মায়াজালে_আবদ্ধ পর্ব_১১

মায়াজালে_আবদ্ধ
পর্ব_১১
কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন

জুনায়েদ ঘুম থেকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলো দরজার কাছে প্রচুর হৈচৈ হচ্ছে। জুনায়েদের বেশ কৌতূহল হলো কি নিয়ে সব এমন করছে দেখার জন্য। কিন্তু দরজার কাছে আসতেই ও চোখ গোলগোল করে ফেলল। ওর সামনে রীমলি দাঁড়িয়ে আছে। হালকা কমলা রঙের শাড়িতে ওকে বেশ সুন্দর লাগছে। এমনিতেও রীমলি দেখতে অনেক সুন্দর। মায়ার মতো ওর গায়ের রঙ চাপা নয়। বরং অতিরিক্ত ফর্সা। জুনায়েদকে দেখে রীমলি ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো।জয়নাল সাহেব ওকে একের পর এক ধমক দিয়েই চলেছে।পটল আর বাড়ির কাজের মেয়েটা তো আছেই উনার তালে তাল দেবার জন্য। জুনায়েদের এটা একদম পছন্দ হলো না। মেয়েটাকে এমন করে হুমকি ধামকী দেবার কি হয়েছে ওর মাথাতেই আসছে না। আর এই ধমক গুলো ওকে না সরাসরি জুনায়েদের হৃদয়ে আঘাত করছে। ও কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না নিজের ভালোবাসাকে এমন করে অপমানিত হয়ে দেখা। কথাটা ভেবেই ও ভ্রু কুচকে গম্ভীর হয়ে বলে উঠলো,

> আব্বু ওকে ধমক কেনো দিচ্ছ? দরজা ছেড়ে দাও ওর সাথে আমার কথা আছে।

> কোনো কথা নেই। সেদিন আমি ওদের পা ধরতেও বাকী রাখিনি তবুও ওরা শুনলো না আমার কথা। ওর জন্য আমার ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছে আর ওকে আমি ছেড়ে দিবো ও ভাবলো কেমন করে?

> আব্বু আমি কষ্ট পাচ্ছি না। তুমি যাওতো আমি দেখছি, প্লীজ।

> আচ্ছা। তবে ওকে তুমি বলে দেবে আমার বাড়িতে যেনো ওকে আমি দুবার না দেখি। তাহলে কিন্তু ভীষণ খারাপ হবে।

জয়নাল সাহেব কথাটা বলে আর অপেক্ষা করলেন না হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই জুনায়েদ ছলছল চোখে কঠিন মুখ নিয়ে নিজের চোখের পানি লুকিয়ে বলল,

> হঠাৎ আমাদের বাড়িতে,কোনো প্রয়োজন আছে?

> সরি জুনায়েদ, খুব সরি। প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। কান্না করে

> ক্ষমা চাইছেন কেনো? আপনি তো ঠিকই করেছেন। যার সাথে যেমন মানায় আর কি। যাইহোক কোনো কথা না থাকলে আসতে পারেন।

জুনায়েদ ওর দিকে তাকাতে পারছে না তাই অন্যদিকে তাকিয়ে কথাটা বলল,

> তুমি আমাকে আপনি করে কেনো বলছো? এতো তাড়াতাড়ি আমি আপনি হয়ে গেলাম? খুব ভালোবাসি আমি তোমাকে। তোমাকে ছাড়া এক মূহুর্ত আমার কাছে বিষাদের মতো লাগছে। প্লীজ আমাকে ফিরিয়ে দিওনা।

কথাটা বলেই রীমলি জুনায়েদকে দুহাতে আকড়ে জড়িয়ে ধরলো। জুনায়েদ হ্যাঁ হয়ে গেলো ওর ব্যবহার দেখে। বিবাহিত একটা মেয়ে অন্য একটা বিবাহিত ছেলেকে জড়িয়ে ধরাটা মোটেও ভালো কথা নয়। আর ওদের প্রেম চলাকালিন সময়েও ও কখনও জুনায়েদকে এভাবে জড়িয়ে ধরেনি তাহলে আজ কেনো? অধিকার ছেড়ে দিয়ে তার উপরে অধিকার দেখিয়ে মায়া সৃষ্টি করে দুর্বল করার কোনো যুক্তি আসে না। তবুও জুনায়েদের খুব ইচ্ছা করলো নিজের দুহাতে ওকে আকড়ে ধরে বলতে আর কখনও আমার থেকে দূরে যেওনা কিন্তু এটা ও বলতে পারবে না।জুনায়েদ কারো স্ত্রীকে নিজের ভালোবাসার চাদরে আটকে রাখতে চাইনা। রীমলি এক মনে বিড়বিড় করছে আর কাঁদছে। জুনায়েদ পাথরের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে রীমলি থমকে গেলো। অলি জুনায়েদের কাছে এসে বলল,

