দোলনচাঁপার_টানে,পর্ব:৬,৭

দোলনচাঁপার_টানে,পর্ব:৬,৭
দেবারতি_ধাড়া
ষষ্ঠ_পর্ব

আজকের সারাটাদিন কিঙ্কিণী ঘরে শুয়ে বসে কাটিয়েছে। বারবার বাবা-মা আর কুশল ফোন করে খোঁজ নিয়েছে ওর। রাতে ডিনার করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো কিঙ্কিণী। কারণ কাল সকাল সকাল উঠতে হবে, স্নান সেরে খেয়ে-দেয়ে আবার স্কুলে যেতে হবে।

সকালে উঠেই কিঙ্কিণী স্নান করে গাছে জল দিতে গিয়েছিলো, তারপর এসে খেয়ে নিয়ে কোকোকেও খাইয়ে দিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেছে স্কুলে। সারাদিন বাচ্চাগুলোকে পড়ালেও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কিঙ্কিণীর শরীরটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে থাকলো। তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ করে বাড়ি চলে এলো কিঙ্কিণী। বাড়িতে এসে দেখলো কোকো ঘুমিয়ে আছে, তাই ওকে আর ডাকলো না ও। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে স্কুলের খাতা গুলো নিয়ে বসে ছিলো। কিন্তু মাথাটা এতো ঝিমঝিম করছে সেগুলো দেখতে ইচ্ছা করছে না। তাই বইপত্তর সবকিছু রেখে এককাপ কড়া করে ব্ল্যাক কফি বানিয়ে আনলো। কফিটা খেতে খেতে স্কুলের কথা ভাবছিলো। হঠাৎই অভিমন্যুর কথা মনে পড়ে গেলো। অভিমন্যুর কথা মনে পড়তেই কিঙ্কিণীর ভীষণ খারাপ লাগলো। আজ খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে ওর সাথে। প্রথমে তো ভালোই ব্যবহার করছিলো ও। তারপর যে ওর কি হলো হঠাৎ করে কেমন উগ্র আচরণ করে ফেললো। তাই মনে মনে ভাবলো যে কাল স্কুলে গিয়ে অভিমন্যুকে সরি বলে দেবে। কিঙ্কিণী নিজের ফোনে ডায়াল করলো কুশলের নাম্বারটা।

কুশলের সাথে একটু কথা বলার পর কফিটা খেয়ে কাপটা ধুয়ে রেখে দিলো কিঙ্কিণী। তারপর ফোনটা নিয়ে ঘাঁটতে শুরু করলো। কিছুতেই যেন মন বসছেনা ওর। শরীরটার মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। বারবার সেদিন রাতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো ওর। শুধু ভাবছিলো, সেদিন ও যা যা দেখেছিলো সেগুলো কী সত্যি নাকি ওর মনের ভুল ছিলো? যদি মনের ভুলই হয়, তাহলে কোকোই বা ওভাবে জানলার দিকে তাকিয়ে চেঁচালো কেন?! কিছুই ভেবে উঠতে পারলোনা কিঙ্কিণী। এসব ভাবতে ভাবতেই বাইরের গেটটায় কেউ আওয়াজ করলো। কিঙ্কিণী উঠে গেলো সেদিকে। গিয়ে দেখলো দুলাল বাবু খাবার দিতে এসেছেন।

-ওহ! দুলাল বাবু আপনি? আসুন ভিতরে আসুন..
-না না ম্যডাম, আমি আর ভিতরে যাবোনা!
-কেন দুলাল বাবু? আসুননা?
-না না আমার আজ একটু কাজ আছে ম্যাডাম। আমি কাল আসবো!
-আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি আসুন!

দুলাল বাবু বেরিয়ে যাওয়ার সময় আবারও ডাকলো কিঙ্কিণী..

-আচ্ছা দুলাল বাবু একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-হ্যাঁ ম্যডাম বলুননা?
-বলছি যে, আমার জানলার ওইদিকটায় মানে এই বাড়ির পিছন দিকে কী কেউ থাকে? মানে আশেপাশে কী কোনো ঘরবাড়ি আছে? আসলে আমি তো সেদিন ওইদিকটায় যাইনি! সামনের দিকটা থেকেই ঘুরে এসেছিলাম একটু..
-না ম্যাডাম। ওদিকে তো কোনো বাড়ি নেই। কেউই থাকেনা ওদিকে। কেন কিছু কী হয়েছে?
-না না কিছু হয়নি! আপনি আসতে পারেন..

