অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত-১
এ রহমান
আজ কি অবাক হওয়ার দিন? প্রশ্নটা মাথায় এলো চোখের সামনের দৃশ্য দেখে। শীতের সকালে গলির মোড় ঘুরতেই সেখানের দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে ঈশার চোখ কপালে উঠে গেলো। জীবনের দীর্ঘ ২২ টা বছরে এতো অবাক হয়নি সে। বাড়ি থেকে বের হয়ে একের পর এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে তার বিস্ময় চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। চৌকাঠ পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়েই দৃষ্টি যায় এক কোণায় পড়ে থাকা এক গুচ্ছ সাদা গোলাপের উপরে। এভাবে কে ফেলে রেখে যাবে সেই কৌতূহল বশতই তোড়াটা হাতে তুলে নিলো। গভীর ভাবে সেদিকে তাকাতেই চোখ জোড়ায় খেলে গেলো এক অনাবিল প্রশান্তি। ফুলগুলো সদ্য সেখানে রাখা হয়েছে। কারণ ফুলের গায়ে লেপটে থাকা শিশির ফোঁটাগুলো এখনো জ্বলজ্বল করছে মুক্তো দানার মতো। আশেপাশে তাকাল। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। কার জন্য এটা আর কে রেখেছে সেটা নিয়েই শুরু হল জল্পনা কল্পনা। আকাশ পাতাল ভাবনার শুরু হল সেখান থেকেই। ভাবনার মাঝে থেকেই আনমনে দুটো সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতেই আবারো চোখে পড়লো আরেক গুচ্ছ গোলাপ। এবার রঙটা গোলাপি। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সেটাও তুলে নিলো হাতে। এটাতেও আগের টার মতো শিশির বিন্দুগুল লেপটে আছে। কৌতূহল বশত শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করেই দাড়িয়ে গেলো। সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় কাউকে খোঁজার চেষ্টা করলো। কিন্তু কাউকেই না পেয়ে হতাশ হয়ে আর একধাপ বাড়াতেই একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে। ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল তার দিকে। হাতে হলুদ গোলাপের তোড়া। সেদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাতেই মেয়েটি অদ্ভুত হেসে তার দিকে এগিয়ে দিলো। ঈশা প্রথমে অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে মুচকে হেসে বলল
–এটা কি?
–ফুল। তোমার জন্য।
কথাটা বলেই মেয়েটি হেসে দিলো। ঈশা হাঁটু ভাঁজ করে মেয়েটির সামনে বসে পড়লো। মুচকি হেসে বলল
–কে দিয়েছে?
মেয়েটি মৃদু হেসে বলল
–ভাইয়া।
ঈশা অবাক হল। আশেপাশে তাকাল অস্থির ভাবে। বলল
–কে ভাইয়া?
–চিনি না।
মেয়েটির সহজ উত্তর শুনে ঈশা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–আমাকে চেন তুমি?
মেয়েটি অদ্ভুত ভাবে হাসল। মাথা নেড়ে বলল
–ঈশা আপু।
ঈশা আরেক দফা অবাক হল। কণ্ঠে অবাকের রেশ টেনে বলল
–আমার নাম জানলে কি করে?
–ভাইয়া বলেছে। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আমি তোমার সাথে বেশী কথা বলতে পারব না। নিষেধ আছে।
ঈশা বিস্ময়টা হজম করে ফেললো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল
–কেন নিষেধ আছে? কে নিষেধ করেছে কথা বলতে?
