অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ১৮,১৯

অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ১৮,১৯
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১৮

রেখাকে বাস থেকে নামতে দেখে দ্রোহ বাইক থামিয়েছিল। আশেপাশে ঠিক করে দেখে নিয়ে বুঝতে পারল এই জায়গাটা তার চেনা। তবে বহুদিন আগের চেনা। বহু বছর এখানে আসা হয়নি তার। রেখাদের আগের বাড়ি। হাতে থাকা ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল একবার। রাস্তা বেশি দুরের না। তবে ট্রাফিক জ্যামের কারণে আসতে প্রচুর সময় লাগে। বাসে বসে থাকতে থাকতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেওয়া যায়। দ্রোহ নিজেকেই মনে মনে বকল। বাইক নিয়ে না এসে যদি বাসেই উঠে পড়ত তাহলে এক ঘুম দেওয়া যেত। কষ্ট করে বাইক চালাতে হত না। এখানে তো আবার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাও নেই। গন্তব্য জানা থাকলে রাস্তা কোণা দিয়ে ফাঁকা জায়গা পেয়ে এগিয়ে যেত। কিন্তু সে তো এখন রেখাকে ফলো করছে। তাই অপেক্ষাই করতে হলো। পৌঁছাতে আধা ঘণ্টার জায়গা দেড় ঘণ্টা কি তারও বেশি সময় লেগেছে তাদের। তারপর আশেপাশে ভালো করে দেখে নিয়ে রেখার পিছু নিল। সেই একই বাড়ি, একই তলা, একই ফ্ল্যাট। সাথে জাগ্রত হওয়া কিছু পুরনো অনুভূতি। যেন স্মৃতিগুলো এতদিন ধুলোয় চাপা পড়ে সাদা কালো রং ধারন করেছিল। আজ তা এক পশলা বৃষ্টি পেয়ে আবার রঙিন হয়ে উঠল। দ্রোহের সচল মস্তিষ্ক জানান দিল, এই তো করিডোর, সেই দরজা। সেই দিনও রেখা বাবার পিছনে এসে নিজেকে আড়াল করেই বাবার হাতের ফাঁকফোঁকর দিয়ে দ্রোহকে দেখার চেষ্টা চালিয়েছিল। রেখার বাবা সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় বা রাতে বাড়ি ফিরলে দ্রোহ নিজের ঘর থেকে বের হয়ে তার সাথে দেখা করত। তখন রেখাও চুপিচুপি বাবার পিছন থেকে দ্রোহের দিকে তাকাত। এটা দ্রোহ খেয়াল করেছিল। তবে তখন অতটা ভেবে দেখেনি। তবে রেখা খেয়াল করেনি দ্রোহের এই অভ্যাসটা রেখার থেকেই এসেছিল। একটু একটু করে জমে যেই অনুভূতি গড়ে উঠেছিল, তার থেকে দ্রোহ রেখাকে অনুসরণ করা শুরু করে। ছুটির দিনে দ্রোহের এই এক কাজ। সেদিন নিজের ঘরেই ঢুকত না সে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে রেখাকে পর্যবেক্ষণ করত। রেখা কখন ঘর থেকে বের হয়, কখন খেতে বসে, কখন পড়ে- সব কিছু। এর মাধ্যমে গোপন সূত্রে জেনেছিল রেখা বাবার বাড়ি ফেরার সময় তার সাথে দেখা করে পানি দিয়ে যায়। দ্রোহ রেখাকে দেখার জন্য আঙ্কেলের সাথে কথা বলার বাহানায় বের হত। কিন্তু রেখার মতো অন্তর্মুখী মানুষের দেখা পাওয়া বেশ কঠিন। সেই কঠিন কাজ করতে করতে আরও একটু একটু করে “প্রেম” নামক অনুভুতিতে জড়িয়ে পড়েছিল দ্রোহ।