ওদিকে কেউ থাকেনা শুনে কিঙ্কিণী মনে মনে ভাবলো, “সত্যিই কী ওদিকে কেউ থাকেনা? তাহলে হয়তো আমারই মনের ভুল হবে! আর নয়তো সেদিন রাতে কোনো চোর-টোর এসেছিলো!”

এসব চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে বের করে দিয়ে কিঙ্কিণী গল্পের বইটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। একটু বই পড়ার পরেই কোকো ঘুম থেকে উঠে পড়লো। কোকো ওঠার পর ওকে খাইয়ে দিয়ে কিঙ্কিণী নিজেও ডিনার করে নিলো। তারপর আবারও গল্পের বই পড়তে শুরু করলো। একটু পড়ার পরেই ওর মনে হলো ওর ঘরের জানলার বাইরের কেউ যেন কথা বলছে। তাই পড়ার টেবিল থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো বাইরে কেউ আছে কিনা। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে দেখলো কেউ কোথাও নেই। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কোনো আলো নেই। তাই নিজের মনের ভুল মনে করে জানলাটা বন্ধ করে দিলো কিঙ্কিণী। খুব ঘুম পেয়ে গেছে ওর। তাই আর পড়লোনা গল্পের বই। ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে ছোট আলোটা জ্বেলে শুয়ে পড়লো ও। সারা রাতে একবারও ঘুম ভাঙেনি। একেবারে সকাল ন’টায় ঘুম ভাঙলো তাও কুশলের ফোন আসাতে। ফোনটা হাতে নিয়ে কুশের নাম্বারটা দেখে ঘুম চোখেই ফোনটা রিসিভ করলো কিঙ্কিণী,

-হ্যাঁ কুশ বলো!
-কি ব্যাপার কিঙ্কি? কখন থেকে ফোন করছি তোমাকে ধরছিলেনা কেন?
-সরি কুশ! আসলে আমি ঘুমাচ্ছিলাম..
-মানেটা কি? সকাল ন’টা বাজে কিঙ্কি! তুমি এখনো ঘুমাচ্ছিলে মানে? এই তোমার শরীর ঠিক আছে তো? ওখানে গিয়ে তুমি প্রতিদিন এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ কেন বলোতো? আমি কি যাবো তোমার কাছে?
-উফ! তুমি চিন্তা করো না তো কুশ.. আমি একদম ঠিক আছি.. তুমি শুধু শুধু এত ভাবছো!
-কেন ভাববো না বলোতো কিঙ্কি? তুমি কী কখনো এত বেলা অবধি ঘুমাতেনা আগে? তাহলে এখন কেন এভাবে অঘোরে ঘুমাচ্ছ তুমি ন’টা পর্যন্ত! নিশ্চয়ই তোমার শরীর খারাপ..
-তুমি শুধু শুধুই এত ভাবছো গো.. আমি অনেক রাত পর্যন্ত একটা গল্পের বই পড়ছিলাম। তাই জন্যই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছি..
-ঠিক আছে.. তুমি যা ভালো বুঝবে তাই করো! তোমার তো আবার লেট হয়ে যাবে! উঠে পড়ো! আমি আবার পরে ফোন করবো.. সাবধানে থাকবে.. টাটা!
-আচ্ছা.. টাটা!

একটু রাগ করেই ফোনটা কেটে দিলো কুশল।ফোনটা রাখার পর কিঙ্কিণী মনে মনে ভাবলো, “সত্যিই তো কুশ ঠিকই বলেছে। আমার শরীরটা যেন ভীষণ দুর্বল লাগছে এই কদিন। কেন যে এরকম হচ্ছে বুঝতে পারছিনা! কিছুতেই যেন এনার্জি পাচ্ছি না! সবার সাথে রুড বিহেভ করে ফেলছি!”

