দোলনচাঁপার টানে,প্রথম_পর্ব
দেবারতি_ধাড়া
-মা! আর কত কিছু দেবে বলোতো! আমি একা এত কিছু কত দিন ধরে খাবো বলোতোহ! প্লিজ তুমি এত কিছু দিয়োনা! আর তাছাড়া এই নাড়ু, মোয়া, নিমকি, চানাচুর এগুলো তো কোকোও খেতে চায়না বেশি! আর ওখানে কী কিছু খাবার পাওয়া যাবেনা নাকি! এসবেই তো আমার ব্যাগ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। এর পর আর আমার জামা কাপড় আর দরকারি কাগজপত্র গুলো নেবো কী করে?
-আরে বাবা ওখানে একা একা থাকবি, যখন যা খেতে ইচ্ছে করবে তখন কী আর সঙ্গে সঙ্গে সেসব খেতে পারবি? তখন তো এগুলো মুখোরোচক হিসেবে খেতে পারবি নাকি? আর তোর ইচ্ছে না হলে স্কুলে গিয়ে কলিগদের দিবি, দেখবি তারা ঠিক খেতে চাইবে!
-মা তুমিও না! এখন থেকেই আমার কলিগদের নিয়ে ভাবছো! কী যে বলিনা তোমায়! আচ্ছা মা তুমি এত ভালো কেন গো?
বলেই কিঙ্কিণী পিছন থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো।
-আহ! ছাড়! মাকে আর সোহাগ দেখাতে হবেনা! মা-বাবার কথা তো আর তুমি শোনার প্রয়োজন মনে করোনা, শুনলে আমরা এত করে বারণ করা সত্ত্বেও সেই কোন ধাধ্বারা গোবিন্দ পুরে সামান্য একটা স্কুল টিচারের চাকরি করতে যেতেনা! নিজের চাকরিটা ছেড়ে, এতগুলো ভালো ভালো চাকরির অফার ছেড়ে দিয়ে এমনকি আমেরিকাতে জব অফার পেয়েও কেউ এমন হেলায় হারায়!
-মা.. তুমি প্লিজ আর ওই চাকরি গুলোর কথা তুলোনা.. তুমি তো জানোই ছোট থেকে আমি শুধু একজন ভালো সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা হতেই চেয়েছিলাম। আর সেই সুযোগটা এত দিনে পেয়েছি, সেটা কী করে হাতছাড়া করি বলোতো?
-সেই তো! হও তোমার স্বপ্নের সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা! আমাদের আর কী বলার আছে? তুমি বড় হয়েছো, নিজের ভালো নিজে বুঝতে শিখেছো, এখানে আর আমরা কী কিছু বলতে পারি? শুধু একটাই চিন্তা, তুই তো কিছু রান্নাও করতে পারিসনা সেরকম। ওখানে গিয়ে কী করে খাওয়া দাওয়া করবি বলতো? ওই তো হোস্টেলের মতো শুধু ডিম সেদ্ধ আর আলু সেদ্ধ ভাতই করতে পারবি।
-তুমি কোনো চিন্তা কোরোনা মা, আমি কথা বলে নিয়েছি স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে। ওখানে একজন কেয়ারটেকার আছেন, উনিই সব ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন।
তখনই পঙ্কজবাবু মানে কিঙ্কিণীর বাবা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
-কী ব্যাপার? আমাকে বাদ দিয়ে কিসের এত কথা হচ্ছে মা-মেয়েতে মিলে?
-দেখোনা বাপি, মা আমাকে নিয়ে চিন্তা করছে! আমি ওখানে কী করে থাকবো, কী খাবো, এসবই চিন্তা করছে!
-আহ! সুমিতা তুমি এত চিন্তা কোরোনা তো, আমাদের কিঙ্কু মা ঠিক থাকতে পারবে। শুধু একটাই চিন্তা সেটা হচ্ছে কোকোকে নিয়ে। সারাদিন কিঙ্কু বাড়িতে না থাকলে কোকোকে কে দেখবে বলতো মা?
