দোলনচাঁপার_টানে,পর্ব:১৪,১৫

দোলনচাঁপার_টানে,পর্ব:১৪,১৫
দেবারতি_ধাড়া
চতুর্দশ_পর্ব

সৌহার্দ্যের ঘর থেকে বেরিয়ে কুশল বললো,

-আচ্ছা দুলালবাবু, সৌহার্দ্য বাবুর কোনো চিকিৎসা করাননি আপনি? ওনার তো ইমেডিয়েটলি কোনো ভালো ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করানোর দরকার!
-জানি কুশল বাবু, কিন্তু আমার রোজগার যে খুবই সামান্য.. বাড়িতে হোম ডেলিভারির ব্যবসা আর ওই স্কুল আর স্কুল বাড়ির দেখাশোনা করে যা টাকা পাই, তা দিয়ে ছেলের পড়াশোনার খরচ, সংসারের খরচ আর এখানে দাদাবাবুর দেখাশোনা করার জন্য আর খাওয়া খরচার জন্য টাকা আর মাধব বাবুকে মাইনে দিতে দিতেই খরচা হয়ে যায়। নিজের ছেলের ভবিষ্যতের জন্য কোনো কিছু সঞ্চয়ও করতে পারিনা.. এরপর দাদাবাবুর মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চিকিৎসা করার জন্য যে আর কোনো টাকাই থাকেনা আমার.. আমি কী করবো বলুন তো?
-আপনি কোনো চিন্তা করবেননা দুলালবাবু! সৌহার্দ্য বাবুর সব চিকিৎসার দায়িত্ব এখন আমার আর কিঙ্কিণীর.. ওনার চিকিৎসা খরচ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা… আজই আমরা সৌহার্দ্য বাবুকে নিয়ে ভালো কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো… আপনি বরং ভিতরে গিয়ে ওনাকে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রেডি করে ফেলুন! ততক্ষণে আমি আমার চেনাশোনা কিছুজনকে কল করে কিংবা গুগলে সার্চ করে দেখে নিচ্ছি কলকাতায় ভালো কোন ডাক্তার আছে মানসিক রোগের..
-আচ্ছা কুশল বাবু, আমি এক্ষুণি দাদাবাবুকে তৈরী হয়ে নিতে বলছি!

দুলালবাবু সৌহার্দ্যকে তৈরী করতে ঘরে ঢুকে যাওয়ার পরেই কিঙ্কিণী কুশলকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো,

-থ্যাংক ইউ কুশ! থ্যাংক ইউ সো মাচ… আমি জানতাম তুমি কিছু একটা নিশ্চয়ই করবে…

কুশলও কিঙ্কিণীকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে বললো,

-তুমি তো জানোই কিঙ্কি, আমি তোমার চোখের জল দেখতে পারিনা! আর তাছাড়া এটা তো আমাদের কর্তব্য.. আমাদের যে এখন অনেক কাজ কিঙ্কি… তুমি চাওনা মেঘার খুনিদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে? মেঘাকে যারা এত নির্মমভাবে ধর্ষণ করে, পাশবিক অত্যাচার করে হত্যা করেছে, তুমি চাওনা তারা তাদের এই জঘন্য অপরাধের জন্য শাস্তি পাক? চাওনা তুমি?
-চাই তো কুশ.. ভীষণভাবে চাই… ওদেরকে শাস্তি দিতে না পারলে আমি শান্তিতে দুচোখের পাতা এক করতে পারবোনা কুশ!
-আমি জানি তো কিঙ্কি… আর সেই জন্যই তো আমি ওই সমাজবিরোধী শয়তান গুলোর শাস্তি দেওয়ার সবরকম ব্যবস্থা করবো.. কিন্তু তার আগে যে সৌহার্দ্য বাবুকে সুস্থ করে তুলতে হবে। ওনাকে একটা ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ওনার চিকিৎসা করাতে হবে!
-থ্যাংকস্ কুশ… আমি জানতাম তুমি আমার পাশে থাকবে…
-হ্যাঁ, সেই জন্যই তো এই সবকিছু আমার থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছিলে!

