একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী শেষ পর্ব : বাকি অংশ।

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী
শেষ পর্ব : বাকি অংশ।

বি.দ্র. শেষ পর্বটি অনেক বড় হওয়ায় শব্দ সংখ্যার লিমিট ক্রস করে ফেলছে। একবারে পোস্ট দেয়া সম্ভব হয় নি। তাই দুইবারে পোস্ট করছি। এটি শেষ পর্বের বাকি অংশ।

দীপা একবার ভাবলো ঐ বাসায় যাবে। বাসার অবস্থা কি, কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সবাই কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করছে। সবাই ঠিক আছে তো? কড়িকে কয়েকবার করে কল করেছে। কড়ির মোবাইল সুইচড অফ। কাদিনকে কল করেছে। কাদিন কল ধরেনি। রিমা আপু কিংবা বাসার অন্য কাউকে কল করবার সাহস দীপার নেই। দুদিন ধরে পাগলের মতো কি করবে ভেবেছে সে। এত বড় একটা ঘটনায় সে যুক্ত। প্রথম থেকেই সব জানতো অথচ, গোপন করে রেখেছে। কি জবাব দিবে ওদের? রিমাই ফোন করলো তাকে। রিমার কাছ থেকে বাসার গুমোট পরিস্থিতি জেনে খুব কষ্ট হলো দীপার। বাবা কড়ির সাথে কথা বলা বন্ধ দিয়েছেন। কাইয়ূম, কাদিন, কায়েস কড়িকে উঠতে বসতে কঠিন কঠিন কথা শুনাচ্ছে। রিমা নিজেও রাগ। রিমা দীপাকে বলল, “কাদিন সবচেয়ে বেশি ক্ষেপেছে। তোমার উপরেও ক্ষ্যাপা। আর ওখানে পড়ে থেকো না। যা হওয়ার হয়েছে, চলে এসো।”
দীপা বলল, “আমি আসতে পারব না, আপু।”
“কেন আসতে পারবে না?”
“আপনাকে বলতে পারব না।”
“আমাকে কিছু বলো আর না বলো, কাদিনের কাছ থেকে আর কিছু লুকিয়ো না তুমি। ও খুব জটিল। আর যা যা লুকিয়েছো বলে দিও।”
টেবিল ল্যাম্পটা ঠিক করে কাদিন নিজেই ফেরত দিতে এলো। যেহেতু সে ভেঙেছে, তারই এটা ঠিক করা দিয়ে যাওয়া উচিত। সামজিকতা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। দীপার মা জোর করে তাকে খেতে বসালেন। ভদ্রতার কারণে কাদিনকে বসতে হলো। কোনোমতে দু লোকমা মুখে নিয়ে সে উঠল। খাওয়া শেষে বেসিনে হাত ধোয়ার সময় দীপা বলল, “কড়িকে মাফ করে দাও।”
কাদিন বলল, “লজ্জা থাকলে এ কথা বলতে না। নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হচ্ছে। তোমরা দুজনেই আমাকে ঠকিয়েছ। আমার বোন, বউ দুজনেই আমাকে বোকা বানিয়েছে।”
দীপা বলল, “তুমি কি কখনই আর আমাদের বিশ্বাস করবে না?”
কাদিন মুখের উপর বলল, “না। তুমি আমার কাছে আরো অনেককিছুই লুকিয়েছ, লুকাবে। তোমাকে আমার চেনা হয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমার মনে যা, মুখেও তা। ঘটনা কিন্তু তা না।”
“ঘটনা কি?”
“ঘটনা হলো আমি একটা ইডিয়ট। আর কিছু না।”
দীপা কান্নার দলা গলায় আটকে বলল, “তোমাকে কখনো বলতে চাইনি। আজ বলব। জানি শোনার পর যেটুকু বিশ্বাস বাকি আছে সেটুকুও আর থাকবে না। তবু বলে দিয়ে শেষ করি। তোমাকে ইডিয়ট ভেবে কোনোকিছু লুকাইনি। আমি ননসেন্স তাই আমার কান্ডকীর্তি তোমাকে বলতে চাই না।”
কাদিনের ভ্রু কুঁচকাল, “কি বলতে চাইছো?”
