মায়াজালে_আবদ্ধ পর্ব_৫,৬

মায়াজালে_আবদ্ধ
পর্ব_৫,৬
কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
পর্ব_৫

জুনায়েদ আর দেরি করলো না খবর পাওয়া মাত্র রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। ওর প্রচণ্ড খারাপ লাগছে মনটা আজ দুদিন ধরে অশান্ত হয়ে ছিল তারপর আবার এমন একটা ঘটনা শুনে ও আরও ভেঙে পড়লো। মেয়েটার ওর বিশেষ কেউ ছিল না কিন্তু তবুও ওর জন্য জুনায়েদের ভেতরে থাকা চাপা কষ্ট টা চোখের কোনে পানি হয়ে বারবার ঝড়ে পড়ছে। হৃদয় ভাঙা মানুষ গুলো মানুষের কষ্ট টা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে জানে। জুনায়েদ আজ আর বাইকে আসলো না।ওর বাবা সাথে গাড়িতে করেই এসেছে। ড্রাইভার গাড়ি ড্রাইভ করছে ও পাশে বসে আছে। পেছন থেকে জয়নাল সাহেব ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। উনি ও কষ্ট পেয়েছেন তবে ছেলের মতো এতোটা না। সমস্ত রাস্তা কেউ কোনো কথা বলল না সবাই নীরব থেকেছে। বাড়ি সামনে এসে হৃদয় কোনো কথা না বলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো। ওর পেছনে পেছনে জয়নাল সাহেব ও আসলে। এই বাড়িতে সাধারন অন্য কোনো মরা বাড়ির মতো প্রচুর লোকজন আর কান্নাকাটি হচ্ছে না। পিউয়ের মা একাই মেয়ের জন্য চিৎকার করে কাঁদছেন। আবার মাঝেমাঝে চুপ করে থাকছেন। আশেপাশের প্রতিবেশীও খুব একটা নেই। লাশ ময়নাতদন্তের পর বাড়িতে আনা হয়েছে। বাড়ির পেছনে আম গাছের নিচে লাশের খাটিয়াটা রাখা হয়েছে। জুনায়েদ একপা দুপা করে সামনে এগিয়ে এসে লাশের সামনে দাঁড়ালো। ওকে আসতে দেখে পাশ থেকে একজন মহিলা লাশের মুখ থেকে কাপড় টা সরিয়ে ফেলল। জুনায়েদ একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। মায়াভরা শুকনো মুখটা চুপসে আছে। নাক মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ও আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না পিছিয়ে আসলো। এতোক্ষন জয়নাল সাহেব ছেলের পাশেই ছিলেন। উনি এবার ওকে হাতধরে পিছিয়ে নিয়ে এসে বললেন,

> আমার মনে হয় তোমার শরীর ঠিক নেই বাড়িতে যাওয়া উচিৎ।

> আমি ঠিক আছি।

> ঠিক থাকলেই ভালো। তবে আমার মনে হচ্ছে তোমার বাড়িতে যাওয়া উচিৎ হবে। আমি এদিকটা সামনে নিবো।

> আব্বু আমি দুর্বল নয় যথেষ্ট শক্ত। পিউয়ের কবরে মাটি দিয়ে তবেই আমি ফিরবো। মেয়েটা আমাকে ভরসা করতো কিন্তু ওর জন্য কিছুই করতে পারলাম না।

> হুম।

জয়নাল সাহেব আরও কিছু বলতে গেলেন কিন্তু পারলেন না। ম্যানেজার উনাকে ডাকছেন। অফিসের সবাই এখানে উপস্থিত ওদের সাথে কিছু পরামর্শ করার আছে তাই উনি চলে গেলেন। জুনায়েদ একা একাই দাঁড়িয়ে আছে। দূরে খাটিয়ার দিকে ওর তাকাতেই ইচ্ছা করছে না তবুও চোখ চলে যাচ্ছে। এই সময় যদি রীমলি পাশে থাকতো তাহলে হয়তো এতোটা কষ্ট কখনও হতো না। ও সবটা সামলে নিতো। এমন সময় হঠাৎ পেছনে থেকে কেউ একজন ওর ঘাড়ে হাত রাখলো জুনায়েদ চমকে উঠে পেছনে তাঁকিয়ে দেখলো আমির দাড়িয়ে আছে। আমিরকে দেখে ওর কিছুটা হলেও ভালোলাগলো। ও জোর করে ঠোঁটের কোনে হাসি এনে বলল,

> এখানে তুই?

