#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। পর্ব- ৩২(শেষাংশ)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
‘অনুতাপ’ চার অক্ষরের ছোট্টো একটা শব্দ। কিন্তু এর পরিধি, অনুভূতি সুগভীর। অহং,যশ, খ্যাতি, রাগ, দাম্ভিকতা, ক্ষমতার বহরে মানুষ নীতিজ্ঞান ভুলে যায়। মনের উপর অহংকারের ছাপ পড়বার সাথে সাথে কঠোরতা হানা দেয়। ভালো মন্দের দেয়াল ভেঙে চলে যায় অন্য এক পথে। যেই পথের দু’ধারে খারাপ কাজে ভরতি। সেই পথ পেরুবার সময় কত খারাপ কাজ হয়ে, আপনজনের মনে কত দুঃখের প্রলেপ ছড়িয়ে যায় সেই টেরটি পায় না। তারা কেবল সমাজে নিজের নাম, নিজের যশ, খ্যাতি, সম্মান সমুন্নত রাখবার চেষ্টায় পাড়ি দেয় অজস্র পথ। চলতে চলতে ক্লান্ত পথে আকস্মিক তার হুশ হয়। নিজের দিকে তাকায়, তাকায় পেছন দিকে। কপালে ভাঁজ পড়ে। মনে পড়ে কতজন ছিল তার জীবনে, তার ভুবনে। সব চলে গেল কোথায়? আপন মানুষ, সুন্দর সময় সব চাপা পড়েছে। পেছু ফিরে চাইলেই দেখে পথে পথে কত মানুষ তার দিকে আকুলতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। তারই দেয়া গা ভরতি জ/খম নিয়ে একটুখানি স্নেহ পাবার আশায় তাকিয়ে আছে তার আত্মার আত্মীয়। পথ থেমে যায় তার। মাঝপথেই ব্যাকুল হয়ে জীবনের হিসেবে কষতে বসেন।ফলাফলে নিজেকে ব্যর্থ হিসেবেই পান। তিনি সমাজের উচ্চবরর্গীয় ব্যক্তি ব্যতীত কিছুই হতে পারেন নি।
আফসোস, অনুতাপে বুক পুড়ে। পিছু গিয়ে সব ঠিক করবার ইচ্ছে জাগে। এক কদম পিছুবার কালে তিনি অনুধাবন করেন, অতীতে যাবার ক্ষমতা নেই তার। হৃদয়ে বসানো ঘায়ের দাগ মুছবার নয়।
লায়লা আঞ্জুমান ঠিক এই পরিস্থিতিতে আছেন। সমাজে হাই প্রোফাইল ধরে রাখতে গিয়ে নিজের মেঝো মেয়েকে ভীষণ অবহেলা করেছেন, অ/ত্যাচার করেছেন। ভালো মন্দের দেয়াল ভেঙে চলেছেন অন্য এক পথে। মাতৃত্ব ভুলে গিয়েছেন। দাম্ভিকতার ভরে মেয়ের হাজার আকুতি মনে তুলেন নি। নিজ হাতে শেষ করেছেন মেয়ের পুরো কৈশোর, তারুণ্যের কিছু সময়। তিনি এতই কঠোর হয়ে গিয়েছেন যে, এক যুগ মেয়ের সাথে অমানবিক আচরণ করবার পরও হৃদমাঝে বিন্দুমাত্র গ্লানি হয়নি। নিজের কাজের উপর তিনি সর্বদা কঠোর অবিচল ছিলেন। এতকাল বাদে আকস্মিক তার পথ থেমে গেছে, একটা ভিডিও তার পুরো ভাবনাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। তিনি থেমে গেছেন। এতকাল বাদে প্রথমবার তিনি মেয়ের জন্য মমতা অনুভব করলেন। হৃদকম্পন নিয়ে পিছু ফিরেছেন। নিজের ফেলে আসা পথের শেষ প্রান্তে তারই আঘাতে জর্জরিত মেয়ের কাতরানো ঠাহর করতে পারলেন। সমীকরণ মেলাতে গিয়ে নিজেকে ব্যর্থ হিসেবে পেলেন। বুক কাঁপল তার, ভুবন নড়ে গেল। হায়! এ কী হলো! এমন কাজ আমি কিভাবে করলাম! কী করে পারলাম! আফসোস অনুতাপে পুড়ল বুক। তিনি খুব করে চাইলেন অতীতে গিয়ে মেয়েকে সব ফেরত দিতে। কিন্তু পারলেন না। সময়ের তালে মেয়েটা চলে গেছে বহুদূর, এখন চাইলে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায়না। একসময় তাকে পাবার আশায় আকুতি করা মেয়েটাকে এক পলক দেখবার সুযোগ মিলছে না তার। তিনি চটপট করছেন, কিন্তু পারছেন না।
