গল্প- পলাশ_ফুলের_বসন্ত ( পর্ব-৬,৭ )
কলমে -দেবিকা_সাহা
পর্ব-৬
— একটা রিপ্লাই দিয়েই দিন বরং। কিচ্ছু আসবে যাবে না তাতে।
হঠাৎ করে আকাশের মুখে এইরকম একটা অপ্রত্যাশিত কথা শুনে বেশ ঘাবড়েই গেলো মেয়েটা।।
আরে কি ভাবছেন এতো? এতো ভাবলে কিন্তু মোটেও চলবে না বুঝলেন তো। যা বললাম সেটাই করুন এতো না ভেবে।রিপ্লাইটা বরং দিয়েই দিন।
— না মানে আমি আসলে……
— আপনার কাছে কোনো এক্সপ্ল্যানেইশন চাইনি পৌষালি। কি জানেন তো,, জীবনে কখনো জোর করে বা ভয়ে পড়ে বা চাপে পড়ে কোনো বিষয় নিয়ে কারোর কাছে এক্সপ্লেন করতে যাবেন না।মন থেকে যখন নিজের ইচ্ছেতে কোনো কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করবে,, একমাত্র তখনই শেয়ার করবেন। কেমন….
আকাশের কথাটা শুনে পৌষালি আবারো খানিকটা অবাক হলো।বারবার মনে হয়,,ছেলেটাকে যতো দেখছি ততো যেনো নতুন করে চিনছি।
কিছু একটা কথা মুখে আনতে গিয়েও থেমে গেলো মেয়েটা।
ইতিমধ্যে আকাশের একটা জরুরি ফোন আসায় ও পৌষালির ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। একা ঘরে বসে এই মূহুর্তে পৌষালির মনটা অনেকটাই হালকা লাগছে। কেনো হালকা লাগছে তার উত্তর ওর কাছে নেই।তবে বারবার একটু আগে আকাশের বলে যাওয়া কথাগুলো কানে বাজছে। ” একটা থ্যাংক ইউ বলে দিতেই পারেন।” সত্যিই কি পারি? হ্যাঁ পারি। অনিন্দ্য যখন আমার জন্মদিনে শুভেচ্ছাবার্তা জানাতে পেরেছে,, তখন আমিও এর প্রত্যুত্তরে একটা ধন্যবাদ জানাতেই পারি।আর সত্যিই তো একটা কথা খুব ঠিক,,একটা মানুষ যখন দূরে চলে যায়, আমাদের জীবনে যখন তার কোনো অস্তিত্বই থাকে না তখন তার প্রতি ফিলিংস-টাও নিউট্রাল থাকা দরকার। রাগ বা অভিমান আমরা সেই মানুষটার উপরেই করতে পারি যার উপর আমাদের নিজস্ব অধিকারবোধ আছে।
এইসব কথা ভেবেই অনিন্দ্যর প্রেরিত শুভেচ্ছাবার্তার প্রত্যুত্তরে গুছিয়ে কয়েকটা কথা লিখলো পৌষালি।
” অনেক ধন্যবাদ আমাকে উইশ করার জন্য। ভালো থেকো। ”
ম্যাসেজটা সেন্ড করে ফোনটা অফ করে টেবিলের উপর রেখে দিলো পৌষালি। চোখে মুখে একটু জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাথেই খানিক্ষন বাক্যালাপ করলো পৌষালি।ওই নিজের মনের সাথে নিজের হিসাব আর কি। এই অভ্যাসটা পোষালির একটা নিজস্ব মন ভালো করার থেরাপি বলা যেতে পারে।এমনটা ও মাঝে মাঝেই করে থাকে।।
রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই বাড়ির সব নিমন্ত্রিত লোকজনেরা পৌষালিকে ঘিরে ধরলো।আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমনি যে ও-ই।তাই সবার নজর স্পেশালি ওর দিকেই থাকবে,,এটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু এতোকিছুর মধ্যেও পৌষালির চোখদুটো যেনো অন্য কাউকে খুঁজছে।
কোথায় গেলো ছেলেটা? অনেকক্ষন ধরেই তো এদিক ওদিক কোথাও দেখছি না।আচ্ছা ও কি চলে গেলো? না না তা কি করে হয়। কাকিমা তো এখানেই আছেন।আর ও যদি চলেও যেতো তবে নিশ্চই যাওয়ার আগে আমাকে একবার বলে যেতো।তাহলে??
