প্রার্থনায়_তুমি #পর্ব-০৫

#প্রার্থনায়_তুমি
#পর্ব-০৫
#Tahmina_Akther

৫.

সন্ধ্যা হয়ে এলো কিন্তু মামনির জ্ঞান এখনো ফিরে আসেনি। আয়মান সেই যে মামনির পায়ের কাছে বসেছে এখন অব্দি তাকে এক ইঞ্চি নড়াতে পারিনি আমি। তার একটাই কথা যখনি মামনির জ্ঞান ফিরে আসবে তখনই সে এখান থেকে উঠবে তার আগে নয়। উনার কাছ থেকে এমন কথা শোনার পর আমি আর জোর করিনি।

আশেপাশের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের সুর ভেসে আসছে।আমি উঠে চলে গেলাম আমার ঘরে।ওয়াশরুম থেকে ওযু করে নামাজের ঘরে গিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। নামাজ আদায় করার পর আবারও মামনির ঘরে চলে গেলাম।

ঘরে ঢুকতেই দেখি মামনির জ্ঞান ফিরে এসেছে।আয়মান, তো মামনিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি ছোট বাচ্চা এবং ওনার মা’কে দীর্ঘসময় পর নিজের কাছে পেয়েছেন।

আমি মামনিকে ডাক দিতেই আয়মান এবং মামনি দুজনেই আমার দিকে তাকালো। মামনি মুচকি হেঁসে আমাকে উনার কাছে ডাকলেন। আমি হেঁটে গিয়ে খাটের কিনারায় মামনির পাশে বসে পরেছি।মামনি, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আমাদের দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

-আয়মান এবং অরুণিমা তোদের দুজনের সাথে আমার কিছু কথা আছে। আশা করি তোরা দুজনেই আমার আদেশ এবং আমার কথার মন
রাখবি ।

আয়মান এবং অরুণিমা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আবার মামনির দিকে তাকালো। কি এমন আদেশ করবে মামনি যা ওদের দু’জনকে মানতে হবে?

অরুণিমা ও আয়মান দু’জন একসাথেই মামনিকে বললো,

-বলো তুমি কি বলবে?তোমার সব কথা বিনাবাক্য আমরা দুজনেই মেনে নিব।

– আমি হয়তো বেশিদিন বাঁচব না রে।তখন,তোদের দুজনকে কে সামলাবে?

-মা, তুমি কিন্তু এবার বেশ বাড়াবাড়ি করছো। কে বলেছে তোমাকে তুমি বেশিদিন বাঁচবে না?

কথাগুলো বেশ রেগেই বলল আয়মান। আর, আমি মামনির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি সত্যিই কি এই মমতাময়ী মা আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন? এই কথাটি ভাবতে গিয়ে আমার চোখদুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে এলো।

– আমার পুরো কথা শেষ হলেই তোরা তোদের কথা বলিস তার আগে নয়? তোরা দুজনেই কিন্তু বলেছিস আমার আদেশ তোরা মেনে নিবি?শোন,
আয়মান তোর বাবা নেই আজ ১০বছর। হয়তো আমিও মরে যেতে পারি। তখন এই দুনিয়ায় তোর আপন বলতে কেউ থাকবে না বাবা। আর, আরু তোকে তোর মামনি বড্ড ভালোবাসেরে। তাই,আমি জীবিত থাকতে তোদের একটা ব্যবস্থা করতে চাই। আশা করি তোরা আমার সিদ্ধান্তকে স্ব-সম্মানে গ্রহন করবি ?

– তুমি ঠিক কি করতে চাইছো মামনি?কথাটি বলেই অরুণিমা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রোকেয়া মির্জার দিকে।

– আরু, তোকে আমি আমার আয়মানের স্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই।

-তোমার এই সিদ্ধান্ত আমি কখনো মানবো না মা। তুমি ঠিক কি বলছো তুমি বুঝতে পারছো তো? তাছাড়া,অরুণিমা?ওর পছন্দ অপছন্দ জিজ্ঞেস না করে তুুমি কি করে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে গেলে?ঠান্ডা মেজাজে কথাগুলো বলল আয়মান।

অরুণিমা, সে তো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কি বলছে এইসব মামনি? মামনি তো এমন ছেলেমানুষী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মানুষ না। উনার উপস্থিত বুদ্ধি সম্পর্কে অরুণিমা খুব ভালো করে রপ্ত করেছে এই কয়মাসে ।

– আমি, মামনির সাথে একা কথা বলতে চাই। আপনি একটু বাইরে যাবেন।আয়মান কে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল অরুণিমা।

আয়মান ওর মায়ের দিকে তাকালো, ওর মা ওকে চোখের ইশারায় রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলল।আয়মান চুপ করে ঘর ছেড়ে বাইরে চলে গেল।

অরুনিমা ওর মামনির সামনাসামনি বসে উনার দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

– কি হয়েছে, তোমার? আমাকে বলা যায় না,মামনি?তুমি না তোমার সব সিক্রেট আমাকে বলো। তাহলে, আজ কেন লুকাচ্ছো?

