স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। #দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ। পর্ব-৩২ (প্রথমাংশ)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ। পর্ব-৩২ (প্রথমাংশ)
#আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা।

কটেজের ব্যালকনিতে মুশরাফা আর জায়ফার জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছে জাওয়াদ তারিফ। ব্রেকফাস্ট করে ঘুরতে হবে। আজ নিভৃতে নিসর্গ পার্ক ঘুরবার প্ল্যান। তারা তৈরি হয়ে বের হয়েছে সেই কবে, দুই রমনীর এখনো সাজ শেষ হয়নি। শ্যালক ভগ্নিপতি কটেজের বারান্দায় বিচ ভিউ দেখতে দেখতে গল্প করছে। এর মাঝে জাওয়াদের ফোন বেজে উঠল। আননোন নাম্বার। কথা বলবার ফাঁকে রিসিভ করে কানে তুলল। জাওয়াদ ‘হ্যালো’ বলতেই অপাশ থেকে নারী কন্ঠ ভেসে এলো, ‘জাওয়াদ বলছো?’

স্বরটা অচেনা ঠেকল জাওয়াদের। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘জ্বি! আপনি কে বলছেন?’

তৎক্ষনাৎ উত্তর এলো। কলার পরবর্তী কথা বলতে সময় নিলেন। তারপর ধীরে বললেন,
‘লায়লা আঞ্জুমান। ‘

জাওয়াদের মনোযোগ সমুদ্রের সুন্দর ঢেউয়ে ছিল। তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল না শ্বাশুড়ির নামখানা। অস্ফুটে বলল, ‘কোন লা…

আকস্মিক থেমে গেল। নামের মানুষটাকে স্মরণে আসতেই কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল ফোনের দিকে। এই মহিলা তাকে কল করেছে! ওর বিস্ময় বাড়াতেই বোধহয় ভেসে এলো , ‘ রাফার মা।’

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল জাওয়াদ। এই কলটা একবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল তার কাছে। শ্বাশুড়ি ইতঃপূর্বে তাকে কল করেনি, আজ হঠাৎ কী হলো! সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল সামনে থাকা শ্যালকের দিকে। জাওয়াদের দৃষ্টি আর অস্ফুটের নাম শুনেই তারিফ আন্দাজ করে ফেলেছিল কলটা তার মায়ের ফোন থেকে এসেছে।
তারিফের মনে বিজয়োল্লাস। সে মনে প্রাণে চেয়েছিল, জামাই শ্বাশুড়ির বোঝাপড়া হয়ে দ্বন্দ্ব মিটুক। জাওয়াদের মাধ্যমেই লায়লা মেয়েকে ফিরে পাক। জাওয়াদ মাধ্যম না হলে মুশরাফার সাথে সম্পর্কে ভালো হলেও জাওয়াদের সাথে সম্পর্ক ভালো হবে না। মুশরাফা মেয়ের মর্যাদা পেলেও জাওয়াদ জামাইয়ের মর্যাদা পাবে না। কারণ তার উপর সুক্ষ্ম রাগ সবার।
ছেলেটার আত্মসম্মানবোধ বেশ। দেখা যাবে নিজের অসম্মান দেখলে মুশরাফাকে পাঠিয়ে দিবে, নিজে যাবে না। তখন পরিবার পূর্ণ হয়ে ও হবে না। একটা পরিবার সুন্দর করে পূর্ণগঠন করবার জন্যই তারিফের ট্যুর প্ল্যান, ফোন বন্ধ, পরিবার থেকে দূরে থাকার আয়োজন। অবশেষে তা সফল হতে যাচ্ছে বোধহয়।
জেনেও না জানার ভান করল তারিফ। প্রশ্নবিদ্ধ স্বরে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’

জাওয়াদ কল মিউট করে বলল, ‘আপনার মা আমাকে ফোন দিল কেন?’
তারিফ অজানার ভান করে বলল, ‘আই ডোন্ট নো। কথা বলে দেখো।’

জাওয়াদ বিনীত সুরে বলল, ‘ অনেস্টলি স্পিকিং, আপনার মায়ের প্রতি আমার ভীষণ রাগ আর ক্ষোভ। রাফাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু বললে আমি আমার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। মিস বিহেভ করে ফেলব আপনার মায়ের সাথে। আপনার সামনে কথা বলে আরাম পাব না। আমি কি অন্যদিকে যেতে পারি?’

তারিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মম যা করেছেন তাতে তার শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু প্রাণাধিক ভালোবাসা মা’কে কারো কাছে ছোটো হতে দিতে ও মন টানছে না। তার সামনে তার মমের সাথে কেউ মিস বিহেভ করবে এটা সে মানতেই পারবে না। তারিফ ধীরে বলল,
‘ প্লিজ বেশি রুডলি কথা বলো না!’ তারিফের কাতর অনুরোধ। ওর স্বরে প্রকাশ পাচ্ছে মায়ের প্রতি এক সন্তানের ভালোবাসা।
জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল,
‘ ব্যাপারটা আমার হাতে থাকলে উনার সাথে একটা কথা বলবার রুচিও কখনো হতো না আমার। কিন্তু কী করা, আমার স্ত্রীর খুশি জড়িয়ে আছে উনার সাথে। ‘

জাওয়াদ গম্ভীরমুখে অন্যদিকে চলে গেল। ওর মুখেও অসহায়ত্ব। লায়লার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না ওর। শুধুমাত্র মাত্র স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটার সাথে কথা বলতে হবে ওকে। জাওয়াদ ফোন কেটে কল ব্যাক করল, এই মহিলার টাকায় কথা বলার ইচ্ছে নেই তার। লায়লা সাথে সাথে রিসিভ করলেন।
‘হ্যালো জাওয়াদ? চিনতে পেরেছো আমাকে?’

জাওয়াদের স্বর গম্ভীর, ‘রাফার গায়ের আঘাতের দাগগুলো আপনাকে ভুলতে দেয় নি। ‘

কথাটা কর্ণকুহরে ভাসতেই বুক কেঁপে উঠল লায়লার। রাফার গায়ের দাগ! চোখে ভাসল আঞ্জুমান ভিলা ছাড়বার দিনের দৃশ্যপট। তিনি আর সাফা মিলে কী মা/রটাই না মে/রেছিলেন সেদিন! চড়,,থাপ্পড়, লাথি, জুতা, স্কেল, লাঠি কিছুই বাদ রাখেন নি। মেয়েটা নেতিয়ে পড়েছিল, তবুও ক্ষান্ত হননি! ফুলে ফেঁপে মেঝেতে পড়ে থাকা নেতানো দেহটা চোখে ভাসল, শিরদাঁড়া উঁচিয়ে গেল। নিজের উপর ধিক্কার জন্মাল তার! এত নিষ্ঠুর কিভাবে হলেন তিনি! চোখের কোণে ভিজল। তিনি অনুধাবন করলেন মায়ের কোন দায়িত্ব তিনি পালন করেন নি, মা হিসেবে তিনি অযোগ্য, ব্যর্থ। মাতৃত্বের মমতা ঝাপিয়ে এলো। তিনি লাই দিলেন না। কষ্টটা প্রকাশ করলেন না। ধীর স্বরে বললেন,
‘কেমন আছে আমার মেয়েটা?’

