কিছু_মেঘ_কিছু_বৃষ্টি,পর্ব-০২
লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ
—-হায় আল্লাহ,,এটা কি দেখছি আমি……
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি প্রশংসা তিন মাসের প্রেগন্যন্ট…..তার মানে আমার সন্তান বড়ো হচ্ছিল ওর গর্ভে।সেই আমি কিনা নিজের হাতে……লেখাগুলো পড়ে হাত থেকে ফাইলটা পড়ে গেলো আমার….ধপাস করে সোফার ওপরে বসে পড়লাম…..
—নাহ!এটা হতে পারে না কিছুতেই,নিজের অজান্তে কতো বড়ো পাপ করে ফেললাম আমি। প্রশংসা খুন হয়েছে আমার হাতে…ওর গর্ভে থাকা আমার সন্তানকে আমি এই নিজের হাতে খুন করেছি।এতো বড়ো ভুল কিকরে হলো আমার দ্বারা।কেন এই মেডিকেল রিপোর্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম না।এটা আরেকটু আগে আসলে হয়তো এতো বড়ো অঘটন ঘটতো না কিছুতেই।
এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলি,আর যাই হোক এই অপদার্থতার কোনো ক্ষমা হয় না।হয়তো সারাটা জীবন এই অনুশোচনা কুড়িয়ে কুড়িয়ে মারবে আমায়,আমি জানি না নিজেকে এই হাতাশা থেকে কিকরে মুক্তি দেবো।
টিভি সেটটা অন করা ছিলো আগেই….হঠাৎ একটা নিউজ চোখজোড়া আটকে দিলো আমার।নিজের মনের চিন্তাকে একপাশে রেখে টিভি নিউজের দিকে মনোনিবেশ করি।
একটা মহিলার লাশ পাহাড়ের রাস্তার খাঁদে খুঁজে পাওয়া গেছে।সেখানে বেশ কিছু মানুষের ভিড় জমে আছে।তবে এতো উপর থেকে পড়ার কারণে লাশের এতটাই বাজে অবস্থা হয়েছে, তার চেহারা শনাক্ত করা যাচ্ছে না।যখন লাশের চেহারা একঝলক দেখানো হয় সত্যি বলতে আমার নিজেরো চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল।তবে আমি খুব ভালো করেই জানি,ওটা আর কেউ নয় আমার স্ত্রী প্রশংসা।কারণ গতকাল রাতে ওকে আমি নিজের হাতে খুন করে খাঁদ থেকে ফেলে দিয়েছিলাম!!একটু পরে পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায় পোস্টমর্টেমের জন্য….
কেন জানি ভীষণ ভয় লাগতে শুরু করলো আমার।জানি না কেন এমনটা হচ্ছে…হয়তো ধরা পড়ে যাবার ভয়।পুলিশ যদি কোনোভাবে আমাকে ধরে ফেলে তখন কি হবে সেই চিন্তা অস্থির করে দিচ্ছে আমায়।কিন্তু আমিও মনে মনে একটা সিধান্ত নিয়ে ফেললাম,ঐ লাশ যতোই প্রশংসার হোক না কেন,আমি মুখ খুলবো না কিছুতেই।পুলিশের পক্ষেও আর লাশের আসল পরিচয় জানা সম্ভব হবে না।প্রশংসার বাবা- মা কেউ আর এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই।যে ওর খোঁজ করবে,বা আইডিনটিফাই করার জন্য যাবে।তাই সেই দিক থেকে আমি অনেকটা নিরাপদ।আমি খুব ভালো করেই জানি আমি ঠিক থাকলে কেউ ধরতে পারবে না আমায়।
এরপর কিছু দিন অতিবাহিত হয়ে যায়…..আস্তে আস্তে পরিবেশ ঠান্ডা হতে থাকে।আমি এবং আমার পরিবার ঠিক এই সময়ের অপেক্ষাই করছিলাম।অবশ্য প্রশংসাকে খুন করেছি এটা আমি ছাড়া কেউ জানে না,তাদের সবাইকে বুঝিয়েছে প্রশংসা সব মেনে নিয়ে ডিভোর্স দিয়েছে আমাকে।তারপর অন্য কোথাও চলে গিয়েছে।আর বাচ্চার কথাও নিজের পরিবারকে জানাই নি।
বিকেলবেলা ড্রয়িং রুমে বসে আছি ঠিক তখন আমার গ্রামের বাড়ি থেকে মায়ের ফোনকল আসে….
—-কিরে,কেমন আছিস বাবা….??
