মায়াজালে_আবদ্ধ
পর্ব_৪
কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
জুনায়েদ খবরটা পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো হসপিটালের দিকে। মেয়েটা প্রচুর মিশুক আর হাসিখুশি ছিল আর এমন একটা মেয়েকে কেউ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্য মেরে ফেলতে পারে বলে জুনায়েদের বিশ্বাস হলো না। মেয়েটা ওদের অফিসের বেশ পুরাতন আর দক্ষ একজন কর্মি ছিল। মেয়েটার বাবা নেই মাকে নিয়ে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। অবশ্য একটা বড় ভাই আছে কিন্তু ওদের কোনো খোঁজ খবর রাখেনা বিয়ে করে আলাদা থাকে।। মেয়েটার কিছু হলে ওর মায়ের কি হবে ভেবেই খারাপ লাগছে ওর। জুনায়েদ এই কয়েকমাস নতুন অফিসে যাচ্ছে তাই ওখানের সব কাজ কার্ম শিখতে মেয়েটা ওকে সাহায্যে করতো। সারা রাস্তা ওর কেমন অস্থিরতার মধ্যেই পার হলো। হসপিটালের সামনে এসে ও তাড়াতাড়ি বাইক রেখে ভেতরে চলল। সদর হসপিটালে আসাটা জুনায়েদ খুব একটা পছন্দ করেনা কারণ রুগীর গুরুত্ব এখানে খুব একটা হয়না।। হাজারো মানুষের ঢল নামে টিকিট কাউন্টারের সামনে ওটা দেখেই মেজাজ বিগড়ে যায়। হাজারটা রুগী কিন্তু ডাক্তার একটা। দুপুরের পরে এরা আবার রুগী দেখাও বন্ধ করে দেই তাই এতো সমস্যা। সরকারি হসপিটাল জনগণেরর সেবার জন্য কিন্তু এখানের কর্মিগণের ব্যবহার দেখলে মনে হয় সবটা এমনি ফ্রি ফ্রি দিচ্ছেন।। জুনায়েদ টিকিট কাউন্টারের পাশ দিয়ে লাশ ঘরের সামনে দিয়ে এগোতে থাকলো। ওর বাম পাশে সিঁড়ির নিচে দুজন মহিলার লাশ রাখা আছে চাদরে ঢাকা হঠাৎ ওটার দিকে তাঁকিয়ে ওর বুকের মধ্যে কেমন করে উঠলো। বেঁচে থাকলে হয়তো এরা কখনও এখানে পড়ে থাকতো না। কতো যত্ন, কতো প্রসাধনী, আরও কতো কিনা আমাদের শরীরের জন্য আমরা ব্যবহার করি কিন্তু মরে গেলে এই শরীরের কোনো দাম নেই। আত্মীয় পরিজন কেউ সাথে থাকবে না, আপনার বলতে সাদা একখণ্ড কাপড়। কথা গুলো ভেবেই জুনায়েদের চোখ দুইটা ছলছল করে উঠলো। আসলে মানুষের মন যখন দুর্বল হয়ে পড়ে যখন সবার কষ্টকেই নিজের বলে মনে হয়। ও পকেট থেকে রুমাল টা বের করে চোখ টা মুছে 223 নাম্বার রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। এখানে বাইরে ভেতরে সব জায়গায় রুগী আর রুগী। রুমের বারান্দায় রুগীরা সব বিছানা পেতে শুয়ে শুয়ে আছে।পাশে পরিবারের লোকজন বাতাস করছে কেউ ওষুধ দিচ্ছে। জুনায়েদ সাইড করে দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো পিউ শুয়ে আছে আর ওর মাথার কাছে ওর মা বসে আছে। পাশে অফিসে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ভেতরে আসতে দেখে সবাই সালাম দিয়ে সরে গেলো। পিউ ঘুমিয়ে আছে। জুনায়েদ কথা বলে বুঝলো ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। ওর একটা পা আর একটা হাত ভেঙেছে তাছাড়া তেমন কিছু হয়নি। প্রচণ্ড বমি হয়েছিল তাই ডাক্তাররা সন্দেহ করছিল যে ভয়ানক কিছু হয়েছে কি না! কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। জুনায়েদ পকেট থেকে কিছু টাকা নিয়ে পিউয়ের মাকে দিয়ে বলল,
> আন্টি টাকা গুলো রাখেন কাজে আসবে। আর আমি ওষুধের দোকানে কথা বলে নিবো এখানের যা বিল হয় আমাকে জানাতে। আপনাকে এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
>বাবা এই একটা মাত্র অবলম্বন ছিল আমার। জানিনা কে আমার এমন সর্বনাশ করলো। কান্না করে
> বাড়িতে আপনারা দুজন মাত্র ছিলেন তাহলে ওকে এমন করে ধাক্কা দিলো কে কিছু বুঝতে পেরেছেন?