কুশলের বুকের মধ্যে মুখ গুজেই কান্নার সুরে কিঙ্কিণী বললো,

-কুশ? তুমি এখনো আমার ওপর রাগ করে থাকবে? আমি তো বললাম আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে তোমাকে আগেই সবকিছু না বলে.. প্লিজ কুশ.. তুমি আর আমার ওপর রাগ করে থেকোনা…

কুশল কিঙ্কিণীর মাথায় আলতো একটা স্নেহের পরশ এঁকে দিয়ে বললো,

-আমি তোমার ওপর রাগ করে নেই সোনা.. তুমি কী জানোনা আমি তোমার ওপর রাগ করে থাকতে পারিনা? ভালোবাসি যে তোমায়.. আর যাকে এত্ত ভালোবাসি, তার ওপর কখনো রাগ করে থাকতে পারি বলো?
-জানি তো তুমি আমার ওপর রাগ করে থাকতে পারোনা! আমিও যে তোমাকে খুব ভালোবাসি কুশ… লাভ ইউ সো সো সো মাচ…
-লাভ ইউ টু কিঙ্কি! নাও, এবার আমার বুক থেকে সরো, দুলালবাবু এক্ষুণি সৌহার্দ্য বাবুকে নিয়ে চলে আসবেন!

কুশের কথায় ওর বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়ালো কিঙ্কিণী। কুশল কিঙ্কিণীর গালে নিজের একটা হাত রেখে বললো,

-খিদে পেয়েছে তো তোমার? কাল রাত থেকে তো কারোরই কিছু খাওয়া হয়নি! কোকোরও হয়তো খুব খিদে পেয়ে গেছে! ওই দু-একটা বিস্কিট খেয়ে কী আর ও থাকতে পারে? চলো গাড়িতে যাওয়ার সময় বাইরে কোথাও একটা ব্রেকফাস্ট করে নেবো আমরা!
-ওকে তাই করে নেবো!

ওদিকে কোকো ওদের থেকে একটু দূরেই বসেছিলো, কিঙ্কিণী কুশলকে জড়িয়ে ধরতে দেখেই দৌড়ে ওদের কাছে চলে এসেছে আদর খাওয়ার জন্য.. তাই কুশল আর কিঙ্কিণী দুজনেই কোকোর গায়ে হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দিলো।

-আমি কোথায় যাবো গো মাধবদা? তুমি যে আমাকে এত ভালো একটা জামা, প্যান্ট পরিয়ে দিলে? ঘুরতে নিয়ে যাবে নাকি আমাকে?
-আমি যাবোনা গো দাদাবাবু, তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন দুলালদা আর ওই দাদা আর দিদিমণি মিলে..

ডাক্তারের কাছে যাওয়ার নাম শুনেই চিৎকার করে উঠলো সৌহার্দ্য। প্রথম প্রথম ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেই ওকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো, তাই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা শুনলেই রেগে যায় ও।

-না!! আমি ডাক্তারের কাছে যাবোনা… কিছুতেই যাবোনা! ওরা আমাকে মারবে! আমার খুব কষ্ট হয় তাতে। আমার তো কিছু হয়নি! তাহলে কেন আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে ওরা?! তাড়িয়ে দাও! তাড়িয়ে দাও ওদের এক্ষুণি!

সৌহার্দ্যকে শান্ত করার জন্য দুলালবাবু এগিয়ে এসে বললেন,

-দাদাবাবু আপনি শান্ত হোন! আমরা তো আপনাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবোনা! সত্যিই তো, আপনার কিছু হয়েছে নাকি যে, আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো? আমরা তো আপনার মেয়ের চেকআপের জন্য ডাক্তারের কাছে যাবো…
-কেন? কেন? কী হয়েছে আমার সোনামায়ের? কী হয়েছে ওর? বলুননা দুলালবাবু?!
-কিচ্ছু হয়নি তো… শুধু চেকআপের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে.. বাচ্চাদের নিয়ে যায়না মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছে? ওরা তো আর ওদের কোনো অসুবিধার কথা বলতে পারেনা, তাইনা? আমাদেরই তো মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে চেকআপ করানোর দরকার হয়? তাই জন্যই নিয়ে যাওয়া হবে আজ…
-ওহ্ আচ্ছা! সেই জন্য নিয়ে যাওয়া হবে? তাই বলুন! আমি তো ভাবলাম আমার সোনা মায়ের আবার কী হলো? আপনি তো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন আমাকে! আচ্ছা দুলাল বাবু, ডাক্তাররা সব বুঝে ফেলেন, তাইনা?!