অনুতাপ, আত্মগ্লানির অকুল দরিয়ায় ভাসছেন লায়লা। চোখের তারায় মেয়ের আক্ষেপ, অনুতাপ, কপালে চিন্তার ভাজ সরছে না। সপ্তাহখানেক ধরে ভীষণ মানষিক চাপে আছে। খেতে পারছেন না, ঘুমাতে পারছেন না। চোখ বন্ধ করলেই মেয়ের উপর করা অত্যাচারের দৃশ্যপট ভাসছে। মুশরাফার তালা ঝুলানো রুমটা দেখলেই বুক ভেঙে কান্না আসে, এই রুম থেকে কত ডাক আসতো। অথচ তিনি একটাবার উঁকি দিতেন না। অনুশোচনায় এক রত্তি শান্তি মেলে না। করুণ মনে এই মুহুর্তে মুশরাফার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন লায়লা। মুশরাফার বিয়ের আগে যেদিন রুগ্ন হয়ে এ বাড়ি ছেড়েছিল, সেদিনই এই রুমে তালা দিয়েছে সাফা। হৃদয়ের সাথে ঘরের দরজাও বন্ধ করেছে। এতমাস আর খোলা হয়নি। মেয়েকে পাশে না পেয়ে মেয়ের স্পর্শী জিনিস ছুঁয়ে দেখবার ইচ্ছায় এই রুমে যাবার মনস্থির করলেন লায়লা। কাজের মেয়েকে ডেকে চাবি দিয়ে তালা খোলালেন। মাকড়সার বাসা বেধে ফেলেছে।, ধুলো ময়লা ঢেকে পড়েছে সব ফার্নিচার। কাজের মেয়ে জেসি বলল,
‘ম্যাডাম, ভেতরে তো ময়লা। আপনি দাঁড়ান, আমি পরিষ্কার করে দিই।’
লায়লা জেসির দিকে তাকালেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের হেল্পিং হ্যান্ড বেশ স্মার্ট। গ্রাম থেকে আসবার সময় নাম ছিল সকিনা। এখানে ক’দিন থাকবার পরেই নিজেই নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘জেসিকা’ রাখল। এই পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছে চমৎকারভাবে। কথার ধাঁচ সুন্দর। মোটা অঙ্কের বেতন থেকে চলাফেরা বেশ মার্জিত। এ বাড়িতে হেল্পিং হ্যান্ডরাও বেশ যত্নে থেকেছে। অথচ তাদের মেয়েটার অযত্নের শেষ ছিল না। লায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা রুমের চৌকাঠে পা ফেলতেই চড়া গলায় বললেন,
‘ একটা জিনিস ও ছুঁবি না। যেমন আছে তেমন থাকুক। যা তুই!’
মেয়েটা আমতা আমতা করল,
‘কিন্তু এখানে ভীষণ ধুলো..
লায়লা চোখ রাঙালেন, ‘ যেতে বলছি তোকে!’
জেসি ভীত মনে চলে গেল। ধীর পায়ে রুমে ঢুকলেন লায়লা। মাকড়সার জালে আবৃত রুমটা খুবই সাধারণ। একটা খাট, ড্রেসিংটেবিল, পড়ার টেবিল আর একটা কাভার্ড। পুরো বাড়িতে আভিজাত্যের বহর, কেবল এই রুমের সাধারণ ছোঁয়া। বিছানায় বালিশ দুটো এখনো পড়ে আছে, ড্রেসিংটেবিলে কিছু স্ক্রিন কেয়ার প্রোডাক্ট গোছানো, টেবিলে তাকে হরেক বই। একটা খাতা এখনো উলটানো, উপরে একটু কলম। চেয়ারের উপর টাওয়াল পড়ে আছে। এই বাসায় ইঁদুর নেই বলেই এসব রক্ষা হয়েছে। সব জিনিসপত্র আগের মতোই আছে। কেবল নেই রুমের মালিক। লায়লার মনে হলো, এই তো খাটেই বসে আছে মেয়েটা। তার দিকে তাকিয়ে আছে। ডাকছে তাকে আলতো সুরে, ‘মা?’ কিন্তু নেই মেয়েটা। লায়লা ধুলোপড়া বিছানাটা ছুঁয়ে দেখলেন, আলতো হাতে। যেন মেয়েকে অনুভব করছেন। তার চোখে কাতরতা, অনুতাপ। রুমে চোখ ঘুরাবার সময় মেঝেতে পড়ে থাকা স্কেলে চোখ পড়ল। এই স্কেলটা দিয়েই যাবার দিন খুব মে/ রেছেন মেয়েটাকে। অনুতাপে ডুকরে উঠলেন লায়লা। চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন। জেসি দৌড়ে আসল,
‘কী হয়েছে ম্যাডাম?’