—এইতো আছি মোটামুটি,তোমরা কেমন আছো?
—আমরাও ভালো আছি,শোন একটা ভালো খবর আছে।
—খবর,কিসের খবর!!(অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম)
—তোর জন্য একটা ভালো মেয়ে পেয়েছি…. এখন তুই যদি চাস…..
—কি বললে মেয়ে দেখেছো?মা আমি তোমাদের বলেছি আমার জন্য মেয়ে দেখতে?(বিরক্ত হয়ে)
—আরে দেখি নি, একটা ভালো মেয়ের খবর পেয়েছি।তুই একটু দেখি আসতে পারবি না। তাছাড়া এখন ঐ আপদটা তো নেই আর… তাহলে সমস্যা কোথায়,
—এখন বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না আমার মা, আমি আগে নিজেকে প্রস্তুত করে নেই তারপর।তাছাড়া আমাদের ভিভোর্সের তিনমাস এখনো হয় নি।
—এখন তোকে বিয়েটা করতে কে বলছে।তুই শুধু দেখে আয় মেয়েটা।যদি পছন্দ হয় তো ভালো,না হলে জোর করবো না।এর আগে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে কি সর্বনাশ করেছিস সেটা কি ভুলে গেলি….
—তোমরা থামবে….এই কথা বার বার শুনতে ভালো লাগে না আমার।
—তাহলে মেয়েটাকে দেখতে যাচ্ছিস কিন্তু….
—হ্যাঁ,যাবো।তোমাদের যা ইচ্ছে তাই হবে….
এই বলে মায়ের কোনো কথার অপেক্ষা না করেই ফোনটা কেটে দিলাম।অথচ এরাই কিছুদিন আগে ঠিকভাবে কথা বলতো না আমার সাথে,এখন প্রশংসাকে ছেড়ে দেবার খবর শুনে আমার ওপরের সমস্ত রাগ মাটি হয়ে গিয়েছে তাদের।ভালোই বুঝতে পেরেছি সবাই আমার জন্য মেয়ে দেখতে উঠে পড় লেগেছে!যদিও এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না আমার।মাথা থেকে সেই অনুশোচনার ভারটা এখনো সরাতে পারি নি,আর একটা দিন অপেক্ষা করলে হয়তো আজকের এই দিনটা দেখতে হতো না।যাই হোক,এই ঘটনা যতো তাড়াতাড়ি ভুলতে পারি ততোই মঙ্গল আমার জন্য।এর জন্য যদি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়েটা করতে হয় তাও করতে রাজি আমি।নিজেকে মানসিক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দেবার হয়তো এটাই একমাত্র উপায় আমার জন্য।
–
–
–
এর দুই দিন পরে…..
মেয়েটার বাসার উদ্দেশ্যে অনুসারে রওয়ানা দিলাম।আপাতত আমি একাই যাচ্ছি…সেরকমই কথা হয়েছে।এরপর যদি মেয়ে পছন্দ হয় তখন না হয় আরেকবার সপরিবারে আসা যাবে…
অবশেষে নিজের গন্তব্যে পৌঁছেও গেলাম।এই জায়গায় আমি আগে আসিনি কখনো।এটাই প্রথম।মেয়েটার বাড়িটা বেশ ছোট।তার ভেতরে ছোট একটা বসার ঘর।আমাকে সেখানেই বসতে দেয়া হলো।কিছু জলখাবারের ব্যবস্থাও করা হলো আমার জন্য।আমি শুধু বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছি কখন মেয়েকে নিয়ে আসা হবে, আর তাকে দেখে এখান থেকে ভালোয় ভালোয় বিদেয় হতে পারবো।
একটু পরে আমার সমস্ত প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে মেয়েকে নিয়ে আসা হলো।তারপর আমার সামনে বসানো হয়!আমি জলের গ্লাসটা মুখে নিতে নিতে মেয়েটার দিকে তাকাতে লাগলাম….তাকে দেখা মাত্রই এক অদ্ভুত কম্পনে চমকে উঠলাম আমি।হাত থেকে কাচের গ্লাসটা মেঝেতে পড়ে খানখান হয়ে গেলো….
—-এটা চোখের সামনে কাকে দেখছি আমি।একে দেখতে তো হুবহু প্রশংসার মতো… কিন্তু ও এখানে এলো কিকরে…. ??😱
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো,সেটা আমাকে আরো হতবাক করে দিলো… কারণ এমন হাসি আমি শুধু একটা মানুষকেই দিতে দেখেছি আর সে হলো আমার মৃত স্ত্রী প্রশংসা…..
চলবে…..