নিবেদন (পর্ব-৩৬)

#নিবেদন (পর্ব-৩৬)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

ঋতুতে অগ্রহায়ণ। আবহাওয়া শীতল। ভ্যাপসা গরমের পর আকস্মিক শীতল হয়ে এলো পরিবেশ।
আবহাওয়ার রদবদলে ঠান্ডা লেগে গেছে মুশরাফার। সকাল থেকে গা গরম লাগছে, সেই সাথে গলা ব্যাথা করছে। জাওয়াদের অফিস আছে। সেই তাগাদায় শরীর খারাপ মাড়িয়ে সকাল সকাল রান্নাঘরে ডুকেছে মুশরাফা। অসুস্থ শরীর নিয়েই একা হাতে রুটি-সবজি করেছে। লাঞ্চ রেডি করেছে। জাওয়াদ অফিসের জন্য তৈরি হয়ে এসে টেবিলে বসল। তাকে দেখাচ্ছে ভীষণ অন্যমনস্ক।

মুশরাফাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে কি না এই নিয়ে দোটানায় ভুগছে জাওয়াদ। অজানা একটা জড়তা, একরাশ দ্বিধা তখনো ওকে ঘিরে রেখেছে। দোটানায় থাকা মন কেবলই বলছিল, এক যুগের কষ্ট মাত্র কটাদিনের অনুতপ্ততায় শেষ! ক্ষমা এতই সহজলভ্য! কষ্ট এতই ক্ষীণ! দ্বিধান্বিত, উদাস চোখের খেয়াল হলো না স্ত্রীর লালচে মুখ। প্রতিদিন স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে নাস্তা করে, আজ তাও করল না। আনমনা হয়ে একটা রুটি খেয়ে উঠে গেল। প্রতিদিন বিদায়বেলা মুশরাফা ওকে এগিয়ে দিতে যায় দরজা অবধি। চৌকাঠ পেরুবার আগে জাওয়াদ স্ত্রীর কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘আসি? ফি আমানিল্লাহ। ‘
আজ সেটাও করল না। ফলে স্ত্রীর শরীরের উষ্ণতা পরিমাণ করতে পারল না। বেখেয়ালি মনেই চলে গেল। মুশরাফা কেবল জাওয়াদের উদাস চোয়াল পানে চেয়ে রইল। এক সময় দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল জাওয়াদ।

মুশরাফা দরজা লক করে বিছানা নিল। ভীষণ শীত অনুভব হচ্ছে। বোধকরি, জ্বর হানা দিয়েছে তার শরীরে। রুগ্ন, দুর্বল শরীর নিয়ে কখন ঘুমিয়ে গেল টেরটি পেল না। কাজের প্রেশার আর মানসিক চাপে জাওয়াদ দুপুরবেলা কল দিল না। মুশরাফার ঘুমে কাটল বেলা, জোহরটাও কাযা হলো। ঘুম ভাঙল বেলা তিনটায়। উঠে তড়িঘড়ি করে নামাজ আদায় করল। শরীরের যেন এক রত্তি শক্তি নেই। গা ব্যাথা বেড়েছে অনেকখানি। কাশি ও আসছে। অযু করবার পর হাঁচি ও শুরু হয়েছে।

মুশরাফাকে হাসপাতালে নেয়া না নেয়ার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে সন্ধ্যাবেলা ফিরল জাওয়াদ। মুশরাফা তখন চোখমুখ লাল করে, ১০২° ডিগ্রি জ্বর নিয়ে বিছানায় শোয়া। জাওয়াদ কলিংবেল বাজিয়ে সাড়া না পেয়ে ভ্রু কুঁচকাল জাওয়াদ। এক্সট্রা কী দিয়ে ঘরে ডুকে স্ত্রীকে বিছানায় পেল। চোখ মুখ লাল। কেঁদেছে না কি! জাওয়াদ তীর্যক চোখে চেয়ে আলগোছে ডাকল,

‘রাফা!’

মুশরাফা আধশোয়া হয়ে ছিল। জাওয়াদের কথায় নড়ে উঠল। চোখ মেলে জাওয়াদকে দেখে বিস্মিত স্বরে বলল,

‘আপনি কখন এলেন!’

জাওয়াদ উত্তর দিল না। টাইয়ের নাট ঢিলে করে বলল,
‘ তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। কী হয়েছে?’