চোখ মুছলেন লায়লা। কান্না চেপে কাতর স্বরে বললেন, ‘একটা কাপড় আন। খুব ধুলো পড়ে গেছে।’
জেসিকা একটা কাপড় নিয়ে এসে নিজেই মুছতে ধরল। লায়লা হাত বাড়িয়ে বললেন,
‘আমার মেয়ের জিনিস আমি পরিষ্কার করব। তুই যা।’
‘আমার মেয়ে’ শব্দ দুটো শুনে জেসি হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে চাইল। এ বাড়িতে আছে সাত বছর যাবত। কখনো লায়লার মুখে মুশরাফাকে মেয়ে বলতে শুনেনি। কখনো আজকের মতো লায়লার মাঝে মেয়ের জন্য আন্তরিকতা দেখেনি। আদর সোহাগের বালাই ছিল না। কী নি/ ষ্ঠুর ব্যবহার ছিল মেয়ের প্রতি! এক বেলা মেয়েকে খেতে ডাকতে অবধি দেখেনি। রাগ ছাড়া এই রুমমুখো ও হতেন না। যখনই এই রুমে আসতেন মেয়ের সাথে রাগারাগি করতেন, মা/রতেন। মেয়েটা নিরবে সহ্য করে যেত। ওর চোখের সামনেই তো মেয়েকে লাঠিপেটা করে বের করেছে। আজ হঠাৎ মেয়ের জন্য এত দরদ! এ যেন স্বপ্ন! ম্যাডামের সুমতি ফিরেছে? জেসিকে বিস্ময় বাড়িয়ে লায়লা নিজেই কাপড়টা নিয়ে নিলেন । তারপর নিজ হাতে মেয়ের রুমের ফার্নিচার মুছতে লাগলেন। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল তখন। সব মুছে কাভার্ড খুললেন। এক কোণে পড়ে থাকা মেয়ের সেলোয়ার-কামিজ, পারিবারিক ছবিতে ভরা এলবাম পরখ করতেই বুক কাঁপতে লাগল তার। টেবিলের উপর খোলা খাতায় লেখা কয়েক লাইন। লায়লা ঝাপসা চোখে চোখ বুলালেন লেখাটায়,
‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে। তাঁদের একজন অথবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁদের উফ্ (বিরক্তিও অবজ্ঞামূলক কথা) বলবে না এবং তাঁদের ধমক দেবে না; তাঁদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলবে। মমতাবশে তাঁদের প্রতি নম্রতার ডানা প্রসারিত করো এবং বলো, “হে আমার প্রতিপালক! তাঁদের প্রতি দয়া করো, যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছেন।’ (সুরা-১৭ ইসরা-বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩-২৪)।’
এর কিছুটা নিচে লেখা, মা, মা, আমার মা। এই কুরআনের আয়াত লেখবার পর বোধহয় লায়লা কথাই স্মরণ করেছে মেয়েটা। লায়লা আয়াতের অর্থটা পড়লেন বারদুয়েক। এই জন্যই এত অত্যাচারের পর ও মেয়েটা তার প্রতি একটু ও ক্ষোভ প্রকাশ করেনি? পূর্বের ধারাতে ভালোবেসে গেছে, এখনো বেসে যাচ্ছে। লায়লার অনুতাপ বাড়ল, গভীর ভাবে অনুভব করলেন মেয়েকে। লেখাটা ছুঁয়ে শব্দ করেই কেঁদে উঠলেন। জেসি বিস্মিত চোখে দেখে গেল এক মায়ের নতুন করে জন্মানো মাতৃত্বের প্রতিচ্ছবি।
ফারুকী অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছেন সবে। কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলল জেসিকা। ক্লান্ত মুখে ফারুকী বললেন, ‘এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দে।’
পানি এনে দিতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘ আঞ্জু কোথায়? ‘
জেসি যেন এরেই অপেক্ষায় ছিল। আফসোসের ভান করে বলল, ‘ম্যাডাম তো রাফা আপুর রুমে।’
ফারুকী চমকে প্রশ্ন করলেন, ‘রাফা এসেছে?’
চাপা উদ্বেগ দেখা গেল তার মাঝে। জেসি বলল, ‘না। ম্যাডাম রাফা আপুর খালি রুমে গিয়ে কাঁনতেছে।’
ফারুকীকে বেশ হতাশ দেখাল। যেন তিনি অন্য কিছু আশা করেছেন। ভ্রু কুঁচকে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে গেলেন।
চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দেখলেন লায়লা এলবাম হাতে খাটে বসে আছেন। একটা ছবিতে হাত বুলাচ্ছেন আর কাঁদছেন। ফারুকী সারারুমে চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ধীরে বললেন, ‘ এখানে কী করছো তুমি!’
লায়লা চোখ তুলে তাকালেন। ফারুকী এগিয়ে এলেন স্ত্রীর দিকে। লায়লা বিরস চোখে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘রাফা আমাদের মেয়ে ছিল। এই যে ছোট্টো মেয়েটা!’ কাতর চাহনিতে ইঙ্গিত করলেন ছবির বুকে ছোটো এক পুতুলের দিকে। ফারুকী দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইলেন সেই ছবির দিকে। চোখে ভাসল কত ছবি!
লায়লা শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়লেন বিছানায়। মুর্ছা গেছেন। ফারুকী উদ্বিগ্ন হয়ে ডাকলেন, ‘আঞ্জু! আঞ্জু! হোয়াট হ্যাপেন্ড? কী হলো তোমার?’
