গল্প -পলাশ_ফুলের_বসন্ত,পর্ব-৮ স্পেশাল ট্রেলার,পর্ব-৯

গল্প -পলাশ_ফুলের_বসন্ত,পর্ব-৮ স্পেশাল ট্রেলার,পর্ব-৯
কলমে-দেবিকা_সাহা
পর্ব-৮ স্পেশাল ট্রেলার

চোখের পাতাদুটো কিছুতেই এক হতে চাইছে না পৌষালির।তবে আজকের ঘুম না আসার কারনটা অন্য। কোনো গভীর চিন্তার জন্য যে ঘুম আসছে না,,এমনটা নয়। আজকের ব্যাপারটা প্রতিদিনকার থেকে একদম আলাদা।বারবার করে চোখের সামনে আজকের দিনে আকাশের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত ভেসে উঠছে।

আচ্ছা এমনটা কেনো হচ্ছে? আকাশের সাথে আমি আজ প্রথম বেড়িয়েছি,, এমনটা তো নয়।তবে কেনো বারবার ওর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার চোখের সামনে ফুটে উঠছে? ওর হাসি মাখানো মুখটা,ওর সেই স্থির দৃষ্টি যা নীরব থেকেও যেনো অনেক কিছু বলতে চায়, ওর সেই এলোমেলো কন্ঠস্বরে যত্ন করে গাওয়া দুকলি গান। কেনো আমাকে ভুলতে দিচ্ছে না? যেনো মনে হচ্ছে ওই মুহূর্তগুলো আমার মনের খাতার পাতাটায় নিজে থেকেই একটা স্থির জায়গা করে নিচ্ছে। যাকে ভুলতে চাইলেও ভোলা যাবে না।আজীবন হৃদয়ে লেখা নাম হয়ে রয়ে যাবে।আমি কি সত্যিই ধীরে ধীরে আকাশকে নিজের মনে জায়গাটা দেওয়া শুরু করেছি??
কই অনিন্দ্যকে নিয়ে তো এমন কিছু মনে হয়নি কখনো? মূহুর্তগুলো তো এভাবে কখনো চিরস্থায়ী ভাবে ধরা দেয়নি আমার মনে।তবে কি আমার অনুভূতি গুলো সব মিথ্যে ছিলো? আমি কি অনিন্দ্যকে সেভাবে কখনো আমার মনে জায়গা দিতে পারিনি? আমি কি ওকে কোনদিনই ভালোবাসতে পারিনি??…..

না না কিসব ভাবছি আমি!! এটা কখনো হতে পারে না।অনিন্দ্যই আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা।অনেকগুলো দিন একসাথে কাটিয়েছি আমরা।ভালোবাসা না থাকলে একসাথে কখনোই থাকতে পারতাম না।কিন্তু….
কিন্তু সেই স্মৃতিগুলো এতো ঠুনকো কেনো আজ আমার কাছে? আজকাল মনে হয় জোর করে মনে করতে হয়। মন আর সেই স্মৃতিগুলোকে যত্ন করে নিজের মাঝে নিবিড়ভাবে আগলে রাখে না।
প্রশ্নগুলো একসাথে এসে একটা অদ্ভুতভাবে জট পাকিয়ে রয়েছে যেনো।চাইলেও সেই এলোমেলো জোটগুলোকে খুলে সোজা সরল ভাবে উত্তরগুলোকে খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু উত্তরগুলোকে যে আমাকে জানতেই হবে।যতোক্ষন পর্যন্ত না এই প্রশ্নগুলোর কোনো সদুত্তর পাচ্ছি,,ততোক্ষন কিছুতেই নিজের মনকে শান্ত করতে পারছি না।কিন্তু উত্তরগুলো আমি পাবো কোথায়? কে দেবে আমায় আমার প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তরের সন্ধান??

পৌষালি কি সন্ধান পাবে নিজের মনের প্রশ্নগুলোর উত্তরের??

