শব্দহীন_অনুভূতি,পর্ব_১৭,১৮

শব্দহীন_অনুভূতি,পর্ব_১৭,১৮
পলি_আনান
পর্ব_১৭

আরাফের ঘুম ভাঙে ভর দুপুরে।হৃদিতা আইদা আর আদীবের সাথে মেঝেতে বসে লুডু খেলছিল।উপরে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে আরাফ।আইদার গুটি কেটে দেওয়ায় হুট করেই রেগে যায় আদীব।
– এই বেয়াদব আমার পাঁকা গুটি কাটলি কেন তুই?আমি না তোর ভাই।
– ভাই হয়েছিস তো কি হয়েছে, খেলা তো খেলাই। খেলার সময় আপন পর ভাই বান্ধব বিচার করতে নেই।
– সময় সুযোগ আমারো আসবে দেখেনিস।তখন তোর কি হাল করি মনে রাখিস,
আদীব আর আইদার ঝগড়া বেড়াই চললো তাদের থামাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হৃদিতা।আইদার মুখ চেপে ধরতেই আইদা হৃদিতার হাত কামড়ে দেয় এবার দুজনের মাঝে আবারো তুমুল ঝগড়া বিরক্ত হয়ে হৃদিতা এবার জোরে ধমক দেয়।তখনি চোখ মুখ কুচকে পীট পীট করে ঘুম থেকে উঠে যায় আরাফ।উঠে বসতে নিলেই মাথায় প্রচন্ড চাপ এবং ব্যাথা অনুভব করে।
হৃদিতা বুঝতে পেরে আইদা আর আদীবকে চলে যেতে বলে তাদের সাথে সাথে হৃদিতাও নিচে নেমে যায়।আরাফের জন্য লেবুর শরবর বানিয়ে আবার উপরে ফিরে আসে।

– নিন এটা ,ঝটপট পেটে চালান করে দিন।
আরাফ বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে নেয়।
-মাথা ভারি ভারি লাগছে কেন উফফফ!
– রাত দিন পার করে যদি ছাই পাশ মদ গেলা হয় তাহলে কি মাথা ঠিক থাকার কথা?আমার তো মনে হয় না।
আরাফ বালিশটা সরিয়ে নিজের দিকে তাকায়।কাল রাতে যে শাট পড়া ছিল এখনো গায়ে সেই শাট।
– আরাফ এটা দ্রুত পেটে চালান কর।
আরাফ মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে।দ্রুয় লেবুর শরবতট মুখে পুরে ঠোঁট বাকিঁয়ে নেয়।
– দূর, জঘন্য লাগে একটু চিনি দিলে কি ক্ষতি হয়ে যেতো।
হৃদিতা প্রত্যিত্তর করলো না চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।আরাফ মাথায় হাত দিয়ে হৃদিতার কান্ড দেখছে।সে ভাবছে কাল রাতের কথা মাতাল নেশার ঘোরে থাকা কালীন হৃদিতার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলেনি তো?
– হৃদিতা এই হৃদিতা,
আরাফের জোরে চিৎকারে সারা রুমে প্রতিধ্বনি হতে থাকে।হৃদিতা দ্রুত ছুটে এসে আরাফের সামনে দাঁড়ায়।
– কি সমস্যা তোর চিৎকার দিচ্ছিস কেন?
– আমি কাল বাড়ি ফিরলাম কখন?
– রাতের তিনটায়, কেন?
– তোর সাথে কিছু করেছি আইমিন রুড বিহেব!
– না।
আরাফ থামলো। কয়েকবার ঢোক গিলে এদিক সেদিক চোখ বুলালো। আগে আরাফ যখন নেশা করে বাড়ি ফিরতো তখন রুমের সব কিছু মাঝে মাঝে ভাঙচুর। তার বাবাকে গালাগাল করতো।তখন হুমায়রা এসে আরাফকে কন্ট্রোল করতো। কিন্তু এবার কি করেছে সে, হৃদিতা হঠাৎ আজ এমন চুপচাপ গম্ভীর কেন?আরাফ আরো কিছুক্ষন ভাবতে থাকে।নেশা অবস্থায় তার পেট থেকে সত্যি কথা বেরিয়ে যায় আরাফ কি কোন সত্যি কথা বলে ফেলেছে তার সম্পর্কে হৃদিতাকে?সে যে ভালোবাসে! কথাটা ভাবতেই আরাফ হৃদিতার দিকে তড়াক করে তাকায়।

