ভালোবাসি তাই❤,পর্ব:০১

ভালোবাসি তাই❤,পর্ব:০১
মাহিয়া_মেরিন

“ভাইয়া!!! আমার সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।।আমার নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড নিধি আমার সাথে বেইমানী করেছে।। আমার সাথে….এই অধরার সাথে বেইমানী!! আমার সব শেষ হয়ে গেলো।। এখন আমার কি হবে?? এই জীবন রেখে আর কি হবে??””

কথাগুলো বলে বোকার মতো হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করলো অধরা। সামনে বসেই আপনমনে বই পড়ে যাচ্ছে আশ্বিন। বইয়ের ভেতর সে এতোটাই ব্যাস্ত যে অধরার বলা কথাগুলোর কোন প্রভাবই পড়ছে না তার।।
অধরার অবশ্য এই নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই।। সে তার মতো কান্না আহা জারি করেই যাচ্ছে।। এদিকে অধরার এমন আবোল তাবোল প্রলাপে আশ্বিনের পড়ার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে তাই সে রেগে গিয়ে বললো…

— সমস্যা কি তোর? এভাবে মরা কান্না করছিস কেনো?? কি হয়েছে??

— কি হয়েছে?? আরে ভাইয়া,,বলো কি হয়নি।। নিধি আমার বুকের ভেতর আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।। এখন সেই আগুন আমার বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।। আর তুমি শুধু বলছো কি হয়েছে??
কথাগুলো বলেই আবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করলো।।

— আশ্বিন স্বাভাবিক ভাবেই বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো,,,,আগুন লেগেছে এটা আমাকে না বলে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসে কল কর।

আশ্বিনের কথায় অধরা কান্না বন্ধ করে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো…
— ভাইয়া,,,আমি কিন্তু সিরিয়াস।। আমার বান্ধবী হয়ে নিধি আমারই ক্রাশের সাথে রিলেশনে গিয়েছে।। ভাবা যায়?? কতো বড় বেইমানী করলো আমার সাথে।।

— কথাটা শুনে আশ্বিন বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে অধরার দিকে একবার তাকিয়ে,,,,তোর কতো তম ক্রাশ?? নাম সহ বল।।

— অধরা অন্যদিকে মুখ করে একটা কাশি দিয়ে আবার হাসি হাসি মুখ করে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে,,,,,,ভাইয়া…তুমি তো জানোই আমি খুব একটা বেশি ক্রাশ খাই না।। তাই আরকি,,,এইতো বেশি না।। মানে,,,আমার ৫২ তম ক্রাশ মিরাজ। আরে যার পিছনে লাস্ট তিন মাস ঘুরঘুর করলাম,,সেই।।

আশ্বিন বইয়ের ভেতর থেকে চোখ বাঁকা করে অধরার দিকে একবার তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো…
— ভালোই তো।। বুদ্ধিমান ছেলে। বিপদের আশঙ্কা দেখেই নিজেকে সামলে নিয়েছে।। নয়তো তোর সাথে কোন পাগলে রিলেশনে যাবে?? আর তাছাড়া,,,এটা আবার নতুন কি? তোর লাস্ট ৫১ জন ক্রাশও তো এখন রিলেশনে আছে।।
তুই বরং একটা কাজ কর,,,আশেপাশে তো অনেক সিঙ্গেল ছেলে আছে যারা রিলেশন করতে চায় কিন্তু মেয়ে খুঁজে পাচ্ছে না,,তুই গিয়ে তাদের উপর ক্রাশ খাবি।।

— অধরা হাতের পিঠ দিয়ে নিজের চোখ মুছে নাক টেনে হাসি হাসি মুখ করে বললো,,,এতে করে কি হবে ভাইয়া??

