হারানো সুর (২)

হারানো সুর (২)
সানজিদা ইসলাম সেতু

‘আমার সমস্যা আমি একাই সমাধান করব। আমার জন্য কারো কোনো সমস্যা হোক তা আমি চাই না।’
‘কি করবি তুই?’
‘জানি না কি করব, কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে।’
‘তুই যা যা বললি তাতে আমার এটা মনে হচ্ছে যে বৃত্ত ভাইয়া তোকে ছাড়বে না।’
‘হুম। আমি খুব ভালো করে ওকে চিনি। নিজের স্বার্থ পূরণ করার জন্য ও সব করতে পারে, এমনকি মানুষ মারতেও ওর হাত কাঁপে না।’
‘বৃত্ত ভাইয়া তোকে খুব ভালোবাসে মৃত্তিকা। হ্যাঁ মানছি তোকে তার নিজের করে পাওয়ার পথ আলাদা ছিল।কিন্তু তুই কি অস্বীকার করতে পারবি যে, বৃত্ত ভাইয়া তোকে ভালোবাসেনি?’
‘আমিতো তা অস্বীকার করিনি। কিন্তু আমি তো তাকে ভালোবাসনি। তার বোঝা উচিত ছিল, জোর করে অন্তত ভালোবাসা পাওয়া যায় না।’
‘তুই সত্যিই তাকে ভালোবাসিসনি?’
‘জানি না। আমার এ ব্যাপারে কথা বলতে ভালো লাগছে না রিধি।’
‘আচ্ছা চল, প্রফেসর ইকবাল আমাদের সবাইকে ডেকেছে।’
‘চল।’

‘তুমি আমাকে ভালোবাস বিন্দু। হয় তুমি তা বুঝতে পারছ না, না হয় তুমি বুঝতে দিতে চাইছ না। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তুমি আমার হয়ে যাবে বিন্দু,শুধু আমার। আর তোমার আমার দেখাও খুব শীঘ্রই হবে।
যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’

এবার বৃত্তের পরিচয় দেই। প্রলয় মজুমদার বৃত্ত, সাজিদ মজুমদার ও আয়শা মজুমদার এর ২য় সন্তান। বড় ছেলে মলয় মজুমদার চিত্ত আর একমাত্র মেয়ে সাবরিনা মজুমদার মম। নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা আছে। তিন বাবা ছেলে মিলেই তা সামলায়। বাড়িতে বৃত্তের দাদা-দাদী, চাচা চাচি, কাজিন সবাই একসাথেই থাকে। চিত্ত ২ মাস আগেই বিয়েই বিয়ে করেছে। আপাতত এটুকুই, বাকিটা আস্তে-ধীরে জানতে পারবেন।

‘স্টুডেন্টস তোমাদের এখানে ডাকার একটা উদ্দেশ্য আছে। তোমরা কি তা বুঝতে পারছ?
আচ্ছা আমিই বলছি। প্রতি বছরের মতো এবারও ফাইনাল ইয়ারের প্রতিটা ডিপার্টমেন্ট জন্য ট্যুরের আয়োজন করা করা। এবারও তাই হবে। আগামী মঙ্গলবার মানে আজ থেকে ৫ দিন পরে আমরা সবাই কক্সবাজার যাচ্ছি। নোটিশ বোর্ডে এমাউন্ট দেয়া আছে সবাই দেখে নিও। আশা করছি সবাই আমাদের সাথে থাকবে।’

কক্সবাজারের নাম শুনে বিন্দুর মুখ শুকিয়ে যায়। এটা সেই জায়গা যেখানে ওর ২৩ বছরের জীবনের সবচেয়ে ভাল এবং সবচেয়ে খারাপ উভয় সময় কেটেছে। রিধি বিন্দুর মনের অবস্থা বুঝতে পারে।

