নিস্তব্ধ_বিকেলে_তুমি 🖤,পর্ব- ১

#নিস্তব্ধ_বিকেলে_তুমি 🖤,পর্ব- ১
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)

প্রাক্তন প্রেমিকার হলুদের অনুষ্টানে, তার হাত ধরে হিচড়ে টেনে স্টোর রুমে নিয়ে আসে ইরাদ। ইরাদের প্রাক্তন প্রেমিকা আরোহী, ইরাদের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর প্রয়াস করতে থাকে, কিন্তু সে ব্যর্থ। আরোহী দাঁতে দাঁতে চেপে বলে, ‘ কি করছেন ইরাদ? কিছুক্ষন পর নিহানসহ সকলে চলে আসবে। আপনার সাথে এইরকম অন্ধকার ঘরে কেউ দেখে ফেললে, কেলেংকারী হয়ে যাবে। ছাড়ুন বলছি। ‘
ইরাদ কেমন অদ্ভুদ দৃষ্টিতে আরোহীর মুখশ্রীর দিকে তাঁকালো। রমনীর গোলাপী ঠোটজোড়া কেমন করে যেন কাঁপছে। নেত্রপল্লবে টলমলে জল। ইরাদের বেশ
ভালো লাগলো। মেয়েটাকে কাঁদলে বেশ সুন্দর লাগে, তাইতো মেয়েটাকে সর্বদা কষ্ট দিয়ে কাঁদায় সে। ইরাদ আরোহীর গালে হাত রেখে নিজের ঠোটজোড়া এগিয়ে নিয়ে আসতে চাইলে, আরোহী সর্বশক্তি দিয়ে ইরাদকে ধাক্কা দিয়ে, নিজের থেকে সরিয়ে নিলো। চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘ আমার কাছে আসার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবেন না আপনি। নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। ‘
ইরাদ তৎক্ষনাৎ আরোহীর গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

‘ ইরাদ আবরারের সঙ্গে মোটেও উচ্চস্বরে কথা বলবে না মেয়ে, নাহলে ইউ নো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ‘

আরোহী দ্বিগুন চিৎকার করে বলে, ‘ আপনার থেকে কেউ খারাপ হতেও পারবে না ইরাদ। আপনি খুব জঘন্য একজন লোক। ‘

ইরাদ আরোহীর অধরে আঙ্গুল রেখে ধীর গলায় বলে,’ হুসস! ডোন্ট সাউট! তোমার চিৎকারে, সকলে এখানে জড়ো হয়ে গেলে এবং তোমাকে আমাকে এমন একটা অন্ধকারে রুমে দেখলে কি হবে বুঝতে পারছো? তোমার বিয়েতে তো ভেঙ্গে যাবেই, তার সঙ্গে সঙ্গে তোমার পরিবারের সব সম্মান ও শেষ হয়ে যাবে। ‘

ইরাদের মজার ছলে বলা কথাগুলো তীরের ন্যায় বুকে গিয়ে বিধলো আরোহীর। সে স্হীর হয়ে নিষ্চুপ হয়ে গেলো। ইরাদ পুনরায় শুধালো,

‘ তাছাড়া বেচারা নিহান বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার কষ্টে দেবদাসের মতো ঘুড়ে বেড়াবে। আমার বেশ কষ্টও লাগবে। যতই হোক আমার নিজের ফুপাতো ভাই বলে কথা।’

টলমলে আখিজোড়া নিয়ে ইরাদের দিকে তাঁকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো আরোহী, ‘ আমার থেকে এখন কি চাইছেন আপনি? ‘

ইরাদ আরোহীর সামনাসামনা একটি চেয়ার টেনে বসে পরে বললো, ‘ কান্না আটকে রেখেছো কেন? কাঁদো ভালো করে কাঁদো। তোমার কান্না দেখলে আমার পরাণ জুড়ায়। ভালো লাগে। অদ্ভুদ ভালো লাগা যাকে বলে। ‘