এত দেরি হচ্ছে দেখে কুশল আর কিঙ্কিণী ঘরে ডাকতে আসছিলো ওদের। ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই কুশল সৌহার্দ্যের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললো,

-হ্যাঁ সৌহার্দ্য বাবু, আপনি একদম ঠিক বলেছেন! ডাক্তাররা সব বুঝে ফেলেন! আপনি এবার তাড়াতাড়ি গুড বয়ের মতো তৈরী হয়ে নিন তো, তা নাহলে তো ডাক্তার রাগ করবেন!
-হ্যাঁ, এইতো আমার হয়েই গেছে! কিন্তু, মেঘা কোথায়? মেঘা না গেলে তো আমার সোনামাকে আমি একা সামলাতে পারবোনা! মেঘা তৈরী হয়েছে মাধবদা?

মাধব বাবু সৌহার্দ্যের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলেননা। তাই কুশলই আবারও বললো,

-হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার মেঘা তৈরী হয়ে গাড়িতে বসে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন.. আপনি বেরোলেই আমরা রওনা হবো…
-ওহ তাই নাকি? মেঘা গাড়িতে অপেক্ষা করছে? তাহলে চলুন, চলুন! আর দেরি করবোনা আমি.. আমার হয়ে গেছে! আমি আসছি মাধবদা! টাটা!

ঘর থেকে বেরিয়েই দৌড়ে গাড়িতে উঠে পড়লো সৌহার্দ্য। জানলার পাশের সিটে মেঘাকে কল্পনা করে নিয়ে একটু জায়গা ফাঁকা রেখে মাঝখানে বসে পড়লো সৌহার্দ্য। তার পাশে দুলালবাবু উঠে বসলেন। আর সামনে কিঙ্কিণী কোকোকে কোলে নিয়ে বসলো। আর তারপর কুশল গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলো কলকাতার সবথেকে বড় এবং নামকরা মানসিক রোগের চিকিৎসক মিস স্নেহলতা দাশগুপ্তের বাড়ির উদ্দেশ্যে…

ক্রমশ…

#দোলনচাঁপার_টানে
#দেবারতি_ধাড়া
#পঞ্চদশ_পর্ব

মোবাইলে অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথেই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেই বিছানা ছেড়ে নেমে বাথরুমে ঢুকলো স্নেহা। ব্রাশ করার পরই খুলে দিলো শাওয়ারটা। তারপর স্নান সেরে শার্ট আর প্যান্ট পরে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে কোটটা হাতে নিয়েই নিচে নেমে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বসলো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর স্নেহলতা দাশগুপ্ত। তারপর নিজের কোটটা পাশের চেয়ারে রেখে আরেকটা চেয়ারে বসেই জোরে জোরে বলতে শুরু করলো,

-মম তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট রেডি করো! আমাকে এক্ষুণি বেরোতে হবে! যা হয়েছে সেটাই দিয়ে দাও প্লিজ!

রান্না ঘর থেকে ব্রেকফাস্টের প্লেটটা হাতে নিয়ে আসতে আসতে চন্দ্রিমা দেবী বললেন,

-শোননা মা স্নেহা.. তোকে একটা কথা বলবো রাখবি?

চন্দ্রিমা দেবীর হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে ব্রেডটায় একটা কামড় দিয়ে চিবোতে চিবোতে স্নেহা বললো,