কাউকে খুঁজছেন?
পিছন থেকে পরিচিত কারোর একটা গলার আওয়াজে ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এলো পৌষালি।
ওইদিকে ঘুরে দেখলো ওর সামনে আকাশ দাঁড়িয়ে। সেই সবসময়কার মতো মুখে একগাল হাসি।
আকাশের এই হাসিমুখটাই পৌষালির বরাবর ভালো লাগে।কি সুন্দর একটা নিষ্পাপ হাসিতে সবসময় ভরে রয়েছে ছেলেটার মুখ।
— কি ব্যপার বলুন তো? এতোক্ষন তো কাউকে একটা খুঁজছিলেন। এখন আবার ভাবতে বসে গেলেন।। এই এক সেকেন্ড আপনি এতো মন দিয়ে কি ভাবছেন বলুন তো?
— নাহ্,,তেমন কিছু না।আমি মানে আপনাকেই….
— আমাকেই খুঁজছিলেন তাই না? আমি ঠিক ধরেছিলাম।আরে আকাশ তোর ভাগ্য তো খুলে গেলো রে,,ম্যাডাম যে তোকে চোখে হারাচ্ছে।
শেষের কথাটা আকাশ একটু আস্তে আস্তে বললেও পৌষালির কান এড়ালো না। ও তো এই কথাটা শুনে কেমন একটা আড়চোখে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে।
সত্যি বলতে আকাশের মুখে এই কথাটা শুনে পৌষালির খুব একটা খারাপও লাগলো না।ও বেশ ভালো লাগার সাথে উপলব্ধি করলো কথাটা। তবে পৌষালির মুখের এরকম অদ্ভুত রকম অভিব্যক্তি দেখে আকাশ-ও নিজের মুখের হাসিটাকে আর কন্ট্রোল করতে পারলো না।দুজনের মুখেই হাসির রেখা ফুটে উঠলো একটা অদ্ভুত উপলব্ধির মুখোমুখি হয়ে।
আজ কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না অনিন্দ্য। বারবার পৌষালির মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আসলে কিছু মানুষকে হয়তো চাইলেও ভোলা যায়না। আমি তো তোমায় ভুলতে চাইনি পৌষালি। তুমি নিজে এই সম্পর্কটা থেকে বেড়িয়ে গেছো।না,,তোমার কোনো মূল্য নেই আমার জীবনে।পৌষালি নামের কেউ কোনোদিন আমার পরিচিত ছিলো না।এই নামের কাউকে আমি চিনি না।কিন্তু আমি চাইলেও কেনো ভুলতে পারছি না ওকে।বারবার করে ওর মুখটাই ভেসে আসছে।বিশেষ করে সেদিন ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে।
আচ্ছা পৌষালির সাথে আকাশের বিয়ে ঠিক হয়েছে?তারমানে পৌষালি নিজের জীবনটা নিয়ে এগিয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। বাহ্,,খুব ভালো।
আচ্ছা আমি এটা কেনো ভাবছি? আমিও তো ওর জন্য বসে থাকেনি।আমিও তো নিজের জীবন নিয়ে এগিয়ে গেছি অনেকদিন আগেই।মায়ের পছন্দ করা মেয়ের সাথে বিয়েও করেছি। সংযুক্তাকে তো মা নিজে পছন্দ করেছিলেন আমার জন্য।মায়ের মতে সংযুক্তাই নাকি এবাড়ির বউ হওয়ার উপযুক্ত। ঘরনী,গৃহিণী একেবারে শান্ত স্বভাবের মেয়ে।যার ছায়ায় নাকি আমাদের পরিবারটা সবসময় হাসিখুশিতে ভরে থাকবে,ভালো থাকবে আমাদের পরিবারটা।কিন্তু আদৌ কি আমাদের সংসারে সেই কাঙ্খিত শান্তিটা আছে? আমার আর সংযুক্তার মধ্যে কি সেই সম্পর্কটা আছে? ও কি আদৌ আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠতে পেরেছে?হ্যাঁ এটা ঠিক,,মায়ের পছন্দ মতো ও সংসারী মেয়ে।চাকরিবাকরি করে না।কিন্তু এতোকিছুর পরেও আর যাই হোক ও আমাদের পরিবারটাকে বেঁধে রাখার উপযুক্ত নয়। সারাদিন সাজগোজ, নিজের বন্ধুবান্ধব এসব নিয়েই আছে।যেনো ওটাই ওর জগৎ।।
আর আমি? আমি কি ভালো আছি?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। ইতিমধ্যে ফোনের নোটিফিকেশনের শব্দে ফোনটা অন করতেই পৌষালির ম্যাসেজটা চোখে এলো অনিন্দ্যর। পৌষালি আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে!! তবে সবটা যেনো বড্ড ফর্মালিটি টাইপের কথা।অবশ্য এখন এটাই তো স্বাভাবিক। ওর সাথে আমার এখনকার সম্পর্ক যে শুধুই ফর্মালিটির।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখের পাতাদুটো যেনো অজান্তেই কিছুটা ভিজে এলো ছেলেটার।।
পৌষালি……
হ্যাঁ আকাশ বলুন।বাই দ্যা ওয়ে আমার গিফ্টটা কোথায়? আপনি কিন্তু ফাঁকি দিয়ে গেলেন।দ্যাট ইজ নট ফেয়ার।আমার জন্মদিন বলে কথা।একটা উপহার তো আমার প্রাপ্যই ছিলো। তাই না?