লায়লার সাড়াশব্দ নেই। নেই নড়চড়। কপালে ভাঁজ পড়ল ফারুকী। বারকয়েক ডেকে সাড়া না পেয়ে কল করলেন পারিবারিক ডাক্তার মোঃ সফিউল উদ্দিনকে। তিনি এসে চেইক করে বললেন। ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ালেন। তারপর ফারুকীর উদ্দেশ্যে গম্ভীরকন্ঠে যা জানালেন। তার সারমর্ম হলো; স্ট্রেসের কারণে এমন হয়েছে। কোন একটা বিষয় নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। শরীর দুর্বল তার। তার স্ট্রেস দূর করতে হবে। কোনভাবে স্ট্রস নেয়া যাবে না। অন্যথায় অ্যাটাকের শঙ্কা আছে।
সাফা বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে সকাল বেলা। জেসির ফোন পেয়ে বাড়ি ফিরল। মায়ের অবস্থা দেখে শুনে বাবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল, ‘মম কী নিয়ে এত টেনসড, ড্যাড? ‘
ফারুকী উদাসী চোখে চাইলেন কেবল উত্তর দিলেন না। সাফা আবার বলল, ‘তারিফের বিয়ে নিয়ে? কিন্তু সেটা তো তারিফ, আংকেলের সাথে যোগাযোগ করে দু’দিন আগে সময় নিয়েছে। তাহলে মম স্ট্রেস নিচ্ছে কেন? হোয়াট এবাউট?’
ফারুকী তৎক্ষনাৎ জবাব দিলেন না। সময় নিয়ে ছোটো করে উত্তর দিলেন, ‘রাফা। ‘
সাফা বিস্মিত চোখে চাইল বাবার পানে। দাম্ভিক বাবার চোখে আজ কিসের এক ছায়া ঠাহর করতে পারল সে। এটা কী ছিল? মায়া? অহং? নাকি অনুতাপ?
•
ভগ্নিপতির কাছে খবর শুনে নাজমুল সাহেব এলেন বোনকে দেখতে। যেমনই হোক বোন, অসুস্থতার কথা শুনে রাগ ধরে রাখতে পারেন না। বোনের বিধ্বস্ত মুখ, কাতর চোখ দেখে যারপরনাই অবাক হলেন। এই লায়লার সাথে পূর্বের লায়লার আকাশ পাতাল তফাৎ। নাজমুল সাহেব বোনের পাশে এসে বসলেন। ধীরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছিস? ‘
রুগ্ন শরীর নিয়ে বিছানা নেয়া লায়লা ভাইয়ের কথার জবাব দিলেন না। আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
‘ ওরা কোথাও আছে তুমি জানো ভাইয়া?’
নাজমুল সাহেব ইঙ্গিতটা ঠিক বুঝতে পারলেন। দশদিনের ট্যুর শেষে সবে কাল ফিরেছে মুশরাফারা। জাওয়াদ-মুশরাফা তাদের বাসায় গিয়েছে। জায়ফাকে নিয়ে তারিফ চট্রগ্রামে আছে। সব মিটমাট হবার আগে বাসায় ফিরবে না, আর না ফিরবে নিজ শহরে। যোগাযোগ ও রাখবে বিচ্ছিন্ন। নাজমুল সাহেবকে কড়া গলায় বলে দিয়ে যেন তাদের খোঁজ না দেয়। নাজমুল সাহেব কথা দিয়েছেন। তিনি ওয়াদা স্মরণ করে নির্বিকার স্বরে বললেন, ‘জানি না।’
লায়লা ভাইয়ের হাত ধরে ফেললেন, ‘আমি জানি তুমি জানো। প্লিজ ভাইয়া! একটা বার বলো কোথায় আছে ওরা? আমার রাফার কাছে নিয়ে যাও!’
এই প্রথম মুশরাফার প্রতি লায়লার উদ্বিগ্নতা ঠাহর করলেন নাজমুল সাহেব! কী যে আনন্দ লাগল তার! বোনটার অবশেষে সুমতি হলো! তিনি মনে মনে খুব হাসলেন। ইচ্ছে করে বললেন, ‘কেন নিব? আবার মারবি ওকে? ওর জীবন তো শেষ করে দিয়েছিস। মেয়েটা তো সরে গেছে, এখন কী চাস?’
