স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। #দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-৩৩)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-৩৩)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

বৃষ্টিমুখর ধূসর সকাল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, আকাশ ঢাকা কালো মেঘে। হিমেল হাওয়ায় দুলছে বারান্দার গাছ গুলো, দোলা দিচ্ছে মনে। প্রেম প্রেম ভাব। ওই একলা বাসায় স্ত্রীর সাথে সময় কাটাবার জন্য এর চেয়ে চমৎকার পরিবেশ আর হয়না। কিন্তু প্রকৃতির প্রেম বিসর্জন দিয়ে জাওয়াদকে যেতে হচ্ছে অফিসে। এ নিয়ে বিরক্তির অন্ত নেই তার। কপালে মোটা মোটা ভাঁজ পড়েছে। সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে বিরক্তির লেশ টেনে বলল,
‘ ধ্যাৎ! এই চাকরি টাকরি ছেড়ে দিব। আর ভাল্লাগতেছে না। এই ওয়েদারে কারো অফিস যেতে মন চায়?’

জিশান নামছিল ওর সাথে। ভাইয়ের আনমনে বলা কথা শুনে বলল,
‘ইশ! আজ যদি একটা পার্সোনাল বউ থাকতো তবে আমি ও এমন রেগে যেতে পারতাম। শা/লার কপালটাই খারাপ।’

জিশানের বলার ভঙি দেখে হেসে ফেলল জাওয়াদ। কাধ চাপড়ে বলল, ‘বিয়ে একটা করে ফেল। তারপর কাধে কাধ মিলিয়ে দুজনে আফসোস করব।’

জিশান আগ্রহী গলায় বলল, ‘ এই ওয়েদারে বিয়ে করা ফরজ। প্লিজ মাকে বুঝাও।’

জাওয়াদ খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।’
‘কী?’
‘দ্যাখ, এমনিতেই এই চাকরি বাকরি ভালো লাগছে না। তুই বিয়ে করলে দুজন চাকরি ছেড়ে বউ নিয়ে গ্রামে চলে যাব। ওখানে ক্ষেত খামার করব, গরু ছাগল পালব। মন চাইলে কাজ করব, নাহলে বসে থাকব। বর্ষা এলে গরু ছাগল দুই একটা বিক্রি করে দিন। ওই টাকা দিয়ে পুরো বর্ষা কাটাব। এই ওয়েদার গুলো উপভোগ করব। কোন কাজ টাজ চলবে না। আমরা কর্মী, আমরাই বস। কী বলিস?’ উৎফুল্ল হয়ে বলল জাওয়াদ। অনিকের পাশে থাকলে ওকে ভীষণ চঞ্চল দেখায়।

জিশান ভাবল। ভেবে চিন্তে ভাইয়ের প্রস্তাব লুফে নেবার উদ্দেশ্যে বলল,
‘গুড আইডিয়া ভাইয়া। চাকরির জন্য দৌড়াদৌড়ি আর স্টুডেন্টের মা বাপের হুকুমদারিতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। স্বাধীনতা নেই, ছুটি নেই। জীবনে কোন মজা নাই। এই লাইফ ভাল্লাগেনা। গ্রামের কৃষক শ্রেণীর মানুষ নিজেই নিজের বস। তারা ইচ্ছামাফিক চলে, কারো হুকুমদারি নেই। স্বাধীন, মুক্ত। আহ্! শুন ভাইয়া, আমি কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি, আমি মাঠের কাজ করব। গরু, গোবর ওসব তোর কাজ।’

জাওয়াদ প্রতিবাদ করে ওঠল, ‘একদম না। আমি গরু ভয় পাই। প্রতিবার কোরবানির গরু তুই সামলাস। সো, তুই গরু পালবি। আমি মাঠে কাজ করব। রাফা ভাত নিয়ে যাবে। আইলে বসে ওকে পাশে বসিয়ে ভাত খাব। আহা্! কী দৃশ্য! আমি মাঠের কাজ নিব। ফাইনাল।’

জিশান হিসহিসিয়ে বলল, ‘ ভাবি পর্দা করে, মাঠে যাবে না। আইলে বসে খাওয়ার দৃশ্য তোর হবে না। ওটা আমার জন্য ফিক্সড। তুই বউ নিয়ে বাড়ি সামলাবি। ভাবি হাঁস মুরগী পালবে, তুই গরু পালবি। আমি মাঠে কাজ করব, আমার বউ রেঁধে খাবার নিয়ে যাবে। চমৎকার কম্বিনেশন।’

