুইয়ে সায় দেয়।
– একা এই নিরিবিলি রাস্তায় কি করছো তুমি? দেখি উঠে দাঁড়াও।

হৃদিতা হেলেদুলে নিজেকে স্থির করে দাঁড়ায়।গায়ের বোরকা ঝেরে মাটি থেকে ব্যাগ হাতে তুলে নেয়।
– আরাফ কে পড়া শেষ করে এদিক দিয়ে ফিরছিলাম যেনো বাড়িতে তাড়াতাড়ি যেতে পারি তাই কিন্তু ভাবিনি এতটা রাত হয়ে যাবে।
– বোকা মেয়ে, কান্ড জ্ঞান নেই নিজের খেয়াল নিজেই নিতে পারো না।
নোমান দ্রুত গাড়ি দিকে এগিয়ে যায় পানির বোতল হায়ে নিয়ে আবারো হৃদিতার কাছে ফিরে আসে। পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,
– নাও পানি টুকু শেষ করো।ওদের সাথে তোমার কি সমস্যা?
নোমানের প্রশ্নে ঠোট কামড়ে কাঁদতে থাকে সে।
– কি হলো আমার প্রশ্নের উওর দাও তারপর যত ইচ্ছা কেঁদো।আমার এত সময় নেই ফটাফট উওর দাও।
– নবীন আমায় খারাপ প্রস্তাব দিয়েছে আমি রাজি হইনি তাই…
কথা শেষ করার আগেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে হৃদিতা।নোমান বিষটি বুঝতে পেরে নবীনের সামনে যায়।তারপর কোন কথা না বলেই এলোপাতাড়ি থাপড়াতে থাকে।

– লজ্জা লাগেনা এমন মেয়ের দিকে হাত বাড়াস।প্রয়জনে পতিতা পল্লিতে যাবি খবরদার আমার এলাকার মেয়েদের দিকে যদি আরেকবার চোখ তুলে তাকাস তবে খুন করে দেবো।
নোমান কিছুটা দম নেয়।নবীন সহ তার দলের লোকেরা মাফ চাইতে থাকে তাদের কথা না শুনে বরং নোমানের লোকদের নির্দেশ দেয় সবাইকে যেন আচ্ছা মতো ধৌলাই দেয়।
নোমান হৃদিতার কাছে গিয়ে ইশারা করে গাড়িতে উঠার জন্য কিন্তু প্রথমে নারাজ হলেও পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে রাজী হয়।অবশেষে নোমান বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করে হৃদিতাকে তার বাড়ি পৌছে দেয়।গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।

হৃদিতাকে পাগলের মতো ফোন মেসেজ করেও কোন খোঁজ পেলনা আরাফ।নেহাকেও বেশ কয়েকবার কল করা হয় কিন্তু প্রতিবারেই নেহার ফোন বন্ধ বাতায়।আড্ডা মাস্তি কোন কিছুই যেন আরাফের মন ফেরাতে পারছেনা।এদিকে বন্ধুরা যতই ঘনিষ্ঠ হোক তাদের কিছুতেই হৃদিতার কথা বলা যাবে না।কেননা একবার যদি ভুল ক্রমে নোমানের কানে উঠে যায় আরাফ হৃদিতার প্রতি দূর্বল তাহলে বিপদ এ কূল ও কূল দুই কূলেরি সমান।
একের পর এক সিগারেট ফুঁকছে আর হৃদিতাকে নিয়ে চিন্তায় মশগুল হচ্ছে।একা একা সিগারেট ফুকঁতে ভালো না লাগায় এগিয়ে যায় গেটের সামনে থাকা দারোয়ানের কাছে।কিছুক্ষন গল্প করে এবার দুজনে মিলেই সিগারেটের নেশায় মগ্ন হয়ে যায়।তখনি গেট দিয়ে নোমানের গাড়ি ডুকে।আরাফকে দেখেই গাড়ি থেকে নেমে যায় নোমান।