উত্তরটা মুশরাফা কথায় নয়, হাঁচিতেই দিল। পরপর কয়েকটা হাঁচি দিল। মুশরাফা অসুস্থ এই সঙ্কেত পেয়ে জাওয়াদ উদ্ধিগ্ন হয়ে পাশে এসে বসল। কপালে হাত দিয়ে দেখল মুশরাফার শরীরের উষ্ণতা অস্বাভাবিক। জাওয়াদ হকচকিয়ে বলল,
‘ হুট করে জ্বর এলো কিভাবে? সকালে তো ভালোই ছিলে।’

মুশরাফা অভয় দিল, ‘ একটু জ্বর। ঠিক হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।’

জাওয়াদ কাভার্ড থেকে থার্মোমিটার বের করে আনল। মুশরাফার জিবের নিচে থার্মোমিটার দিয়ে বলল,
‘মেডিসিন নিয়েছো?’

মুখে থার্মোমিটার থাকায় কথা বলতে পারল না মুশরাফা। মাথা নাড়াল কেবল। জাওয়াদ আবার বলল,
‘লাঞ্চ করেছো?’
মুশরাফা মাথা নাড়াল। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করল, ‘মা আসেনি আজ?’

এবারও মাথা নাড়ল মুশরাফা। জাওয়াদের মনে পড়ল, মা বাবা কাল জেরিনের বাসায় গেছেন। জাওয়াদের কপট রাগ হলো নিজের উপর, রাফার উপর। লাঞ্চে ফোন না দেবার জন্য নিজের উপর আর নিজে ফোন দিয়ে না জানানোর জন্য রাফার উপর। রাফার মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করে জাওয়াদ জিজ্ঞেস করল,
‘শরীর খারাপ কখন থেকে?’
‘সকাল থেকে। ‘ দুর্বল গলায় ছোটো করে উত্তর দিল মুশরাফা।
‘ চমৎকার! ‘ তিরস্কার সুরে টেনে বলল জাওয়াদ।

জাওয়াদ থার্মোমিটারের স্ক্রিনের চোখ রেখে দেখল ১০২° শরীরের তাপমাত্রা। চিন্তার পাশে রাগের রেখা দেখা গেল জাওয়াদের মাঝে। সেই রাগ বাড়ল যখন ওষুধ বক্স খুঁজে দেখল বাসায় নাপা, প্যারাসিটামল কিছুই নেই। ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ সকাল থেকে, এর মানে আমি যাবার আগে থেকে, তাই তো?’

মুশরাফা ইতিবাচক উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’ জাওয়াদ ধমকে উঠল, ‘একটাবার বলেছো আমায়? সারাবেলা কেটে গেছে, এখন এসে বলতেছে, সকাল থেকে শরীর খারাপ! জানাও নি কেন?’

জাওয়াদ ভালোই রেগে গেছে সে আন্দাজ করে ফেলেছে মুশরাফা। জানায়নি বলে কী রাগ! এই রাগটা সুন্দর! তেতো মুখে স্মিত হাসল মুশরাফা। বলল,

‘ বউয়ের জ্বর দেখলে কি আপনি অফিস মিস দিয়ে বউয়ের সেবা করতেন?’

এই অসময়ে মুশরাফার মশকরায় রাগ বাড়ল জাওয়াদের। রেগেমেগে বলল,
‘ ডোন্ট বি ফান! অসুস্থতা নিয়ে একদম হেয়ালি করবে না। ‘ জাওয়াদের রাগ দেখা হয়না অনেকদিন। এই ক্ষণে জাওয়াদকে বিয়ের পরের সেই জাওয়াদের মতো ঠেকল মুশরাফার।

জ্বর বাঁধিয়ে এখন মজা করছে! রাগে বিড়বিড় করতে করতে হনহন করে বেরিয়ে গেল জাওয়াদ। সদর দরজার আওয়াজ হলো। রাগ উড়াল যেন দরজায়। সেই শব্দ মুশরাফা আন্দাজ করল, জাওয়াদ মেডিসিন আনতে বেরিয়ে গেছে। ফিরল মিনিট বিশেকের মাথায়। মেডিসিন আর ফ্রুটস নিয়ে। ফ্রুটস টেবিলে রাখল। কিচেন থেকে এক প্লেট ভাত নিয়ে গেল বেডরুমে। বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে বলল,

