দোলনচাঁপার_টানে,অন্তিম_পর্ব

দোলনচাঁপার_টানে,অন্তিম_পর্ব
দেবারতি_ধাড়া

কিঙ্কিণী আর কুশলের পরিচিত উকিলের সাহায্যে ওরা ফুলতলী গ্রামের ওই সমাজবিরোধী গুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সব রকম ভাবে তৈরী হয়ে গেছে। দুলালবাবুর কাছে থাকা মেঘোমালার ডায়েরি আর ফোন রেকর্ড গুলো উকিলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে কেস লড়ার জন্য। প্রশাসনের কাছে ওরা অভিযোগ জানিয়েছে এবং মেঘমালার মৃত্যুর বা নিখোঁজ রহস্য খুঁজে বের করার জন্য আবারও রি-ওপেন করার জন্য আগেকার ওই ফাইল গুলো। কুশল এবং কিঙ্কিণীর পরিচিত উকিলটি খুব নামকরা এবং কলকাতার সব থেকে বড় উকিল। তাই ওদের কেস লড়তে সুবিধাই হবে। দুলালবাবুর সহযোগিতায় ওরা জানতে পেরেছে যে এখনো গ্রামে স্কুল কর্তৃপক্ষের বাড়ির পিছন দিকের বাগানে সমাজবিরোধী এবং বেআইনি কাজকর্ম চলে। তাই উপযুক্ত প্রমাণের জন্য দুলালবাবু এবং কিঙ্কিণী আর কোকো বাগানের পিছন দিকটা নজর রাখছিলো আজ। দুলালবাবু আর কিঙ্কিণী সমাজবিরোধী গুলোর কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখলেও কোকোর হঠাৎ চিৎকার করে ওঠায় ওদের উপস্থিতি চোখে পড়ে যায় সমাজবিরোধী গুলোর। ততক্ষণে সমাজবিরোধী কাজকর্ম প্রায় পুরোটাই বন্দি হয়েছে কিঙ্কিণীর হাতের ক্যামেরায় এবং সিসিটিভি ফুটেজে। এদিকে কুশল পুলিশ ফোর্স নিয়ে এসে গেছে সময়মতো। পুলিশকে দেখেই শয়তান গুলো দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলো। আর একটা লোক এসে কিঙ্কিণীর মাথায় রিভলবার ধরে বাকিদের পালাতে সাহায্য করতে এলো। ঠিক তখনই কোকো এগিয়ে গিয়ে ওই লোকটার পায়ে একটা কামড় বসিয়ে দিলো। লোকটার হাত থেকে রিভলবারটা সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেলো। কিঙ্কিণী দৌড়ে পালালো ওখান থেকে। তারপর লোকটার ওপর উঠে লোকটাকে কামড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করলো কোকো। লোকটা যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো। আর তখনই অন্য একটা লোক কোকোকে উদ্দেশ্য করে ছুড়ে দিলো গুলি। তা সত্ত্বেও কোকো কিঙ্কিণীকে বাঁচানোর জন্য দাপাদাপি করতে লাগলো ওই লোকটার ওপর। ততক্ষণে সমস্ত লোককে পুলিশ ঘেরাও করে ফেলেছে। সমস্ত অপরাধীকে গ্রেফতার করে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলো থানার উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ দাপাদাপি করার পরই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো কোকো। কিঙ্কিণী দৌড়ে গিয়ে ওখানে বসে পড়ে কোলে তুলে নিলো ওকে। কোকোকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো কিঙ্কিণী।

-কোকো ওঠ সোনা! ওঠ…. কিচ্ছু হবেনা তোর! কিচ্ছু না… আমি কিচ্ছু হতে দেবোনা তোর.. তুই এভাবে আমাদের ছেড়ে যেতে পারিসনা কোকো! কিছুতেই পারিসনা… আমি কী নিয়ে থাকবো সোনা? তুই কিছুতেই আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারিসনা… কোকো… ওঠনা বাবু.. প্লিজ ওঠ… দেখ আমি.. তোর কিঙ্কু তোকে এত করে ডাকছে, তাও তুই সাড়া দিচ্ছিসনা! তোর দিদি কিন্তু খুব রাগ করবে! তুই কথা না বললে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম! কোকো…