> আঙ্কেল ফোন করে বলল আসতে।

> আব্বু ফোন করেছিল কিন্তু কেনো? অবাক হয়ে

> বলল জুনায়েদের মন ভালো নেই তুমি আসো হয়তো তুমি থাকলে ওর ভালোলাগবে। একা একা আছে তাই কষ্ট পাচ্ছে।

> আরে ছাড় তো আব্বু এমনিই।

> আচ্ছা ওই ব্যাপারটা নিয়ে কি হলো? জানতে পেরেছিস কে এমন করলো?

> যেই করুক, সে তো সফল হয়েছে। আমার যা হারানোর সে তো হারিয়েছি। অপরাধিকে চিনতে পারলে কি আর ও ফিরে আসবে? কখনও আসবে না। আসলে ও আমার কপালে নেই। ভালোবাসার মানুষ কে ভালোবেসে কাছে রাখতে কপাল লাগে।যাইহোক ছাড় সেসব কথা। হৃদয়ের অনুভূতি একদিন ঠিক শুকিয়ে যাবে তখন আর সুখ দুঃখ কিছুই অনুভব হবে না।

জুনায়েদ হাসি মুখেই বলল কিন্তু চোখের পানি লুকিয়ে এই সামান্য টুকু হাসতে যে ওর কতটা কষ্ট হলো শুধুমাত্র ওই জানে। ওর কথা শেষ হতে না হতেই আমির ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। আমির ওর কথা শুনে কেঁদে ফেলেছে। ও নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পরেনি। জুনায়েদ ওর পিঠে হাত রেখে বলল,

> এই হঠাৎ কি হলো?

> সরি দোস্ত আমি তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। সেই ছোট থেকে আমাদের বন্ধুত্ব তখন থেকেই আমরা এক সাথে আছি। বিপদে আপদে কেউ পাশে না থাকলেও তুই থেকেছিস। আর আজ তোমার এমন সময়ে আমি কিছুই করতে পারলাম না। ক্ষমা করে দে আমাকে।

> আরে পাগল ক্ষমা কেনো চাইছিস? একজন গেছে আরেকজন আসবে। যে আমার ছিল না তাকে জোর করে আমার করতে চাওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই না। ওসব ছাড় এখন যে জন্য এসেছি এটা তো করতে হবে তাইনা?

> হুম। চোখ মুছে

অমির ওকে ছেড়ে দিলো তারপর ওরা দুজন মিলে দাফনের সব ব্যবস্থা করে ফেলল। গোরস্থানে মাটি দিয়ে ওরা ফিরে আসলো। আমির না থাকলে হয়তো ও কিছুই পারতো না। লাশ দাফনের পর ঠিক করা হলো পিউয়ের মায়ের খরচের জন্য কিছু নগর অর্থ প্রদান করা হবে।আর এর মধ্যেই পিউয়ের ভাই ভাবি এসে হাজির। উনারা বেশ কান্নাকাটি করছেন নিজের মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন বলছে। জুনায়েদ ওখানে আর দাড়ালো না। ভদ্রমহিলার হাত ধরে শুধু বলল,

> আপনার যখন যা প্রয়োজন আমাকে জানাবেন। আর আপনার নামে যে টাকা টা দেওয়া আছে এটা আপনি একবারে উঠিয়ে নিতে পারবেন না। প্রতিমাসে এই টাকা থেকে আপনার খরচের জন্য যা লাগবে শুধু সেই টাকা টা আসবে।

সেদিন বাড়িতে ফিরতে ফিরতে ওদের প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। জুনায়েদ বাড়িতে এসে গোসল করে কিছু খেয়ে বিছানায় শুতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। ও একটানা বিকাল পযর্ন্ত ঘুমালো তবুও ওর ঘুম কাটলো না। ঘুম কাটলো বাইরে থেকে অলির চিৎকার শুনে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি তাই ওর একটুও উঠতে ইচ্ছা করছিল না তবুও উঠতে হলো। ও ঘুম ঘুম চোখে টলতে টলতে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো অলি কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,

> কিরে তোর জন্য কি ঘুমিয়েও শান্তি পাবনা?

