একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ১৭

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৭
দীপা বুঝছিল না কি করবে। এভাবেই ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে? না কিছু বলবে? কাদিন এভাবে বালিশে হেলান দিয়ে কপালে হাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে কেন? ক্লান্ত তো ওর হওয়ার কথা। এত ভারি শাড়িটা! তার উপর ম্যাকআপ। অসহ্য লাগছে। আর কথা না বলে থাকা যাচ্ছে না। দীপা বলেই ফেলল, “আমাকে আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে?”
কাদিন চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “বসে থাকতে হবে না।”
ঘোমটার নীচেই দীপা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সমস্যা কি এই লোকের? সেও কি ছ্যাকাট্যাকা খেয়েছে নাকি? জিজ্ঞেস করতে মনটা আকুপাকু করে উঠল। পরে ভাবল না থাক বেচারাকে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা। ভয়াবহ শোকেজর্জরিত মনে হচ্ছে। দীপা ইচ্ছে দমন করে ঘোমটা ফেলে ফুলের বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। লাগেজ টেনে এনে বিছানার উপর তুলে রাখতেই কাদিন চোখ খুলে অস্থির হয়ে বলল, “নামাও নামাও। লাগেজে ময়লা কত! চাদরে ময়লা লাগবে।”
দীপা বিছানা থেকে লাগেজ নামিয়ে নীচে রাখল। সালোয়ার কামিজ বের করে বাথরুমে চলে গেল সে। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখল কাদিন বিছানার চাদর পাল্টাচ্ছে। দীপা অবাক হয়ে গেল। ও বাবা! এ কার সাথে এসে পড়ল সে! কাদিন বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল এক পাশে। দীপাও উল্টোদিকে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত থাকায় দীপা সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল। কাদিন ঘুমালো না। তার কিছুতেই ঘুম আসছে না। সারাটা জীবন মেয়েদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে এসেছে। জীবনে কোনোদিন প্রেম পিরিতির ধারে কাছেও ঘেঁষেনি। সবসময় শুধু পড়াশুনা এবং নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই মজে ছিল। নিজেকে সম্পূর্ণ যত্নসহকারে তোলে রেখেছিল নিজের ভবিষত স্ত্রীর জন্য। সেও এমনি একজনকে আশা করেছিল জীবনে। আর তার জীবনেই কিনা জুটল এমন কেউ? বিয়ের আগের রাতে এসে বিয়ে ভাঙাটা ঠিক মনে হয়নি তার। দুপক্ষের সকল আত্মীয়স্বজন, তার সব বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ভর্তি এত এত মেহমান রেখে পরিবারের মান ক্ষুণ্ন করার কথা আর ভাবতে পারেনি সে। তাছাড়া, এই মেয়ে একবার জমের ঘর থেকে ফিরে এসেছে। নতুন করে বিয়ে ভাঙার কারণে যদি কিছু করে বসত! সর্বনাশ হয়ে যেত। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল বিয়েটা না করলে অন্যায় হতো। তাই সে শেষ পর্যন্ত নিজের মনের বিরুদ্ধাচার করে হলেও বিয়েটা করেছে। কিন্তু এ কাকে বিয়ে করল সে? এই মেয়ের মাঝে কোনো শিষ্টাচার নেই। ভদ্রতা নেই। গাড়িতে উঠার সময় হুট করে কেমন একটা কথা বলে ফেলল সে। লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছিল। কায়েস আর তার বন্ধুরা সারাটা পথ হাসাহাসি করেছে। অসহ্য!

