দোলনচাঁপার_টানে,ষোড়শ_পর্ব

দোলনচাঁপার_টানে,ষোড়শ_পর্ব
দেবারতি_ধাড়া

প্রায় দু-সপ্তাহ ডক্টর স্নেহলতার দেওয়া ওষুধ গুলো একরকম জোর করেই খাওয়ানো হলো সৌহার্দ্যকে, ওষুধ গুলো খাওয়ালেই বেশি বেশি ঘুমাতো সৌহার্দ্য। শরীরে সারাক্ষণ ঝিমুনি ভাব জড়িয়ে থাকতো ওর। সেদিন স্নেহলতার বাড়ি থেকে ফেরার পরই ওর চেম্বারে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিয়েছিলো কুশল। সৌভাগ্যবশত কোনো একটা অন্য পেশেন্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ায়, সেই ডেট আর সময়েই সৌহার্দ্যকে দেখানোর জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে গিয়েছিলো। তা নাহলে স্নেহলতার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া খুবই মুশকিলের ব্যাপার। সৌহার্দ্যের চেকআপের পর স্নেহলতা আলাদা ভাবে কিঙ্কিণী আর কুশলের সাথে কথা বলার জন্য ওদের ভিতরে আসতে বললো। তখন সৌহার্দ্য বাইরে দুলাল বাবুর সাথে চেম্বারের বাইরেটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। বাইরেটা বিভিন্ন রকম ফুলের এবং বাহারি গাছ দিয়ে সুন্দর ভাবে সাজানো। দেখলেই মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো। সৌহার্দ্য বেশ আনন্দই পাচ্ছিলো চেম্বারের বাইরেটা ঘুরে বেড়াতে…

-কী বুঝলেন ডক্টর? সৌহার্দ্য বাবুর মানসিক ভারসাম্যটা কী আর ঠিক হবেনা?
-দেখুন মিস্টার রায়, আমি ট্রাই করবো ঠিক করার.. সম্ভবত উনি হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হয়েছেন! আপনাদের হয়তো এই ব্যাপারটা বুঝতে একটু অসুবিধাই হবে.. তাই প্রথমেই আপনাদের জানানো দরকার হ্যালুসিনেশন আসলে কী?

শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা যে সকল অনুভূতি অনুভব করি, যেমন- ছোয়া, গন্ধ, স্বাদ ইত্যাদি। এবং যেগুলোকে আমরা সত্য বলে জানি, দেখি ও বিশ্বাস করি। হ্যালুসিনেশনের অনুভূতিও ঠিক তেমনই। অবিকল সত্য কিন্তু সেখানে বাস্তব সত্য কোনো উদ্দীপনা অথবা বাস্তব কোনো কিছুর অবস্থান থাকে না। হ্যালুসিনেশন কিন্তু কোন স্বপ্ন নয়। ইচ্ছা করলেই কেউ হ্যালুসিনেশনের অনুভূতি গুলোকে অনুভব করতে পারবে না। এমনকি হ্যালুসিনেশন হলে ইচ্ছা করলেই কেউ আবার এই অনুভূতি গুলোকে বাদও দিতে পারবে না। সম্পূর্ণ ঘটনাটিতে হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত ব্যাক্তির কোন ধরনের ইচ্ছা বা নিয়ন্ত্রন থাকে না। এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত ব্যাক্তিটি এই ধরনের অবাস্তব অনুভূতি গুলোকে একেবারে সত্য মনে করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কোনো একজন ব্যাক্তি হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত এবং সে দেখছে তার পাশে একটা লোক সারাক্ষণ ঘুরাঘোরি করছে, তার সাথ কথা বলছে বা তাকে স্পর্শ করছে। কিন্তু বাস্তবে তেমন লোকই নেই। অন্য সুস্থ মানুষরা সেই অবাস্তব লোকটিকে কখনোই দেখবে না। এখন এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের সকল মানুষ এসেও যদি আক্রান্ত ব্যাক্তিকে বুোঝানোর চেষ্টা করে, তাহলে এক বিন্দুও কাজ হবে না।
এমনও হতে পারে আক্রান্ত মানুষটি এক বা একের অধিক মানুষের সাথে কথা বলতে পারে। আসলে কেউ কেউ এটাকে অলৌকিক শক্তি ভাবলেও এটা একটা মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তির চিকিৎসা শুরু হবার কিছু দিন পর যখন রোগ একটু একটু নিয়ন্ত্রনে আসে তথন বেশীরভাগ রোগীই ঘটনাটি বুঝতে পারে।