-কী কথা মম? তাড়াতাড়ি বলো! আমার একদম টাইম নেই!
-তোর ড্যাডের এক পেশেন্টের কোনো এক পরিচিত আজ তোর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছে.. ওনাদের কোনো একজন মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীর জন্য।
-মম! তুমি কী ভুলে গেছো? আমার চেকআপ নিতে গেলে দু’মাস আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখতে হয়, তুমি সেটা জানোনা? আর এসব ব্যাপার আমি দেখিনা। আমার চেম্বারে কল করে নিতে বলো! সঞ্জয়দা ডেট অ্যান্ড টাইম জানিয়ে দেবেন!
-স্নেহা, যিনি তোর অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছেন, তোর বাবা তাদের ফ্যামিলি ডক্টর.. বহু বছর ধরে ওনাদের পরিবারের সবার চিকিৎসা করে আসছে তোর বাবা!
-সো হোয়াট মম? আমি এসব জেনে কী করবো? আমাকে এখন বেরোতে হবে। আর আজ আমার ভীষণ বিজি শিডিউল! একদম টাইম নেই আমার!
-তোমার বাবা ওদের কথা দিয়ে দিয়েছে স্নেহা!
-হোয়াই মম? আমার সাথে কথা না বলে ড্যাড কী করে কথা দিয়ে দিলো?! আর তোমরা কী জানোনা আমি কতটা পাংচুয়াল? কতটা পাংচুয়ালিটি মেইনটেন করে চলি আমি? এরপর একটা পেশেন্টকে টাইম দিতে গেলে আমার তো চেম্বারে পৌঁছাতে ভীষণ লেট হয়ে যাবে!
-তোর ড্যাড তো আর জানেনা যে তোকে এখনই বেরোতে হবে! আর এমনিতেই তো আজ তোর হাফডে চেম্বার থাকে। তাই.. তুই প্লিজ রাজি হয়ে যা মা.. তা নাহলে তোর ড্যাড ওনাদের কাছে ছোট হয়ে যাবে… তুই কী চাস তোর ড্যাড ওনাদের কাছে ছোট হয়ে যাক?
-উফ্ মম! ডিসগাস্টিং! এসব ছোট হওয়া, বড় হওয়া এসব আমার কাছে বলবেনা! ওকে! ড্যাডকে বলো ওনাদেরকে হাফ অ্যান আওয়ারের মধ্যে আসতে বলতে! আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু টেন মিনিটস্ এর এক সেকেন্ডও বেশি দেখতে পারবোনা পেশেন্টকে!
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, তুই ওইটুকু সময়ের জন্যই দেখিস.. বেশিক্ষণ দেখতে হবেনা তোকে! ওনারা হয়তো আর পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে!
-হোয়াট? তার মানে আমার পারমিশন না নিয়েই ড্যাড ওদের আসতেও বলে দিয়েছে? হোয়াটস দিশ মম? আমি কিন্তু এসব একদম ডিসলাইক করি!
-মাথা গরম করিসনা মা.. ওই বুঝি ওনারা এলেন! আমি ওনাদের বসতে বলছি, তুই খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বাইরে আয়..

বেল বাজার শব্দ শুনে চন্দ্রিমা দেবী দরজা খুলতে এগিয়ে গেলেন। আর স্নেহলতাও নিজের খাওয়া কমপ্লিট করে প্লেটটা সিংকে রেখে হাত ধুয়ে চেয়ার থেকে কোটটা নিয়ে গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। ওদের বাড়িতেই একটা ডক্টর চেম্বার করা আছে, সেখানে কোনো এমারজেন্সি পেশেন্ট এলে স্নেহার বাবা অর্থাৎ ডক্টর অলোকেন্দু দাশগুপ্ত দেখেন। আর সপ্তাহে দুদিন ওই চেম্বারেই উনি বসেন। চন্দ্রিমা দেবী ওনাদের বাইরের বেঞ্চে বসতে দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। স্নেহলতা বাইরে আসতেই সৌহার্দ্য বাদে সবাই উঠে দাঁড়ালো। সৌহার্দ্য নিজের মনে ওর মেয়েকে কোলে নিয়ে দোল দিয়ে চলেছে। স্নেহা ওদের উদ্দেশ্যে “ভিতরে আসুন” বলে চেম্বারে গিয়ে বসলো। সাথে সাথেই কিঙ্কিণী আর কুশল ভিতরে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো।

স্নেহলতা ভিতরে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে কিঙ্কিণী আর কুশলকে বললো,

-প্লিজ টেক ইওর সিট!

কিঙ্কিণী আর কুশল দুজনে একসাথে বলে উঠলো “থ্যাঙ্ক ইউ”। তারপর দুজনে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসলো। কুশল বললো,

-গুড মর্নিং ডক্টর! আমি কুশল রায় আর ও কিঙ্কিণী সেন..