দুই ভাইয়ের দ্ব/ন্দ্ব বেঁধে গেল রাখাল আর কৃষক পদ নিয়ে। কেউ কৃষকের পদ ছাড়তে রাজি না। জয়নাল আবেদীন ও সিড়ি বেয়ে নামছিলেন। ওরা খেয়াল করেনি। দুই ছেলের তর্ক শুনে ধমকে উঠলেন,
‘ এই থাম তোরা। কী শুরু করেছিস!’

বাবার কথা শুনে দুই ভাইয়ের ঝগড়া থেমে গেল। কিঞ্চিৎ লজ্জাও পেল। আমতা-আমতা করে সামনের দিকে পা বাড়াল। জয়নাল আবেদীন বললেন,
‘ এত বড়ো হয়ে গেলি, এখনো জ্ঞান বুদ্ধি হয়নি তোদের। ‘

জিশান অনুতাপের সুরে বলল, ‘স্যরি বাবা। ভাইয়া আমাকে মাঠের কাজ দিচ্ছিল না, তাই..’
জাওয়াদ অভিযোগের সুরে বলল, ‘বাবা আমি গরু ভয় পাই এটা ও মানতেই চাচ্ছে না। আপনি ভাগ করে দিন, কে কোন কাজ নিবে।’

বাবার পরামর্শ চাইল জাওয়াদ। জিশান আগ্রহী চোখে তাকাল। ভাইকে সতর্ক করল, ‘বাবা যা বলবে, তাই হবে । তুই কিন্তু আপত্তি করতে পারবি না।’

জয়নাল আবেদীন গম্ভীরমুখে বললেন, ‘ একদিন একজন রাখাল, অন্যজন কৃষক। এভাবে পালাবদলে চলবে। বউ’মায়েরা রান্না করব। আর আমি…

জাওয়াদ ফোঁড়ন কাটল, ‘বাবা, আপনি ও যাবেন?’

জয়নাল আবেদীন গম্ভীরমুখে বললেন, ‘আমি না গেলে তোদের বাচ্চাদের কে সামলাবে। ‘

বাচ্চার প্রসঙ্গ আসায় আড়ষ্ট হলো জাওয়াদ। লাজুক হাসল। জিশান বলল, ‘ পারফেক্ট। ভাইয়া, প্ল্যান কর। সবাই মিলে ব্যাগপত্র উঠিয়ে রওনা দিই।’

জয়নাল আবেদীন হাসলেন। ছেলেদের সাথে আজকাল দারুণ সময় কাটছে তার। সারাজীবনের অপূর্ণতা যেন শেষ বয়সে এসে পূর্ণতা পাচ্ছে।

_____

পথিমধ্যে জাওয়াদের ফোন বাজল। দেখল নাজমুল সাহেবের কল। ফোন তুলে বিনীত স্বরে সালাম দিল জাওয়াদ। কুশল বিনিময়ের পর তিনি অনেকটা ফিসফিস করে বললেন,
‘ ফারুকী তো তোমার সাথে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। তুমি নাকি ফোন ধরছো না, ম্যাসেজের রিপ্লাই করছো। আমাকে অনুরোধ করছে তোমাকে ডাকার জন্য। কী করা যায় বলো তো?’

জাওয়াদ বিস্মিত হলো না। সেদিন ফোন রাখার পর যখন সে হাসপাতালে যায়নি তখন তার ধারণা ছিল, এমন কিছুই হবে। সে ঠোঁট চেপে হেসে বলল, ‘ সেদিন কথা বলার পরিস্থিতিতে ছিলাম না। ভদ্রলোকের সাথে কিছু কথা বলা দরকার। মিটিং ফিক্সড করুন। আমি যাব। ‘

নাজমুল সাহেব খুশি হলেন। অফিসের পরের জন্য মিটিং ফিক্সড করে ফোন রাখলেন। কথা হলো রেস্টুরেন্টে বসবে।

