কিছু_মেঘ_কিছু_বৃষ্টি,পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

কিছু_মেঘ_কিছু_বৃষ্টি,পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

শাফিন ভাই ফোনটা বের করে আমার সামনে ধরলেন।মেয়েটার ছবি দেখে চোখ জোড়া বিষ্ময়ে ক্রমশ বড়ে হয়ে যেতে লাগলো আমার। কি আশ্চর্য….এটা তো সে নয় যার সাথে বিয়ে হয়েছে আমার।তাহলে প্রশংসার মতো দেখতে আমার বর্তমান স্ত্রী যে,সে কি আসল প্রকৃতি নয়…যদি তাই হবে সে নিজেকে প্রকৃতি হিসেবে পরিচয় দিলো কেন,আর আমি প্রকৃতির বাড়িতে যেতে গিয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হলাম কিকরে…..???

—- আচ্ছা আপনি আমার মাকে সঠিক ঠিকানা দিয়েছিলেন তো,

—হ্যাঁ আমি ঠিক ঠিকানাই দিয়েছিলাম,কিন্তু তোমরা সেখানে যাওই নি!

—দেখুন শাফিন ভাই আমার মনে হয় আমাদের কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে,

—-ভুল বোঝাবুঝি,,??কিসের ভুল বোঝাবুঝি!!

না এই মুহূর্তে শাফিন ভাইকে কিছু বলাটা ঠিক হবে না,তাই আমি তার থেকে সম্পূর্ণ বিষয়টা এড়িয়ে গেলাম।

—আচ্ছা ঠিক আছে এ বিষয়ে আমরা বরং পরে কথা বলব।

—-তুমি যে বললে যে তুমি বিয়ে করেছ,এই বিষয়টা বুঝলাম না ঠিক।

—-বললাম তো আপনার সাথে আমি পরে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলব,

শাফিন ভাই হয়তো বুঝতে পেরে গেছে আমি কোন কিছু লুকোতে চাইছে তার থেকে।সে আর কথা বাড়ালো না।যাই হোক মনে একরাশ দুশ্চিন্তা আর হতাশা নিয়ে শাফিন ভাইকে বিদায় জানালাম,তারপর বাসার ভেতরে ঢুকি….

চারদিকে নিস্তব্ধতা,কোথাও কোনো সারা শব্দ নেই।আমি প্রকৃতিকে ওর নাম ধরে ডাকতে লাগলাম।দীর্ঘক্ষন থাকার পরেও প্রকৃতি কোন উত্তর দিল না।এবার আমি সত্যিই বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই,ওতো কখনো বাসা থেকে একা বেরোয় না,বেরোলেও আমাকে সাথে নিয়ে যায়।বাসার ভেতরটা আবারো ভালো করে চেক করলাম কিন্তু প্রকৃতিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা….আমার দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়তে লাগলো।আচ্ছা কোথাও এমনটা নয় তো ও বুঝতে পেরে গেছে যে আমি ওর আসল পরিচয় জেনে গেছি,তাই হয়তো গা ঢাকা দিয়েছে আমার ভয়ে।কিন্তু সেটাও বা কি করে সম্ভব? এইমাত্র শাফিন ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে আমার,এইটুকু সময়ের ভেতরে কারোর পালিয়ে যাওয়া টা একেবারেই অসম্ভব!হঠাৎ একটা শব্দ আমার কানে ভেসে আসলো আর সেটা ছিলো কোন বাচ্চার কান্না আওয়াজ!কিন্তু শব্দটা ঠিক কোথা থেকে আসছিল বুঝতে পারছিলাম না।একপর্যায়ে শব্দ টা ক্রমশ বাড়তে থাকে….কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি অনেক অনুসন্ধান করে ঐ বাচ্চার কান্নার আওয়াজ এর উৎস খুঁজে পাচ্ছিনা,প্রচন্ড যন্ত্রণায় মাথাটা যেন ফেঁটে যাবার উপক্রম হলো আমার,মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম।দুদিন প্রকৃতিকে তন্ন তন্ন করে চারিদিকে খুঁজতে থাকি।এমনকি ওর সেই পুরোনো বাড়িতেও,কিন্তু ওর বাবা মা ছিলো ও সেখানে।সত্যি বলতে এতোদিনে প্রকৃতিকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম আমি।তার সাথে সাথে ওর গর্ভে আমার সন্তান বড়ো হচ্ছে।এই দুজনের শোকে পাগলপ্রায় আমি।আপ্রান চেষ্টা করি প্রকৃতিকে খুঁজে বের করার।কিন্তু আমার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