– হৃদিতা আমি কি তোকে কিছু বলে ফেলেছি?আইমিন আমার মনের কিছু,ধর এমন কথা যেটা তুই জানতি না।
আরাফ ঢোক গিলে। হৃদিতা তার দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সে ভেবছে বলবে কি, বলবেনা।অবশেষে হৃদিতা সিধান্ত নেয় আরাফের কালকের কথা হৃদিতা কিচ্ছু বলবে না।

– না কিচ্ছু বলিস নি।
– মানে কি আমি রুমে এলাম আর ঘুমিয়ে গেলাম?
– না তাও না।
– তবে?
– একটু মাতলামি করেছিলি কিন্তু আমি পাত্তা দি নি।কান টেনে বিছানায় ফেলে ঘুমাতে বলেছিলাম তুইও ঘুমিয়ে গেলি।
– স্ট্রেঞ্জ!
হৃদিতা কথা বাড়ালো না আবারো বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।তখনি আরাফ আবারো ধমক দিয়ে তাকে রুমে ডাকে।

– কিরে আমি বলেছিলাম না এই রুমের বাইরে যাবি না। তাহলে রুম থেকে বের হলি কেন?
– তোর মতো মাতালরা দুপুরেও উঠে না। তারা রাত জেগে নেশা করে আর দিনের শেষ পর্যন্ত ঘুমায়।সো চাপ নিস না।
– নিয়াজ ভাইয়ের ঘুম এখনো ভাঙেনি?
– না।বাই দা ওয়ে তুই এখন কি খাবি?দুপুরের নাস্তা নাকি সকালের ভাত!
হৃদিতার মশকরা বুঝতে আরাফের একটু সময় লাগলো। ঠোঁট বাকিয়ে গাল চুলকে বলে,
– ভুল বলেছেন জনাবা,দুপুরের ভাত আর সকালের নাস্তা হবে।
– তোর মতো মাতালের বউ হলে আরো কত কি ভুলবো তার হিসেব নেই।

আরাফ মাথা নিচু করে হাসলো। হৃদিতা তবে মুখ দিয়ে স্বীকার করলো সে আরাফের স্ত্রী।
– কিরে হাসছিস কেন?উওর দে কি আনবো তোর জন্য?
– আমি এই বাড়ির জল টুকুও মুখে তুলবো না। বেইমান, বেইমান এই বাড়ির সদস্যরা।
হৃদিতা গাঢ় করে শ্বাস ছাড়ে।আরাফ কাল সন্ধ্যা থেকেই রেগে আছে তবে সেই রাগ আবার সাত সকালে চওড়া না হয়ে যায়।
– একটু আগেই তো লেবুর শরবত খেলি এখন বলছিস মুখে তুলবি না

আরাফ কথা বাড়ালো না ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকে দরজা আটকে জোরে চিল্লিয়ে বলে,
– তোর হাতে বিষ খেতেও প্রস্তু আমি।

হৃদিতা মিষ্টি করে হাসে। আলমারি থেকে আরাফের জামা নামাতে নামাতে বিড়বিড় করে বলে,
– ভাঙবি তবু মচকাবি না।