সবটার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ মনে পড়তে থাকে। রেখা ততক্ষণে দরজা আটকে দিয়েছে। দরজার সামনে এসে দাঁড়াল নিঃশব্দে। দাঁড়াতেই মনে পড়ল, এই তো, সে যখন এই দরজা দিয়ে কলেজের জন্য বের হত, তখন পর্দার আড়ালে থাকা দুটি চোখ তাকে পর্যবেক্ষণ করত। শুরু থেকেই করত। তবে দ্রোহ জানতে পেরেছিল অনেক পরে। তারপর থেকেই তো সে কলেজে বের হওয়ার অনেকক্ষণ আগে থেকে ড্রয়িং রুমে এসে বসে থাকত। খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাসও এই জন্যই ধরেছিল। বিনা কারণে তো আর বসে থাকা যায় না বেশি সময়। অবশ্য খবরের কাগজ সোজা করে পড়ার বদলে উল্টো করে পড়ত হয়তো সে। মাঝে মাঝে রেখার বাবা খবরের কাগজ রেখে উঠে পড়তেন, তখন উল্টো হয়ে থাকত। দ্রোহ সোজা হাতে ধরলে তার কাছে উল্টোই আসতো। কিন্তু অতদিকে দেখার সময় কোথায়? দ্রোহ খবরের কাগজ পড়তে আসলে তো? তবে এক দুই লাইন পড়তে হত। নাহলে কেউ যদি হুট করে এসে জিজ্ঞেস করে বসে- আজকেই দেশের অবস্থা কি? কি লিখেছে? তাহলে যাতে ওই একটা লাইন বলে নিজের সৃজনশীলতা মিশিয়ে আরও কিছু মনগড়া লাইন বলে দিতে পারে। সারাটা দিন এমন কত বাহানায় ড্রয়িং রুমে বসা। এমনকি পড়তে বসলেই ড্রয়িং রুমে থাকা টি-টেবিল এ বই রেখে ফ্লোরে বসে পড়ত। রেখাকে পড়ানো শুরু করার পর থেকে দ্রোহ রেখার রুমে বই নিয়ে চলে যেত ঠিকই। তবে দরজা জানালা সব খুলে রাখতে হত। ক্কিছু সময় পর পর কেউ না কেউ রুমে এসে অবস্থা দেখে যেত। কখনো কখনো পাশের বাড়ির ছোট বাচ্চাগুলো আসতো, মাঝে মাঝে রেখার মা। এতে ঝামেলা হওয়ায় রেখার আর দ্রোহের পড়ার টেবিল বের করে এনে ড্রয়িং রুমের এক কোণে রাখা হয়েছিল। মাঝে কিছুটা দুরুত্ব রেখে দুই টেবিল। মাঝে মাঝে কাঠের স্কেল দিয়ে রেখাকে মারার হুমকি দিত। আর পড়া না পারলে তো ১ ঘা মেরেও দিত দ্রোহ, তবে ধীরে। রেখা মাকে ডাকত খুব আসতে, যেন রেখার মা শুনতেই পেতেন না তাদের কথা। মাঝে মাঝে পরীক্ষার খাতা একে অপরকে দেখাত। রেখার খাতা দ্রোহ দেখে দিত। আর দ্রোহের পরীক্ষার খাতার নাম্বার গুলো রেখা সব না বুঝলেও দেখত। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করত এখানে শিক্ষক কম নাম্বার কেন দিয়েছেন। এর মূলত কোন কারণ ছিল না তেমন। দুজন একে অপরের সাথে কথা বলতে চাইত আর মায়ের রান্নাঘর থেকে করা গার্ড। রান্নাঘরের দেয়াল আলাদা করে ছিল না বলে রান্না করতে করতে দেখা যেত সব। একটা বাঁধা ধরা জীবনের মধ্যে লুকিয়ে চুরিয়ে অপরের অজান্তে কথা বার্তা, সব হত। সেই সময়টায় এইটুকু কাজও অনেক গুরুত্ব বহন করত এই দুই জনের জন্য। পরস্পরের প্রতি অনুভূতি অগোচরে থাকলেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটত খুব স্বাভাবিক ভাবে, যেটা বিপরীত দিকের মানুষের অজান্তেই থেকে যেত, ঘটে যেত।

মনে আগমন যখন অজান্তেই ঘটেছে, প্রকাশটাও অজান্তেই থাকুক। অপরপক্ষ যখন বুঝতে পারবে, তখন বাকিটা সামলানোর দায়িত্বটা তার জন্যই তোলা থাকল।