অফিস থেকে বেরিয়ে জাওয়াদ গেল রেস্টুরেন্টে। নাজমুল সাহেব অপেক্ষা করছিলেন বাইরে। ওকে দেখেই সালাম দিয়ে মুসাফাহা করল। বাংলায় যাকে বলে করমর্দন। ইংরেজি প্রতিশব্দ হ্যান্ডশেক।

বারা’ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘দু’জন মুসলিম সাক্ষাৎকালে মুসাফাহা করলেই একে অপর থেকে পৃথক হবার পূর্বেই তাদের (গুনাহ) মাফ করে দেওয়া হয়।’’
(আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ)

বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিতঃ
আবদাতা ইবনু আবূ লিবাবাহ মুজাহিদ থেকে এবং তিনি ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে মারফূ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, যখন কোন মুসলিম ব্যক্তি অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তার হাত ধরে মুসাফাহা (করমর্দন) করে তখন তাদের অঙ্গুলিসমূহ হতে গুনাহ এমনভাবে ঝরতে থাকে যেমন শীতকালে গাছ থেকে পাতা ঝরতে থাকে। আবদাহ বলেন, আমি মুজাহিদকে বললাম, এটা তো খুবই সহজ ব্যাপার। মুজাহিদ বললেন, এমন বলো না। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে (কুরআন মাজীদে) বলেনঃ যদি আপনি তাদের মাঝে বন্ধুত্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করতেন তথাপি তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হতেন না। বরং আল্লাহ তা’আলা তাদের মাঝে হৃদ্যতা ছড়িয়ে দিয়েছেন। (সূরা-আল-আনফাল-৬৩ আয়াত) তখন আমি ইলমের (বিদ্যার) গভীরতা অন্যান্যদের তুলনায় অনুভব করলাম। (আস-সহীহাহ)

মামা শ্বশুরের সাথে বরাবরই চমৎকার সখ্যতা জাওয়াদের। নাজমুল সাহেব ওকে বেশ পছন্দ করেন। স্নেহ করেন। একজন শ্বশুর হওয়ার সব দায়িত্ব তিনি পালন করে এসেছেন। জাওয়াদ ও তাকে সম্মান দেয়। জামাই শ্বশুরের আলাপের মাঝে রেস্টুরেন্টের ভেতরে এলো। দেখল ফর্মাল ড্রেসাপের এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বসা কোণার এক চেয়ারে। চোয়ালে গম্ভীরতার ছায়া। এই লোকের সাথে সেভাবে আলাপ হয়ে ওঠেনি জাওয়াদের। বিয়ের দিন ও গা ছাড়া ভাব ছিল তার। সৌজন্যতাবোধে উপস্থিত হয়েছিলেন এই যা, বাদবাকি কোন দায়িত্ব পালন করেন নি। জামাইয়ের সাথে ভালো করে দুটো কথাও বলেন নি। জাওয়াদ তখন সেটাকে ব্যস্ততা ভেবে গ্রাহ্য করেনি।

মনে মনে বেশ প্রস্তুতি নিয়ে এলেও শ্বশুরের সামনে বসবার পর বেশ অস্বস্তিবোধ করল জাওয়াদ। আকস্মিক সালাম ও দিতে পারল না, মুসাফাহা ও করতে পারল না। আর না কুশল বিনিময়। কেবল চুপচাপ গিয়ে চেয়ারে বসল। নাজমুল সাহেব বসলেন দুজনের মাঝামাঝি। ফারুকী গভীর চোখে পরখ করছেন জামাতাকে। রাগ নেই, ক্ষোভ নেই। মুখে গম্ভীরতা থাকলেও দৃষ্টি কোমল। অন্তর্ভেদী চোখে অবজার্ভ করছেন। জাওয়াদ তার দিকে তাকাল না। তবে দৃষ্টি টের পেল ঠিকই। নিচের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল,
‘ তারিফ ভাইয়ার মতো ইনিও প্রেমিক প্রেমিক আচরণ শুরু করেছেন। কী এক বিপদে পড়লাম!’

