দোলনচাঁপার_টানে,পর্ব:৮,৯

দোলনচাঁপার_টানে,পর্ব:৮,৯
দেবারতি_ধাড়া
অষ্টম_পর্ব

কিঙ্কিণী যত এগিয়ে যাচ্ছে ওই ফুলের দেখানো পথে ততোই যেন ফুলের সুগন্ধটা তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হয়ে উঠছে। হঠাৎই ওর মাথাটা ঘুরে যাওয়ায় পড়ে গিয়েছিলো ও। তারপরই জ্ঞান হারিয়ে যায় কিঙ্কিণীর। সকালে কোকোর ডাকে জ্ঞান ফিরলো ওর। জ্ঞান ফেরার পরই কাল রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে যাওয়ায় আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ফুল গুলো পড়ে আছে কিনা। কিন্তু ও পড়ে থাকা ফুল গুলো আর দেখতে পেলোনা। তাই উঠে গিয়ে ছাদ থেকে নিয়ে এসে টেবিলে রাখা ফুল গুলোকে দেখতে গেলো। কিন্তু সেই ফুল গুলো যেমন ছিলো তেমন ভাবেই রাখা আছে দেখলো। তাই একটু অবাক হলো কিঙ্কিণী। আর মনে মনে ভাবলো, “তাহলে কী আমি কাল রাতে যা যা দেখলাম সবটা আমার মনের ভুল ছিলো? কিন্তু কী করে অামার মনের ভুল হতে পারে? আমি তো নিজের চোখেই দেখলাম ফুল গুলো সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছিলো। আর ওই ফুল গুলো দিয়ে একটা রাস্তাও তৈরী হয়েছিলো। কিন্তু আমি তো মাত্র কয়েকটা ফুল এনেছিলাম ছাদ থেকে। তাহলে কী করে অত ফুল হয়ে যাবে? তাহলে হয়তো আমার মনেরই ভুল হবে! আর ওই স্বপ্নটা? আমার ওই স্বপ্নের মানুষ গুলো কারা ছিলো? কি মিষ্টি ছেলে-মেয়ে দুটো। বেশ সুন্দর সুখের সংসার ওদের। কিন্তু আমি কেন এসব স্বপ্ন দেখলাম?! কি জানি!” এসব নিয়ে ভেবে আর সময় নষ্ট করলোনা কিঙ্কিণী। কোকো বাইরে যাওয়ার জন্য চিৎকার করছিলো। আজ খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি। একটু বাইরে নিয়েই যাওয়া যায় কোকোকে। তাই তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নিয়ে কোকোকে নিয়ে একটু বাইরে থেকে হেঁটে এলো ও। তারপর এককাপ কফি বানিয়ে নিয়ে স্কুলের খাতা গুলো নিয়ে বসলো। কিন্তু কিছুতেই কাল রাতের ঘটনাটা ভুলতে পারছেনা কিঙ্কিণী। বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছে ওই স্বপ্নটা। স্কুলে গিয়েও মাথাটা ঝিমঝিম করছিলো। তাই যখন কোনো ক্লাস ছিলোনা তখন সামনের টেবিলে মাথা রেখে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো কিঙ্কিণী। আর তখনই আবারও ওর চোখের সামনে ভেসে এলো ওই স্বপ্নটা।

একটা ছোট্ট সংসার। সেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনই ভীষণ হাসি-খুশি। ছটফটে একটা মেয়ে। তাকে ভীষণ আগলে রাখছে তার শান্ত এবং পরিণত মনস্ক স্বামীটি। তার পড়াশোনার জন্য কী নিদারুণ ভাবে রাত-দিন এক করে খেটে চলেছে সেই পুরুষটি। সেই মেয়েটিরও স্বপ্ন ছিলো একজন স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার। তাই একজন স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার জন্য যা যা পড়াশোনা করা দরকার তার সমস্তটাই ওই মেয়েটিও রাত-দিন এক করে পড়ে চলেছে ওই পুরুষের উপার্জনের টাকায়। শুধু একটা চাকরি পাওয়ার আশায়। আর তারপরই ওদের এই অভাবের সংসারের অবসান ঘটে একটা সুন্দর স্বচ্ছল সংসারে রূপান্তরিত হবে। সেই পুরুষটি তার স্ত্রীর সামনে চা-জলখাবার সমস্ত কিছু এগিয়ে দিচ্ছে। আর স্ত্রীটি বইয়ের মধ্যে মুখ গুজে পড়েই চলেছে একভাবে। আর তারপর হঠাৎই একদিন চাকরির পরীক্ষা এসে গেলো। আর তার কিছুদিন পরেই স্কুলে চাকরির স্বপ্নটাও পূরণ হলো ওই দম্পতির।