–ভাইয়া নিষেধ করেছে। তুমি নাকি অনেক প্রশ্ন করো। আর সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমার অনেক সময় নষ্ট হবে তাই আমি তোমার সাথে বেশী কথা বলতে পারব না। শুধু এটাই বলতে বলেছে যে এই সব ফুলগুলো তোমার।
বলেই এক দৌড় দিলো মেয়েটি। ঈশা হতবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। মস্তিস্ক সজাগ হতেই সব কয়টা ফুলের তোড়া দুই হাতে জড়িয়ে নিয়ে সামনে হাটা ধরল। মাথা ভর্তি চিন্তা তার। কিছুই বুঝতে পারছেনা। এতো বছরে কোনদিন কোন ছেলে তাকে প্রপোজ পর্যন্ত করলো না। শুধু তাই কেন ছোট বড় সব ছেলেরাই আপু বলে মুখের ফেনা তুলে ফেলে। আর এসব ফুল এখন কোন ভাইয়া তাকে দিলো। এলোমেলো চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যেতেই এলাকার পরিচিত ছেলে চলে এলো। হাতে ধরে আছে এক গুচ্ছ কমলা রঙের গোলাপ। ঈশা সেটা দেখে থমকে গেলো। উদ্ভট চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। এতো সব গোলাপ কি এই ছেলে দিয়েছে? কিভাবে সম্ভব? একই এলাকায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে পরিচিত তারা। রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখা হয়। কিন্তু কোনদিন সেভাবে কথা হয়নি। আর ছেলের তো গার্ল ফ্রেন্ড আছে। তাহলে তাকে কিভাবে গোলাপ দিতে পারে? ঈশার আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই ছেলেটি এগিয়ে আসলো। মিষ্টি হেসে বলল
–আপু এটা তোমার জন্য।
ঈশা চোখ বড় বড় করে তাকাল। হাতে গোলাপ নিয়ে মুখে আপু ডাকছে। এটা কি ছেলেদের ট্র্যাডিশন? ছেলেটি গোলাপ গুলো বাড়িয়েই আছে ঈশার দিকে। ঈশা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে একটু ঝাঁঝালো গলায় বলল
–এসব তাহলে আপনি দিয়েছেন?
ছেলেটা কিছুটা ভড়কে গেলো। মুখের হাসিটা বিলিন হয়ে বিস্ময় দেখা দিলো। পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেলো সে। তার চেহারার বিস্ময় দেখে মনে হল যেন আজগুবি কথা জীবনেও শুনেনি। ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল
–না না তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। আমি তোমাকে এসব ফুল দেইনি।
ঈশা ভ্রু কুচকে ফেলল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল
–তাহলে কে দিয়েছে?
ছেলেটি চমৎকার হেসে বলল
–ভাইয়া।
ঈশা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–ভাইয়াটা কে?
ছেলেটি মুচকি হেসে বলল
–এটা তো বলতে পারব না আমি। এটা বলা নিষেধ। ভাইয়া শুধু এই ফুলগুলো দিতে বলেছে।
ঈশা চোখমুখ শক্ত করে বলল
–ভাইয়া কে সেটা না বললে আমি ফুল নেবো না। কিছুতেই নেবো না।
ছেলেটি অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। করুন কণ্ঠে বলল
–এমন করবেন না প্লিজ আপু। ভাইয়া খুব রাগ করবে। আমি নিরুপায় আমার উপরে দয়া করুন।
ছেলেটির কথা শুনে ঈশার খুব মায়া হল। কিছু সময় ভাবল। তারপর একটু কঠিন সরে বলল
–ঠিক আছে ভাইয়া কে সেটা বলতে না পারলেও ভাইয়াকে গিয়ে আমার একটা কথা বলে দিবেন।
নিজের হাতের ফুলগুলো ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–ভাইয়াকে বলবেন নিজে এসে যেন এগুলো আমাকে দেয়। তবেই আমি এসব নেবো। এভাবে লুকিয়ে দূরে বসে থেকে ফুল দিলে আমি কোনভাবেই এসব নেবো না। যদি সাহস থাকে তাহলে আপনার ভাইয়াকে সেটা দেখাতে বলবেন সামনে এসে। আমিও দেখতে চাই কতটা সাহস।
বলেই সেখান থেকে দ্রুত চলে গেলো। ছেলেটি পেছন থেকে আপু বলে কয়েকবার ডাকলেও ঈশা শুনল না। নিজের মতো হেটেই চলল। গলির শেষ মাথায় এসে মোড় ঘুরতেই আচমকাই উপরে চোখ গেলো তার। বিস্ময়ে কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সামনের দৃশ্যটা কোনভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। মোড়ের মাথায় সারি বেঁধে গোলাপের দোকান। প্রতিটা গোলাপের দোকানের সামনে বড় বড় করে সাইন বোর্ড টাঙ্গানো। প্রতিটাতে লেখা
“আমার জীবনের প্রানবন্ত ফুল ঈশা পাখির জন্য। জানি এই গোলাপ গুচ্ছ তোমার মতো গোলাপের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। তবুও এসব গ্রহন করলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।“
ঈশা এক নজরে সব কয়টা দোকানের সামনের সাইন বোর্ড গুলোর দিকে তাকাল। একই লেখা। মাথাটা ঘুরে উঠলো তার। ঠিক সেই মুহূর্তে কানে এলো পরিচিত কণ্ঠস্বর।
–এমন প্রেমিক আমি আমার জীবদ্দশায় দেখিনি।
ঈশা কিছুটা চমকে ঘুরে তাকাল। ইফতি হা করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল
–তুই এখানে?