তারপর গলা ঝেড়ে শ্বশুরের দিকে তাকাল। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বলল,
‘ কেন ডেকেছেন?’ জাওয়াদের স্বর গম্ভীর। বাবার বয়সী একজন মানুষের সাথে ওর শ্রদ্ধাভরে পেশ আসা উচিত। কিন্তু এত চেয়ে ও একটা সালাম অবধি আসেনি ভেতর থেকে। ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে যেন। এই ক্ষণে টের পেল, সে এখনো পুরোপুরি ভালো হতে পারেনি। আগের জাওয়াদের ছটা রয়েই গেছে।

ফারুকী চমকালেন বেশ। সালাম নেই, সম্মান নেই, কুশল বিনিময় নেই, একবারে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করছে! শ্বশুরের সাথে এভাবে কথা বলে কেউ! এ তো দেখি ভারি বেয়াদব ছেলে। ফারুকী ভ্রু কুঁচকালেন। সৌজন্যতাবোধে বললেন,
‘ কিছু অর্ডার করি, খেতে খেতে কথা বলি।’

জাওয়াদকে অনাগ্রহী দেখাল। হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল, ‘ আমার হাতে খুব একটা সময় নেই। এশার আযান হয়ে যাবে, নামাজে যেতে হবে। আপনি বলুন, কী যেন বলতে চেয়েছিলেন?’

ফারুকীর চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ল জাওয়াদের অনাগ্রহী ভাব। সে যে শ্বশুরের অন্ন মুখে তুলতে চাইছে না তা বুঝতে সময় লাগল না। তিনি চাপা শ্বাস ফেললেন। কথার কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরলেন,

‘ হাসপাতালে যাবে বলে যাওনি কেন?’
জাওয়াদ দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আমি একবারও যাব বলিনি!’
ফারুকী ভারি বিস্ময়ের সাথে বললেন,
‘আপত্তি ও তো করোনি। চুপ থেকে সম্মতি দিয়েছো।’

জাওয়াদের বলতে ইচ্ছে করল, ‘আপনার পাজি মেয়ে তখন দুষ্টুমি করছিল, আপত্তি করার উপায় ছিল না।’

কিন্তু বলতে পারল না। শান্ত স্বরে বলল,
‘এটা আপনার এক পক্ষীয় ধারণা। যাবার আগ্রহ না তখন ছিল আর না এখন আছে।’

মুখের উপর এভাবে কথা বলে কেউ! কী বেয়াদব ছেলে! ফারুকী ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘একটা মানুষ অসুস্থ, দেখতে যাবে না?’

জাওয়াদ স্বর শান্ত। কোন রাগ ক্ষোভ প্রকাশ করছে না স্বরে। শান্ত স্বরে কঠিন কথা বলে যাচ্ছে,
‘মামার কাছ থেকে শুনেছি, আপনার স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থ নন। জাস্ট স্ট্রেস। দেখতে যাবার মত অসুখ বা অবস্থা হয়নি।’

‘আপনার স্ত্রী’ শব্দটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন ফারুকী। শ্বাশুড়িকে এমন সম্বোধন কেউ করে! সাফা ঠিকই বলেছিল, এই ছেলে আসোলেই ম্যানারলেস। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘ মা তার মেয়েকে দেখতে চেয়েছে, তুমি মেয়েকে দূরে রাখছো কেন?’

জাওয়াদের আত্মবিশ্বাসে ভাটা পড়ল না। সে দৃঢ় সুরে বলল,
‘মেয়েকে দূরে রাখা মাকে দূরে রাখাই স্বাভাবিক ।’

জাওয়াদের বাঁকা বাঁকা কথা শুনে রেগে গেলেন ফারুকী। আকস্মিক তার ভেতর পিতৃত্ব জেগে উঠল। রাগ রাগ স্বরে বললেন,
‘তুমি ভুলে যাচ্ছ, রাফা আমাদের সন্তান। অসুস্থ মাকে দেখা সন্তান হিসেবে ওর দায়িত্ব। এই দায় থেকে ওকে দূরে রাখার অধিকার তোমার নেই।’

এ কথার পরেই জাওয়াদ হেসে উঠল। শব্দহীন হাসি। সেই হাসিতে খেলে গেল তাচ্ছিল্যতা। হাসিমুখে বলল,
‘আমাদের সন্তান, দায়িত্ব, অধিকার। শব্দগুলো সুন্দর। তা এই শব্দের ব্যবহার এতবছর করলেন না কেন? রাফা যে আপনাদের সন্তান, এটা আমি ভুলে গেছি। মনে কিন্তু আপনারাও রাখেন নি। রেখেছেন? করেছেন কোন দায়িত্ব পালন?’