– আমি বোধহয় মরে যাব তাই তোদের দুটো এতিমকে এক করতে চাইছি?আমি কখনো কি তোদের খারাপ চাইব বল?আমার এই শেষ অনুরোধটি তোরা রাখ। আমি মরে গেলেও শান্তি পাবো।

খেয়াল করে দেখি মামনির কথাগুলো বলতে কষ্ট হচ্ছে।ঠিক তখনি আমার ডাক্তারের বলা কথাগুলো মনে পরে গেলো, ডাক্তার তো বলেছিল মামনি কোনো কারণে প্রচুর চিন্তায় ছিলেন তাই তো তিনি হুট করে অসুস্থ হয়ে পরেছেন।

-তার আগে তুমি এটা বলো কিসের চিন্তা করছো তুমি? গতকাল, ও তো অনেক হাসিখুশি ছিলে তোমার ছেলে আসবে বলে। আর আজই কেন এভাবে শয্যাশায়ী হয়ে পরলে। আমাকে সত্যি কথা বলো মামণি? কঠোর কন্ঠে কথাগুলো বললো অরুণিমা।

– আসলে, আয়মান তোকে ভালোবাসেরে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। তুই নাকি সুস্থ হলে তোর বর্তমান সবকিছু ভুলে যাবি।আয়মান তোর প্রতি ওর মনের ভালোলাগাকে মনের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে। জানিস আজ সকালেও আয়মান, আমার সাথে তোর জন্য ওর মনের অনুভূতিগুলো বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল, আমার বাচ্চাটা। জানিস ও একটু চাপা স্বভাবের ওর কি প্রয়োজন ও কখনো চেয়ে নেয়ে না। তোকে ও ভালোবেসে দিনরাত গুমরে মরছে। কিন্তু, না নিজে তোকে বলছে না আমাকে বলতে দিচ্ছে।
তাই, আমি চাই তোরা দু’জন এক হয়ে যা। তোর কাছে তোর মামণির এই শেষ চাওয়া।

কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললো মামণি। আমি কি বলব সেই ভাষা আমি ভেবে পাচ্ছি না। আর, মামনির কথা কি বলব উনি তো সন্তানের দুঃখে নিজেই অসুস্থ হয়ে পরেছেন। আর, আয়মান সাহেব সে তো আরেকজন মহান মানুষ তাকে আর কি বা বলা যায়?

– মামনি আমি তোমার আদেশ মেনে নিতে রাজি। তোমার খুশি মানে আমার খুশি। তুমি যদি আমার প্রাণটা চাইতে তাও তোমাকে হেসে দিয়ে দিতাম।

অরুণিমা কোনোকিছু না ভেবে হাসিমুখে সম্মতি জানিয়ে দিলো।রোকেয়া মির্জা অরুণিমার কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন। সেই খুশিতে আমাকক বললেন, আয়মানকে ডেকে নিয়ে আসতে।

আমি তাকে ডাক না দিয়ে মোবাইলে কল দিলাম দুই মিনিট পর উনি রুমে এসে হাজির হলো। এসেই আবারও মামনির পাশ ঘেঁষে বসে পরলেন। মা ছেলের এত টান দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছি আমি।

মামনি আয়মানের চুলে হাত বুলিয়ে বলছে,

-আব্বু,অরুণিমা তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।

আয়মানের মনে হচ্ছে ও যে কথাটা শুনেছে সবটা ভুল শুনেছে।তাই আবারও ওর মা’কে জিজ্ঞেস করলো,

– কি বললে মা, বুঝতে পারিনি?

– অরুনিমা তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।আশা করি,এই বিয়ে করতে এখ৷ তোর কোনো সমস্যা থাকবে না?