> তুমি কথা দিয়েছিলে আমার সাথে বার্থডে পার্টিতে যাবে।

> যাবো বলেছি তখন যাব কিন্তু এখন কেনো?

> চারটা বাজে সন্ধ্যায় যেতে হবে তুমি রেডি হবে কখন শুনি?

> আমি কি তোর মতো মেকআপ বক্স নিয়ে বসবো যে আমার লেট হবে। যাবি এখন নাকি কান মলা খাবি? ধমক দিয়ে

> যাচ্ছি

অলি মুখ ভার করে চলে গেলো। ও যেতেই জুনিয়র বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালো। আজ দুদিন ওর কেমন ছাদে যাবার নেশায় ধরেছে। ও যাবার আগে এককাপ কফি নিতে ভুলল না। জুনায়েদ ছাদে এসে আশেপাশের তাকিয়ে কফির কাফে মুখ ঢুবালো। বাচ্চারা সব পাশের ছাদে খেলছে। ওদের চিৎকার চেচামেচিতে জুনায়েদের বেশ অসহ্য লাগলো তবুও ও নিজেকে শান্ত রেখে সময়টাকে উপভোগ করতে চাইলো। ওর নজর বারবার বাম পাশের বিল্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছে। আজ সেই মেয়েটা আসনি দেখে ও কিছুটা নিরাশ হলো। একবার ভাবলো চলে যায় এমন ভেবে ও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যখন ফিরে আসতে চাইলো ঠিক তখনই ওর ডাক পড়লো। সেই চেনা কাঙ্ক্ষিত সুরটা ওর কানে ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো,

> এইযে মশাই আপনি আজ এখুনি চলে যাচ্ছে যে?

জুনায়েদ পেছনে তাঁকিয়ে বলল,

> এসেছি যখন তখন তো যেতেই হবে।

> থাকুক না আর একটু আপনাকে দুচোখ ভরে দেখি। আপনাকে দেখতে আমার ভীষণ ভালোলাগে। আমি হয়তো আপনার প্রেমে পড়ে গেছি।

মেয়েটার কথা শুনে জুনায়েদের কাশি এসে গেলো।ও কাশতে কাশতে ও বিড়বিড় করে বলল, পিচ্চিটা বলে কি। এখানে আর আসা যাবেনা। ভেবে ও চলে আসতে গেলো তখনই মেয়েটা আবারও বলল,

> ওই আপনি এতো ভীতু কেনো বলবেন? পিচ্চি বলে কি আমার প্রেমে পড়া বারণ আছে নাকি?

> ওহে পিচ্চি তুমি দেখি আমার হার্ট এটাক করিয়ে তবেই ছাড়বে। এইসব ভালো না। তুমি আমার বোনের বয়সি। আমি তোমার কমপক্ষে ছয় বছরের বড়। বাড়িতে গিয়ে পড়তে বসো যাও।

> এই একদম পিচ্চি পিচ্চি বলবেন না তো।আমার গা জ্বলে যায় আপনার মুখে পিচ্চি শুনলে। আমার নাম মায়া তাই আমাকে মায়া বলেই ডাকবেন।

> মায়া পিচ্চি তোমার মাথায় প্রেমের ভুত কে ঢুকিয়েছে বলবে?

> সব আপনি করেছেন। কে বলেছিল ছাদে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে। প্রেমের জ্বালে ফাঁসিয়ে দিয়ে এখন না বললে তো শুনবো না। আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।