চলবে

#গল্প – #পলাশ_ফুলের_বসন্ত ( পর্ব-৯ )
#কলমে – #দেবিকা_সাহা

হাজার প্রশ্ন মনে নিয়েই সেই রাতটা কাটলো পৌষালির। পরেরদিন বেশ ভোর ভোরই উঠলো মেয়েটা।ও ঠিক করে নিয়েছে এরপর ওকে কি করতে হবে।মানে ওর মনের না জানা প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপটা ঠিক করে নিয়েছে পৌষালি।

আকাশের সঙ্গে একবার কথা বলতে হবে।ওকে আমার মনের সব কথা খুলে বলতে হবে।যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। ফোনটা হাতে নিয়ে আকাশের নাম্বারে ফোন করলেও উল্টোদিকের মানুষটার থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না।বেশ কয়েকবার কল করার পরেও উল্টোদিক থেকে একইভাবে নো রেসপন্স। সত্যিই হয়তো এমনভাবে আমাদের ভাবনার সাথে বাস্তবটা কখনো কখনো মেলে না।
হতে পারে আকাশ হয়তো কোনো কাজে আছে।তাই ফোনটা ধরছে না।ঠিক আছে কোনো ব্যপার না।আমি নাহয় ওকে পরেই ফোন করে নেবো।আপাতত কাজের দিকেই ফোকাস করা যাক।নতুন চাকরি,,ঠিকঠাক করে মন দিয়ে কাজগুলো করতে হবে।পৌষালি আপাতত মনের বেহিসাবি ভাবনা গুলোকে মনেই থাকতে দিয়ে নিজের কাজের দিকে ফোকাস করো।
সেদিনের পর আরো দুটো দিনের সময়টা হয়তো খুব তাড়াতাড়িই অতিবাহিত হয়েছিলো।পৌষালি আর আকাশের বুঝে ওঠার আগেই অনেক মুহূর্ত আপন তালেই নিজের মতো করে নিজেদের বিস্তৃত হওয়ার প্রাক মূহুর্ত গুনছিলো।

কি রে পৌষালি,, আকাশ দুদিন বাদে বাইরে চলে যাচ্ছে শুনলাম। কই এটা তো তোর মুখে শুনিনি।এই তো সেদিনই কথা হলো ছেলেটার সাথে। তখনো তো এই বিষয়ে কিছু শুনিনি।হঠাৎ করে এইভাবে বাইরে চলে যাচ্ছে!!!
মায়ের মুখে আকাশের চলে যাওয়ার কথাটা শুনে পৌষালি কেমন যেনো একটু হকচকিয়ে গেলো।
— কি? আকাশ চলে যাচ্ছে মানে? কোথায় যাচ্ছে ও?
— ওমা। তুই জানিস না? ও তো ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছে। পরশুই ওর রিজারভেশন। ওর মায়ের মুখেই আজ শুনলাম।উনিই ফোন করে বললেন। জানিস তো উনিও ঠিক এভাবে আকাশের হঠাৎ করে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। আকাশের নাকি কি একটা এমার্জেন্সি কাজ পরে গেছে।সেই জন্যই নাকি এতো তড়িঘড়ি করে ছুটতে হচ্ছে।

পৌষালিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পৌষালির মা আবার বলতে শুরু করলো–
আচ্ছা তুই এতোটা অবাক হলি কেনো বল তো? আকাশের সাথে তোর তো কথা হয়।তুই কি জানতিস না আকাশের ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার ব্যপারটা?

মায়ের প্রশ্নে পৌষালি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো —
না মা আসলে…. দুদিন ধরে কাজের এতো চাপ যাচ্ছিলো না,,যে সেভাবে আর আকাশের সাথে কথা বলার সময় হয়ে ওঠেনি।তাই হয়তো ওর যাওয়ার ব্যপারটা ও আমাকে বলে উঠতে পারেনি।আমি আজকেই ওর সাথে একবার কথা বলবো এই বিষয়ে।আর নিশ্চই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজই আছে।নাহলে এরকম সিদ্ধান্ত আকাশ কখনোই নিতো না।

— দেখিস বাবা। তোদের কিন্তু বিয়ে ঠিকঠাক। শুধু তোদের চারহাতটা এক করার অপেক্ষা। অবশ্য বিয়েটা কিন্তু তোদের ইচ্ছেতেই পিছোনো হয়েছে।এখন যেনো এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় যাতে……
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন উনি।
আসলে মা তুই বুঝতে পারছিস তো যে আমি ঠিক কি বলতে চাইছি। ঠিক আছে তুই কাজ কর। আমি আসছি।