আয়মান ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না তবে এতটুকু বুঝতে পারছে,ওর এই আদরের মা ছেলের সুখের জন্য সব কিছু করতে পারবেন।

অবশেষে,সেই রাতে আয়মানের সঙ্গে বিয়ে হয় অরুণিমার।

*****************

নিশু হকিষ্টিক হাতে নিয়ে হাঁপাচ্ছে আর অংকন সে তো রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে ড্রইংরুমের কার্পেটের উপরে।

নিশু হকিস্টিক ছুঁড়ে ফেলে দিলো এককোনায় এরপর হেঁটে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে খেয়ে নিলো।পানি পান শেষ করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল করলো মায়ার চাচীর নাম্বারে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলে এপাশ থেকে নিশু বললো,

– আমাদের বাড়িতে এসে আপনার কুলাঙ্গার ছেলেটাকে নিয়ে হসপিটালে যান।

বলেই কল কেটে দিলো নিশু।এরপর, হাঁটতে হাঁটতে একটি রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।দরজার ওপাড় থেকে বারবার অনুরোধ করছে দরজা খোলার জন্য। নিশু রুমের দরজা লক খুলে দিলো। দরজা খুলে রুম থেকে বের হয়ে এলো নিশুর বাবা-মা।

উনারা বাইরে বের হতেই দেখতে পেলো অংকনের রক্তাক্ত দেহ। নিশুর মা দৌঁড়ে গেলো অংকনের কাছে। অংকনকে এমন অবস্থায় দেখে নিশর মা নিশুকে উদ্দেশ্যে করে বলল,

– তুই একেবারেই জানোয়ার হয়ে গিয়েছিস? কি এমন অপরাধ করেছে ছেলেটা যার জন্য এভাবে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছিস? এ্যাম্বুলেন্স খবর দে নয়তো এই ছেলে মরে গেলে তোকে থানায় নিয়ে যাবে। কি হলো কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
ও এখন তোর জীবনে আমাদের কোনো কথার মূল্য নেই। মায়ার মতো একটি মেয়ের জন্য তুই আজ দুনিয়া ভুলে যাচ্ছিস?আর এই ছেলে অংকন কি এমন অপরাধ করেছে যে আমাদের রুমে লক করে ওকে এখানে এভাবে মেরে রক্তাক্ত করেছিস?

– মা,সবকিছুর উত্তর পাবে তবে ওর বাবা-মা আসার পর।

হতদন্ত হয়ে নিশুদের বাড়িতে প্রবেশ করলো মায়ার চাচা চাচী।ভেতরে ঢুকতেই নিজের ছেলের রক্তাক্ত শরীর দেখে আর্তনাদ করে উঠলো মায়ার চাচী। দৌঁড়ে ছেলের কাছে যেতে চাইলে বাঁধা দেয় নিশু। অংকন শুধুমাত্র তাকিয়ে আছে ওর মা এবং নিশুর দিকে কিছু বলার শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই ওর মাঝে।

নিশু বাঁধা দেয়াতে অংকনের মা এবার চটে যায়। রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো,

-তোমাদের বাড়িতে কোনো মেহমান এলে তাদেরও কি এভাবে মেরে রক্তাক্ত করো তোমরা?অংকন কি এমন করেছে যে এভাবে মেরে ওর এই হাল করেছো?

– চাচী, আপনি আমার গুরুজন। আপনার ছেলের করা পাপের জন্য আমি আপনাকে কিছু বলতে চাচ্ছি না।

নিশু এবার মায়ার চাচা এবং ওর বাবা-মায়ের দিকে ফিরে বললো,

– অংকন এখানে এসেছে আমাকে কিছু দেখাবার জন্য। আমি ওসব দেখার পর সহ্য করতে না পেরে ওকে ওর প্রাপ্য শাস্তি দিয়েছি। এখন, তোমরা দেখো তারপর বলো, আমি ওকে মেরে কোনো ভুল করেছি কি না?

নিশু অংকনের নিয়ে আসা ল্যাপটপ ওপেন করে একটি ভিডিও ফুটেজ অন করলো।
সেই ফুটেজে দেখা যাচ্ছে একটি কার দ্রুত গতিতে এসে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। সেই গাড়ি থেকে কিছু সময় পর একটি ছেলে নেমে আসে। সবাই সেই ছেলের চেহারার দিকে লক্ষ করে তাকাতেই বুঝতে পারে ফুটেজের ছেলেটি আসলে অংকন। অংকন সেই গাড়ি থেকে আহত অবস্থায় বের হয় এবং দৌঁড়ে রাস্তার উল্টো পথে চলে যায়। সেই ভিডিও ফুটেজে আর কোথায় অংকনকে দেখা যায়নি।