“ঘরে এসো।”
দীপা চোখে মুখে কান্না নিয়ে ঘরের দিকে গেল। কাদিনও পেছন পেছন গেল। দীপা দরজা বন্ধ করে এক নিশ্বাসে
বলল, “তোমার বন্ধু তাহমিদ আমার এক্স। ও আমাকে ডিচ করে। কড়ি এটা জানতো। বলতে নিষেধ করেছিল।”
কাদিন কতক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। সে যা শুনছে সত্যিই দীপা তা বলছে তো? দীপা বলল, “কিছু বলবে?”
কাদিন বলল, “আর কি লুকিয়েছো?”
“তাহমিদ একদিন তোমার সাথে দেখা করতে বাসায় এসেছিলো। তুমি ছিলে না।”
“তারপর?”
“আমাকে সুযোগে কিছু কথা বলেছে।”
“কি কথা?”
“ছোটবেলা থেকেই তুমি ওর থেকে, সবার থেকে সবকিছুতে এগিয়ে ছিলে। পড়াশুনা, রেজাল্ট, গুড ইমেজ, চাকুরী। শেষ বেলায় এসে আমাকে বিয়ে করে ঠকে গেলে। যে মেয়েকে ও বিয়ে করতে রাজি হয়নি, সে মেয়েকে শেষ পর্যন্ত তোমার বিয়ে করতে হলো।”
“কবে বলেছে?”
দীপা তারিখ বলল। কাদিন মিলিয়ে দেখলো সেদিনই দীপা অন্য একটা ঝগড়ার ছুঁতোয় রাগ করে চলে এসেছে। কাদিন সাথে সাথে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। দীপা বলল, “কাকে কল করছো তুমি?”
কাদিন বলল, “বোন, বউ, বন্ধু সবাই মিলে আমার সাথে কানামাছি খেললে। তোমাদের ধরেছি, তাহমিদকে ধরব না?”
তাহমিদ কল রিসিভ করল, “আরে বন্ধু কেমন আছিস তুই?”
কাদিন বলল, “ছোটবেলা থেকেই তুই আমার মত হতে চাইতিস। তোর সব জিনিস কেবল আমার হয়ে যায় চেয়েও কখনো কিছুই অর্জন করতে পারিস না। একাডেমিকালি, ফিনানশিয়ালি, গুড ইমেজ সবকিছুতে তুই আমার সাথে অযথা টক্কর দিতিস এবং
সব কিছুতে পিছিয়ে ছিলি। সব সময় তোর মাঝে ইনফিরিউরিটি কমপ্লেক্স কাজ করতো। তুই হীনমন্যতায় ভুগেছিস। আমাকে হিংসে করেছিস। রেজাল্ট, পড়াশোনা, চাকুরী সব আমার মত চাইতিস। যে অফিসে এখন চাকুরি করছি এখানেও দুজনে মিলে একসাথে ইন্টারভিউ দিলাম। আমার হলো, তোর হলো না। সবসময় আমার সাথে প্রতিযোগিতা করিস। আমি কখনো তোর সাথে প্রতিযোগিতায় নামিনি। আমার সাথে তোর কম্পিটিশনটা আমি বুঝি। কিন্তু কম্পিটিশনের দরকারটা কি আমি আজো বুঝিনি। তোর মত করে ভাবতে পারি না আমি। আমি কখনো তোর মত ভাববোও না, তোর মত হবোও না।
আর তুই চাইলেও আমার মত হতে পারবি না। আমার সাথে প্রতিযোগিতা করিস না, তাহমিদ। সবসময়ের মত হারবি। আজও তুই হারলি। দীপা তোর গার্লফ্রেন্ড ছিল। অথচ, দীপাকে বিয়ে করে ফেললাম আমি। দীপা তোর পিছনে পাগল ছিল। আমাকে পেয়ে তোকে ভুলেই গেল। তাই খুব লাগছে তাইনা? যার মত তুই আজীবন হতে চেয়েছিস, নকল করেছিস, হিংসে করেছিস, পেছনে পেছনে শত্রুতা করেছিস দীপা তাকেই বিয়ে করে ফেলল। যে দীপাকে তুই বিয়ে করিসনি তার বর আসলে তোর আইডল। একদিকে বুকে ছুড়ি বসল। যে বন্ধু সবসময় তোর থেকে সবকিছুতে এগিয়ে সে বন্ধু শেষ পর্যন্ত তোর গার্লফ্রেন্ডকেও বিয়ে করে নিলো। দীপাকেও রাখতে পারলি না। আরেকদিকে পিঠে তীর। দুদিকেই জ্বলছিস। তোর বুকে এখন শিখা অনিবার্ণ। বৃত্তি, চাকুরী, দীপা সব আমার। তুই আজীবন আমার মত হতে চেয়েছিস কিন্তু কখনো পারিস নি, পারবিও না। তোর দ্বারা আমার মত হওয়া সম্ভব না। যা তোর দ্বারা সম্ভব না তা কেন করতে চাস?”
