অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ২০ (শেষ পর্ব – বাকি অংশ)

অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ২০ (শেষ পর্ব – বাকি অংশ)
সাদিয়া_সৃষ্টি

দ্রোহের মা প্রতিবারের বারের মতো এইবারও খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলেন, বাড়িতে কে এসেছে দেখার জন্য। দ্রোহ আর রেখাকে একসাথে দেখে অবাক হলেও প্রথমে রেখাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আর রেখার খোঁজ খবর নিতে থাকলেন। সেই ফাঁকে দ্রোহ টুক করে ঘরের ভিতর ঢুকে বাবা আর দিবাকে ডেকে আনলো। তারপর সবাইকে বসতে বলা হলো। দ্রোহ কিছু বলতে চায় সবাইকে। তাই সবাই দ্রোহের কথায় মনোযোগ দিলেন। কিন্তু দ্রোহ কিছু বলবে বলে আর একটা কথাও বলল না। এদিকে রেখার চিন্তায় কপালের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। দ্রোহ না সত্যি সত্যি বিয়ের কথা তুলে! তাহলে দ্রোহের বাবা মা আর দিবা যদি তার উপর রাগ করে, তাহলে তো রেখা সহ্য করতে পারবে না। আবার দ্রোহের মুখের উপরও কিছু বলতে পারবে না। দ্রোহের বাবা ১০ মিনিট অপেক্ষা করে বলে উঠলেন,

— এবার কিছু বলার থাকলে বল নাহলে আমি বের হলাম।

দ্রোহের বাবার কথা সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ল এবার দ্রোহের মাও বলে উঠলেন,

— হ্যাঁ বাবু, বল। কি বলবি তুই?

দিবাও বাদ রইল না, সে বলল,

— তুই কি কিছু বলবি? নাহলে আমি পড়তে গেলাম।

সবাইকে উঠে যেতে দেখে রেখা বেশ খুশি হলো মনে মনে। কিন্তু তার মনের খুশিতে এক বালতি জল ঢেলে দ্রোহ বলে উঠল,

— বাবা, তুমি আর রকিবুল আংকেল ভালো বন্ধু ছিলে না?

— হ্যাঁ কেন?

— আচ্ছা, বাবা মা, রেখাকে তোমাদের কাছে বাড়ির বউ হিসেবে কেমন লাগবে?

দিবা চট করে ধরে ফেলল ব্যাপারটা। তাই সে বলে উঠল,

— কিন্তু রিহান ভাইয়া তো রেখা আপুকে বিয়ে করবে বলে মনে হয় না। রিহান ভাইয়া আরেকজনকে…

— রুপের কথা কে বলছে। আমি তো বলছি আমি রিখিকে বিয়ে করব।

— এইতো ভাই, আসল কথা বল এবার। এতদিন বলে বলে মুখ ক্ষয় হয়ে গেল আমার যে তুই কি রেখা আপুকে আমার ভাবি বানাবি নাকি? খুব তো বলতি বিয়ে করবি না। এখন নিজে নিজে সামনে আসলি।

দ্রোহের অবস্থা দেখে বাবা আর মা দুজনেই হেসে ফেললেন। দিবাও যোগ দিল তাতে। দ্রোহের মুখেও হাসি ফুটে উঠল। দ্রোহের মা রেখাকে বলে উঠলেন,

— তুমি কি রাজি আমার ছেলেকে বিয়ে করতে?