কিঙ্কিণীকে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখে ওর দিকে এগিয়ে এলো কুশল আর দুলালবাবু। ওদের দেখে আরও জোরে কেঁদে উঠলো কিঙ্কিণী।

-দেখোনা কুশ! কোকো কোনো সাড়া দিচ্ছেনা! শুধু একবার একটু জোরে ডেকে উঠেই কেমন চুপ করে গেলো! ও কেন আমার সাথে কথা বলছেনা কুশ? ওকে কথা বলতে বলোনা… আমি তো পাগল হয়ে যাবো ওকে ছাড়া! প্লিজ কুশ! বলোনা ওকে…
কোকো সোনা আমার ওঠনা.. তুই জানিস তোর দিদি তোর জন্য কী এনেছে? তোর ফেভারিট বিস্কুট এনেছি আমি! তুই তো এই বিস্কুটটা খেতে খুব ভালোবাসিস বল! তাই জন্যই তো আমি এনেছি… ওঠনা বাবু! আমি আর পারছিনা! তুই এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? তোর চোখ থেকে জল বেরোচ্ছে কেন? কী কষ্ট হচ্ছে তোর? বলনা আমায়? কিচ্ছু হবেনা তোর! আমি এক্ষুণি তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো…

কোকোকে কোলে তুলে কিঙ্কিণী উঠে দাঁড়াতে গেলো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনই কুশল কিঙ্কিণীকে নিজের বুকে চেপে জড়িয়ে ধরে বললো,

-কেঁদোনা কিঙ্কি… প্লিজ তুমি এভাবে কেঁদোনা.. চুপ করো কিঙ্কি.. চুপ করো… তুমি জানোনা তুমি কাঁদলে কোকো কতটা কষ্ট পায়? তোমার কান্না তো আমার মতো কোকোও সহ্য করতে পারেনা বলো? এভাবে চোখের জল ফেলোনা সোনা.. তুমি এত কাঁদলে তো কোকোও কষ্ট পাবে… ও তো সবসময় তোমার সাথে সাথেই থাকে। আর থাকবেও.. ও যেখানেই থাকুকনা কেন, ও কিন্তু সবসময় তোমার কাছেই থাকবে!
-তুমি কী বলতে চাইছো কুশ? কোকো বেঁচে নেই?! না! না! এটা হতে পারেনা! কিছুতেই হতে পারেনা! কোকো মরতে পারেনা! না….

কুশলের বুকের মধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়ে দাপাতে থাকলো কিঙ্কিণী। কুশল আর দুলালবাবুও কেঁদে ফেলেছে কোকোর জন্য.. এদিকে চিন্তায় কিঙ্কিণীর বাবা-মাও আর কলকাতায় বসে থাকতে পারছিলেননা। কারণ ওনারা জানতেন, আজ রাতেই ওই সমাজবিরোধী গুলোকে ধরার জন্য এবং ওদের অসামাজিক কাজকর্ম গুলোকে বন্ধ করার জন্য সবরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। সৌহার্দ্য এতদিন গ্রামে আসেনি। কারণ সৌহার্দ্য বেঁচে থাকার কথাটা জানতে পারলেই আবারও ওরা সৌহার্দ্যকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে ওকে। সৌহার্দ্য এখন কিঙ্কিণীর বাবা-মায়ের কাছেই থাকে। তাই চিন্তায় ওরা কেউই আর বসে থাকতে পারেনি ওখানে। কিঙ্কিণীদের বাড়ির গাড়িতে করেই ওরা মাঝরাতেই চলে এসেছে ফুলতলী গ্রামে।

থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা আর মারধোর করতেই এই দলের সাথে আরও যারা যুক্ত তাদের সবার নাম এবং তাদের সবার ডেরার খোঁজও দিয়ে দিলো ওই সমাজবিরোধী শয়তান গুলো। তারপর মেঘোমালাকে ধর্ষণ করে খুন করার কথাও স্বীকার করে নিলো ওরা। এটাও বললো যে ওরা সত্যি সত্যিই ওই বাগানের মধ্যেই পুঁতে দিয়েছিলো মেঘোমালার মৃত দেহটাকে। তাই পরের দিন সকালেই বাগানের ওই নির্দিষ্ট জায়গার মাটি খুঁড়ে বের করা হলো মেঘোমালার কঙ্কালসার মৃত দেহটাকে… তারপর মেঘোমালার দাহকার্যও সম্পন্ন করা হলো সঠিকভাবে। আর কোকোর মৃত দেহটাকে কবর দেওয়া হলো গ্রামের পাশের কবরস্থানে। সমস্ত অপরাধী তাদের করা অপরাধের শাস্তি পেলো কুশল আর কিঙ্কিণীর উকিলের সহযোগিতায়। এবং স্নেহলতাও এই লড়াইয়ে ওদের পাশে থেকে অনেক সাহায্য করেছে কুশল, কিঙ্কিণী এবং সৌহার্দ্যকে। দুলালবাবুও সারাক্ষণ ওদের পাশে ছিলেন এই লড়াইয়ে। গ্রামবাসীরা সকলে শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করলো তারপর থেকে। সমস্ত সমাজবিরোধী বেআইনী কাজকর্মও বন্ধ হয়েগেলো এই ঘটনার পরে। সন্ধ্যের পর আর লোডশেডিংও হয়না একদমই। বাচ্চাদের পড়াশোনারও আর অসুবিধা হয়না। ওরা মন দিয়ে পড়াশোনা করতে পারে স্কুল থেকে ফেরার পর। গ্রামের বয়ঃজ্যেষ্ঠ এবং অসুস্থ মানুষরাও আর গরমে কষ্ট পায়না। সন্ধ্যের পর গ্রামের মেয়ে-বৌদের বেরোতেও আর কোনো অসুবিধা হয়না। তারা নিশ্চিন্তে নিজেদের কাজে কিংবা টিউশনে যেতে পারে..

-থ্যাংকস ডক্টর দাশগুপ্ত! আপনি না থাকলে আজ হয়তো আমি সুস্থ হতে পারতামনা.. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এতগুলো দিন ধরে আমার পাশে থেকে আমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য..
-না মিস্টার সরকার.. আমাকে থ্যাংকস দিয়ে আমাকে ছোট করবেননা প্লিজ.. এটাই তো আমার কাজ.. আমি যদি আমার কাজটাই ঠিকমতো করতে না পারি তাহলে চলবে কী করে বলুন তো মিস্টার সরকার?
-সেতো আপনি ঠিক বলেছেন.. কিন্তু আমারও যে সুস্থ হওয়াটা ভীষণ দরকার ছিলো ডক্টর দাশগুপ্ত.. আপনি যদি এত ভালো একজন বন্ধুর মতো পাশে থেকে আমাকে সুস্থ করে না তুলতেন, তাহলে তো আজ এই দিনটা আসতোনা.. আজ যে আমার জীবনের সবথেকে কষ্টের আর সবথেকে আনন্দের দিন..
-কিন্তু আমার তো মনে হয় আপনি আমাকে বন্ধু মনে করেননা মিস্টার সরকার!
-মানে? কেন মনে করবোনা? এসব কী বলছেন আপনি ডক্টর দাশগুপ্ত?
-আমি তো ঠিকই বলেছি মিস্টার সরকার.. আপনি যদি আমাকে বন্ধুই মনে করতেন, তাহলে আমাকে ডক্টর দাশগুপ্ত নয়, স্নেহলতা কিংবা স্নেহা বলেই ডাকতেন…!
-ওহ্ এই ব্যাপার! হ্যাঁ সে নাহয় আপনাকে স্নেহা বলে ডাকাই যায়… কিন্তু এদিক থেকে ভাবলে তো আপনিও আমাকে মিস্টার সরকার না বলে ডেকে সৌহার্দ্য বলেই ডাকতেন..