দ্রোহ সেখান থেকে ফিরে গেল। পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো বড্ড বেশিই তারা করছে। এখন রেখার সামনে উপস্থিত হলে নিজের অজান্তে কি করে বসবে- তার কোন ঠিক নেই। তাছাড়া রেখা দ্রোহকে দেখে আবার বাসা বদলাতে পারে। তাই আপাতত দেখা করাটা বন্ধই রাখল। রেখার এখানে আসার কারণটা আগে ভালো করে বুঝে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। মনের অনুভূতি যাই হোক, সবটা বুঝতে বুঝতে দেরি করা যাবে না। সবটা সময় হলে এমনিই বুঝে যাবে- তবে এসবের চক্রে রেখাকে হারাতে চায় না দ্রোহ। দরকার পড়লে গোল্লায় যাক মেয়ে দেখা। সব দেখাদেখি বন্ধ করে একদিন হুট করে রেখা আর বাবা, মা , দিবাকে এক জায়গার ঠিকানা দিয়ে দিবে। সবাই পৌঁছালে টুক করে রেখাকে বিয়ে করে নিবে। তাহলে রেখার আর পালানোর কথা চিন্তা তো করবে না!

_____

রেখার খালামনিকে সকাল সকাল ফোন করল দ্রোহ। রাত করে কল করা ঠিক দেখায় না, আবার ভালো আচরনের মধ্যেও পড়ে না বিধায় সকালের অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বলা যায় অপেক্ষার ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তে এসেও সময়টা অনেক লম্বা মনে হয়। আবার যখন আরও সময় চাওয়া হয়, তখন সময় হাতেই থাকে না। দ্রোহের অবস্থা কিছুটা নয়, পুরোটাই ১ম অবস্থার মতো। সে ফোনে এলার্মও দিয়ে রেখেছে। কিন্তু সেটার অপেক্ষা করতে না পেরে সকাল ৮ টা বাজার ৪-৫ মিনিট আগেই কল করল রেখার খালামণিকে। সালাম দিয়েই ‘কেমন আছেন?’ ‘শরীর কেমন আছে?’ ‘কাজের চাপ বেশি কি না?’ ‘খাবার খেয়েছেন?’ এসব করে তারপর জিজ্ঞেস করল,

— আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে অ্যান্টি?

— হ্যাঁ বলো।

— আসলে রিখি, মানে সরি, মিস রেখা…

— বাড়ি বদলিয়েছে কেন?

— জ্বি। মানে, উনি যখন বাড়ি বদলালেন তখন আমি ঠিক জানতাম না। অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এর মাঝে কোন কিছু সম্পর্কে জানা হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ করে দেখলাম উনি বাড়ি নেই, তখন জানতে পারলাম যে উনি বাড়ি থেকে চলে গিয়েছেন। আর জানলাম বাড়ির সবাই ব্যাপারটা জানত, শুধু আমাকেই জানানো হয়নি।

— বাড়ির সবাইকে তো জানানো হয়েছেই, তোমাকে ছাড়া।

“কারণটা বলেন না অ্যান্টি, প্ল্যান করতে হবে তো নাকি! আমাকে জানানো হয়নি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি।”

মনে মনে কথাটা বলে একটু থামল দ্রোহ। তারপর জোরেই বলে উঠল,

— কেন চলে গিয়েছেন সেটা যদি জানতে পারতাম। তাছাড়া কোথায় গিয়েছেন এটাও যদি একটু জানাতেন। তাহলে ভালো হত, উনার কোন সমস্যা হলে আমরা সাহায্য করতে পারব। তাছাড়া উনি ওখানে ঠিক মতো আছেন কি না সেটাও তো একটু দেখতে হয়।