মেয়েটা আরও কিছু বলতে গেলো কিন্তু পারলো না এর মধ্যেই কিন্তু নিচে থেকে কেউ একজন মায়া বলে ডেকে উঠলো আর মেয়েটা আসছি বলে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। জুনায়েদ সেদিকে তাঁকিয়ে ভাবলো বিষয় টা আরও গভীর হয়ে যাবার আগেই এখানে আসা বন্ধ করতে হবে। বাচ্চা মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। ও যতো এখানে আসবে ততই মেয়েটা ওকে নিয়ে ভাবতে থাকবে দুর্বল হয়ে যাবে তার থেকে জুনায়েদ ছাদে আসা বন্ধ করে দিবে। কথাটা ভেবে ও নিচে চলে গেলো। এদিকে অলি সুন্দর করে সেজেগুজে রেড়ি হয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আছে। জুনায়েদ আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত রেড়ি হয়ে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। কিন্তু অনুষ্ঠান বাড়িতে এসে বার্থডে গার্লসকে দেখে জুনায়েদের চোখ ছানাবড়া ও ভয়ে ঢোক গিলল। ও তো বাচ্চাদের গিফট কিনেছে কিন্তু মেয়েটা মোটেই বাচ্চা নয়। এখানে এসে অলি খুব মজা করলো। জুনায়েদ যতটা পারে অলির মন রাখার চেষ্টা করেছে। এই বাড়ির সবাই বেশ মিশুক। অলির বান্ধবীর বোন ইরিনা জুনায়েদের দিকে কেমন লাজুক লাজুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে এটাই ওর বিরক্ত লেগেছে তাছাড়া সব ঠিকই ছিল। জুনায়েদ ওর বাবা মায়ের মুখের ভাব দেখে বুঝলো এরা এখানে ওকে এমনি এমনি আনেনি। কিছু অঘটন ঘটাবে তাই ও অলিকে ডেকে শুনলো। কিন্তু ও প্রথমে রাজি না হলেও পরে বলল ইরিনার সাথে ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে তাই ওকে এখানে আনা হয়েছে। একরকম পাকা কথা হয়ে গেছে এখন অনুষ্ঠানে করে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সব শুনে জুনায়েদের মাথায় আগুন লেখে গেলো কিন্তু কিছু বলতে পারলো না । অনুষ্ঠান শেষে বাড়িতে ফিরে আসলো। সেদিন সারারাত ধরে ওর ঘুম আসেনি। সকালে উঠে ও বাইরে গিয়ে দেখলো বাড়িতে কেউ নেই। কাজের মেয়েটা ওকে দেখেই বলল,

> ভাইজান অলি আপার বন্ধুদের বাড়িতে গেছে সবাই। খাবার রাখা আছে আপনারে খেয়ে নিয়ে বলেছে খালা আম্মা।

> কেনো রে?

> ইরিনা আপা খুবই অসুস্থ। উনি গতকাল রাতে সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছেন।

(চলবে)

#মায়াজালে_আবদ্ধ
#কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_৬

জুনায়েদ ভ্রু কুচকে ভাবলো ওর আবার কি হলো কে জানে। হয়তো চোখের সমস্যা, গতকাল যেভাবে তাঁকিয়ে ছিল তখনই বুঝেছিলাম এমন কিছু হবে। উপরের দিকে তাঁকিয়ে হাটে তো সে। ও বিড়বিড় করে কথা গুলো ভাবতে ভাবতেে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো।টেবিলে খাবার বলতে রুটি ডিম ভাজি আর আলুভাজি রাখা আছে। জুনায়েদের খাবার গুলো দেখে আর মুখে নিতে ইচ্ছা করলো না।ক্ষুধা সব উধাও হয়ে গেলো। ভাবলো পেটে যা আছে এতেই দুপুর পযর্ন্ত চলে যাবে পরে কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে। কথাটা ভেবে ও খাবার রেখে দিলো। বাড়িতে আজ তেমন কেউ নেই, কাজের মেয়ে শলাকা আর পটল ছাড়া। পটল আর শলাকা দুজন দুজন কে একদম সহ্য করতে পারেনা। এরা সুযোগ পেলেই ঝগড়া করতে শুরু করে। আজ পটলের মন বিশেষ ভালো নেই।ও সেই সকাল থেকে দরজার ওপাশে মাথায় হাত রেখে বসে আছে আর উঠেনি। পটল এই বাড়ির কর্তার প্রিয় পাত্র। ওকে কেউ তেমন ঘাটাই না। জয়নাল সাহেব ওর চোখ দিয়েই সমস্ত বাড়িটাকে দেখে রাখেন। জুনায়েদ মাঝে মাঝে ওকে আব্বুর সিসি ক্যামেরা বলেও ডাকে। পটল সব সময় হাসিখুশি থাকে কিন্তু আজ হঠাৎ ওর মন কেনো খারাপ হলো জুনায়েদের খুব জানতে ইচ্ছা হলো তাই ও দরজার পাশে গিয়ে জোরে করেই বলল,

>কিরে পটল হঠাৎ তোর মন খারাপ কিছু কি হয়েছে?

