স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। #দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-৩৭)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-৩৭)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

দিনটা শুক্রবার। হিমেল মধ্যহ্ন। জুম’আর নামাজে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে জাওয়াদ। মুশরাফা বিছানায় শোয়া। জ্বর সেরেছে, কিন্তু শরীরের দুর্বলতা কাটেনি। এখনো শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি। খাবারে রুচি নেই। মাথা ভার হয়ে থাকার ফলে ঠিকঠাক চলাফেরা করতে পারছেনা। জাওয়াদ শুভ্র পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে আয়নায় চোখ ফেলল। দেখল মুশরাফা তাকে পরখ করছে স্থির দৃষ্টিতে । সে ভ্রু উঁচালো, কী?
মুশরাফা ঠোঁট নাড়িয়ে বলল, ‘ মাশা আল্লাহ।’
জাওয়াদ আনমনেই হেসে ফেলল। আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘শরীর কেমন এখন? আগের থেকে ভালো লাগছে না?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’ ছোটো করে উত্তর দিল মুশরাফা। জাওয়াদ পায়ে পায়ে এগিয়ে কাছে এলো। কপালে হাত দিয়ে দেখল গা গরম কিছুটা। সে ভ্রু কুঁচকাল। পুরো কোর্স তো শেষ তবুও গা গরম লাগছে কেন? সে জিজ্ঞেস করল,
‘ সর্দি, কাশি, গলা ব্যাথা তো নেই, তাই না?’
মুশরাফা সায় জানাল। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করল,
‘এখন কী সমস্যা আছে? ‘
থেমে আদেশের সুরে বলল, ‘লুকাবে না একদম?’

মুশরাফা ধীরে বলল, ‘মাথা ভারি লাগে, আর ক্লান্তি লাগে।’
জাওয়াদ ভেবে বলল, ‘ জ্বরের ইফেক্ট উইকনেস থেকে হচ্ছে এমন। গত কদিন ধরে তো খাওয়া দাওয়া ছিল না। কী খাবে বলো, নামাজ থেকে ফেরার সময় নিয়ে আসব?’

‘কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।’ মুখ বাঁকাল মুশরাফা।

জাওয়াদ চোখ রাঙাল,
‘ কাল সকালে ফল কেটে দিয়েছি খাওনি। সন্ধ্যায় জুস করে দিলাম দুই চুমুক দিয়েই মুখ বাঁকিয়ে রেখে দিয়েছো। রাতে ডিম আর চিকেন স্যুপ এনে দিলাম তাও খাও নি। ভাতটাও খাওনি। এক লোকমা নিয়ে বমি হবে বলে রেখে দিয়েছো। এসব বাহানা করেই এই হাল করেছো। আর কোন বাহানা চলবে না। ফ্রিজে ফল গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সব তোমাকে খাইয়ে শেষ করব। শুধু নামাজ থেকে ফিরতে দাও।’

মুশরাফা অসন্তোষ চোখ তাকাল, ‘আমার খেতে ইচ্ছে না করলে আমি কী করব?’

‘জোর করে খাবে। নাহলে মামা বাড়ি গিয়ে রোগী সেজে শুয়ে থাকো। এ বাসায় রোগ ডেকে আনা মানুষের জায়গা হবে না।’ তীব্র রাগ দেখাল জাওয়াদ। মুশরাফা মুখ চেপে হাসল,
‘মামী আমার জন্য বিছানা রেডি করে বসে আছেন। ফোন দিব? ‘

জাওয়াদ ক্রুর চোখে তাকাল, ‘দাও! আমি নিষেধ করেছি?’
‘আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন?’