স্কুলে এসে কালকের কথাগুলো মনে করে অভিমন্যুর সামনে খারাপ লাগায় মাথা হেঁট করে নিলো কিঙ্কিণী। কাল শুধু অভিমুন্য ওকে বলেছিলো, “বাহ! দোলনচাঁপা ফুল! বেশ মানিয়েছে তো আপনাকে! কি সুন্দর গন্ধ…” বলেই কিঙ্কিণীর মাথার খোঁপা থেকে একটা দোলনচাঁপা ফুল নিতে যাচ্ছিলো অভিমন্যু। আর তখনই কিঙ্কিণী রেগে গিয়ে বলে উঠেছে “অভিমুন্য! আমাকে একদম টাচ করবেন না আপনি! আর দোলনচাঁপা ফুল গুলোকে তো নয়ই! আর কখনো এই ফুলে আপনি হাত দেওয়ার চেষ্টা করবেননা!” বলেই কিঙ্কিণী ওখান থেকে চলে গিয়েছিলো। বাড়ি ফিরে এটা ভেবে নিজেরই খারাপ লেগেছে অনেক। কালকের ওরকম ব্যবহারের জন্য অভিমুন্য আজ আর কথা বললোনা কিঙ্কিণীর সাথে। নিজের মতো অফিসের রেজিস্টার নিয়ে ক্লাসে চলে যাচ্ছিল। তখনই কিঙ্কিণী পিছন থেকে ডাকলো,

-অভিমুন্য..?

পিছনে ফিরে অভিমুন্য বললো,

-হ্যাঁ কিঙ্কিণী কিছু বলবেন?
-সরি অভিমুন্য..
-সরি? বাট হোয়াই?
-না, আসলে আমার কালকের ব্যবহারের জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে! সামান্য একটা ভুলের জন্য আপনাকে অত কিছু বলাটা আমার একদমই উচিত হয়নি.. আসলে তখন আমার মাথাটা এত যন্ত্রনা হচ্ছিলো.. ক্ষমা করবেন আমায় প্লিজ..
-না না! এতে সরি বলার কী আছে? আমারই উচিৎ হয়নি ওভাবে আপনার খোঁপায় হাত দিতে যাওয়াটা.. হাজার হলেও আপনি একজন মেয়ে.. আর আমি একটা ছেলে! সরি তো আমারই আপনাকে বলা উচিৎ.. আমি আপনার কথায় কিছু মনে করিনি কিঙ্কিণী.. আর আমি বুঝেছি আপনার প্রিয় দোলনচাঁপার ভাগ আপনি কাউকে দিতে চান না! আসলে মেয়েরা এমনই হয় অনেক দামি কিছু হাসিমুখে অন্যকে দিয়ে দিতে পারে! আবার কখনো কখনো খুব সামান্য, খুব কম দামি অথচ প্রিয় জিনিস কাউকে দিতে পারে না, দিতে চায় না… আপনিও হয়তো সেরকমই..
-না আপনি যেটা ভাবছেন সেটা কিন্তু নয় অভি..

কিঙ্কিণীকে থামিয়ে দিয়ে অভিমন্যু বললো,

-আপনি আমাকে অভিই বলুন.. শুনতে বেশি ভালো লাগে! আর আমি কাল আপনার কথায় কিছু মনে করিনি.. আপনি এত ভাববেন না! সেরকম হলে আমাকে এক কাপ কফি খাইয়ে দেবেন.. তাতেই আমি খুশি!

অভিমন্যুর কথায় হেসে ফেললো কিঙ্কিণী। তারপর বললো,

-হ্যাঁ সিওর! কবে খাবেন বলুন!
-সে আপনার যেদিন যখন ইচ্ছে হবে! এখন আমি যাই.. আর আপনিও যান.. আর বেশি লেট হলে এক্ষুণি বাচ্চারা ডাকতে এসে যাবে! আসলে ক্লাসের সময় হয়ে গেছে তো অনেকক্ষণ।
-হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই যান.. আমিও যাই!