মেকি রাগ দেখিয়ে আকাশকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাগুলো বললো পৌষালি।
— কুল ম্যাডাম কুল। আপনার উপহারটা দেবো বলেই তো আপনাকে এখানে ডেকেছি।
— কি এমন উপহার যেটা দেওয়ার জন্য এতো ঘটা করে এখানে ডেকে আনলেন ? আমি তো জানার জন্য ভীষণ এক্সাইটেড।
— ওয়েট।
আকাশ ওর হ্যান্ড ব্যাগটা থেকে একটা টিফিন বক্স বের করে পৌষালির হাতে দিলো।
নিন,,এটা আপনার গিফ্ট।
— এটা তো একটা টিফিন বক্স।কি আছে এটাতে?
অবাক চোখে বক্সটার দিকে তাকিয়েই আকাশের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো পৌষালি।
— নিজেই বক্সটা খুলে দেখুন।
পৌষালি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে টিফিন বক্সটা খুলে দেখলো।বক্সটা খুলে পৌষালি বেশ অবাক চোখেই একবার আকাশের দিকে তাকালো। ছেলেটা বেশ স্মার্টলি হাসি মুখে পৌষালির দিকে তাকিয়ে আছে।
— এটা তো পায়েস।
— ইয়েস।আমি বানিয়েছি। অনেক কষ্ট করে ইউটিউব দেখে শিখেছি।একটুও মায়ের হেল্প করেনি।সকালে ঘুম থেকে উঠে একা একা রান্না করেছি শুধু আপনাকে খাওয়াবো বলে।
আরে জানেন তো,, আমাকে প্রথমবার এতোক্ষন ধরে রান্নাঘরে থাকতে দেখে মা- তো বেশ অবাকই হয়েছিলেন। অবাকের সাথে সাথে একটু ভয়-ও পেয়েছিলেন নিশ্চই।ভাবছিলেন হয়তো ছেলের আবার মতিভ্রম হলো নাকি যে সকাল সকাল উঠে রান্নাঘরে মন দিয়েছে।কিন্তু মা তো আর জানতো না যে তার ছেলে তার বৌমার সেবায় নিজেকে নিয়জিত করেছেন।পরে অবশ্য সবটাই জেনে গেছে।
আকাশের কথাগুলো শুনে পৌষালি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে।ও ঠিক নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না,,যে কেউ ওর জন্য এভাবে রান্না শিখে ওকে ওর জন্মদিনে পায়েস বানিয়ে খাওয়াবে।
— এই দেখেছেন তো।আমিই তো তখন থেকে বকে যাচ্ছি।আপনাকে কিছু বলার অবকাশই তো দিচ্ছি না। আপনি এখন একবার টেস্ট করে বলুন তো কেমন হয়েছে পায়েসটা। আসলে প্রথম রান্না তো,,কেমন হয়েছে ঠিক বুঝতে পারছি না।তবে এক্সাইটেড-ও আছি খুব। নিন নিন এবার টেস্ট করে বলুন কেমন লাগলো।
কথাটা বলতে বলতেই এক চামচ পায়েস টিফিন বক্স থেকে তুলে পৌষালির মুখের সামনে ধরলো আকাশ।
— এবার তো বলুন কেমন লাগলো?