দ্রোহ যেভাবে রেখাকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল, সেভাবেই টানতে টানতে আবার নিজের ঘরে নিয়ে গেল। একেবারে বারান্দায় এনে রেখাকে সেখানে থাকা আরএফএল এর লম্বা টুল এ বসিয়ে দিল। তারপর নিজে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। রেখা দ্রোহের দিকে কিছুক্ষণ অদ্ভুত চাহনী নিয়ে তাকিয়ে থাকল। কিছুটা ভারী দৃষ্টিতে, নেশাগ্রস্থের মতো। তারপর দ্রোহের চোখে চোখ পড়তেই মাথা নামিয়ে নিল সে। দ্রোহের বারান্দায় একটা সেলাই মেশিন রাখা। এটা দ্রোহের মায়ের ঘরে আগেও দেখেছে সে। কয়েকদিন আগেই হয়তো এখানে আনা হয়েছে। নাহলে আগেই নজরে পড়ত তার। সেই সেলাই মেশিনের পা রাখার জায়গায় নিজের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখল। তার খুব ইচ্ছা করল সেটায় পা রেখে সেলাই মেশিন চালানোর মতো করে পা নাড়িয়ে দেখতে। আঁকাবাঁকা হোক সেলাই, তাও চালানোর ইচ্ছা জাগল তার। দ্রোহ সবটা বেশ ভালো করে খেয়াল করল। তারপর রেখাকে সে নিজেই দাঁড় করিয়ে টুলটা মেশিনের কাছে রেখে চোখের ইশারায় রেখাকে বলল- “এখন চালাও।” রেখাও খুশি হয়ে মেশিন চালানো শুরু করল। যন্ত্রে কোন সুতো লাগানো ছিল না। তাছাড়া সেখানে আলাদা কোন কাপড় ও ছিল না। তাই রেখা নির্দ্বিধায় পা নাড়াতে থাকল। তালে তালে যন্ত্রের সুচ ওঠা নামা করল। দ্রোহ হঠাৎ বলে উঠল,

— আমার থেকে পালাচ্ছিস কেন রেখা? আমার পরিবার মানবে না, আমার সাথে তোর যোগ্যতা, তোর পরিবারে কেউ নেই – এসব লেইম কারণ আমাকে না বলে একটা সলিড রিজন বল।

রেখা অবাক হয়ে দ্রোহের দিকে তাকাল। পা নাড়াতে ভুলে গেল সে। দ্রোহ কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল,

— আমি তোর খেয়াল রাখতে পারব কি না এই নিয়ে আশা করি কোন প্রশ্ন নেই। তোর বলার আগেই চেষ্টা করি সেটা ঠিক করার। যেহেতু আগে থেকেই চিনতাম তোকে, তাই তোকে পুরোপুরি ভাবে বুঝতে পারি হয়তো। এমনটাও না যে আমার সাথে থাকলে তোকে আলাদা করে খুশি হওয়ার অভিনয় করতে হবে। তুই যেমন, তেমনই থাকতে পারবি সব সময়। হ্যাঁ, অফিসের কাজের চাপের জন্য হয়তো বেশি সময় নাও দিতে পারি, আমার অনুপস্থিতিতে পাশের বাড়ির অ্যান্টি কিছু বললে আমি থাকব না হয়তো, কিন্তু মা তো থাকবে, পারলে দিবাও থাকবে। আর ওরাও না থাকলে আমি নাহয় কাজ থেকে রাতে বাড়ি ফিরে তোকে পাল্টা জবাব দেওয়া শিখিয়ে দেব। আর তাতেও মন ভালো নাহলে রাত ২ টায় গিয়ে অ্যান্টির ঘুম ভাঙিয়ে দুজন মিলে বকা দিয়ে পালাব।

রেখা না চাইতেও হেসে ফেলল দ্রোহের শেষ কথায়। দ্রোহ দেখল, তার কথায় কাজ হচ্ছে। তাই সে আরও একটা কথা তুলে ধরল,

— হ্যাঁ, আমি জানি, হয়তো আমাদের মধ্যেও ঝগড়া হবে, মনোমালিন্য হবে, কিন্তু তখন আমাদের সম্পর্কটা ঠিক করতে মাঝে মাঝে তুই এগিয়ে আসতে পারবি না? আমি যদি কখনো একটু বেশি রাগ করি তখন? আমি জানি, আমি শতভাগে ভালো না। হ্যাঁ, ভার্সিটি লাইফে আমিও একবার বন্ধুদের জোরাজুরিতে রিলেশনে গিয়েছিলাম।