— নিজেই ফোন করে জেনে নিতে পারো তো তুমি দ্রোহ।

— আরে, ব্লক করে দিয়েছে তো আমা…

দ্রোহ থেমে গেল সাথে সাথে। মনোয়ারা বলে উঠলেন,

— কি বললে? শুনতে পেলাম না।

বলেই মুচকি হাসলেন। দ্রোহ জবাব দিল,

— আসলে নাম্বার হারিয়ে ফেলেছি। ভাবলাম আপনার কাছ থেকেই নেওয়া যাক খবর।

— শুনলাম ও ওর বাবা-মায়ের স্মৃতি নিয়ে থাকতে চাচ্ছে। তবে ওখানে ওর চাচার বাড়িও আছে। শুরুতে ওখানেই উঠেছিল। এখনো ঘর পরিষ্কারের কাজ সহ বিদ্যুৎ পানি আসবাব এসবের ব্যবস্থা করছে রেখা। রেখা এতদিন এসব থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিল বলে ও জানতই না যে ওদের ওই ফ্ল্যাটটা ওর বাবা কিনে ফেলেছিল অইবার কক্সবাজার যাওয়ার আগে। রেখা প্রথমে ভেবেছিল চাচার বাড়িতে কয়েক দিন থেকে তারপর বাড়ি ভাড়া খুঁজবে। এখন নিজের বাড়ি নিজের নামেই আছে জানতে পেরে সেটাই ঠিক করার কাজ ধরেছে রেখা। আর তোমাদের বাড়ি ছেড়ে হঠাৎ কেন গেল- সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করো না। নিজেই রেখাকে জিজ্ঞেস করে দেখো। আমি তোমাকে ঠিকানা দিচ্ছি।

ঠিকানা নিয়ে সালাম দিয়ে কল কেটে দিল দ্রোহ। সেটা শার্ট এর বুক পকেটে রেখে কাজের জন্য তৈরি হতে শুরু করল। কিন্তু শার্টটা হাতে নিয়ে পরার সময় খেয়াল হলো হারিয়ে যেতে পারে ঠিকানা। সেটার ছবি তুলে, কাগজটা ভাঁজ করে ফোন আর ফোন কভারের মাঝে রেখে দিল। ফোন এর নিচে কাগজ রেখে তার নিচে কভার এঁটে দিল ফোনের সাথে। তারপর চলে গেল হাত মুখ ধুতে।

_____

রেখার অবস্থা সচরাচরের মতই। তার বলতে গেলে কোন কাজ নেই, আবার অনেক কাজ আছে। অনেক কাজ আছে বলতে গেলে প্রতিদিনের একই ব্যস্ত রুটিন মেনে চলে কাজ করা। আর কোন কাজ নেই বলতে এই রুটিনের বাইরে এক পাও নড়ে না রেখা। তবে এই রুটিনের মধ্যে দ্রোহের ভাবনায় ডুবে থাকার জন্য একটা অংশ রয়েছে। আর এর সময়সীমা নির্ধারণ করার চেষ্টা একবার চালিয়েছিল রেখা। পরে বুঝতে পারে এই কাজের জন্য তার ক্ষেত্রে কোন সময়সীমা নেই। সারা দিন- রাত এমনকি ঘুমে স্বপ্নেও কাঁথা বালিশ নিয়ে দ্রোহ এসে পড়ে। রেখা নিজের এই অভ্যাসের জন্য নিজের উপর বিরক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে ঠিকই, কিন্তু পারেনি। এক বিন্দু পরিমাণ বিরক্তি আসে নি তার এই কাজে, না এসেছে ক্লান্তি। অদ্ভুত হলেও সত্য, কয়েক দিন ধরে সে ক্লাসে পড়া ধরার জন্য শিক্ষার্থীর নামে বদলে অভি আর দ্রোহ ডাকা শুরু করে দিয়েছে। নেহাৎ তার গলার স্বর আস্তে শোনায়, কাউকে ডাকতে গেলে দুই বার করে ডাকা লাগে, তাই কেউ শুনতে পায়নি। নাহলে বিচ্ছু শিক্ষার্থীগুলো রেখা ম্যাম রেখা ম্যাম করার বদলে “অভি দুলাভাইয়ের বউ ম্যাম” কিংবা “দ্রোহ স্যার এর বউ ম্যাম” বলা শুরু করত। বিচ্ছুগুলোকে সেদিন পরীক্ষার খাতা দিল। নাম্বার সবাই মোটামুটি। কেউ কেউ একটু বেশি খারাপ করেছে। প্রশ্ন কঠিন ছিল যে। কিন্তু সেদিকে কার খেয়াল। সবাই খাতা হাতে নিয়ে বার বার জিজ্ঞেস করছিল

— ম্যাম, আমাদের স্যার এই নাম কি?

— কোন স্যার?

— আপনার বর।

— ইংরেজি বই।

রেখার এমন উত্তর শুনে পুরো ক্লাস মিলে বসে উঠেছিল,

— ম্যাম বলুন না?

রেখা পড়ায় ফিরে গিয়ে সবার মনোযোগ অন্যদিকে সরায় অনেক কষ্টে। আজকার বড্ড সাবধানে কথা বলতে হচ্ছে রেখা। রেখা কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? পাগল হলে তো বিরাট ঝামেলা। অতিরিক্ত ভাবনাগুলো আজকাল অনেক জ্বালাচ্ছে রেখাকে। বিশেষ করে অবাধ্য চিন্তাগুলো যে বড্ড বেহায়া!