– কত দিন বলেছি সিগারেটের নেশা ছেড়ে দে শুনবিনা তুই আমার কথা।
– তুমি কি ছেড়ে দিয়েছো দাদাভাই?বরং তোমার আরো বিষাক্ত নেশা গুলো বেশি।
– আমার নেশা আছে বা কি নেই তা দিয়ে কোন সমস্যা না কিন্তু তোর এইসব নেশায় সমস্যা হলে আমার বোনটার ক্ষতি। প্রভার ভবিষ্যত তুই তোকে যেন ফিট এন্ড ফাইন থাকতে হবে।
নোমানের কথা শুনেই স্থির হয়ে যায় আরাফ।তার রাগ লাগছে, ভীষণ রাগ লাগছে তার।যেকোন কথার উলটা পিঠে কি নোমানকে প্রভার কথা আনতেই হবে?যতসব বিরক্তিকর আলোচনা।
ঘাড় ঘুরিয়ে আরাফ চলে যেতে নিলেই নোমান তাকে ডেকে বলে,
– আরাফ শোন আজ একটা কান্ড হলো।হৃদিতাকে রাস্তায় কিছু গুন্ডারা এটাক করে।
আরাফ চমকে তাকায় নোমানের দিকে তার দুনিয়া যেন ওলট পালট হয়ে গেছে।শ্বাস আটকে আসছে।
– ক.কি বলছিস কখন?
নোমান একে একে সবটা খুলে বলে আরাফ কথা।তারপর ফ্রেশ হতে ঘরে চলে যায় এদিকে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আরাফ সে ভাবছে হৃদিতার মনের অবস্থা।তখনি হেলেদুলে পা নাচিয়ে গলায় শেকল বাঁধা বিড়ালটি নিয়ে এগিয়ে আসে আইদা আরাফের দিকে।আরাফ হৃদিকে কোলে তুলে নিয়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়।
– ভাইয়া ব্যাপারটা কি হঠাৎ তুমি বাড়িতে বিড়াল নিয়ে এলে তার উপর মেয়ালি নাম রেখেছো “হৃদি” বিষয়টা বুঝিয়ে বলো প্লিজ!
– বোঝানোর কিচ্ছু নেই। এমনিতেই ভালো লেগেছে তাই নিয়ে এসেছি।
আরাফ হৃদিতে নিয়ে বাগানের দিকটায় হাটতে শুরু করে তার সাথে আইদা, দুজনের মাঝে চলে নানান কথা কিন্তু গোপনে আরাফের মাথায় ভর করে আছে হৃদিতার চিন্তা।

কিছুক্ষণ পর আরাফ ঘরে ডুকতেই লিবিং রুমে বাড়ির ছোট থেকে বড় সবাইকে দেখতে পায়। শুধু মাত্র সেখানে উপস্থিত নেই সে এবং আইদা।সবার দিকে একবার তাকিয়ে উপরে চলে যেতে নিলেই আদীব আরাফকে ডেকে নিয়ে আসে।সবাই মিলে শুরু করে গোল মিটিং।আজকের বিষয় ব্যবসায় সফলতা অর্জনে বাড়িতে বিশাল করে পার্টির আয়োজন করা হবে।আরাফের বাবার নির্দেশে তার ছোট চাচা জসীম এনায়েত সবার নামের লিস্ট টুকতে থাকে। কার কয়জন গেস্ট আসবে এর একটা প্রাথমিক লিস্ট করা হচ্ছে। সবার হিসাব নেওয়া হলেও আরাফকে জিজ্ঞেস করা হলো না তার কোন গেস্ট আছে কি না?

– একি চাচ্চু বাড়িতে এতো বড় আয়োজন সবার বন্ধু বান্ধব আসবে,সবার লিস্ট নিলে কিন্তু আমার টা নিলে না কেন?
জসীম কিছু বলার আগেই গম্ভীর কন্ঠে তার বাবা জহির বলে,
– আমি জানি তোমার কোন ফ্রেন্ড,ওই গাজাখোর ছেলে মেয়ে গুলো।তুমি ভালো করেই জানো আমি ওই ছেলে মেয়ে গুলোকে পছন্দ করিনা।তাদের এই বাড়িতে আসা নিষিদ্ধ। তাহলে তোমার লিস্ট নেওয়া হবে কেন?
জহিরের কথা তীব্র রাগের সঞ্চার হয় আরাফের মনে। একদিকে হৃদিতার চিন্তায় তার মাথা ঠিক নেই তার সাথে জহিরের এমন গায়ে লাগানো কথা বার্তা,
– বাবা একটু ভদ্র ভাষায় কথা বলো।তারা আড্ডা মাস্তি করলেও তাদের চরিত্র অন্তত ঠিক আছে এই বাড়ির ছেলে গুলোর মতো নোংরা না।

– তুমি বাইরের ছেলের সাথে এই বাড়ির ছেলের তুলনা করো কোন সাহসে? আগেই বলেছিলাম তোমার ওইসব থার্ড ক্লাস ফ্রেন্ড গুলোকে আমার মোটেও পছন্দ না তাদের এই বাড়িতে আসা চলবেনা।
আরাফের রাগ যেন ক্ষনে ক্ষনে বেড়েই চলছে হৃদিকে আইদার কোলে দিয়ে রাগে মাথার চুল টেনে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
– আমি কিচ্ছু ভুল বলিনি বাবা, ঘরের ছেলের সাথে বাইরের ছেলের তুলনা করাই যায়।এই বাড়িতে চারটা ছেলে আছে আমি,নোমান ভাই,নিয়াজ,আদীব।তাদের মাঝে আদীব হয়তো সবার সেরা কিন্তু দেখবে কয়েকদিন পর ভার্সিটিতে গেলে সে নিজেও বিগড়ে যাবে।ছেলেটা ভালো থাকবে কি করে তার বড় দাদাভাই গুলোই ভালোনা সেখানে এই ছেলের ভদ্রতা টিকে থাকার আশা বাদ দিলেই চলে।তোমার বাড়ির এই ছেলে গুলোর চাইতেও আমার ফ্রেন্ড গুলোর চরিত্র, অভ্যাস,আচার আচরণ অনেক ভালো।তাই তোমার ভুলভাল চিন্তাধারা আমার ফ্রেন্ড গুলোর চরিত্র এক চুল পরিমানেও পাল্টাতে পারবেনা।আর তাদের খারাপ বলে চিল্লাতে থাকলেও তারা খারাপ হয়ে যাবেনা
– যতই তাল বাহানা পাকাও তুমি।আমি কিছুতেই এই বাড়িতে ওদের আসার পার্মিশন দেবোনা। তোমার পার্টি করার হলে, টাকা দিয়ে দেবো তাদের সাথে পার্টি করবে।