‘মৃত্তিকা আমার না কক্সবাজার যেতে ইচ্ছে করছে না রে।’
‘কেন? তোর আবার কি হল?’
‘জানি না।’
‘ন্যাকা ষষ্ঠী, কয়েকদিন আগেও তো ট্যুর ট্যুর করে মাথা খাচ্ছিলি, আর আজ ট্যুরের কথা বলতে না যাব না। তুই যাস বা না যাস আমি তো অবশ্যই যাব। ‘
‘তাহলে আমিও যাব।
‘পাগলি একটা। চল বাড়ি ফিরি।
জানতাম তুই আমার জন্য না বলেছিস। কিন্তু আমি এতটাও স্বার্থপর নই রে।’
‘ ও হ্যাঁ, তোকে তো বলতেই ভুলে গেছি।’
‘আবার কি ভুলেছিস?’
‘মা তোকে আমাদের বাড়ি যেতে বলেছে।’
‘কখন বলল? তোদের বাড়ি হয়েই তো আসলাম, তখন তো কিছু বলল না।’
‘আরে ভার্সিটিতে আসার পর ফোন করে বলেছে। কাকা কাকি সবাই আমাদের বাড়িতে আসবে।’
‘আচ্ছা চল।’
[রিধি অার বিন্দু কাজিন,সমবয়সী।]

‘হ্যাঁ রে বৃত্ত, তোর কি বাড়ি ফিরতে
ইচ্ছে করে না?’
‘একদমই ইচ্ছে করে না।’
ছেলের অকাট্য কথায় আয়শা মজুমদারের চুপ হয়ে যায়। নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই দাদা ইখতিয়ার মজুমদার পথ আটকায় বৃত্তর।
‘নিজের মায়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, তা কি ভুলে গেছ?’
‘চাইলেই কি সবটা ভোলা যায় দাদুভাই, যেমন আমি আজও বিন্দুকে ভুলতে পারি নি।’
‘আবার বিন্দু! এই মেয়েটা তোমার মাথা থেকে কবে যাবে বৃত্ত? ‘
‘বিন্দু আমার মাথায় না মনে আছে। আর কিছু বলার আছে তোমার?’
‘তুমি যা চাইছ তা কোনোদিনও হবে না বৃত্ত।’
‘নিজের চাওয়াকে পূর্ণতা দিতে কেউ আমাকে আটকাতে দিতে পারবে না, স্বয়ং ইখতিয়ার মজুমদারও না।’

ইখতিয়ার মজুমদার বৃত্ত কথায় অপমানিত বোধ করলেন। দূর থেকে মম আর দাদী দাড়িয়ে সবটা দেখছিল। এ বাড়িতে একমাত্র ইখতিয়ার মজুমদার এর ধারনা, বিন্দু বৃত্তের টাকার জন্য ওর সাথে ছিল আর টাকা পাওয়ার পর ওকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তাদের এ ধারনা পুরোটাই ভুল। বাড়ির বাকিরা তার মুখের উপরে কিছু বলার সাহস পায় না।

ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল আজ থেকে সাড়ে তিন বছর আগে, যখন বৃত্ত হায়ার এডুকেশন কম্পিলিট করে দেশে ফিরে আর বিন্দু কক্সবাজার একটা ভার্সিটিতে অনার্স ফাস্ট ইয়ার এ। আহসান সাহেব তখন স্থানীয় ব্যাংকে ম্যানেজার পদে ছিলেন। খুব ভালোই দিন যাচ্ছিল তাদের।
কক্সবাজার এ নিজেদের কোম্পানির নতুন ব্রাঞ্চ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মজুমদার পরিবারের সবাই আসে।
প্রতি শুক্রবার বিকালে বিন্দু আর বীনা সাগর পাড়ে ঘুরতে আসত। তেমনই এক শুক্রবারে দুজনে আসে। হয়ত সেদিন না আসলে আজ এই ঘটনা বা দূর্ঘটনা হত না।
মম আর বিন্দু দুজনেই একই ডাব ওয়ালার কাছে যায় ডাবের পানি খেতে। ডাব নিয়ে বিন্দু বীনাকে নিয়ে একটু দূরে দাড়ায়। তখন দুটো ছেলে এসে মমকে বিরক্ত করা শুরু করে। দুবোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে মমর দিকে এগিয়ে যায়। দুজনে হাতে থাকা ডাব দুটো ছেলে দুটোর পায়ের উপর ফেলে দেয়।
‘এলাকায় নতুন মনে হচ্ছে? এখানে মেয়েদের সাথে অসভ্যতামীর শাস্তি কি জানিস? গণধোলাই। লোক ডাকব?’
‘না না। সরি আপু, এমন কাজ আর কখণো করব না।’
‘ভাগ এখান থেকে।
আর ইউ ওকে?’
প্রথমবার আর হঠাৎ এমন হওয়ায় মম অনেকটাই ভয় পায়। ততক্ষণে মমকে খুঁজতে চিত্ত আর ওর আরেক কাজিন চিত্রা আসে। বিন্দু সবটা বলাতে ওরা ধন্যবাদ দিয়ে চলে যায়। বিন্দু রাও বাসার দিকে ফেরত আসে। তার কিছুক্ষণ পর বৃত্ত আসে ডাব ওয়ালার কাছে বিন্দুর খবর নিতে। ছোট থেকে এ এলাকায় বড় হওয়ায় প্রায় লোকই ওকে চিনে। ডাব ওয়ালা বিন্দুর বাড়ির ঠিকানা বৃত্তকে বলে।
প্রথমবার বিন্দুকে দেখে চোখ ফেরাতে পারে না বৃত্ত। খোলা চুলে গোলাপ গাঁথা, লাল সাদার কম্বিনেশনে শাড়ি, হাতে লাল সাদা চুরি আর কাজল টানা চোখ। বৃত্ত বুকে হাত দিয়ে গাড়ির সাথে দাড়িয়ে থাকে। বিন্দু এসে বৃত্তের সামনে তুড়ি বাজায়। ধ্যান ভাঙে ওর।
‘হ্যালো, কে আপনি? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
বৃত্ত কিছু না বলে মাথা চুলকে চলে যায়। বিন্দু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
‘পাগল না বেটা।’
‘যাই বলিস না কেন আপু, দেখতে কিন্তু হ্যান্ডসাম।’
‘তাহলে বাবাকে তোর বিয়ের কথা বলি।’
‘ধূর, তুই হলি একটা আস্ত মেন্টাল।’