বলে রেখার দিকে আবার তাকাল দ্রোহ। রেখার অগ্নিদৃষ্টি নজরে পড়তেই সাথে সাথে বলে উঠল,

— খুব কম সময়ের জন্য। আমি তো ওর নামও জানতাম না। প্রপোজ ওই করেছিল। বন্ধুরা চাপ দিচ্ছিল অনেক তাই হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু ব্রেক আপের দিন আমি প্রথম ওর নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম।

দ্রোহ আবার এক নজর তাকাল রেখার দিকে। তারপর বলে উঠল,

— অভাবে তাকাচ্ছিস কেন? কিছু দিন আগেও একটা টিচার তোকে প্রপোজ করেছে। আমি সবটা জানি। ওর বাপ দাদার নামও আমার মুখস্ত করা শেষ।

রেখা নজর সরিয়ে নিল দ্রোহের দিক থেকে, যেন সে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।

— এবার বল রিখি, তুই কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি? আমি কিন্তু তোকে আবার ভালোবাসি-টালোবাসি বলতে পারব না। তুই রাজি কি না বল, তাহলে আজই রেজিস্ট্রি অফিসে যাবো।

রেখা নিজের মুখের কথাই যেন হারিয়ে ফেলেছে। এই মুহূর্তে ঠিক কি বলা উচিত সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। তখন বাইরে থেকে সাউন্ড বক্সে বেজে উঠল,

“বসে বসে ভাবি, আমি সারাদিন
কি করে মেটাব তোমার এই ঋণ।”

রেখা চোখে ইশারায় বলল ওদিকে কান পেতে শুনতে। দ্রোহ এবার খেয়াল করল গানটা।

“এ মনের ঘরে, কবে ধীরে ধীরে
ফিরিয়ে দিলে আবার হারানো সেই দিন।”

দ্রোহ এক গাল হাসি নিয়ে বলে উঠল,

— আর বসে বসে ভাবতে হবে না। আমি বুঝেছি আপনি রাজি। আমাকেও ভালোবাসার কথা বলা লাগবে না। আপনি শুধু মা এবার প্রশ্ন করলে কষ্ট করে “রাজি” শব্দটা বলে দিবেন। যাহ্‌, অনেকক্ষণ ধরে তোকে আপনি বলে ফেললাম। এবার এর মাশুল হিসেবে একবার জড়িয়ে ধরবি?

রেখা উঠে পড়ল টুল থেকে। তারপর দ্রোহের দিকে এগিয়ে গিয়ে বুকে আসতে করে ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে চলে এলো। দ্রোহ “হায়রে… আমি শেষ” বলেই সেলাই মেশিনটা জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। লোহার তৈরি সেই মেশিন ধরে চুমু খেলো কয়েকটা। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার দরজায় চুমু খেলো যেখানে কিছুক্ষণ আগে রেখা হাত রেখে সেখান থেকে চলে গেল। জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,

— মাম্মি, আমিও বিয়ে করছি এবার।

_____

আরেক রাত, আকাশে চাঁদের দেখা মিলছে সেদিনের মতই। ৬ বন্ধু জড়ো হয়েছে এক জায়গায়। সেই একই চায়ের দোকান। দোকানদার মামা চায়ের কাঁপে অনবরত চামচ নাড়িয়ে চলেছেন। ড্যানিশের কৌটা খালি পড়ে রয়েছে পাশেই। দ্রোহ অভ্যাস মতো সেই কৌটায় চা পান করবে আজ বহুবছর পর। ইমন ওদের মাঝে কথা শুরু করল।

— ভাই, কি পাগলামিটাই না করলি সেদিন। তোর কথা আমি নিজের বাড়ি থেকে শুনতে পেরেছিলাম।

