অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ০২,০৩

অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ০২,০৩
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ০২

রাতবিরাতে ঘুরে বেড়ালেই নিজেকে হিমু হিমু অনুভুত হতে পারে। এমন কথা অনেকের কাছেই শুনেছে দ্রোহ। যদিও কেউ পরীক্ষা করে বলেনি। হয়তো কেউ একজন বলেছিল। তারপর তার কথা অন্য সবাইকে বলে বেড়িয়েছে কিছু মানুষ। তারপর এখন হুটহাট যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে এই উক্তি যিনি করেছেন, তার নাম বলো, নিঃসন্দেহে সে সেখান থেকে কেটে পড়ার চেষ্টা চালাবে। সহজ কথায় পালিয়ে যাবে। আর কিছু অতি বুদ্ধিমান মানুষ ইন্টারনেটে খোঁজা শুরু করে দেবে। দ্রোহ যখন প্রথমবার এমন কথা শুনেছিল, তখন সে নিজেও ওই অতি বুদ্ধিমানের কাতারে পড়ে ইন্টারনেটে খুঁজেছিল। নিজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে লাইব্রেরিতে দুপুর থেকে বিকাল খুঁজেছিল। যদি উক্তিদাতার নাম মিলেনি। হিমুসমগ্রের প্রায় সবগুলো বই যাদের কাছ থেকে পেয়েছে, তাদের কাছ থেকেই ধার নিয়ে নিয়ে পড়েছে। যদি কোথাও দেখা মিলে। অদ্ভুত ভাবে তখন তার মাথায় আসেনি যে এটা লেখকের কথা কিংবা অতি পরিচিত কোন গবেষকের কথা হবে না। তারপর হতাশ হয়ে নিজেই রাতে ঘুরে বেড়ানো ধরল। বাবার সামনে যখন ভোরে বাড়িতে ফিরে আসার পর পড়ত, তখন সে আরেক এলাহি কাণ্ড। বাড়িতে তেলাপোকার উপদ্রব কমাতে দরজার নিচের ফাঁকা স্থান আটকাতে ৩০ ইঞ্চির, দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে পরিপুষ্ট কাঠের ২-৩ ঘাও খেয়েছে কয়েকবার। তাও সে ঘা কাজে দেয়নি। বড় হওয়ার পর এই ২৭ বছরে পা দিয়েও সেই কৌতূহল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সারাদিন কাজের চাপের পর রাতে হুটহাট মামা বাড়ির সামনে হাজির হওয়া যেন খুব মজার একটা ব্যাপার। কোথাও ঘুরতে গেলেও সেই রাতেই যাবে। পরের দিন সকালের অপেক্ষা করবে না। নিজের বাড়ি থেকে মামা বাড়ির দুরুত্ব ২ ঘণ্টার রাস্তা। জ্যাম না থাকলে আরও দ্রুত পৌঁছানো যায়। কিন্তু ঢাকা শহর আর জ্যাম হবে না- সে এক স্বপ্নের মতো। ভোরবেলার সময়টা এই ঢাকা শহরকে স্বপ্নের রাজ্য বলেও মনে হয় অনেকের। তখন রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম থাকে না।

আজও দ্রোহ মামা বাড়িতে এসেছিল। রাত হলেও জ্যাম লেগেই আছে। আজ তার ইচ্ছা ছিল হঠাৎ করে রাতে হলুদ পাঞ্জাবী পরে মামা বাড়ি উপস্থিত হবে। রাত করে মামা অন্য কাউকে দরজা খুলতে দেন না। নিজেই খুলেন। তখন দ্রোহকে দেখে যদি তিনি হিমু মনে করেন, তাহলেই পরিকল্পনায় সার্থকতা লাভ হবে। কিন্তু খুঁজে খুঁজে হলুদ পাঞ্জাবী কি, একটা শার্টও পাওয়া গেল না। মাকে ডাকতেই মা রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে বলে উঠলেন,

