অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ০৪,০৫

অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ০৪,০৫
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ০৪

আগে চোখ বন্ধ করতেই একটা মেয়ের খিলখিলিয়ে হেসে ওঠার মুখটা চোখের সামনে ভাসত। মূলত ভাসত না, তবে নিজের কল্পনায় ধরে নিয়েছিল সে সে তার সামনে দাঁড়িয়ে আবার ঠিক একই ভাবে হাসছে। সেই হাসির ঝংকারে দ্রোহ নিজে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে বারবার। আবার নতুন করে গড়ে উঠে আবার ভেঙে পড়ছে। কিছুই করার নেই। প্রথম অনুভূতি ছিল তার জন্যই। আজও আছে। সেই কিশোরের শেষ পর্যায়ে এসে সেই অনুভূতির প্রগাঢ়তা বুঝলেও প্রকাশ করতে পারেনি। তার প্রথম অনুভূতি অপ্রকাশ্য-ই রয়ে যায়। অনুভূতি প্রেমের নাকি অন্য কিছুর, সেসব তখন ভাবেনি দ্রোহ। এখনো ভাবে না সে। মানুষটার সাথে যোগাযোগের ন্যূনতম সুযোগ যেখানে নেই, সেখানে অনুভূতির নামের কথা চিন্তা করে লাভ কি? হতেই পারে, সে এখন স্বামী সংসার নিয়ে ভালোই আছে। মানুষ মন যেমন-ই হোক, দ্রোহের মন স্বার্থপর, খুব। নিজেই এটা মানে দ্রোহ। তাই তো আর তাকে নিয়ে কিছুই ভাবে না। শুধু হাসি মুখের কল্পনা করার অধিকারটুকু ছাড়েনি। এইটুকু নিজের কাছেই রেখেছে, জোর করে। এরপর ভার্সিটিতে ওঠার পর বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কিংবা এক প্রকার অদৃশ্য চাপে একটা নামমাত্র রিলেশনে গিয়েছিল সে। যদিও গুনে গুনে মাসে একবারও দেখা করেছে কি না সেটায় যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। না কোনোদিন কথা বলেছে আর না তার কোন কথা শুনেছে, এমনকি রিলেশনের কয়েক মাস পরে তো এমন প্রশ্ন করতেই দ্রোহকে দেখা গিয়েছে,

“তোমার নামটা জানি কি ছিল?”

তারপর মেয়েটা নিজেই হতাশ হয়ে সরে আসে। অবশ্য শুরুটাও সে-ই করেছিল। দ্রোহ শুধু হ্যাঁ বলেছে। সেই নিয়ে কোন দিন মাথা ঘামায়নি দ্রোহ। মাঝে মাঝে নিজের কাজের জন্য মেয়েটার উপর মায়া কাজ করত। হয়তো প্রথমে ‘না’ বলে দিলেই সব ঠিক হয়ে যেত! তবে পরমুহূর্তেই আবার সব ভুলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। সারাদিনের কাজের পর কি আর নিজের জন্য ভাবার সময়টুকু মেলে তার?

তবে আজ সেই ষোড়শী মেয়ের জায়গায় ভেসে উঠেছে চব্বিশ বছর বয়সী এক যুবতীর ছবি। পরনে লাল পাড় বিশিষ্ট সাদা শাড়ি। আর কিছুই নেই। না সাজগোজ, না অলংকার। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যেও তো সাজা যায় একটু। শুধু এক পলকের জন্যই দেখেছিল। তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। শুধু একবার যখন পিছনে ঘুরল, তখন-ই দেখতে পেল তাকে দ্রোহ। আর না। ওই এক ঝলক ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল দ্রোহকে। সবার হাসি মুখের মাঝে তার মুখের ভাবটা আলাদা করতে পারল দ্রোহ। আনন্দ নেই সেই মুখে। ঠোঁটের কোণে যেই হাসি সে সেই প্রথম দিন দেখেছিল, সেই হাসিটুকুও নেই। চোখ-মুখ জুড়ে বিষণ্ণতার ছাপ। তবুও সবার সামনে প্রকাশ করছে না। জোরপূর্বক আটকে রেখেছে নিজের অনুভূতিকে। সূর্য ডোবার পূর্বের আলো তার টলমলে চোখে প্রতিফলিত হয়। কিসের টানে মেয়েটা পিছু ফিরেছিল, তাও জানা নেই দ্রোহের। কিন্তু ওই এক ঝলকে কোন মেয়েকে এতো সূক্ষ্মভাবে দেখল কি করে- সেই প্রশ্ন এসে হানা দিল মস্তিষ্কে। উত্তর পাওয়ার জন্য আর চিন্তা করল না। পরে ভাবা যাবে। ভিড়ের মাঝেও মেয়েটাকে চোখের আড়াল হতে দিল না সে। সামনে এগুতেই হাতে টান অনুভব করল। আর পিছু নেওয়া হলো না রেখার। হাতের দিকে তাকাতেই কারো কথা ভেসে আসলো তার কানে,

— এখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন নব? বাবা মা তো সামনে চলে গিয়েছে। আয় দ্রুত।

— আসছি।

বলেই আবার পিছনে তাকাল দ্রোহ। রেখাকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পেরেও কিছু করল না। শুধু রিহানের সাথে হেঁটে চলল। মন চাইল, সেইদিনের মতো করে ওড়নার কোণের বদলে আজ শাড়ির আঁচল ধরে আটকাতে। জিজ্ঞেস করছে, কেন সেই মুখে হাসি নেই। কিন্তু সুযোগ থাকলেও এমন একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার অধিকার কি আর দ্রোহের আছে?

সারাদিনের ছুটোছুটি শেষে বাড়ি ফিরেছিল দ্রোহ। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে মামা, মামি, মামাতো দুই ভাইয়ের সাথে সেও বের হয়েছিল বিকালে। তার আগে সকালে রিহান আর রাহাতের সাথে বৈশাখী মেলা ঘুরে এসেছে। রমনায় গিয়ে ছবিও তুলে এসেছে শখানেক। সবগুলো রাহাত-ই তুলেছে। ফটোগ্রাফির দিকে তার ঝোঁক বেশি। সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে বেশ ক্লান্ত দ্রোহ। মামাবাড়িতে ফিরেই শ্রান্ত চোখজোড়াকে বিশ্রামে রাখার জন্যই বন্ধ করেছিল নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে। কিন্তু রেখার ওই এক ঝলক সামনে এক বার ভেসে এসে যেন সেখানে বাড়ি তৈরি করল। আর সরছে-ই না। সেই বিষণ্ণ চাহুনি চিনচিনে ব্যথার উদ্রেক ঘটাল দ্রোহের বুকে। অনেকক্ষণ পরও যখন রেখা দ্রোহের মস্তিষ্ক থেকে নিজ দায়িত্বে বের হলো না, তখন সে নিজেই চোখ খুলে ফেলল বুকে হাত দিয়ে।

নিজের এসব চিন্তা ভাবনাকে এতদিন রেখার বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করার ফল হিসেবে ধরে নিয়ে ঠিক করল আজ আর সে যাবে না। রেখাকে নিজের চিন্তা থেকে বের করতেই হবে। যে করেই হোক, আপাতত সে চোখ বন্ধ করবে না। তাই চলে গেল রিহানের ঘরে। তাকে জ্বালালে কিংবা মামাকে জ্বালালে এসব ভুলে যাবে সে- এই ভেবে। অনেক রাত পর্যন্ত তাদের সাথে গল্প গুজব করে নিজেকে আরও ক্লান্ত বানিয়েই তবে নিজের ঘরে ফিরল দ্রোহ। বিছানায় শুয়ে পড়তেই রাজ্যের ঘুম হানা দিল তার চোখে। আর কিছু ভাবা সম্ভব হলো না।