আজকের দিনটা বেশ ভালো ভাবেই কেটে গেলো কিঙ্কিণীর। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে ছাদে গেলো ও। দোলনচাঁপা গাছটায় অনেকগুলো ফুল ফুটেছে। একটু বৃষ্টি হওয়ার ফলে আর কিঙ্কিণীর যত্নে গাছটা বেশ সতেজ হয়ে উঠেছে এই কয়দিনে। দোলনচাঁপার মিষ্টি সুবাসে সারা ছাদ ভরে গেছে। কিঙ্কিণী কয়েকটা ফুল নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে রাখলো। সারা ঘর জুড়ে দোলনচাঁপার মিষ্টি সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। কিঙ্কিণী যেন হঠাৎ করেই এই দোলন চাঁপা ফুল গাছটাকে আর গাছের ফুল গুলোকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে। নিজের খোঁপায় দোলনচাঁপা ফুল লাগানোটা যেন ওর অভ্যাস হয়ে গেছে। রাতে ডিনার করার পর ভীষণ ঘুম পেয়ে যায় ওর। তাই জন্য ও ভাবলো যে আজ আগে গল্পটা শেষ করে নেবে, তারপরে ডিনার করবে। কিন্তু বই পড়তে পড়তে কত রাত হয়ে গেছে সেটা খেয়ালই ছিলোনা কিঙ্কিণীর। হঠাৎ করে লোডশেডিং হয়ে যাওয়ায় ওর খেয়াল হলো অনেকটা রাত হয়ে গেছে! ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো চার্জ না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে ফোনটাও।

-ইস! এখনই লোডশেডিংটা হতে হলো? কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিনা.. ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেছে! আমার তো ফোনটা চার্জ দেওয়ার কথা মনেও ছিলোনা! খাওয়াও হয়নি কিছু। খুব খিদেও তো পাচ্ছে.. যে এমারজেন্সিটা এনেছিলাম সেটাতেও তো চার্জ দেওয়া হয়নি! লোডশেডিং হয়নি বলে ওটার কথা তো মনেই পড়েনি! এই অন্ধকারে খাবোই বা কী করে! কী করি এখন? ভীষণ গরমও তো হচ্ছে!

অন্ধকারে হাতরে হাতরে বুকমার্কটা হাতে নিয়ে বইয়ের মাঝে রেখে বইটা বন্ধ করলো কিঙ্কিণী। তারপর চোখ থেকে চশমাটা খুলে হাতরে হাতরেই টেবিলের ওপর রাখলো। সেদিনের পর থেকে রাতে জানলাটা বন্ধই করে রাখে ও। কিন্তু এত গরম হচ্ছে যে অন্ধকারের মধ্যেই কোনোরকমে গিয়ে জানলাটা খুলে দিলো.. জানলাটা খোলার সাথে সাথেই মিষ্টি বাতাসে ভরে গেলো সারা ঘর..

ক্রমশ…

#দোলনচাঁপার_টানে
#দেবারতি_ধাড়া
#সপ্তম_পর্ব

এই অন্ধকারের মধ্যে আর ডিনার করতেও ইচ্ছা করলোনা কিঙ্কিণীর। একটা মোমবাতিও নেই যে সেটা জ্বালবে। ফোন বা এমারজেন্সি কোনোটাতেই চার্জ নেই। তাই হাতরে হাতরে বিস্কুটের কৌটো থেকে দুটো বিস্কুট আর জল খেয়ে জানলার দিকে মাথা করেই একটু শুলো ও। ছোট থেকেই ভীষণ সাহসী কিঙ্কিণী। ভূত-টূতে কোনোকালেই ভয় করতোনা ও। আর একটু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়ও ছিলো ছোট থেকেই। হোস্টেলে থাকাকালীন যখন ওর রুমমেটরা থাকতোনা তখন ঘর অন্ধকার করে রাত্রিবেলা অনুভব করার চেষ্টা করতো কোনো প্যারানরমাল অনুভূতি হয় কিনা। কিন্তু কোনো দিনই ওর সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। এখানেও সেদিনের ঘটনাটা ওর মনে সেভাবে প্রভাব ফেলেনি। ভয়ও করেনি ওর। কিন্তু ওর মনের মধ্যে সবকিছু জানার একটা আগ্রহ ছোট থেকেই ছিলো। এখনো আছে। ও ভীষণ ভাবে সবকিছু জানতে চায়। তাই ছোট থেকেই গল্পের বইয়ের পাশাপাশি অনেক অন্যরকম বইও পড়তো। তাই সেদিনের ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভাবাচ্ছে ওকে। এই বাড়িটাতে আসার পর থেকে ওর যেন কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে কিছুদিন ধরে। এই গরমের মধ্যে ঘুম না আসাতে এসবই ভাবছিলো কিঙ্কিণী। তার মধ্যেই একটু ঘোর লেগে গিয়েছিলো ওর। আর হঠাৎ করেই যেন ওর চোখের সামনে ভেসে আসছিলো কিছু ঘটনা।