জাওয়াদ যেন ভারি অবাক হলো, ‘ মেয়ে! রাফা আপনার মেয়ে! ‘ পরক্ষণেই দুঃখ ভারাক্রান্তে বলল, ‘স্যরি, আপনার মতো আমি ও ভুলে গিয়েছিলাম। ‘

জামাতার মনে নিজের জন্য জমে থাকা রাগ আর ক্ষোভের লেশ বেশ টের পেলেন লায়লা। ছেলেটার স্বরে স্পষ্ট তিরষ্কার! যেন লায়লা মুশরাফার মা হবার যোগ্যই নয়। আসোলেই নয়, নয়তো কোন মা তার সন্তানকে ভুলে যেতে পারেন! লায়লা গম্ভীরমুখে বললেন,
‘অতীতের কথা ভুলে যাও।’

জাওয়াদের চোয়াল শক্ত হলো! এত সহজ! এতকিছুর পরও লায়লার নমনীয়তা নেই। সে গম্ভীরমুখে বলল,
‘আই কান্ট। হাসপাতালের বেডে রাফার কাতরানোর সেই দৃশ্য, সেই অতীত আমি সহজে ভুলতে বা ক্ষমা করতে পারব না। ‘

সেদিন আঞ্জুমান ভিলা থেকে পা বাড়ানোর পর রাফার অধ্যায় মুছে ফেলেছিলেন লায়লা। হাসপাতালে নেবার খবর শুনেও গ্রাহ্য করেন নি। বরং বলেছিলেন, যে মেয়ে বাবা মায়ের সম্মান ডুবায়। সেই মেয়ে বেঁচে থাকা উচিত না। ম/রুক, আপদ বিদায় হোক। ক্রোধের বশে ভুলে বসা সেই ক্ষণের কথা এই ক্ষণে স্মরণে এলো লায়লার। বুক কাঁপুনি বাড়ল। মনে প্রশ্ন ও জাগল, তখন তো ওদের বিয়ে হয়নি তবে জাওয়াদ দেখল কিভাবে? কিন্তু প্রশ্ন করলেন না। বিষাদে নিশ্চুপ রইলেন। জাওয়াদ এই সুযোগটাই নিল।
‘ পুরো শরীরে মারের জগম, হাড়কাঁপানো ব্যাথা,১০৪°জ্বর নিয়ে হাসপাতালে পড়েছিল মেয়েটা। আপনার জন্য রাফার পুরো জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। মানুষ কতটা নির্দয় হলে এমন অত্যাচার করতে পারে! স্যরি টু সে, আমার মনে প্রশ্ন জাগে, আপনি সত্যিই রাফার মা তো! মানে মায়েরা আর যাই হোক এতটা পাষাণ হতে পারে না। আপনি কিভাবে পারলেন?’

লায়লার মাতৃত্বে প্রশ্ন উঠেছে। এটা একটা মায়ের জন্য ম/রণসম। লায়লার বুক ভেঙে এলো। কী ভীষণ কষ্ট জমা হলো বুকে! এ যেন তার কাটা গায়ে নুনের ছিটা পড়ল। তার করুণতা বেড়ে দ্বিগুণ হলো। তিনি নিশ্চুপ রইলেন।

তৈরি হয়ে মুশরাফা আর জায়ফা বের হলো। তারিফকে দরজার বাইরে পাওয়া গেল। জাওয়াদকে না দেখে মুশরাফা এদিক ওদিক চাইল। বারান্দার শেষ মাথায় গিয়ে ফোনে কথা বলছে। ভীষণ রাগত আর চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছে ওকে। কোন সমস্যা হলো না তো! প্রশ্নবিদ্ধ মনে এগুলো সেদিকে। কাছাকাছি গিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
‘ আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কে ফোন দিয়েছে?’

জাওয়াদ দৃষ্টি ঘুরাল। মুশরাফাকে ঠাহর করে কান থেকে ফোন সরাল। গম্ভীরমুখে বলল, ‘কেউ না। তুমি যাও, আমি আসছি।’

মুশরাফা আরও কিছু বলতে গেল। জাওয়াদ কল মিউট করে ধীর স্বরে বলল, ‘কোন প্রশ্ন নয়। আমি উত্তর দিতে পারব না। যাও প্লিজ!’