__________

চায়ের কাঁপে থাকা চা অনেক আগেই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। জানালা বেয়ে আসা হিমশীতল বাতাসে জমে যাওয়ার অবস্থা রেখার। রাত একটা, দেড়টা, দুটো করে এখন আড়াইটা বাজার উপক্রম। ঠাণ্ডা অনুভুত হচ্ছিল আগে। কিন্তু এখন যেন কিছুই অনুভব করতে পারছে না সে। নিজের ডান হাত বাম বাহুতে ছোঁয়াতেই শরীরের তাপমাত্রা আন্দাজ পারল রেখা। নিজের চোখের বিরুদ্ধে লড়াই আর চালিয়ে রাখতে পারছিল না। কোন মতে এক বারে কাপে থাকা ঠাণ্ডা, তেঁতো চা পান করে নিল সে। অজানা অনুভূতি হানা দিচ্ছে মনে। অবশ্য অজানা নয় রেখার কাছে, তবে সে মানতে নারাজ। ৫-৬ দিনের পরিচয় যেখানে মাত্র ২ দিন কথা হয়েছে, তার প্রতি অভিমান করা বড্ড বেমানান। রেখার জন্য তো আরও বেশি বেমানান। অভিমান সবার সাথে করতে নেই। সবার প্রতি সব অধিকার থাকে না। অভিমান শুধু তাদের উপর-ই করতে হয় যেখানে বিপরীত পক্ষের মানুষ তাকে বুঝতে পারবে। বাকিদের অপর অভিমান করা নেহাত সময় নষ্ট বৈ কিছু নয়। কেউ যদি কারো উপর অভিমান করে, আর সেই ব্যক্তি জানতে-ই না পারে, তাহলে কোন লাভ কি আছে? না অভিমান কমবে আর না সমস্যার সমাধান হবে। উল্টো এই ক্ষুদ্র মানবজীবনের কিছু সময় নষ্ট হবে। আবার অন্য ক্ষেত্রে এই থিওরি কাজ করবে না। কিছু কিছু মানুষ এই অভিমান পুষে রেখেই বেঁচে থাকতে পছন্দ করে। অন্তত জীবনে একটা পিছুটান রেখে দেয় অভিমান আকারে, যাতে ডিপ্রেশনে ভুগে নিজের জীবন নষ্ট করার মতো সিদ্ধান্ত না নেয়। মানুষ বড়ই বিচিত্র প্রাণী। তাদের নিয়ে গবেষণার শেষ নেই!

দ্রোহ যে আর কোন দিন আসবে না- এই কথা মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে ঘুমাতে গেল রেখা। আগামীকাল স্কুলে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান আছে। সকালে দ্রুত যেতে হবে। আগামীকালের সকালের এক ঘণ্টার একটা টিউশনিও বাদ দিতে হয়েছে এজন্য। দ্রোহের কথা ভেবে আর ঘুম নষ্ট করা ঠিক হবে না। মানুষটা তো আর কখনো আসবে-ই না, সত্যিই!

_____

সামনে বিশাল সমুদ্র। যার সীমা নির্ধারণ সাধারণ চোখের দ্বারা সম্ভব নয়। তাই ধরে নেয়া হচ্ছে সেটা দিগন্তে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সমুদ্রের পানি নীল, আকাশও নীল, তবে পানির থেকে কম রঙের দিক থেকে। বালিতে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। দূরে সমুদ্রের পাড়ে হেঁটে চলেছে এক যুবতী। অদ্ভুত তো! মেয়েটা রেখার শাড়ি পেল কি করে? সামনেই তাকিয়ে রইল। নিজে অনুভব করল, সে হাসছে মেয়েটার দিকে তাকালেই তার চোখে হাসি খেলে যাচ্ছে। হঠাৎ এক বিশাল স্রোত এসে পাড়ে আছড়ে পড়ল। তাতেই মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে গেল। কোন আওয়াজ শোনা গেল না। না তাকে দেখতে পাওয়া গেল।

_____

চট করে চোখ খুলে তাকাল দ্রোহ। স্বপ্নের কথা ভাবতে গিয়ে তার মনে থেকে যেন সব স্মৃতি হারিয়ে গেল। শুধু মনে থাকল একটা মেয়ে সমুদ্রের স্রোতে হারিয়ে গেল।