— জানতাম, এমন কিছু করবি। তাই তোর সব জামা কাপড় আমি তোদের অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। অফিস তো এখন বন্ধ। তালাও সেই অফিসের দারোয়ানের কাছে। আর দারোয়ানের বাড়ি সেখান থেকে আরও ১ ঘণ্টার রাস্তা। জ্যামে পড়লে ওই বাসেই ঘুমিয়ে কাৎ হয়ে পড়ে থাকবি। কেউ দেখবে না। সেখান থেকে তোকে নিয়ে সরাসরি পদ্মা নদী পর্যন্ত চলে যাবে। ভালো না?

— কিন্তু মা, তুমি কি করে জানলে আমি মামা বাড়ি যাব?

— হ্যাঁ তো, আমি তোর মা না? আগে থেকেই তোর বাবার কাছ থেকে শুনে নিয়েছি। মামাকে এই বয়সে এসে হার্ট এট্যাক দেওয়ার অভ্যাস তো তোর আর গেল না। এখন চুপচাপ তোর বাপের কাছ থেকে একটা লুঙ্গি নিয়ে খেতে বসে পড়। আমাকে আর জ্বালাস না বাবা।

বলেই তিনি আবার রান্নায় মনোযোগী হলেন। দ্রোহের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তিনি হাতে থাকা খুন্তি আবার কড়াই এ ডুবিয়ে দিলেন। দ্রোহ কোনোমতে খাবার খেয়ে ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে পড়ে। তার এই আরেক অভ্যাস। ট্রাভেল ব্যাগ ছাড়া কোথাও যাবে না। একবার গিয়েছিল ঘুরতে সপরিবারে। সেখানে গিয়ে দেখে মা ব্যাগ-ই নেন নি। তারপর বাবার সেই ঢোলা প্যান্ট পরে ঘুরতেও যেতে পারেনি। কি যে লজ্জা লেগেছিল। ট্রাভেল ব্যাগে স্বাভাবিক ভাবে দুটো প্যান্ট, দুটো শার্ট বা টিশার্ট, সাথে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকে। বের হওয়ার আগে খালি নিজের ফোন আর ল্যাপটপ আলাদা ভাবে ঢুকিয়ে নেয়।

রাতে পৌছুতেই সেখানে গিয়ে রেখার সামনে পড়ে কি এক একটা ঘটনা ঘটল, সেসবের পর নিজের বুকে হালকা থু থু ছিটিয়ে সামনের রাস্তায় মন দিল। ভাগ্য ভালো ওই বখাটেগুলো উল্টো ওকে মারেনি। আর ওই বয়ফ্রেন্ড না কি ছিল, সেও ছিল বন্ধ করা ছাতা। একেবারে সরু। এক ঘুষিতেই কাৎ। এবারের মতো নিজে বেঁচে গিয়েছে। সৃষ্টিকর্তাতে শুকরিয়া জানিয়ে আবার হেঁটে চলল। এতকিছুর মধ্যেও মামাকে চমকে দেওয়ার পরিকল্পনা মাথা থেকে বের হয়নি দ্রোহের। ৫ তলা বিল্ডিং এর সামনে এসে থামল সে। পুরোটাই তার মামার। মামা থাকেন ৩ তলায়, দুটো পাশাপাশি ফ্ল্যাট নিয়ে। বাকিগুলো ভাড়া দেওয়া। দরজায় বেল বাজিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলতেই জোরে চিৎকার করে সালাম দিয়ে দরজার সামনে উপস্থিত হলো সে। মামাও চমকে গেলেন। তারপর হেসে নিজের ভাগ্নেকে জড়িয়ে ধরলেন আর সালামের উত্তর নিলেন। দ্রোহ সেই অবস্থায় থেকেই বলল,

— আজ আবার মা তোমাকে কল করে সব বলে দিয়েছিল না মামা?

— বুঝে গিয়েছিস?