মুশরাফা সন্দিহান চোখে বলল, ‘আপনি কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছেন?’
ওর সন্দেহ দেখে জাওয়াদ আকস্মিক হেসে ফেলল। বলল,
‘ তুমি ছাড়া আমার আর কোন বউ নেই, আপাতত কোন গার্লফ্রেন্ড ও নেই। সবার স্থানে তুমিই আছো। সো, নিশ্চিন্তে থাকো। ‘

‘আমি ওটা মিন করিনি।’ মুশরাফা প্রতিবাদ করল।

জাওয়াদ দূর থেকে তারিফকে ইশারা করল। এসে বোনকে নিয়ে যেতে। তারপর মুশরাফার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যেভাবে জেরা করছিলে, তা তো মনে হয়নি। ‘
‘আপনি একটু বেশি বুঝেন।’
জাওয়াদ ওকে অনুকরণ করে বলল, ‘আপনি একটু কম বুঝেন, তাহলেই হবে। যান, গিয়ে খেতে বসুন।’

তারিফ এসে গেল। বোনকে তাড়া দিল, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল, আমরা ব্রেকফাস্ট অর্ডার দিই। জাওয়াদ কল শেষ আমাদের সাথে জয়েন করবে না হয়। ‘

অগত্যা মুশরাফাকে যেতে হলো। মুশরাফা যেতেই জাওয়াদ আনমিউট করে কানে দিল। সাথে সাথে লায়লা প্রতিবাদী সুরে বললেন,” ‘কেউ না’ বললে কেন? আমি ওর মা।” লায়লার স্বরে অধিকারবোধ।

জাওয়াদ কিছু তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘এক যুগ বাদে অবশেষে আপনার মনে পড়েছে আপনি রাফার মা। ঠিক এই অধিকারবোধ যদি রাফার কৈশোর,তারণ্যে প্রয়োগ করতেন তবে আজ আমাকে ‘কেউ না’ বলতে হতো না। এর জন্য দায়ী আপনি।’

লায়লার মুখ চুপসে গেল। আজ ছেলেটা ওকে কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না । আজ জাওয়াদের দিন। সে বলে গেল,
‘ বারো বছর। সময়টা কম নয়। হিসেব কষলে দিন সংখ্যা ৪৩৮০ হয়। এই লম্বা সময়টা রাফার জীবনের কালো অধ্যায়, কারণটা আপনারাই। বারোটা বছর সামান্য পর্দা করার জন্য রাফার উপর অমানবিক অত্যাচার করে গিয়েছেন। খাওয়া দেননি, ভালো ব্যবহার টুকু ও করেন নি কখনো, গৃহবন্দী করে রেখেছেন দিনের পর দিন। নিজেরা উচ্চবিত্তের জীবন যাপন করেছেন, অথচ রাফা এক কাপড়ে, এক রুমে মানবেতর জীবনযাপন করেছে বছরের পর বছর। মা বাবা থেকেও এতিমের মতো দিন কাটিয়েছে। পুরো পরিবার থেকেও একাকীত্বের মাঝে গুটে ম*রেছে মেয়েটা। সারা শরীরে মা*রের দাগ নিয়ে ও আপনাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে গেছে, একটা ভালো ব্যবহারের আক্ষেপ করেছে, তাও করেন নি। রাস্তার কুকুরের চেয়ে ও খারাপ ব্যবহার করেছেন। এক যুগ এত অত্যাচার করেও ক্ষান্ত হন নি। শেষে বেধড়ক মা/রধর করে বাড়িছাড়া করেছেন।
বারোটা বছরে একটাবার মনে পড়েনি ও আপনার মেয়ে। এখন ঠিক কী কারণে মনে পড়ছে, একটু বলবেন? আমার তাড়া আছে।’