তাহমিদ বলল, “অহঙ্কার করছিস?”
কাদিন হাসলো, “আমি কখনো অহঙ্কার করিনি। আজ করছি। দীপার মত এত লয়্যাল একটা মেয়েকে আল্লাহ তোর ঝুলি থেকে তুলে এনে আমার করে দিয়েছে। তুই দীপাকে যা বলেছিস, করেছিস সবটাই করেছিস হিংসায়। হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্যই তোর দ্বারা কখনো ভালো কিছু হয় না। তুই জীবনে কিছুই করতে পারিসনি।”
তাহমিদ বলল, “দীপার মত আহাম্মককে আমি ছুঁড়ে ফেলেছি। তুই টোকাইয়ের মত ঘরে তুলেছিস।”
কাদিন জবাবটা দিলো তীরের ফলার মত,
“দীপা হাই মেনটেনেন্স। তোর মত আহাম্মকের দ্বারা সামলানো সম্ভব না। দীপাকে সামালাতে নিজে আহাম্মক হলে হয় না। বুদ্ধি লাগে। দীপার মত ব্র্যান্ড কেবল আমাকেই মানায়। তোর সাধ্যের বাইরে, ব্রো।” বলতে বলতেই কাদিন দীপাকে কাছে টেনে নিজের বাহুডোরে নিয়ে নিলো। যেন তাহমিদ ফোনের ওপাশেই দেখতে পাচ্ছে। বউকে নিয়ে খুব প্রাউড কাদিন।
তাহমিদ বলল, “আমি ভালো বলেই তোকে দীপার আর আমার পুরোনো প্রেম নিয়ে কিছু জানাইনি। আন্দাজ করছি দীপার কাছে থেকেই জেনেছিস। দীপা তোর কাছে ইনোসেন্ট সাজতে চায়। আজ বুঝতে পারলাম যতটা ইনোসেন্ট ওকে ভাবতাম ততটা ইনোসেন্ট ও না। তুইও একদিন বুঝবি।”
কাদিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “তোকে আমি ল্যাংটাকাল থেকে চিনি। তুই আমার বন্ধু। হাজারটা মেয়েকে তুই ঘুরিয়েছিস। হাজারটা মেয়েকে তুই নিজের ইশারায় নাচিয়েছিস, কষ্ট দিয়েছিস। অনেক না করেছি, বুঝিয়েছি। শুনিস নি। কখনো কারো সাথে সিরিয়াস হোসনি। তুই যদি পারতিস, দীপার নামে আমার কাছে অবশ্যই, অবশ্যই
উল্টাপাল্টা বদনাম করতিস। তুই এসব করিসনি কারণ জানিস আমি বিশ্বাস করব না। আমি তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি। কত কত মেয়েকে কষ্ট দিয়েছিস আমি জানি। আমাকে বলে লাভ হবে না, তাই দীপাকে ফালতু, হাস্যকর একটা কথা বলে আমাদের মাঝে দূরত্ব তৈরী করার চেষ্টা করেছিস। হিংসায় জলে পুড়ে শয়তানি করেছিস। তুই যে আমার হিংসা করতিস ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম। বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকতাম। তোকে আমি বারবার ক্ষমা করেছি। তবু নানান ভাবে, নানান সময়ে তুই আমার সাথে শত্রুতা করেছিস। অযথা, ভালো সাজার চেষ্টা করিস না। আমি দীপা না যে, তুই যা বলবি ওটা শুনেই প্রভাবিত হয়ে যাব৷ আমি কাদিন। আমার সাথে ভেবেচিন্তে, হিসেব করে কথা বলবি। আমি তোর পালস ওঠানামাও ধরতে পারি। আর কোনোদিন আমার সামনে আসবি না। তোকে চোখের সামনেও দেখতে চাই না।”
