একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ১৮

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৮
জায়গাবদল হওয়ায় ভোরের দিকে দীপার ঘুম ভেঙে গেল। এমনিতে এক ঘুমে সে রাত এমনকি সকাল আর দুপুরও নিশ্চিন্তে পার করে দিতে পারে। নড়েচড়ে চোখ মেলতেই তার চোখ জলে ভরে গেল। কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল বালিশে। ঘুমের মাঝে হাত – পা তুলে দেওয়ার অভ্যাস তার। কাদিনের উপর পা তুলে রেখেছে সে। হাতটাও কাদিনের বুকে। কাদিন অবশ্য হাত দিয়ে কপাল ঢেকে চিন্তা করতে করতে যেভাবে শুয়েছিল সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দীপা উঠে বসল। তার পাশে তো এই মানুষটি থাকার কথা নয়। যাকে গোলাপের পাঁপড়ি ছিঁড়তে, খোঁপায় ফুল গুঁজতে, বৃষ্টিতে ভিজতে এতটা কাল ধরে ভেবে এসেছে তার থাকার কথা। থাকার কথা তার যার সাথে বিগত বর্ষাগুলোয় পিঁচঢালা পথে হেঁটেছিল। ডুবেছিল যার চোরাবালিতে। বিছানা ছেড়ে নেমে গেল সে। বারান্দার দরজা খুলে বারান্দার দাঁড়াল। চারদিক পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখোরিত হচ্ছে। অন্ধকার খানিকবাদেই কেটে যাবে। আর দীপার কান্না? কখনো কি থামবে? দোলনায় বসে চোখ বুজল সে। তাহমিদ গতকাল তার বিয়েতে এসেছিল তাও প্রেমিকা সহিত। না ঠিক তার বিয়েতে নয়, নিজের বন্ধু কাদিনের বিয়েতে। কাদিন নাকি তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন। অথচ, দীপাকে কখনো সে কাদিনের নামটুকুও বলেনি। শুধু কাদিন কেন? কোনোদিন তাহমিদ তার অন্য কোনো বন্ধুদের সাথেও তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। না দিয়ে দিয়েছে তার পরিবারপরিজনেরর সাথে পরিচয় করিয়ে। অথচ, দীপা গতকাল খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে তাহমিদের নতুন প্রেমিকা তার বন্ধুমহলে বেশ সুপরিচিত। শুধু সুপরচিত’ই নয় ভাবি বলে পরিচিত। কাদিনও মেয়েটাকে ভাবি বলে কথা বলছিল!
সে যে এতদিন বোকার স্বর্গে বাস করছিল তাতে আর কোনো সন্দেহ রইল না তার। বোকাই ত সে। ঘুম ভাঙা চোখে যে মেয়ে তার স্বামীকে মানতে পারে না, যে এখনো চোখ মেলে তার প্রতারক প্রেমিককে দেখার জন্যে, সে বোকা ছাড়া আর কিছুই নয়।
.
কাদিন আর কাইয়ূমের ঘরের বারান্দা পাশাপাশি। রিমা তার বারান্দায় সকালে কি একটা কাজে যেন এল। পাশের বারান্দায় চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। দীপা বারান্দার দোলনায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে কেন? নতুন বউকে কি সারারাত বারান্দায় রেখেছিল কাদিন? এ কেমন কথা? হলুদ সন্ধ্যা থেকেই কাদিনকে চিন্তিত লাগছিল। কোনো সমস্যা হয়নি তো? রিমা চুল বাঁধতে বাঁধতে কাদিনের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলো। রিমার জায়গায় অন্য কেউ হলে দেবর আর জায়ের মধ্যকার বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতো না। কিন্তু সে ভিন্ন। সে কাদিনের বড় বোনও। ধীর গলায় দরজা ধাক্কে কাদিনকে ডেকে তুলল। কাদিন আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুলতেই রিমা ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা আটকে ফেলল। বলল, “এসব কি হচ্ছে, কাদিন?”
কাদিন কাঁচা ঘুম থেকে উঠায় অনেককিছুই ধরতে পারছে না সে। তাই প্রশ্ন করল, “কি হবে?”
“দীপা বারান্দায় কি করছে? রাস্তা থেকে বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। মানুষজন কি বলবে, কাদিন?”
কাদিনের এতক্ষণে খেয়াল হলো দীপা বিছানায় নেই। সে বারান্দার দিকে হেঁটে গেল। রিমাও পেছন পেছন গেল। বারান্দার ঠাণ্ডা বাতাসে আরাম পেয়ে দীপা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাদিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে গেল। নীচ থেকে কেউ দেখে ফেলেনি তো? আর পাশের বাসার ওরা?