‘ আপনার তথাকথিত ‘একটু জ্বর’ কমানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে থাকলে ভাত খেয়ে নিন। মেডিসিন নিতে হবে। ‘

মুশরাফা আশাভরা চোখে তাকাল জাওয়াদের দিকে। উঠে বসে খেতে ইচ্ছে করছে না ওর। শরীর এত দুর্বল লাগছে! মাথা ভারি হয়ে আছে। বালিশ থেকে মাথা তুলতেই ঘুরে উঠছে। ওর চাহনি পরখ করল জাওয়াদ। কাভার্ডের দিকে যেতে যেতে বলল,
‘ আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, আমি খাইতে দিব না। সারাদিনে আমার হেল্প লাগেনি যেহেতু এখনো লাগবে না। আজকাল আপনি নিজের জীবন, রোগশোক চমৎকারভাবে সামলানো শিখে গেছে। এটাও করতে পারবেন।’

কাভার্ড থেকে ট্রাউজার, টি-শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল জাওয়াদ। মুশরাফা বিরস মুখে প্লেট হাতে নিয়ে বসল। জাওয়াদ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল মুশরাফা বিরস মুখে প্লেটে হাত দিয়ে বসে আছে। প্লেটে ভাতে এখনো ভরতি। দুই এক লোকমা খেয়েছে বোধহয়। জাওয়াদ এসে বিরক্তমাখা সুরে বলল,
‘ কী সমস্যা?’

মুশরাফা হাঁচি দিতে দিতে জবাব দিল, ‘ তেতো লাগছে। খেতে পারছি না।’

জাওয়াদ চাপা শ্বাস ফেলে মুশরাফার সামনে বসল। টিস্যুর বক্স থেকে টিস্যু তুলে হাতে দিল। আলতো সুরে বলল,
‘এভাবে উপোস থাকলে হবে? মেডিসিন নিতে হবে না?’
মুশরাফা টিস্যু নিল কেবল। জাওয়াদ নিজের রাগ জেদ, প্রতিশ্রুতির প্রাচীর ভেঙে দিয়ে খাবার প্লেট হাতে নিল। এক লোকমা ভাত নিয়ে মুশরাফার মুখে সামনে ধরে কোমল সুরে বলল,
‘ একটু জোর করে খাওয়ার চেষ্টা করো। মেডিসিন নিলে দেখবে বেটার ফিল করবে।’

মুখে টিস্যু চেপে হাসল মুশরাফা। একটু আগে না খাইয়ে দিবে না বলে চলে গেল, এখন আবার এসে নিজেই খাইয়ে দেবার পায়তারা করছে! অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাত মুখে নিল সে। তেতো মুখে বিস্বাদ লাগল। পেট পাকিয়ে বমি আসতে চাইল। কোনমতে গিলল কেবল। দ্বিতীয় লোকমা দিতে গেলেও মুশরাফা নিষেধ করল,
‘ আর খেতে পারব না। বমি হয়ে যাবে।’
‘বমি হবে ভাবলে হবেই। মাইন্ড ডাইভার্ট করো। দেখবে বমি হবে না। জাস্ট কয়েক গ্রাস নাও। প্লিজ!’

তারপর কথায় মনোযোগ ঘুরিয়ে খাইয়ে দিল। মেডিসিন দিয়ে গেল কিচেনে। চা, আর গরম পানি খাওয়াতে বলেছে ডাক্তার। নাজমুল সাহেবের ফোনটা এলো সেই ক্ষণে। তুলতেই বিরসমুখে বললেন,
‘তুমি এলে না জাওয়াদ! এত কঠোর হতে পারল? কম তো হলো। তুমি যেমন চেয়েছো তেমন নিবেদন পেয়েছো, তাও ইগো ধরে বসে আছো! আমার বোনটা রাফা রাফা করে আর্তনাদ করছে। একটু দয়া করতে ও তো পারো!’

লাগাতার কথা বলে থামলেন নাজমুল সাহেব। তার স্বর বলে দিল এই পর্যায়ে জাওয়াদের কাজে তিনি বেজায় নারাজ। জাওয়াদ চুলোয় পানি বসিয়ে ধীর স্বরে কেবল একটা কথা বলল,
‘রাফা অসুস্থ, মামা!’