জাওয়াদের প্রতিটা কথা বুকে তীরের মতো বিঁধছিল। আঘাতে জর্জরিত হচ্ছে ভেতরটা, বুক ব্যাথা বাড়ছে।
এতকালের অর্জিত অহং চুরমার হচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে। তবুও তিনি নিশ্চুপ। অন্যসময় হলে হয় বাক্যবাণে জর্জরিত করতেন, কিংবা ক্ষমতার দোহাই পদক্ষেপ নিতেন। কিন্তু এই ক্ষণে সবচেয়ে গভীর সম্পর্কে বাধা পড়েছেন তিনি, মাতৃত্ব আর তাকে ধিক্কার দিয়েছে, নিশ্চুপ করেছে। জাওয়াদের সব কথা হজম করে নিলেন। এত কথার পর তিনি বলতে পারলেন না, আমার মেয়েটাকে এক নজর দেখতে চাই। ওকে একটু দেখাবে? তিনি বাহানা খুঁজলেন। পেয়ে গেলেন। সাত পাঁচ না ভেবে বলে দিলেন,
‘ তারিফের বিয়ে কদিন বাদে। আমি চাইছি তোমরা আসো।’

জাওয়াদ মুখ চেপে হাসল। তারিফের বিয়ে যে ভেঙে গেছে সে কথা অজানা নয় তার। লায়লাও জানেন যে জাওয়াদ জানে। তবুও তিনি এই যুক্তিহীন বাহানার আশ্রয় নিলেন। সে তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না। সময় নিয়ে বলল, ‘ তারিখটা জানিয়ে দিবেন। আমাকে থানায় ইনফর্ম করতে হবে।’

লায়লা ভারি চমকালেন, ‘থানায় ইনফর্ম করবে কেন!’

‘অতীতে আমার স্ত্রীর সাথে যা হলো, তাতে আপনাদের বা আপনাদের বাড়িটাকে আমার স্ত্রীর জন্য নিরাপদ মনে করতে পারছি না। আমি আমার স্ত্রীকে পাঠালাম, তারপর দেখা গেল, আপনারা ওকে মে/রে মর্গে টর্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনাদের দ্বারা তো অসম্ভব নয়। তাই আমার স্ত্রীকে ও বাড়ি পাঠাতে হলে আমি সাথে পুলিশ ফোর্স পাঠাব। যারা ওকে আপনাদের থেকে গার্ড দিবে। ‘

জাওয়াদের স্বর শান্ত। কৌতুকের লেশমাত্র নেই। তবুও লায়লার মনে হলো জাওয়াদ উনার সাথে ঠাট্টা করছে। উনাকে তিরস্কার করছে। পরোক্ষভাবে বলছে, যাবে না। লায়লা হতাশ হলেন। আকস্মিক কাতর সুরে বললেন, ‘ সময় সব এক থাকে না। এবার আসো। ‘

জাওয়াদ দৃঢ় স্বরে জানাল, ‘ আমার স্ত্রী এত সস্তা নয় যে চাইলে ঘাড় ধরে বের করে দিবেন আবার ডাকবেন সে চলে যাবে। ‘

লায়লার মনোক্ষুণ্ণ হলো। হতাশ স্বরে বললেন, ‘ সত্যিই আসবে না তোমরা?’

‘আপনারা যা করেছেন, তারপর ও ও বাড়িতে না যাওয়াটা স্বাভাবিক। ও বাড়ি রাফার জন্য নিরাপদ না। দেখা যাবে ওখানে গেলে বাই চান্স আপনি বা আপনার মেয়ে যদি আমার স্ত্রীকে আঘাত করার চেষ্টা করে তবে হয়তো আমি শুট করে দিব। ইসলামের পথে আসলেও রাগটাকে এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। আমি আমার এবং আমার স্ত্রীর মঙ্গল চাইতে গিয়ে আসতে পারব না। দুঃখিত।’ জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল। পরপরই বলল,
‘আশা করি, আপনি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। আর আমাকে বা রাফাকে কল দিবেন না। আমি বিরক্তবোধ করছি। ‘

লায়লাকে কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে ফোন ছাড়ল জাওয়াদ। পরপরেই ব্লক করল নাম্বারটা। লায়লা গম্ভীরমুখে বসে রইলেন। শ্বাশুড়ির সাথে এভাবে কথা বলে কেউ! ছেলেটা বেয়াদব। মনোক্ষুণ্ণ হলেন। মেয়েকে দেখার তৃষ্ণায় মন কেঁদে উঠল।

