দোলনচাঁপার_টানে,পঞ্চম_পর্ব

দোলনচাঁপার_টানে,পঞ্চম_পর্ব
দেবারতি_ধাড়া

সকালে কিঙ্কিণীর মা-বাবা, কুশল সবাই অনেকবার করে ফোন করলেও কিঙ্কিণী ফোন রিসিভ করছেনা দেখে ভীষণই চিহ্নিত হয়ে পড়লেন ওনারা। তাই কিঙ্কিণীর বাবা কুশলকে ফোন করে বলতে কুশল দুলাল বাবুকে ফোন করলো কিঙ্কির কথা জিজ্ঞেস করার জন্য। কিন্তু দুলাল বাবু তখনও ব্রেকফাস্ট নিয়ে যাননি তাই কিছু জানতেও পারেননি। কুশ ফোন করায় একেবারে ব্রেকফাস্টটা নিয়েই দুলাল বাবু ছুটলেন কিঙ্কিণীর বাড়ির দিকে। গিয়ে দেখলেন কোকো গেটের সামনে এসে ঘেউ ঘেউ করছে জোরে জোরে। গেটে ভিতর থেকে তালা দেওয়া। দুলাল বাবু এসেছে দেখে কোকো চাবিটা মুখে করে এনে গেটের বাইরে বের করে দিলো। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে গেটের ভিতর হাত গলিয়ে তালাটা খুললেন দুলাল বাবু। ঘরে গিয়ে দেখলেন কিঙ্কিণী জ্বরের ঘোরে পড়ে আছে। কোনো জ্ঞান নেই ওর। দুলাল বাবু কুশকে ফোন করে সেকথা জানানোর পর উনিই ডাক্তারকে ফোন করে নিয়ে আসেন..

প্রথমে ডাক্তার আসতে না চাইলেও দুলাল বাবু অনেক করে অনুরোধ করাতে এসেছেন উনি। ডাক্তারবাবু চেকআপ করে প্যারাসিটামল আর অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট লিখে দিয়েছেন। সেগুলো কিনে এনে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলেন কিঙ্কিণীকে। প্যারাসিটামলটা খাওয়ার পর ঘাম দিয়ে কিঙ্কিণীর জ্বরটা নেমে যেতে জ্ঞান ফিরলো ওর। তবে মাথাটা প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে। দুলাল বাবু কোকোকে খেতে দিয়েছেন, কিন্তু কিঙ্কিণী অসুস্থ হওয়ায় কোকো কিছুতেই খেতে চাইছিলোনা। তাই দুলাল বাবু কোকোকে কোলে নিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন। কিঙ্কিণীর জ্ঞান ফিরতে দুলাল বাবুর গলা পেয়ে কিঙ্কিণী কষ্ট করে একটু উঠে হেলান দিয়ে বসে বললো,

-দুলাল বাবু আপনি? কখন এসেছেন? গেট কে খুললো?
-অনেক্ষণ আগে এসেছি কিঙ্কিণী ম্যাডাম.. আপনাকে ফোনে না পেয়ে আপনার বাবা-মা আর কুশল বাবু খুব চিন্তা করছিলেন। তাই কুশল বাবু আমাকে ফোন করে আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন আর আপনাকে একবার দেখে যেতে বললেন। এখানে এসে দেখি গেটে তালা দেওয়া, তাই আপনাকে ডাকতে কোকা মুখে করে গেটের চাবিটা দিলো। আর গেট খুলে দেখলাম আপনি জ্বরের ঘোরে পড়ে আছেন। তাই কুশল বাবুকে সবটা জানিয়ে ডাক্তার বাবুকে ফোন করে আসতে বলি। ডাক্তার এসে আপনাকে দেখে কয়েকটা ওষুধ লিখে দিয়েছেন। তার মধ্যে একটা প্যারাসিটামল খাওয়াতে আপনার জ্বরটা একটু কমেছে মনে হয়। আপনি কিছু খেয়ে নিয়ে বাকি ওষুধ গুলো খেয়ে নিন ম্যাডাম। তাহলেই আর কোনো চিন্তা থাকবেনা! আর হ্যাঁ, আপনি পারলে একটু আপনার বাড়িতে আর কুশল বাবুকে একটু ফোন করে নিন! ওনারা হয়তো খুব চিন্তা করছেন..
-হ্যাঁ হ্যাঁ আমি করে নিচ্ছি। আপনি বরং বাড়ি যান.. আমার আর কোনো অসুবিধা হবেনা। আমি ব্রেকফাস্ট করে ওষুধ গুলো খেয়ে নেবো..
-না না আমি আছি, যদি আপনার কোনো অসুবিধা হয়!
-না না দুলাল বাবু, আমার কোনো অসুবিধা হবেনা। অাপনি চিন্তা করবেননা.. আর হ্যাঁ, যাওয়ার সময় একটু কাল রাতের খাবার গুলো নিয়ে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন প্লিজ? কাল রাতে আমি খেতে পারিনি..
-সেকী?! আপনি রাতে খাননি কেন?!