‘ সকালে ও তো কথা হলো। ভালোই ঠেকল। কী হলো এটুকু সময়ে?’ অবিশ্বাস্য সুরে বললেন নাজমুল সাহেব। তার অবচেতন মনের সন্দেহ, এটা জাওয়াদের না যাওয়ার বাহানা নয় তো? কিন্তু জাওয়াদ তো ওমন চল-চাতুরী স্বভাবের নয়।

জাওয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘অফিস থেকে ফিরে দেখি জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছে। ১০২°জ্বর, হাঁচি কাশি সব মিলে একাকার। ‘
থেমে বলল, ‘এখন তো মেয়েটা অসুস্থ, ওকে জানানো ঠিক হবে না। নিতে পারবে না। ও সুস্থ হোক। তারপর যাওয়া নিয়ে ভাবব। ‘

না বললেও নাজমুল সাহেবের সন্দেহ জাওয়াদ আঁচ করতে পারল। বেডরুমের গিয়ে মুশরাফার সাথে কথা বলিয়ে দিল। নাজমুল সাহেব ভাগ্নের স্বর শুনে উদ্ধিগ্ন হলে, ঘটনার সত্যতা পেলেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। আসতে চাইলেন সেই ক্ষণে। জাওয়াদ নিষেধ করল।

____

চা বানাতে গিয়ে হলো আরেক বিপত্তি। লবঙ্গ, ফ্লাস্ক, আদা, এলাচি কিছুই পাচ্ছে না জাওয়াদ। বার বার এসে জিজ্ঞেস করছে, রাফা আসা কোথায় রেখেছো? ফ্লাস্কটা কোন কেবিনেটে? লবঙ্গ কোন বক্সে? গোলমরিচ কোথায়? মুশরাফা কিচেনে যেতে চাইল। জাওয়াদ কড়া আদেশ দিল, বেড থেকে নড়া যাবে না। অগত্যা শুয়ে শুয়ে দেখল জাওয়াদের উদ্ধিগ্নতা, স্ত্রীর সেবা। অনন্যচিত্তে গরম পানি, চা করে আনল। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘চা টা খাও, ঠান্ডা ভাব কম লাগবে।’

মুশরাশা চুমুক দিল কাপে। বিড়াল বাচ্চা দুটো ডেকে উঠেছে। ক্ষিধে টিধে পেয়েছে বোধহয়। জাওয়াদ তাদের ও খেতে দিল। মুশরাফা বলল, ‘এবার আপনি ও খেয়ে নিন!’

জাওয়াদ মুশরাফার এঁটো প্লেটেই খেতে বসল। আকস্মিক মুশরাফার কাশি বাড়ল। লাগাতার কাশছে। কাশতে কাশতে প্রাণ বেরিয়ে আসছে যেন। জাওয়াদ খাওয়া ছেড়ে দ্রুত কাছে গেল। পিঠে, মাথায় হাত বুলাল। চোখ মুখ মেঘে ঢেকে গেছে। মনে মনে রবের নাম ঝপতেছে! কমিয়ে দাও অসুখটা। গায়ে হাত দিয়ে দেখল, গা পুড়ে যাচ্ছে। জ্বর কি আরও বেড়ে গেছে? এবার কত হলো? ১০৪°! জাওয়াদ পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ লাঞ্চের পর মেডিসিন নিলে এতটা বাড়তো না। উপোস পেটে সারাদিন শুয়ে থাকায় বেশি ঝেঁকে ধরেছো। এখন কী হলো দেখেছো!’

অনেকক্ষণ বাদে মুশরাফার কাশি কমল। পানি খেয়ে শান্ত হয়ে শুলো। জাওয়াদ স্পঞ্জ করল। মাথায় জলপট্টি দিল। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। জাওয়াদ নড়ল না, ঘুমাল না। স্ত্রীর শিওরে বসে একনিষ্ঠ চিত্তে স্ত্রী সেবা করল জাওয়াদ। রাতের খাওয়াটাও হলো না।
মধ্যরাতে জ্বর ছাড়ল মুশরাফার। দরদর করে ঘামতে শুরু করল। গা থেকে কমফোর্টার ফেলে দিল, নড়ে উঠল। চোখ মেলে ড্রিম লাইটের আলোয় দেখল ওর শিওরে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে জাওয়াদ। টেবিলে আধখাওয়া ভাতের প্লেট। স্ত্রীসেবায় খাওয়াও হয়নি লোকটার। ঘাড় বাকিয়ে ঘুমাচ্ছে, এভাবে ঘুমানোর ফলে ঘাড়ে ব্যাথা করবে। মুশরাফা আলতো স্বরে ডাকল,
‘ এ্যাই! উঠুন! ঠিক করে শুয়ে পড়ুন। ঘাড়ে ব্যাথা করবে তো!’