সারাদিন কঠোর সাধনা করল দ্রোহ। মামা পারে না খালি ঠেলে রিহানের স্কুলে দ্রোহকে পাঠিয়ে দেয়। কিংবা পারলে তো এক লাথি দিয়ে দ্রোহকে উড়িয়ে স্কুলে পৌঁছে দেন তিনি, একেবারে আকাশ পথে। কিন্তু দুইটার কোনটাই সম্ভব না। দ্রোহকে রাজি করানো যাচ্ছে না। সারাদিন ধরে রাহাতের সাথে বসে বসে ফোনে গেম খেলবে। তাছাড়া সেদিন-ই আবার রাতে নিজের বাড়ির জন্য রাতে রওয়ানা দেবে। তাই সারাদিন মামা- মামির সাথে কাটাবে এই বলে এড়িয়ে গিয়েছে। সারা সকালে তাকে বুঝিয়েও স্কুলের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করানো গেল না। অনুষ্ঠান বলে রিহান খাবার খেয়ে স্কুলে চলে গেল সকালেই। স্কুল সাজানোর দায়িত্ব তাদের ঘাড়েই।

বিকাল হতেই দ্রোহ তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আজ সারাদিন সে মনে মনে একটা কথা বারবার আওড়ে পুরো মুখস্ত করে ফেলেছে। রেখার সাথে দেখা হওয়ার আর কোন পথ-ই খোলা রাখবে না। কিন্তু গতকালের রেখাকে শাড়িতে এক ঝলক দেখার পর আবার ইচ্ছে জাগল তার। দ্রোহ নিজেই কনফিউশনে ছিল তার কি করা উচিত সেই ভেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। বিকালে সুড়সুড় করে ঘর থেকে কিছুটা লুকিয়েই বের হয়ে গেল। আসার সময় মামার মুখোমুখি হতে হয়েছিল যদিও। কিন্তু কোনমতে হাতিরঝিলে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে বের হয়েছে। পিছনে মামাও কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ কল আসায় আর সেখানে দাঁড়ানো হয়নি মামার।

রেখাকে শাড়িতে দেখার যে ইচ্ছে জেগেছে, তাকে লোভের নাম দিতে অনিচ্ছুক সে। একবার দেখবে, আর দেখেই চলে আসবে। রূপও টের পাবে না কিছু। এমন পরিকল্পনাই করে রেখেছে দ্রোহ।

স্কুলের গেট পার হতেই দেখতে পায় সামনে বিশাল মাঠে মানুষ গিজগিজ করছে। অনুষ্ঠানও হয়তো শুরু হয়ে গিয়েছে। বিকেলে দেওয়া হয়েছে অনুষ্ঠান। সবাইও খুশিমনেই অংশগ্রহণ করেছে। মানুষের জন্য দাঁড়ানোর জায়গা নেই বোধ হয়। এক পাশে দৈর্ঘ্যর দিক থেকে লম্বা স্কুল আর তার সামনে বিশাল জায়গাজুড়ে মাঠ। মাঠের উপর ছালার বস্তা পেতে রাখা হয়েছে। আর মাথার উপর শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। যাতে পরবর্তীতে বৃষ্টির জন্য কোন সমস্যা না হয়। অভিভাবকদের জন্য একদিকে রাখা হয়েছে আলাদা বসার জায়গা। সেখানে চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লম্বা লম্বা বাঁশের খুঁটিতে কাপড় পেঁচিয়ে তার উপর কাগজে করে লিখে রাখা হয়েছে কোন অংশে কারা বসবে। সবটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল দ্রোহ। এক সময় চোখ পড়ল রেখার দিকে। সে অভিভাবকদের বসার জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছে। কারো কোন সমস্যা হলে সেদিকে খেয়াল রাখছে। গতকালের সেই একই শাড়ি, তবে তার মুখে আজ হালকা সাঁজ। হাতে চুরি, কানে দুল, চোখে কাজল আর কপালে ছোট একটা টিপ। হঠাৎ কোন একটা মেয়ে তার কাছ যেতেই ছিটকে সরে গেল রেখা। দ্রোহ মনোযোগ দিয়ে দেখল, মেয়েটার হাতে হয়তো সাজসরঞ্জাম। যেটার জন্য রেখা মানা করছে। তাই দৌড়ে অন্যদিকে চলে গেল। দ্রোহ পুরোটা সময় ওই ভিড়ের মধ্যে ছিল। অনুষ্ঠানের দিকে তার মন নেই। পুরোটা সময় রেখার দিকেই তাকিয়ে ছিল। অভিভাবকদের মধ্যে বসে থাকায় তাকে কেউ তেমন খেয়াল করল না হয়তো। অনুষ্ঠান শেষ হতেই সে সেখান থেকে চলে গেল রিহানের আড়ালে। বাকিটা সময় কাটানোর ইচ্ছা হাতিরঝিলে। মামাকে তো একেবারেই মিথ্যা বলা যায় না।