রাতে কিঙ্কিণী খায়নি কেন সেটা দুলাল বাবু কেমন যেন রূঢ়ভাবে জিজ্ঞেস করলেন।

-আসলে কাল শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছিলো, তাই খেতে পারিনি। আর হ্যাঁ, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে দুলাল বাবু..

দুলাল বাবুর সাথে কিছু কথা আছে বলায় দুলাল বাবু কেমন যেন চমকে উঠলেন। তারপর বললেন,

-কী কথা? বলুন..
-না না এখন নয়, আমি একটু সুস্থ হয়েনি.. তারপর বলবো। আপনি এখন আসুন..

আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন দুলাল বাবু। তারপর কিঙ্কি কোকাকে খাবারটা খেয়ে নিতে বলে ফোনে মায়ের নাম্বারটা ডায়াল করলো। ফোনটা ধরেই উত্তেজিত হয়ে সুমিতা দেবী বললেন,

-হ্যালো কিঙ্কু?! তুই ঠিক আছিস তো মা?! কাল রাত থেকে ফোন ধরিসনি কেন আমাদের? তুই জানিস আমাদের কত চিন্তা হচ্ছিলো?
-ভালো আছি মা.. প্যারাসিটামলটা খেয়ে জ্বরটা নেমে গেছে। তোমরা চিন্তা কোরোনা.. আমি ঠিক আছি একদম!
-কী যে বলিসনা তুই! আমাদের চিন্তা হবেনা বলতো? সেই কত দূরে গিয়ে রয়েছিস আমাদের ছেড়ে। তোকে এই জন্যই বলেছিলাম যে ওখানে যেতে হবেনা! এখানের চাকরিটা তো ভালোই ছিলো! কেন শুধু শুধু এটা ছেড়ে দিয়ে ওখানে গিয়ে থাকতে গেলি বলতো? আমি আর তোর বাবা গিয়ে তোকে নিয়ে চলে আসবো আমাদের কাছে…
-উফ! মা! চুপ করো তুমি.. আমি তো বলছি আমি ঠিক আছি.. কোনো অসুবিধা হলে আমি তোমাদের বলবোনা বলো?
-সেতো জানি.. কিন্তু..

কথাটা থামিয়ে দিয়ে পঙ্কজ বাবু সুমিতা দেবীর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললেন,

-তুই ঠিক আছিস তো মা? আসলে কাল রাত থেকে ফোন ধরছিলিসনা তো, তাই তোর মা একটু বেশিই চিন্তা করছে রে মা.. তুই রাগ করিসনা সোনা মা আমার..
-হ্যাঁ বাপি আমি একদম ঠিক আছি, আসলে রাতে খুব মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিলো, তাই ফোনটা ধরতে পারিনি.. আর মাথার যন্ত্রণার জন্যই হয়ত জ্বরটা এসেছিলো। তোমরা তো জানোই আমার মাথার যন্ত্রণা হলে আর কিচ্ছু ভালো লাগেনা! তোমরা চিন্তা কোরোনা! আমি রাখছি এখন.. কুশল ফোন করছে, ওকেও একটা ফোন করতে হবে..
-হ্যাঁ মা.. করেদে তাড়াতাড়ি.. ছেলেটাও খুব চিন্তা করছে তোর জন্য.. রাখলাম কেমন!

কুশল কল করেই যাচ্ছিলো আর ওয়েটিং পাচ্ছিলো। ফোনটা কাটার পরই রিং হতে শুরু করলো। ফোনটা রিসিভ করতেই কুশল বললো,

-কী ব্যাপারটা কী কিঙ্কি? সেই কখন থেকে কল করে যাচ্ছি.. ঠিক আছো তো তুমি?! তুমি জানো কত চিন্তা হচ্ছিলো আমার?! কখন জ্ঞান ফিরলো তোমার?
-এই তো একটু আগে.. আমি মাকে ফোনটা করেই তোমাকে ফোন করতাম। এখন ঠিক আছি আমি..
-আমি যাবো কিঙ্কি? আমি যাবো তোমার কাছে? ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে যে তোমাকে..
-আমারও খুব ইচ্ছা করছে তোমাকে দেখতে। তোমাকে এখনই আসতে হবেনা। আমি কটাদিন একটু রেস্ট নিয়ে নিই, তারপর আমি নিজেই তোমাকে আসতে বলবো..
-কিন্তু তুমি তো অসুস্থ কিঙ্কি.. ওখানে একা একা সব কিছু সামলাবে কী করে তুমি?
-আমি একদম ঠিক আছি কুশ.. আর কয়েকদিন পর আমি নিজেই তোমাকে আসতে বলবো.. প্রমিস..
-ঠিক আছে তাই.. কিন্তু তাড়াতাড়ি বোলো কিঙ্কি.. আমি কিন্তু এবার যেতে চাই তোমার কাছে..
-হ্যাঁ কুশ বলবো..