চলবে।

#অজান্তে_আগমন
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১৯

স্কুল ছুটি হওয়া বিকাল চারটায়। তারপর শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে চলে আসে রেখা। নিজের হাতে থাকা বইগুলো জায়গা মতো রেখে অন্যসব কাগজপত্র গুছিয়ে নেয়। সারাদিনে কোন কাজ বাকি থাকলে সেটাও শেষ করার চেষ্টা করে নিজের ব্যাগ একবার দেখে নিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে পড়ে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শুধু আধ ঘণ্টা দেরিতে বের হতে হয়েছে সব কাজ শেষ করে। মূল গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান মামাকে সালাম দিয়ে সোজা বের হয়ে পড়ে রেখা। বয়সে বড় হলেও শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই মামা বলে ডাকেন উনাকে। একেবারে বাচ্চাগুলো দাদুভাই বলে ডাকে। তাকে সবাই সম্মান করে অনেক। বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে কর্মরত আছেন বলে। তবে আজ গেট থেকে বের হতেই আচমকা আক্রমণ হয় তার উপর। মাথার উপর কিছু একটা দিয়ে পুরো মুখটা ঢেকে ফেলা হয় তার। সে চিৎকার করলে দারোয়ান মামার হাসি হাসি মুখটা দেখতে পায়। আপনাআপনি ভ্রূ কুঁচকে যায় রেখার। সামনের দৃশ্য দেখতে পেয়ে হাত দিয়ে মাথার উপরের আবরণটা স্পর্শ করে। শক্ত খোলস অনুভুত হতেই বুঝতে পারে এটা হেলমেট। কিন্তু দিনে দুপুরে কোন পাগল হেলমেট পরাতে এসেছে সেটা বোধগম্য হলো না রেখা। তার কিছু ভাবার আগেই তাকে ধরে একটা মোটরসাইকেলে উঠিয়ে নিজেও উঠে পড়ল লোকটা। তারপর রেখার হাত দুটো টেনে নিজের কোমরের দুই দিক থেকে ঘুরিয়ে সামনে এসে বেঁধে দিল। আচমকা ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ায় রেখা কিছু অনুধাবন করতে পারছে না। মূলত অভ্যাসের কারণেই। আচমকা ঘটনায় হ্যাং মেরে বসে থাকা রেখার অতি পুরনো অভ্যাস। সেটার এদিক ওদিক হচ্ছে না এই মুহূর্তেও। কয়েক সেকেন্দেই বাইকে টান পড়তেই রেখা ভয় পেয়ে শক্ত করে লোকটাকে ধরে ফেলে। এই মুহূর্তে সে কাঁধ ধরেছে না কি পেট- সেদিকে রেখার খেয়াল নেই। অনেকক্ষণ ভাবার পর খেয়াল হলো সামনে বসা ছেলেটা শুধু তার মাথায় হেলমেট পরিয়ে দিয়েছে, মুখ তো আর বাঁধেনি। মুখ দিয়ে তো কথা বলতেই পারে। তাই চুপ না থেকে বলে উঠল,

— আপনি কে? আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

— গেলেই দেখতে পারবে।

আওয়াজ পরিচিত মনে হতেই রেখা গোল গোল চোখে তাকাল সামনের মানুষটার দিকে।

— অভি? আপনি?

— এতক্ষণে তোর খেয়াল হলো যে আমি তোর মুখ বাঁধিনি। তোর মাথায় কি বুদ্ধির ছিটেফোঁটা নেই রিখি? কেউ তোকে তুলে ধরে নিয়ে গেলে তো দেখা যাবে তুই এক ঘণ্টা ধরে প্রথমে নিজের নাম মনে করার চেষ্টা করবি। ভয়ে নিজের নাম-ই ভুলে না যাস।

দ্রোহের কথায় রেখা লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে বসে থাকতেই মনে পড়ল তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা। সে তো নিজ ইচ্ছায় দ্রোহের সাথে আসেনি। তাহলে এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা অবশ্যই অন্যায়। সে চিৎকার করে বলে উঠল,

— আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়, দ্রোহ?