জাওয়াদের ঘুম ছুটল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে রাফা? খারাপ লাগছে? জ্বর বেড়েছে? দেখি!’ বলে চটজলদি কপালে হাত দিয়ে চেক করল। স্বাভাবিক তারমাত্রা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,
‘উঠে গেলে যে!’
‘ ঘুম ভেঙে গেল। আপনি সোজা হয়ে শোন।’
বলে উঠতে নিল। জাওয়াদ আবার জিজ্ঞেস করল,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
‘এশার নামাজ পড়া হয়নি। নামাজটা পড়ে আসি।’

জাওয়াদ ও উঠে বসল, ‘আমারও নামাজ পড়া হয়নি।’

অতঃপর অযু করে এসে নামাজে দুজন। নামাজ শেষ করে সালাম ফেরাতেই জাওয়াদ মুশরাফার কপালে হাত দিয়ে জ্বর চেক করল। হালকা গরম লাগছে গা। আবার জ্বর আসছে। জাওয়ার দোয়া পড়ে ফুঁ দিল। জাওয়াদের উদ্ধিগ্নতায় মুশরাফা হাসল। জাওয়াদের কাধ ঘেঁষে বসল। ভারি মাথাটা রাখল জাওয়াদের কাধে। বলল,
‘ জ্বর হলে আমার ভীষণ খুশি লাগে, জানেন?’

জাওয়াদ প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে তাকাল। বাঁকা স্বরে বলল, ‘আমাকে চিন্তায় রাখতে বরাবরই তোমার আনন্দ!’

মুশরাফা দুর্বল মুখে হাসল, ‘ কিছু চিন্তা দেখতে ভীষণ সুন্দর, উপভোগ্য। তবে এর বাইরে আরেকটা কারণ আছে।’

‘কী সেটা?’
‘জ্বর আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা নেয়ামত বলা যায়। ‘ ধীরে বলল মুশরাফা। জাওয়াদ বুঝল না। বলল,
‘কিভাবে?’

মুশরাফা দুর্বল স্বরে হাদিস শুনাল,

আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর অসুস্থ অবস্থায় তাঁর কাছে গেলাম। এ সময় তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমি বললামঃ নিশ্চয়ই আপনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত। আমি এও বললাম যে, এটা এজন্য যে, আপনার জন্য দ্বিগুণ সাওয়াব। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। যে কেউ রোগাক্রান্ত হয়, তাথেকে গুনাহসমূহ এভাবে ঝরে যায়, যেভাবে গাছ হতে তার পাতাগুলো ঝরে যায়। [সহিহ বুখারী]

জ্বর হলে সব গুনাহ ঝরে যায়, এটাকে নেয়ামত বলা যাবে না?’

জাওয়াদ আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘ জ্বর হলে সব গুনাহ ঝরে যায়!’

মুশরাফা সায় জানাল, ‘হ্যাঁ। হাদিসে এসেছে,
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে বলেনঃ তিনি এক রোগীকে দেখতে যান, যে জ্বরের কারণে অসুস্থ ছিল, -আবু হুরায়রা ছিলেন তার সাথে- রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বলেনঃ “সুসংবাদ গ্রহণ কর, আল্লাহ বলেনঃ আমার আগুন [১] দুনিয়াতে আমি আমার মুমিন বান্দার ওপর প্রবল করি, যেন তা আখেরাতের আগুনের বিনিময় হয়ে যায়”। [আহমদ, ইব্‌ন মাজাহ ও তিরমিযি]

ফুটনোটঃ
[১] অর্থাৎ জ্বরটি হচ্ছে একটি আগুন, যার মাধ্যমে মুমিন বান্দার আখেরাতের গোনাহের বিনিময় হয়ে যায়। ‘

জাওয়াদ তাসবীহ গুনতে গুনতে শুনছিল স্ত্রীর কথা। এ পর্যায়ে এসে মুখ খুলল। অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
‘ আমি আজ প্রথম শুনলাম। আমি তো জ্বর হলে ভীষণ বিরক্ত হই। আগে তো জ্বরকে গালমন্দ ও করতাম।’

