মায়াজালে_আবদ্ধ অন্তিম_পর্ব

মায়াজালে_আবদ্ধ
অন্তিম_পর্ব
কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন

জুনায়েদ মায়াকে রুমে যেতে বলল কিন্তু মায়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা হঠাৎ করেই লজ্জা পাচ্ছে। জুনায়েদ ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। মেয়েটার মধ্যে একটা অন্যরকম বিশুদ্ধতা আছে যেটা যেকারো মন ভালো করার জন্য ওষুধের মতো কাজ করবে। মেয়েটার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই। জুনায়েদ ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলো সরল এই মেয়েটার মনে কষ্ট দেওয়া কি ঠিক হবে? আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। হয়তো আমার নিয়তিতে মায়াকেই লিখেছেন। তাইতো বিয়ের একমাস আগে এমন হলো। রীমলি ওকে ভুল বুঝলো। জুনায়েদকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া মাথা নিচু করেই বলল,

> এবার কিন্তু আমি দেখছি না। আপনি দেখছেন।

> তো? গম্ভীর হয়ে

> কিছুনা।

> রুমে যাও। আমার কাজ আছে।
> হুম।

মায়া হাসতে হাসতে চলে গেলো। ও চলে যেতেই জুনায়েদ দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। আমিরকে বলেছিল সকালে আসতে কিন্তু ও আসেনি তাই জুনায়েদ ওকে ফোন করলো দ্রুত আসতে। ওকে ফোন করে জুনায়েদ ল্যাপটপের দিকে নজর দিলো। কেউ একজন জুনায়েদের ফোনে একটা ভিডিও পাঠিয়েছে। জুনায়েদ ভিডিও টা অপেন করে অবাক হলো এটা সেই ভিডিও যেটা দেখে রীমলি ওকে ভুল বুঝেছিল। জুনায়েদ ভালো করে ভিডিওর দিকে তাকিয়ে দেখলো এটা ওর বন্ধু রাতুল ও তার স্ত্রী রোজীর ভিডিও। জুনায়েদের এবার মনে পড়লো রাতুল আর রোজী পালিয়ে বিয়ে করেছিল তাই জুনায়েদ ওদেরকে নিজের বাংলোতে থাকার জন্য বলেছিল। ওদের সবকিছু এখন ঠিকঠাক হয়ে গেছে আর অনেকদিন ওদের সাথে ওর যোগাযোগ ও হয় না। জুনায়েদ বুঝলো এই ভিডিওটা এডিট করেই ওর ভিডিও তৈরি করা হয়েছিল। ওর ভিডিও দেখতে দেখতেই কয়েকটা টেক্সট আসলো,

> জুনায়েদ আমি রীমলি বলছি, এই ভিডিও থেকেই তোমার ভিডিও তৈরী করা হয়েছিল আমি বুঝতে পারিনাই। তোমার বন্ধুরা ষড়যন্ত্র করে তোমাকে আর আমাকে আলাদা করে দিলো। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও প্লীজ। তুমি মায়াকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে তোমার করে নাও। নয়তো তোমার আশেপাশে যেই আসবে তাদেরকে আমি ছাড়বো না। কি ভাবেছো আমাকে ছেড়ে দিয়ে তুমি অন্য মেয়েদের সাথে মজা করবে আর আমি তা সহ্য করবো কখনও না।

জুনায়েদ মেসেজ টা পড়ে ওকে ব্লক করে দিলো। এই মেয়েটা সত্যি সত্য পাগল হয়েছে। ভুলভাল বকছে শুধু। যে একটা তেলাপোকা দেখলেও ভয়ে চিৎকার করে সে করবে মানুষ খুন। বাড়াবাড়ির একটা লিমিট থাকে। জুনায়েদের ভাবতে ভাবতেই ওর দরজায় কেউ আঘাত করলো তাই ও তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলো। আমির হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বলল,

> পিউয়ের খুনিকে ধরা হয়েছে।

> মানে কখন আর কিভাবে?

> জুনায়েদ তুই ভাবতেও পারবিনা কি কি হচ্ছে আর হতে চলেছে।

> আরে রহস্য করছিস কেনো খুলে বল,আমার টেনশন হচ্ছে। আর খুনিটাকে?

> খুনী একজন ভাড়াটে কিলার। লোকটা এমন ভাবে কাজ করে ওকে কেউ কখনও ধরতেই পারেনা। তুই নিচে চল ওখানে পুলিশ এসেছে।

> কিন্তু আমাদের বাড়িতে পুলিশ কেনো?