নোমানের সামনে তার মুখোমুখি বসে আছে মাইশা।নোমানের দিকে সে তাকিয়ে আছে অপলক ভাবে। নোমানের আচার আচরন ভঙ্গিমা সব যেন তাকে বার বার মুগ্ধ করে তুলছে।তার দৃষ্টি অনুসরন করে তাকায় নোমান।
– কি সমস্যা তোমার এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
– না কিছু না।
দুজনেই আবার চুপ থাকে।কয়েক মিনিট পর নোমান বলে,
– কাজটা তুমি একদম ঠিক করো নি।
– কোন কাজ?
– এইভাবে অফিসে না আসলেও পারতে।তোমাকে বুঝতে হবে, আমি রাজনৈতিক দলের লোক আমাকে নিয়ে কোন ছুতো পেলেই নিউজ হয়ে যাবে শত্রু পক্ষ তিল থেকে তাল করবে। তাই পরবর্তীতে যা করবে ক্যায়ারফুলি করতে হবে।
– সরি নোমান ভুল হয়ে গেছে।আর ভুল হবে না।আসলে তোমায় দেখতে ইচ্ছে হলো তাই আর নিজেকে সামলাতে পারিনি।

– নোমানের বউ হতে উঠে পড়ে লেগেছো আর দৈর্য্য নামক জিনিসটা তোমার মাঝে নেই তা তো মানতে পারলাম না এনিওয়ে কি খাবে চা নাকি কফি?
-না লাগবে না কিছু।
মাইশা দ্রুত তার পার্স থেকে ছোট্ট একটি বক্স বের করে বক্সের ভেতরে একটি আংটি।নোমানের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরতেই দ্রুত ঝটপট আঙুলে আংটি ঢুকিয়ে দেয় মাইশা।নোমান অবাক হয়ে তাকালে মিষ্টি করে হাসে মাইশা।
– কেমন হয়েছে?
– তুমি এটা কেন পড়ালে?
– দেখো সেইম আঙটি আমার হাতে।
মাইশা এবার সবচেয়ে আশ্চর্যের কাজটা করলো নোমানের হাত টেনে তার অধর ছুঁয়ে দিলো সেই হাতে।দ্রুত চেয়ার থেকে উঠে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যতি হয়।
– আমি আসি এবার।
মাইশা দ্রুত চলে যায় অফিস থেকে এদিকে নোমান স্তম্ভিত হতে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।আঙুলে থাকা আংটিটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে,
– কেন এই বাঘের রাজ্যর রানী হতে চাইছো তুমি?ক্রমশ দূর্বল করছো আমায়।মাঝে মাঝে মনে হয় আমার পাপী জীবনে তোমায় না জড়াই আবার মাঝে মাঝে মনে হয় শক্ত করে জড়িয়ে রাখি তোমায়।তুমি আমার সত্যি নেশা অন্য রকম নেশা।
গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।
নোমান আংটিটায় নিজের ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়।বিড়বিড় করে বলে,
– মাই লাভ!

আরাফ ওয়াশরুম থেকে বের হতেই হৃদিতাকে খাওয়ার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা ধমক দেয়।
– এই এখানে খাবার এনেছিস কেন?বললাম না খাবো না।
– আপনার জন্য কে এনেছে এগুলো আমি খাবো।

আরাফ আড় চোখে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।বিছানায় বসে চুল ঝাকরাতেই হৃদিতা এগিয়ে এসে আচঁল দিয়ে আরাফের মাথা মুছতে থাকে।হৃদিতার হঠাৎ কান্ডে আরাফ ভড়কে যায়। এক রাতেই এত চেঞ্জ কি করে হলো হৃদিতা।আরাফের অবাক চাহনী দেখে ঠোঁট বাকিয়ে তার পাশে বসে যায় হৃদিতা।
খাওয়ার থালা হাতে তুলে আরাফের মুখের সামনে খাওয়ার তুলে ধরে,
– নে হা কর!
হৃদিতার কান্ড দেখে এবার আরাফ অবাক হলেও প্রকাশ করে না।কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলো না।যে মেয়ে দূরে দূরে থাকে সে মেয়ে হঠাৎ করেই এত কাছে,এত পাশে আর্শ্চজ!
আরাফ হা করে খাওয়ার মুখে তুলে নেয়।
– তোর কি হয়েছে হৃদিতা তোর মাঝে হঠাৎ এত পরিবর্তন?
– আমার কি হবে আজব! নে হা কর।
আরাফ কিছুক্ষণ চুপ থাকে ঠোঁট বাকিয়ে হৃদিতার কানে ফিসফিস করে বলে,