— আশ্বিন স্বাভাবিক ভাবে অধরার দিকে তাকিয়ে বললো,,,এতে করে তোর কি হবে জানি না তবে আমি শিওর সেই ছেলে আগামী তিন মাসের মধ্যেই রিলেশনে যাবে।।

— নিজের সম্পর্কে এমন অপমানজনক কথা শুনে অধরা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,,,হুহহ,,,আমারই ভুল হয়েছে।। তোমার কাছে নিজের কষ্টের কথাগুলো বলাই উচিত হয়নি।। তুমি কখনোই আমার মনের অনুভূতি বুঝতে পারো না ভাইয়া।। কথাগুলো তোমাকে না বলে এখন যদি শ্রাবণ ভাইয়াকে বলতাম তাহলে এতোক্ষণে ভাইয়া আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে মন ভালো করে দিতো।।
একদমে কথাগুলো বলে আশ্বিনের দিকে তাকাতেই দেখে রাগে চোখ মুখ লাল করে অধরার দিকেই তাকিয়ে আছে।।
— অধরা মনে মনে,,,ওরে বাবা…রে।। এগুলো কি বলে ফেললাম আমি। এখন আমার কি হবে??

আশ্বিনের এমন রূপ দেখে অধরার দম যায় যায় অবস্থা।। সে তো ভুলেই গিয়েছিল আশ্বিন রেগে গেলে কি হতে পারে।
— ভাইয়া,,,আমি আসলে এভাবে বলতে চাইনি।মানে আসলে….

— বই বের কর।। কালকে তোর ক্লাস টেস্ট আছে না?? টেস্টে যদি ভুলেও এইবার ফেল করিস অধরা। বিশ্বাস কর,,,আমি তোর কি হাল করবো আমি নিজেও জানি না।।
কথাগুলো বলে একটু চুপ থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,,,,এখন পদার্থ বিজ্ঞান বইটা দাও।।

অধরা আর কিছু না বলে চুপচাপ আশ্বিনের কথা মতো বইটা এগিয়ে দিলো।। সে ভালোমতোই জানে এখন যদি অধরা একটা টু শব্দও করে তাহলে আশ্বিন এখনই তাকে চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে কিমা বানিয়ে ফেলবে।। তাই এই মুহূর্তে চুপ থাকাই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।।

🍁

দীর্ঘ চার ঘন্টা একটানা পড়ানোর পর আশ্বিন অধরাকে তার বাসায় যাওয়ার অনুমতি দেয়।। অধরা এক মুহূর্ত দেরি না করেই তার বাসায় গিয়ে খাটের উপর শুয়ে পড়ে।
— আমি শেষ।। শেষ আমি।। বাপ দাদার জীবনে আজকের মতো এতো পড়ালেখা করি নাই।। আশ্বিন ভাইয়া,,,লিখে রাখো।। একদিন আমিও এর শোধ তুলবো।।। হুহহ!!

হঠাত অধরার ফোনে একটা কল আসে।। ফোন হাতে নিয়ে দেখে তার বেস্ট ফ্রেন্ড নিধি কল দিয়েছে।। আর কিছু না ভেবেই কল রিসিভ করে অধরা।।
— হ্যা,,,নিধি বল।।
— আরে আগে তুই বল,,,আমার প্ল্যান কাজ করেছে তাই না??

— ধুর।। কাজ তো করেইনি উল্টো একটানা চার ঘন্টা ধরে ভাইয়ার কাছে আমার পড়তে হয়েছে সাথে বকা ফ্রি।।

— কি বলিস এসব??? আমার এতো কষ্টের প্ল্যান কিছুই কাজে দিচ্ছে না??
আচ্ছা তুই কোন চিন্তা করিস না অধরা,,,;আমি নতুন প্ল্যান করে তোকে জানাচ্ছি।।

— তোর আর কিছুই করতে হবে না।। মিরাজের সাথে তোর রিলেশন করাতে আমি তোকে কতো হেল্প করেছি।। আর তুই আমাকে কতগুলো ফালতু আইডিয়া দিয়ে উল্টো আমার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দিচ্ছিস।। তোর কথায় আমার ভাইয়াকে বলতে হয় আমার ৫২ টা ক্রাশ।। ভাবা যায়??