— গেলেই দেখতে পারবি।

— থামান, থামান বলছি।

রেখার এই কথা বলতে বলতেই বাইক থেমে গেল। রেখা বোকার মতো চেয়ে রইল। থামাতে বলল আর সাথে সাথেই থেমে গেল? সামনের এলাকার বিখ্যাত তুরাগ নদী দেখে বুঝতে পারল তারা বাস স্ট্যান্ডের সামনে এসে থেমেছে। দ্রোহ রেখাকে নামতে বললে রেখা সাথে সাথেই নেমে পড়ল। দ্রোহ নিজেও নেমে পড়ে পাশে থাকা দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে দ্রোহের কিছু বন্ধুদের দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে দুজনকেই রেখা চিনে। ওদের বাড়ির কাছে থাকে ওরা। ইমন আর অর্পণ। ওরা মাঝে মাঝে ছুটির দিনে দ্রোহের বাড়িতে আসে। সেখান থেকেই পরিচয়। ছেলে দুটো মাঝে মাঝে ওকে ভাবি বলেও ডেকেছে। যদিও প্রতিবার রেখা ওদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছিল, তবুও পরের বার আবার ভাবি বলে ডেকেছে। তাই রেখা আর ঘাটায়নি ওদের। দ্রোহ ওদের সাথে কিছু কথা বলে ওই বাইকটা রেখে আরেকটা বাইক নিয়ে চলে আসলো। এসে রেখাকে আবার বসতে বলল বাইকে। রেখা চুপচাপ বসে পড়ল। দ্রোহের উপর বিশ্বাস নেই। নাহলে আবার টেনেটুনে বাইকে বসিয়েই ছাড়বে। বাইক চলা শুরু করলে রেখা প্রশ্ন করল,

— আপনার এই তুরাগ নদী এতো ভালো লাগে কেন? বিশেষ করে এই রাস্তাটা?

— ভালো লাগে না তো। এখন যাওয়া প্রয়োজন তাই যাচ্ছি। নাহলে জীবনেও এই রাস্তা দিয়ে যেতাম না। এবার ভালো মেয়ের মতো সেই রাতের মতো করে ওড়না চেপে ধরো তো।

রেখা তাই করল। কথা বাড়াল না। কিছুক্ষণ পর দ্রোহ নিজে থেকেই বলে উঠল,

— এখন এই জায়গাটা বিরক্তির লাগলেও আরও ১০ বছর আগে আসতে এখানে। তাহলে এটাকে গ্রাম থেকে কম কিছু বলে মনে হত না। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, সারিসারি গাছের বাহার, পরিষ্কার পানি সব পাওয়া যেত। এখনকার মতো এতো বিল্ডিং ও ছিল না তখন। সব দোতলা ভবন গুলোও তখন ছিল না। আর না ছিল এতো যানবাহন। তখন যে কি ভালো লাগত! বন্ধুরা সপাতে একবার হলেও এই তুরাগ নদীতে নৌকায় উঠতে আসতাম। এখন সময়ের সাথে সাথে মানুষ বেড়েছে। জনসংখ্যা বাড়ায় বাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, বিল্ডিং হয়েছে, যানবাহন আর ময়লার পরিমাণও বেড়েছে। তুরাগ নদীর পাড়ে ময়লা রাখা শুরু হয়েছে। তাই এখন এখানে দাঁড়াতেও ইচ্ছা করে না। মনে হয় নাক কেটে পকেটে ঢুকিয়ে রাখি। কিন্তু ১০ বছর আগে আসলে তুমি এই পানিতেই ডুব দিয়ে বসে থাকতে। তোমাকে টেনে তোলা যেত না।

— আচ্ছা, আপনি তখন বাইক বদলালেন কেন?

— ধুর, কি সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি করেছিলাম, নষ্ট করে দিলে পুরোটা।

— বলুন না।

— তোমার সাথে দেখা করার জন্য। স্কুলে আসতে যাতে দেরি না হয় সেই ভেবে আরেকজনে বাইক নিয়ে ছুঁতে এসেছিলাম। এসে দেখি মহারানী বের-ই হননি। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড়িয়েছিলাম।

— যাক, ওজন কমে গিয়েছে কয়েক কেজি।

— তুই বুঝলি না রিখি, খালি বয়সে আর আকারেই বড় হলি, বাকি সব দিক থেকে পিচ্চি রয়ে গেলি।

— ভালো কথাই তো বললাম। আচ্ছা, বলুন না, বদলালেন কেন?