ইরাদের কথা শুনে আরোহী অবাক না হয়ে পারলো না। এই অসীম নিষ্ঠুর মানুষটাকে সে ভালোবাসে ভাবতেই, তার কষ্টে বুক ভারি হয়ে আসে। তার কষ্ট, কান্না মানুষটাকে সুখ দেয়? এতোটা পাষাণ মানুষ ইরাদ। ‘

আরোহী উপরের সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকালো।ছোট্ট রুমটার পাংখা বেশ সময় নিয়ে ঘুড়েই চলেছে, অথচ বাতাস তেমন দিতে পারছে না। অনেকদিন ধরে রুমটার ফ্যান কেউ ছাড়ে না, তাই ধুলো দিয়ে জমে গিয়ে বিচ্ছিরি অবস্হা! আরোহীকে স্হীর থাকতে দেখে ইরাদের বিরক্ত লাগলো। যথেষ্ট গরম পরেছে। মেয়েটা এমন অবাধ্য কেন? ইরাদ ফের বললো, ‘ কি হলো কাঁদছো না কেন? কালকে বিদায়ের সময় তো কাঁদতেই হবে। এখন ভালো করে কেঁদে প্রেক্টিস করে নাও। কান্না করার সময় মুখের এক্সেপেরেশন তো ঠিক রাখতে হবে, নাহলে ছবি বাজে উঠবে। যদি ছবিতে পেত্নির মতো লাগে তোমাকে তখন? তাই এখুনি ভালো করে প্রেক্টিস করে নাও। জলদি ফাস্ট! একটু পরেই হলুদের অনুষ্টান শুরু হয়ে যাবে।’

আরোহী তার সামনে থাকা নিষ্ঠুর মানুষটার অদ্ভুদ কথা শুনে হুড়মুড়িয়ে কেঁদে ফেললো। ইরাদ দেখলো। বসে থাকলো। উঠে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়ালো না। শুধু আরোহীর নিশব্দ কান্নার শব্দগুলো ভেতরে ভেতরে বেশ উপলব্ধি করলো। ইরাদ সম্পর্কে
আরোহীর দুসম্পর্কের খালাতো ভাই হয়। আরোহীর মা এবং ইরাদের মা পরস্পরের চাচাতো বোন হলেও, তাদের মাঝে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, আপন বোনের ন্যায়। ইরাদ বর্তমানে বুয়েট নিয়ে পড়াশোনা করছে। আরোহী অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। ইরাদ ছোটবেলা থেকেই যথেষ্ট দাপটের সাথে থেকেছে।তার বুয়েটের ইইন্সটিটিউটে সিনিয়র থেকে জুনিয়র মেয়েরা সকলেই তার জন্যে পাগল। সেও কোনপ্রকার সুযোগ হাতছাড়া করে না। মাসে মাসে জিএফ চেঞ্জ করা যেন তার কাছে ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালোবাসা নামক সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার গুলো তার কাছে শুধু টাইম পাস মনে হয়। ছোটবেলা থেকেই আরোহী ইরাদকে পছন্দ করতো, সে ভালোলাগা একসময়ে ভালোবাসার চাদরে আবৃত হয়ে যায়। সে যখন ইরাদকে নিজ থেকে নিজের পছন্দের কথা জানায়, তখন ইরাদও তাকে ফিরিয়ে দেয় নি। যদিও তখন ইরাদের দুজন জিএফ ছিলো বটে। ইরাদ জানে তারা শুধুমাত্র ইরাদের টাকা-পয়সা এবং ভালো ফিউচারের জন্যে তার সাথে রিলেশনে গিয়েছে, আর কিছুই নয়। তাই ইরাদ ব্রেকাপ করে ফেললেও তখন তাদের কিছু করার থাকতো না, শুধু আফসোস টুকু করা ছাড়া, কিন্তু আরোহী? সে মনপ্রান দিয়ে ভালোবাসতো ইরাদকে। ইরাদের এমন অভ্যাসের সম্পর্কে যদিও অজ্ঞাত ছিলো আরোহী। ইরাদ চরিত্র বাড়িতে একরকম, বাইরে গেলে আরেকরকম। ভিন্ন দুই ধর্মী যেন মানুষের অস্বিত্ব রয়েছে তার দেহে। ইরাদের সাথে ভার্সিটির ফাকি দিয়ে ঘুড়তে যাওয়া, তার সাথে ছোট খাটো সব কথা শেয়ার করা আরোহীর জীবনকে অন্যরকম সুখের সাগরে নিয়ে গিয়েছিলো।যদিও ইরাদ ছিলো যথেষ্ট দায়িত্বহীন ছেলে। সময়ের সাথে সাথে ইরাদ বেশ বদলেও যায়। আরোহী যখন তাকে দেখার জন্যে একপলক তার বাড়িতে যেতো কিংবা ইরাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইতো, তাহলে সে নানা কাজের বাহানায় আরোহীকে এড়িয়ে, নিজের অন্য জিএফদের সঙ্গে সময় কাটাতো। আরোহী কতদিন অপেক্ষা করেছে ইরাদের জন্যে রাত জেগে, হয়তো ইরাদ তাকে ফোন করবে, সারাদিনের সকল জমে থাকা কথা সে ইরাদকে বলবে, কিন্তু ইরাদ তাকে হতাশ করতো। আরোহী নামক রমনীর কষ্ট হতো। বুক ফেটে কান্না আসতো। ইরাদ সামনে আসলে, সেই অভিমান নিয়ে কেঁদেও ফেলতো। ইরাদ সেই অভিমান আদোও বুঝত? উহু না! সে তো আরোহীর কান্না মনোযোগ নিয়ে দেখতো। ভালো লাগা কাজ করতো অদ্ভুদ্ভাবে।