— তার মানে দিয়েছে। ধুর, একদিন হিমুর ভূত হয়ে এসে সত্যিই ভয় দেখাব।

— আচ্ছা, সে দেখাস। এখন ভেতরে আয়।

দ্রোহ নিজের জুতো জোড়া খুলে সেটা হাতে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। দরজার পাশে রাখা শু-র‍্যাকে সেগুলো রেখে বলল,

— সেই তখন থেকে অপেক্ষা করছ আমার? ঘুমাওনি কেন? নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রাখবে তো মামা?

— আমাকে ভয় দেখিয়ে হার্ট এট্যাক করাতে চাস, আবার ঘুমের দিকে নজর দিচ্ছিস?

— আমি তো জানি, মা তোমাকে সব বলে দিবে, তাই তো এমন করি। কিন্তু তুমি জেনে শুনেও কেন যে নিজের ঠিক করে যত্ন নেও না।

— ওসব বাদ দে। আয়, খাবি এখন।

— আমার পেট ফুল আছে। আমি ঘুমাব। বাই বাই, গুড নাইট। আর জেগে থেকো না। আমি শোয়ার আগে তোমার ঘরে ঢুঁ মেরে দেখব। আর না ঘুমালে আর জীবনেও এখানে আসব না।

এই বলে পাঠিয়ে দিল সে মামাকে। দ্রোহ খুব ভালো করেই জানে, এখন সে মামাকে ঘুমাতে না পাঠালে প্রায় সারা রাত-ই জেগে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। আর সেটা ঘুম পাগল দ্রোহ টেরও পাবে না।

__________

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই সামনে পড়ল মামাতো ভাই রিহান। তাকে দেখেই দ্রোহ বলে উঠল,

— শুভ সকাল রূপ, কেমন আছিস?

রিহান দ্রোহর থেকে শুধু কয়েক মাসের ছোট। প্রায় সমবয়সী বলা চলে। সেও নিজের ভাইয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,

— শুভ সকাল। ভালো আছি। তুই আবার রাতে চলে এসেছিস? দেখাও করলি না?

— তুই যে তখন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলি। তাই ভাবলাম, বেচারা। ওর ঘুম ভাঙলে সারাটা রাত আর ঘুমাবে না। তাই আর জ্বালালাম না। এখন কথায় ধন্যবাদ জানাবি, তা না…

— হয়েছে বাবা। খেতে বসো।

দ্রোহ সোজা মামার কাছে চলে গেল। হাত থেকে খবরের কাগজ টেনে বলে উঠল,

— গুড মর্নিং মাম্মা।

— আমি তোর মা না রে পাগলা, তোর মামা।

— সে একই। মা কে আম্মা বলে ডাকলে মামা কে মাম্মা বলে ডাকতে পারব না কেন?

— তুই বাপ, যা, কথা না বলে খেতে বস।

— এতই যখন খেতে বলছ তোমরা, তখন খাচ্ছি।

বলেই ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল দ্রোহ। পাশ থেকে রিহান বলে উঠল,

— নব, তুই বিয়ে করবি কবে?

— হুয়াট?

— হুয়াট না, হোয়াট বল। ইংরেজির ১২ টা বাজাবি নাকি এখন?

— বিয়ের কথা তুললেই এমন হবে।

— তুই কি তাহলে সন্ন্যাসী হবি?

— নো ওয়ে। বিয়ের বয়স হলেই করব, তুই থাম তো রূপ।

— কেন থামব। আর ২৭ বছরে মানুষ ৩-৪ বাচ্চার বাপ হয়ে যায়।

— সেটাই তো, সেটা বাচ্চার বাপ হওয়ার বয়স, বিয়ের না।

— তুই শুধরালি না নব।

— থ্যাংক ইউ মাস্টার মশাই।

— আমি তোর তারিফ করতে চাইনি, আর করিও নি।

অন্যদিক থেকে মামা চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন,

— রিহান তো ঠিক-ই বলছে। তুই কি বিয়ে করবি না, মি. অভিনব মাহমুদ দ্রোহ।

— না মাম্মা, তুমি বরং তোমার ছেলে অভিরূপ আহমেদ রিহানের বিয়ে দিয়ে দেও, আমি ব্যান্ড নিয়ে আসব সেদিন।

— তুই আমার জেন্ডার নিয়ে টানাটানি করছিস কেন বাপ?