— শোন অধরা।। ভাইয়ার মনে যদি একবার হিংসা তৈরি হয় বুঝবি ভাইয়াও তোকে ভালোবাসে। আরে দোস্ত কিছু পেতে হলে কিছু হারাতেই হয়।। এটাই নিয়ম।।

— হুম।। রাখছি এখন।। আজকে এতো এতো পড়ালেখা করে এখন আমি অনেক টায়ার্ড।। আমার এখন ঘুম দরকার। সো,,,টাটা।।
অধরা ফোন রেখে আশ্বিনকে বকতে বকতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে।।

🍁এবার তাদের পরিচয় জানা যাক,,,,এতোক্ষণ ধরে যে মেয়েটা বকবক করে যাচ্ছিল উনি হলেন অধরা,,,,অধরা ওহি। খুব ছোট বেলায় মা-বাবা কার এক্সিডেন্টে মারা যায়,,,তখন থেকেই বড় ভাইয়া অর্ণবকে সাথে নিয়ে দাদা-দাদি,,চাচা-চাচির সাথে এক বাসায় থাকে।। অধরা পরিবারের একমাত্র এবং ছোট মেয়ে হওয়ায় সবার কাছেই সে খুব বেশি আদরের। অধরা এবার ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ে,,,পড়ালেখায় উনি একদমই জিরো,,,,তাই প্রতিদিন আশ্বিনের কাছে তাকে পড়তে হয়।।

আশ্বিন চৌধুরী,,,সম্পর্কের দিকে দেখতে গেলে…. আশ্বিনের বাবা আর অধরার চাচা বেস্ট ফ্রেন্ড + বিজনেস পার্টনার।। দুই পরিবার একে অপরের এতোটাই ক্লোজ যে তারা পাশাপাশি বাসায়ই থাকে।। অর্ণব আশ্বিন আর শ্রাবণ এবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে।। শ্রাবণ হলো অধরার চাচাতো ভাই।।
বাকিটা গল্পে জানতে পারবেন।। এখন গল্পে ফিরে যাওয়া যাক।।।।🍁

বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে….কিন্তু অধরার ঘুম থেকে ওঠার কোন লক্ষণই নেই।। ছোট মা(চাচি) এসে অধরাকে অনেকবার ডেকে গিয়েছে কিন্তু কে শোনে কার কথা।। শেষে না পেরে হাল ছেড়ে দিলেন ছোট মা।। এদিকে অর্ণব বাহির থেকে বাসায় আসতেই ছোট মা তার সামনে এসে…

— বাবা অর্ণব,,,,চলে এসেছিস??

— হ্যা ছোট মা।। কিছু হয়েছে নাকি?? আর টুনির মা(অধরা) কোথায়??

— ঘুমাচ্ছেন। অধরাকে গিয়ে ঘুম থেকে ওঠা।। আজকে নাকি রাণী সাহেবা অনেক পড়ালেখা করেছেন তাই উনি ক্লান্ত।।

— হিহিহি।। আচ্ছা আমি দেখছি।।

অর্ণব দৌড়ে অধরার রুমে এসে দেখে অধরা তার বড় টেডি জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো করে ঘুমাচ্ছে।।
— বোন উঠে পড়।। আর কতো ঘুমাবি?? এই টুনির মা।।।
অর্ণবের এতোবার ডাকার পরেও অধরা ঘুম থেকে ওঠার কোন নাম গন্ধ নেই তাই অর্ণব বাঁকা হেসে বললো,,,,,””আচ্ছা কেউ যদি আইসক্রিম খেতে না চায় তাহলে আর কি করার?? আমি গিয়ে আইসক্রিমটা দাদিকে দিয়ে আসি।।””