লায়লা উদ্ভ্রান্তের মতো বললেন, ‘আমি আমার মেয়েকে চাই, আর কিছুই চাই না।’
‘যা করেছিস তুই, পাবার আশা দেখছি না। আমি কোন মুখে জাওয়াদকে তোর কথা বলব? মুখ রেখেছিস?’ ক্ষোভ নিয়ে বললেন নাজমুল সাহেব। লায়লা অনুতাপের কান্নায় ভেঙে পড়লেন। নাজমুল সাহেব চেয়ে চেয়ে দেখলেন। কিছুই বললেন না। কিছু দৃশ্য করুণ হলেও চমৎকার। এই দৃশ্যটা তেমন। দেখতে ভালো লাগছে তার। তিনি দেখলেন, তারপর ধীরে বললেন, ‘ নিজের খেয়াল রাখিস। আসি।’
বলে উঠে দাঁড়ালেন। লায়লা কাতর চোখে আকুতি করলেন, ‘ভাইয়া আমার মেয়েটা…
নাজমুল সাহেব যেতে যেতে নিষ্ঠুরের মতন গম্ভীরমুখে বললেন, ‘ ওকে আ/ঘা/ত করবার সময় আমার হেল্প চাসনি। এখনো চাস না। আমি কোন হেল্প করতে পারব না। জাওয়াদ থেকে পারলে মেয়েকে নে। ‘
•
রাত নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। জিশানের বাসার রান্নাঘরের পরিবেশ জমজমাট। জেরিনের হাতের বিরিয়ানি অমৃত। গেল কাল জিশান আবদার করেছে, ‘আপু, তোর হাতের বিরিয়ানি খাওয়া হয়না অনেকদিন। কাল করিস তো! ‘ ভাই মুখ ফুটে বলেছে, জেরিন করবেনা তা তো হয়না। ব্যাস, জেরিন আজ রান্নার দায়িত্ব কাধে তুলে নিল। তাকে সঙ্গ দিচ্ছে তার মা আর দুই ভাইয়ের বউ। ননাশের পাশে মেরিনেট করা চিকেন ভাজতেছে মুশরাফা । সালাদের শসা কা/টছে কাকন। মায়মুনা চুলোর পাশে চেয়ারে বসে সবার কাজ তদারকি করছেন। সেই ফাঁকে চলছে আড্ডা। এই সেই কত গল্প! ছেলেরা কেউ ফিরেনি এখনো। জিশান টিউশনিতে, দশটার আগে ফিরবে না। বাকিরা অফিসে। আসবার সময় হয়ে এলো। এই ফাঁকা বাসায় মুশরাফাও বেশ আমোদে আড্ডায় অংশ নিয়েছে।
গল্পের মাঝে আকস্মিক কাকন বলল, ‘ আচ্ছা মুশরাফা, তোমাদের বিয়ের বছর হতে চলল অথচ তোমার ভাইকে বিয়ে থেকে এ অবধি কখনো দেখিনি। বিয়েতেও আসেন নি। হুট করে ইদের দিন এলেন! ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে। উনি এতদিন আসেন নি কেন?’
জা-য়ের জটিল প্রশ্নবাণে মুশরাফা থমকাল। বিব্রতবোধ করল। ওকে ভীষণ অপ্রস্তুত দেখাল। মায়মুনা আকস্মিক বলে উঠলেন, ‘ আসবে কিভাবে? ওর ভাই তো বিদেশ ছিল। এইতো কদিন আগে এলো। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালোই। ‘
মুশরাফা তৎক্ষনাৎ শ্বাশুড়ির দিকে তাকাল। মায়মুনা আলগোছে হাসলেন। প্রশ্রয়ের ঝলমলে হাসি। শ্বাশুড়ির এই আগলে নেয়াটা ভীষণ ভালো লাগল মুশরাফার। সে হাসল। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্যকথায় গেল।
অফিস থেকে ফিরে বাসায় তালা দেয়া দেখে ভ্রু কুঁচকাল জাওয়াদ। তারপর কালবিলম্ব না করে জিশানের বাসার কলিংবেল চাপল। দরজা খুলল জিহান। উৎফুল্ল স্বরে বলল, ‘চাচ্চু!’
জাওয়াদ হাসল। ওর হাতে চকলেট দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘তোর চাচ্চি এখানে আছে?’
‘হ্যাঁ। চাচ্চু জানো, আজ পার্টি হবে? ফুপ্পি বিরিয়ানি করছে।’ বেশ উৎফুল্ল জিহান। জাওয়াদ এক গাল হাসল। বিরিয়ানির মৌ মৌ ঘ্রাণ নাকে যেতেই এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। মায়ের কল পেয়ে কথা বলতে বলতে বাসায় গিয়েছে কাকন। রান্নাঘরে বাকি তিন নারী। দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিল জাওয়াদ। ছেলেকে দেখে এক গাল হাসলেন মায়মুনা!
‘এসে গেছিস! ফ্রেশ হয়ে আয়। আজ জেরিন বিরিয়ানি করছে। ‘
জাওয়াদ উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘বাবা, ভাইয়া, জিশান সবাই আসুক। একসাথে খাবো।’
মুশরাফা জাওয়াদের দিকে তাকাল। চোখাচোখি হলো, হাসি বিনিময় হলো কেবল। ধীরে বলল,
‘চা দিব?’
‘দাও।’
জেরিন বলল,
‘ আচ্ছা শুন না?’