‘ এই মেয়ে যথেষ্ট কান্না করেছো, এইবার থামো, নাহলে ম্যাকাপ নষ্ট হলে তোমাকে ভুতের মতো লাগবে। তখন আমার ভাই দৌড়ে পালাবে।’

ইরাদের কথায় চুপ হয়ে পরে আরোহী, কিন্তু ফুপানির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। ইরাদ আরোহীর ললাটের মাঝের অংশের টিপখানা যত্নসহকারে ঠিক করে দিলো। আরোহী শুধু চেয়ে রইলো।

‘ বাঁকা টিপ পরলেও বুঝি মেয়েদের সুন্দর লাগে। তোমাকে দেখে বুঝলাম। ‘

‘ আমাকে সুন্দরও লাগে? ‘

‘ সুন্দর তো বটেই, অদ্ভুদ সুন্দর। চাঁদের মতো সুন্দর। যেই চাঁদের সৌন্দর্যে কোন কলঙ্ক নেই।

‘ সেই চাঁদকে বুঝি শুধু কষ্ট দেওয়া যায়? ‘

‘ হু! সেই চাঁদকে কষ্ট দেওয়া যায়। সেই কষ্টের মাঝে তৃপ্তি রয়েছে, কিন্তু……’

‘ কিন্তু কি? ‘

‘ সেই চাঁদখানাকে শুধু কষ্ট দেওয়া যায়, পাওয়ার সাধ্যি থাকে না। ‘

ইরাদের শেষের কথাটুকু বুঝতে পারলো না আরোহী। বরবরের মতো অবুঝের ন্যায় চেয়ে রইলো। ইরাদ তা দেখে ক্ষীন্ন হাসলো। কিছু মুহুর্ত পেরিয়ে গেলো। আরোহী বেশ অস্বস্হী নিয়ে বললো, ‘ এতোক্ষনে বুঝি উনারা চলে এসেছে। আমাকে খুঁজবে সবাই। আমি বরং স্টেজের দিকে যাই। নিহান আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ‘

‘ নিহান আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ‘ কথাটি শুনে ইরাদের বুকে অজানা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো। সে কোনরুপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