-মহারানী আর কত জাদু দেখাবে আমায়?ঘুম থেকে উঠেই তোমার এইসব কান্ড কীর্তি আমার হজম হচ্ছে না।বিয়ের পর একবার নেশা করেই বউয়ের এত আদর সোহাগ বেড়ে গেছে তবে একবার কেন আমি প্রতি রাতেই নেশা করে বাড়ি ফিরবো তবে বউটা আমার সয়ংসম্পূরর্ণ আমার হয়ে যাবে।

আরাফের কথায় চটে যায় হৃদিতা। প্লেট টা নামিয়ে আরাফের চুল গুলো টেনে দিয়ে বলে,
– লাত্তি মেরে যদি রুম থেকে তোকে না বের করেছি আমার নাম হৃদিতা মেহেরীন না।ভালো হয়ে যাও আরাফ ভালো হয়ে যাও,এখনো সময় আছে।
– তুমি আমার হয়ে যাও হৃদিতা তুমি আমার হয়ে যাও এখনো আমি তোমাতে বিভোর আছি।

আরাফের দাত কেলানো প্রশ্নে কোন উওর দিলো না হৃদিতা।চুপচাপ আরাফের মুখে ভাত পুরে দেয়।এদিকে দরজার আড়ালে দারিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে তাদের খুনশুটি দেখছে কেউ।যার চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে আগুনের ফুলকি।

বেশ অনেকটা রাত হয়ে গেছে আজকে আবারো আরাফ বাড়িতে ফিরেনি।তার চিন্তায় হৃদিতা নিদ্রাহীন বসে আছে।বেশ কয়েকবার আরাফকে ফোন করেও পাওয়া গেলোনা।দীরে দীরে রাত বেড়েই চলেছে।তখনি দরজায় ঠকঠকানো আওয়াজ হহ হৃদিতা গায়ে ওড়না জড়িয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। বেশ কয়েকবার জানতে যায় দরজার বাইরে কে?
কিন্তু কোন শব্দ পাওয়া গেলোনা। বেশামাল ভাবে দরজায় করাঘাত করছে অপর প্রান্তের লোকটি।হৃদিতা ভেবেই নিল দরজার অপর প্রান্তে আরাফ।

আরাফেকে বকতে বকতে দরজা খুলে চমকে যায় অদ্রিজা।সে ভুলেও টের পায়নি আজ তার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে।দরজা খুলতেই নিয়াজকে চোখে পরে তার দ্রুত দরজা আটকাতে নিলেই নিয়াজ হৃদিতাকে ধাক্কা দিয়ে রুমে ডুকিয়ে দরজা আটকে দেয়।হৃদিতা নিজেকে বাচাঁতে চিৎকার দিতে গেলেই মাতাল নিয়াজ মুখ চেপে ধরে তার।

নিকষ কালো আঁধারটায় আরেকটি কালো অধ্যায় সূচনা হয় হৃদিতার। জীবনে দুঃখ গুলো ছুঁয়ে যায় তার জীবনে আরেকবার।প্রলয়ংকারি ঝড়ে মুষড়ে পরে সে।তবে কি পালটে যাবে তার জীবনের রঙ?
#চলবে…