> নিচে গেলেই সব জানতে পারবি

জুনায়েদ আর আমি দ্রুতপায়ে নিচে চলে আসলো। জয়নাল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন আর কিছু লোক বাড়ির দেয়াল থেকে কিছু একটা খুলছে। জুনায়েদ নিচে নামতেই থানার ওসি সাহেব এগিয়ে আসলেন আর বললেন,

> সামান্য মজা থেকে এতোবড় একটা ঝামেলার সৃষ্টি হলো আর একজন নিরপরাধীর প্রাণ গেলো।

> মানে কি ঠিক বুঝলাম না। অবাক হয়ে

> কিছুদিন আগে আপনার একটা ভিডিও দেখে আপনার গার্লফ্রেন্ড বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন। আসলে ওটা আপনার বন্ধুরা মজা করে আপনার গার্লফ্রেন্ডকে দিয়েছিল। ওরা বিষয়টাকে মজা ভেবেছিল কিন্তু আপনার গার্লফ্রেন্ড সিরিয়াস ভেবে নেই। যেহেতু মেয়েটার মুখ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছিল না তাই উনি আপনার সাথে সংযোগ আছে এমন মেয়েদেরকে টার্গেট করেন। আর একজন ভাড়াটে কিলার ঠিক করে আপনার পেছনে লাগিয়ে দেয়। পিউয়ের সাথে আপনার ভালো সম্পর্ক ছিল তাই ছেলেটা পিউ মেয়েটাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিলো। হসপিটালে যখন ও প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছিল তখন লোকটা কৌশলে মেয়েটার শরীরে বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে ওকে মেরে ফেলে। আপনার বাড়িতে কখন কি হচ্ছে তা জানার জন্য বাড়ির ভেতরের সিসি ক্যামেরা হ্যাক করা হয়েছে। আপনার স্ত্রীকে বিয়ের দিন ওই বাড়িতে বিষ সেই খুনী নিজেই দিয়েছিল ছদ্মবেশে আত্মীয় সেজে গিয়ে।

> আর অলির বন্ধুর সিড়ি থেকে পড়ে যাওয়া?

> ওটা কাকতলীয় ঘটনা। তবুও জিঞ্জাসাবাদ চলছে পরে সব জানা যাবে।

> রীমলি কোথায় এখন?

> ওকে খোঁজা হচ্ছে আশাকরি খুব তাড়াতাড়ি ওকে ধরতে পারবো। আপনাদের জানানোর ছিল তাই এসেছিলাম। আর হ্যাঁ আপনি বুদ্ধিমান একজন মানুষ হয়ে এমন সাইকো টাইপ মেয়ের প্রেমে পড়লেন কেমন করে?

> আপনি ভিডিওর ব্যাপারটা জানলেন কেমন করে?

> পিউয়ের খুনিকে ধরার জন্যই সম্ভব হয়েছে। আমরা হসপিটালে সিসি ক্যামেরা আর আপনার স্ত্রীর বাবার বাড়ির সিসি ক্যামেরাতে খুনিকে দেখে সন্দেহ করে লোক লাগিয়েছিলাম। আপনি তো বলেছিলেন আপনার স্ত্রীকে কেউ মারার চেষ্টা করছে। সেই অনুযায়ী ওকে ধরেছি আর ও সব বলে দিয়েছে। ভিডিওর ব্যপারে আমরা নিজেরাই সন্দেহ করে আপনার বন্ধুদের তুলে এনেছি।আপনার বন্ধুদের ও থানায় নিয়ে জিঞ্জিরা করা হচ্ছে। যাইহোক এখন আসছি আমি। আপনি ও আসুন তবে নিজেকে শান্ত করুন আগে।আল্লাহ হাফেজ।

জুনায়েদের দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি টা মনে হলো একদম চলে গেলো। ওর দুপা থরথর করে কাপছে। ও আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না মেঝেতে থপ করে বসে পড়লো। মনে হলো কাকে ভালোবেসেছিলাম আমি যে কিনা নিজের স্বার্থের জন্য অন্যর জীবন নিতে পিছপা হয়না। মেয়েটা প্রচণ্ড জেদী কিন্তু এমন করবে এটা ও কখনও ভাবেনি। আমির ওর পাশে বসে চুপ করে আছে। জয়নাল সাহেব সোফায় বসে মাথায় হাত দিয়ে আছেন। এই ছেলেটার জন্য একটা নিরপরাধ মেয়ের প্রাণ গেছে ভাবলেই উনার কেমন মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলোর ভালোবাসা দেখলে উনার গা জ্বলে যায়। এরা ভালোবাসার নামে যা ইচ্ছা তাই করে। সামান্য মজা থেকে যে বিশাল কিছু হয়ে যেতে পারে এরা বুঝতেই চাইনা। আরা ভালোবাসা মানে জানেনা আবার ভালোবাসতে আসে। আমির জুনায়েদের হাত ধর বলল,

> উপরে চল। যা হবার ছিল সেতো হয়েছে এখন ভেবে আর কি হবে?