— খুব সুন্দর লাগলো। খুব সুন্দর। আর সত্যি বলছি এটা আমার জন্মদিনের একদমই অপ্রত্যাশিত উপহার ছিলো।তবে এটা আজকের বেস্ট উপহার।
— একি পৌষালি,, আপনার চোখে জল?
— নাহ্,, তেমন কিছু না।আসলে মায়ের পর এমন যত্ন করে নিজের হাতে কেউ কখনো খাওয়াইনি আমাকে।তাই আর কি।
নিন হা করুন তো।শুধু আমি খেলে হবে? যে রান্না করেছে তাকেও তো টেস্ট করতে হবে। তাই না??
মুহূর্তটা ওদের দুজনের মতো করে দুজনের জন্য বেশ কাটলো।একটা নতুন সম্পর্কের শুভারম্ভের সূচনা হয়তো।।
( চলবে )
#গল্প- #পলাশ_ফুলের_বসন্ত ( পর্ব-৭ )
#কলমে – #দেবিকা_সাহা
শহর থেকে শীত পেড়িয়েছে সবে সবে।বসন্তের আগমনে নগরজীবনে যেনো এক নতুনত্বের ছোঁয়া। আর তার সাথে ভালোবাসার এই গোটা সপ্তাহ জুড়ে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ভাবে তাদের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে উদযাপনের আনন্দ।
পৌষালি আজ বেশ সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠেছে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-এর এই দিনে ওর উদযাপনটা বরাবরই একটু অন্যরকম। অনিন্দ্যর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন কখনোই এই দিনটা সেভাবে সেলিব্রেট করতে পারেনি পৌষালি। এই নিয়ে অনিন্দ্যরও অভিযোগের অন্ত ছিলো না। অবশ্য এই বিষয়ে তারও খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না।অন্যান্য সব প্রেমিক প্রেমিকার মতো অনিন্দ্যও চাইতো পৌষালির সাথে পুরো দিনটা নিজেদের মতো করে কাটানো।কিন্তু পৌষালির বরাবরই একটু অন্যরকম চিন্তা, অন্যরকম ভাবনা।তাই অনেক রকমই টুকটাক মতের অমিল থাকতো অনিন্দ্যর সাথে।
যাই হোক,,হঠাৎ করেই ক্যালেন্ডারের পাতায় আবার ঘুরে ফিরে এই ১৪-ই ফেব্রুয়ারি দিনটা আসায় পৌষালিরও কেমন অজান্তেই যেনো অনিন্দ্যর এই অভিযোগ গুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো।
ধুর,,কি সব ভাবছি আমি।কোনো মানে হয় এসবের!! আমার এখন কত্তো কাজ।এই গিফ্ট গুলো প্রপার ওয়েতে ডিস্ট্রিবিউট করে প্যাক করতে হবে।
এসো বাবা ভিতরে এসো।তুমি যে আসবে সেটা তোমার মা একটু আগেই ফোনে বললো।দেখেছো তুমি আসবে আর আমিই আজ থাকতে পারবো না।একটু বাদেই আমাকে বেড়িয়ে যেতে হবে।ইস্,আমি যদি আগে জানতাম যে তুমি আজ আসছো তাহলে কোনো না কোনো ভাবে বেড়োনোটা ক্যান্সেল করব দিতাম।
— আন্টি কোনো ব্যপার নয়।আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।আমার জন্য শুধুশুধু প্ল্যান ক্যানসেল করার কোনো মানেই হয় না।
মধুরিমাদেবী হালকা হেসে আকাশের কথায় সন্মতি জানালেন।
— আচ্ছা আন্টি পৌষালি কোথায়? ও কি বাড়িতে নেই? না মানে একচুয়ালি ওকে কোথাও দেখছি না তো,,তাই আর কি…
— তার কথা আর বলো না।তিনি এখন ঘরেই আছেন।কতো কাজ তার এখন।যাও না ভিতরে গিয়ে দেখো,,সে কতোসব আয়োজন নিয়ে বসেছে।
আয়োজনের কথা শুনিয়ে একটু মনে মনে উৎসাহ দেখিয়েই আকাশ ভিতরে গেলো পৌষালির কার্যকলাপ দেখার জন্য।
একটা টেবিল জুড়ে বই,খাতা,পেন্সিল বক্স,পেন আর কিছু বিস্কুটের প্যাকেট আর চকলেট। আর টেবিলের সামনে বসে খুব মন দিয়ে ওই জিনিসগুলো গোছাতে ব্যস্ত পৌষালি।মেয়েটা খুব মন দিয়ে প্রতিটা জিনিস সুন্দর ভাবে ভাগ করে নিয়ে আলাদা আলাদা প্যাকেটে ভরছে।
ওর এই কার্যকলাপগুলো আকাশের বেশ ভালোই লাগলো। অন্যরকম মনে হলো বেশ।কিন্তু মেয়েটা যে ঠিক কি করতে চাইছে সেটা ঠিক বোধগম্য হলো না আকাশের।তাই কৌতুহল বশত প্রশ্নটা করেই ফেললো।
কি করছেন এগুলো নিয়ে? না মানে এই এতোসব খাতা,পেন,বক্স,চকলেট এসব রাখা….