কাল রাতের ঘটনাটা কিঙ্কি কুশল বা ওর বাবা-মা কাউকেই বললোনা। ও জানে এসব বললেই ভীষণ চিন্তা করবে ওরা। কাল রাতে যেটা ঘটেছে, সেটা হয়তো ওর মনের ভুলও হতে পারে। অচেনা জায়গা, তার ওপর শরীর দূর্বল তাই হয়তো এসব কিছু ভেবেই ও স্বপ্নও দেখতে পারে। তাই ও ভাবলো আগে দুলাল বাবুর সাথে কথা বলতে হবে এটা নিয়ে। তারপর না হয় কুশকে বলবে। বাবা-মাকে এসব এখনই বলাটা ঠিক হবেনা। ওর কেন জানেনা মনে হচ্ছে দুলাল বাবু কিছু জানেন। আর রাতের খাবারের ব্যাপারটা নিয়ে কিঙ্কিণীর মনে একটু সন্দেহ জাগছে। ওর মনে হলো, সেদিন রাতে কোকো খায়নি তাই রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। সেদিন জানলার দিকে তাকিয়ে কোকো চেঁচাচ্ছিলো। আর আমার ঘুম ভাঙছিলোনা। আবার কাল রাতে আমি খাইনি আর আমার মনে হলো জানলার সামনে কিছু ছিলো, কিন্তু কোকোকে অত করে ডাকতেও উঠতে চাইছিলোনা কোকো। তার ওপর কাল রাতে আমি খাইনি শুনে দুলাল বাবুর মুখচোখ কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছিলো”। এটা নিয়েই কিঙ্কির মনে খটকা লাগলো। তারপর সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ও কেমন একটা মনে হয়েছিলো, সেটাতে তো ও পাত্তাই দেয়নি। “যাক সেসব নিয়ে এখন ভেবে কাজ নেই! উঠে ফ্রেস হয়ে খেয়ে নিয়ে ওষুধটা খেতে হবে। এভাবে বাড়িতে বসে থাকতে ভালোলাগেনা! বাচ্চাগুলোর সাথে বেশ ভালো সময় কেটে যেতো। কিন্তু আজ তো আর যেতেও পারবোনা!”

কিঙ্কিণী বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে ঢুকলো। জ্বরটা ছাড়ার পর খুব গরম হচ্ছে ওর, তাই ভাবলো একেবারে স্নান করে নেবে। ব্রাশ করার পর শাওয়ারটা চালিয়ে দিলো কিঙ্কি। কিছুক্ষণ পর বাথরুমের দরজায় কেউ যেন টোকা দিচ্ছে মনে হলো। তাই কিঙ্কিণী বাথরুম থেকেই চেঁচিয়ে বললো,

-দুলাল বাবু আপনি আবার এলেন? কিছু বলবেন? আমি স্নান করছি আপনি একটু বসুন প্লিজ!

আবারও যেন টোকার আওয়াজ হলো। হয়তো জলের আওয়াজে উনি শুনতে পাননি, তাই কিঙ্কিণী শাওয়ার আর কলটা বন্ধ করে দিয়ে আবারও বললো,

-হ্যাঁ আরেকটু বসুন.. আমার হয়েই এসেছে.. কী হলো কোকো তুই চেঁচাচ্ছিস কেন..? নিশ্চয়ই দুষ্টুমি করছিস? দাঁড়া আমি যাচ্ছি! গিয়ে খুব বকে দেবো কিন্তু!

তাড়াতাড়ি করে স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরোতে বেরোতে কিঙ্কিণী বললো,

-সরি দুলাল বাবু, আপনাকে অনেক্ষণ অপেক্ষা করালাম.. বলুন কী বলবেন?
তারপরই ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো ঘরে কেউ নেই। কোকো দরজার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে।

-যাহ্! দুলাল বাবু চলে গেলেন! ওনাকে তো বললাম একটু বসতে!

তখনই বাথরুম থেকে শাওয়ারের জল পড়ার আওয়াজ পেলো কিঙ্কিণী।

-কী হলো? আমি তো শাওয়ারটা বন্ধ করেই এলাম। তাহলে আবার খুললো কী করে! উফ! কলের প্যাঁচ গুলো মনে হয় একেবারে খারাপ হয়ে গেছে!

কিঙ্কিণী আবার বাথরুমে ঢুকে বন্ধ করে দিলো শাওয়ারটা। তারপর ব্রেকফাস্ট করে ডাক্তারের দেওয়া বাকি ওষুধ গুলো খাওয়ার আগে ওষুধ গুলোর ব্যবহার, উপকারিতা, সাইড এফেক্টস এ সম্পর্কে ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখে নিলো কিঙ্কিণী। কারণ ওভাবে অজ্ঞান থাকা অবস্থায় ডাক্তার এসে ওষুধ গুলো দিয়েছিলেন। আর দুলাল বাবুর হাবভাবও ঠিক ভালো ঠেকছেনা ওর কাছে। তাই ওষুধ গুলো খাওয়াটা ঠিক হবে কিনা একবার দেখে নিলো কিঙ্কিণী।

ক্রমশ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here