জাওয়াদ অভিমান নিয়ে বললাম, ‘না পারার কী আছে?’
‘তাহলে চলে যাই? পরে কিন্তু আবার রাফা রাফা বলে কাঁদবেন না। আমি আগেই বলেই দিচ্ছি আপনার চোখের পানি মুছে দিব না।’
কৌতুকের স্থলে বলল মুশরাফা। জাওয়াদের রাগ দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে ওর। বহু কষ্টে হাসি চেপে রাখল। আধশোয়া হয়ে বসে ফোন হাতে নিল। সত্যি ‘মামী’ সেভ করা নাম্বারে ডায়াল করে বসল। তুলতেই সালাম দিয়ে যখন বলল, ‘মামী আমি তোমা….

পুরো কথা শেষ করবার আগে জাওয়াদ চো মেরে ফোন কেড়ে নিল। কল কেটে তীক্ষ্ম চোখ চাইল, ‘ খুব সাহস হয়েছে না? আমাকে না বলে একবার যেয়ে দেখাও! ‘

ফোন নিয়ে জাওয়াদ আয়নার কাছে ফিরে গেল। মুশরাফা চেপে রাখা হাসি মেলে দিল। প্রাণবন্ত হেসে উঠল। তেলো,মিলো নামক বিড়াল দুটো তখন ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মিলো খাটের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। মুশরাফা হাত বাড়িয়ে কোলে নিল। অল্প কদিনেই বিড়াল দুটো পোষ মেনে গেছে। কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ তোদের বাবা তোদের মায়ের ভালোবাসায় হাবুডুবু খাচ্ছে। একবারে চোখে হারায়। তোদের মাকে না দেখে থাকতেই পারে না। দ্যাখ, আমার যাবার কথা শুনতেই কেমন রেগে আছে। দ্যাখ, দ্যাখ!’

বলে মিলোর মাথাটা আয়নার দিকে নিল। মিলো মেয়াও করে ডেকে উঠল। মুশরাফা ফিসফিস করে বলল, ‘চোখ টোকে হারাই কিন্তু আমিও। এটা তোদের বাবাকে বলিস না। ভাব নিবে খুব!’

আয়নার ভেতর দিয়ে মুশরাফার কথা বলার ভঙ্গি দেখে রাগ সরে গেল জাওয়াদের। ভীষণ হাসি পেল। আস্ত ড্রামা কুইন একটা!

মুশরাফা কিছু সময় চুপচাপ বসে রইল। চুপটি করে দেখল জাওয়াদের চুল আঁচড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা। স্ত্রীসেবা করতে গিয়ে নতুন রাঁধুনি হয়েছে জাওয়াদ। মা না থাকায়, অফিস যাবার আগে রান্না বান্না করে দিয়ে গেছে কদিন যাবত। অনাড়ি হাতে রান্না করতে গিয়ে কখনো চপিংয়ে সবজির উপর ছুরি বসাতে গিয়ে হাতের উপর ছুরি বসিয়েছে। আবার কখনো গরম পাতিল ধরে ফোস্ক ফেলেছে হাতে। কখনো গরম তেল, কখনো ভাতের মাড়ে ঝলসেছে চামড়া। দুই হাতে কত জায়গায় যে কালসিটে আর ফোস্কা পড়েছে তার ইয়াত্তা নেই। এখন চিরুনিতে চাপ দিতে পারছে না, জ্বলতেছে। মুশরাফা বিছানায় টিকতে পারল না। বিড়াল ছেড়ে দিয়ে হেলেদুলে উঠে এলো। মাথা ঘুরে উঠল। টেবিল, চেয়ার, দেয়াল ধরে এগিয়ে গেল জাওয়াদের দিকে। আয়নায় দিকে পিঠ করে জাওয়াদের সামনে এসে দাঁড়াল। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘উঠে এলে কেন? মাথা ঘুরে পড়বে তো!’

মুশরাফা ড্রেসিংটেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ভর ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল,
‘ মৃদু স্বরে বলল,
‘পড়ব কেন?আপনি আছেন না?’