‘হ্যাঁ, বল।’ আগ্রহী চোখে বোনের দিকে তাকাল জাওয়াদ।
‘ তোদের বিয়ের এতগুলো মাস পেরিয়ে গেল অথচ এখনো মুশরাফাকে আমার বাসায় নিতে পারলাম না। তাও আমি চাইছি আমি যাবার সময় ওকে নিয়ে যাব। কদিন বেড়িয়ে আসবে। কী বলিস?’ ভাইয়ের কাছে যেন অনুমতি চাইল জেরিন।
জাওয়াদের কপালে বিতৃষ্ণার চাপ পড়ল এর পরেই। যেন এই আবদার করে অপরাধ করে ফেলেছে জেরিন। আকস্মিক প্রতিবাদী সুরে বলল, ‘একদম না।’
ওর এহেন মুখভঙ্গিতে জেরিন আর মায়মুনা অবাক চোখে চাইল জাওয়াদের পানে। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল মুশরাফাও। ওদের চাহনিতে বিব্রতবোধ করল জাওয়াদ। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
‘না মানে এখন যাবার দরকার নেই। পরে আমি দিয়ে আসব।’
জেরিন ভ্রু কুঁচকাল,
‘এখন গেলে সমস্যা কী?’
জাওয়াদ ভেবেচিন্তে বলল, ‘ অনিকের ফ্যামিলিকে দাওয়াত করেছি। আন্টিরা আসবেন কয়েকদিনের মধ্যে। রাফা এখন গেলে থাকতে পারবে না। এতদূর জার্নি করে যাবে, তারপর আবার ফিরতি গাড়ি ধরতে হবে। তারচেয়ে বরং সব ঝামেলা মিটুক তারপর যাবে না হয়! রিল্যাক্সলি কদিন বেড়িয়ে আসবে।’
জেরিন জোর করতে গেল। মায়মুনা ইশারায় নিষেধ করলেন। ছেলের মতিগতি বোঝা হয়ে গেছে তার। মুশরাফার চোখে তখনো প্রশ্ন। অনিকের মা আসবে সে কথা বলেনি জাওয়াদ। মিথ্যা বলল কেন! সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ টাইয়ের নাট ঢিলে করে বলল, ‘আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’
বলে পা বাড়াল। এক কদম গিয়ে আবার পিছু ফিরল। কী যেন বলতে চাইল, বলতে পারল না। অস্বস্তি নামল চেহারায়। আবার পা বাড়াল সামনে। মায়মুনা বেশ ঠোঁট চেপে হাসলেন। উঁচু গলায় বলল,
‘মুশরাফা, এখানে চুলোয় তো জায়গায় নেই। তুমি বরং জাওয়াদের চা-টা বাসায় গিয়ে বানাও। ‘
মুশরাফার ভাজার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিছুক্ষণের মাঝেই চুলো খালি হয়ে যাবে। মুশরাফা শ্বাশুড়ির দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল। তিনি হেসে বললেন, ‘ছেলেটা সারাদিন অফিস করে ফিরেছে। কিছু লাগবে কি না দেখো!’
মুশরাফা হেসে বিদায় নিল। মায়ের কথা শুনে বাসার সামনে দাঁড়িয়েছে জাওয়াদ। মুশরাফা এসে এক গাল হেসে সালাম দিল। তারপর তালা খুলায় মন দিল। জাওয়াদ সালামের উত্তর নিয়ে বলল,
‘ এ বাসা, ও বাসা যেখানে থাকো আমার অফিস থেকে ফিরবার সময় হলে আমাদের বাসায় চলে আসবে। আমি এসে যেন তোমাকে বাসায় পাই।’
জাওয়াদের স্বর গম্ভীর। ও কী রেগে আছে! বাসায় ফিরে বউকে না দেখে মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে গেছে বোধহয়। মুশরাফা মুখচেপে হাসল। বলল, ‘ আচ্ছা।’
তালা খুলে ভেতরে ঢুকল। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালে জাওয়াদ বলল, ‘চা লাগবে না। ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো।’
অন্যদিন জাওয়াদ রেগে গেল মুশরাফা দোয়া পড়তে বলে। আজ বলল না। এই রাগটা শীতল, সুন্দর। ট্যুর থেকে ফিরবার পর থেকে বউকে চোখে হারাচ্ছে জাওয়াদ। মুশরাফা ঠান্ডা পানি নিয়ে গেল। জাওয়াদ তখন টাই খুলে রেখে হাত ঘড়ি খুলছে। মুশরাফা পানি এগিয়ে দিল। জাওয়াদ বসে পানি পান করল। বিসমিল্লাহ বলে শুরু করল, আলহামদুলিল্লাহ বলে শেষ করল। তারপর ওঠে ঘড়ি খুলে রাখল টেবিলের উপর। মুশরাফা এসে দাঁড়াল সামনে। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বলল,
‘ জেরিন আপুর বাসায় যাবার অনুমতি দিলেন না কেন?’