-ও নিয়ে তুমি চিন্তা কোরোনা বাপি। কোকো ঠিক থাকতে পারবে। আর আমি তো সামনেই থাকবো, মাঝে মাঝে একটু করে দেখে আসবো কোকোকে। আমার থাকার জায়গাটা তো ওই স্কুলের পাশেই। কিরে কোকো সোনা, তুই একটু ম্যানেজ করে নিয়ে একা থাকতে পারবিনা আমার জন্য? কিরে বল?
এতক্ষণ ঘরের এক কোণে বসে বসে সব কথা শুনছিলো কোকো। যেই কিঙ্কিণীর মুখে নিজের নামটা ডাকতে শুনেছে ওমনি দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো কিঙ্কিণীর বুকের ওপর। তারপর একটু আদর করে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করে কী বলতে চাইলো কে জানে! হয়তো কিঙ্কিণীর প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলতে চাইলো এভাবে লাফ ঝাঁপ করে।
-মা, বাপি তোমরা দেখছো তো কোকো সোনা বললো যে হ্যাঁ ও ঠিক কিছুটা সময় থাকতে পারবে একা একা! কীরে কোকো তুই আমার সাথে না গিয়ে থাকবি নাকি মা বাপির কাছে?
কথটা শোনা মাত্রই কোকোর মনটা কেমন যেন খারাপ হয়েগেলো, কিঙ্কিণীর বুক থেকে নেমে ওর পায়ের কাছে বসে পড়লো। চোখ গুলো কেমন যেন ছলছল করে উঠলো ওর। তখনই কিঙ্কিণী নীচু হয়ে আবারও কোলে তুলে নিলো কোকোকে। তারপর কোকোকে জড়িয়ে ধরে চেপেচুপে চটকে অনেক আদর করে দিয়ে বললো,
-নারে সোনা তুই ভাবলি কী করে কোকো আমি তোকে এখানে রেখে দিয়ে চলে যাবো? কখনও না সোনা। আমি তোকে নিয়েই যাবো। জানি তোর মা-বাপিকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হবে, কিন্তু আমি জানি তুই ঠিক আমার জন্য এটুকু কষ্ট করে থাকতে পারবি।
তখন আবার যেন কোকোর মনটা একটু খারাপ হয়েগেলো মা বাপির জন্য। কোকো কিঙ্কিণীর কোল থেকে নেমে মা-বাপির কাছে গিয়ে ওদের কোলে উঠতে গেলো।
জামা কাপড় গুলো সব পাট করে রাখাই ছিল ব্যাগের পাশে। মা সব খাবার গুলো ব্যাগে গুছিয়ে দেওয়ার পর কিঙ্কিণী নিজের সব জামা কাপড়, স্কুলের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, আইডেন্টিটি কার্ড আর কোকোর সব ওষুধপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। কাল ভোরেই ওদের বেরোতে হবে। তাই আজ একটু তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়লো কিঙ্কিণী। শুয়েই ফোনে ডায়াল করলো ওর প্রিয়তমের নাম্বারটা। একবার মাত্র রিং হওয়াতেই ফোনটা রিসিভ করলো সে।
-কী ব্যাপার আজ যে সকাল থেকে ম্যাডামের একটাও ফোন নেই! আমি কতবার ফোন করলাম তাও রিসিভ করলেনা! ভালো ভালো! ওখানে যাওয়ার আগেই আমাকে ভুলে যাচ্ছো! তাহলে যে ওখানে গিয়ে আমাকে কত মনে রাখবে সেতো বুঝতেই পারছি আমি। আউট অফ সাইড, আউট অফ মাইন্ড!
-কেন এরকম করে বলছো কুশ? তুমি তো জানোই আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি.. আমার তোমাকে ছেড়ে থাকতে সত্যিই খুব কষ্ট হবে কুশ। কিন্তু তুমি তো জানো বলো? আমার কতদিনের ইচ্ছা সরকারি স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার। আসলে কাল ভোরেই তো বেরোতে হবে। তাই ভোরে উঠে একদম সময় পাবোনা। আর সেজন্যই তো সব গুছিয়ে নিচ্ছিলাম আজ। তাই একটু ব্যস্ত ছিলাম। আর তুমি তো আমার শরীর মন সবটুকু জুড়েই আছো.. আমি তোমাকে কী করে ভুলতে পারবো কুশ?