পরপরেই জাওয়াদের হাত দিয়ে চিরুনি নিয়ে ওর দুই হাতের উলটো পিঠ নিজের কোমরে রাখল, ‘চিরুনি নয়, আমায় ধরুন।’

জাওয়াদের শক্ত হাত প্রিয়তমাকে আগলে নিল। না নিজের ঘায়ে আঘাত লাগল, আর না স্ত্রীর গায়ে। একটুও পড়তে দিল না। মুশরাফা যত্নভরে চুল আঁচড়ে দিল। তারপর আঁতরের শিশি নিল। জাওয়াদের মুখে ফুটে উঠল প্রসন্ন হাসি। মন বলল, পৃথিবীর সব সুখ আল্লাহ তোমায় দিক। মুখ বলল,
‘ একটু হাঁটাচলা করতে পারবে? কাল তোমায় নিয়ে বেরুবো।’
‘কোথায় যাব?’
‘ভাইয়ার বাসায়। জায়ফা ও আছে। মামা মামীকে ও যেতে বলব না হয়। সবার সাথে থাকলে ভালো লাগবে। যাবে?’

মামা মামী, তারিফ সবাই আসতে চাইছিল। ও নিষেধ করেছে। সামান্য জ্বরে আসা লাগে! বাসায় একা একা ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে গেলে ভালো লাগবে। মুশরাফা রাজি হয়ে গেল। পরক্ষণেই বিড়াল দুটোর কথা ভেবে বলল,
‘ মা ও নেই! তিলো মিলো কার কাছে থাকবে?’
জাওয়াদ ভেবে বলল,
‘ ভাবির কাছে রেখে যাব। জিহান দেখবে। মা ও ফিরবেন কাল সকালে। তা ছাড়া ডিনার করে রাতেই ফিরব আমরা। এ টুকু সময় সমস্যা হবে না। ‘

মুশরাফা সায় জানাল। খানিক ভেবে বলল, ‘ আপনি না সারপ্রাইজ দিবেন বলেছিলেন। সেটার জন্য নিবেন?’

জাওয়াদ হাসল। কিছু বলল না। মুশরাফা অনুসন্ধানী চোখে চেয়ে বলল, ‘এ্যাই! আপনি আর ভাইয়া মিলে আবার কোথাও যাবার প্ল্যান করছেন না তো! কী খিচুড়ি পাকাচ্ছেন, বলুন শীগগির! ‘

জাওয়াদ হেসে বলল, ‘হ্যাপিনেসের খিচুড়ি! ওই খিচুড়িতে সব পাবে তুমি। সব দুঃখ ভুলে যাবে এত চমৎকার টেস্ট। একবার খেলে জীবনেও ভুলবে না। খুশিতে পাগল হবার দশা হবে।’

মুশরাফা এই রূপক অর্থ বুঝল না। সে জানল না তার আড়ালে কত চক্রান্ত হচ্ছে। সে হেসে আঁতর লাগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ তবে তো খেয়ে দেখতেই হয় কেমন খিচুড়ি পাকাচ্ছেন আপনারা।’

জাওয়াদ মনে মনে বলল, ‘ তোমার মা, বাবা তোমার পুরো পরিবার তোমার অপেক্ষায় চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে। তোমার সুখের পর্ব এসে গেছে।’

সে কথা মুখে আনল না। চমকানো যাক মেয়েটাকে। সে বলল, ‘খিচুড়ি তো বিকেলে খাবে। লাঞ্চে কী খাবে, বলো? বাইরে থেকে নিয়ে আসব। কাচ্চি, চিকেন, ফিশ, ডেজার্ট?’

মুশরাফা না না করল, ‘ কাচ্চির নাম শুনলেই বমি আসছে। ‘ মুখ বাঁকাল সে। জাওয়াদ অবাক হলো, কাচ্চি ভীষণ পছন্দ রাফার। আজ নাম শুনে বমি আসছে! স্ট্রেঞ্জ! কাল ওর পছন্দের বার্গার এনেছে, এক চিমটি মুখে নিতেই বমি করে ফেলেছে। বলেছে, আর কখনো এসব আনবেন না। যেন জীবনেও খায় নি! জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ তাহলে কী খেতে ইচ্ছে করছে? বলো, নিয়ে আসব।’