এভাবে প্রায় একমাস অতিক্রম হয়ে যায়।প্রতিরাতে যখন ঘুমাতে যাই সেই বাচ্চাটার কান্নার আওয়াজ আমার কানকে এফোঁড় ওফোড় করে দেয়, তারোপর নিজের স্ত্রী আর অনাগত সন্তান হারানোর যন্ত্রনা সবকিছু যেন বিপর্যস্ত করে তুলেছে আমায়।আমি কিভাবে এখনো বেঁচে আছি নিজেই জানি না,নিজের অন্তরের অনুশোচনা দগ্ধে দগ্ধে মারছে আমায়।এভাবে প্রতিদিন মরার থেকে একেবারে নিজের জীবনটা শেষ করে দেয়াটাই উত্তম মনে হচ্ছে আমার নিকট।নিজের জীবনের প্রতি বিরক্তি ধরে গিয়েছে আমার।

এরপর একদিন রাতে বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে বিষন্ন মনে পায়চারি করছি।হঠাৎ আমার চোখ নিচের দিকে যায়।দেখতে পাই প্রকৃতির মত দেখতে একটা মহিলা,হয়তো প্রকৃতিই হবে….সে একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।আমি তার পিছু নেই…আজকের ঘটনাও হুবহু সেই দিনের মত।মহিলাটা বাচ্চা কোলে নিয়ে সেই দিকেই যাচ্ছে যেখানে আমি প্রশংসা নিয়ে খুন করেছিলাম।

একপর্যায়ে মহিলাটা সেই খাদের পাশে এসে উপস্থিত হলো…আমিও তার পেছনে পেছনে চলে আসলাম।সবকিছু কেমন জানি ঘোরের মতো লাগছে আমার কাছে।চোখের সামনে কি হচ্ছে বুঝতে পারছিনা।মহিলাটাটা তার বাচ্চাকে উঁচুতে তুলে ধরলো,তারপরে খাদ থেকে নিচে ফেলে দেবে এমন উপক্রম….ঠিক তখন আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম,,

—-এই কি করছো তুমি এটা,ওকে নিচে ফেলে দিও না?

মহিলাটা আমার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়,আমার ধারণাই ঠিক।আর কেউ নয় প্রকৃতি নিজেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে।তাকে প্রশ্ন করি-

—-প্রকৃতি তুমি এসব কি করছো,?আর এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি?

—প্রকৃতি কে,আমি কোন প্রকৃতি নই।

—প্রকৃতির নও,তাহলে কে তুমি?আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমায়,

—প্রকৃতি বলতে কেউ নেই এই পৃথিবীতে,প্রকৃতি বলতে কারো অস্তিত্ব নেই।আমি প্রশংসা….!!

—-না এটা হতে পারে না,তুমি প্রশংসা হতে পারো না!

—কেন হতে পারি না,

-আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম।আর যাই হোক নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করতে সবারই দ্বিধা বোধ হয়,সেটাই স্বাভাবিক।

—-কারণটা আমি জানি,তুমি প্রশংসা কে নিজের হাতে খুন করেছ তাইতো,সেই কারণে তোমার দৃঢ়বিশ্বাস সে কিছুতেই ফিরে আসতে পারো না।

—না এটা কিছুতেই সম্ভব নয়,আমায় মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছ তুমি!

—না আমি কাউকে মিথ্যা ভয় দেখাচ্ছি না,এই বাচ্চাটাকে কে জানো তো?

—নাহ!