চলবে।

#অজান্তে_আগমন
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ০৫

রাতে মামা বাড়ি ফিরেছিল দ্রোহ। অন্যদিন গুলোর মতই, স্বাভাবিকভাবে। খাওয়া-দাওয়া করেছে, মামার প্রশ্নের ঝড় সামলিয়েছে। সারাদিন কোথায় ছিল সে, কি করছিল- এমন অনেক প্রশ্ন। অবশ্য যাওয়ার আগে মামার কোঁচকানো ভ্রূ দেখেই আন্দাজ করেছিল এমন কিছু হবে। তারপর ঘুমাতে চলে গেল। হঠাৎ করেই তার মনে হলো আজকের দিনটা এই বাড়িতেই থাকা যাক। রাত করে আর বাড়ি ফিরবে না। কোন কারণ ছাড়াই এমন ইচ্ছে হলো না। অবশ্য এই এক সপ্তাহে অনেক কিছুই করেছে কারণ ছাড়া। হুট করে রিহানের স্কুলে হাজির হয়ে রিহানকে ধরে নিয়ে ঘুরতে চলে গিয়েছে, মামাকে সকালে জগিং এর জন্য টেনে নিয়ে গিয়েছে, হঠাৎ করেই মামিকে রান্নাঘর থেকে বের করে উল্টাপাল্টা রান্না করেছে। এসব সাধারণ তার জন্য। এর সাথে আরেকটা কাজ যুক্ত ছিল। রাতে রাস্তায় হাঁটতে বের হয়ে রেখাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। রেখার বাড়ির রাস্তা এমনভাবে মুখস্ত হয়েছে যে এখন যেন দ্রোহ চোখ বন্ধ করেই সেখানে চলে যেতে পারবে কোন বাঁধা ছাড়াই। এমনটা ধারণা তার, তবে একদিন চেষ্টা করেও দেখবে ভাবছে। তখন মস্তিষ্ক তাকে বলে উঠল,

“তুই না আর রেখার সামনে যাবি না বলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি, দ্রোহ? কোথায় গেল তোর সেই সিদ্ধান্ত? হুম… হুম…”

এই কথা মনে পড়তেই নিজের সেই ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিতে ইচ্ছা করে দ্রোহের। এই ভেবে ভেবে গত রাতে বাড়ি থেকেই বের হয়নি সে। মামা আর মামি কপালে হাত দিয়ে দেখে গিয়েছেন কয়েকবার। রাতে রিহানও এসে তাকে দেখে গিয়েছে, সে অসুস্থ কি না? এই নিয়ে চরম বিরক্ত হয়েছিল দ্রোহ, যদিও কিছু বলেনি। আজ রাতটা ও সেইভাবেই কাটাবে। রেখার প্রতি টানটা কাটিয়ে তারপর বাড়ি ফিরতে হবে না। বলা তো যায় না, দ্রোহের সাব-কন্সিয়াস মাইন্ড আবার কখন তাকে নিজের বাড়ি থেকেই এখানে রাতে টেনে আনে! দেখা যাবে রাত ১২ টা পর্যন্ত কাজ করে অফিস থেকে সোজা বাড়ি না গিয়ে বাস ধরে এখানে চলে এসেছে। সে এক মহা ঝামেলা। এই নিয়ে প্রশ্নের মুখে তেমন পড়তে না হলেও সারাদিনের পরিশ্রমের পর বিশ্রাম নেওয়ার সময়টুকু আর পাবে না। এক সময় দেখা যাবে মায়া জন্ম নিবে, তারপর গাঢ় অনুভূতি আরও কত কি! তখন না রাতে আবার কাজী সহ নিজের বাড়ি থেকে ২ ঘণ্টার রাস্তা অতিক্রম করে রেখার বাড়িতেই মাঝ রাতে চলে আসে। তারপর রাত আড়াই টায় রেখার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দ্রোহ বলে উঠবে,

“রেখা, বল কবুল।”

সে আরেক দূর-দূরান্তের চিন্তা ভাবনা। অবশ্য মায়া জন্ম নেওয়ার সুযোগ আছে তো নাকি সেটা আগে থেকেই আছে?