— অর্ণবের কথা শুনে অধরা এক লাফ দিয়ে উঠে বসে,,,,””ভাইয়া আইসক্রিম নিয়ে এসেছো?? আগে বলবে না?? দাও আমাকে।।”” বলেই অর্ণবের হাত থেকে আইসক্রিম ছিনিয়ে নিয়েই খেতে শুরু করলো।।
অধরার কান্ড দেখে অর্ণব মুচকি হেসে অধরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।। অধরা আইসক্রিম খেতে খেতে বললো,,,,ভাইয়া জানো? তোমার ওই অসভ্য বেস্ট ফ্রেন্ড…দ্যা গ্রেট আশ্বিন চৌধুরী আজকে আমাকে কতগুলো বকা দিয়েছে!! আশ্বিন ভাইয়া একটা পচা,,,ধলা চিকা,,মির- জাফরের বংশধর,,পচা ডিম।। ভাইয়ার সাথে আর কথা নাই। হুহহ!!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখটা কালো করে বললো…. “”আশ্বিন ভাইয়া কি কখনোই আমার মনের অনুভূতি বুঝতে পারবে না??””
ঠোঁট উল্টে কথাগুলো বললো অধরা।

— অর্ণব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে বোনের মনের অবস্থা,,,””মন খারাপ করিস না বোন।। সবার মতো আশ্বিনও তোকে অনেক পছন্দ করে,,,কিন্তু সে প্রকাশ করে না।। আমার বোনটা এমনি কিউট যে সবাই তাকে ভালোবাসে।। ভালোভাবে খোঁজ নিলে দেখবি,,,আশ্বিনের মনেও তোর জন্য অপ্রকাশিত অনুভূতি আছে।।””

অর্ণবের কথায় অধরা মুচকি হেসে ভাইয়ের দিকে তাকায়।। এদিকে অধরার অবস্থা দেখে অর্ণব হাসতে হাসতে শেষ।। আইসক্রিম মুখের আশেপাশে লেগে আছে।। অধরা আপন মনে আইসক্রিম খাচ্ছে আর অর্ণব মুচকি হেসে টিস্যু দিয়ে তার হাত মুখ মুছে দিচ্ছে।।
দুই ভাইবোন মিলে হাসা হাসি খুনসুটি করতে থাকে।।

🍁এদিকে…..

আশ্বিন বই নিয়ে বসে আছে।। সারাদিন ধরে পড়া ছাড়া যেন তার আর কোন কাজই নেই।। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাত তার সকালে অধরার বলা কথাগুলো মনে পড়ে….
“” তুমি কখনোই আমার মনের অনুভূতি বুঝতে পারো না ভাইয়া “”

কথাটা মনে হতেই একটা বাঁকা হাসি দেয় আশ্বিন।। অধরা তাকে সেই ছোট বেলা থেকেই পছন্দ করে,,আশ্বিন বিষয়টা বুঝতে পারলেও সে পাত্তা দেয় না। যদিও এর একটা বিশেষ কারন আছে।। কিন্তু অধরার দিকে একবার তাকালেই তার মায়ায় সাগরে পরে যায় আশ্বিন। বিশেষ করে,,,অধরার মন কাঁড়ানো হাসিটা।। মেয়েটা যে আহামরি সুন্দর এমন না। তবে তার গলুমলু দুটো গাল,,হাসির সময় শুধু ডান গালে পড়া সেই টোল,,টানাটানা চোখ,,আর কাঁধ সমান ঝলমলে সিল্কি চুল সব নিয়ে অধরার সৌন্দর্যকে আরও বেশি ফুটিয়ে তুলেছে।। যা আশ্বিনকে এক অজানা ঘোরের মাঝে ফেলে দেয়।।

আশ্বিন কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আনমনে মুচকি হেসে আবার পড়ায় মনোযোগ দেয়।।

—চলবে❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here