–তোর প্রেমলীলা দেখতে এসেছি। এলাকা জুড়ে প্রেমিকদের হাহাকার চলছে। আর এসবের জন্য দায়ী শুধু তুই।
ঈশা ভ্রু কুচকে ফেললো। বলল
–কিসব বাজে বকছিস? আমি কেন দায়ী হতে যাবো?
ইফতি এগিয়ে এসে ঈশার ঘাড়ে হাত রেখে দাঁড়ালো। সামনে তাকিয়ে বলল
–তোর এই গায়েবী প্রেমিক সারা এলাকার ফুলের দোকান কিনে ফেলেছে তোর জন্য। একটা ফুলও কাউকে দিচ্ছে না। রোজ ডে উপলক্ষে প্রেমিকাকে রোজ দেয়ার জন্য হাহাকার করে বেড়াচ্ছে এলাকার প্রেমিকরা। দূর দুরান্ত থেকে তারা ফুল সংগ্রহ করে আনছে। অথচ এলাকায় ভরি ভরি ফুলের দোকান। কিন্তু কোন প্রেমিক সেগুলো নিতে পারবে না। সবকিছু নাকি শুধুই ঈশার জন্য বরাদ্দ। কি অদ্ভুত!
ঈশা ইফতিকে আলতো হাতে মারল। বলল
–কে এই ব্যক্তি তুই চিনিস তাকে?
ইফতি মুখ দিয়ে অদ্ভুত রকমের শব্দ করলো। বলল
–চিনলে তো তাকে এতক্ষন কাঠ গড়ায় দাঁড় করাতাম। এভাবে এলাকার প্রেমিকদের সাথে অন্যায় করার অধিকার তাকে কে দিলো? জবাব দিহি করতে হবে তাকে।
ঈশা ভীষণ বিরক্ত হল। ইফতির কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে বলল
–কি অদ্ভুত ব্যাপার! এতো কিছু করলো মানুষটা অথচ কেউ বলতে পারছে না কে?
ইফতি পুরো কথাটা শুনে ঈশার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। বলল
–আচ্ছা ওটা মানুষ তো?
ঈশা ঘুরে তাকাল। খুব বিরক্ত নিয়ে বলল
–তোর মাথায় সমস্যা ইফতি।
ইফতি ভ্রু উঁচিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। বলল
–আমার কোন সমস্যা নেই। একটু ভেবে দেখ এতো কিছু করলে কেউ না কেউ তো চিনবেই। কিন্তু কেউ চিনে না। এটা কখন সম্ভব যখন একটা মানুষ মানুষই না। আত্মা, অথবা কোন জাদুকর যে গায়েব হওয়ার মন্ত্র জানে।
এমন বিদঘুটে কথা শুনে ঈশার বিরক্ত চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। রাগে তার মাথা ধরে আসছে। ইফতির দিকে তাকিয়ে বলল
–তোর মতো বলদের দ্বারাই এসব ভাবা সম্ভব। আর একটাও বাজে কথা বলবি না। একদম চুপ।
ইফতি থমকে গেলো। ঈশার কথার তেজে চুপ হয়ে গেলো। ঈশা সামনে ঘুরে তাকাল। অত্যন্ত অভিজ্ঞের ভঙ্গীতে বলল
–সবাই জানে মানুষটা কে। কিন্তু কেউ বলছে না। না বলুক। আমিও বের করেই ছাড়ব।
———-
সকাল সকাল চিৎকারের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ঈশার। ধরফরিয়ে উঠে বসল। নিজের মস্তিস্ক স্থির করতে সময় নিলো কিছুটা। চোখ মেলে রুমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখেই ঘাবড়ে গেলো। কয়েকবার পলক ফেলে বলল
–কি হয়েছে ভাবী? সকাল বেলা এমন চিৎকার করছ কেন?