নেই, অবশ্যই নেই।

নিজেকে বোঝাল দ্রোহ। তারপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। আর জাগা ঠিক হবে না। এখন তো শুধু বিয়ের কথা ভাবছে, এরপর আর না কি কি চলে আসে তার মনে। জীবনে প্রথমবার কোন মেয়েকে নিয়ে এতদূরের কথা ভাবল সে। চমকে উঠে নিজের বুকে থু থু ছিটাল। তারপর চোখ বন্ধ করে ভেড়া গোনা শুরু করল।

১ টা ভেড়া, ২ টা ভেড়া, ৩ টা ভেড়া, ……

৫০ পর্যন্ত গোনার পরও যখন ঘুম আসলো না তখন সে বিরক্ত হয়ে ছাগল গোনা শুরু করল। এটাও ২০ এ থেমে গেল। বিছানার এপাশ ওপাশ করল শুয়ে থেকেই। তাতে যেটুকু ঘুম চোখে ছিল, সেটাও চলে গেল। টানা দুই ঘণ্টা এমন অকাজ করে উঠে পড়ল দ্রোহ। গায়ে শার্ট জড়িয়ে নিয়ে একেবারে বাড়ির বাইরে। হাঁটতে গিয়ে মনে হলো সে জুতো পরে বের হয়নি। তাই আবার ফিরে এসে দেখে বাড়ির দরজার সামনে মামা স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছেন। দ্রোহ দাঁত কেলিয়ে হাসল।

— তুই প্রেমে পড়েছিস না কি বাবু?

মামা সোজাসাপ্টা একটা প্রশ্ন শুরুতেই ছুঁড়ে দিলেন।

— না, মামা। কিসব বলছ?

— এতো রাতে না ঘুমিয়ে কোথায় বের হচ্ছিস?

— ঘুম আসছিল না, তাই হাঁটতে যাচ্ছিলাম।

— যাক, বাঁচা গেল।

— কেন? কি হয়েছে? কে মরে যাচ্ছিল?

— নাহ, তুই রাতে বের হলি না দেখে তোর মামি ভাবল তোর কোন অসুখ হয়েছে। তাই বললাম।

— মামির দোষ দিও না। নিজে এসব ভাবছিলে, সেটা বলো। এবার বল না যে তুমি আমাকে এই জন্য একেবারে পাগলাগারদে পাঠানোর কথাও ভাবছিলে কিংবা কোন ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার কথা ভাবছিলে।

তখনই মামা দাঁত দিয়ে জিহ্বা চেপে ধরলেন। দ্রোহ মাথায় হাত দিয়ে বলল,

— এসবও ভাবা শেষ? আমি গেলাম এখন। নাহলে সত্যিই পাগল হয়ে যাবো। আর তুমি পারলে এমন দূরদর্শী চিন্তা করা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করো। আমার অপেক্ষা করো না কিন্তু। তাহলে আমি আগামী এক বছরে আর এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়াব না বলে রাখলাম। ঘুমিয়ে পড়। আমি এখন আসি।

বলতে বলতে জুতো পরে নিয়ে বের হয়ে গেল দ্রোহ। মামা সেদিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বললেন,

“গাধা ছেলে, আমি জেগে না থাকলে তোর জন্য দরজা খুলবে কে?”