🌼পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন।

#শব্দহীন_অনুভূতি
#পলি_আনান
#পর্ব_১৮

লিভিং রুমের এক কোনায় ভয়ে আড়ষ্ট দাঁড়িয়ে আছে হৃদিতা।তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মাইশা,আইদা আর আদীব।বাড়ির সবার মুখের অবস্থা থমথমে বিরাজমান।নোমান কিংবা আরাফ কেউ এখনো বাড়ি ফিরে নি।নিয়াজ অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে সোফার উপর তার দিকে একবার তাকিয়ে দ্বিতীয় বার তাকানোর সাহস হয়নি হৃদিতার।নিরাবতা কাটিয়ে মুখ খুলেন আরাফের বাবা জহির।

– আরাফ কোথায়?সে কাকে বলে বাড়ির বাইরে রাত পার করছে, ঘরে তার বিবাহিত স্ত্রী?
জহির থামলো তার কথার উল্টো পিঠেই সহসা জবাব দিলো নিয়াজের বাবা জাবেদ,
– দেখো এখন আমার ছেলে খারাপ হয়ে যাবে।সবাই বলবে নিয়াজ নেশা করে।হ্যা এটা সত্য কিন্তু তাই বলে বাড়ির কোন সদস্যর ক্ষতি আমার নিয়াজ করেনি আমার তো মনে হয় এই মেয়ের দোষ নিশ্চই আরাফ ঘরে নেই তাই ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার ছেলেকে নিজের রুমে ডেকেছে।নিশ্চই ভেবেছিল আরাফকে যেভাবে ব্যবহার করে টাকা হাতিয়ে নেবে ঠিক সেই কাজ নিয়াজের সাথেও করবে।
– কেন বলেছেন এইসব উদ্ভট কথা।আপনার ছেলে কি দুধে ধৌয়া তুলসি পাতা।আপনার ছেলের ঠিক কতটা নিম্ন শ্রেণির তা আমি এই বাড়িতে অল্প কয়েকদিন থেকেই বুঝে ফেলেছি।

মাইশার তীক্ষ্ণ জবাবে সবাই বেগবান দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।তানিয়া মাইশার কথায় রাগ ঝেরে বলে,

– এই মেয়ে তোমাকে না বলা হয়েছে আমাদের পারিবারিক বিষয়ে তুমি ঢুকবে না।কথা কি কানে যায় না তোমার?
– সরি, তবে চুপ থাকতে পারলাম না যেখানে অন্যায় সেখানেই মাইশা।আর মেয়েদের নির্যাতন সেনসেটিভ বিষয় অন্তত সবাই এই নরপশুটার দলে ভিড়লেও আমি ভিড়বো না।
মাইশা উওর শুনে সবাই চুপ থাকে। তখনি কপালে হাত দিয়ে বাড়ি ঢুকে আরাফ।কিন্তু রাতের তিনটায় লিভিং রুমের সবার উপস্থিতি স্বাভাবিক ভাবে নিলনা সে।সবার মাঝে হৃদিতাকে খুঁজতে থাকে তার দু চোখ।মাইশার পাশে বিদ্ধস্ত অবস্থায় হৃদিতাকে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসে। মুখে,হাতে গলায় তার আচড়ের দাগ ভাসমান।
– কিরে কি হয়েছে তোর?
আরাফ প্রশ্নে দেরি হলো কিন্তু হৃদিতার হুমড়ি পরে কাদঁতে দেরি হলোনা।আরাফকে ফুফিঁয়ে কেঁদে উঠে। তার কান্নায় ছমছমে পরিবেশ হয়ে যায় এনায়েত মঞ্জিলে।

তখন রাতে নিয়াজ হৃদিতার রুমে ঢুকে ধস্তাধস্তি শুরু করলে,নিজেকে ছাড়াতে অনেক চেষ্টা করে হৃদিতা।ততক্ষনে নিয়াজের নখের দাগ তার শরীরে আছড়ে যায়।উপায়ন্তর না পেয়ে নিয়াজকে ধাক্কা দেয় হৃদিতা তখনি ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় মাথা গিয়ে ঠেকে নিয়াজের। কাচঁ ভাঙ্গার শব্দে আরো একবার জেগে যায় বাড়ির সবাই।কাশতে কাশতে হৃদিতা নিচে নেমে এলেই তাকে ঝাপটে ধরে নেয় মাইশা।নিয়াজের বেগতিক অবস্থা দেখে দ্রুত ব্যান্ডেজ করে দেয় জাহিদ।তারপর লিভিং রুমে শুরু হয় বিচারকার্য।পুরোটা সময় লজ্জায় বাকরুদ্ধ ছিলেন হুমায়রা।