রিসোর্টে ফিরতেই চিত্ত, চিত্রা আর মম ঘিরে ধরে বৃত্তকে। সবটা বলে ওদের।
‘বড় ভাইয়া যাই বল না কেন, ওই মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমাদের ছোট ভাইয়ার সাথে বেশ মানাবে।’
‘খুব পেকেছিস তুই।’
‘কি করব বল, যেখানে এই ছোট মেয়েটার সামনে তার বড় ভাই বোন বফ গফ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে তো আমার এ অবস্থাই হবে।’
পরে আরো কিছুক্ষণের আড্ডা শেষ করে সবাই যার যার রুমে চলে যায়। বৃত্ত চোখ বন্ধ করলেই শুধু বিন্দুর মুখটা দেখতে পায়। অবশ্য তখন বৃত্ত বিন্দুর নামটাও জানত না। পরের দিন চারজনই আবার সেই ডাব ওয়ালার কাছে যায়। কথায় কথায় বিন্দুর ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারে।
সাতদিন কক্সবাজার থাকার পরও বৃত্ত আরো কয়েকদিন থাকতে চায়। পরে সাজিদ মজুমদার সিদ্ধান্ত নেয় কক্সবাজার ব্রাঞ্চের দ্বায়িত্ব বৃত্ত নেবে। এ যেন সোনায় সোহাগা।
এর পর শুরু হয় বিন্দুর মন জয় মিশন। আড়াল থেকে নানারকম গিফট পাঠাতে থাকে। তবে বিন্দু সে সবে পাত্তা দিত না। ব্যাপারটাতে বেশ রাগ লাগে বৃত্তর। খুব ভালোবাসে ও বিন্দুকে, বিন্দুর এমন অবহেলা বৃত্ত নিতে পারছিল না। ঠিক করে নেয় বিন্দুর সামনে আসবে।
এক শুক্রবারে সাগর পারে বিন্দুর জন্য অপেক্ষা করে বৃত্ত। সেদিন বিন্দু একটা নীল শাড়ি পরে আসে। কিন্তু বিন্দুকে দেখে রাগে লাল হয়ে যায় বৃত্ত। সেদিন বিন্দুর সাথে বীনা আসেনি, এসেছে একটা ছেলে। দুজনে হাত ধরে সাগর পাড়ে ঘুরছিল। বৃত্ত ওদের সামনে গিয়ে দাড়ায়। সজোড়ে একটা চড় বিন্দুর গালে বসিয়ে দায়। ওখানে উপস্থিত সবাই অবাক হয়। বিন্দু যেন বোকা বুনে গেছে এমন কান্ডে। রাগে কাপছে বৃত্ত।
হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় বিন্দুকে, আর বিন্দু যেন কিছু বলতেই ভুলে গেছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here