ফোন রেখে জাওয়াদ নিচে নামল। ক্যাফে এরিয়াতে বসে ব্রেকফাস্ট করছে তারিফরা। খাওয়া সামনে নিয়ে বসে আছে মুশরাফা। বাকিরা টুকটাক মুখে নিচ্ছে। জাওয়াদ এসে মুশরাফার পাশে বসল। মুশরাফা তড়িৎ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার সমস্যা সমাধান হয়েছে?’

জাওয়াদ তারিফের দিকে তাকাল। সে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে আছে। সুযোগ পেলে প্রশ্নবাণে ছুঁড়বে। জাওয়াদ দৃষ্টি ঘুরাল। প্রসন্ন হাসল। মুশরাফা তার উত্তর পেয়ে গেল। জাওয়াদ তার জন্য বরাদ্দ প্লেট দুটোর খাবার দেখে হাসল। অমলেট, ওয়াফল। জাওয়াদের বেশ পছন্দের খাবার। নিশ্চয়ই মুশরাফা অর্ডার দিয়েছে, মেয়েটার সবদিক খেয়াল থাকে। সে স্ত্রীর দিকে তাকাল। মুশরাফাকে না খেয়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল,
‘না খেয়ে বসে আছো কেন?’
জায়ফা টিপ্পনী কাটল,
‘ আপি তার হাব্বির জন্য বসে আছে। কত সাধলাম খেলোই না। দেখেছেন ভাইয়া, আপির কত ভালোবাসা আপনার জন্য!’

তারিফ বসে থাকায় বিব্রতবোধ করল জাওয়াদ। মুশরাফার দিকে এক পলক তাকাল। টিস্যু হোল্ডার থেকে একটা টিস্যু নিয়ে মুশরাফার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল,
‘খাওয়া শুরু করো।’

মুশরাফা টিস্যু নিল। টিস্যুটা নোজ নিকাবের নিচে বসানোর ফাঁকে প্রসন্ন হাসল। সাইডে থাকা কাটা চামচ হাতে নিয়ে স্মিত হাসল জাওয়াদ ও।

নাস্তা শেষে বেরুবার সময় একা পেয়ে তারিফ জাওয়াদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘মম কী বলল?’
জাওয়াদ হেয়ালি করে বলল,
‘আপনার ভেঙে যাওয়া বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে আপনার মা। ‘

তারিফ ভ্রু কুঁচকাল, ‘স্ট্রেঞ্জ! তা কী বললে তুমি?’
‘বলেছি পুলিশ ফোর্স নিয়ে আমার স্ত্রীকে পাঠাব। নয়তো আবার না গু/ম করে ফেলেন উনারা।’ বলে হেসে ফেলল জাওয়াদ। সে ঠাট্টা করেছে না কি বাস্তবিক বলেছে বুঝতে পারল না তারিফ,
‘আর কিছু বলেছে?’

জাওয়াদ ভাবুক হয়ে বলল, ‘আপনার মায়ের বিহেভিয়ার চেঞ্জ মনে হলো, কারণটা কী?’

তারিফ উত্তর দিল না সে কথার। প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘ আমার মা, তোমার শ্বাশুড়ি হয়। ‘মা’ ডাকা উচিত তোমার।’

জাওয়াদ ভ্রু নাড়াল, ‘ মা ডাকতে হলে তাকে মা হতে হয়, আপনার মা এখনো নিজেরই মেয়েরই মা হয়ে উঠেন নি, আমার কী মা হবেন! আগে মা হয়ে দেখাক। যেদিন মনে হবে, তিনি ‘মা’ হয়ে উঠেছেন ডাকটা না হয় সেদিনই ডাকব।’

দিন গড়াল। মেয়ের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়লেন লায়লা।

চলবে…

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here