রুমা দরজার কাছ থেকেই আবারো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল
–এসব কি করেছো? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?
ঈশা রুমার কথা ধরতে পারলো না। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–কি করে…।
কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই মেঝেতে চোখ পড়লো। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। চোখ ডলে আবারো ভালো করে তাকাল। সামনের দৃশ্যটা সত্যি নাকি কল্পনা সেটা ধরতেই চলে গেলো কয়েক মুহূর্ত। মস্তিস্ক সজাগ হতেই বলল
–বিশ্বাস করো ভাবী আমি এসবের কিছুই করিনি।
রুমা দ্রুত পায়ে হেটে এগিয়ে এলো। কোমরে হাত দিয়ে বলল
–এই ঘরে তুমি ছাড়া আর কেউ থাকে না ঈশা। তাই আর কারো এসব করার কথাও না। আর বাইরের কেউ বাসায় আসেনি। তাছাড়া তোমার ঘরের মেঝেতে এমন গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখবে কে বলতো?
ঈশা অসহায়ের মতো তাকাল নিচের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো সরে বলল
–আমি করিনি। বিশ্বাস করো। কে করেছে জানি না?
রুমা কঠিন গলায় বলল
–কে করেছে সেটা নিয়ে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আপাতত এগুলো তোলার ব্যবস্থা করো। মা দেখলে কিন্তু সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে যাবে। প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মাথা ঘুরে যাবে। বুঝতে পারছ তো।
ঈশা ভয়ে ঢোক গিলে ফেললো। সত্যিই তার মা দেখে ফেললে প্রশ্ন করে মেরে ফেলবে আর সেসবের উত্তর ঈশা দিতে পারবে না। কারণ সে তো নিজেই কিছুই জানে না। ঈশা বিছানা থেকে নেমে বাইরে থেকে ঝাড়ু হাতে নিয়ে আসলো। পুরো ঘর পরিস্কার করতে অনেক সময় লেগে গেলো। হাপিয়ে উঠে ওয়াশ রুমের দিকে চলে গেলো। ওয়াশ রুমে ঢুকতেই প্রথমে চোখ পড়লো আয়নায়। একটা হলুদ কাগজে ছোট্ট করে কিছু একটা লেখা। কাগজটা হাতে নিলো কৌতূহল বশত। সেখানে লেখা আছে।
“হ্যাপি রোজ ডে জান। সাহস দেখতে চেয়েছিলে না? দেখালাম। সাহসটা আমার বরাবর বেশী। তাই তো একবারেই ঘরে এসে সমস্ত গোলাপের পাপড়ি আমার জিবন্ত গোলাপের পদতলে বিছিয়ে দিলাম। সামনে এসে সাহস প্রমান করতে বলেছিলে। সামনে এসেছিলাম ঠিকই কিন্তু এভাবে আসার জন্য দুঃখিত। এখনই তোমার কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করতে পারছি না। সময় মতো ঠিকই করবো। একটু অপেক্ষা করতে হবে। সেদিন তোমার সব উত্তর দেবো। আগামীকাল প্রপোজ ডে। তাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে বড় সারপ্রাইজ! দিনভর সারপ্রাইজ পেতেই থাকবে তুমি। নিজেকে প্রস্তুত করে নাও জান।“
চলবে……