হৃদিতা শ্বাস আটকে আসা কান্নায় আরাফের পাগল হওয়ার মতো অবস্থা।বাড়ির সব মুরব্বিদের উপেক্ষা করে আজ মাইশা তেলে বেগুনে জ্বলে।উঠেছে। আরাফের কাছ থেকে হৃদিতাকে একটানে সরিয়ে এনে ধমক সুরে বলে,

– বিয়ে করে ছিলে কেন,যদি একটি মেয়ের নিরাপত্তাই না দিতে পারো।যতসব!
আরাফ মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।আজকে যা হলো তা হৃদিতার চরিত্রে আঘাত পড়লো।সোফার উপর নিয়াজকে দেখেই ছুটে এসে তার কলার টেনে ধরলো আরাফ।সঙ্গে সঙ্গে সবার আরাফকে পেছন থেকে আটকে ধরে।আরাফ নিয়াজকে মারতে নিয়েই আইদার বাবা জসীম এসে তাকে বাধঁ দেয়।

– দেখ নিয়াজের দোষ একা আমি দিচ্ছি না।হৃদিতাকে কে বলেছিল দরজা খুলতে আমার তো এই মেয়েটাকেই সন্দেহ হয়।
তানিয়ার যুক্তিহীন অভিমতে আরাফ আর মাইশার রাগে শরীর থরথর করে কাপঁতে থাকে।এক হাতে হৃদিতাকে হেচঁকা টেনে কাছে এনে তানিয়ার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,

– এই বাড়িতে ন্যায় বিচার কোন দিন হয়নি আর হবে ও না।আমার হৃদিতা কেমন তা আমি ভালো করেই জানি।অন্তত আপনার কাছ থেকে তার চরিত্র সম্পর্কে আমি জানতে চাই না।মেনেই নিলাম দোষটা আমার বউয়ের তবে আইদা!আইদা কি দোষ করেছিল?তার সাথে নিয়াজ এমং নোংরা ব্যবহার করে কেন?সাবধানে থাকবেন চাচি,আজ হয়তো হৃদিতা বাইরের মেয়ে বলে তাকে সঙ্গ না দিয়ে চরিত্রহীন ছেলের প্রতি দল গড়ছেন।বলা তো যায় না কবে আপনার মেয়ের উপর নেকড়ের আঁচড় পড়ে।

আরাফ হৃদিতাকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে যায় সবাই এদিকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লেখনীতে পলি আনান

হৃদিতার নিশব্দে দুচোখ দিয়ে পানির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে আরাফ তার হাতে, পায়ে গালে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে কিন্তু আরাফের ছোঁয়াও এই মূহুর্তে তার বড্ড বিষাক্ত লাগছে।হঠাৎ করেই আরাফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় হৃদিতা।অবাক হয়ে আরাফ তার দিকে তাকালে সে ঝাঝালো গলায় বলে,
– কোথায় ছিলি তুই?নেশা করতে গেছিস আর আজ নেশা করিস নি?সজ্ঞানে কীভাবে আছিস?
আরাফ দীর্ঘ ছাড়লো,
– শাকীল এক্সিডেন্ট করেছে তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম।
হঠাৎ করেই পরিবেশটা যেন গুমুট হয়ে যায়। হৃদিতা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে চোখ মুছে বলে,
– শ..শাকীল ভাইয়ার কি হয়েছে?
– বাইক এক্সিডেন্ট করেছে। নাফিসা ভেঙ্গে পরেছে রে তাদের কাছেই ছিলাম।কিন্তু আমি জানতাম না এমন কিছু হবে।আর ফোনেও চার্জ ছিল না পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল আমি তোকে ফোন করেও জানাতে পারলাম না।মাফ কর আমায়।