আরোহী চলে আসতেই, তার বান্ধুবিগণ তাকে স্টেজে বসিয়ে দিলো। নিহান এবং বাকি বরপক্ষ ও চলে এসেছে আরোহীকে হলুদ ছোঁয়াতে। আজ আরোহীর হলুদ সন্ধ্যা। সকলে চোখ যাচ্ছে, আরহীর দিকে । হলুদ শাড়িতে বেশ মানিয়েছে তাকে।
হলদে ফর্সা মুখখানায় আলাদা মায়া রয়েছে। নিহান গালে হাত দিয়ে আরোহীকে পর্যবেক্ষন করে যাচ্ছে।যদিও এতে আরোহীর অস্বস্হী লাগছে, তবুও সে নিরব। নিহান বাদেও আরেকজন দূর থেকে আরোহীকে পর্যবেক্ষন করে যাচ্ছে,সে আর কেউ না বরং ইরাদ। আলাদা এক রাগ উঠছে নিহানের প্রতি। নিজের আখিজোড়া দিয়ে যেন আরোহীকে গিলে খাচ্ছে, মেয়েটাও কেমন অস্বস্হি নিয়ে বসে রয়েছে, কিছু বলছে না কেন?

আরোহীকে দেখে, ইরাদের মায়ের আফসোসের শেষ নেই। খুব শখ করেছিলেন নিজের ছেলের বউ করবেন, কিন্তু ইরাদের একই কথা, ক্যারিয়ারের এমন এক জায়গায় এসে বিয়ে করে, ক্যারিয়ার নষ্ট করতে পারবে না সে। ছেলেকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেন নি তিনি, তাইতো নিজের নন্দের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন। আরোহীর জন্যে যখন নিহানের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে, তখন আরোহী প্রায় দৌড়ে ইরাদের রুমে এসে সেদিন বলেছিলো, ‘ দেখুন না ইরাদ, আমার জন্যে নিহান ভাইদের বাড়ি থেকে সমন্ধ এসেছে। বাবা বোধহয় রাজি। ‘

ইরাদ নিজের গাঁয়ে পারফিউম ছিটিয়ে বলতে থাকে, ‘ তো কি হয়েছে? বিয়ে করে নাও।’

ইরাদের কথা শুনে একপ্রকারের জন্যে স্তব্ধ হয়ে পরলো। ক্ষিপ্ত হয়ে ইরাদের কলার ধরে বলে,

‘ বিয়ে করে নাও মানে? আমরা তো একে-অপরকে ভালোবাসি তাইনা? আপনি এখুনি নিচে গিয়ে সবাইকে বলে দিন, আমরা একে-অপরকে ভালোবাসি। বিয়েটা এখুনি ভেঙ্গে দেন। ‘

আরোহী ইরাদের হাত ধরে নীচে যেতে চাইলে, ইরাদ আরোহীর হাত ছাড়িয়ে বলে, ‘ পাগল হয়েছো তুমি?
রিলেশন চলে যাওয়া মানেই ভালোবাসা নয় বুঝলে? বড়’রা যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই অনুযায়ীই তুমি চলো। আমাকে বিরক্ত করবে না। ‘

আরোহীর হাত ছাড়িয়ে, ইরাদ ফোনে কথা বলতে বলতে চলে যায়। আরোহীর নেত্রপল্লবে নেই অশ্রু, সেই কেমন অবুঝের মতো মেঝেতে বসে থাকে। স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। কান্না আসছে না তার, কিন্তু কাঁদলো না সে। অনুভুতিশূন্য হয়ে থাকলো শুধু। অনেক আশা -ভরসা নিয়ে সে ইরাদের কাছে ছুটে এসেছিলো। সব যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো।
অত:পর উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে করতে সকলকে জানিয়ে দিলো, সে বিয়েতে রাজি। অত:পর ছাদে গিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। যাকে মনপ্রান দিয়ে ভালোবাসলো, সে তাকে ধোঁকা দিলো, তার অসহায়ত্বের সময় তাকে একা ফেলে চলে গেলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় আরোহী।

অতীত থেকে ফিরে এসে, আরোহী দেখতে পায়, তার কিছু কাজিন মিলে একপ্রকার জোড় করে ইরাদকে, আরোহীকে হলুদ ছোঁয়ানোর জন্যে নিয়ে আসছে। ইরাদ আরোহীর সামনে দাঁড়িয়ে…

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here