মুশরাফা ভেবে বলল, ‘ বরবটির ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।’

জাওয়াদের চমকে তাকাল। ভর্তা তো দূরে থাক, মুশরাফাকে বরবটি খেতে দেখেনি কখনো। হলো কী এই মেয়ের, কোথা থেকে নতুন নতুন নিয়ম চালু করতেছে। ভাইরাস জ্বরে জিহবার স্বাদ চলে যায়, এর জন্যই এমন হচ্ছে? হবে হয়তো। এই জ্বরের মধ্যে আর কী হবে? জাওয়াদ অতো ভাবল না। বলল,
‘আচ্ছা আমি নিয়ে আসব। আর কিছু লাগবে?’

মুশরাফা হাসল। জাওয়াদের হাত দুটো সামনে আনল। তালুতে পড়া ফোস্ক আর চামড়ার কালসিটে দাগে চোখ বুলাল। কালসিটে দাগের উপর চুমু খেয়ে বলল,
‘ আপনার ভালোবাসা আমার হৃদয় জয় করে ফেলেছে। আমি আপনার কাছ থেকে যতটা ভালোবাসা কামনা করেছিলাম, তার হাজারগুণ বেশি পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ । এতটাই পেয়েছি, বাকি জীবন না পেলেও আফসোস থাকবে না। আপনার প্রতি আমার কোন অভিযোগ, আক্ষেপ নেই। আর কিছু লাগবে না।’

জাওয়াদ হাসল, কপালে অধর চেপে বলল, ‘তোমাকে এখনো তোমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি উপহার দিতে পারলাম। সেটা দিই তারপর ক্রেডিট নিব। ‘

থেমে বলল, ‘আমি নামাজ পড়েই ফিরব। ততক্ষণ সাবধানে থেকো। কিছু লাগলে ফোন দিয়ে জানিও। আসি, ফি আমানিল্লাহ। ‘

______________

মায়মুনা ফিরেছে পরদিন সকালে। আরও কদিন থাকবার ইচ্ছে থাকলেও পুত্রবধূর অসুস্থতার কথা শুনে ফিরে এলেন। এসেই স্বামীকে নিয়ে পুত্রবধূর হালচাল দেখতে চলে এলেন। সবাই তখন শোবার ঘরে বসা। সেসব পুত্রবধূর হাতে দিয়ে বললেন,
‘ এখন কেমন আছো, মা?’

জয়নাল আবেদীন সাহেব ভীষণ স্নেহ নিয়ে ডাকেন। মুশরাফার মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। এই মানুষটার ভালোবাসা একবারেই শুদ্ধ। সে শ্রদ্ধার হাসি টেনে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন, বাবা?’

কুশল বিনিময় হলো। মুশরাফা খাট থেকে ওঠতে নিয়ে বলল, ‘ বাবা বসুন। আপনার জন্য চা করি আনি।’

জয়নাল আবেদীন সাহেবের ভীষণ পছন্দ মুশরাফার হাতের চা। ব্যাপক ইচ্ছে থাকলেও নিষেধ করলেন। হেসে বললেন, ‘রোগীকে সেবা করতে হয়, সেবা নিতে হয়না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো তো! তারপর তোমার হাতের চা খাবো।’

জয়নাল আবেদীন পুরান ঢাকায় গিয়েছিলেন। আসবার সময় বাকেরখানি নিয়ে এসেছেন। প্যাকেটটা পুত্রবধূর হাতে দিয়ে বললেন, ‘বাকের খানি দেখেই তোমার কথা মনে পড়ল। ‘

মুশরাফা খুশিতে গদগদ হলো। সেই কবে একদিন চা খেতে বসে কথায় কথায় বলেছিল, চায়ের সাথে বাকেরখানি খেতে ভালো লাগে ওর। সে কথা মনে রেখেছেন এতদিন! শ্বশুরের এমন নির্মল ভালোবাসা কজনার ভাগ্যে থাকে! মুশরাফার ভাগ্যে আছে, বোধহয় বাবার ভালোবাসা পায়নি বলেই।

মায়মুনা মুশরাফাকে দেখে ছেলেকে বললেন, ‘ কোন ডাক্তার দেখিয়েছিস যে, এক সপ্তাহ হয়ে গেল এখনো জ্বর সারছে না?’

