হারানো সুর (১)

হারানো সুর (১)
সানজিদা ইসলাম সেতু

‘দেখ আহসান একটা কথা তোকে বলে দিচ্ছি, আমার মৃত্তিকাকে একদম বকবি না। দেখ দেখ মেয়েটার মুখটা এতোটুকু হয়ে গেছে।’
‘এই হয়েছে এক জ্বালা! এই মেয়ে যতই দুষ্টুমি যতই বদমাশি করুক না কেন তাকে কিছু বলা যাবে। তুমি জানো মা, এই মেয়ের জন্য আমাকে এলাকায় কত কথা শুনতে হয়?
আজ একজন ডেকে বলল, ভাই আপনার বড় মেয়ের জন্য গাছের পেয়ারা থাকে না, প্রতিদিন চুরি করে নিয়ে যায়। আমার বউ ছাদে আচার রোদ দেয় তাও থাকে না।
আচ্ছা তুমিই বল মা এমন করলে কি ওকে বিয়ে দেয়া যাবে?’
‘আমাদের রাজকন্যার বিয়ে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। ওর জন্য রাজপুত্র আসবে ঘোড়ায় চেপে।’
‘এমন চলতে থাকলে রাজপুত্র কেন রিক্সাওলাও আসবে না। সব দোষ হচ্ছে বাড়ির সবার, আদর দিয়ে দিয়ে বাদর তৈরী করেছ।’
‘একদম ঠিক বলেছ বাবা, আপু একটা বাদর তৈরী হয়েছে। আমি জানতাম ও মানুষ হবে না।’
‘আরে আরে, মা জননী আমি তো আপনার অনুপস্থিতি অনুভব করছিলাম। আপনি এখানে এসে আমাকে ধন্য করেছেন।
চোরের সাক্ষী মাতাল, হুহ।’

আহসান সাহেব রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায়। মা, স্ত্রী, এক ছেলে-ছেলের বউ, দুই মেয়ে আর নাতনী নিয়ে তার ভরা সংসার। এতোক্ষণ যাকে নিয়ে কথা হল সে হচ্ছে মৃত্তিকা, মৃত্তিকা আহসান বিন্দু। সবাই তাকে মৃত্তিকা বলে ডাকে। কথার মাঝে যে ফোঁড়ন দিয়ে সে হচ্ছে বিন্দুর ছোট বোন মাহিরা আহসান বীনা, আহসান সাহেবের ছোট মেয়ে।
আহসান সাহেবের মা বকুল বেগমের কথা সবাই মানে, এ বাড়ির আসল খুটি তিনি। নাতি-নাতনিরা তার বড়ই আদরের।

রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে আসে আহসান সাহেবের স্ত্রী মাহবুবা খাতুন, হাতে হাতা, রাগে শরীর কাঁপছে।
স্ত্রীকে এভাবে দেখে এগিয়ে যায় আহসান সাহেব,
‘কি হয়েছে? ‘
স্বামীর কথার উত্তর না দিয়ে শ্বাশুড়ির দিকে এগিয়ে যায় মাহবুবা খাতুন।
‘মা আজ আপনাকে একটা বিহিত করতেই হবে, না হলে আমি আজই বাপের বাড়ি চলে যাব।’
ছেলের বউয়ের মুখে বাপের বাড়ি যাবার কথা শুনে তিনি বুঝতে পারলেন আবার কিছু ঘটেছে। কারণ, মাহবুবা খাতুন তখনই বাপের বাড়ি যাবার কথা বলে যখন সে কোনো কিছু নিয়ে খুবই রেগে যায়।
‘কি হয়েছে বৌমা? তুই এমন অলক্ষুণে কথা বলছিস কেন?’
‘রান্নাঘর একটা তাকের উপর আমি চার কৌটায় চার রকমের আচার রেখেছি। আজ দেখি সব খালি, একদম পরিষ্কার, দেখে মনেই হয় না আমি তাতে আচার রেখেছিলাম। ‘
‘কি বলছ কি?’
‘সত্যি বলছি মা আর আমি এটাও জানি এ কাজ কারা করেছে?’
‘কারা?’
‘আপনার নাতি বিশ্ব, নাতনী মৃত্তিকা আর বীনা, নাতবৌ ফাইজা। এটাও বলে দিচ্ছি আজ এদের সবার খাবার বন্ধ। ‘
নাম গুলো শুনে বকুল বেগম কিছু বলতে গিয়েও বলে না। মৃত্তিকা আর বীনা একে অপদের দিকে কিছু ইশারা করে রুম থেকে আড়ালে বের হয়ে যায়। সোজা বিশ্বর রুমে। বেচারা কেবলমাত্র বিছানায় শরীর ফেলেছিল। দুই বোনকে একসাথে দেখে উঠে বসে।
‘তুই এখানে আয়েশ করছিস, ওদিকে মা আচার চোরদের ধরে ফেলেছে আর বলে দিয়েছে তাদের খাবার বন্ধ। ‘
খাবার বন্ধের কথা শুনে বিশ্বর মুখ শুকিয়ে গেছে, কারণ আজ তার মানিব্যাগ হালকা হয়ে যাবে।
ঘরের বাইরে থেকে মাহবুবা খাতুন এর কথা শোনা যাচ্ছে।
‘একমাত্র ছেলের জন্য কত ভালো একটা মেয়ে এনেছিলাম, ভেবেছিলাম হনুমানটাকে একটা মানুষে পরিণত করবে কিন্তু কে জানত সেই ভালো মেয়েটাও হনুমতিতে পরিণত হবে। আর আমার মেয়েদের কথা কি বলব, যত বলব ততই কম পরবে। সব হয়েছে মা আপনার জন্য। আপনার আশকারাতেই এগুলোর এ অবস্থা। আচ্ছা মা আপনিই বলুন, ওরা দিনদিন বড় হচ্ছে নাকি ছোট হচ্ছে?
বিশ্ব নিজে এক মেয়ের বাবা, বিন্দু অনার্স শেষ পর্যায়, বীনা অনার্স ফাস্ট ইয়ার, ওদের কি এখনও এসব মানায়?’
মায়ের কথা শুনে বিন্দু বাইরে এসে বলে,
‘শুধু আমাদের বলছ কেন? বাবা আর দাদীও তো আচার খেয়েছে। ‘
বিন্দুর কথা শুনে ওর মায়ের মাথায় হাত।
‘শেষে কিনা তোমরাও!!
খাবার দিচ্ছি খেয়ে নাও সবাই, আর হনুমানটাকেও ডাক। সবাই খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর।
এটা বাড়ি না চিড়িয়াখানা তাই মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না।’