স্নেহলতা আর সৌহার্দ্য দুজনেই একসঙ্গে সশব্দে হেসে উঠলো। তারপর স্নেহা বললো,

-আপনি তো বেশ ঘুরিয়ে কথা বলতে পারেন সৌহার্দ্য!
-হ্যাঁ সেতো আপনার থেকেই শেখা স্নেহা! এতদিনে আপনার সাথে মিশে, কথা বলে আমিও আপনার মতোই কথা বলতে শিখে গেছি!
-আচ্ছা আচ্ছা চলুন! ওদিকে অনুষ্ঠানের আয়োজন তো প্রায় শেষের দিকে! এবার শুরু হবে বোধহয়..
-হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন…

আজ রেণুবালা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যানিকেতনের একটা গ্রন্থাগার উদ্বোধন হবে। আর সেই অনুষ্ঠানেই সবাই উপস্থিত হয়েছে। কিঙ্কিণীর অনুরোধে মেঘোমালার স্মৃতিস্বরূপ স্কুল কর্তৃপক্ষের ওই বাড়িটাই গ্রন্থাগার তৈরী হয়েছে। যাতে গ্রামের সব বাচ্চারা এবং স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রীরা ওই গ্রন্থাগার থেকে নিজেদের দরকারি সমস্ত পাঠ্যপুস্তক নিয়ে নিজেদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। এবং যাদের বাড়িতে সেভাবে পড়ার জায়গা নেই, বা বিদ্যুৎ পরিষেবা যাদের ঘরে এখনো এসে পৌঁছায়নি, তারা এখানে এসে পড়াশোনা করতে পারে। গ্রামের মানুষের জন্য, স্কুলের বাচ্চাদের জন্য এতকিছু ভাবার জন্য, ওদের হয়ে লড়াই করার জন্য কিঙ্কিণীকে রেণুবালা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষিকার পদে উন্নীত করা হয়েছে। সেইজন্য কিঙ্কিণীরও একটা সম্বর্ধনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। সেই সাথে গ্রামের যেসমস্ত বাড়িতে এখনো বিদ্যুৎ পরিষেবা পৌঁছায়নি, সেই প্রত্যেকটা বাড়িতে বিদ্যুৎ পরিষেবা চালু হওয়ারও আজ প্রথম দিন। কিঙ্কিণীর অনুরোধে সেই উদ্যোগটাও সরকার গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। তাই গ্রামের মানুষের কাছেও কিঙ্কিণী ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে…

সৌহার্দ্য সবার কাছে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও ও এখনো মেঘার সাথে কথা বলে। তবে সেটা সবার আড়ালে। এমনকি স্নেহলতা এত ভালো বন্ধু হয়ে উঠেও জানতে পারেনা সৌহার্দ্যের মেঘোমালার সাথে কথা বলার আর দেখতে পাওয়ার কথাটা। কারণ সৌহার্দ্য জানে কারোর সামনে মেঘার সাথে কথা বললেই সবাই ওকে মানসিক রোগীই ভাববে। কিন্তু প্রতিদিন ও মেঘার সাথে কথা বলে। সারাক্ষণ ওর মেঘা ওর কাছেই থাকে। সৌহার্দ্য যখন সবার সাথে থাকে, তখন মেঘা ওর কাছে থাকে ঠিকই, কিন্তু ও তখন মেঘার সাথে কোনো কথা বলেনা। যখন কেউ থাকেনা, ও একা থাকে, তখনই মেঘার সাথে কথা বলে, মেঘার কোলে মাথা রেখে শোয়, মেঘা ওর সৌহার্দ্যের মাথায় হাতও বুলিয়ে দেয়… আজকের এই অনুষ্ঠানে সবাই এসেছে। কুশল, কিঙ্কিণী, কিঙ্কিণীর বাবা-মা, স্নেহলতা, স্নেহলতার বাবা-মা, স্কুলের সব শিক্ষক-শিক্ষিকারা, এমনকি গ্রামের সমস্ত মানুষও এসেছেন। প্রতিটা চেয়ারে লোক ভর্তি হয়ে গেছে। এমনকি চেয়ারের পিছনে সারি সারি লোকও দাঁড়িয়ে রয়েছে। সৌহার্দ্যের একপাশের চেয়ারে স্নেহা বসে আছে। কিন্তু অন্য পাশের চেয়ারটা সৌহার্দ্য ফাঁকা রেখেছে। কারণ জানতে চাওয়ায় সৌহার্দ্য বলেছে ও নিজের ব্যাগ রাখবে। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই মেঘোমালা এসে বসলো ওর পাশে.. সৌহার্দ্য নিজের হাতটা রাখলো ওর মেঘার হাতের ওপর…

সমাপ্ত।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here