এক মনে বই পড়ে চলেছে একটি অল্প বয়সী মেয়ে। মেয়েটি খেয়ালই করেনি কখন তার স্বামী এসে দাঁড়িয়ে একভাবে দেখছে ওকে। পড়তে পড়তে হঠাৎই মেঘার চোখ পড়ে গেলো ওর স্বামীর দিকে..

-কিগো? তুমি কখন এলে? বলোনি তো আমায়? তুমি ফ্রেস হয়ে নাও, আমি তোমার জন্য চা করে আনছি..
-না মেঘা.. তোমাকে চা করতে যেতে হবেনা.. আমি ফ্রেস হয়ে চা করে নেবো.. তুমি শুধু পড়ো মেঘা.. শুধু পড়ো… সামনেই যে তোমার পরীক্ষা!
-কিন্তু..
-উহ্ হু! আর কোনো কিন্তু না মেঘা.. তুমি মন দিয়ে পড়ো.. আমি আসছি..

কিছুক্ষণ পর সৌহার্দ্য নিজের জন্য চা আর মেঘার জন্য হেল্থড্রিংক নিয়ে এলো।

-এই নাও মেঘা তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও এটা.. তারপর আবার পড়বে!
-তুমি আবার টাকা খরচা করে হেল্থড্রিংক এনেছো কেন? তুমি আর কত করবে গো আমার জন্য? আর কত?! সেই প্রথম দিন থেকে আমার জন্য এত কিছু করে চলেছো। দিন-রাত এক করে খেটে চলেছো! নিজের পড়াশোনাটাও ছেড়ে দিলে শুধুমাত্র আমার জন্য! পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সামান্য একটা চাকরি করছো! তার ওপর রোজ রোজ ওভার টাইম করো আমার পড়াশোনার খরচার জন্য! কত টাকা খরচা হচ্ছে আমার বি.এডের জন্য! আমি পড়াশোনা ছেড়ে দেবো সৌহার্দ্য!