— আরও বলো বিয়ের কথা।

— যাহ্‌, আর বলব না। এক কাজ কর, সারাদিন বাসায় থেকে আর কি করবি, রিহানের সাথে ওদের স্কুলে ঘুরে আয়।

— ঠিক বলেছ মামা, রূপ তুই একটা বিয়ে করে নে। তারপর আমি আমার ভাতিজাকে নিয়ে ওই স্কুলে যাব। তুই টিচার, তোর ছেলে স্টুডেন্ট আর আমি তোর ছেলের অভিভাবক। আহা, তুই বিয়ে করে ফেললে এতদিনে তোর বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে যেতাম আমি।

— এতই যখন শখ, তুই বিয়ে কর না।

— ভাইয়ারা, তোমরা থামবে প্লিজ। আমি ঘুমাব।

বলে উঠল রাহাত। এইচএচসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সে আপাতত ঘুমের মধ্যেই আছে। কোথাও ঘুরতেও যায়নি এমনকি। তাকে দেখে কেউ আর কিছু বলল না। রাহাত ঘরে ঢুকতেই আমার ৩ জনের আলোচনা শুরু হয়ে গেল। দুই ভাইয়ের নাম মিলিয়েই রাখা হয়েছিল ছোট কালে। অভিরূপ আর অভিনব। দেখা হলেই একে অপরকে নব আর রূপ বলে ডাকবে। অভি নামটা তো এক প্রকার বাদ-ই দিয়ে দিয়েছে যেন। বাকি সবাই ডাকনামে ডাকে ওদের। ওরা দুজনেই এই নিয়ম বানিয়েছে। কেই বলেও না তাই।

খাবার শেষে দুই ভাই মিলে বের হয়ে পড়ল স্কুলের উদ্দেশ্যে। রিহান একটা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক পদে আছে। এর পাশাপাশি বাবার ব্যবসা সামলায়। দুই ভাই কিছু করলেই একসাথে করে। একই রকম কাজ করে। দ্রোহও এর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। মাঝে মাঝে শিক্ষক হওয়ার ভূত মাথায় চাপলে তাই করে। তাছাড়া বাবার ব্যবসা সামলায়।

__________

সকালের নিয়মিত রুটিন অনুসারে ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে একেবারে রান্না সেরে নিয়ে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয় রেখা। ৭ টা থেকে ৮ টা একটা ছাত্রীকে পড়িয়ে আবার স্কুলে যায়। ৮.৩০ থেকে স্কুল শুরু হয়ে যায়। নিয়মিত দৈনিক সমাবেশে ছাত্র-ছাত্রীদের দাঁড় করিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের পর জাতীয় পতাকাকে স্যালুট করে আবার শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ঢোকানো। তারপর ৯ টা থেকে ৪ টা ক্লাস।

সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি আজও। ছাত্রীকে পড়িয়ে সেখান থেকে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় সে। চৈত্রের শেষের দিক ঘনিয়ে আসছে। রোদের উত্তাপ সেই তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছুক্ষণ থেমে রইল বিল্ডিং থেকে নামার পর। এরপর হাঁটা শুরু করলে আর থামা যাবে না। থামলে আর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করবে না। অলসতা তাকে ঘিরে ধরবে। কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগটা শক্ত করে ধরল রেখা। সামনে তাকাতে পারছে না রোদের জন্য। তবে চোখ আধ খোলা অবস্থায় চেনা চেহারা দেখতেই চমকে উঠল রেখা। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,

— দ্রোহ?