-সৌহ.. সৌহ আমি চাকরিটা পেয়েগেছি সৌহ… আজ আমাদের স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে… আমি আজ ভীষণ খুশি.. থ্যাংকস সৌহ.. এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র তোমার জন্য.. তুমি যদি আমাকে এত সাপোর্ট না করতে তাহলে তো আমিই পারতামইনা…

স্কুলের চাকরিটা কনফার্ম হয়ে যাওয়ায় বাড়ি ফিরে দৌড়ে এসে মেঘা জড়িয়ে ধরলো সৌহার্দ্যকে। মেঘা আজ ভীষণ খুশি। ওর এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলে।

-আমিও ভীষণ খুশি হয়েছি মেঘা.. আমার মেঘা যে দিদিমণি হয়ে গেলো!
-কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে সৌহ.. আমি কী করে তোমাকে ছেড়ে ওখানে একা একা থাকবো? আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবোনা..
-তা বললে কী করে হয় মেঘা? আমি তো প্রত্যেক সপ্তাহেই তোমার কাছে যাবো.. তখন তো আমরা একসাথেই থাকবো.. আর কিছু বছর পরে না হয় আমিও তোমার ওখানেই চলে যাবো.. ওখানেই কোনো একটা চাকরি খুঁজে নেবো..
-কিন্তু…
-আর কোনো কিন্তু নয়.. এই নাও মিষ্টি খাও..

বলেই সৌহার্দ্য একটা রসগোল্লা ঢুকিয়ে দিলো মেঘার মুখে। তারপরই সব গোছগাছ করে নিলো মেঘা। পরশু থেকেই ওর জয়েনিং। আর খুব বেশি সময় নেই।

তখনই অভিমন্যুর ডাকে আলগা ঘুমটা ভেঙে গেলো কিঙ্কিণীর।

-কী ব্যাপার কিঙ্কিণী ম্যাডাম? রাতে ঘুম হয়নি নাকি আপনার?

টেবিল থেকে মাথা তুলে অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে কিঙ্কিণী বললো,

-না না! আসলে চোখটা একটু লেগে গিয়েছিলো। এখন তো কোনো ক্লাস ছিলোনা তাই আর কি…

কিঙ্কিণী অভিমন্যুর দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো অভিমন্যু। তারপর বললো,

-একী অবস্থা হয়েছে আপনার মুখ চোখের? আপনার শরীর ঠিক আছে তো কিঙ্কিণী? আপনার চোখ মুখ তো পুরো শুকিয়ে গেছে! কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারেন আপনি..

কিঙ্কিণী টেবিল থেকে নিজের চশমাটা নিয়ে পরে নিলো চোখে। তারপর বললো,

-না না সেরকম কিছু না! আসলে কাল রাত পর্যন্ত একটু গল্পের বই পড়ছিলাম, আর তারপরই লোডশেডিং হয়ে গেলো! তাই ঘুমটা ঠিক মতো হয়নি বলে হয়তো এরকম লাগছে। আমি ঠিক আছি অভি..
-হুম! বুঝলাম.. আমাদের গ্রামের দিকে একবার লোডশেডিং হলে তো আর কারেন্ট আসতেই চায়না! ভাগ্যিস আমাদের ওদিকটায় কাল রাতে লোডশেডিং হয়নি! তা নাহলে তো আমারও ঘুমের বারোটা বেজে যেতো! আগে তো প্রায় প্রতিদিনই লোডশেডিং হতো। এখন সেই তুলনায় একটু কমেছে। তা কখন এলো কারেন্ট?
-আমি ঠিক জানিনা অভি.. ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, রাতে বা ভোরের দিকে কোনো একটা সময় এসে গিয়েছিলো হয়তো! সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন তো দেখলাম কারেন্ট এসেগেছে।
-ওহ আচ্ছা! ওই দেখুন ঘন্টা বেজে গেছে! যান! আপনার ক্লাস আছে তো এখন?
-হ্যাঁ যাই! আপনিও যান.. আপনারও তো ক্লাস আছে!
-হ্যাঁ যাই..