– আমার ছেলের এক্সিডেন্ট হয়েছে। এখানে ওর কোনো ভুল আছে আমি তো দেখতে পাচ্ছি না?
নিশু, তুমি একজন মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হও। মায়া আমাদের থেকে দূরে যাওয়ার পর থেকে তুমি পাগল হয়ে গেছো। বিদ্রুপের সুরে কথাগুলো বলে অংকনের মা।

– চাচী, ফুটেজ এখনো শেষ হয়নি আগে পুরোটা দেখুন। তারপর, না-হয় আপনার থেকে ঠিকানা নিয়ে আমি মানসিক ডাক্তারের কাছে যাবো।

ফুটেজ ঠিক ৪০মিনিট এগিয়ে দিলো নিশু। এবার ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সেই এক্সিডেন্ট করা গাড়ির সামনে অন্য একটি গাড়ি এসে থেমেছে। সেই গাড়ি থেকে একজন মহিলা নেমে মায়াদের গাড়ির কাছে যেয়ে গাড়ির ডোর খুলতেই একটি মেয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো।

ব্যস ঠিক এতটুকুতে এসে নিশু ভিডিও স্টপ করে মেয়েটির চেহারায় জুম করলো। আর এতেই সবাই পরিষ্কার দেখতে পেলো মায়ার আদলখাণি।
এবার সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। এ কাকে দেখছে সবাই?নিশু আবারও ভিডিও প্লে করে দেয়। দেখা যাচ্ছে সেই মহিলা এবং একজন পুরুষ মিলে মায়াকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে উনাদের গাড়িতে করে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এতটুকুতে ভিডিও শেষ।

এবার অংকনের মা অংকনের কাছে গিয়ে ওর গালে সপাটে দুটো থাপ্পড় মেরে দিলো।ওর কলার চেপে ধরে উপরে তুলে বললো,

– মায়া, যেদিন নিখোঁজ হয় তুই সেদিন বলেছিস তুই রিকশা থেকে পড়ে তোর মাথা ফেটে গিয়েছে। কিন্তু, এখন দেখতে পাচ্ছি তুই গাড়ি এক্সিডেন্ট করে নিজে বের হয়ে এলি কিন্তু মায়াকে বের করিস নি? কি এমন অপরাধে ওকে তুই মৃত্যুমুখে ফেলে চলে এসেছিলি, বল উত্তর দে?

– মা, আমার থেকে তো তোমার ভালো করে জানার কথা। ছেলের মুখ থেকে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অংকনের মা।

অংকন ধীরে ধীরে উঠে বসে এরপর নিশুকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করে,

– আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি ঠিক তখন থেকে আমি মায়াকে পছন্দ করি। যখন ও বিয়ের উপযুক্ত হলো তখন মা’কে একবার বলেছিলাম আমি মায়াকে বিয়ে করতে চাই। তখন মা কি বলেছিল জানেন? বলেছে এমন এতিম মেয়েকে বিয়ে করলে তুই শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছুই পাবি না। তোকে আমি বড়লোক ঘরের মেয়ে এনে দিব। আর, এই কথা যেন তোর বাবা কোনোদিনও না জানে।আজকের পর থেকে এই কথা কোনোদিনও তোর মুখে আনবি না।মায়ের কথায় চুপ হয়ে গেলাম আর কোনদিন কখনো এই কথা মায়ের সামনে তুলিনি।
আমার মা শুধু টাকাপয়সা, স্ট্যাটাস এগুলোকে সুখ মনে করে। একটিবারও ভাবেনি আমি কি চাই? এর কিছুদিন পর আপনার সাথে মায়ার আংটিবদলের কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। তাই প্ল্যান বানিয়েছিলাম মায়াকে ওর ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় কিডন্যাপ করব।এরপর, ওকে নিয়ে চলে যাব কক্সবাজার। সেখানে গিয়ে বিয়ে করবো আমরা দু’জন। প্ল্যান অনু্যায়ী ওকে কিডন্যাপ করে রওনা হই কক্সবাজারের উদ্দেশ্য। কিন্তু, মায়া বারবার চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে যেতে চাচ্ছিল আর ওকে থামাতে গিয়েই গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা লাগে।
আমার তেমন কিছুই হয়নি কিন্তু মায়ার অনেক জখম হয়, ওর সারা শরীর রক্তে ভিজে গিয়েছিল। আমিও ভয় পেয়ে যাই যদি ও মরে টরে যায় তখন তো আমাকে জেলে যেতে হবে। তাই ওকে রেখেই আমি চলে আসি।

এতটুকু বলা শেষ হতেই অংকনের গালে আরেকটি থাপ্পড় পড়ে। অংকন চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে ওর বাবা।