আরাফ হৃদিকে আবারো কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করতে থাকে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে,
– তোমাদের পার্টি তোমরা করো বাড়ির এই আয়োজনে আমি থাকবো না।আগেই বলেছিলাম আমার ফ্লাট আমায় দিয়ে দাও কথা দিলাম এই বাড়ির সিমানাও মাড়াবো না। উপপ্স, জেঠিমা আর আইদা,আদীবকে না দেখলে তো আমার পেটের ভাত হজম হবে না শুধু তাদের সাথেই দেখা করতে আসবো।
– তোমার ফ্লাট তুমি পাবেনা এই বাড়িতেই থাকতে হবে তোমায়।

আরাফ কথা না বাড়িয়ে চলে যেতে উদ্ধৃত তখনি তার মা মায়মুনার গলা ভেসা আসে তার কানে,
– কি ছেলে জন্ম দিয়েছি আমি যে ছেলে তার জেঠিমাকে দেখতে এই বাড়ির চৌকাঠে আসবে অথচ আমায় না।এই দিন দেখার ছিল আমার?
– অবশ্যই তুমি হয়তো আরো বাজে দিন দেখবে মা।কারন তুমি তো তোমার কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছেলের খোঁজ কি তোমার নেওয়া হয়?আর কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা আমি গেলাম।
আরাফ দ্রুত তার রুমের দিকে পা বাড়ায়।হৃদিতাকে কল করতে হবে যতক্ষণ না তার খোঁজ পাচ্ছে কোন শান্তি হবে না তার।

এদিকে রাতে বাড়ি ফিরেই দপাশ করে বিছানায় বসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে হৃদিতা।দ্রুত নেকাব ছুড়ে সাইডে মেরে,পাশে থাকা জয়গা উপড় করে ঢকঢক করে পানি পান করে দ্রুত গলা ভিজিয়ে নেয়।তার এমন উদ্ভট আচরনে অবাক না হয়ে পারেনা বাকি সবাই। নেহাসহ বাকিরা যখন যানতে চায় তার কি হয়েছে সে শুধু বলেছে কুকুরের দৌড়ানিতে এতটা ভয় পেয়েছে।জামা কাপড় নিয়ে তারপর যায় পুকুর পাড়ে। যতক্ষন না গোসল করবে ততক্ষন শরীরে পাপীদের ছোঁয়া গুলো কিছুতেই যাবেনা।

কেটে যায় তিনদিন এই তিনদিন আরাফ বেশ কয়েকবার হৃদিতার কাছে ফোন করেছে কিন্তু প্রতিবারেই ফোন বন্ধ।ব্যাকুল আরাফ আর কোন উপায় না পেয়ে নেহাকে ফোন করে আর ছলে বলে কৌশলে জানতে পারে, সেদিনের রাতের পরে হৃদিতার গা কাপিয়ে ভীষন জ্বর উঠেছে।বর্তমানে কিছুটা সুস্থ সে।
হৃদিতার অসুস্থতার কথা শুনে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলো না সে মনে মনে সিধান্ত নেয় যে করেই হোক হৃদিতার সাথে দেখা করবে।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরে মোবাইল হাতে নিতে মেসেজ চেক করতে থাকে নোমান। তখন মাইশার দেওয়া একটি মেসেজ চোখে পড়ে তার,

“এই যে, ভাবওয়ালা ছেলে শুনো,আমি বিডিতে আসছি।কাজী, বিয়ের শাড়ি গহনা তৈরি রেখো। আজকেই বিয়ে সেরে ফেলবো।এইভাবে দূরত্ব আর মানা যাচ্ছেনা।তুমি দিন দিন মাত্রা পেরিয়ে অসভ্য হয়ে যাচ্ছো আর তোমাকে ঠিক করতে আমাকে প্রয়োজন তাই আমি আসবো।আমি আসছি ভালোবাসা আরেকটু দৈর্য্য ধরো.!

মেসেজটি পড়ে নোমান স্থির হয়ে যায়।মাথায় বুদ্ধি গুলো যেন লোপ পেয়েছে।এই পাগল মেয়ে বিডিতে আসলে এবার নির্ঘাত কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ছাড়বে কি করবে এবার নোমান?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here