ক্লাসে গিয়েও কিঙ্কিণীর ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে ওই স্বপ্নটার কথা। কিসব হচ্ছে ওর সাথে? বাচ্চাদের ঠিক মতো পড়াতেও পারছেনা। বারবার ওর মনে হচ্ছে তারপর কী হলো? তাহলে কী এই দোলনচাঁপা গাছটা ওই মেয়েটির গাছটাই? কিন্তু তাহলে ওই মেয়েটি ট্রান্সফার নিয়ে চলেই বা গেলো কেন? এসব চিন্তা ভাবনাই ওর মাথার মধ্যে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসবের চিন্তায় কিঙ্কিণীর বাড়িতে বা কুশলকে ফোন করার কথাও মনে থাকছেনা। কোকোর প্রতিও যেন কেমন উদাসীন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। শুধু জানতে ইচ্ছা করছে তারপর কী হলো?

এসব ভাবনা চিন্তা কিছুদিন ধরে অবিরত ঘুরে বেড়াচ্ছে কিঙ্কিণীর মনের মধ্যে। আর যখনই ও একটু ঘুমাতে যাচ্ছে বা ঘুমিয়ে পড়ছে তখনই ওর স্বপ্নের মধ্যে বারবার আসছে ওই ছেলেটি আর মেয়েটি। সেরকমই আজ রাতেও ও দেখলো, ওই মেয়েটি দোলনচাঁপা গাছটা নিজের সাথে নিয়ে এসেছে এই বাড়িতে। সেটাকে টব-শুদ্ধু ছাদে রেখেছে। তার সাথে আরও অনেক গাছ কিনে পুরো ছাদটা সাজিয়েছে নিজের হাতে।

-বাহ! কী সুন্দর লাগছে ছাদের গাছ গুলো। মেঘা এত গাছের যত্ন করতে তো তোমার খুব কষ্ট হয় সোনা?
-না! আমার কিচ্ছু কষ্ট হয়না সৌহ। আমার খুব ভালোলাগে গাছ গুলো। সারা সপ্তাহ তো তুমি আমার সাথে থাকোনা, তাই এই গাছ গুলোকে নিয়েই আমার সময় কেটে যায়। আমার আর এখানে একা একা থাকতে ভালোলাগেনা সৌহ… আর তোমাকেই বা কী করে এখানে এসে রোজ রোজ থাকতে বলি? তুমি তো ছুটিও অ্যারেঞ্জ করতে পারোনা!
-আমি আমার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বরং তোমার এখানেই চলে আসি! এখানে নাহয় কোনো একটা কাজ জোগাড় করে নেবো..
-তা বললে কী করে হয় সৌহ? তোমার ওই কম স্যালারির চাকরিটার জন্যই তো আমাদের সংসারটা এতদিন ধরে চলেছে। আর আমার পড়াশোনার সব খরচ তো তুমি ওই চাকরির উপার্জন থেকেই করেছো.. আমি কিছুতেই আমার সুখের জন্য তোমার ওই চাকরিটা ছাড়তে বলতে পারিনা…
-তাহলে উপায় কী মেঘা? আমি তো রোজ রোজ এত দূরে আসতেও পারবোনা!
-আমার এবার একটা বাচ্চা চাই সৌহ.. তাকে নিয়েই আমার ঠিক সময় কেটে যাবে!
-কিন্তু তুমি একা এখানে বাচ্চা সামলাবে কী করে?
-প্লিজ সৌহ.. আর কোনো কিন্তু নয়.. এখন তো আর ও এলে আমাদের কোনো অসুবিধা হবেনা.. এবার তো ওকে আসতে দাও.. আর কতদিন অপেক্ষা করাবে আমাকে? আমি এবার মা হতে চাই.. আমি ঠিক সামলাতে পারবো আমাদের বাচ্চাকে..
-আচ্ছা বাবা! ঠিক আছে তাই হবে…

হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেলো কিঙ্কিণীর। আজও সারা ঘরময় শুধুই দোলনচাঁপার সুগন্ধে ভরে গেছে। কিঙ্কিণী বুঝতে পারলোনা ও কী করবে। ও মনে মনে ভাবলো, “আজ তো আমি দোলনচাঁপা ফুল নিয়ে আসিনি ছাদ থেকে! তাহলে এত মিষ্টি ফুলের গন্ধ কোথা থেকে আসছে?! কী সব হচ্ছে আমার সাথে? ওরা কারা? আমি কেন বারবার ওদের দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে? আমার কী কোনো সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাওয়া উচিৎ? কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা আমি! এই বাড়িটাতেই কী কোনো রহস্য আছে? এই দোলনচাঁপা গাছটাই কী ওই গাছটা? আমি এই গাছের ফুল নিই বলেই কী আমি এসব দেখতে পাচ্ছি? আমাকে কালই দুলাল বাবুর সাথে কথা বলতেই হবে!”

সকালে দুলাল বাবু আসার পর কিঙ্কিণী দুলাল বাবু কে বললো,

-আপনার সাথে আবার কথা আছে দুলাল বাবু। আপনি কি এখন ফ্রি আছেন?
-হ্যাঁ ম্যাডাম কি ব্যাপারে বলুন তো?
-এই বাড়িটার ব্যাপারে দুলাল বাবু! আমার আপনার থেকে কিছু জানার আছে আর আমার মনে হয় আপনি সেগুলো বলতে পারবেন!
-এই বাড়িটার ব্যাপারে বলতে? আমি কি করে বলবো বলুন তো?
-আপনি ভয় পাবেন না দুলাল বাবু! আমি এমন কোনো প্রশ্ন করবোনা যেগুলো আপনার পক্ষে জানা বা তার উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।
-আচ্ছা বলুন কী জানতে চান?
-আচ্ছা দুলাল বাবু আপনি এখানে কতদিন আছেন? মানে কবে থেকে আছেন এখানে?
-তা ওই ধরুন না প্রায় দশ বছর ধরে হবে..
-দশ বছর ধরে? তাহলে তো আপনি নিশ্চয়ই অনেক কিছুই জানেন এই বাড়ি সম্পর্কে। কি তাইনা দুলাল বাবু?
-আপনি কি জানার কথা বলছেন একটু পরিষ্কার করে বলবেন কিঙ্কিণী ম্যাডাম?
-আচ্ছা দুলাল বাবু আপনাকে কিছু বলতে হবে না আপনি শুধু আমাকে একটা কথাই বলুন যে, এই বাড়িতে আগে যিনি থাকতেন তার নাম কি ছিলো?
-দেখুন ম্যাডাম এখানে তো অনেকেই থাকতেন। সবার নাম কি আর আমার পক্ষে মনে রাখা সম্ভব?
-না না.. আমি সবার নাম জানতে চাই না দুলাল বাবু.. আমি শুধু জানতে চাই ছাদে যার গাছগুলো ছিলো, তার নাম কী?

কিঙ্কিণীর মুখে এইসব প্রশ্ন শুনে দুলাল বাবু কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন। ওনার মুখটা কেমন যেন নিরুপায় আর ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। দুলাল বাবু কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। দুলাল বাবুর কাছে কোন উত্তর না পেয়ে কিঙ্কিণী আবারও জিজ্ঞেস করলো,

-কি হলো দুলাল বাবু বললেন না যে? কি নাম ছিলো ওনার?

একটু ভেবে চিন্তে তারপর দুলালবাবু উত্তর দিলেন,

-ওনার নাম.. ওনার নাম ছিলো মেঘোমালা সরকার.. খুব ভালো ছিলেন ওই ম্যাডাম.. ওনাকে সবাই মেঘা দিদিমণি বলেই ডাকতো..