> ওরা আমার সাথে এমন কেনো করলো বলতে পারিস? ওরা এমন না করলে রীমলি কখনও এমন করতো না। আমার জন্য পিউকে অকালে প্রাণ দিতে হল। আমি কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।

> আবোলতাবোল বলবিনা। তোর জন্য নয় সবটা হয়েছে ওদের জন্য। কে বলেছিল পিক আর ভিডিও এডিট করতে। আমি চাই ওদের ও শাস্তি হোক। মজা করার একটা লিমিট থাকে।

> যা হবার তা তো হয়েছেই। রীমলির কি হবে?

> ওর চিন্তা ছাড় তুই। যেই মেয়ে এমন সাংঘাতিক একটা কান্ড করতে পারে তাকে আর যাইহোক আমি সুস্থ বলে মানতে পারছি না। ও মানুষিক রুগী তাই ওর চিকিৎসার প্রয়োজন। কান নিয়েছে চিলে তাই চিলের পেছনে দৌড়ানোর মতো কাজকর্ম করে ও।

জুনায়েদ আমিরের কথার কর্ণপাত না করে উঠে ভেতরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। মায়া রুমে মুখ ভার করে বসে আছে। জুনায়েদের কষ্ট দেখে ওর চোখের পানি আটকাতে পারছে না। সারাদিন বাড়িতে সবাই চুপচাপ থাকলো। জুনায়েদ রুমের দরজা খোঁলেনি আর খাবার ও খাইনি তাই মায়া ও খাবার খেতে আসলো না। আমেনা বেগম একবার ছেলে আরেক বার বউমার কাছে এসে অনুরোধ করছে খেয়ে নেবার জন্য কিন্তু ওরা শুনছে না। বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। রাতের বেলা মায়া রুম অন্ধকার করে বসে আছে হঠাৎ কারও পায়ের শব্দে মায়ার বুকটা কেপে উঠলো। ওর কেমন ভয় করছে তাই চিৎকার করতে গেলো আর একটা হাত ওর মুখ চেপে ধরলো। একজন মানুষের নিশ্বাস ওর মুখের উপর পড়ছে। ভয়ে মায়ার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। আগন্তুক ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

> সরি এমন আর হবেনা।

কন্ঠ শুনে মায়া বুঝলো জুনায়েদ এসেছে। জুনায়েদ ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে পাশে দাঁড়ালো। অন্ধকারের জন্য ওরা একে অন্যর মুখ দেখতে না পরলেও বুঝতে পারছে ওদের অবস্থান কোথায় আছে। মায়ার মুখ থেকে হাত সরাতেই ও ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

> আপনি এমন ভাবে এসেছেন আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যদি হার্ট এটাক হতো আর আমি মরে..

> বাজে কথা বলবে না পিচ্চি। এমনিতেই মন খারাপ। এসেছি মন ভালো করতে।

> সারাদিন আপনি রুমে ছিলেন আর আমাকে কষ্ট ও দিয়েছেন।

> আমি ঠিক করেছি এখন থেকে তোমাকে আর কষ্ট দিবো না। যাইহোক প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে খেতে দিবা?

> আমারও পেয়েছে।

> না খেয়ে আছো কেনো?

> আপনি না খেলে আমি কখনও খাইনা বুঝলেন? বাইরে চলুন আম্মুও না খেয়ে আছে। সারাদিন আপনার জন্য সবাই কষ্ট পাচ্ছে।

> আমি আর কাউকে কষ্ট দিবো না।এখন বাইরে চলো।

মায়া ওর কথা শুনে রুম থেকে চলে যেতে গিয়েও ফিরে এসে জুনায়েদ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। জুনায়েদ ওর মাথায় হাত রেখে ভাবলো আজ থেকে শুধু পরিবারের কথা ভেবে সুখে থাকবো। জীবনের এই বাকী সময়টা শুধুমাত্র পরিবারের কথা ভেবে হলেও সুখে থাকার অভিনয় করবো। হয়তো এমন করতে করতে সুখের সন্ধান পেয়েও যাবো।

সমাপ্ত

ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন। এতোদিন যারা পাশে ছিলেন সবাইকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here