তামিম নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে বলে উঠল,

— তোদের বিয়ের আগে সেদিনের কাণ্ড তো স্মরণীয় হয়ে থাকবে ভা…

অর্পণ ওর কথা মাঝে বলে উঠল,

— ভাগ্যিস ইমন তোকে আর ভাবীকে বারান্দায় দেখে সাথে সাথে কনফারেন্স কল এ এসেছিল, নাহলে তো জানতেই পারতাম না। তুই এতোটা বিয়ে পাগল।

তামিম নিজের আসন থেকে উঠে গিয়ে কোন পূর্ব সংকেত না দিয়ে দুম করে কিল বসিয়ে দিল অর্পণের পিঠে। সিয়াম তাদের ঝগড়া হওয়ার পূর্বাভাস পেয়ে সাথে সাথে আলাদা করল দুজনকে। ইমন বলে উঠল,

— তুই তো ভাবীকে সারপ্রাইজ দিতে পারতি না বলে হঠাৎ করে বিয়ের কথা বলতি।

— না, রিখি সারপ্রাইজ চায়নি কখনো। হুট করে করা কাজে ও খুশি হওয়ার বদলে কান্না করে বেশি। হঠাৎ করেই আঙ্কেল অ্যান্টি চলে গেল। তাই ও আর কখনো কোন সারপ্রাইজ পেতে চায়নি।

— এসব তোকে বলেছেন ভাবি?

— না, বুঝে নিয়েছি। ওকে যত বার আমি অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে পড়তে দেখেছি ততবার দেখেছি ওর ভয়ার্ত চেহারা। তাছাড়া বিয়ে জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। এই নিয়ের সবার কোন না কোন ইচ্ছা থাকে, আমি যদি হঠাৎ কর এক দিন বলতাম যে- রিখি আজ আমাদের বিয়ে, তাহলে চমকে যেত ঠিকই। কিন্তু নিজের ইচ্ছাগুল আমাদের কাছে বলতে পারতো না। আর না পারতো আনন্দ করতে। তাই আর কিছু করিনি আমি অমন।

রাফি বলল,

— ফাইনালি চাইল্ডহুড ক্রাশ তোর বউ হলো। সেই খুশিতে এক সপ্তাহ আমাদের বিনা নালিশে খাওয়াবি তুই।

— কেন?

দ্রোহের প্রতিবাদী জবাব। ইমন বাঁকা হেসে বলল,

— তোর সেইদিনের সব কাহিনী শুরু হওয়ার আগেই আমি স্ক্রিন রেকর্ডার অন করে দিয়েছিলাম। তোর সব কাজ আমার রেকর্ড করা আছে। না মানলে পুরো এলাকায় বড় পর্দায় দেখামু মামা।

— দেখা।

খাপছাড়া ভাবে জবাব দিল দ্রোহ। সিয়ান নিজের চশমা একটু ঠেলে দিয়ে বলল,

— চিন্তা করিস না, ভাবি নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াবে আমাদের। শুধু একবার বাসায় যেতে হবে ঘটা করে।

— তোরা…

দ্রোহের কিছু বলার আগেই সবাই বলে উঠল,

— গালি দিবি না শয়তান। ভাবীকে নালিশ করমু।

**********

হঠাৎ করে একটা বাইক সামনে এসে থামায় চমকে উঠল রেখা। এমনটা গত ৬ বছরে অগণিতবার হয়েছে। তাও চমকে যায় সে। জানে মানুষটা কে, তবুও অবাক হয়। দ্রোহ নিজের হেলমেট সরিয়ে বলে উঠল,

— কি ব্যাপার রিখি? আজও তুই ভয় পেলি?

— আমি ভয় পাই না।

— সত্যিই?

— রিজভী কি বাসায় পৌঁছে গিয়েছে?

— কথা ঘোরাচ্ছিস?

— বলুন না।

— হ্যাঁ ম্যাম, আপনার ছেলে বাসায় সুস্থ সবল ভাবে পৌঁছে গিয়েছে। এবার বল তোর মন খারাপ কেন?