> ভাইয়া ভাবি তোমাকে উপরে ডাকছে। ভাবির শরীর আবারও খারাপ হয়েছে।

কথাটা রীমলির কানের মধ্যে ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো। ও মনে হলো চারদিকে ভূমিকম্প হচ্ছে। অলির ভাবি মানে কি জুনায়েদ বিয়ে করছে? এটা ভেবে ও জুনায়েদ কে ছেড়ে দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। জুনায়েদ হঠাৎ করেই চনচল হয়ে বলল,

> কিছু বলার থাকরে বলুন আমি ভেতরে যাবো। আমার স্ত্রী অসুস্থ আছে।

> তুমি বিয়ে করছো জুনায়েদ?

> কেনো আপনি করলে দোষ নেই,আমি করলেই বুঝি দোষের?

> আমি কোনো বিয়ে করিনি জুনায়েদ। তোমাকে মিথ্যা বলা হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে মিথ্যা বলে ভয় দেখালে তুমি সব সত্যি টা আমাকে বলবে। কিন্তু তুমি এই কয়েকদিনের মধ্যেই এভাবে এগিয়ে গেলে?

> ভালো করেছেন এখন আসতে পারেন। আর দয়াকরে আপনি আমাদের বাড়িতে আর আসবেন না। আপনার জন্য আমার স্ত্রী আমাকে ভুল বুঝবে এটা আমি মানতে পারবো না। যে আমাকে অবিশ্বাস করে সে আর যাইহোক আমাকে কখনও ভালোবাসেনি।

জুনায়েদের মেজাজ প্রচুর খারাপ হচ্ছে। মেয়েটা ওকে মিথ্যা বলে ঠকিয়েছে কথাটা ভাবতেই ও গা জ্বলে উঠছে।

> সরি বলছিতো তো আমি।

>কিসের সরি? সরি বললেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে? কখনও যাবেনা। আপনি আসুন।

কথাটা বলেই জুনায়েদ দরজা লাগিয়ে দিয়ে গটগট করে উপরে চলে গেলো। রীমলি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে চোখে পানি ফেলছে আর দুহাতে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দারোয়ান এসে ওকে বাড়ির ভেতর থেকে বাইরে বের করে দিলো। জয়নাল সাহেব প্রতিশোধ নিতে রীমলির বাবা আশরাফুল ইসলামকে ফোন দিয়ে আচ্ছা মতো ধোলাই করলেন আর বলে দিলেন মেয়েকে নিয়ে যেতে। আশরাফুল ইসলাম মেয়েকে তখনই নিতে বের হলেন। জুনায়েদ মায়ার রুমে এসে থমথমে মুখ নিয়ে বলল,

> ঔষুধ খেয়েছো?
> না।
> কেনো?
> ইচ্ছা করছে না।

জুনায়েদ ওষুধ বের করে ওর হাতে দিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বলল,

> খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো। ঝামেলা করবে না। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও প্লীজ।

> আমি কি করেছি আপনার? এমন করছেন কেনো? ছলছল চোখে

> তর্ক করতে ইচ্ছা করছেনা মায়া। খেলে খাও, আর না খেলে আমি আসছি।

জুনায়েদ ওষুধ টা মায়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেমন এসেছিল তেমন করেই নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। জুনায়েদের মাথা ঘুরছে। রীমলিকে ফিরিয়ে দেবার একটুও ইচ্ছা ছিল না ওর। কিন্তু কি করবে এখন? ঘরে স্ত্রীকে রেখে প্রেমিকার কাছে চলে যাবে? সমাজ সংসার পরিবার কার দিকে তাকাবে? জুনায়েদের ইচ্ছা হলো সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে। যে ওকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল সে তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে সফল হয়েছে। জুনায়েদ স্থির হতেই পারছেনা। ওর একবার মনে হলো যাকে ভালোবাসি তাকে নিজের করে চাওয়া তো কোনো দোষের না।বরং যাকে ভালোবাসি না তার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে সারাজীবন এক সাথে থাকাই দোষের হবে। কিন্তু আব্বু আর মায়ার বাড়ির লোকজন কি ভাববে ওরা? জুনায়েদের নিজের চুল গুলো নিজেকেই ছিড়তে ইচ্ছা করছে আর মনে হচ্ছে রীমলিকে গিয়ে কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে আসতে। এতোদিন পর হঠাৎ আজ কি এমন হয়েছে যে ওর বাড়িতে চলে আসলো মাফ চাইতে। জুনায়েদ মাথায় কাজ করছে না। মনে হচ্ছে মারা গেলেই ভালো হবে।নয়তো সব কিছু প্রথম থেকে শুরু হোক। এসব এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ওর পাশের ফোনটা বেজে উঠলো। ওর একটুও ইচ্ছা করছে না ফোনটা তুলতে বা কে ফোন করেছে এটা দেখতে। ওর ভাবার মধ্যেই ফোনটা কেটে গিয়ে আবারও বেজে উঠলো। ও এবার ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো রীমলির নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। আগে এই পরিচিত নাম্বারটা দেখলে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠতো কিন্তু এখন আর উঠছে না বরং ভয় আর বিরক্তি দুইটাই ওর মধ্যে ভর করেছে। জুনায়েদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা তুলে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কান্নারত কন্ঠে ও বলে উঠলো,