__________

রেখার বাড়ির সামনে যেতে যেতে দ্রোহ নিজের মনকে এই বলে বুঝ দিল যে, সে এই শেষ বারের মতো যাচ্ছে। আর জীবনেও এদিকে আসবে না ভবিষ্যতে। যদিও এই কথা সে গত কয়েক দিন ধরেই বলছে। তবুও আগামী কাল থেকেই মানবে বলছে রোজ। এই আগামী কাল যে তার কাছে কবে আসবে- সেটা সে নিজেও জানে না।

রেখার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে। রেখা আজও মন খারাপ করেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিল। এক পা বাড়িয়ে আবার পিছিয়ে এসে জানালা দিয়ে দেখছিল। যদি দ্রোহ আসে! তার ভাবনাকে সঠিক করে দিয়ে দ্রোহ আসলোও। রেখা সাথে সাথে ফ্লোরে বসে পড়ল। চায়ের কাপ ফ্লোরেই পাশে রেখে দিয়ে দুই হাতে ভর দিয়ে জানালা দিয়ে তাকানোর চেষ্টা করল। হঠাৎ কানে একটা শব্দ ভেসে আসতেই সে ভাবল হয়তো ফোনে কোন ম্যাসেজ এসেছে। হাতড়ে হাতড়ে টেবিল থেকে ফোন নিয়ে সেভাবেই চালু করল। কিন্তু আসলে কোন শব্দ-ই হয়নি। ওটা ওর মনের ভুল ছিল। তারপর যখন অনুধাবন করল সে ফোনের স্ক্রিন হতে আলো মুখে এসে পড়ছে, তখনই তার চোখ গেল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা দ্রোহের দিকে। দ্রোহের চোখে বিস্ময় সে স্পষ্ট দেখতে পারছে। অজান্তেই দ্রোহের ঠোঁটের কোণে যে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল, সেটাও চোখের আড়াল হলো না রেখার। স্ট্রিট লাইটের আলোয় সেই হাসিকে এক টুকরো হীরের সাথে তুলনা করতে ইচ্ছা হলো তার। মুহূর্তেই চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল রেখা, ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক। তৎক্ষণাৎ নিচে বসে পড়ল ঠিকই, কিন্তু রক্ষা পেল না হয়তো দ্রোহের নজর থেকে। অনেকক্ষণ বসে থেকে আবার মাথা তুলে বাইরে তাকাল। কেউ নেই সেখানে। রেখা শান্ত হয়ে চায়ের কাপ ধোঁয়ার জন্য সেখান থেকে উঠে রান্না ঘরে চলে গেল। কিছু সময় হতে না হতেই খট খট আওয়াজ শুনতে পেল সে। রাতের বেলায় এই আওয়াজ এতো জোরে শুনতে পেয়েই ভয়েই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার জোগাড় রেখার। কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে মূল দরজার দিকে এগিয়ে গেল। যতই এগিয়ে যাচ্ছে, শব্দটা ততই বেশি জোরে শোনাচ্ছে। দরজার আই হোলের মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করল। দ্রোহকে দেখে আবার চমকে উঠল। খুলবে কি না সেই নিয়ে ভাবতে ভাবতে আবার খট খট আওয়াজ এলো। মাঝ রাতে আওয়াজ ঠিক শোনায় না বলেই দরজা খুলে দিল সে। দ্রোহ স্বাভাবিক ভাবে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সেই একটা চেয়ারে বসে পড়ল আর বলল,

— পানি পাওয়া যাবে?

রেখা গ্লাসে করে পানি এনে দ্রোহকে দিল। দ্রোহ সেটা ধরে পান করল না। হাতেই রেখে দিল আর বলল,

— আগামী কাল আমি আমার বাসায় চলে যাব। ছুটি শেষ। আবার কাজের জন্য যেতে হবে। মামা বাড়িতে আবার কবে আসা হবে ঠিক নেই।

এ পর্যন্ত বলে এক ঢোকে পুরো পানি শেষ করল। তারপর থেমে আবার বলল,

— আপনাকে আর দেখতে পারব না আর না আপনার সাথে কথা বলা হবে। আচ্ছা, এতদিন আমি ভাবতাম জানালার আশেপাশে হয়তো আপনার ঘরে অশরীরীর অস্তিত্ব আছে। বলতে গেলে আপনার ঘর যে এটাই হবে, সেটাও অনুমান করেছিলাম। কিন্তু আজ আপনাকে দেখলাম। আপনি কি সত্যিই রোজ আমার অপেক্ষা করতেন?

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here