ক্রমশ…

#দোলনচাঁপার_টানে
#দেবারতি_ধাড়া
#নবম_পর্ব

দুলাল বাবুর মুখে মেঘা নামটা শুনেই যেন চমকে উঠলো কিঙ্কিণী। ও যে স্বপ্নটা এতদিন ধরে দেখছে তাতে ওই মেয়েটির নামও তো মেঘা! তাহলে কি মেঘোমালা থেকেই মেঘা? নামটা মেলাতে পারলেও আর কোনো কিছুই মেলাতে পারলোনা কিঙ্কীণী। আর দুলাল বাবু কে জিজ্ঞেস করতেও উনি সবটাই অ্যাভয়েড করে গেলেন। কিঙ্কিণী ভাবলো দুলাল বাবুকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও এবং উনি জানলেও ওনার থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলোনা দুলালবাবুকে। দুলালবাবু কিঙ্কিণীর প্রশ্নের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিঙ্কিণী মনে মনে ভাবলো বাবা-মাকে না বললেও কুশলকে সবটা জানানো দরকার। কিন্তু এটাও ভাবলো যে কুশল ভীষণ ভীতু প্রকৃতির। এসব শুনে তো ও এই বাড়িতে আর আসবেইনা বরং কিঙ্কিণীকেও এখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইবে। তাই কিঙ্কিণী কাউকেই আর কিছু জানালোনা। কিন্তু মনে মনে ঠিক করলো যে এই স্বপ্নের রহস্য ও উদঘাটন করবেই। কিন্তু কিভাবে করবে সেটাই ভেবে উঠতে পারছিলোনা। তাই তারপর কিঙ্কিণী কয়েক দিনের জন্য ছুটি নিলো স্কুল থেকে। আর বাড়িতে বাবা-মাকে আর কুশল সবাইকেই ও বললো যে ও একটা উপন্যাস পড়তে শুরু করেছে তাই ওকে যেন কেউ এখন কয়েকদিন ফোন করে ডিস্টার্ব না করে। উপন্যাসটা শেষ হলে ও নিজেই সবাইকে ফোন করে নেবে। ছোট থেকেই কিঙ্কিণী এই রকম একটু বইপোকা টাইপের। কিছু একটা পড়া শুরু করলে সেটা যতক্ষণ না শেষ করবে ততক্ষণ সেই বই থেকে কেউ ওর মুখ সরাতে পারেনা। খাওয়া ঘুম ফেলে রেখে শুধু সেটা নিয়েই পরে থাকবে। সে কোনো উপন্যাস, গল্প কিংবা যেকোনো কাজই হোকনা কেন! যতক্ষণ না সেটা শেষ করবে ততক্ষণ ওর আর কোনোদিকে লক্ষ্য বা মন কিছুই থাকেনা। তাই কেউই আর ওকে জ্বালাতন করলোনা ফোন করে। কিঙ্কিণী এই কটাদিন এই বাড়িতে একদম একা থেকে জানার চেষ্টা করলো সব কিছু.. প্রথমদিন এই বাড়িতে আসার পর কিঙ্কিণী একা থাকবে বলে পাশের ঘর গুলো বন্ধ করে দিয়েছিলো বাইরে থেকেই। কিন্তু ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখেনি কিছুই। তাই আজ ও ঠিক করলো পাশের ঘর গুলোতে কী আছে সেটা ও দেখবে। তখনই ওর মনে পড়ে গেলো সেদিন ঘরে তালা দিয়ে সেই চাবি গুলো দুলাল বাবুকেই দিয়ে দিয়েছিলো। তাই কিঙ্কিণী দুলালবাবু খাবার দিতে এলে পাশের ঘরের চাবি গুলো চাইলো। কিন্তু প্রথমে দুলাল বাবু পাশের ঘরের চাবি গুলো দিতে রাজি না হলেও কিঙ্কিণীর জোড়াজুড়িতে দিয়ে দিলেন চাবি গুলো। দুলালবাবু চাবি আর খাবার দিয়ে চলে যাওয়ার পর কিঙ্কিণী ঘর