> আসলে ভাইজান হয়েছ কি….

পটল আর কথা বাড়াতে পারলো না ওপাশ থেকে শলাকা চিৎকার করে বলে উঠল,

> মুরগীর বাচ্চার মতো ছোট একটা মন ওর,ও আর নতুন করে খারাপ কি হবে।

শলাকার কথা শুনে পটল তেড়ে উঠলো,

> আমার মন মুরগীর বাচ্চার মতো? তোর মন মনে হচ্ছে হাতীর মতো বিশাল। আমার তো কিছুটা আছে কিন্তু তোর তো কিছুই নেই। কাজের বুয়ার এতো ভাব কেনো বুঝিনা। বড় সাহেবরে বলতে হবে এইসব মহিলারে বাড়িতে রাখা ঠিক না।

ওদের ঝগড়া তুমুল আকার ধারণ করলো এটা দেখে জুনায়েদ দ্রুত উপরে উঠে আসলো। এদের ঝগড়া চলতেই থাকবে মানা করলেও শুনবে না। তাই এখানে থেকে মেজাজ খারাপ করতে ওর একটুও ইচ্ছা হলো না।ও উপরে চলে গেলো অফিসে যাওয়ার জন্য রেড়ি হতে।

ও রেড়ি হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শুনতে পেলো বাইরে কেউ একজন পটলের সাথে কথা বলছে। ও কৌতূহলী হয়ে দ্রুত এগিয়ে এসে দেখলো বাইরে ছাদের সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে আসতে দেখেই মেয়েটা হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলল,

> আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু আপনি তো আসলেন না?

> কিসের জন্য? অবাক হয়ে

> ভুলে গেলেন? আপনাকে না প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাসাই আসতে বলেছিলাম,আপনি আসলন না যে?

> শুনো পিচ্চি তুমি আল্প বয়সে অনেক পেকে গেছো। এইসব একদম ভালো নয়। তুমি বাড়িতে যাও এখন।

ওদের কথা শুনে পটুল উৎসুক হয়ে জিঙ্গাসা করলো,

> আপা কি হয়ছে? আপনার লগে ভাইজানের কি সম্পর্ক?

> আর বলো না ভাই তোমার ভাইজানকে যে আমি ভালোবেসে ফেলেছি কিন্তু সেতো এটা বুঝেনা। আসতে বলেছিলাম আমাদের বাড়িতে কিন্তু সে যায় নাই। তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে? আচ্ছা ওকে বলতে হবে না আমার শশুর মশাই আছে না বাড়িতে? উনাকে দয়াকরে আমার কথাটা বলবেন প্লিজ।

> বলেন কি আপা? আচ্ছা আপা ভাইজান কি আপনার সাথে কথা বলেছিল?

জুনায়েদের প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো পটলের কথা বলার ধরন দেখে তাই ওকে ও ধমক দিয়ে বলল,

> পটল তুই যদি ওর সাথে আবার কথা বলিস আমি কিন্তু তোকে ভাজি করে খেয়ে নিবো। ওকে এখুনি বিদাই কর। আর ভালো কথা আব্বুকে কিন্তু এইসব কিছু বলবি না। যদি আব্বুর কানে কথাটা গেছে তাহলে কিন্তু তোর খবর আছে। ধমক দিয়ে

> কিন্তু ভাইজান

> কোনো কিন্তু না।

জুনায়েদ গটগট করা হাটা ধরলো কিন্তু মায়া ওর পেছন ছাড়লো না। চিৎকার করতে করতে ওর দিকে এগিয়ে গেলো ততক্ষণে জুনায়েদ গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ও গাড়ি ছেড়ে বিড়বিড় করছে, মেয়েটা বাড়িতে পযর্ন্ত চলে এসেছে না জানি আরও কি করে বসে। একতো এতো ঝামেলা তার মধ্যে আবার এই মেয়েটাও ঝামেলা করছে। কিছুদিন বাড়ি থেকে দূরে থাকলে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায় এটা ভেবে ও আমিরকে ফোন করলো। আমিরের একটা গুন আছে সে ফোনে রিং বাজার সাথে সাথেই রিসিভ করে। মনে হয় সব সময় ফোন রিসিভ করার জন্য বসে আছে। জুনায়েদ ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই ও যথারীতি ফোন ধরে বলল,

> হ্যাঁ বল।

> কোথায় তুই?