– তুই যেহেতু ওকে পছন্দই করতি তাহলে ওকে এভাবে ফেলে এসেছিস কিভাবে? তুই তো বলছিস ওর পুরো শরীর রক্তে ভিজে গেছে। সেই মহিলা তো মায়াকে ৪০ মিনিট পর উদ্ধার করেছে। আমার মায়া বেঁচে আছে কি না মরে গেছে কে জানে? হে আল্লাহ তুমি কেন আমায় এই কুলাঙ্গার সন্তানের পিতা বানালে? বলেই হু হু করে কাঁদছে অংকনের বাবা।

নিশুর কানে শুধু একটি কথাই বাজছে মায়া বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে।
নিশু এবার সহ্য করতে না পেরে ওর মাথা চেপে ধরে কেঁদে উঠলো। নিশুর চোখের পানি দেখে ওর বাবা মা দু’জনেই ছলছল নয়নে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাদেরই বা কি করার আছে?

নিশুর মা গিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন। কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই নিশু মাথা উচু করে তাকিয়ে দেখলো ওর মা ওর পাশে বসে আছে।মা’কে দেখতেই নিশু কান্নারত সুরে বলছে,

– মায়া, বেঁচে আছে না মা, বলো?ও মরতে পারে না।

– না, বাবা তুই শুধু শুধু ভাবছিস মায়া হয়তো সুস্থ আছে ভালো আছে, তুই চিন্তা করিস না। আমরা তো মায়াকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ চাইলে একদিন ওকে খুঁজে পাবো।

নিশু এবার চোখের পানি মুছে অংকনকে বলল,

– তাহলে, তুমি এতদিন কেন এই কথা গোপন রাখলে ? আর আজ হঠাৎ আমাকেই কেন বলতে এলে?আর এই ফুটেজ তুমি কিভাবে পেলে?

-চোখ বন্ধ করলে মায়ার সেই রক্ত মাখা চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতো। তখন নিজেকে নিজের কাছে পশু মনে হতো। আমি যদি সেদিন ওকে না ফেলে এসে হসপিটালে নিয়ে যেতাম হয়তো মায়া সুস্থ থাকতো আমাদের সবার মাঝে থাকতো। আপনাকে দেখলেই আমার অপরাধবোধ যেন শতগুণ বেড়ে যেত।
তাই যেখানে অর্থ্যাৎ মিরসরাই আমরা এক্সিডেন্ট করি সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি। সেই হাইওয়ে রাস্তা সিসিটিভির অন্তর্ভুক্ত। সেখানে কিছু টাকা দিয়ে এই ভিডিও ফুটেজটি নিয়ে আসি আপনাকে দেখানোর জন্য। বিশ্বাস করুন নিশু ভাই আমার আর কোনো আফসোস নেই। এখন, আপনি আমাকে পুলিশের কাছে দিতে চাইলে দিতে পারেন।

– তোমাকে পুলিশের কাছে দিলে আমি আমার মায়াকে ফিরে পাব না । শুধুমাত্র, আরও একবার আমার উপকার করো তুমি। যেই গাড়িটি দিয়ে মায়াকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই গাড়ির নাম্বারপ্লেট দিয়ে গাড়ির মালিক কে?এতটুকু তথ্য জোগাড় করো অংকন।
চাচী, অংকনকে হসপিটালে যান। মা আমাকে একটু ধরে আমার রুমে দিয়ে এসো আমার, ভালো লাগছে না। মলিন কন্ঠে কথাগুলো বলল নিশু।

নিশু এবারও আরও একটি রাত ভালোবাসার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়ে হারানোর বেদনায় কেঁদে কাটিয়ে দিল।

মায়া, সে কি আদৌ বেঁচে আছে? নাকি হারিয়ে গেছে এই পৃথিবী থেকে?
যদি বেঁচে থাকে তাহলে কোনদিন জানতেও পারবে না তার জন্য কেউ একজন খুব করে কাঁদে তাকে পাবার আশায়।

কাক ডাকা ভোর; নতুন দিনের, নতুন আশা। হয়তো কারো সুখের নতুন আরও একটি দিন। আর কারো দুঃখের আরও একটি কালো দিন।
নতুন কারো জীবনের সূচনা নয়তো কারো এই পৃথিবীর জীবনের পরিসমাপ্তি।

কারো লাশ নিয়ে যাচ্ছে খাটিয়া করে উদ্দেশ্য চিরকালের ঠিকানা কবরস্থান।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here