হ্যালুসিনেশন অনেক ধরনের হতে পারে। যেমন ধরুন, ভিজুয়াল বা দৃশ্য হ্যালুসিনেশন, অডিটরি বা শ্রবণ হ্যালুসিনেশন, ট্যাকটাইল বা স্পর্শকাতর হ্যালুসিনেশন, অলফ্যাক্টরি বা ঘ্রান হ্যালুসিনেশন কিংবা গাস্টেটরি বা স্বাদ হ্যালুসিনেশন এবং সোমাটিক বা দেহগত হ্যালুসিনেশন। মানে আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের যেকোনো একটির মাধ্যমেই হতে পারে বা একাধিক ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেও হতে পারে। তার মধ্যে সৌহার্দ্য বাবু অডিটরি এবং ভিজুয়াল উভয় হ্যালুসিনেশনেই আক্রান্ত হয়েছেন। অডিটরি হ্যালুসিনেশন মানে হলো অবাস্তব কিছু শুনতে পাওয়া। অর্থাৎ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এমনই কিছু শুনতে পান যার কোনো বাস্তব অস্তিত্বই নেই! অনবরত কিছু শুনতে থাকেন, এবং তার উত্তরও দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে রোগী এক বা একাধিক মানুষের কথা বলার বা কোনো কিছুর আওয়াজ শুনতে পান, এবং তাদের কথার উত্তরও দিয়ে থাকেন। ঠিক যেমনটা সৌহার্দ্য বাবু করছেন। উনি সারাক্ষণ ওনার স্ত্রীর এবং সন্তানের কথার এবং কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, এবং তাদের কথার উত্তর দিচ্ছেন। অথচ ওনার স্ত্রী বা সন্তান কারোরই বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই।

আর ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন হলো এমনই কিছু কখনো কখনো কিংবা আবার সারাক্ষণও চোখের সামনে দেখতে পাওয়া, যেটা অবাস্তব, যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই নেই! যেমন এক্ষেত্রে রোগী তার মৃত বাবা-মা, স্ত্রী কিংবা তার প্রিয় কোনো মানুষ, সে প্রেমিক-প্রেমিকাই হোক কিংবা বন্ধুই হোক, তাদের চোখের সামনে দেখতে পান।

আবার ওনার ডিলিউশনও হচ্ছে, অর্থাৎ ওনার একটি বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণাও জন্ম নিয়েছে। যেমন উনি অলীক কিছুতে বিশ্বাস করছেন। যেমন, ওনার স্ত্রী বেঁচে নেই বা নিখোঁজ অথচ উনি বিশ্বাস করছেন যে ওনার স্ত্রী জীবিত কিংবা নিখোঁজ নন, ওনার সামনেই রয়েছেন! সাধারণত হ্যালুসিনেশন থেকেই এই ডিলিউশনের জন্ম হয়।