গুলো খুলে দিলো। একটা ঘরে ঢুকে দেখলো এই ঘরটাতে কয়েকটা ফুল গাছের টব, গাছের সার এসব ছাড়া কিছুই পাওয়া গেলোনা। তাই এই ঘরটা আবার তালা দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলো কিঙ্কিণী। এই ঘরে বেশ অনেক কিছু জিনিস পাওয়া গেলো। একটা পড়ার টেবিল-চেয়ারসহ বেশ কিছু বইপত্র খাতা পেন আর এছাড়াও মহিলাদের ব্যবহৃত কিছু প্রসাধনী খুঁজে পেলো। একটা বুকশেল্ফে অনেক বইপত্র রয়েছে। কিঙ্কিণী হাতরাতে লাগলো ওই বুকশেল্ফটা। সেখানে বেশ কিছু ভালো ভালো রাইটারের অনেক বইও পাওয়া গেলো। একটা ডায়েরি দেখতে পেলো কিঙ্কিণী। সঙ্গে সঙ্গে ডায়েরিটা হাতে নিয়েই ঘরে রাখা টেবিল-চেয়ার টার দিকে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসলো কিঙ্কিণী। ডায়েরির পাতা উল্টোতে উল্টোতে দেখলো ডায়েরির ভিতরে অনেক কিছু লেখা আছে। কিঙ্কিণী দেখলো ডায়েরীর প্রথম পাতায় লেখা আছে “মেঘাকে… সৌহার্দ্য…”
তারপর লেখা আছে “আমি তো আর তোমার সাথে সারা সপ্তাহ থাকতে পারিনা মেঘা.. তাই তোমাকে এই ডায়েরিটা উপহার দিলাম! তুমি তোমার সারাদিনের সমস্ত কথা এই ডায়েরির মধ্যেই লিখে রেখো.. প্রত্যেক সপ্তাহে আমি এসে এই ডায়েরিটা পড়বো। যদিও আমাদের মধ্যে প্রত্যেক দিন ফোনে কিংবা ভিডিও কলে কথা হবেই.. তা সত্ত্বেও তোমার হাতের লেখা আর তোমার হাতের ছোঁয়া থাকবে এই ডায়েরিটাতে। তাই সেটা পড়তে আমার খুব ভালো লাগবে মেঘা.. আর তাই তোমাকে এই উপহার! সারাদিনে ভালো-মন্দ যা কিছু তোমার সাথে ঘটবে, সেই সমস্ত কিছু তুমি এই ডায়েরির মধ্যে লিখে রেখো। আজ থেকে এই ডায়েরি তোমার নতুন এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ঠিক যেমনটা তোমার গাছগুলো, আমার দেওয়া দোলনচাঁপা তোমার প্রিয় বন্ধু, ঠিক এই ডায়েরিটাও তোমার ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠুক সেটাই আমি চাই.. এই ডায়েরির সাথেই সব কিছু ভাগ করে নিও তুমি.. তোমার সুখ-দুঃখ, ভালোলাগা, খারাপ লাগা, সারাদিন স্কুলে বাচ্চাদের সাথে কেমন কাটলো সমস্তটা লিখে রেখো এই ডায়েরির মধ্যে। প্রতিদিন তোমার গাছে কতগুলো করে ফুল ফুটলো সেটাও লিখতে ভুলোনা কিন্তু। আমি তোমার সমস্তটা জানতে চাই মেঘা.. সমস্ত খুটিনাটি ছোট ছোট জিনিস গুলোও আমি জানতে চাই.. আমি জানি তোমার স্কুল, আমার চাকরি এসবের মাঝে আমাদের সেভাবে সুখ-দুঃখের কথা গুলো ভাগ করে নেওয়া হয়না! আগে তো তুমি তোমার সারাদিনের সমস্ত কথা আমি ফেরার সাথে সাথেই আমাকে বলতে! আমাকে তোমার সবটা না বললে তো তোমার ঘুমই হতোনা! তাইজন্যই অনেক ভেবে চিন্তে এই ডায়েরিটা তোমাকে দিলাম… ভীষণ ভালোবাসি আমি তোমাকে মেঘা..”