তাহমিদ বলল, “আমিও।” তারপর রাগে কলটা কেটে দিলো। মেবাইলে রেখে কাদিন এবার দীপার উপর ক্ষ্যাপল, “তুমি এ কারণে চলে এসেছো? এজন্যই তো আমি মিলাতে পারি না। তোমাকে কতবার৷ কতকিছু বকেছি, কত দোষ ধরেছি তুমি রাগ করোনি। তাহমিদের একটা কথায় চলে এলে? ওর কথায় উঠবস চলবে না।”
“ও বলেছে তোমার জন্য নাকি ওর আফসোস হয়। আমাকে বিয়ে করে তুমি ঠকেছো।”
কাদিন বলল, “ওর মাথা আর তোমার মুন্ডু। তোমাকে বিয়ে করে আমি জিতেছি।”
দীপা মুখ ঘুরিয়ে কান্না করে দিলো, “মিথ্যে কথা।”
কাদিন দীপার চিবুক ধরে নিজের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে বলল, “ব্যাগ গুছাও।”
দীপা বলল, “না, আমি যাব না। ইউ ডিজার্ভ বেটার।”
কাদিন দীপার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “আই স্যুয়ের, ইউ আর দ্যা বেস্ট অ্যাওয়ার্ড। অ্যান এবসিলিউট ট্র্যাজার। প্লিজ ব্যাগ গুছাও।”
দীপা নিজেকে কাদিনের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “একটু বসো।”
তারপর লাগেজ বের করল। আলমারি থেকে কাপড় বের করতে গিয়ে ভাঁজ করা কাপড় এলোমেলো করে ফেলল। সব নীচে পড়ে গেল। দুহাতে যতটুকু সম্ভব কাপড় আগলে ধরে তুলতে তুলতে কাদিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যরি, স্যরি আমি ঠিক করে নিচ্ছি।”
কাদিন এগিয়ে এসে দীপার হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে বলল, “তুমি বসো। আমি ভাঁজ করছি।”
দীপা বলল, “না, না আমি পারব। আমি পারি।”
কাদিন বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে তুমি পারো। কিন্তু বসো চুপচাপ। আমি করছি।”
দীপাকে কাদিন জোর করে টেনে বসিয়ে রেখে নিজে কাপড় ভাঁজ করে করে সুন্দর করে লাগেজ গোছাচ্ছে। দীপা লাফিয়ে উঠে বলল, “ধুর, আমাকে তো ধরতেই দিচ্ছে না। আমি তাহলে তোমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসি।”
কাদিন বলতে যাচ্ছিলো, “আচ্ছা।”
কিন্তু দীপা বলতে আর দিলো কই? তার আগেই বাচ্চাদের মত একটা দৌড় দিলো রান্নাঘরের দিকে। কাদিন প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও শেষে সেদিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। সে ঠিক করেছে, দীপাকে গুছালো হতে হবে না। সে নিজে সব গুছিয়ে রাখবে। দীপাকে টিভির শব্দ কমাতে হবে না। সে কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে ঘুমাব। কাপড় বদলাবার আগে দীপার ঘরের পর্দা টানার কথা মনে রাখতে হবে না। সেই টেনে দিবি। বিড়বিড় করল সে, “দীপা তুমি অগোছালোই সুন্দর।”
.
এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকেই মিলা ইন্টারের পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছে। ধুমসে পড়ছে। একটা কোচিংয়েও ভর্তি হয়ে গেছে। সেই কোচিংয়ে অভ্রও পড়ে। অভ্র একদিন এসে বলল, “আমাকে ভেক্টর বুঝিয়ে দিয়ো তো।”
মিলা বলল, “তার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো পারো।”
অভ্র বলল, “তোমার মত পারি না।”
“সবসময় তো আমার চেয়ে বেশি নম্বর পাও।”
“তুমি বুঝিয়ে দাও বলেই পড়তে সহজ হয়। ভালো করি।”
মিলা বলল, “দেখো, তুমি যা চাইছো তা হবে না।”
“আমি আবার কি চাইলাম?” অভ্র চোখ বড় বড় করে খুব অবাক হবার ভান করল।
মিলা সুন্দর করে বলল, “তুমি কি চাইছে সেটা খুব ভালো করেই জানো। অযথা আমার কাছে পড়া বুঝতে আসবে না।”
অভ্রর মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরদিন মিলা তার খাতায় অভ্রর একটা লেখা পেল। তার খাতা কখন নিলো অভ্র? আবার কখন ফেরত দিলো? ক্লাসের ফাঁকেই হবে। অভ্র লিখেছে,
রোদমিলা,
তুমি ঠিক বলেছো আমার তোমার কাছে পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার সাথে ভাব জমানোর জন্য তোমার কাছে পড়া বুঝতে যাই। সরাসরি আজকে বলেই দিলাম। আমি জানি তুমি মুবিন গুন্ডার বোন, তোমার মা – বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে, তোমার জীবনে নানা সমস্যা কিন্তু আমি তোমাকে বড় হয়ে বিয়ে করতে চাই। এইতো আর মাত্র কয়েক বছর। তোমার জীবনের সব সমস্যা আমি ছুমন্তর করে নাই করে দিব। দুজন একসাথে অনেক ভালো কিছু করব। উই বোউথ আর শার্প এন্ড ব্রিলিয়ান্ট। আমাদের একসাথে খুব যায়। উই উইল বি আ পার্ফেক্ট কাপল।”
লেখাটা একবার পড়েই মিলার মুখস্থ হয়ে গেল। তার মাথা ভালো। সে সাথে সাথে কাগজটা খাতা থেকে ছিঁড়ে সুন্দর করে একটা কাগজের প্লেন বানালো। তারপর সেটা হাওয়া উড়িয়ে দিলো। সে হবে পাইলট। স্বপ্ন তার ভালোবাসা, পড়াশুনা তার প্রেম। সফলতাই তার গন্তব্য। মা – বাবা একদিন সবাইকে গর্ব করে বলবে, আমার মেয়ে রোদমিলা দেশসেরা। তার পরিচয়ে পরিচিত হবে সবাই। পাইলট রোদমিলা।

এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়ে মুবিন সবাইকে ট্রিট দিলো। তার কোনো বন্ধু নেই। সুতরাং সে ট্রিট দিয়েছে মেসের সবাইকে। সবার হাতে হাতে ধরিয়ে দিলো হাজী বিরিয়ানীর প্যাকেট, ডায়নার হালিম আর ২৫০ মিলির কোকা কোলা। সবাই খুশি হয়ে জানতে চাইলো, “আরে গোল্ডেন নাকি? গোল্ডেন নাকি?”
মুবিন একগাল হেসে বলল, “না ফেইল।”
সবাই এ কথা শুনে হা হা করে হাসল৷ মুবিনের পিঠ চাপড়াল। কারণ কেউ ভাবতেই পারে না ফেইল করেও কেউ কেউ এভাবে সেলিব্রেট করতে পারে? এ পৃথিবীর কোথাও ব্যর্থতার কোন উদযাপন নেই। আসলেই নেই। মুবিনও তার ব্যর্থতাকে সেলিব্রেট করছে না। সে যে তার বাবা মায়ের নাম একটু হলেও ডোবাতে পেরেছে – এই তার আনন্দ, এই তার জয়। আজ তার ই সেলিব্রেশন!!

কেবল ইমাদ বুঝলো মুবিন সত্যি বলছে৷ সে নিজ চোখে মুবিনের রেজাল্ট না দেখলে অন্যদের মতোই ভাবতো মুবিন মজা করে এসব বলছে। কিন্তু সে মুবিনের রোল নাম্বারটা জানতো। চেক করে খুব দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু হতাশ হয়নি। ইমাদ জানে না সে সত্যিকার অর্থে ঠিক কতটা ভালো শিক্ষক, কিন্তু সে শিক্ষক তা সে জানে। তার সে শিক্ষকের চোখ তাকে বলছে, “মুবিন জিনিয়াস। ওর সহজে থামা নাই।”
ওর হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট, হালিমের বাক্স আর কোক দিয়ে চলে যাচ্ছিলো মুবিন। ইমাদ ডেকে বলল, “মুবিন, শুনে যাও।”
মুবিন চুপচাপ এসে দাঁড়ালো। এতক্ষণ হাসলেও এখন মাথা নিচু করে আছে,চোখেমুখে কষ্ট বা অনুতাপ নাই, কিন্তু আছে জেদ!!