> না বাবা আমি কাউকে আসতে দেখিনি আবার যেতেও।
> এমন ও তো হতে পারে ও নিজেই অসাবধানতার জন্য পড়ে গেছে। আপনাকে কে বলল যে ওকে কেউ ধাক্কা দিয়েছে?
> ওকে যেখান থেকে ফেলে দেওয়া হয় আমি তার নিচেই ছিলাম। ও বারবার বলছিল আমাকে ফেলো না প্লীজ আমাকে ছেড়ে দাও।
> আচ্ছা আমি পুলিশের সাথে কথা বলে দেখবো ভালোভাবে তদন্ত করার জন্য। আপনি চিন্তা করবেন না।
তবুও ভদ্রমহিলা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করলো ওর হাত ধরে। এর জন্য জুনায়েদের বেশ বিরক্তও লাগলো কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না। এমনিতেও ও ডিপ্রেশনে ভুগছে, নিজের যন্ত্রণায় কাতর তারপর আবার ওর সামনে এমন কান্নাকাটি করছে দেখে ওর ইচ্ছা করলো ছুটে পালিয়ে যায়। ও কোনো রকম বুঝিয়ে শুনিয়ে ওখান থেকে বের হয়ে অফিসে চলে আসলো। সারাদিন ওর এখানেই কাটলো। কিছুতেই কাজে মন বসছে না। কিছু একটা করছে আর বারবার ল্যাপটপে রীমলির ছবি নিয়ে বসে থাকছে। দূরে বসে জয়নাল সাহেব ছেলের দিকে তাঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। উনি বুঝতে পারছেন ছেলের মনের অবস্থা কেমন। অল্প বয়স মন মানসিকতা কতক্ষণ ভালো থাকবে তার গ্যারান্টি নেই। যদি একা থাকতে থাকতে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে তখন কি হবে ভেবেই উনি শিউরে উঠলেন। আর দেরী করা ঠিক হবে না ভালো একটা মেয়ে দেখতে হবে। বিকালে অফিস থেকে বের হয়ে কিছুদূরে আসতেই জুনায়েদের মনে হলো অলির বান্ধবীর বোনের জন্মদিনের গিফট কেনার ছিল কিন্তু এটা তো কেনা হলো না। মেয়েটা ছোট কি বড় এটা তো ওর জানা নেই। গিফট কিনতে হলে তার সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয় কিন্তু ওর জানা নেই। অনেক ভেবে ও ঠিক করলো অলির বান্ধবীর বোন তাহলে আর কতই বড় হবে পিচ্ছি হবে হয়তো। তারপর বেশকিছু পর জুনায়েদ ভাবে মার্কেট থেকে পছন্দ করে খুব সুন্দর একটা কথা বলা ডল আর সাথে কয়েক বক্স চকলেট নিয়ে বের হলো। সারাদিন বাইরে থেকে ও বেশ ক্লান্ত তাই বাড়িতে ফিরে এসে ফ্রেস হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।।ও সারাদিন মানুষের মধ্যে ছিল কিন্তু এখন ওর বেশি করেই রীমলিকে মনে পড়ছে। ইচ্ছা করছে একটা ফোন করতে এই ইচ্ছা টা ওর কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়ানক আকার ধারণ করবে তখন কিছুতেই মনকে শান্ত রাখতে পারবে না। জুনায়েদ অস্থির হয়ে বিছানা থেকে উঠে ছাদের দিকে চলল। গোধূলি লগ্ন আকাশে সিঁদুরে রঙের মেঘের ভেলা মন ভালো থাকলে এই সময়টাতে জুনায়েদ বেশ উপভোগ করে কিন্তু আজ সারা মন জুড়ে বিষাদের ঘনঘটা, কোথাও এতটুকু শান্তি নেই। সন্ধ্যা হতে চলেছে তাই আশেপাশের তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দূরের বিল্ডিংয়ের ছাদে দুইটা কাক বসে আছে জুনায়েদ সেদিকেই তাঁকিয়ে আছে কিন্তু হঠাৎ ওর সেই বাম সাইডের বিল্ডিং থেকে চিকন মিষ্টি কন্ঠে ডাক আসলো,
> হ্যালো শুনছেন আপনাকে বলছি।
জুনায়েদ পেছনে ঘুরে তাঁকিয়ে দেখল সেদিনের সেই মেয়েটা ওকে হাত নেড়ে ইশারা করছে আর ডাকছে। ও ভ্রু কুচকে গম্ভীর হয়ে বলল,
> আমাকে ডাকছেন? এগিয়ে গিয়ে
> জ্বী আপনাকে ডাকছি, আশেপাশে আপনি ছাড়া আর কি কেউ আছে যে তাকে ডাকবো?