মুশরাফার কাশি শুরু হলো। জাওয়াদ ফ্লাস্ক থেকে গরম পানি একটা কাপে ঢেলে লবন মিশিয়ে আনল। ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘গর্গল করো, কফ কমে গেলে কাশি কমে যাবে।’

মুশরাফা কাপ তুলে নিল। কিঞ্চিৎ ঠান্ডা হবার অপেক্ষায় রইল। তারপর বলল, ‘জ্বরকে গালি দিতে নেই।

আবূ হুরায়রাহ (রাঃ), থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সামনে জ্বরের বিষয় উল্লিখিত হলে এক ব্যক্তি জ্বরকে গালি দেয়। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ জ্বরকে গালি দিও না। কেননা তা পাপসমূহ দূর করে, যেমন আগুন লোহার ময়লা দূর করে। ‘

থামল মুশরাফা। তারপর বলল, ‘যখনই আমার জ্বর হয়, তখন আমি ভাবী আমার সব গুনাহ ঝরে যাচ্ছে। আমার ভীষণ আনন্দ লাগে। ‘ মুশরাফাকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। জাওয়াদ বলল,
‘জ্বর ও নেয়ামত! ব্যাপারটা সুন্দর, চমৎকার। সুবহানাল্লাহ। কিন্তু নিজ ইচ্ছায় জ্বর এনে নিজের শরীরকে কষ্ট দেয়া গুনাহ। ‘
‘আমি নিজের ইচ্ছায় আনিনি।’
‘নিজের শরীরের যত্ন নাও তবে।’

মুশরাফা বেসিনে গিয়ে গর্গল করে এলো। তারপর খাটে এসে বসল। জাওয়াদ আবার জায়নামাজে দাঁড়িয়ে আছে। স্ত্রীর সুস্থতা কামনায় দুই রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ছে বোধহয়।

মুশরাফা উদাস চোখে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রইল। জাওয়াদ নামাজ শেষ করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছো?’
‘একটা কথা মাথায় আসছে আমার। ‘
‘কী?’
‘ এখন আমার জ্বর। আল্লাহ চাইলে আমার যত গুনাহ আছে সব ঝরে যাচ্ছে বা গেছে। ধরুন এখন আমার মৃত্যু হলো, তবে তো আমি নেককার অবস্থায় মারা যাব। ব্যাপারটা কী সৌভাগ্যের হবে তাই না?’
আনমনে বলে গেল মুশরাফা।

জাওয়াদ জায়নামাজ ভাজ করছিল। মুশরাফার কথা থেমে গেল। চমকে তাকাল মুশরাফার দিকে। ওর বুক কেঁপে উঠল, গায়ের শিরদাঁড়া উঁচিয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল, ‘ হঠাৎ মৃত্যুর কথা বলছো কেন?’

মুশরাফা দায়সারা জবাব দিল, ‘মৃত্যুর তো কোন নিশ্চয়তা নেই। হুটহাট যখনতখন এসে হানা দেয়। এমনি মাথায় এলো কথাটা।’

জাওয়াদ রেগে গেল, ‘নিজের বা কারো মৃত্যু কামনা করা মহাপাপ, জানো না? মৃত্যু কামনা করছো কেন!’
‘কামনা করি না, জাস্ট কথার কথা বললাম। ‘

‘কথার কথাও বলবে না আর কখনো।’ ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল জাওয়াদ। জ্বরে বুদ্ধিশুদ্ধি চলে গেছে এই মেয়ের। কী সব বলছে! জাওয়াদ জায়নামাজ ভাজ করতে গিয়ে পারল না, এলোমেলো মনে কিছু গুছানো যায় না। ওর বুক কাঁপছে তখনো। জায়নামাজ রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে উদ্ভ্রান্তের মতো ফিরে এলো। মুশরাফার পাশে বসে ওকে বুকে টানল। মাথাটা বুকে চেপে, মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলল,
‘তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও, তোমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সারপ্রাইজটা তোমার অপেক্ষা করছে। ‘
‘কী সেটা!’
‘ হ্যাপিনেস, ফুলনেস।’
মুশরাফা মাথা তুলে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইল। বিপরীতে জাওয়ার চমৎকার হাসল। বলল,
‘শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এত বেশি দিবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে। ‘

মুশরাফা শুনলেও বুঝল না। ধারণা করতে পারল না সামনে ওর জন্য কত বড়ো চমক অপেক্ষা করছে।

চলবে…

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here