ইমাদ শুধু বলল, “তুমি একদিন না চাইতেও হুট করে অনেক বড় কিছু হয়ে যাবে। তোমার মত জীবন সেলিব্রেট করতে পারা মানুষরাই পৃথিবী জয় করে।”
মুবিন ইমাদের কথায় ইমাদের মতো স্থির চোখে বলল, “আচ্ছা।”
তারপর শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল। তার জীবনে কিচ্ছু হতে হবে না। কেবল মা – বাবার নাম ডুবাতে পারলেই, ওদের লজ্জায় ফেলতে পারলেই সে খুশি। কচু হবে সে। স্যার বললেই হলো! সে কিছু হতেই চায় না। জীবনে কিছু করতে চায় না। সে হবে বাউন্ডুলে, টো টো কোম্পানির সিইও। ইমাদ বুঝলো মুবিন তার কথা বিশ্বাস করেনি, কিন্তু ইমাদের তার উপর বিশ্বাস আছে।
.
কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে মুবিনের রোল নাম্বারটা বসিয়ে রেজাল্ট শিট বের করে শিল্পী কষ্টে কেঁদে ফেলল। ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলো না কোনোমতেই। শেষ পর্যন্ত ফেইল করলো? কোনো চেষ্টার কমতি তো সে রাখে না। ছেলের ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠল। গালে হাত দিয়ে দোকানেই একটা টুলে অনেকক্ষণ যাবত মূর্তির মত বসে রইল সে। ছেলেটার দ্বারা কি শেষ পর্যন্ত পড়াশুনা হবেই না? মুবিনের চিন্তায় হাহাকার করা বুক নিয়েই মিলার রোল নাম্বারটা দোকানীকে দিলো সে। মিলার রেজাল্ট দেখে চমকায়নি। গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। এটা তো হওয়ারই ছিল। মিলা পড়াশুনায় খুব ভালো। তবে মার্কশীট দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। এতো এভারেস্টের সমান নম্বর! শিল্পীর দুঃখ কমলো। মেয়েটা তার খুব ভালো করছে। ফিউচার ব্রাইট। মায়ের মনটা লিলুয়া বাতাসে জুড়ালো। কিছু সময় যেতে না যেতেই জানা গেল, মিলা শুধু গোল্ডেন এ প্লাস পায়নি, পুরো কুমিল্লা বোর্ডে ফার্স্টও হয়েছে! আর সারা বাংলাদেশে তার স্থান নবম! শিল্পী খুশিতে কি করবে ভেবে পেল না। আত্মীয় – স্বজন, পাড়া – প্রতিবেশী, অফিসের কলিগ সবাইকে ফোন করে করে মেয়ের ফার্স্ট হবার কথা জানালো। পরদিন অফিসে তো মিষ্টিও নিয়ে গেল। সবাইকে মিষ্টিমুখ করালো। আর মিলাকে জড়িয়ে ধরে চুমুর পর চুমু খেল। মিলা এত আদর পেয়ে মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে রইল। মা তাকে আদর করছেন। তার ভালো লাগছে৷ খুব ভালো লাগছে। মায়ের এমন আদরের জন্য সে শত রাত জেগে পড়তে পারবে। সে যদি জানতো এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন সে এত আদর পাবে তবে আরো দু বছর আগেই দুই ক্লাস টপকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট হয়ে যেত। এই এটুকু আদরই তো সে আজীবন চেয়ে এসেছিল। মাকে সে খুব ভালোবাসে। সবচেয়ে বেশি। সবার চেয়ে বেশি।

মিলাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিল মঈনও। মিলাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শিল্পীকে বলল, “যা হয়েছে, হয়েছে। মিলার জন্য পেছনের কথা আমরা ভুলে যাই। আবার নতুন করে সব শুরু করি।”
মিলা উঠে চলে গেল। শিল্পী বলল, “মিলার দোহাই দিও না, মঈন। মিশেল তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার কাছে এখন কি চাও? দুদণ্ড শান্তি? দেবদাস হলেই তোমার কেবল আমাকে লাগে। জোহরার পর একবার তোমার চন্দ্রমুখী হয়েছি৷ আর না৷ এইবার আমি পারু৷ আমাকে তুমি দেবদাস আর কখনো পাবে না।”

চন্দ্রমুখীরাও একটা সময় পারু হতে বাধ্য হয়। দেবদাসের জন্য মায়া হলেও ফিরে আর যায় না। দেবদাস মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। বেঁচে থাকলে চন্দ্রমুখীও একটা না একটা সময় পারুর মত নিজের অধিকার চাইতো। একতরফা ভালোবাসারও সংবিধান থাকে। ভালোবাসবে, জীবন দিবে, কিন্তু বিনিময়ে সম্পর্কের মৌলিক অধিকার চাই। ভালোবাসা নিলে, অধিকার দিতে হয়।
.