রাত বাড়ছে। এলার্ম ঘড়িটা বিদঘুটে শব্দ তুলতেই মিলার ঘুম ভাঙল। টেবিল থেকে মাথা তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দুটো বিশ বাজে। ঘুমে চোখ দুটো জ্বলছে। কিন্তু চ্যাপ্টারটা আজ রাতের মাঝেই শেষ করবে। সে প্রায়ই এমন করে। সারারাত ধরে পড়ে। তার পড়াটা অবশ্য একটানা নয়। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত একটানা পড়ে। তারপর থেকে শুরু হয় আধা ঘণ্টা পড়া আর বিশ মিনিট ঘুমানো। আধা ঘণ্টা পর পর বিশ মিনিটের ঘুম দেয় সে। তখন এলার্ম দিয়ে রাখে। এলার্ম বাজতেই আবার পড়তে বসে। মিলার শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল। রান্না করতে গিয়ে ওর সব এনার্জি শেষ। তবুও উঠে বইয়ে ঝুঁকে গুনগুন করে পড়া শুরু করল সে।
রাজপ্রাসাদে থেকেও সবাই রাজকন্যা হয় না। কেউ কেউ অতি সাধারণ হয়ে অক্লান্ত আর অচিন্তনীয় পরিশ্রম করে। মিলা তেমনি একজন। এর চাইতে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সুহার জীবন বড় বেশি শান্ত আর প্রশান্তিময়। তবে ক্ষতি নেই। মিলা এতদিনে বুঝে গেছে সে রেশমের বিছানার কিংবা ফুলের বারান্দার রাজকন্যা হতে জন্মায়নি। সে জন্মেছে নিজের তৈরী সিংহাসনের মাথা উঁচু করা এক সম্রাজ্ঞী হতে।

ঠিক পাশের ঘরেই বাতি নিভিয়ে মুবিন তখন মোবাইল হাতে নেশাগ্রস্তের মত ফ্রি ফায়ার গেইম খেলছে। মোবাইলের আলো তার অস্থির চোখে মুখে জেঁকে বসে আছে। ওর অন্ধকার ঘরের দরজায় দাঁড়ালে মোবাইলের আলোতে কিশোর মুখটাকে দেখা যায়। যেন মনে হয় অন্ধকার আকাশের উজ্জ্বল কোনো নক্ষত্রের পতন ভেবে বিভ্রম হয়।
.
ইমাদ এত রাতেও মেসে ফিরেনি। সে পদুয়ার বাজারের ফুট ওভার ব্রিজটা ধরে বিভোর হয়ে হাঁটছিল। একটু পর পর নীচ দিয়ে মালবাহী বিরাটাকার ট্রাকগুলো দৌড়ে যাচ্ছে। খানিক আলো জ্বেলে, কেমন একটা শব্দ করে ট্রাকগুলো নিজেদের আগমণের, প্রস্থানের জানান দিয়ে যাচ্ছে। সব আগমণের’ই কি এমন আগমনবার্তা থাকে? আর প্রস্থানের? ইমাদ নিজের গায়ের হালকা গড়নের চাদরটা খুলে ফুট ওভারব্রিজটির কিনারা ঘেঁষে যে মধ্যবয়সী লোকটি হাত – পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছেন, তাঁর গায়ে জড়িয়ে দিলো। তারপর নিঃশব্দে পায়ে পায়ে ব্রিজটির সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। কড়ি মেয়েটি কি সত্যিই তার আশেপাশের সবাইকে বুঝতে পারে? কিছুটা হয়তো পারে, তবে পুরোপুরি নয়। এ জগতে নিজেকেও নিজে পুরোপুরি বুঝা অসম্ভব। মজার বিষয় হলো কড়ি সম্পর্কে সে দারুণ হাস্যকর একটি সত্য আবিষ্কার করতে পেরেছে। কড়ি আসলে যতটুকু বুঝে তার চাইতেও বেশি প্রকাশ করে ফেলে। অথচ, ইমাদ তা করে না। সে কাউকে বুঝলেও কখনো তা প্রকাশ করে না। এই যে কড়িকেও সে বুঝে কই কখনো তো সে কড়ির কাছে তা প্রকাশ করেনি? ইমাদ মুচকি হাসল। রাত হঠাৎ করেই আরো অন্ধকার আর রহস্যময় হয়ে উঠল। কড়ি তাকে যতটুকু বুঝে তার চাইতে কড়িকে সে খানিকটা বেশিই বুঝে। শুধু বলা হয়নি। তবে কড়ি যদি এবার তাকে বুঝবার শক্তি নিয়ে খেলতে চায় তবে সেও সেই খেলায় মেতে উঠবে।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here