তারপর নিজের চোখ আবার হাত দিয়ে মুছে নিল। আর দেখতে পেল না সে। গত রাত থেকে দ্রোহের কথা ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে যেন রেখার। সারা রাত খালির ওই ছেলেগুলোর বাজে কথা, তার পাশাপাশি ওই ছেলেটার হাত ধরে টানার কথা মনে পড়ছিল। সাথে সাথে দ্রোহের কথাও বারবার মনে পড়ছিল। কিন্তু এতো কম সময়ে একটা মানুষকে যে হ্যালুসিনেট করা যায়, সেটা জানা ছিল না রেখার। সে আর থেমে না থেকে হেঁটে চলল। স্কুলে পৌঁছে ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে ফাকেই যেন স্কুলের মধ্যে দ্রোহকে হাঁটা চলা করতে দেখল রেখা। একবার নয়, বেশ কয়েক বার। এর জন্য টিফিন টাইমে ওয়াসরুমে গিয়ে টানা ১০ মিনিট ধরে পানির ঝামটাও মেরেছে। তবুও কাজ হয়নি। একেবারে ৪ টায় নিজের ব্যাগ গুছিয়ে টিচার্স রুম থেকে বের হয়ে আসবে এমন সময় কানে আওয়াজ ভেসে এলো রেখার।

— আপনি রেখা না? গতরাতের রেখা?

রেখা মনে মনে ভাবল,

“এবার কি চেহারার সাথে সাথে গলার স্বরও হ্যালুসিনেট করছি? সে কি করে হবে?”

চলবে।

#অজান্তে_আগমন
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ০৩

দ্রোহের কথায় অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কতক্ষণ। দ্রোহ রেখার দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে তার মুখের সামনে তুড়ি বাজায়।

— কোথায় হারিয়ে গেলেন?

— না, কোথাও না। আপনি এখানে?

— হ্যাঁ, এখানে আমার মামাতো ভাই কাজ করে। তার সাথেই আসা। আপনিও কি এখানে একজন শিক্ষক?

— জ্বি।

তারপর কিছুক্ষণ থেমে রেখা নিজেই প্রশ্ন করেছিল,

— গত রাতে আপনি আবার কি মনে করে উপরে উঠেছিলেন?

— আ… আমি? তেমন কিছু না। ওই… ওই রাতের অন্ধকারে ভেবেছিলাম ওটাই বোধ হয় আমার মামা বাড়ি। কিন্তু পরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে বুঝলাম সে ওটা না।

মাথা চুলকে বলে উঠল দ্রোহ। রেখা একটু হেসে বলে উঠল,

— আচ্ছা, তাহলে আসি।

বলেই দ্রোহের কোন জবাবের অপেক্ষা না করেই চলে যায়। বলতে গেলে পালানোর প্রচেষ্টা ছিল তার। দ্রোহের সাথে কথা বাড়াল না। মূলত কারো সাথেই কথা বাড়ায় না সে। সবসময় এড়িয়ে চলে এই বিষয়টা। একা হওয়ার পর থেকে নিষঙ্গ জীবনের প্রতি একটা টান এসেছে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হয় না। নিজের পরিশ্রমেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। একটা রুটিন তৈরি করেছে আর সেটাই মেনে চলেছে রোজ।