পাতা উল্টোলো কিঙ্কিণী.. সেখানেই পেলো মেঘা আর সৌহার্দ্যের বিয়ের একটা ছবি.. সাধারণ লাল রঙের একটা শাড়ি পরে মেঘা, আর সৌহার্দ্য একটা পাঞ্জাবী পরে। ছবিটা ভালো করে দেখে কিঙ্কিণী বুঝলো খুব সম্ভবত কোনো মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করার ছবি। তারপর আবারও পাতা উল্টে পড়তে শুরু করলো মেঘার লেখা সমস্ত কথা..

“থ্যাংক ইউ সৌহ.. সত্যিই আমার মনের কথা গুলো ভাগ করে নেওয়ার জন্য একটা বন্ধুর দরকার ছিলো.. সারাদিন যতই স্কুলে বাচ্চাদের নিয়ে কেটে যাক কিংবা বাড়ি এসে ছাদের গাছগুলো নিয়ে সময় কেটে যাক কিন্তু সারাদিনের পর নিজের মনের কথা গুলো লেখাটা আমার দরকার ছিল। কিন্তু কিভাবে সারাদিনের সবকিছু লিখবো আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা.. ভেবেছিলাম প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে ডায়েরি লিখতে বসবো। কিন্তু এখানে প্রতিদিন রাতে লোডশেডিং হয়ে যায় সৌহ! তাই লিখবো মনে করলেও রাত্রিবেলা আমি লিখতে পারিনা। তাই আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই ডায়েরিটা নিয়ে বসে পড়লাম। জানো সৌহ, কাল সারাটা দিন অনেক ভালো কেটেছে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে। বাচ্চাগুলো যা দুষ্ট না.. একদম কথা শুনতে চায়না! পড়াশোনা তো করতেই চায় না। শুধু অজুহাত দেয় যে ওদের এখানে নাকি প্রতিদিন লোডশেডিং হয়ে যায় তার জন্য স্কুল থেকে বাড়ি গিয়ে ওরা আর পড়তেই পারে না। আর তাই কোনোদিন পড়া হয়না। প্রথম প্রথম আমি সত্যিই অজুহাত মনে করতাম জানো, কিন্তু এখানে কিছুদিন থাকার পরে আমি সত্যিই দেখলাম যে ওরা ঠিকই বলেছে। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যার পরই লোডশেডিং হয়ে যায় এখানে। আর তাই বাচ্চাদের পড়াশোনার ভীষণ ক্ষতি হয়! আর শুধু বাচ্চাদের পড়াশোনা কেন কেউই ঠিক মতো নিজের কাজ করতে পারে না কারেন্ট না থাকার কারণে। আমারই তো কি অসুবিধা হয় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পরে কাজ করতে কিংবা স্কুলের খাতা দেখতে। তাই যা কিছু দরকারি কাজ সব আমি ভোর ভোর উঠে সকালেই করে রাখি। আর ভীষণ গরমও হয়। এই গরমে ফ্যান ছাড়া থাকা যায় বলো? কত অসুস্থ মানুষও তো আছেই এই গ্রামে। তাদেরও তো এই গরমে থাকতে খুব কষ্ট হয়! জানো তো সৌহ.. আমার মনে একটা ইচ্ছা আছে… কিন্তু আমি সেটাতে তোমাকে আমার পাশে চাই.. আর আমি জানি আমার এই জার্নিতে তুমি আমার পাশে থাকবে। আর পাশে থেকে আমাকে সাহায্য করবে… প্রত্যেকদিন সন্ধ্যের পর যাতে এভাবে আর লোডশেডিং না হয় সেটারই ব্যবস্থা করতে চাই আমি.. তার জন্য যতদূর যেতে হয় আমি যেতে চাই সৌহ.. আমি সরকারের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাতে চাই! এভাবে আর কতদিন সবাই মুখ বুজে বসে থাকবে? এতে যে বাচ্চাদের পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হচ্ছে! বয়স্ক মানুষরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন! সবার কাজের ক্ষতি হচ্ছে, বিকেলের পর গ্রামের মানুষ রাস্তায় বেরোতে পারছেনা আলোর অভাবে!”

ডায়েরিটা পড়তে পড়তে সমস্তটা যেন কিঙ্কিণীর চোখের সামনে ভেসে আসছিলো। তার সাথে অভিমন্যুর বলা কথাটাও মনে পড়ে গেলো। অভিমন্যুও তো বলছিলো, যে এখানে আগে প্রতিদিন কারেন্ট চলে যেতো সন্ধ্যার পর। এমনকি এখনো তাই! যদিও আগের থেকে কিছুটা কমেছে.. আবারও পাতা উল্টে পরের পাতায় পৌঁছলো কিঙ্কিণী..

ক্রমশ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here