— আরে আকাশ,, আপনি কখন এলেন?
— এই তো জাস্ট ঢুকলাম।কিন্তু আপনি কি করছেন বলুন তো,, ঠিক বুঝতে পারছি না।আবার বেশ এক্সাইটেডও লাগছে জানার জন্য।
— কি করছি?? ভালো প্রশ্ন করেছেন।কি করছি বলুন তো?
এই প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে আকাশ মাথা নাড়ালো শুধু।
— বুঝলেন না তো!! আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি শুনুন।এগুলো দিয়ে ভ্যালেন্টাইন্স ডে সেলিব্রেশন হবে বুঝলেন তো।
এরকম একটা উত্তর শুনে আকাশ একটু আড়চোখে তাকালো মেয়েটার দিকে।
আরে সত্যি বলছি।আমার ভ্যালেন্টাইনদের সাথে আজকের দিনটা আমি সেলিব্রেট করবো।প্রতিবারই করি জানেন তো।
আকাশকে চুপচাপ ওরদিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে পৌষালি আবার বলা শুরু করলো–
আচ্ছা দাঁড়ান দাঁড়ান,,আমি বুঝিয়ে বলছি আপনাকে। একচুয়ালি কাছেই একটা চাইল্ড হোম আছে।ওখানকার বাচ্চাগুলো আমার খুব ভালো বন্ধু। জানেন তো ওরা না খুব ভালোবাসার কাঙাল।একটু ভালোবাসা যদি আপনি ওদের দেন,, ওরা আপনাকে হাজার গুন ফেরত দেবে।তাই এই ভালোবাসার দিনটা আমি ওদের সাথেই থাকি।বলতে পারেন ওদের সাথে এই দিনটা থাকতে আমি ভালোবাসি।
কথাগুলো বলে পৌষালি একটু থামলো।একটা পরিতৃপ্তির হাসিতে ভরে রয়েছে ওর সারা মুখটা।
আকাশ এক দৃষ্টিতে অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধতার সঙ্গে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।এই দৃষ্টির মধ্যে রয়েছে এক অনন্য পরিতৃপ্তি।
— আপনি একদম অন্যরকম পৌষালি।
— যাহ্,,এটা কি বলে দিলেন আপনি? আমি অন্যরকম কেনো হতে যাবো? আমি তো আর বাকি সবার মতোই একজন।
— নাহ্,,আপনি কারোর মতো নন।আপনি সম্পূর্ণ আপনার নিজের মতোন।এমনটাই থাকবেন সবসময়। আচ্ছা একটা রিকোয়েস্ট করতে পারি?
— অবশ্যই। এতো পারমিশন নেবার কিছু হয়নি।বলুন না কি বলবেন।
— আমাকে নিয়ে যাবেন আপনার বন্ধুদের কাছে? আমিও আপনার বন্ধুদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাই। তারপর আমরা দুই বন্ধু মিলে আমাদের বাকি বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে আজকের দিনটা আনন্দ করবো। কি রাজি তো??
— আপনি?? আপনি সত্যি যাবেন আমার সাথে? আপনি ওদের সাথে আলাপ করবেন সত্যি?