লোহার গেইটটা সরালেই সামনে ছোট ছোট ঢেউয়ের কুঞ্চন, স্বচ্ছ জলরাশি। গেটের দু’ধারে কিছু গাছ। এইতো কয়েক কদম এগুলোই জলে ডুব দেয়া যায়। ওপারে ধীরেন্দ্রনাথ স্টেডিয়াম। সাথে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কুমিল্লার নাক উঁচু বিল্ডিংগুলো। জায়গাটা পৌর পার্ক আর ধমর্সাগর সংলগ্ন কুমিল্লা নজরুল ইন্সটিটিউট। ইন্সটিটিউটের পেছন দিকের এই মনোহর দৃশ্য চোখের প্রশান্তি। কড়ি আর ইমাদ নজরুল ইন্সটিটিউটের পেছনের এদিকটায় এসে কিছুক্ষণ বসেছিল। পাশাপাশি। পুরো আঙিনা জুড়ে ধাপে ধাপে টাইলস দেয়া বসার জায়গা তৈরী করা। চারিপাশে বড়, ছোট টবে সবুজের রাজত্ব। বড় বড় গাছ অভিভাবকের মতন ছায়া দিয়ে রেখেছে। তার উপর আকাশ। ইনস্টিটিউটের ভেতরে সাহিত্য অনুষ্ঠান চলছে। সেখান থেকে ভেসে এলো নজরুলের অমর সৃষ্টি,
“বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে
দিসনে আজই দোল,
আজও তার
ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি
তন্দ্রাতে বিলোল।”
ইমাদ গেটটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কড়ি দাঁড়ালো গেটে চিবুক ঠেকিয়ে। ওভাবেই সে ইমাদকে দেখছে। অনেকক্ষণ। ইমাদও তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ইমাদ তাকিয়ে থেকেই বলল, “প্রেমে পড়ে গেলেন নাকি?”
কড়ি পাল্টা প্রশ্ন করল, “কার?”
“আমার।”
“না তো।”
“আচ্ছা।”
“আপনাকে দেখছি বলে বললেন?”
“জি।”
“দেখছি কারণ আপনাকে আমি বিয়ে করব।”
“কেন?”
“অনেকগুলো কারণ।”
“শুনি?”
কড়ি হাসল, “এবার আর আচ্ছা বললেন না?”
ইমাদ নিরবে হাসলো। কড়ি বলল, “আমার জন্য আপনি আপনার এত বছরের, এত সাধনার খোদাই করা মূর্তিটা বিক্রি করতে গেছেন।”
“এজন্য বিয়ে করবেন?”
“আরো একটা কারণ আছে।”
“আপনি আপনার চোর বন্ধুকে এত ভালোবাসেন, বউকেও ভালোবাসার কথা।”
“বাসায় আপনি সব সত্যি বলে দিলেন কেন? না বললেও হতো।”
“আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।”
“আচ্ছা।”
“ভেবেছিলাম ওদের পছন্দে বিয়ে করে প্রায়শ্চিত্ত করব। তা তো আর হচ্ছে না। তাই সব বলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলাম। বিবেক বলেও তো একটা কথা থাকতে হয়।”
“আপনার সাথে আঙ্কেল এখন কথা বলেন?”
“হ্যাঁ, এখন একটু আধটু বলেন। প্রথম দিকে অনেকদিন কথাই বলেননি।”
“আর ভাইয়ারা?”
“বড় ভাইয়ার মায়া বেশি। ভাইয়া ঠিক হয়ে গেছেন। ছোট ভাইয়া এখনও খোঁচা মারে।”
“কাদিন ভাইয়া?”