চারদিক নিস্তব্ধ, কেউ একজন বাঁচার জন্য আকুতি মিনতি করছে সামনে দাড়ানো লোকটার কাছে। লোকটা হাত বাড়ালেই পাশের একজন একটা লোডেড রিভলবার দেয়। ঠিক কপালের মাঝ বড়াবড় তাক করে রিভলবারটা। সামনের লোকটার আকুতি যেন তার কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না। রিভলবারের একটা বুলেট জায়গা করে নিল সেই লোকটার কপালের মাঝে। রিভলবার টা ফেরত দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। এতকিছুর মাঝেও লোকটা একবারও মুখ থেকে মাস্কটা সরায় নি,তাই তার চেহারাও দেখা যায়নি।

হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায় বিন্দুর, এই কনকনে শীতেও ঘেমে যায় ও। বারান্দার দিকে তাকাতেই বিন্দুর মনে হয় কে যেন দাড়িয়ে আছে কিন্তু গিয়ে কাউকে পায় না। হঠাৎই রুমের ভিতর থেকে মোবাইলের রিংটোন আসে। এতরাতে ফোনের আওয়াজ শুনে অবাক হয় বিন্দু। কে ফোন করবে এত রাতে? ফোন হাতে নিয়ে দেখে অচেনা নাম্বার। রিসিভ করার আগেই ফোন কেটে যায়, আবার ফোন আসে, রিসিভ করে বিন্দু…
‘তুমি আর শোধরালে না বিন্দু! একবার ফোন দিলে তুমি ফোন রিসিভ কর না। আচ্ছা তুমি এই ঠান্ডার মধ্যে বারান্দায় কি করছিলে? তোমাকে কতবার বারন করেছি ঠান্ডায় বাইরে না যেতে। আমার কোনো কথাই কি তুমি একবারে বুঝতে পার না? চুপ করে আছ কেন ড্যামেড?’

না কিছুতেই ভুল হতে পারে না, এ সেই ভয়ংকর কন্ঠ, যা একসময় বিন্দুর কাছে নেশার মতো ছিল, আজ তা বিষের চেয়েও বিষাক্ত। ফোনের ওপাশ থেকে এ কন্ঠ শুনে হাত হাত থেকে ফোন পরে যায়। চিৎকার দিয়ে বসে পরে বিন্দু, পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
বিন্দুর চিৎকারে ঘুম ভাঙে বীনার। বিন্দুকে এ অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে যায় ও। দৌড়ে যায় বিন্দুর কাছে।
‘আপু কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?’
‘ও এসে গেছে, আমাকে ছাড়বে না, মেরে ফেলবে, ও এসে গেছে এসে গেছে। ‘
‘কে এসেছে আপু? কার কথা বলছিস?’
‘ও এখানেই আছে, আমাকে বাঁচতে দেবে না। ‘
বিন্দুর এমন অবস্থায় অনেকটা ভয় পায় বীনা। দরজা খুলে সবাইকে ডাকে। এতো রাতে বীনার এমন ডাক শুনে বাকিরাও ভয় পায়। রুমে এসে বিন্দুকে এক কোনে গুটিশুটি হয়ে বসে কাঁদতে দেখে। আহসান সাহেব মেয়ের কাছে যায়। বিন্দুর মাথায় হাত রাখে উনি। মাথা উঁচু করে বাবাকে দেখে জরিয়ে ধরে বিন্দু। হঠাৎ বিন্দুর অবস্থা পরিবর্তন নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে উনি। কি এমন হল যে বিন্দু এমন করছে?
‘মৃত্তিকা কি হয়েছে? এমন করছিস কেন?’
‘বাবা ও এসে গেছে,, এবার আর আমাকে ছাড়বে না। বাবা ও আমাকে মেরে ফেলবে, মেরে ফেলবে, আর বাঁচতে দেবে না।’
‘কে এসে গেছে? কে তোকে বাঁচতে দেবে না?’
‘বৃত্ত!’
বৃত্ত নামটা শুনে সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরল। এতবছর পর আবার সেই নাম।
বিন্দুর কথার মানে কিছুই বুঝতে পারছে না আহসান সাহেব।
‘দেখ মা বৃত্ত আসে নি, সবটা তোর মনের ভুল। নিশ্চয়ই কোনে খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস। বৃত্ত কোথা থেকে আসবে,ও তো জানেই না তুই কোথায় আছিস।’
‘না বাবা আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। আমি বৃত্তর সেই কন্ঠ শুনেছি। আমার এতটা ভুল হতে পারে না বাবা।ও সবটা যেনে গেছে। এবার ও আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না।’
‘মৃত্তিকা আমার কথা শোন বোন, কেউ তোর কিছু করতে পারবে না। তোর ভাইয়া আছে তোর সাথে, কিচ্ছু হবে না তোর।’
বিন্দু কিছুটা শান্ত হলেও এখনও অনেকটা ভয়ে আছে।
না চাওয়া ভয়ংকর অতীত কারো জন্যই সুখে নয়। বিন্দুর বিষয়টাও তেমন।