> তুমি পারলে জুনায়েদ আমাকে ভুলে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনন্দে থাকতে? ওই মেয়েটা তোমার রুমে আছে তাইনা? তুমি আর আমাকে ভালোবাসো না শুধু ওকে ভালোবাসো তাই আমার কাছে আসতে পারছো না তাইতো? তাহলে ওকে আমি মেরে ফেলবো। তুমি ওকে আমার থেকে বাঁচিয়ে নিতে পারলে ভালো। আর না পারলে ওকে মেরে আমি তোমাকে আমার করে নিবো দেখে নিও।

> ভুলভাল বকছো কেনো বলবে? এতোদিন পরে এসেছো ভালোবাসা দেখাতে। যখন তোমার বাড়ির সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি তখন কোথায় ছিল তোমার ভালোবাসা । ভেবেছিলাম তুমি আসবে কিন্তু এসেছিলে? দারোয়ান ডেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলে। তুমি নিজের ইচ্ছাতে আমাকে ছেড়েছো আমি না। ধমক দিয়ে

> তোমার উপর আমার অধিকার আছে। আমি ইচ্ছা করলে ধরবো আবার ইচ্ছা করলেই ছাড়বো। তুমি শুধুমাত্র আমার ঠিক আছে?

> ফোন রাখো। আমার আর মায়ার মাঝখানে আসার চেষ্টা ভুলেও করবে না।

জুনায়েদ রেগে ফোনটা রেখে দিলো। রীমলির মান অপমান বোধটা প্রখর তাই ও সহজে জুনায়েদ কে ছাড়বে না এটা ও ভালো করেই জানে। ওর সব রাগ এখন মায়ার অপরে গিয়ে জমা হবে। জুনায়েদ ফোন রেখে দুহাতের তালুতে মুখ ঢেকে বসে আছে। বাইরে থেকে অনবরত দরজা ধাক্কানো হচ্ছে ওর সেদিন খেয়াল নেই। শব্দের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে শেষমেশ জুনায়েদ গিয়ে দরজা খুলে দিলো। ও দরজা খুঁলতেই হুট করে মায়া ওকে জড়িয়ে ধরলো। জুনায়েদ থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বলল

> কি সমস্যা? কান্নাকাটির কি হয়েছে বলবে?

> সরি আমার জন্য আপনাকে এতোটা কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। আমি এখুনি বাড়ি চলে যাবো। আপনি রীমলি আপুকে নিয়ে আসুন। কাঁদতে কাঁদতে

> তোমাকে এসব কথা কে বলেছে?

> সব শুনেছি আমি। আমি বাড়ি যাবো।

> রুমে যাও। এই বাড়িতে নিজের ইচ্ছাতে ঢুকলেও আর নিজের ইচ্ছায় বের হওয়া যায় না। তাই ওসব আজগুবি চিন্তা না করে পড়তে বসো। শাশুড়ি আম্মু বলেছেন না দশ বাচ্চার মা হলেও তোমাকে পরিক্ষা দিতে হবে তুমি কি সত্যি তাই দিতে চাও?

মায়াকে শান্ত করে জুনায়েদ কথাটা জোর করেই বলল। কিন্তু ওর কথা শুনে মায়ে বেশ লজ্জা পেলো তাই ওকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছ বলল,

> আপনি তো খুব।

> কি খুব? তুমি তো পড়ার ফাঁকি দেবার জন্য এসব করছো। এসব কি আমি বুঝিনা?

> কিছুই বুঝেনা আপনি।

জুনায়েদ কিছু একটা ভাবলো। এই মূহুর্তে কি জানি সব চিন্তা ওর হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে গেলো। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছিল ও নিয়ে ফেলেছে। আর যাইহোক এটা থেকে ওকে কেউ আর টলাতে পারবেনা।।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here