ওর তীক্ষ্ণ প্রশ্নে ভড়কে গেলেন ফারুকী! দায়িত্বের কথা এলেই তার কাছে কোন কথা অবশিষ্ট থাকে না। ভেতর হাতড়ে কোন কথা খুঁজে পান না। চটাং চটাং কথা বলছে বেয়াদব ছেলেটা। কিন্তু তার কথা মিথ্যা নয়, সত্য। সত্য তিতা হয়, এই জন্যই বোধহয় তিনি নিতে পারছেন না। তবুও তিনি দমলেন না। দাম্ভিক স্বরে বললেন,
‘ যা হয়েছে ভুলে যাও। ‘

নাজমুল সাহেব মাঝে বসা। বিরক্তি নিয়ে তাকালেন ভগ্নিপতির দিকে। মনে মনে বললেন, ‘অন্যায় করে আবার অহংকার দেখাচ্ছো কেন? নত হও। তোমার সামনে যে বসে আছে, সেই ছেলেটা ভীষণ চালাক। ওকে নিবেদন ছাড়া এই ভাবে বশ করতে পারবে না। চিনো নি ওকে। মেয়ের বাবাদের নত হয়ে হয়।’ জাওয়াদ চাপা শ্বাস ফেলল। ধীরে বলল,

‘ভাইবোনদের মধ্যে আমি ছিলাম বাবা মায়ের চরম অবাধ্য। ছন্নছাড়া, বাউণ্ডুলে, উগ্র ছিল আমার স্বভাব। সামাজিকতা, ধর্মকর্ম এসবে আমাকে পাওয়া যেত না বরাবরই। বাইক রেসিং, ক্লাবিং, ফ্রেন্ডস, পার্টি, ট্যুর এগুলোতে আমার দিন কা/টতো। আমার পুরো বংশে ও আমার মতো উশৃংখল কেউ ছিল না। আমার এহেন চলাফেরা ছিল বাবার চক্ষুশূল। বাবা ভীষণ শাসন করতেন, বকতেন, কখনো আবার বুঝাতেন। আমি বুঝতাম না। সেই রাত করে বাড়ি ফেরা, ট্যুর পার্টিতে টাকা উড়ানো এসব চালিয়ে যেতাম। আমার চরম অবাধ্যতায় বাবার ভীষন অপছন্দের পাত্র হয়ে ওঠলাম একসময় । ঠিক যেমন আপনাদের কাছে রাফা।’

কথায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফোন বেজে ওঠল জাওয়াদের। জাওয়াদ থামল। সম্মুখে চাইল একবার। দুই ব্যক্তিই উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার কথা।

ফোনটা টেবিলের উপরই ছিল। দুই শ্রোতা ধ্যান ভঙ্গ হয়ে চাইল ফোনের দিকে। নাজমুল সাহেবের ভাবাবেগ পরিবর্তন না হলেও নামটা দেখে ফারুকীর চোয়ালে কিসের একটা আভা এলো। কেমন করে চেয়ে রইলেন ফোনের দিকে। ফোনের বুকে ভেসে থাকা নামটার দিকে। চোখে ভাসল মেয়ের ছবি, সেই সাথে একরাশ আকুলতা। কেন যেন তার ইচ্ছে হলো, ফোনটা তুলে নিজের কানে দিতে। কতদিন মেয়েটার কথা শোনা হয়না! এই ক্ষণে ভিডিওখানার ওই ডাকটা বারংবার শুনতে বড্ড ইচ্ছে হলো। কিন্তু ইচ্ছেদের ডানা মেলে উড়তে দিতে পারলেন না তিনি। তার আগেই কানে তুলল জাওয়াদ।