‘ ট্যুর থেকে ফিরেছো এক সপ্তাহ ও হয়নি। আবারও যাবার নাম নিতে বুক কাঁপছে না তোমার?’ কী ভীষণ রাগ জাওয়াদের স্বরে!
মুশরাফার হাসি পেল। কিন্তু হাসল না সে। ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বলল, ‘ না কাঁপেনি। আপু বারবার সাধতেছে। আমি ভাবলাম গিয়ে কদিন বেড়িয়ে এলে মন্দ হবে না।’
জাওয়াদের রাগ বাড়ল, ‘হু! তারপর ওখানে গিয়ে দু’দিন যেতেই আমার বিরহে মুখে আঁধার নামাবে। নিজেও শান্তিতে থাকবে না, আমাকে তো শান্তিতে থাকতে দিবেই না। উলটো নিষ্ঠুর উপাধিটাও আমাকেই দিবে। ‘
ওর রাগ দেখে মুশরাফা হেসে ফেলল। জাওয়াদ রাগী স্বরে বলল, ‘আগামী একমাসে ও কোথাও গিয়ে থাকার নাম নিবে না। ‘
মুশরাফা হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনি তো আমাকে ছাড়া থাকতেই পারেন না।’
জাওয়াদ স্বর নরম করে বলল, ‘ আপনি তো খুব পারেন, তাই না! ‘
মুশরাফা প্রশ্রয়ের হাসি দিলে। হাসিমুখে বলল, ‘মিথ্যা বাহানা দিলেন কেন? বীরের মতো বলে দিতে পারতেন, বউ ছাড়া আমি থাকতে পারব না। এই জন্য আমি আমার বউকে কোথাও যেতে দিব না।’
ওর কথার ভঙি দেখে হেসে ফেলল জাওয়াদ। দু’হাত ওর কাধে তুলে দিয়ে বলল, ‘ মিথ্যা বলিনি। আন্টি সত্যিই আসবেন।’
‘আমাকে বলেন নি কেন?’
‘ বলব বলব করে বলা হয়নি। ভুলে গেছিলাম।’
মুশরাফা ঠাট্টার সুরে বলল, ‘ বউ যাবার কথা শুনে স্মরণে চলে এল! বাহ্! আপনার স্মরণশক্তি ও কী রোমান্টিক!’
স্মরণশক্তি রোমান্টিক! কথাটা শুনেই হো হো করে হেসে উঠল জাওয়াদ। সারাদিনের সব ক্লান্তি ঝরে গেছে। কী প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে ওকে!
প্রেমঘন মুহুর্ত চলছিল। ফোনটা বাজল তখন। জাওয়াদ মুশরাফাকে এক হাতে আগলে নিয়ে নাম্বার না দেখেই ফোন কানে তুলল। অপাশ থেকে পুরুষালি স্বরে ভেসে এলো,
‘হ্যালো… কেমন আছো?’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। স্বরটা তার অপরিচিত, নাম্বারটাও। এমন দাম্ভিক স্বরে কথা বলবার মানুষটা কে হতে পারে? জাওয়াদ ভাবল কিছুক্ষণ।
আকস্মিক তার মনে হলো, মুশরাফার পরিবার থেকে কেউ হতে পারে। মা ভাই তো ফোন করে ফেলেছে। বাদবাকি কে আছে? বাবা আর দুলাভাই! তাদের কেউ হতে পারে। জাওয়াদ তৎক্ষনাৎ স্ত্রীর পানে চাইল। শক্ত করে আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা, মাথা তুলে তার দিকেই চেয়ে আছে। চোখ ভরা দুষ্টুমি খেলা করছে। এই ক্ষণে ছাড়াছাড়ি হবে না। নিশ্চিত মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলছে। জাওয়াদ মুশরাফার কপালে আসা চুল সরিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ‘ ইয়াহ, আই এম অলরাইট। বাট হু…
কথা শেষ করতে পারল না জাওয়াদ। কলার নিজ থেকেই পরিচয় দিলেন, ‘ ফারুকী সিদ্দিকী। তোমার সাথে কিছু জুরুরি কথা ছিল। তুমি কি ফ্রি আছ?’
ফারুকীর স্বর শান্ত, গম্ভীর, স্বাভাবিক। জাওয়াদ বিব্রতবোধ করল বেশ। এই মানুষটার সম্পর্কে সে কখনোই ভাবনায় আনে নি। সেই যে বিয়ের সময় দেখা হলো। আর দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। মুশরাফার বিভীষিকাময় জীবনে ফারুকীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা না থাকলেও পরোক্ষ ভূমিকা আছে ঠিকই। তার স্থানটা অনেকটা তারিফের মতো। যে নিজে কিছু করেনি, তবে লায়লাকে সাপোর্ট করেছেন। ক্ষোভের পরিমাণ লায়লার মতো না হলেও কম নয়। এই লোকটা কী বলবে তার সাথে। জাওয়াদ মুশরাফার পানে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ‘হুশশশশশ…’ শব্দ করে মুশরাফাকে কথা বলতে নিষেধ করল।
মুশরাফা জানে না কে কল করেছে। তবে মনে হচ্ছে কোন ইম্পর্ট্যান্ট কল। তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল। সে জাওয়াদের মুখে আঙুলের রেখা টানতে লাগল। জাওয়াদ শিউরে উঠল। বিস্মিত চোখে চাইল। মুশরাফা প্রাণবন্ত হাসল। কথা বলতে গিয়ে জাওয়াদের স্বর কেঁপে উঠল, ‘জ্জ্বি! ব্বল্লুউউন!’