সৌহার্দ্য বাবুর হ্যালুসিনেশনের কারণ হয়তো হঠাৎ করেই ওনার স্ত্রীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। আবার এটাও হতে পারে, ওনার মাথায় অপ্রত্যাশিত আঘাত। তার ফলে ওনার মানসিক ভারসাম্য আর ওনার নিয়ন্ত্রণে থাকছেনা। অপ্রত্যাশিত ওই আঘাতের ফলে ওনার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গেছ। উনি সম্পূর্ণভাবে হ্যালুসিনেট হয়ে রয়েছেন সারাক্ষণ। অনেকেই হয়তো মানসিক রোগকে সেভাবে গুরুত্ব দেননা। তারা মনে করেন, মানসিক রোগ আবার কোনো রোগ নাকি? তারা মনে করেন এটার কোনো চিকিৎসারই দরকার নেই! কিন্তু যেকোনো শারীরিক সমস্যার মতো এটাও একটা বিশেষ রকমের রোগ। মানসিক রোগের ফলেও মানুষের শরীর এবং মনের বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে! তাই এটারও সঠিক এবং সময় মতো চিকিৎসার প্রয়োজন! তা নাহলে কিন্তু সামান্য কোনো ছোট ব্যাপারও বড় কোনো আকার ধারণ করতে পারে!

আপনাদের কথা মতো ওনাকে আগে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো। এই ইলেকট্রিক শক দেওয়াটাও একটা থেরাপি। এটার নাম হলো ইলেকট্রো কনভালসিভ থেরাপি বা ই.সি.টি। এই পদ্ধতির সাহায্যে মানসিক রোগীর মাথায় বৈদ্যুতিক মৃগীর সৃষ্টি করানো হয়। এবং তার ফলে হয়তো ধীরে ধীরে উনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেন। কিন্তু মিস্টার সরকারের ক্ষেত্রে এই ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি ঠিকমতো কার্যকরী হয়নি.. ওনার ফার্মাকোথেরাপি এবং সাইকোথেরাপি দরকার। মানসিক রোগের চিকিৎসায় সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ের গুরুত্বও কিন্তু কম নয়। ওষুধ যেমন ওনার মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে, ঠিক তেমনই সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং ওনার মনকে সুসংহত করার মাধ্যমে যৌক্তিক বিশ্বাস আর আচরণে উৎসাহিত করে তুলবে। যেসমস্ত মানসিক রোগীরা নিজের মানসিক রোগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অর্থাৎ নিজের মানসিক সমস্যা গুলি নিজে বুঝতে পারেন, যেমন- কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা, অবসাদ, রাতে ঘুম না হয়ে নানারকম উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা করা এসব হলে সেই ক্ষেত্রে সমস্যা গুলো সেরকম গুরুতর নয়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসাও সহজসাধ্য। কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি নিজের মানসিক সমস্যা গুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, যিনি নিজের অন্ধবিশ্বাস ও বদ্ধমূল ধারণা সম্পর্কে বদ্ধ ধারণায় আবদ্ধ হয়ে রয়েছেন সেক্ষেত্রে রোগীর চিকিৎসা করাটা একটু কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ। তবে একেবারেই নিরাশ হওয়ার মতোও কিছু নেই। হয়তো একটু সময় লাগবে, তবে ওনার মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনা অসম্ভবও নয়..
তাই আপনাদের চিন্তা করার মতো সেরকম কোনো ব্যাপার নেই। আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করবো। আপনারা শুধু সময় মতো মিস্টার সরকারকে মেডিসিন গুলো খাইয়ে দেবেন। এবং সাইকোথেরাপির জন্য ঠিকমতো আমার চেম্বারে নিয়ে আসবেন!
-থ্যাংকস ডক্টর দাশগুপ্ত! আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাবো, আমরা বুঝতে পারছিনা..
-নো মিস সেন, এতে তো থ্যাংকস জানানোর কিছু নেই। আমি একজন ডক্টর। আর একজন ডক্টর হিসেবে আমার কর্তব্য পেশেন্টকে সুস্থ করে তোলাটা। আপনাদের আর কিছু জানার থাকলে আপনারা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি চেষ্টা করবো আপনাদের উত্তর দেওয়ার।

স্নেহলতার প্রশ্নের উত্তরে কুশল বললো,

-না না ডক্টর দাশগুপ্ত! আপনি যা সহজভাবে আমাদের সবটা বুঝিয়ে বললেন, সেখানে আমাদের আর কী করে বুঝতে অসুবিধা হবে বলুন তো?!
-ওকে! দেন অল ক্লিয়ার! আপনারা এবার আসতে পারেন! আর একটু খেয়াল রাখবেন যাতে মিস্টার সরকার সময় মতো ওষুধ গুলো খান!
-ওকে ওকে শিওর! অ্যান্ড থ্যাংকস এগেইন ডক্টর দাশগুপ্ত!