ফারুকী চাপা শ্বাস ফেললেন। তার মনে যেন আক্ষেপ করে ওঠল, এমন একটা কল তার ফোনে আসার। মেয়ের নাম দেখেই প্রগাঢ় এক মায়া উদয় হলো তার মনে। এই নামটা বড্ডো শখ করে রেখেছিলেন তিনি। এক সন্ধ্যায় তার ঘরে যখন পরীর মতো একটা শিশু জন্মাল,তখন তাকে কোলে নিয়ে বিমোহিত হয়ে চেয়ে ছিলেন ফারুকী। কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলেন, ‘মাই প্রিন্সেস!’
বছর কয়েক এই রাজকন্যা বড্ড আদরের ছিল তার। কিন্তু সময়ের পালাবদল সেই রাজকন্যা কখন তার রাজ হারিয়ে ছন্নছাড়া হলো তিনি টের পেলেন না। ফারুকী চাপা শ্বাস ফেললেন। তার চোখে ভাসল পরীর মতন সদ্যজাত শিশুটি। যে চিৎকার করে কাঁদছিল, বাবা কোলে নেবার পর নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে ছিল। সবাই হৈ হৈ করে উঠেছিল। তিনি ধরতেই তার হাত মুঠোয় নিয়েছিল পরীটা। কী চমৎকার ছিল সেই ক্ষণ! এত বছর বাদে হটাৎ পুরোনো স্মৃতি চোখে ভাসতেই হেসে ফেললেন তিনি, আনমনে। টেরটি পেলেন না। নাজমুল সাহেব ধীরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘হাসছ কেন?’

ফারুকী আনমনেই বললেন, ‘রাফার যখন জন্ম হলো তখনকার চেহারাটা মনে আছে আপনার? লাইক আ ফেইরি। ‘

বলতে গিয়ে তার চেহারা ঝিলিক দিয়ে উঠল। নাজমুল সাহেব অবাক চোখে দেখলেন। ভ্রু কুঁচকাল জাওয়াদ ও। মনে মনে বেশ অবাক হলো, সেই সাথে সন্তুষ্ট ও। যাক, এদের বাবা মেয়ের এক আধটু স্মৃতি হলে ও আছে। সে ফোনটা হাতে নিল। কানে তুলতেই ওর স্বর হয়ে ওঠল ক্ষীণ, কোমল। বিনম্র সুরে সালাম দিল,
‘আস-সালামু আলাইকুম। ‘

কখনো কারো কথায় আড়ি পাতেন নি ফারুকী। এই প্রথম বোধহয় তিনি শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ করে আড়ি পাতছেন। শুনছেন জাওয়াদের কথা। অপাশ থেকে কী বলছে শুনা যাচ্ছে না। জাওয়াদ নরম স্বরে উত্তর দিচ্ছে।
‘ আলহামদুলিল্লাহ বৃষ্টি পায়নি আমাকে। অফিস থেকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকবার পরেই বৃষ্টি নেমেছে।
মামার সাথে।
কিছু লাগবে?
গাড়ি আছে তো সাথে। সমস্যা হবে না। তুমি বলো।

এভাবে বললে তো মনে থাকবে না। তুমি এক কাজ করো, লিস্ট করে হোয়াটসঅ্যাপ করে দাও। আমি লিস্ট দেখে সব নিয়ে আসব।

আর শুনো, মায়ের বাসার বাজারের লিস্ট ও দিও।

আমার সাথে ঘন্টাখানেক আগে কথা হয়েছে। কাল আসবে নিশ্চিত করেছে।
চিন্তা করো না, সমস্যা হবে না। আল্লাহ ভরসা।

আমি আছি না? আমি হেল্প করব। ‘

তারপর কী বলল, শোনা গেল না। জাওয়াদ বিস্তৃত হাসল। তারপর ফোন রাখল। নাজমুল সাহেব কৌতূহলী জিজ্ঞেস করলেন, ‘ অনিকরা যাচ্ছে কাল?’
জাওয়াদ মাথা নাড়াল। তারপর নম্র স্বরে বলল, ‘দুঃখিত, ফোন আসায় কথার ব্যাঘাত ঘটেছে।’

ফারুকী চাক্ষুষ ভাবে জাওয়াদের ব্যবহার লক্ষ্য করলেন। ফোন আসবার পরেই জাওয়াদের স্বর বদল, কথার মাঝে স্ত্রীর প্রতি সম্মান, সাহস দেয়াটা যেন স্পষ্ট চোখে লাগছিল। এই সময়টায় একবারের জন্য ও জাওয়াদকে উগ্র মনে হয়নি। বরং কিয়ৎক্ষণেই ওদের সুন্দর একটা সম্পর্কের ধারণা হলো তার। নাহ্, ছেলেটা রাফার সাথে এতটাও খারাপ না বোধহয়। আকস্মিক তার মনে পড়ল, ছেলেটা সবে বলেছে সে পূর্বে ধর্মকর্মে ছিল না। কিন্তু রাফার সাথে কথা বলার সময় তার কথায় বেশ ধার্মিকতা প্রকাশ পাচ্ছে। নাজমুল সাহেবের কাছে এ সম্পর্কে বেশ শুনেছেও। ওমন বাউণ্ডুলে ছেলে এমন পরিবর্তন হলো কিভাবে? জানতে ইচ্ছে হলো তার। তিনি আগ্রহী গলায় বললেন,
‘কথা শেষ করো।’