জাওয়াদ আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল, ‘ মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছে। কোর্স শেষ করতে বলেছেন। কোর্স পুরো শেষ, তবুও রোগ সারছেন। শরীর দুর্বল, রুচি নেই, মাথা ভার, বমি ও করছে মাঝে মাঝে। কী করা যায় বলো তো! আজ আরেকবার ডাক্তার কাছে নিয়ে যাব?’ জাওয়াদের চেহারায় রাজ্যের চিন্তা।

মায়মুনা অন্তর্ভেদী নজরে পরখ করলে পুত্রবধূকে। তারপর মৃদু হাসলেন। তার চোখে মুখে আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছে। ছেলেকে অভয় দিলেন, ‘ এমন হয় এক আধটু। ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।’

জাওয়াদের চোখে পড়ল না মায়ের পরিবর্তিত চেহারা। জয়নাল আবেদীন সাহেব কী বুঝলেন কে জানে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন,
‘ আমি আসি, মা? একটু বিশ্রাম নিব।’

মুশরাফা সায় জানাল। জয়নাল আবেদীন যেতে গিয়েও গেলেন না। মুশরাফার মাথায় হাত দিয়ে স্নেহের সুরে বললেন,
‘ অনেক দোয়া রইল তোমার জন্য। নিজের যত্ন নিও। কিছু দরকার হলে নির্দ্বিধায় বাবাকে বলো, কেমন?’

মুশরাফা এই কথার পেছনে জ্বরকে দায়ী করে বিশেষ গ্রাহ্য করল না। শ্বশুরের স্নেহে গা ভাসিয়ে বলল, ‘জ্বি, বাবা।’

জয়নাল আবেদীন চলে গেলেন। মায়মুনা গেলেন না, বসে রইলেন পুত্রবধূর পাশে। সুযোগের অপেক্ষায় বসে থেকে ছেলেকে বললেন, ‘যা ফল কেটে নিয়ে আয়! ‘

জাওয়াদ রুম থেকে বেরুবার পর পুত্রবধুর পাশ ঘেঁষে বসলেন। অনেকটা ফিসফিস করে কী যেন বললেন। কানে যেতেই চমকে তাকাল মুশরাফা। অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল। বাকরুদ্ধতায় কথা বলতে পারল না। খানিক বাদে আমতাআমতা করে বলল, ‘ ভাইরাস জ্বরের ও সিম্পটম এগুলো। তাই আমি ভেবেছিলাম… সত্যিই, মা?’

বউ শ্বাশুড়ি গোপন আলাপ হলো অনেকক্ষণ। উত্তেজনায় বুক কাঁপছে মুশরাফার। জাওয়াদ ফল এনে বলল, ‘কী আলাপ হচ্ছে?’

বউ শ্বাশুড়ি একে অপরের চোখাচোখি করল। মায়মুনা চোখের ইশারায় বললেন, ‘নিশ্চিত হলে, তুমি নিজেই বলো। আমি কিছু বলব না।’

কথা ঘুরালেন কোনমতে। জাওয়াদ মাকে বাসায় রেখে অফিসে গেল। হাফ টাইমে ফিরল। বিকেলে তারিফের বাসায় যেতে হবে কি না।