এভাবেই কিছুদিন ওষুধ এবং কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে চিকিৎসা চলার পর এখন মানসিকভাবে বেশ কিছুটা সুস্থ সৌহার্দ্য। ডক্টর স্নেহলতাকেও বেশ ভরসা করা শুরু করেছে ও। স্নেহলতাও একজন ডক্টরের দায়িত্ব পালন করে, সৌহার্দ্যের সাথে বন্ধুর মতো মিশে, ওর সাথে কথা বলে মানসিকভাবে অনেকটা সুস্থ করে তুলেছে ওকে। সৌহার্দ্য এখন বুঝতে পারে যে ওর এতদিনের ধারণাটা ভুল ছিলো। মেঘা বা ওদের সন্তান কেউই ওর কাছে নেই বা থাকেনা। যেটা ছিলো সেটা হচ্ছে ওর অমূল প্রত্যক্ষ বা অলীক কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস। স্নেহলতা যে কবে একজন ডক্টরের ঊর্ধ্বে গিয়ে সৌহার্দ্যের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে শুরু করেছে সেটা নিজেও বুঝতে পারেনি। যে মেয়ে প্রফেসনালিশমের বাইরে গিয়ে এক বিন্দুও কিছু করেনি, তাকে এভাবে প্রফেসনালিশমের বাইরে গিয়ে সৌহার্দ্যকে সুস্থ করে তুলতে দেখে খুবই অবাক হয়েছেন চন্দ্রিমা দেবী এবং অলোকেন্দু বাবু। তবে ওনাদের মেয়েকে এভাবে ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং অহংকারী মনোভাব থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে দেখে ওনাদের বেশ ভালোই লাগছে। প্রত্যেক সপ্তাহে অন্তত একবার করে সৌহার্দ্যের সাথে সামনাসামনি কথা বলাটা যেন একটা রুটিন হয়ে গেছে স্নেহলতার। ঠিক তেমনই সৌহার্দ্যেরও অভ্যাস হয়ে গেছে মনের সমস্ত কথা স্নেহাকে খুলে বলাটা। এখন আর ওষুধ খাওয়ার জন্য জোর করতে হয়না ওকে। নিজে থেকেই সব ওষুধ খেয়ে নেয়। সৌহার্দ্যও মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যে, ও ওর মেঘার হত্যাকারীদের যোগ্য শাস্তি দিয়ে ওদের আইনের হাতে তুলে দেবে…

এদিকে কুশল আর কিঙ্কিণী দুজনেই যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে অন্যায়কারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। কুশল এবং কিঙ্কিণীর একজন পরিচিত লইয়ার আছেন। তার সাথেই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে ওই সমাজবিরোধী গুলোকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করে চলেছে ওরা। কিঙ্কিণীর ওই বাড়িতে কোকোকে নিয়ে একা থাকতে এখন আর কোনো অসুবিধা হয়না.. কোকো আর কিঙ্কিণী বেশ ভালো ভাবেই থাকে ওখানে। কিঙ্কিণী সমস্ত ঘটনা জেনে যাওয়ায় দুলাল বাবুও আর ওদের রাতের খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশাননা। রাতে জেগে থাকলেও কিঙ্কিণীর ভয় লাগেনা, বরং ওর মনে হয় ওকে আর কোকোকে রক্ষা করার জন্য মেঘার আত্মা সবসময় ওদের পাশে পাশেই রয়েছে…

ক্রমশ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here