__________

ছাত্রীকে পড়াতে পড়াতে কোন সময় যে ভাবনার জগতে ডুবে গিয়েছিল, তার ঠিক নেই রেখার। দ্রোহের কথা মনে পড়তেই সেসব ভাবা বন্ধ করে দিল। ছেলেটাকে অদ্ভুতভাবে চেনা চেনা লাগছে তার কাছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। হয়তো রাস্তায় চলার পথে কখনো দেখেছিল তাকে। সেই ভেবে নিজের কাজে মন দিল। গত রাতের কথা মনে পড়তেই রাগ হলো নিজের উপর। অমন কম বয়সী ইঁচড়েপাকা মেয়ে যে তার ছাত্রী সেটা ভাবতেই নিজেকে গালি দিতে ইচ্ছা হলো। তবে শুধু কয়েকটা শক্ত বকা মনে মনে দিয়েই আপাতত ক্ষান্ত হতে হলো। মানুষকে আজও তার ঠিক করে চেনা হলো না। কি করে যে সে একা এই দুনিয়ায় টিকে থাকবে, সেটাও জানে না।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হলো। টানা ৪ জায়গায় গিয়ে ১ ঘণ্টা করে পড়াতে যায়। সারাদিনে স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি ৫ টা জায়গায় টিউশনি করাতে যায়। এতেই চলে যায় মাস। বাড়িতে আরও ২ টা মেয়ের সাথে থাকে সে। ভাড়া ভাগাভাগি করে দেওয়ায় সুবিধা হয়েছে তার জন্য। কিন্তু কয়েক বছর আগেও এসবের কিছুই জানত না সে। নিজেকে হুট করে বদলে ফেলল কি সুন্দর! এসব নিয়ে ভাবতে না চাইলেও মাথায় চলে আসে। প্রতিদিনের মতো রাত ১০.৩০ এ বাসায় ফিরে নিজে গোসল সেরে নেয়। তারপর সকালে রান্না করা খাবার গরম করে খেয়ে স্কুলের কিংবা অন্য কোন কাজ থাকলে করে। তারপর সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে এক কাপ চা করে চলে যায় নিজের রুমের জানালার ধারে। সেখানে একটা চেয়ার সবসময় রাখা থাকে। মাঝারি আকারের জানালায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আগে চা বানাত না। কিন্তু আজকাল চা পানের নেশা জেগেছে যেন। বাড়ির কাছে স্কুল-বাজার সব হওয়ায় দূরে যেতে হয় না কোন কাজের জন্য। এরজন্য রিকশা আর বাসের অতিরিক্ত খরচটা বেঁচে যায়। সেটা আগে জমিয়ে রাখত। এখন সেটা চায়ের জন্য ব্যয় করছে। খুব হিসাব রেখেই টাকা খরচ করে। কিন্তু মাঝে মাঝে এদিক ওদিক হবেই।

__________

দ্রোহ আবার নেমেছিল রাস্তায়। তবে আজ রাস্তার দিকে কিংবা নিস্তব্ধ পরিবেশের দিকে মন নেই তার। মানুষের বলা বিভিন্ন যুক্তি নিয়েও ভাবছে না সে। মামার সাথে এক দফা কথার যুদ্ধ করেই বের হতে হয়েছে। দ্রোহের এই স্বভাব পুরো পরিবারের লোক জানলেও কেউ মানতে চায় না। বিশেষ করে রাত নিয়ে কুসংস্কার ধাঁচের কথাগুলো যাদের মনে গেঁথে আছে। ভাগ্য ভালো তার যে মা বাবা এরকম হয়নি। কিন্তু গ্রামের আত্মীয়গুলো বিশেষ করে দাদি-চাচি বয়সের মানুষগুলো টাকা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই নিয়ে জ্ঞান দেন। সেগুলো আবার একান দিয়ে ঢুকিয়ে ও কান দিয়ে বের করেও দেয় দ্রোহ। তবে চিন্তা সেখানে নয়।

বিকালের কথাগুলো ভাবছে সে আজ। রাস্তার ধারে কিছুদূর পর পর জ্বলতে থাকা লাইটগুলোর ফলে ফাঁকা রাস্তায় এক অসাধারণ সৌন্দর্য মানুষের চোখে ধরা পড়বেই। হলদেভাব সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশে। অলিগলির মধ্যে থাকা সকল দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। গলির শুরুর দিকে দোকানের সংখ্যা বেশি আসলেও ভেতরের দিকে তার ছিটেফোঁটারও অস্তিত্ব নেই। অনেকটা সময় পর পর পাশ থেকে টুং টাং আওয়াজের সৃষ্টি করে ছুঁতে চলেছে একটা রিকশা। কিন্তু এসবে থাকা সুপ্ত মুগ্ধতা দ্রোহের চোখে ধরা পড়ছে না। শান্ত পরিবেশে পোকাদের আওয়াজ তার কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না।