মা চলে যেতেই পৌষালি পাশের সোফাটাতে বসে পড়লো।মাথাটা কেমন একটা ধরে আসছে।কি হয়েছে আকাশের? ও এতোবড়ো একটা সিদ্ধান্ত এভাবে হঠাৎ করে নিয়ে নিলো? আমি কিচ্ছু জানতে পারলাম না!! কি করে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারলো ও? আমাকে একবারের জন্য জানানোর প্রয়োজনই মনে করলো না।উপরন্তু আমি এতোবার ফোন করলেও ছেলেটা একবারের জন্যেও ফোনটা ধরেনি।কি হচ্ছে এসব? কিচ্ছু বোধগম্য হচ্ছে না আমার। আচ্ছা আমি কি আকাশের জীবনে এই প্রায়োরিটি টুকুও পাই না? আমার কি এটুকু অধিকার ওর উপর এখনো জন্মাইনি যার জন্য এই কথাটা ও আমার সাথে শেয়ার করতে পারলো না।
না না আমাকে জানতেই হবে। আমাকে আকাশের সাথে কথা বলতে হবে।
আজই।হ্যাঁ আজকেই আমার ওর সাথে দেখা করতে হবে। কি হয়েছে ওর এটা আমাকে জানতেই হবে।

আর মাত্র দুটো দিন।তারপর আমি তোমার জীবন থেকে অনেকটা দূরে চলে যাবো পৌষালি।নীরবেই নিজের মতো করে তোমার জীবনে এসেছিলাম।আর নীরবেই তোমার জীবন থেকে দূরে চলে যাবো।অনেক অনেক দূরে।তুমি ভালো থেকো এখানে তোমার ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে। তবে হ্যাঁ পৌষালি তোমায় আমি কক্ষনো ভুলতে পারবো না।এজীবনে হয়তো কোনোদিন আকাশের জীবন থেকে পৌষালির নামটা মুছে ফেলা সম্ভব হবে না।আমার জীবনের সাথে, আমার মনের প্রতিটা কোনায় খুব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেছো তুমি।যেটাকে অস্বীকার করাটা আমার অক্ষমতা। অবশ্য আমি অস্বীকার করতেও চাই না।এটা আমার জীবনের ধ্রুব সত্যি।এই কয়েকদিনের তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মূহুর্ত আমার মনে প্রজ্জ্বলিত থাকবে,,,ঠিক যেমন আকাশের বুকে তারা-রা জ্বলজ্বল করে।

এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই চোখের কোনাটা কেমন যেনো চিকচিক করে উঠলো আকাশের।
না না আমার চোখে জল কেনো? আমার তো আনন্দ হওয়ার কথা।আমি যে আমার ভালোবাসার মানুষটাকে তার ভালোবাসার কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছি।এর থেকে আনন্দের কি-ই বা হতে পারে!!
তবে পৌষালি একটাই আফসোস জানোতো,, আমরা তো বন্ধু ছিলাম বলো।তুমি আমাকে ভালোবাসতে হয়তো পারোনি,,কিন্তু বন্ধু তো ভাবতে।তাহলে নিজের মনের কথাটা, নিজের ভালোবাসার কথা একবারের জন্যেও কি শেয়ার করা যেতো না এই বন্ধুর সাথে? না কি আমি এতোটাই অযোগ্য মনে হয়েছিলাম তোমার কাছে? এতোটাই স্বার্থপর মনে হয়েছিলো তোমার আমাকে?
কিন্তু তুমি ভুল ছিলে পৌষালি। আমি নিজের ভালোবাসার কাছে এতোটা স্বার্থপর কোনোদিন ছিলাম না।আর কক্ষনো হবোও না।আমি ফিরিয়ে দেবো তোমাকে তোমার ভালোবাসার কাছে।তোমাদের দুজনের মাঝখানে আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না কক্ষনো।আমি সব ঠিক করে দেবো।