— বললাম তো, ওটা আরেকজনের ছিল। দেখলাম যেহেতু তুই দেরি করছিস, তাহলে বদলেই নেওয়া যায়। তাই বদলে নিলাম। কিন্তু তোর জন্য ওদের কাছে কথা শুনতে হলো, এতো দেরি করলাম কেন?

— তাহলে এটা আপনার বাইক?

— না, বাবা জীবনেও আমাকে বাইক কিনতে দিবে না। এটা তো ইমনের।

— ইমন ভাইয়ার?

— হ্যাঁ, ওই যে, রাতে তোমাকে নিয়ে নদী ঘুরে আসলাম যেই বাইকে, ওটাই।

— আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? সেটা তো বলুন।

— তুই তো সাঁতার জানিস না, তাই ভাবলাম তোকে গিয়ে তুরাগ নদীতেই ফেলে আসবো। এবার চুপ কর।

রেখা আর কিছু বলল না। দ্রোহের কাঁধে হাত দিয়ে বসে থাকল। দ্রোহ এর মাঝে একবার বাইক থামিয়ে সিএনজি ফিলিং স্টেশন থেকে ডিজেল ভরিয়ে নিল সেসময়। সাথে ইমনকে কল করে বকাবকিও করল। একে তো সন্ধ্যা নেমে আসতে চলেছে, তারুপর বাইক থেমে যেতে পারতো দ্রোহ খেয়াল না করলে। আর এই হুমকিও দিল- এইবার মাথা ভালো আছে বলে বেঁচে গেলি, নাহলে পরের বার সোজা রেখে বাসে উঠে চলে যাব।

দ্রোহের বাইক থামল বিশ্বরোড ফ্লাইওভার এর কাছে। দ্রোহ আর রেখা বাইকেই বসে থাকল চুপচাপ। রেখার চোখ এখানে আসার সাথে সাথেই আটকে গিয়েছিল লেকের পানিতে। দ্রোহ চুপ করে থেকে বলে উঠল,

— এটার নাম কুড়িল ফ্লাইওভার লেক।

— হুম।

— আমার কথা শুনছিস?

— হুম।

— বাড়ি ছেড়ে চলে আসলি কেন?

রেখার দ্রোহের কথায় কোন মনোযোগ নেই। সে পানির মধ্যেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে যেন। পানি পরিষ্কার লাগছে। কিছুটা অন্ধকার হয়ে আসায় রাস্তার লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাথে এখানের সবগুলো ফ্লাইওভারের লাইট তো আছেই। সেগুলোর আলো পানিতে প্রতিফলিত হয়ে অপরূপ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। মূলত রেখার কাছে অপরূপ এই দৃশ্য। সাধারণ মানুষ তো কাজের চাপে এইসবের দিকে ফিরেও তাকায় না। দ্রোহ রেখাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে আবার একই প্রশ্ন করল। রেখা বলে উঠল,

— সব দিক থেকে ভেবেই বাড়ি বদলিয়েছি। সারাজীবন তো আর ওখানে থাকতাম না।

— সারাজীবন থাকলে কিছু বলতাম না তোকে।

— মানে?

— আমাকে তো বলতে পারতিই তুই? আমি সব সমস্যার সমাধান করে দিতাম। আমাকে না জানিয়ে চলে গেলি কি করে?

— সেসব বাদ দিন।

— সেসব জানার জন্যই তোকে এখানে এনেছি। এবার বল।

— কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমি ওখানে থাকলে আপনার সমস্যা হত। তাছাড়া আমার তো এতদিন থাকার কথাও না।

— আসল কথা জানতে চাচ্ছি আমি রিখি।

— কয়েক দিন পরই তো আপনার বিয়ে। তাই না? কেমন লাগছে?

— কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছিস?

— অনেক ব্যস্ত না? আঙ্কেল অ্যান্টির ব্যস্ততার তো শেষ নেই।

— তুই গিয়ে একটু সাহায্য করে দিয়ে আয় না। আমার বিয়ে আর তুই কিছু করবি না?