_____________

মুশরাফা থ্রি-পিস পরে সাদামাটাভাবে তৈরি হয়ে বসে আছে। আসর নামাজ পড়ে এলেই জিলবাব পরে বেরুবে। মায়মুনা এসেছেন পুত্রবধুকে দেখতে। মুশরাফাকে দেখে বললেন, ‘তোমরা না বেরুবে, রেডি হচ্ছো না?’
মুশরাফা ধীরে বলল,
‘আমি তো রেডি, উনি এলেই বেরুবো ইনশা আল্লাহ । আপনি আমার বিড়াল দুটোকে দেখে রাখবেন, মা! ‘ শেষ কথাটা অনুরোধের সুরে বলল মুশরাফা।
‘ বিড়ালের চিন্তা করো না। আমি আর জিহান দেখে রাখব। কিন্তু এভাবে যাবে ! ‘

‘হ্যাঁ। কেন খারাপ লাগছে?’ চিন্তিত মুখে নিজেকে পরখ করল মুশরাফা। মায়মুনা গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ বিয়ের পর বাবার বাড়ি যাবার সময় শাড়ি পরে যেতে হয়। শাড়ি পরে যাও।’
‘আমি তো ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছি। শাড়ি পরতে হবে! ‘
‘বাবা, ভাই একই কথা। শাড়ি পরে সেজেগুজে নতুন বউয়ের মতো যাবে। আমাদের বাড়ির বউ, দেখেই যেন বুঝা যায়।’

শ্বাশুড়ির কথায় মুশরাফা উঠে কাভার্ড খুলল। শাড়িতে চোখ বুলাতে গিয়ে বলল, ‘আপনি বলে দিন মা, কোনটা পরব?’

গোটা বিশেক শাড়ি দেখে ও মায়মুনার মনে ধরল না। আকস্মিক বললেন, ‘ আমার একটা শাড়ি দিলে, পরবে তুমি?’

মুশরাফা বিস্মিত চোখে তাকাল, ‘আপনার শাড়ি?’
‘হ্যাঁ। পরবে?’ মায়মুনাকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। মুশরাফা হেসে সায় জানাল, ‘অবশ্যই পরব।’

মায়মুনা দ্রুত পায়ে বাসায় গেলেন। কাভার্ড সিম্পল কাজের ডার্ক মেরুন ইন্ডিয়ান শাড়ি নিয়ে ফিরলেন। পুত্রবধুকে দেখিয়ে বললেন, ‘ এটা কেমন?’

মুশরাফা মুগ্ধ হলো। শাড়িটা চোখধাঁধানো সুন্দর। মুশরাফা বলল,’চমৎকার।’

‘ বিয়ের পর একটা ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম। সেবার এনেছিলাম। একদিন ও পরা হয়নি। একবারেই নতুন। পরতে সমস্যা হবে?’

‘না।’ মুশরাফা খুশিমনেই শাড়ি নিল পরতে। মায়মুনা দিলেন না। নিজেই পুত্রবধূকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। তারপর বাসা থেকে গহনার বক্স নিয়ে ফিরলেন। একটা জুয়েলারি বক্স ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘ এগুলো জাওয়াদের বউয়ের জন্য বানিয়ে রেখেছিলাম। বিয়ের পর তোমার সাথে সম্পর্কে ভালো ছিল না বলে দেয়া হয়নি। এখন নাও। ‘

মুশরাফা অবাক হয়ে তাকাল, ‘এসব কেন?’
মায়মুনা এক জোড়া বালা নিয়ে মুশরাফার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
‘ ছেলে বউদের গহনা দেয়া শ্বাশুড়িদের কর্তব্য। আমার শ্বাশুড়ি আমায় দিয়েছেন, আমি তোমায় দিচ্ছি। তুমি তোমার ছেলে বউকে দিবে। ‘

মায়মুনা টুকটাক গহনায় পুত্রবধূকে সাজালেন। তারপর লিপস্টিক, কাজল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি বিয়ের পর বাবার বাসায় যাবার সময় খুব সাজতাম। তুমি কী মেয়ে! শাড়ির সাথে এভাবে যাবে? একটু সাজো।’

সব শেষ করবার পর নিজেই মগ্ধভরে দেখলেন। এত সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! মাশা আল্লাহ।
তারপর বললেন, ‘ মাশা আল্লাহ! সুন্দর লাগছে। এইবার লাগছে আমাদের বাড়ির বউ। এখন কারো সাহস হবে না আমাদের বাড়ির বউয়ের রূপ কিংবা চালচলন নিয়ে কথা কথা বলার। ‘

জাওয়াদ ফিরে এলো তখন। মুশরাফাকে দেখে বিস্মিত হয়ে চাইল। মুগ্ধতা থেকে কথা বলতে পারল না, চোখ সরাতে পারল না।

মুশরাফা বলল,
‘এসবের কী দরকার মা!’