— একদম।এই সুবর্ণ সুযোগ কেউ ছাড়ে বলুন।
আর তাছাড়া আমার ভ্যালেন্টাইনও তো থাকছে সেখানে। একেবারে ডাবল আনন্দ।
আকাশের মুখে এমন একটা কথা শুনে পৌষালি কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে চুপ করে গেলো।
— আরে চুপ করে গেলেন যে!! এই দাঁড়ান দাঁড়ান আপনি কি ভাবছেন যে আমাকে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। যদি এসব ভাবেন,, তাহলে বলবো ভাবনা ছেড়ে দিন।কারন আমি যাবোই।তাই খামোখা এসব নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।আমরা বরং প্যাকিংগুলো তাড়াতাড়ি সেরে নিই। সেটাই কাজে দেবে।।
সময়টা এগোলো বেশ সুন্দর করে।পৌষালির মনের মতো করেই সারাটা দিন গেলো।তবে ও আজ এভাবে আকাশকে নিজের পাশে নিজের সঙ্গে পাবে সেটা আশা করেনি।তবে সবটা তো আর আমাদের আশা অনুযায়ী চলে না।আমাদের প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে একদম অপ্রত্যাশিত ভাবেও কিছু ঘটনা ঘটে।আর সেটাই তো আমাদের কাছে প্রাপ্তি। পৌষালির জন্য আজকে এমনটাই হয়েছিলো।
সন্ধ্যার শহরটাও বেশ সুন্দর আজ। আকাশের আবদারে পৌষালি আজ সন্ধ্যেটা ওর সাথেই রয়েছে।তবে শুধু যে আকাশের আবদারের জন্য তা কিন্তু নয়।কোথাও না কোথাও গিয়ে ওর মনেও একটা আলগা ইচ্ছে ছিলো।আর সেই ইচ্ছে আর আবদারগুলোর প্রতিফলনই আজকের সন্ধ্যেটা।।
আকাশ পৌষালিকে নিয়ে লংড্রাইভে বেড়িয়েছিলো।
শহরের জনবহুলতা পেড়িয়ে একটু নিস্তব্ধ শান্ত শহরতলি এলাকায় একা ফাঁকা রাস্তার পাশে বাইকটা থামালো আকাশ।
— নিন নেমে পড়ুন।এটাই আমাদের গন্তব্যস্থল।
— এখানে?
— হ্যাঁ এখানে।জানেন পৌষালি,,এই জায়গাটা আমার বড্ড প্রিয়,বড্ড কাছের বলতে পারেন।যখনই মনটা মাঝেমাঝে খারাপ লাগতো ছুট্টে চলে আসতাম এখানে। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে অদ্ভুত একটা শান্তি খুঁজে পেতাম।মনটা যেনো এক নিমেষেই শান্ত হয়ে যেতো।। তাই আজ আপনাকেও এখানে নিয়ে এলাম।
পৌষালি চুপচাপ আকাশের কথা শুনে বাইক থেকে নেমে এলো।সত্যি একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে মনে।।
পৌষালি,,চোখটা একবার বন্ধ করুন।
কি?? কিন্তু কেনো??
আরে করুনই না। কারনটা বলে দিলে তো হয়েই গেলো।ক্রমশ প্রকাশ্য।।
পৌষালি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ আকাশের কথাটাই শুনলো।
একগুচ্ছ গোলাপ,একটা গীতবিতান, আর পৌষালির প্রিয় চকলেট এগুলো চুপচাপ আলতো করে পৌষালির হাতে তুলে দিলো ছেলেটা। আর তার সাথে দুকলি গান একদম নিজের মতো করে।
কোরা কাগজ থা এ মন মেরা।
লিখ দিয়ে নাম ইসনে তেরা।।
অনেক সময় বেসুরো গানও স্পেশাল মানুষটির ভালোবাসা মাখানো কন্ঠস্বরে মিষ্টি মধুর আখ্যা পেয়ে যায়।
চোখ খুলে একবারে এতোসব সারপ্রাইজ দেখে পৌষালি বেশ অবাক হয়ে গেলো।আর তার সাথে ভালোলাগারও সীমা রইলো না। চোখদুটো অজান্তেই ভিজে উঠলো ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে।।
দুটো চোখ পরস্পরকে গভীর দৃষ্টিতে উপলব্ধি করতে ব্যস্ত।আর এদের সাক্ষী থেকে গেলো রাতের আকাশের জ্বলজ্বল করা দৃশ্যমান চাঁদ আর তারা গুলো।।
©দেবিকা..
( চলবে )