রেখা দ্রোহের দিকে ঘুরে তাকাল। দ্রোহের দৃষ্টি তখনও পানির দিকে। রেখা নজর সরিয়ে হাসি মুখে বলে উঠল,

— কিছু করব না কেন? আপনার বিয়ের দিন গিয়ে খেয়ে আসবো।

— তাই? ভালো।

আযানের ধ্বনি কানে আসতেই দ্রোহ আবার ঠিক হয়ে বসে পড়ল। বাইক ঘুরিয়ে আবার চলা শুরু করল বাড়ির উদ্দেশ্যে। রেখাকে ওর বাড়ির সামনে নামাতে গিয়ে লেগে গেল এক ঘণ্টা। আব্দুল্লাহপুর এর ট্রাফিক জ্যামেই আটকে থাকতে হয়েছিল অনেকক্ষণ। তাও পাশ কাটিয়ে যাওয়ায় পৌঁছানো গেল। রেখা কিছু না বলেই চলে গেল সেখান থেকে। তার উদ্দেশ্য তখন দ্রোহের থেকে পালানো। নাহলে আরেকটু মাথা খাটালে ঠিকই প্রশ্ন আসতো তার মাথায়,

“দ্রোহ তার বাড়ির ঠিকানা জানল কি করে?”

_____

রেখা খাবার শেষে বেশ কিছুক্ষণ বাড়ি গুছিয়ে নিল। তারপর ক্লান্ত শরীরকে এলিয়ে দিল বিছানায়। বাড়ির সব ময়লা পরিষ্কার করতে অনেকটা সময় লাগবে। তাছাড়া ওর আগের বাড়ির সেই একটা খাট, টেবিল আর চেয়ারও এই বাড়িতে কোনোমতে ঢুকিয়ে রেখেছেন খালামণি। সেগুলো সরাবে কি করে, সেটাও জানে না রেখা। মানুষ এনে আলাদা করে করাতে গেলে টাকা লাগবে। কিন্তু সেটাও হাতে নেই। মাস শেষে হাত ফাঁকাই থাকে। তার উপর বাড়ি পরিষ্কার হতে গিয়েও হয় না যেন। একটা রুম ঠিকঠাক করেছে রেখা। নিজেরটা। সেখানে নিজেকে এলিয়ে দিয়েই নজর পড়ল পর্দার দিকে। জানালা থেকে আসা বাতাসে পর্দা নড়ে উঠছে। সেখান থেকে পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে ড্রয়িং রুম এর সোফা। সেই কোন দিয়ে তাকিয়ে থাকতেই পুরনো কথা মনে পড়ল রেখার। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে দিল রেখা।

রেখা নিজের ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েই ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। তার ভাবনা মতে তার মতো একজন অনাথ মেয়ে, যার উপর পরিবারের কোন ছায়া নেই, একাই উপার্জন করে সে, না আছে রূপ, না আছে গুণ- তাকে দ্রোহের মতো অতো ভালো ছেলের স্বপ্ন দেখার অধিকার কেউ দেয়নি। এটা নেহাত বোকামি। দ্রোহের পরিবারও মেনে নিয়ে পারবে না তাকে। একটা জায়গায় কষ্ট থেকেই যাবে।

তাছাড়া দ্রোহের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। এখন তো কিছুতেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা যাবে না। এটা ঠিক না। কয়েক দিন গেলেই দ্রোহের বিয়ে হয়ে যাবে, সে দ্রোহের পাশে মানায়, সেদিন ই তো দেখে এলো তাকে। তারপর ওই বাড়িতে আর থাকার ইচ্ছা হয়নি রেখার। সে থাকলে পরিবারে যেন কোন অশান্তি না হয়- সেই ভেবেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে ওদের থেকে।

তবে রেখা শুধু নিজের দিক থেকেই ভেবেছে। শুধু একটা পরিণতিকে কেন্দ্র করেই সবটা বুঝে নিয়েছে। দ্রোহের দিক থেকে ভেবে দেখেনি। দ্রোহ যে তার প্রতি দুর্বল হতেও পারে- এই ভাবনা তার আসেনি। দ্রোহের পরিবার যে তাকে মেনে নিতেও পারে- এই চিন্তাও সে করেনি। শুধু একটা কথা ধরেই বসে আছে। কিন্তু রেখা “একই মুদ্রার দুই দিক” ভেবে দেখছে না। নাহলে এই সহজ সম্পর্কটাও এতো জটিল হত না, আর না হতো বোঝার ক্ষেত্রে এত কষ্টের ও সময়সাপেক্ষ্যের।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here