-আমার খুব কষ্ট হবে কিঙ্কি, তোমাকে ছেড়ে থাকতে। আমি কী করে তোমার সাথে দেখা না করে থাকবো এতদিন? রোজ একবার করে দেখা না করে তো আমি থাকতেই পারিনা! সেখানে প্রায় একমাস করে দেখা না করে থাকবো কী করে কিঙ্কি? আমি তো পাগল হয়ে যাবো কিঙ্কি!
-কিচ্ছু পাগল হবেনা কুশ.. কাল তো তুমি যাচ্ছোই আমার সাথে। তুমি তো চিনেই যাবে আমার থাকার জায়গা। যখনই আমাকে দেখতে ইচ্ছা করবে তখনই ওখানে চলে যাবে আমাকে দেখতে এক দুদিনের জন্য।
-সত্যি বলছো কিঙ্কি? আমি মাঝে মাঝে তোমার সাথে দেখা করতে ওখানে যাবো? তুমি ঠিক বলছো তো? ওখানে কোনো প্রবলেম হবেনা তো?
-না! কিচ্ছু প্রবলেম হবেনা। দরকার হলে তুমি আমার ওখানে না থেকে ওখানকার সামনে কোনো একটা হোটেলে থাকবে। আর আমি দু একদিনের জন্য ওখানেই চলে যাবো! এবার খুশি তো?
-ভীষণ ভীষণ.. আচ্ছা ঠিক আছে এবার ঘুমিয়ে পড় সোনা। আজ আর বেশিক্ষণ জাগতে হবেনা.. কাল ভোরে উঠতে হবে তো।
-ওকে! তুমিও ঘুমিয়ে পড়.. তোমাকেও তো উঠতে হবে..
-ওকে কিঙ্কি.. টাটা! লাভইউ!
-লাভইউ টু! টাটা!
ভোরবেলা উঠে রেডি হয়ে নিয়ে মা-বাবাকে প্রণাম করে কুশলের গাড়িতে উঠে পড়লো কিঙ্কিণী আর কোকো। সব ব্যাগপত্র আগেই গাড়িতে তুলে নিয়েছে কুশল।
-সাবধানে থাকবি মা.. অচেনা শহর, সব অচেনা মানুষ, কোনো অসুবিধা হলে কিন্তু আমাদের সবটা বলবি! একটা ফোন করলেই আমরা গিয়ে তোকে ওখান থেকে নিয়ে চলে আসবো। তুই ওই স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমাদের সাথে চলে আসবি।
-উফ বাপি! আমি এখনো ওখানে গেলামই না, আর তুমি চলে আসার কথা বলছো?
-তোর বাপি ঠিকই বলেছে, তোর কোনো অসুবিধা হলে কিন্তু আমাদের বলবি মা..
-হ্যাঁ মা বলবো! উফ!
-আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না আঙ্কেল, আন্টি.. আমি তো যাচ্ছি.. আমি সব দেখে শুনে আসবো, আর মাঝে মাঝে আপনাদেরকেও নিয়ে যাবো ওখানে। এবার কিন্তু আমাদের বেরোতে হবে, তা নাহলে ওখানে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। তারপর সব গুছিয়ে দিয়ে তো আমাকে ফিরেও আসতে হবে সন্ধ্যের মধ্যে। ওদিকে তো আবার সন্ধ্যে হলেই সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। গ্রামের দিক তো!
কুশল কিঙ্কিণীর বাবা-মাকে কথা গুলো বলে নিজেও গাড়িতে উঠে গেলো। কিঙ্কিণীর বাবা বললেন,
-হ্যাঁ হ্যাঁ এবার এসো তোমরা.. সাবধানে যেও কিন্তু..
-হ্যাঁ বাপি টাটা! মা টাটা!
গাড়িটা হুস করে ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে গেলো কিঙ্কিণীর মা-বাবার সামনে দিয়ে।
ক্রমশ…