— আসতে পারি?
চেনা কন্ঠস্বর শুনে ওদিকে ফিরে আকাশ যাকে দেখলো,,তাকে দেখে আরেকবার স্থির হয়ে গেলো ছেলেটা।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো উল্টোদিকের মানুষটার দিকে।
— কি হলো ঘরে আসতে বলবেন না?
প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে কয়েকটা কথা সাজিয়ে নিয়ে আকাশ এবার বলা শুরু করলো —
— আপনি এখানে হঠাৎ?? না মানে…..
বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো? ভিতরে এসো।
— না এসে আর উপায় কি? আপনি তো ধনুরভাঙা পন নিয়ে আছেন আমার ফোনটা ধরবেন না বলে। তাই আমাকে ডিরেক্ট এখানেই আসতে হলো। আপনার সাথে যোগাযোগ করে আসবো একবার ভেবেছিলাম।কিন্তু আবার মনে হলে আপনি যদি কাজের অযুহাতে দেখা না করেন,,, তাই আন্টির সাথে কথা বলে শুনলাম আপনি বাড়িই আছেন।আর আমিও এই সুযোগটা মিস করলাম না।চলে আসলাম আপনার বাড়িতে।এবার বলুন তো আপনার ব্যপারটা কি??

আজ পৌষালিকে কতোটা স্বতঃস্ফূর্ত দেখাচ্ছে।আলতো হাসিতে ভরে উঠেছে মেয়েটার মুখটা।যেনো মনে হচ্ছে বসন্তের রঙ নিজে এসে ধরা দিয়েছে আমার পৌষালির মুখে।হয়তো অনিন্দ্যর সাথে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেছে।তাই ওকে এতোটা আনন্দিত দেখাচ্ছে।অবশ্য সেদিন কফিশপে ওদেরকে দেখেই বুঝেছিলাম,,ঝামেলাটা হয়তো মিটেই যাবে।।

— কি হলো আবার? আপনি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন বলুন তো? অবশ্য জানেন তো কয়েকদিন ধরে একটা কথা,একটা চিন্তা খুব ভাবাচ্ছিলো আমায়।একটা উত্তর খুঁজছিলো মন।অনেকদিনের না মেলা প্রশ্নের উত্তর। আর তার উত্তরটা আমি পেয়ে গেছি।
অবশ্য আপনার কথাটা বলুন তো। কি হয়েছে আপনার? কোনো কথা নেই,বার্তা নেই আপনি নাকি ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন?

— আপনি যে আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন,, সেটা আমি জানতাম।

— জানতেন? কি করে জানতেন? আচ্ছা বাদি দিন।আপনি আগে বলুন তো এভাবে হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে এতো দূরে ট্রান্সফারের সিদ্ধান্তটা নিলেন কি করে? আর কয়েকদিন ধরে ফোনটা কেনো……

— হঠাৎ করে না তো।বলতে পারেন আমার এখানকার কাজ ফুরিয়েছে,,,তাই হয়তো এখানে আর আমাকে কারোর দরকার হবে না।আর কয়েকদিন ধরে কাজ ছিলো,,তারপর গোছগাছও ছিলো এই যাওয়াটা নিয়ে।তাই আর আপনার সাথে কথা হয়নি।আসলে বুঝতেই তো পারছেন দুদিন পরেই ট্রেন।
আচ্ছা আপনি চা খাবেন তো?? দাঁড়ান আমি বানিয়ে আনছি।আপনার জন্য চা বানানো-টা শিখেছিলাম।যদিও সেটার হয়তো আর দরকার হবে না।তবুও শেখা তো কখনো ফেলনা যায় না।যাই হোক,,,আপনি একটু বসুন।আমি আসছি।

আকাশের মুখ থেকে এরকম একদম অপ্রত্যাশিত কথা শুনে পৌষালি যেনো কেমন চমকে উঠলো।
আকাশকে আজ বড্ড অচেনা লাগছে।কেনো বললো ও এরকম? ওর প্রয়োজন ফুরিয়েছে মানে? ও কি জানে না,, আমার জীবনে সব থেকে প্রয়োজনের মানুষটা এখন ও? আকাশ আমার কথাটা একবারের জন্যেও ভাবলো না!! আর আমি আমার কোন প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পেয়ে গেছি,,সেটা একবারের জন্যেও জানতে চাইলো না?? উলটে ও বললো ও নাকি জানতো আমি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়ে যাবো।সবকিছু জানার পরেও ও এভাবে চুপ করে থাকতে পারলো? কি করে পারলো?
আকাশকে যে আজ আমার বড্ড অচেনা লাগছে। এই আকাশের সাথে আগের সেই হাসি মুখের ছেলেটার যে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না আমি।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অজান্তে পৌষালির চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।।

দেবিকা..

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here