> এই তো বাড়িতে বসে আছি আপাতত কোনো কাজ নেই।

> আমি বিকালে তোর বাড়িতে আসছি তুমি রেড়ি থাকিস। আমি তোকে নিয়ে আমাদের বাংলোতে যাবো। ওখানে যদি কোনো প্রমাণ পাই আর দুদিন থাকবো।

> আরে এটা তো খুব ভালো খবর । তুই যখন আসবি আমি তখনই রেড়ি।

> আচ্ছা রাখছি এখন। আল্লাহ হাফেজ।

জুনায়েদ ফোন রেখে অফিসে গিয়ে সারাদিন মোটামুটি সব কাজ গুছিয়ে নিলো। পিউয়ের কেবিন টা ফাঁকা পড়ে আছে ওদিকে বারবার চোখ যাচ্ছে আর মনে হচ্ছে এখুনি ও চলে আসবে। কাজ করার সময় ও বারবার ওর মনে হয়েছিল পিউ ওখানে বসে আছে আর ওর দিকে তাঁকিয়ে হাসছে। হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই ওর শূন্য স্থান পূরণ করা হবে। ওর নাম সারাজীবনের জন্য হারিয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে। জুনায়েদ ওদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ওর বাবা কথা ভাবলো, লোকটার আজ হলো কি?। জয়নাল সাহেব আজ অফিসে আসেননি এমন টা খুব একটা হয়না। উনি বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়া কখনও অফিস কামাই করেন না। যাইহোক দুপুরে পরেই জুনায়েদ সব কাজ শেষ করে আমিরের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। আমিরকে ও আগেই ফোন করে বলেছিল রেড়ি হয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। ও কথা মতো কাজ করেছে। ব্যাগ ঘাড়ে করে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জুনায়েদ ওখানে গাড়ি থামানো মাত্রই ও উঠে আসলো গাড়িতে। জুনায়েদের বাংলোটা অসাধারন সুন্দর। চারদিকে জঙ্গলে ঘেরা বিশাল বড় এই বাড়ির জমিটা জয়নাল সাহেবর বাবা যুদ্ধের সময় এক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের থেকে খুব অল্প দামে কিনেছিলেন। যদিও এটা উনার বাড়ি থেকে দূরে ছিল তবুও এক নিকট আত্মীয় উনাকে সাহায্য করেছিল এটা কিনতে। এখনকার সময় হলে হয়তো উনার সারা জীবনের উপার্জিত অর্থের প্রায় অর্ধেক অংশ এই জমিটা কিনতেই চলে যেতো। আমির বেশ উৎফুল্ল হয়ে আছে কিন্তু জুনায়েদের মুখভার। ওকে এমন মুখ ভার করতে দেখে আমিল বলল,

>মুখটা এমন করে রেখেছিস কেনো বলবি?