চেম্বারে ঢোকার আগে ওদেরকে এক ঝলকে দেখেই স্নেহলতা বুঝে গেছে কে পেশেন্ট। তাই ওর বুঝতে ভুল হলো না যে কিঙ্কিণী বা কুশল কেউ পেশেন্ট নয়।

-ইয়েস গুড মর্নিং। সো বলুন, পেশেন্টের কী প্রবলেম? কে হয় পেশেন্ট আপনাদের? পেশেন্টের যা যা প্রবলেম আছে আমাকে দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে সবটা ক্লিয়ার করে বলুন। আমার হাতে আজ টাইম ভীষণই কম!

কিঙ্কিণী বললো,

-উনি আমাদের যদিও আমাদের ফ্যামিলিগত ভাবে কেউ হননা, তবুও আমাদের একজন পরিচিত।

তারপর কুশল আর কিঙ্কিণী দুজনে মিলেই সব ঘটনা খুলে বললো। সবটা শুনে স্নেহলতা বললো,

-ওকে! আপনারা বাইরে গিয়ে পেশেন্টকে প্লিজ ভিতরে পাঠিয়ে দিন। আমি ওনার সাথে একটু আলাদাভাবে কথা বলতে চাই..

-ওকে ডক্টর! আমরা এক্ষুণি ওনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বলেই কিঙ্কিণী আর কুশল বাইরে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসে কুশল সৌহার্দ্যকে বললো,

-সৌহার্দ্য বাবু, আপনি এবার ভিতরে যান.. আমাদের ডাক্তার দেখানো হয়ে গেছে।

সৌহার্দ্য বললো,

-আমি একা কেন যাবো? আমি তো মেঘার সাথেই যাবো। মেঘা না থাকলে আমি আমার সোনামায়ের সব অসুবিধা তো ঠিক করে বলতে পারবোনা..
-হ্যাঁ সৌহার্দ্য বাবু আপনি আপনার মেঘাকে নিয়েই যান..
-আচ্ছা তাহলে আমি ভিতর যাচ্ছি.. এসো মেঘা..
আসবো ডাক্তার ম্যডাম?
-ইয়েস কাম ইন! বসুন..
-ধন্যবাদ ম্যডাম.. বসো মেঘা..
-আপনার নাম?
-আমার নাম হলো সৌহার্দ্য সরকার।

নিজের নাম বলার পরে পাশের সিটের দিকে আঙুল নির্দেশ করে এবং নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আর ইনি হলেন আমার স্ত্রী মেঘোমালা সরকার আর এটা আমার সোনামা…
-আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি আমি.. আমি আগে একটু আপনার সাথে কথা বলেনিই, তারপর আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলবো ওকে মিস্টার সরকার?
-হ্যাঁ নিশ্চয়ই.. তবে ডাক্তার ম্যাডাম, আমার থেকে তো মেঘা মানে আমার স্ত্রী সোনামার শরীরের কথা বেশি ভালো বলতে পারবে!
-কিন্তু আমার তো মনে হয় আপনিই বেশি ভালো বলতে পারবেন! কারণ আপনি তো আপনার মেয়ে আর স্ত্রীর জন্য নিজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সারাক্ষণ মেয়েকে দেখাশোনা করেন, কী তাই তো?
-হ্যাঁ সেটা ঠিক। কিন্তু..
-আচ্ছা মিস্টার সরকার, আপনি আপনার চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন কেন? আপনার কী ইচ্ছা করেনা আপনার নিজের টাকায় নিজের সন্তান আর স্ত্রীর জন্য কিছু কিনে আনতে?
-হ্যাঁ ইচ্ছে করে তো… খুব ইচ্ছে করে…
-তাহলে? কেন ছাড়লেন চাকরিটা?

সৌহার্দ্য নিজের মনে ভাবতে ভাবতে মাথা চুলকাতে শুরু করলো। তারপর নিজের চুল গুলোকে টেনে টেনে ছিঁড়তে শুরু করলো। তারপর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

-কেন ছাড়লাম? আমি চাকরিটা কেন ছাড়লাম? কেন.. কেন…

নিজের মাথার চুল টানতে টানতে একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেলো সৌহার্দ্য।

-ওকে! ওকে মিস্টার সরকার! কুল ডাউন! আপনি এত চিন্তিত হয়ে পড়বেন না… মিস্টার সরকার? আপনি শুনতে পাচ্ছেন? মিস্টার সরকার?