—এটা সে যাকে তুমি নিজ হাতে খুন করেছিলে, এবং তখন তার অস্তিত্ব সম্পর্কে তোমার কোন ধারণাই ছিল না।

—তারমানে তুমি সত্যি প্রশংসা…??

— হ্যাঁ আমি প্রশংসা…

—কিন্তু তুমি বেঁচে আছো কি করে,,!!

—-বেঁচে আছি…?তুমি সেদিন বাঁচতে দিয়েছিলে আমায়…!!

—মানে কি বলছো তুমি,আমি বুঝতে পারছি না।

কথাগুলো বলার সাথে সাথেই প্রশংসা হাত থেকে বাচ্চাটা উধাও হয়ে গেল। আমি সেদিকে তাকিয়ে ভয়ে চমকে উঠলাম।

—-এটা কি করলে তুমি,?

—সেটাই যা তুমি আমার সাথে আজ থেকে আট মাস আগে করেছিলে,আমার সাথে আর আমার বাচ্চার সাথে।মনে করে দেখো কতবার আমি তোমাকে অনুনয় বিনয় করে বলেছিলাম যে আমি প্রেগনেন্ট।কিন্তু তুমি তখন আমার কোন কথাই কানে তোলো নি।শেষ করে দিলে আমায়।একটা সন্তানের লালসা এতোটাই অন্ধ করে দিয়েছিলো তোমায়,আমার কথা একটিবারের জন্য ভাবলে না।

—হ্যাঁ,আমি অন্যায় করেছি।আমি জানি তোমার সাথে যা করেছি আমি ঠিক করিনি।তার শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আমি।কিন্তু তুমি..তুমিও ষড়যন্ত্র করেছো আমার পেছনে,আমাকে ঐ রাতে খুন করার প্লান ছিলো তাই না,বলো আমার সাথে কি এমন শত্রুতা ছিলো তোমার সাথে,

—হাহাহাহা….শত্রুতা।কিসের শত্রুতা।পাগলের মতো ভালোবাসতাম তোমায় আমি।আমি তোমাকে মারতে কেন চাইবো,

—তাহলে ঐ চিঠি, পিস্তল ওগুলো কিসের ছিলো,

—মায়া!সবটাই মায়া,,তোমার জীবনটাকে যন্ত্রনাময় করে তোলার জন্য তোমার সাথে ছলনা করেছি আমি।প্রথমে তোমার মাথায় একটা দুশ্চিন্তার বীজ বপন করে দেই আমি।তারপর আমি প্রকৃতির রুপ নেই।প্রকৃতি সেজে তোমার সাথে নাটক করি।এরপর আমি যা যা করি তোমাকে মানসিক যন্ত্রনা দেবার জন্য, আজ দেখো নিজের জীবনের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তোমার।জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছো তুমি…আজকে আমি সফল… আমি আমার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পেরেছি।আমি জানি তোমার মতো মানুষরুপী পশুর সাথে এটাও পর্যাপ্ত নয়,তোমার আরো অনেক শাস্তির বাকি।

যাও আমি তোমায় ছেড়ে দিলাম…নিজের মতো করে জীবন শুরু করো।কিন্তু তোমার সেই জীবনে আমি থাকবো না,না থাকবে কোনো সন্তান।থাকবে কেবল হতাশা,সাথে একরাশ অনুশোচনা।আর কিছুই না।

এই বলে প্রশংসা ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলো।না,আজকেও আমি ওকে সফল হতে দেবো না।আমাকে সারাজীবন যন্ত্রণা দিয়ে মারতে চায় ও,তাই না।ওর এই পরিকল্পনা সফল হতে দেবো না আমি।আজকেও আমিই জিতবো,তার সাথে সাথে শিক্ষা দিয়ে যাবো তাদের যাদের প্ররোচনায় আজকে আমি জীবনের এই প্রান্তে।আবার বাবা মা…
এরপর আমি ধীরে ধীরে খাদের কাছে এগিয়ে গেলাম।নিজের চোখজোড়া বন্ধ করি..তারপর শরীরটা নিচের দিকে ছুড়ে দিলাম….এরপর কেবল মুক্তিই আর মুক্তি।চিরমুক্তি।।🙂

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here