> আমার মনে হচ্ছে ওখানে কিছুই পাওয়া যাবে না।

> তবুও চেষ্টা। মনে একটা সান্ত্বনা তো থাকবে।

> হুম ।

ওদের বাংলো বাড়িতে পৌঁছাতে প্রায় মধ্য রাত হয়ে গেলো। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ওরা কিছু খেয়ে নিয়েছিল নয়তো উপোস দিতে হতো। আমির না খেয়ে থাকতে পারেনা। এই বাড়ির দেখাশোনার জন্য রমেন নামের একজন লোক রাখা আছে কিন্তু ভদ্রলোক কিছুদিন ধরে নিখোঁজ। নিখোঁজ বলতে সে দ্বিতীয় বিবাহ করে শশুর বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। ফোন দিলে বলে কালকের মধ্যে সাহেব চলে আসবো কিন্তু সেই কাল আর আসেনা। জুনায়েদ ঠিক করেছে নতুন লোক ঠিক করে তাকে দায়িত্ব দিয়ে তবেই ও বাড়িতে ফিরবে। যাইহোক ওরা সেদিন অনেক রাতে এখানে এসে পৌঁছেছে তাই সেদিনের মতো রুম ঠিক করে ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন খুব সকালে জুনায়েদের ঘুম ভাঙলো ও ব্রাশ হাতে নিয়ে বাইরের দিকে বের হলো। বাড়ির একদম সামনে সেই সুইমিং পুলটা অবস্থিত। জুনায়েদ হাটতে হাটতে সেখানে এসে দাঁড়ালো। পুলের পানিতে প্রচুর ময়লা জমে আছে অনেকদিনের অযত্নের জন্যই এমন অবস্থা কিন্তু সেই ছবিতে এই পুলটা এমন ছিল না একদম ঝকঝকে ছিল। জুনায়েদ হাটতে হাটতে বাগানে সামানে দিয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়ালো। গিটের পাশেই তমিজ চাচার ছোট একটা চায়ের দোকান ও সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই তমিজ চাচা ওর দিকে তাঁকিয়ে হেসে বললেন,

> কেমন আছো আবা?

> আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন? কেমন চলছে আপনার দোকান?

> মাশাআল্লাহ বেশ ভালো। এবার অনেক দিন পরে আসলে বাবা,বাড়িতে সব ঠিক আছে?

> আলহামদুলিল্লাহ সব ঠিক আছে। আচ্ছা চাচা আপনি তো সব সময় এখানেই থাকেন। আপনি কি বলতে পারবেন এই বাড়িতে আমি ছাড়া এই দুমাসে কখনও কেউ এসেছে?

> কি বলো তুমি? কখনও কেউ আসবে আর আমি জানবো না? কেনো কিছু কি হয়েছে?

> না চাচা কিছু না। আচ্ছা আপনি আমাকে একজন লোক ঠিক করে দিতে পারবেন যে আমার বাড়িটার দেখাশোনা করতে পারবে?

> পারবো না আবার তুমি চিন্তা করোনা আমি আজকের মধ্যেই ব্যবস্থা করে দিবো ইনশাআল্লাহ

> চাচা আজ আসছি আপনি থাকেন?

> আচ্ছা বাবা।

জুনায়েদ কথা শেষ করে চলে আসলো। ওকে না দেখে আমির ও উঠে এসেছে। ও একটা মহা কাজে ব্যস্ত আছে। সে পুলের পানিতে নেমেছে পরিষ্কার করতে। ওকে দেখে জুনায়েদের হাসি পাচ্ছে। আমির কোনো কাজ পারুক না পারুক ছেড়ে দেবার পাত্র না। জুনায়েদ ওকে মানা করলো কিন্তু ও শুনছে না তাই ওদিকে ও না তাকিয়ে রুমে আসলো ব্রাশ রাখতে। ফোনটা আপন মনে বেজে চলেছে রুমে কেউ ছিল না যে ধরবে। জুনায়েদ এসে দেখলো দশবারের মতো মিসকল উঠে আছে যেটা ওর বাবার নাম্বার থেকে আসা। জুনায়েদ ভ্রু কুচকে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে জয়নাল সাহেব দমকে উঠলো,

> ফোন রেখে কোথায় ছিলে? এখুনি বাড়িতে আসো।

> কিন্তু কেনো?

> বাড়িতে আসলেই জানতে পারবে কেনো। পটল আমাকে সব বলছে।

> ও তোমাকে কি বলেছে? অবাক হয়ে

> তুমি পাশের বাড়িতে মায়া নামের মেয়েটাকে পছন্দ করো। প্রতিদিন ছাদে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলা হয়। আমাকে বললে কি হতো আমি কি তোমাকে বাধা দিতাম?

> আব্বু এস কিছুই না। ও তোমাকে এইসব বলেছে?

> বাড়িতে আসো কথা হবে এখন রাখছি।

জুনায়েদের কথা বলার সুযোগ না দিয়েই উনি ফোনটা রেখে দিলেন। জুনায়েদ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এই পটলটা ওকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। পাজির পা ঝাড়া ওর কপালে দুঃখ আছে। জুনায়েদ রাগে ফুলতে ফুলতে বাইরে বের হলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here