“মেজো ভাইয়ার রাগ কঠিন। সময় লাগবে।”
“আমার জন্যই আপনার বিপদ হলো।”
“কি রকম?”
“আমাকে বিয়ে করবেন বলেই সবাইকে সব বলেছেন। আমি না থাকলে বলতেন না। ওদের পছন্দে বিয়ে করতেন। সব ঠিক থাকতো।”
“কিছু পেতে হলে, সবকিছু হারাবার সাহস রাখতে হয়।”
“আপনি সত্যিই আমার প্রেমে পড়েননি?”
“উঁহু।”
“তাহলে?”
“আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। প্রেমে পড়া এত সহজ নাকি?”
“কঠিন কেন?”
“অনুভূতি ক্ষত হয়ে আছে।”
“আচ্ছা।”
“আপনার মত এত ভালো একটা মানুষ আমি কোথায় পাব বলুন?”
“আমি ভালো কে বলল?”
কড়ি উত্তরটা ইচ্ছে করেই দিলো না, “দেরি হচ্ছে। আজ আসি।”
ইমাদ বলল, “এক মিনিট।”
কড়ি প্রশ্নাতুর চোখে তাকাল। ইমাদ বলল, “আপনার গয়না এনেছি।”
কড়ি বিস্মিয়ে বলল, “পাথরের খোদাই করা মূর্তি কি আরেকটা বিক্রি করলেন?”
“না আর নেই।”
“তাহলে?”
ইমাদ পকেট থেকে গয়নাটা বের করে হাত বাড়িয়ে দিলো, “আপনার জন্য কড়ির গয়না।”
কড়ি হাত বাড়িয়ে গয়নাটা ছুঁলো। তবে হাতে নিলো না। মুক্তার মালায় কড়ি বসানো। নিজের নামের কারণেই হোক কিংবা যে কারণেই হোক কড়ি তার খুব পছন্দ। সমুদ্রের ছোট ছোট সামুদ্রিক শামুকের শক্ত খোলসটাকে কড়ি বলে। অনেকটা পোর্সেলিনের মত। পোর্সেলিন শব্দটিও এসেছে ইতালিয়ান শব্দ পোর্সেলিনা থেকে। যার অর্থ কড়ি।
কড়ি মুগ্ধ হয়ে বলল, “কোথায় পেলেন?”
“মুক্তো, আর কড়ি সমুদ্র থেকে চুরি করেছি।”
“তারপর?”
“বানিয়েছি।”
“কোথা থেকে বানালেন?” ইমাদের মুঠো খোলা হাতে ছড়িয়ে থাকা কড়ির গয়নায় কড়ি নরম আঙুলে ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল। গয়না ছুঁতে ছুঁতেই আচমকা লেগে যাচ্ছে ওদের আঙুলে আঙুল। ইমাদ কড়ির আঙুল আর নিজের হাতের দিকে মনোনিবেশ করে বলল, “আমি বানিয়েছি।”
“আপনি? আপনি আর কি কি পারেন?”
ইমাদ হাসলো। কড়ি বলল, “আপনি কি ফ্রুট কার্ভিংও পারেন?”
“আপনি কীভাবে জানলেন?”
“মেজো ভাইশা ভাবির হলুদের ডালার সাজানো ফলের ডিজাইন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন।”
“আপনার বুদ্ধি ভালো।”
“ফ্রুট কার্ভিং, পাথরে মূর্তি খোদাই, গয়না বানানো, ইংরেজী কবিতা লেখা আর কি কি জানা বাকি আমার?”
ইমাদ দুষ্টু গলায় বলল, “ফ্লার্টও তো করতে জানি।”
কড়ি শব্দ করে হেসে ফেলল। ইমাদ ঘুরে কড়ির পেছন দাঁড়িয়ে গয়নাটা কড়ির গলায় পরিয়ে দিলো। কড়ি বলল, “থ্যাঙ্কস।”
ইমাদ শুনালো তার লেখা আরেকটা ইংরেজী কবিতা,
“Do you know how to dance in the rain?
How to love in the pain?
Do you know how pretty stars are?
how to love beyond fear?
I can give you the clue
From dark to blue.
Are you ready to fall in love?
Follow me,
I’ll show you how to be
I am in love with you already.
Are you ready to fall
And rise in love with me?”

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here