‘হ্যাঁ গো আমার মৃত্তিকার সাথে কেন এমন হচ্ছে ? ও কি কোনোদিনও এসব থেকে মুক্তি পাবে না?’
‘সব কিছুর একটা শেষ আছে মাহবুবা, আর এসবেরও শেষ হবে চিন্তা করো না।’
‘কবে হবে? যখন আমার মেয়েটা ভালো থাকার চেষ্টা করে তখনই ওই বৃত্ত নামটা সব কিছু তছনছ করে দিয়ে যায়। কি ক্ষতি করেছে আমার মেয়েটা?’
‘মাহবুবা সব ভুল আমারই, আমার জন্যই আজ এ সব হচ্ছে।’
‘বাবা এসব বল না তো। আমাদের এখন এটা ভাবতে হবে কি করে মৃত্তিকাকে বৃত্তের থেকে দূরে রাখা যায়। আমার মনে হচ্ছে ও ঠিকই বলেছে। বৃত্ত ফিরে এসেছে। ‘
‘কে ফিরছে না ফিরছে তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি শুধু এটা জানতে চাই আমার মেয়ের সেফটির জন্য কি করবে তোমরা?’
‘মাহবুবা চিন্তা কর না, মৃত্তিকার কিছু হবে না। তুমি গিয়ে শুয়ে পর, আমরা আছি তো।’
‘কিন্তু.. ‘
‘মা আমাদের উপর একটু ভরষা রাখ, যাও।’
মাজবুবা খাতুন যাওয়ার পর আহসান সাহেব আর বিশ্ব মন খুলে নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করে।

‘বুত্ত যদি ফিরে এসেই থাকে তাহলে কিন্তু আমাদের কিছু করার থাকবে না। ওকে আমি খুব ভালো করে চিনি। ও যা চাই তা ও নিয়েই ছাড়ে।’
‘তাহলে কি করব এখন?’
‘আমার এক ফ্রেন্ড আছে, ওর পরিবারের মৃত্তিকাকে খুব পছন্দ। তুমি বললে আমি কথা বলতে পারি।’
‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু মৃত্তিকা, ও কি? ‘
‘চিন্তা কর না বাবা। মৃত্তিকা নিজে থেকেই রাজি হবে।’
‘আচ্ছা ওদের সাথে তুই কথা বল আমি বাড়িতে সবার সাথে কথা বলছি।’
‘ওকে।’

দেয়াল জুড়ে শুধু বিন্দুর ছবি। তবে সেগুলো কোনোটাই সামনে থেকে তোলা নয়। সবচেয়ে বড় ছবিটার সামনে দাড়িয়ে আছে বৃত্ত। মুখে হাসি থাকলে চোখে তার সীমাহীন রাগ। রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। বৃত্ত যাকে এতো ভালোবাসে সে ওকে বোঝার চেষ্টাই করে না, সবসময় দূরে থাকে।
‘বিন্দু, তুমি যতই দূরে যাওয়ার চেষ্টা কর না কেন, পারবে না। তুমি যত দূরে যাবার চেষ্টা করবে আমি তার চেয়েও কয়েকগুন কাছে আসব। তোমাকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।
খুব শীঘ্রই তুমি বৃত্তর বুকে থাকবে।
তোমাকে তোমার কাজের শাস্তি পেতেই হবে। তোমার জন্য যে কি অপেক্ষা করছে তা তুমি কখনো কল্পনাও করনি।
আমার জীবনের হারানো সুর তোমাকেই ফিরিয়ে আনতে হবে, শুধু তোমাকেই।’

চলবে

নোটঃ লেখিকা কথনে মৃত্তিকা আহসান বিন্দকে সে বিন্দু নামে উপস্থাপন করবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here