বিকালে রেখার পালিয়ে যাওয়া দেখে সে ছুট লাগিয়েছিল রিহানের কাছে। রিহান তখন সব গোছাতেই ব্যস্ত। নিজের টেবিল ঠিক করে গুছিয়ে নিচ্ছিল সে। দ্রোহ এসে সরাসরি রিহানের গলা চেপে ধরেছিল। কাঁধের উপর দিয়ে হাত নিয়ে গলা পেঁচিয়ে আশেপাশে সতর্কদৃষ্টিতে তাকায় সে। তারপর ধীর স্বরে বলে উঠল,

— রূপ, তোদের এখানে রেখা নামের কোন টিচার আছে?

রিহান কাজ করতে করতেই বলে উঠল,

— কোন রেখা? রিখিয়া ইসলাম রেখা? ইংরেজির শিক্ষিকা?

— আমি কি জানি?

— তুই তো জিজ্ঞেস করলি।

— তোদের এই স্কুলে কয়টা রেখা নামের টিচার আছে?

— একটাই।

— গাধা। তাহলে এতো পেঁচালি কেন? আগে বললে কি হত?

— আমি আবার কি করলাম? আগে গলা ছাড়। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

এই কথা শোনার পর দ্রোহ আরও জোরে রিহানের গলা চেপে ধরে তারপর ছেড়ে দিল। আর নিজে সেখান থেকে বের হয়ে চলে গেল। “রিখিয়া” নামটা তার বারবার মাথায় আসছে।

এসব ভাবতে ভাবতে একটা ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল দ্রোহ। ডান হাত দিয়ে কপাল ঘষতে থাকল। ভালোই ব্যথা পেয়েছে। তারপর আবার সামনে এগোতে থাকল। একটা জায়গায় এসে থামতেই সামনে তাকাল। গত রাতের বিল্ডিং এটা। সহজ কোথায় রেখার বাসা। রেখার ফ্ল্যাট নম্বর ও মনে আছে তার। ৪-ক। উপরের দিকে তাকাল দ্রোহ। হাত দিয়ে গোনার জন্য উপরে তুলে আবার নামিয়ে ফেলল। কেউ যদি আবার তাকেই ভুল বোঝে! তাই মনে মনে গুনল সে। এক, দুই, তিন, চার। পুরো বিল্ডিঙটায় প্রতি তলায় ৪ টা করে ফ্ল্যাট। আকারে ছোট। তাই বিল্ডিংটা দেখে এই বিল্ডিং এর নামকরণ করতে ইচ্ছা করল তার। গেটের সামে নেমপ্লেট ঝোলানো। সেখানে বড় বড় করে লেখা খান ভিলা (কাল্পনিক)। নামের মধ্যে একটা দাপট রয়েছে। কেউ যদি নাম দেখার পর তারপর বিল্ডিং দেখে তাহলে এই নেমপ্লেট সরিয়ে বড় বড় করে “টিকটিকি ভিলা” লেখা বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়ে যাবে। সরু একটা বিল্ডিং। নিজের এমন অযাচিত ভাবনায় নিজের হেসে ফেলল দ্রোহ। আবার উপরে তাকাল। সবগুলো ফ্লোরেই বাড়ির ভেতর অন্ধকার। শুধু সিঁড়িঘরের যেই জানালা, সেখান থেকে আলো ভেসে আসছে। তবে সবগুলো থেকেই না, কয়েকটা নষ্ট হবে। গুনে গুনে চারতলায় দেখল, সেখানেও আলো জ্বলছে না। গতকালের কথা থেকে আন্দাজ করে নিল রেখার ঘরটা। সেটাও অন্ধকার। বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে। বাইরে চলে এসেছে সেই পর্দা। চাঁদের আলোয় সেই পর্দা দেখা গেল ঠিকই, কিন্তু উঁকি দিয়েও ঘরের ভেতরের কিছু দেখা গেল না।