হৃদিতা আবারো কেঁদে দেয়।আরাফের কলার খামছে ধরে বুক ভাসাতে থাকে আরাফের।হৃদিতার মাথায় হাত বুলিয়ে আরাফ মনে মনে বলে,
– চিন্তা করিস না।ভালো কিছু হবেই দেখিস। একদিন এ বাড়ির প্রত্যাকটা কাল সাপের মৃত্যু আসবে। আসতে হবেই!

পরের দিন খুব ভোরে কেউ যেন আরাফের রুমের দরজায় করাঘাত করছে।ক্লান্ত আরাফ ঘুমিয়ে আছে। তার পাশে হৃদিতা নিদ্রাহীন রাত্রিযাপন করেছে।দরজায় কারো আসার শব্দে হৃদিতা উঠে যায়।মনে ভয় থাকা শর্তেও সাবধানতা অবলম্বন করে দরজা খুলে। কিন্তু দরজার বাইরে আরাফের মাকে দেখতে পাবে ইহজন্মেও সে আশা করেনি।
– আপনি?

মায়মুনা হৃদিতার প্রশ্নে উওর না দিয়ে তড়িঘড়ি করে রুমে ডুকে দ্রুত দরজা আটকে দেয়।
– আরাফ কি গভীর ঘুমে?
– জি আন্টি!
মায়মুনা চকিতে তাকালো হৃদিতার দিকে।হৃদিতার মাথা টেনে কপালে নিজের অধর ছুয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
– আন্টি না মা ডাকিস।আমার মেয়ে নেই।
হৃদিতা চমকায়!এই মহিলা কাল রাতেও তার বিপক্ষে ছিল তবে হঠাৎ করেই রুপ পাল্টালো কেন?এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তিনি হৃদিতার হাতে একটি চেক তুলে দেন।
– এটা কেন মা!এত টাকা।
– চুপ কর আর আস্তে কথা বল আরাফ উঠে যাবে।এখানে পাচঁ লক্ষ টাকা আছে।বলা তো যায় না কখন তোরা কোন বিপদে পড়িস। বিপদ তোদের চারিদিকে উৎ পেতে আছে মা।তোদের নিজেদের কোন সঞ্চার নেই আমি জানি তাই এটাই তোদের ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
– কিন্তু কিসের বিপদ?

– আহ!এত কথা বলছিস কেন আমার কথা গুলো মন দিয়ে শোন। এই বাড়িতে যা তোরা প্রকাশ্যে দেখিস তা কিন্তু সত্যি নয় আবার যা আড়ালে ভাবিস তা কিন্তু সত্যি নাও হতে পারে।আরাফ আমার অনেক কষ্টের সন্তান।আমার বিয়ের নয় বছর পর আরাফ হয়েছে মানে বুঝতে পারছিস।খুব অল্প বয়সেই আমার শাশুড়ী আমায় এই বাড়িতে আনে।কোন দিন কোন আদর যত্নে ত্রুটি রাখে নি।আমি ছিলাম শিক্ষিত ধাঁচের মেয়ে।বিয়ের পরে এবং আগে পড়াশোনাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি।যার দরুনে স্বামীর হাতে হাত রেখে এত বড় ব্যবসা সামলাচ্ছি।কিন্তু ছেলেটাকে আমি আমার মত গড়ে তুলতে পারিনি রে।