মেঘাকে থামিয়ে দিয়ে ওর ঠোঁটে আঙুল রেখে থামিয়ে দিলো সৌহার্দ্য। তারপর বললো,

-আর তুমি যে আমার জন্য তোমার মা-বাবা, পরিবার সবাইকে ছেড়ে চলে এলে?! শুধুমাত্র আমার সাথে সংসার করার জন্য? তাহলে? আর আমি তোমার জন্য সামান্য একটু পরিশ্রম করতে পারবোনা?! তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য আমি সবকিছু করতে পারবো মেঘা.. সবকিছু…
-কী করবো সৌহার্দ্য? বাবা যে আমার বিয়ের ঠিক করেছিলো অন্য ছেলের সাথে! আমার স্বপ্নের থেকে যে তুমি আমার কাছে অনেক বড়.. তাই অন্য কাউকে বিয়ে করে তিনটে জীবন নষ্ট করার চেয়ে তোমার সাথে আমাদের অভাবের কিন্তু সুখের সংসার করাটাই আমার কাছে বড় বলে মনে হয়েছে…
-কেন আমায় এত ভালোবাসো তুমি? আমি তো তোমাকে সুখে রাখতে পারছিনা মেঘা.. তোমাদের কত বড় বাড়ি.. কত চাকর-বাকর। আর এখানে আমাদের এই ছোট্ট একটা ভাঙা বাড়িতে অভাবের সংসারে তোমাকে কত কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে! নিজেকে হাত পুড়িয়ে রান্না-বান্না করতে হচ্ছে! আবার পড়তেও হচ্ছে! তোমার বাড়িতে থাকলে তো তুমি শুধু পড়াশোনাই করতে। আর তোমার বাবা-মা, চাকর-বাকররা তোমার মুখের সামনে খাবার ধরতো!
-আর এখানে আমার স্বামী আমার মুখের সামনে খাবার ধরছে। এটাই যে সবথেকে বড় সুখের সৌহার্দ্য। এইরকম ভাগ্য যে সব মেয়ের হয়না সৌহার্দ্য। আমি যে খুব ভাগ্যবতি.. এই ভাঙাচোরা বাড়িটাই যে আমার কাছে সুখের রাজপ্রাসাদ। আমার ওই বড় অট্টালিকার মানুষ গুলোর অনেক টাকা-পয়সা থাকলেও সুখের বড় অভাব ছিলো গো.. আর তাছাড়া আমি যদি কোনো ভাবে একটা চাকরি পেয়ে যাই, তাহলে তো আমাদের দুজনের সংসারটা খুব ভালোভাবেই চলে যাবে.. আর তারপর…
-তারপর কী?
-তারপর তোমার আর আমার ঘর আলো করে ছোট্ট একটা বাচ্চা আসবে.. আমাদের সংসারটা ভরে উঠবে আরও.. আমার যে অনেক স্বপ্ন সৌহার্দ্য…
-আচ্ছা মেঘা রানী এবার এই হেল্থড্রিংকটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন! আর আপনি নিজেই তো এখন ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে! আপনাকেই তো আমাকে সামলাতে হচ্ছে, আর আপনি নাকি বাচ্চা সামলাবেন?
-আহ! সৌহার্দ্য! আমি কী এখন বাচ্চার কথা বলেছি নাকি? আগে আমি একটা চাকরি পাবো.. আমাদের সংসারটা আরও গুছিয়ে নেবো.. তারপর তো.. তখন তো আমি অনেক বড় হয়ে যাবো..

বলেই মেঘা জড়িয়ে ধরলো সৌহার্দ্যকে। সৌহার্দ্যও নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিলো মেঘাকে। তখনই মেঘা মিষ্টি একটা গন্ধ পেয়ে বললো,

-এই সৌহার্দ্য! কী সুন্দর একটা গন্ধ আসছে! কোথা থেকে আসছে বলোতো?!

তারপরই দৌড়ে গেলো ওই সুন্দর গন্ধটার উদ্দেশ্যে। বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখলো একটা টবের মধ্যে দোলনচাঁপা ফুলের চারা রাখা আছে। আর তারপাশে রাখা আছে একগুচ্ছ দোলনচাঁপা ফুল।

-সৌহার্দ্য তুমি আমার ফেভারিট দোলনচাঁপার চারা এনেছো..? তুমি জানো আমার পছন্দের ফুল দোলনচাঁপা?
-তোমার কী মনে হয় মেঘা? আমি তোমার পছন্দ জানিনা?
-থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু সৌহ! এই জন্যই তো আমি তোমায় এত্তো ভালোবাসি সৌহ…
-আজ থেকে আমি প্রতিদিন তোমার জন্য দোলনচাঁপা ফুল আনবো.. কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করবে…
-কথা দিলাম সৌহ… আমি মন দিয়ে পড়াশোনা করবো..

হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেলো কিঙ্কিণীর। ঘুমটা ভেঙে যেতেই কিঙ্কিণী দেখলো সারা ঘর জুড়ে দোলনচাঁপার মিষ্টি সুগন্ধে ভরে গেছে। আর ওর ঘরে রাখা দোলনচাঁপা গুলো সারা ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কিঙ্কিণী দেখলো অন্ধকারের মধ্যেও সাদা দোলনচাঁপা ফুল গুলো যেন জ্বলজ্বল করছে.. কিঙ্কিণীর শরীরটা যেন কেমন শিহরিত হয়ে উঠলো ফুল গুলোকে দেখে। হঠাৎই ওর চোখ পড়লো দোলনচাঁপা ফুল গুলো দিয়ে একটা রাস্তার মতো তৈরী হয়েছে। আর সেটা ঘরের বাইরের দিকে যাচ্ছে.. কিঙ্কিণী আস্তে আস্তে যেন একটা ঘোরের মধ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিলো সেই ফুলের দেখানো পথের দিকে…

ক্রমশ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here