জুনায়েদ আরও সামনে এগিয়ে প্রায় কাছে গিয়ে বলল,
> হুম বলুন কেনো ডেকেছেন?
> আপনি দেখতে অনেক সুন্দর আর আপনার ওই যে ভ্রু দুইটা কুচকে রাখেন ওইটা আরও অসাধারণ লেগেছে আমার। আপনি হাসতে তো জানেন কিন্তু কিছুদিন এমন মুখ কালো করে থাকেন কেনো দুঃখ পেয়েছেন তাইনা? হেসে
পিচ্চিটার কথা শুনে জুনায়েদ ঘাবড়ে গেলো তবুও মুখে হাসি নিয়ে অমতা অমতা করে বলল,
> পিচ্চিরা পড়াশোনা আর খেলাধূলা নিয়ে নাক গলাবে তাদের কি দরকার বড়দের ব্যাপারে নাক গলানোর।
> মোটেও আমি পিচ্চি নয়। গতমাসে আমার আঠারো পার হয়েছে,তাই আমি আর পিচ্চি নেই। বড় হয়েছি। এখন আমার বিয়ের বয়স চলছে।
> আঠারোতে আপনার পিচ্চি পিচ্চি ভাবটা এখনো কাটেনি তাই বড় হতে আরো দুবছর লাগবে।বুঝলেন তো মিস পিচ্চি?
> আপনি কি জানেন না কুড়িতে মেয়েরা বুড়ি হয়ে যায়। আমি বুড়ি হতে চাইনা। এখন বিয়ে করবো কুড়িতে গিয়ে গুলুমুলু একটা বেবি কোলে নিয়ে ঘুরবো। বাহ কি মজা।
> এগুলো কি বাড়িতে জানে?
> না। এই আপনি একটু সাহায্য করেন না প্লীজ। আমার হয়ে আম্মুকে বুঝিয়ে বলবেন। কি সব ছাইপাশ পড়াই কিছুই আমার মাথায় যায় না। আম্মুর বললাম বিয়ে দিয়ে দিতে কিন্তু আম্মু বলেছে বিয়ে হয়ে যদি দশটা বাচ্চার মা ও হয়ে যায় তবুও আমাকে এইচ এস সি পাশ করতে হবে। পড়াশোনা ছাড়া যাবে না।
> আমি কোনো সাহায্য করতে পারবো না। আর উনিতো ঠিকই বলেছেন। যাইহোক পিচ্ছি আজ আসি।
> চলে যাবেন? আর একটু থাকেন না।
> পিচ্চি আপনার এখন পড়াশোনা করার বয়স। এই বয়সে প্রেম ভালোবাসা ভালো নয়। নিচে গিয়ে পড়তে বসেন। আপনার নজর তো দেখছি একবারে উপরের দিকে। এটা কিন্তু ভালো না।
> আপনি একটুও ভালো না।
> হুম জানি তো ভালো না।
মেয়েটা ওর দিকে অভিমান করে ঝাড়ি দিয়ে চলে গেলো। জুনায়েদ সেদিকে তাঁকিয়ে অবাক হয়ে ভাবছে এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে ওর সাথে এমন সাবলীল ভাবে কথা বলে চলে গেলো যেনো মনে হলো কতদিনের চেনা, কিন্তু এটা একটুও আজব ব্যাপার নয়, সময় পরিবর্তন হয়েছে আগেকার দিনের মতো বাচ্চারা এখন আর বড়দের দেখে লজ্জা বা ভয় কিছুই পায়না। এরা ছোট থেকেই অনেক কিছু শিখে যায় । ও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে এসে ফাইল খুলে বসলো। দুদিনের কাজ জমে আছে তার উপর আবার পিউয়ের কাজ গুলোও আছে সব ওকেই দেখতে হবে। জুনায়েদ মন দিয়ে কাজ করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেলো। কাজের