মায়মুনা ছেলেকে দেখে বললেন, ‘তোর বউকে বুঝা কেনো দরকার। আমি গেলাম।’

মুশরাফা ভাবুক স্বরে বলল, ‘মায়ের হলো টা কী হঠাৎ! এভাবে সাজিয়ে দিল। আরও কতগুলো জুয়েলারি দিয়ে গেছে। ‘

জাওয়াদ আনমনে হাসল। মায়ের এই সাজের কারণ তার অজানা নয়। আজ মুশরাফার ও বাসায় যাবার কারণ মুশরাফা না জানলেও মায়মুনা জানেন। জাওয়াদ মাকে বলেছে। সেসব মাথায় রেখেই পুত্রবধূকে সাজিয়ে দিয়েছে। যেমনই হোক বিয়ের পর পরিবারের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। এক আধটু না সাজলে হয়! তার উপর বিয়ের আগে মুশরাফার পোশাক নিয়ে, চালচলন নিয়ে ওদের আপত্তি ছিল। মায়মুনা চাইছেন, আজ তারা মুশরাফাকে চমৎকার রূপে দেখুক। বলুন, এই মেয়েটাকে তারা চালচুলোহীন বলেছেন! তার পস্তাক, কেউ যেন প্রশ্ন উঠাতে না পারে। তার ছেলে বউ! এত সহজ না কি!

জাওয়াদ মুশরাফার কাছে গেল। চার কুল পড়ে ফুঁ দিল মুশরাফার মাথায়। ঘোর নিয়ে বলল,
‘ মাশা আল্লাহ! আমার বউটাকে সুন্দর লাগছে। কারো নজর না লাগুক!’

_____________________

ওরা গিয়ে পৌঁছাল শেষ বিকেলে। তারিফ আজ নিচে আসেনি। চমক বাঁধিয়ে উপরে বসা। দরজা খুললেন ফারুকী! মুশরাফা বাবাকে দেখে চমকাল। সেই যে বিয়ের সময় দেখেছে, আর দেখেনি। কতকাল বাদে দেখছে বাবাকে। চোখ ভরে এলো জলে। অস্ফুট স্বরে বলল’ বাবা!’

তারপর জাওয়াদের দিকে তাকাল, যার অর্থ বাবা এখানে! জাওয়াদ হাসল। নিজে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম।
ধীরে মুশরাফাকে বলল, ‘বাবাকে সালাম দাও।’

মুশরাফার যেন অবাক হবার পালা। জাওয়াদের মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনে যারপরনাই অবাক হলো। জাওয়াদ ওর বাবাকে ‘বাবা’ ডাকছে! আদৌ সম্ভব! ওর বিস্ময় বাড়িয়ে ফারুকী ওর মাথায় হাত দিয়ে মৃদুস্বরে ডাকলেন,
‘রাফা, আয় ভেতরে আয়? ‘

মুশরাফা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। বাকরুদ্ধতায় কথা বলতে পারল না। এসব সত্যি! বাবা ওর সাথে কথা বলছেন!

চলবে….

গত পর্ব পড়ে সবাই না কি ভয় ডর পেয়ে বসে আছেন। তাই আজ আবেগী দৃশ্যপট তুলে ধরলাম না। আজ সুখবর সুখবর একটা পর্ব দিলাম। পড়ে খুশি হন। মিষ্টি তিষ্টি খাওয়ালেও খাওয়াতে পারেন।

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here