স্বজ্ঞানে ফিরতেই নিজের কপাল চাপড়াল দ্রোহ। মেয়েদের ঘরে উঁকি দেওয়া তার অভ্যাস হলো কবে? এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মামা বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল দ্রোহ। রেখার চিন্তা সম্পূর্ণ মাথা থেকে বের করে অন্যান্য পুরনো কথা ভাবতে থাকল বাকি রাস্তা।

দ্রোহ চলে যেতে সম্পূর্ণ জানালার সামনে এসে দাঁড়াল রেখা। এতক্ষণ সে ফ্লোরে বসে ছিল। মাঝে মাঝে একটু করে উঁকি দিচ্ছিল মাথা উঁচু করে। দ্রোহকে খেয়াল হতেও বসে পড়েছিল সে। দ্রোহর মুখোমুখি হতে ইচ্ছা হচ্ছে না তার। এমনিই, কোন কারণ ছাড়াই। দ্রোহ চলে যেতেই সে সেখান থেকে চলে গেল। একেবারে এক ঘুমে সকাল করেই তবে উঠবে। এসব কিছু মুহূর্তের টুকরো টুকরো চিন্তা-ভাবনা তার জন্য নয়, এই কথা তো সেই কবেই মেনে নিয়েছে। দ্রোহও তো চলে যাবে। হয়তো রাতে হাঁটার বাতিক আছে বলেই দুই দিন রাতে দেখা হলো। আর স্কুলেরটাও কাকতালীয় ধরেই নিজেকে শান্ত রাখল রেখা।

দ্রোহের রাতে সেই একই রাস্তায় যাওয়ার ঘটনা ঘটল আরও তিন দিন। প্রতিরাতেই যেতে ইচ্ছে হয় দ্রোহের। সারাদিন ধরে নিজেকে হাজার বার বলে যে আজ রাতে আর যাবে না। কিন্তু রাত হলেই সেই বাঁধা ডানা মেলে দূর আকাশে উড়ে যায়। দেখা মিলে না মানুষটার। তবুও এক ভালো লাগা কাজ করে।

অন্যদিকে চায়ের কাপ নিয়ে জানালার ধারে বসে রেখাও অপেক্ষা করে দ্রোহের, নিজের অজান্তেই। রাস্তায় একমনে তাকিয়ে থাকে। এই বুঝি মানুষটা সামনে আসবে আর রেখা টুক করে নিচু হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে তাকে দেখার চেষ্টা করবে। এসব চিন্তা করতে করতেই কাপে থাকা চা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। শেষে দ্রোহ চলে গেলে সেই ঠাণ্ডা চা এক চুমুকে শেষ করতে হয় রেখাকে। কি তেঁতো যে লাগে তখন! এমনিই চিনি দেয় না বললেই হয়। তার উপর ঠাণ্ডা চা তো চা নয়, যেন আস্ত একটা অত্যাচার। তবুও সেই চা-ই ভালো লাগে। ৫ দিনের দেখা, ভুল বলা হলো হয়তো। দেখা তো হয় রাতে। যার মধ্যে দ্রোহ তাকে দেখতে পায় না। কিন্তু রেখা ঠিকই দেখে। এই রাতের অপেক্ষায় ছটফটও করেছে দ্রোহকে দেরিতে আসতে দেখে। নিজের এমন অদ্ভুত পরিবর্তনে নিজেই অবাক রেখা। হয়তো সাময়িক অনুভূতির জন্ম নিয়েছে তার মনে, দ্রোহ এর পর থেকে আসা বন্ধ করে দিলে এই অনুভুতিও চলে যাবে। এসব বলেই নিজেকে বুঝ দিয়েছে সে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here