কাদিন প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ডাকল, “দীপা? অ্যাই দীপা? উঠো। উঠো বলছি। তুমি এখানে কি করছ? দীপা?”
কাদিন এবার দীপার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনী দিলো। দীপা ঘুম থেকে উঠে হকচকিয়ে গেল। রিমা ভাবি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। দীপা ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াল। কাদিন বলল, “তুমি বারান্দায় ঘুমাচ্ছিলে! আশ্চর্য!”
দীপা বলল, “গরম করছিল বলে বাতাস খেতে বসেছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি।”
কাদিন রাগে কিছু বলতে পারল না। রিমা বলল, “কাদিন তোমায় উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে? কোনো ঝামেলা হলে আমাকে বলো, লুকিয়ো না।”
দীপা বলল, “না, না তেমন কিছু না। আপনি কি করে জানলেন আমি এখানে?”
“তোমার পাশের ঘরটা আমার আর তোমার পাশের বারান্দাটাও।”
কাদিন আর নিজেকে সামলাতে পারছে না বলে সেখান থেকে সরে এল। এই মেয়ে জাস্ট রিডিকিউলাস! রিমা আপুকে প্রশ্ন করছে আপু কি করে দেখল। কোনো আক্কেল নেই। কত গাধী এই মেয়ে! কখনো, কোথায়, কি বলতে হবে সে সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানও তার নেই।
.
কাদের সাহেব ঠিক করলেন বড় ছেলের মত মেজো ছেলের বউভাতের অনুষ্ঠানটাও তিনি নিজের গ্রামের বাড়িতেই করবেন। দীপাকে নাশতার টেবিলে বললেন, “তোমাদের বাড়ির লোকদের অসুবিধে হবে না তো, মা?”
দীপা বলল, “না, বাবা। অসুবিধা কেন হবে?..”
দীপা হয়তো আরো কিছু বলত। কিন্তু তার আগেই কাদিন খপ করে টেবিলের নীচে দীপার হাত চেপে ধরল। পাঠক, এই হাত চেপে ধরাকে কোনো প্রকার রোমান্টিসিজমের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করার দরকার নেই। এই হাত চেপে ধরার অর্থ, দয়া করে এখানেই থামো। বেশি বেশি বলো না তুমি। তুমি মুখ খুললেই আমি বিপদে পড়ব। দীপা এই হাত ধরার মানে কি বুঝল কী যেন! তবে হকচকিয়ে উঠল। দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চুপ হয়ে গেল। কায়েস এসে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “দীপা ভাবিকে জানালার পাশের চেয়ারটা দাওনা তোমরা।”
রিমা এই কথা শুনে হাসতে হাসতে কড়ির উপর ঢলে পড়ল। কড়িও ঠোঁট টিপে হাসছে। কাদের সাহেবও না হেসে পারলেন না। কাইয়ূম নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, “দীপা, নাও বোন তুমি এটায় বসো।”
দীপা লজ্জায় মাথা নীচু করে জিহ্ব কাটল, “ভাইয়া প্লিজ বসুন।”
কাদিনের মুখ থমথম করছে। সে চুপচাপ মুখে লোকমা তুলল।
কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া বউ তার।
.
নাঈম সকালের নাশতা করতে মেস থেকে বেরুচ্ছিল। ইমাদ পিছু ডাকল, “নাঈম?”
নাঈম হাসতে হাসতে ইমাদের কাছে ফিরে গেল, “কি খবর, ইমাদ?”
“ভালো। একটা ভালো টিউশনীর সন্ধান আছে। তুমি চাইলে পড়িয়ে দেখতে পারো।”
নাঈমের চোখ চকচক করে উঠল, “কোন ক্লাস? কত দিবে?”
“দিবে ভালোই। রেসকোর্সের দিকে পারবে?”
“পারব, পারব আলবত পারব। বড় উপকার করলে ভাই।”
ইমাদ প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে বলল, “গার্ডিয়ানের নাম্বারটা মেসেজ করে দিচ্ছি। তুমি আগে কথা বলে দেখো।”
নাঈম ইমাদের কাঁধ চেপে ধরল, “নাশতা করেছ? এসো না একসাথে যাই।”
ইমাদ নাশতা করেনি তবুও বলল, “করে ফেলেছি। আরেকদিন।” সে নাঈমের কাছ থেকে ট্রিট নিতে নারাজ।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here