— আসলে আজ…

দ্রোহ বাইক থেকে নেমে সেটা স্কুল গেটের কাছে পার্ক করল। তারপর স্কুলের ভিতরে ঢুকে ক্যান্টিনে রাখা দুটো চেয়ার টেনে রেখাকে বসালো। নিজে বসে আবার প্রশ্নটা করলে রেখা বলল,

— আমাদের স্কুলে জেএসসি পাশ করার পর একটা মেয়ে অন্য স্কুলে চলে যায়। আজ জানতে পারলাম মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে। সবাই বলছে মেয়েটা অনেক ডিপ্রেশনে ছিল কিন্তু আসল ঘটনা কেউ জানে না। মেয়েটা না অনেক ভালো স্টুডেন্ট ছিল। পড়াশোনায় অনেক ভালো বলেই ভালো একটা স্কুলে চলে গিয়েছিল ২ বছর আগে। আর আজ শুনলাম। জানেন ও খুব হাসিখুশি থাকত সব সময়, কিন্তু ওই কি না…

— এজন্য মন খারাপ?

— হ্যাঁ।

— দেখ রেখা, এই নিয়ে আমি তোকে কিছু বলব না। ভাগ্যের লেখা যেহেতু বদলানো যায় না তাই অনেকে ভাগ্যে ছিল বলে মেয়েটা নেই এমন ভাববে। তুই কি ভাববি সেটা তোর একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে আমি বলব এই চিন্তার পাশাপাশি আশেপাশের খেয়াল রাখিস, তুই যদি নিজেকে শক্ত না করিস, তাহলে স্কুলের বাকি স্টুডেন্টদের কে সামলাবে? আর তোর মন খারাপ দেখে আমরাও কষ্ট পাবো। তাই দ্রুত এই সিচুয়েশনটা কাটিয়ে ওঠ। এখন আমার সাথে আয়।

বলেই দ্রোহ রেখাকে নিয়ে অলিগলির ভিতর দিয়ে হাঁটা শুরু করল। গাছপালার ছায়ায় একটা ঠাণ্ডা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আসার আগে দারোয়ানের কাছে বাইকের চাবি দিয়ে সেটার একটু খেয়াল রাখতে বলে এসেছে দ্রোহ। হাঁটতে হাঁটতে তারা অনেক দূর এলো। এদিকে বাড়ির পরিমাণ কম, গাছগাছালির পরিমাণ একটু বেশি। পানির শব্দ কান পর্যন্ত পৌছুতেই রেখা সামনে তাকাল। এতক্ষণ তার দৃষ্টি দ্রোহের পায়ের দিকেই আটকে ছিল। সে শুধু দ্রোহের পিছনে হাঁটছিল। সামনে পানির অস্তিত্ব দেখে অভিভূত হলো। রেখার দৃষ্টি দেখে দ্রোহ বলে উঠল,

— এটাও তুরাগ নদীর অংশ কিন্তু এ অংশে ময়লার অস্তিত্ব পৌছায়নি তাই এখনো স্বচ্ছ রয়েছে এই পানি।

তারপর আর কথা না বাড়িয়ে রেখানে নিয়ে সেখানে ঘাসের উপর বসে পড়ল। রেখার মন ধীরে ধীরে ভালো হতে লাগল। পানির শব্দ স্পষ্ট কানে ভেসে আসছে। মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে তাই। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে পরিবেশ। মাঝে মাঝে গাছের পাতার সাথে পাতার ঘর্ষণ হয়ে মড়মড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বেশ কিছু সময় সেখানে কাঁটাল তারা। অন্ধকার হওয়ার আগেই ওরা ফিরে আসলো স্কুলে। দারোয়ান মামার কাছ থেকে চাবি নিয়ে বাইক চালি করল দ্রোহ। ওরা বাড়ি চলে গেল।