ফাঁকে ও রাতের খাবার শেষ করে আবারও কাজে মন দিলো। নির্জন রুম মাথার উপরে সিলিং ফ্যানটা অনবরত ঘুরছে। দেয়াল ঘড়ির কাটা প্রায় দুইটা ছুই ছুই। ও একবার তাঁকিয়ে আবারও ফাইলের দিকে তাঁকালো। হঠাৎ এমন সময় ওর মনে হলো ঠিক ওর পেছনে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। জুনায়েদের কেমন অস্বস্তি হচ্ছে ও আর অপেক্ষা না করে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাঁকিয়ে দেখলো কেউ নেই। ও হাফ ছেড়ে বাঁচলো তারপর ভাবলো আর কাজ করা ঠিক হবে না। তাই ও সব গুছিয়ে রেখে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। বিছানায় শুলেই যে ঘুম আসবে এমন তো নয়। কতকিছু ভাবনা চিন্তার পর ওর ঘুম ধরলো তাও খারাপ একটা স্বপ্ন দেখে ভোর রাতে আবারও ঘুম ভেঙে গেলো। জুনায়েদ ল্যাপটপ নিয়ে বসলো উদ্দেশ্যে আবারও রীমলির ছবি দেখা। কিন্তু ও কিছুতেই সেই ছবি গুলো পেলো না। খুঁজতে খুঁজতে ও ক্লান্ত হয়ে পড়লো তবুও পেলো না। ওর ভালো করে মনে আছে রাতে ঘুমানোর আগেও সব ঠিক ছিল তাহলে এগুলো কি আপনা আপনি ডিলিট হয়ে গেলো? ল্যাপটপে ছবি রেখেছিল তাই আর ফোনে কোনো ছবি রাখা হয়নি। শেষ স্মৃতি বলতে আলমারিরে ওর দেওয়া নীল রঙের একখানা পাঞ্জাবী রাখা আছে। জুনায়েদ তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেম আলমারি খুলে পাঞ্জাবীর প্যাকেটা টা খুঁজছে থাকলো কিন্তু এটাও এক অজানা কারণে গায়ের। ও মেজাজ প্রচুর খারাপ হলো। ইচ্ছা করলো সব কিছু ভেঙে তছনছ করে ফেলতে কিন্তু করলো না। দুহাতে নিজের চুল গুলো জোরে টানতে শুরু করলো। মনে হলো সব রাগ নিজের উপরে একবারে ঢেলে দিতে। চারদিকে আলো ফুটে উঠেছে এর মধ্যেই বাইরে থেকে অলি দরজায় দাঁড়িয়ে অনবরত ডাকতেই আছে। জুনায়েদ নিজেকে স্বাভাবিক করে চুলটা ঠিক করে দরজা খুলতেই ও বলল,
> ভাইয়া তোমার ফোন বন্ধ কেনো? রাত থেকে পিউ আপুর বাসা থেকে তোমাকে ফোন করছে। আপু গতকাল রাতে মারা গেছে তোমাকে এখুনি যেতে বলল।
> কে বলেছে তোকে? গতকাল তো ঠিকই ছিল।
> জানিনা ভাইয়া তুমি তাড়াতাড়ি যাও। একটু আগে আন্টি ফোন দিয়ে বললেন। আব্বু ও যাচ্ছেন।
জুনায়েদ খবর পা পেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে চেঞ্জ করলো। জুনায়েদ বুঝতে পারছে না ডাক্তার বলেছিল সামান্য লেগেছে ভয়ের কিছু নেই তাহলে মেয়েটা মারা গেলো কেনো? এটাকি কাকতলীয় নাকি হত্যা?
চলবে