ফোনের অপাশের ব্যক্তি প্রশ্নবিদ্ধ স্বরে বললেন, ‘তুমি তোতলাচ্ছ কেন? তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো?’
জাওয়াদ বিব্রতবোধ করল। সে কীভাবে বলবে, আপনার মেয়ের অবেলায় আমার প্রতি প্রেম প্রয়োগের ইচ্ছে জেগেছে। এটা ভয় নয়, প্রেম গ্রহণ করবার অনুভূতি মাত্র।’ বলতে পারল না সে। মুশরাফার দিকে তাকাল। ছাড়াতে চাইল ওকে। মুশরাফা আবার দুষ্টু হাসল, ছাড়বার বদলে শক্ত করে ধরল। আকস্মিক গালে অধর পরশ দিল। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে, ‘ ক্যান ইউ হিয়ার মি, জাওয়াদ?’
এমনতাবস্থায় গুরুজনের সাথে কথা বলা যায়!জাওয়াদ খু খু করে কেশে উঠল! মেয়েটা হাসছে, দুষ্টুমি বাড়ছে তার। এবার সুড়সুড়ি দিচ্ছে। কথা আসছে না ভেতর থেকে। জাওয়াদ মুশরাফার মাথা বুকে চেপে বলল, ‘ ইয়াহ। বলুন!’
‘ তোমার সাথে জুরুরি কথা আছে, তুমি কি ফ্রি আছো?’ গম্ভীর স্বর ভেসে এলো আবার। জাওয়াদ অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘ কোন ব্যাপারে?’
‘মুশরাফার ব্যাপারে। ‘
জাওয়াদ শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ করে শুনতে লাগল। নির্বিঘ্নে কথা বলা গেলে ভালো হতো। এই ক্ষণে ঠিকঠাক কথাও আসবে না। জাওয়াদ মুশরাফার দিকে চাইল। আজ রাজ্যের সব দুষ্টুমি ভর করেছে মেয়েটার মাঝে। অসময়ে জব্দ করবার পায়তারা তার। জাওয়াদ হতাশ শ্বাস ফেলে ধীরে বলল, ‘ কী কথা?’
ফারুকী সময় নিয়ে বললেন, ‘ মুশরাফার মম অসুস্থ। হসপিটালাইজড। ওকে দেখতে চাইছে। তুমি কি নিয়ে আসবে?’
বিস্মিত হলো জাওয়াদ। ফারুকীর কথা শুনে মনে হচ্ছে তাদের সম্পর্কটা বাকি দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক, যে কিনা বাবার ফোন পেয়েই মেয়ে ছুটে যাবে। তার স্বরে আদেশ ছাড়া অনুতাপ, অনুরোধ কিছুই পেল না জাওয়াদ। রাগ হলো তার। এই মানুষগুলো এত কঠোর কেন! রাগ নিয়ে কিছু বলতে গেল, পারল না। কলদাতার মেয়ে আজ অধর পরশের পসরা সাজিয়ে বসেছে। জাওয়াদ বিব্রতবোধ করল। অসহায় চোখে তাকাল স্ত্রীর পানে। মুশরাফা এখন ওর গলা জড়িয়ে ধরে আছে। তার মুখে প্রাণবন্ত হাসি অবিচল। জাওয়াদ উত্তর খুঁজছে, পেয়েছে ও বোধহয়। কিন্তু দিতে পারল না। ভেতর থেকে কথা বেরুলো না। ফারুকী ওর নিরবতাকে সম্মতি ভেবে শান্ত স্বরে বলল,
‘ ওকে, দেন আমি লোকেশন ম্যাসেজ করে দিচ্ছি। কাল চলে এসো।’
কথার ঢং দেখে নাকের ডগা ফুলাল জাওয়াদ। যেন ও হুকুমের গোলাম। অন্যসময় হলে কটা কঠিন কথা শুনিয়ে দিত। আজও ইচ্ছে হলো কটা কথা শুনাতে। কিন্তু মুশরাফার সামনে বলে পারল না। ফারুকী কলে রেখেই লোকেশন ম্যাসেজ করে দিলেন। বললেন, ‘এই লোকেশনে চলে এসো’
কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিল ফারুকী। জাওয়াদ অসহায় হরিণের মতো চেয়ে দেখল। মেয়ে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে না, ওদিকে বাবা সেই সুযোগে কার্য সিদ্ধি করবার ফন্দি আঁটছেন। কী সাং/ঘাতিক অবস্থা!
চলবে..