গলা ঝেড়ে জাওয়াদ বলা শুরু করল,
‘ আমার অবাধ্যতা, বাবার শাসনের জন্য আমাদের বাবা ছেলের মাঝে দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল বেশ। বাবা আমাকে খুব বকাবকি করতেন। অপছন্দ করতেন। আমি ও বাবার চোখ থেকে ফাঁকি দিয়ে চলতাম। বাবা ঘুমিয়ে গেলে বাড়ি ফিরতাম, সকালে বাবা অফিস যাবার পর রুম থেকে বেরুতাম। এমন করে আমাদের দেখা হতো না খুব একটা। আমাদের সেভাবে সময় কাটানো হয়ে উঠেনি। আমার প্রতি বাবার অসীম রাগ ছিল। অপছন্দের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল দিনকে দিন। বাবা প্রিয় আমি ও ছিলাম না। আমি বাবাকে পছন্দ করতাম না, তবে ঘৃণা ও কিন্তু করতাম না। বাবা করতে দিতেন না। বাবা আমাকে অপছন্দ করতেন যেমন, তেমনি ভালো ও বাসতেন। কখনো বকাবকি করলে, আমি যখন না খেয়ে রুমে যেতাম। তখন বাবা খেতে বসে সবার আগে আমার কথা জিজ্ঞেস করতেন। নিজে আসতেন না, মাকে দিয়ে রুমে খাবার পাঠাতেন। বাবা সেভাবে আমার রুমে আসতেন না, কিন্তু আমি যখন যখন বাইক এক্সিডেন্টে করে হাসপাতালে ভর্তি হতাম, তখন সবার আগে বাবা গিয়ে হাজির হতেন। বাবা আমার সামনে খুব রাগ দেখাতেন, কিন্ত আমি ঘুমাবার গভীর রাতে আমার ঘরে এসে বসে থাকতেন। কপালে বাবার হাতের স্পর্শে আমার ঘুম ভেঙে যেত। সকালে রুমের বাইরে নিচু স্বরে বাবার অস্থির স্বর শুনতে পেতাম। ছেলেটা কী অবস্থা?
আমি টের পেতাম, কিন্তু বাবাকে বুঝতে দিতাম না। নিশ্চুপ অনুভব করতাম। আমার তখনই মনে হতো বাবা আমাকে যতটা অপছন্দ করেন তার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। ওই ভালোবাসা আমাকে কখনো বাবারর প্রতি ঘৃণা জন্মাতে দেয় নি। ‘

লম্বা কথা বলে থামল জাওয়াদ। খানিক থেমে আবার বলা শুরু করল,
‘ অবাধ্যতার দিক দিয়ে আমার আর রাফার ভীষণ মিল। দুজনেই বাবা মায়ের অবাধ্য সন্তান। পারিবারিক সংস্কৃত বিপরীত পন্থী ছিলাম এ দিক দিয়ে মিল হলেও ভাগ্যলেখাটা মিল হলো না।
আমার বাবা যখন রেগে বকাবকি করতেন, তখন মা আগলে নিতেন। মা আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমার মায়ের ভালোবাসাটা বাবার বকাকে ঢেকে দিত। একটা ঘা হলে, অন্যটা হতো মলম। এ ক্ষেত্রে রাফার জীবন ভিন্ন। ওর মা ওকে অপছন্দ করত। খুব শাসন করতো, বকতো মা/ রতো। কিন্তু আমার মায়ের মতো বাবা ওকে আগলে নিত না। বরং শাসনে সায় জানাতো। ঘা’য়ের উপর ঘা বসতো, মলম হয়ে আসতো না কেউ। আপনি আমার মায়ের মতো আগলে নেয়ার ভূমিকা পালন করলেন না কেন? আমার বাবার শাসন যেমন আমার মায়ের আদরে মুছে যেত তেমনি আপনার আদর ও রাফার দুঃখ গুজতো। আমার যেমন বাবার শাসন ভুলে গেছি, এখনো আপনাদের অতীত ভুলে যেতাম। কিন্তু আপনি করেন নি। আমার বাবা অপছন্দ করেছেন কিন্তু ঘৃণা করেন নি। বরং আড়ালে ভালোবেসেন। কিন্তু আপনি তো সবখানেই ঘৃণা করে গেছেন। কিভাবে ভুলব বলুন?’