যাই হোক আমার শেষ কথা একটাই তুই আমার ছেলেকে তোর আচঁলে বেঁধে রাখবি।কি হলো অবাক হচ্ছিস শাশুড়ী হয়ে এমন কথা বলছি বলে?আমাকে যেমন শাশুড়ী মানিস তেমন বন্ধুও ভাবতে পারিস।যেকোন প্রয়োজনে আমার কাছে আসবি তবে একটা কথা এই বাড়ির কারো সামনেই তোর সাথে আমি ভালোভাবে কথা বলতে পারবো না।আগে যেমন রুট বিহেব করেছি আবারো করবো।তুই মনে কষ্ট নিস না মা।আমার ছেলেটাকে দেখে রাখ তার সংসারের হাল ধর তোর নিজের পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যা।আমি যে এখানে এসেছি তোকে চেক দিয়েছি এইসব কিচ্ছু আরাফকে জানাবি না। টাকার চেকটা তোর কাছেই রাখ গোপনে।আমি আসি।

মায়মুনা দ্রুত রুম ত্যাগ করেন।এদিকে হৃদিতা স্থির হয়ে গেছে।একটু আগে কি হলো তার হিসাব মেলাতে পারছে না সে।

কেটে যায় বেশ কিছু দিন।অনেক চিন্তা ভাবনার পর হৃদিতা সিধান্ত নিয়েছে আরাফকে সে হারাবে না।প্রভা তার জীবনে ফিরে এলেও না। যেখানে আরাফ আর তার ভালোবাসা সত্য তাহলে সেখানে অন্য ব্যাক্তির হস্তক্ষেপে কেন মানবে হৃদিতা।দুজন দুজনের অনুভূতি ভালোবাসা প্রকাশ না করলেও কাজে কর্মে প্রকাশ পাইয়ে দিচ্ছে।

মাইশা আর নোমানের সম্পর্ক বেশ উন্নতি হয়েছে।অতীতে মাইশাকে বাড়ির সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেও নোমানের কিচ্ছু যায় আসতো না।কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উলটো মাইশাকে কেউ কটাক্ষ ভাবে কথা বললেই প্রতিবাদ করে নোমান।বাড়িরে বর্তমানে মাইশার রাজ্যত্ব বিদ্যমান।সবাই জানে বাড়ির সিংহ নোমানের হবু স্ত্রী মাইশা।সেখানে কার বা সাধ্য আছে মাইশাকে অবজ্ঞা করার।

নিয়াজ সেদিনের পর সুস্থ হয়ে আবারো বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।সেদিনের পরের দিন নিয়াজের সাথে তুলকালাম ঝগড়া হয় আরাফের।বাড়ির কেউ আরাফকে ঠান্ডা করতে না পারলেও হৃদিতার একবার চোখ ইশারায় আরাফ ঠান্ডা হয়ে যায়।তাদের ব্যাপারটা দেখে দূর থেকে আড়ালে মিটিমিটি হাসে মায়মুনা

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে।হৃদিতার অপেক্ষায় আরাফ থাকতে থাকতে রাতের প্রায় নয়টা বেজে গেছে এখনো টিউশন থেকে বাড়ি ফিরে নি হৃদিতা।হৃদিতার মোবাইল বন্ধ,পরিচিত সবার নাম্বারেই ফোন করা শেষ আরাফের, কিন্তু হৃদিতার খোঁজ নেই।
ক্রমশ চিন্তা বেড়েই চলেছে একপর্যায়ে হৃদিতা যেখানে পড়ায় যেখানে গিয়ে যানতে পারে হৃদিতা আগেই চলে গেছে।তবে হৃদিতা কোথায়?নিয়াজ কোন ক্ষতি করে দেয়নি তো?মুখে হাত দিয়ে মাঝ রাস্তায় থেমে যায় আরাফের গাড়ি।তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসা বন্ধুরাও থেমে যায়।
– কি রে আরাফ। থেমে গেলি কেন? হৃদিতাকে খুঁজবি না?
– আমি হৃদিতাকে খুঁজে পাবো তো?
আরাফের প্রশ্নে মুখ কুচকায় শাকীল।
– কেন পাবি না আজব!
– যদি নিয়াজ ভাই তার কোন ক্ষতি করে দেয়?
আরাফের উওরে নিশ্চুপ হয়ে যায় শাকীল আর লিবান।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here