_____

রাত দেড় টা কি তার বেশি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রেখা। ভেতরে দ্রোহ ঘুমাচ্ছে। ওদের ছেলে রিজভী চলে গিয়েছে দাদা- দাদির সাথে ঘুমাতে। দাদির গল্প তার বেশ পছন্দ। খালামনির সাথে কথা বলার পর আজ রাতে বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু স্কুলের কথাগুলো আবার মনে পড়ল। দ্রোহ তার মন ভালো করার ওষুধ জানে। যখন যা প্রয়োজন তখন তাই এনে দেয়। মাঝে মাঝে ঝগড়া হলে রেখা নিজের বাবার বাড়িতে চলে যায় ছেলেকে নিয়ে। দেখা যায় তার সাথে দ্রোহের মা বাবা আর দিবাও চলে গিয়েছে তার রাগ ভাঙাতে। হ্যাঁ, দিবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে ইমনের সাথে। এখন দ্রোহ না চাইলেও ইমনের মুখে “শালা” শুনতে বাধ্য। সেই নিয়েও অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হওয়ায় সবাই খুশিই ছিল। দ্রোহ মানুষটা একটা জাদুকর রেখার কাছে। আজও কি সুন্দর রেখার মন ভালো করার কাজে লেগে আছে। নিজ হাত পুড়িয়ে ছেলেটা রান্না করেছে আজ। তখন তো রেখা ভুলেই গিয়েছিল সব কথা। ৪০ মিনিট ধরে বকেছে রেখা দ্রোহকে। তাও নিজেকে শান্ত করতে পারছিল না। তারপর নিজেই খালাকে কল করে রেখার সাথে কথা বলিয়ে দিল।

এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের ফোনের রিং টোন শুনতে পেল রেখা। দ্রুত ঘরে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে এলো যাতে দ্রোহের ঘুম না ভাঙে। নাম না দেখেই ফোন রিসিভ করতেই ঘুমুঘুমু কণ্ঠে দ্রোহ বলে উঠল,

— এখনও ঘুমাস নি রিখি?

— ঘর থেকে হেঁটে বারান্দায় আসতে পারলেন না অভি? ফোন করলেন এই ১০ কদমের রাস্তা পার না হয়ে?

— একটাও কথা বলবি না। আমি নিচে যাচ্ছি। কিছুক্ষন পর ফোন দিলে তুইও নিচে নামবি।

বলেই দ্রোহ কল কেটে দিল। রেখা হাসল শুধু। আগেও দ্রোহ একবার এমন করেছিল। তখন রেখা পাশের বারান্দায় ছিল আর এখন সে নিজেই দ্রোহের বারান্দায়। রেখা জানে এখন কি হবে। দ্রোহ গিয়ে ইমনের ঘুম ভাঙিয়ে ঝগড়া করবে অনেকটা সময় নিয়ে। তারপর ওর বাইকের চাবি নিয়ে আসবে। সেই বাইকে অনেকটা সময় দুজনে মিলে রাতের শহর ঘুরবে।

ভাবতে ভাবতেই কল এলো দ্রোহের। সেই আগের মতই রিসিভ করে কানে ধরতেই দ্রোহ রেখাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,

— নিচে নাম রিখি।

তারপর কেটে দিল। রেখা নিজের গায়ে শালটা জড়িয়ে নিয়ে চুপিচুপি নিচে নেমে গেল। ঘর থেকে বের হওয়ার পর দরজাও ভেতর থেকে লক করে দিল।

নিচে নেমে দাঁড়াতেই দেখল বাইকে হেলান দিয়ে দ্রোহ দাঁড়িয়ে আছে। দ্রোহ তাকে দেখে সেই প্রথম দিনের মতই বলে উঠল,

— একটাও কথা বলবি না। এই বাইকের চাবি নিয়ে আসতে গিয়ে অনেক কথা বলতে হয়েছে। আর মুখে জোর নেই। চুপচাপ বসে পড়।

।সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here