ফারুকী কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে আছেন। এই ক্ষণে কিছু বলার সাহস বা ক্ষমতা কোনটাই তার নেই। ব্যর্থতাগুলো খুব চোখে লাগছে। দুজনেই অবাধ্য, তবুও কত বৈচিত্র্য। তারও বোধহয় জাওয়াদের মায়ের মতো মেয়েকে আগলে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেন নি। বারোটা বছর বাবার ছায়া থেকে দূরে রেখেছেন। কিছুই করেন নি মেয়ের জন্য। পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তির তালিকায় নিজেকে পেলেন ফারুকী! বুক কেঁপে উঠল তার। মন হায় হায় করে উঠল। কী এক তান্ডব চলল ভেতরখানায়। অনুতাপে পুড়ল সারা বুক।

নাজমুল সাহেব হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছেন। জাওয়াদ অতীত সম্পর্কে তার সুধারণা ছিল। এখন পর্দা সরতেই তিনি বিস্মিত হলেন। জাওয়াদ এমন ছিল! তিনি কিভাবে জানলেন না। বুক কাঁপল তার। জাওয়াদ যদি ভালো না হতো তবে এমন ছেলের কাছে রাফা কিভাবে থাকতো! আল্লাহ!

ফারুকীর নিরবতা দেখে জাওয়াদ বলল, ‘ বিগত বারো বছরে সব বাবাদের মতো যদি একদিনের জন্য হলেও আপনি রাফাকে রাজকন্যার মতো আগলে নিতেন তবে আমি অতীতের সব ভুলে যেতাম। কিন্তু রাজকন্যা তো দূরে থাক, আপনি তো রাফার সাথে দাসীর মতো ব্যবহার ও করেন নি।
আপনার মনে পড়ে, শেষ কবে আপনি রাফাকে আদর করে ডেকেছেন? আলতো হাত মাথায় দিয়েছেন? শেষ কবে রাফার বাবা হয়েছেন?’

বিমুঢ়, বিমূর্ত ফারুকী মনে করবার চেষ্টা করলেন। মনে পড়ল না। রাফার অবুঝ বয়সে হবে বোধহয়। তিনি চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকালেন। গভীর ভাবনায় মজলেন। জাওয়াদ বলল,

‘ স্যরি টু সে, আপনি এখনো রাফার বাবা হয়ে ওঠতে পারেন নি। আই মিন, বাবার সংজ্ঞায় নিজেকে বসাতে পারেন নি। ভালো হবে, আগে বাবা হয়ে উঠুন। ঠিক যেদিন আপনার মনে হবে, রাফা আপনার রাজকন্যা। মেয়ের মতো অসীম ভালোবাসা জোগাড় করতে পারবেন, বাবার সংজ্ঞা ধরে রাখতে শিখবেন ঠিক সেদিন আপনার সাথে আমার দেখা হবে। এর আগে না। চলি।’

জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। মনটা হালকা লাগছে। সেই সাথে মুশরাফাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। ভাগ্যিস সেদিন কথা হয়নি। সেদিন কথা হলেও এতসব বলতে পারতো না। রাফার ওমন করেছে বলেই আজকের মুখোমুখি হবার এই সুযোগ মিলেছে।
জাওয়াদ আসার আগে ফারুকী কফি নিয়েছিল। জাওয়াদ বিল মিটিয়ে বিদায় নিল।

এই ঘটনার রেশ চলল অনেকদিন। কত উত্থান পতন এলো। তারপর একদিন ফারুকী স্বস্ত্রী নিবেদন নিয়ে জাওয়াদের মুখোমুখি হলেন। রচিত হলো আরেক অধ্যায়।

চলবে…

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here