সৌহার্দ্য একেবারে নিস্তেজ হয়ে গিয়ে টেবিলে মাথা রেখে ঝিমিয়ে পড়লো। তখন স্নেহা ওর হাতের সামনে থাকা বেলটা বাজাতে কুশল আর কিঙ্কিণী ভিতরে এলো। তারপর কুশল স্নেহলতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-কী দেখলেন ডক্টর? ওনাকে কী সুস্থ করে তোলা সম্ভব?
-এখনই কিছু বলা যাচ্ছেনা! উনি সেন্সলেস হয়ে গেছেন। আপনারা আমার চেম্বারে কল করে নেক্সট অ্যাপয়েন্টমেন্ট টা নিয়ে নেবেন। আগে আরও দু-এক দিন দেখি, ওনার সাথে কথা বলি, তারপর বুঝতে পারবো ওনাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা যাবে কিনা! আমি দুটো মেডিসিন লিখে দিলাম, এগুলো রোজ দুবার করে খাওয়াবেন ওনাকে।
-ওকে ডক্টর! আপনার ফিজটা?

স্নেহলতার সাধারণত যা ফিজ, তার অর্ধেক নিলো কুশলের থেকে। কারণ ও ভীষণ প্রফেশনালিসম মেনে চলে। ও যতটুকু সময় দেখেছে, ততটুকু সময়ের মতোই টাকা নিয়েছে ও। ওরা চলে যাওয়ার পর চন্দ্রিমা দেবীকে বলে স্নেহলতাও চেম্বারে বেরোতে যাচ্ছিলো।

-মম আমি বেরোলাম। তুমি দরজাটা বন্ধ করে দাও প্লিজ..
-স্নেহা তুই ওদের থেকে ফিজ নিলি কেন? এইটুকু সময়ের জন্য দেখলি ছেলেটাকে, তার জন্য ফিজটা তো না নিলেই পারতিস স্নেহা! আর তাছাড়া ওনারা তো তোর বাবার পেশেন্টের পরিচিত..
-কেন মম? ভালো সাজবো ওদের কাছে ফিজ না নিয়ে? তাতে কী হবে? ওরা আমাকে বেশিদিন মনে রাখবে? নাকি সবার কাছে বলে বেড়াবে যে আমি ভীষণ দয়ালু, বিনা ফিজে চিকিৎসা করি! আর বাবার পেশেন্টের পরিচিত তো, তাতে আমার কী?!
-আমি কী সেটা বলছি?
-হ্যাঁ সেটাই তো বলতে চাইছো! দেখো মম, আমি চাইনা যে আমাকে আমার প্রফেশনের বাইরে এবং আমার ফ্যামিলি কিংবা বন্ধু বৃত্তের বাইরে সেভাবে কেউ আমাকে চিনুক, জানুক কিংবা মনে রাখুক! কী হবে ফিজ না নিয়ে? ওরা হয়তো এটা ভেবে আমাকে দুদিন বেশি মনে রাখবে যে আমি ওদের থেকে ফিজ নিইনি। অথবা যদি আমি ওদের থেকে পুরো ফিজটা নিতাম তাহলে হয়তো ওরা এটা বলতো যে, আমি ঠিক মতো না দেখেই ওদের থেকে পুরো ফিজটা নিয়েছি। তার জন্যও হয়তো ওরা আমাকে দুদিন বেশি মনে রাখতো! বাট আমি সেটা চাইনা মম! আমি শুধু একজন ডক্টর হয়েই বাঁচতে চাই.. তার বাইরে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কাউকে বেশি কাটাছেঁড়া করতে দিতে চাইনা! বেরোলাম আমি! আমার আজ ফিরতে লেট হবে মম! বাই!

বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গ্যারেজ থেকে নিজের গাড়িটা নিয়ে স্নেহলতা নিজেই ড্রাইভ করে বেরিয়ে গেলো নিজের চেম্বারের উদ্দেশ্যে…

ক্রমশ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here